Friday 17 July 2020

ইতালি ভ্রমণ কাহিনি (২)

মিকেলাঞ্জেলোর দেশে
ফ্লোরেন্স-পিসা-রোম
শম্পা গাঙ্গুলী

ফ্লোরেন্সঃ রেনেসাঁর আঁতুড়ঘর
      ফ্লোরেন্সে আমরা গিয়েছিলাম ইন্টারসিটি ট্রেনে  ট্রেনে ফ্লোরেন্স প্রায় পৌনে পাঁচ ঘন্টার রাস্তা। ত্রিয়েস্তে ইতালির একেবারে উত্তর পশ্চিম কোণে বলে যে কোনো জায়গাতে যেতে গেলে ভেনিসের মেস্ত্রে সেন্ত্রালে স্টেশন টপকে তবে যেতে হয়। ভেনিস, ভেরোনা ঐ ভাবেই গিয়েছিলাম । কিন্তু এবার সব লাগেজ  নিয়ে ত্রিয়েস্তে ছেড়ে চলে যেতে মন খারাপ করছিল। সাত দিনের জন্য হলেও ত্রিয়েস্তে শহরে বেশ গুছিয়ে সংসার করছিলাম । ফ্লোরেন্সের পথে দুপাশের দৃশ্য পাহাড়ে আর সবুজে ভরা। রাস্তায় অসংখ্য টানেল পেরোলাম এক একটা টানেল পেরোতে কখনো কখনো প্রায় আট- দশ মিনিট সময়ও লাগছিলো। সবচেয়ে বড়ো এপেনিনো টানেলটার দৈর্ঘ্য ১৮.৫ কিমি। এপেনাইন পর্বতকে লম্বালম্বি ভেদ করে বোলোনা আর ফ্লোরেন্সের মাঝে১৯৩৪ সালে এটা তৈরি হয়েছিলো । পেরোতে ট্রেনের সময় লাগল  প্রায় দশ মিনিট । আমাদের ভারতে জম্মু আর শ্রীনগরের মাঝে বানিহাল বা জহর টানেল এগারো কিমি লম্বা, এটার তুলনায় বেশ ছোটো।  ট্রেনে একজন গর্ভবতী  মহিলা ভিক্ষে করছে দেখে অবাক হলাম। মহিলাটি সম্ভবত পূর্ব ইউরোপের ত্রিয়েস্তের ফুটপাথেও বেশ কয়েকটা ভিখারি চোখে পড়েছিল। রোমেও তাদের সংখ্যা নেহাত কম পাইনি। এর ওপর নাকি ইতালির রাজধানীর চোর, পকেটমাররা খুবই পারদর্শী। সেজন্য গৌতম আমাকে যাবার আগে পাসপোর্ট আর ইউরোর জন্য নরম কাপড়ের দুটো বটুয়া বানিয়ে নিয়ে যেতে বলেছিল  ইউরোপের অনেক দেশের বেকারত্ব আর আর্থিক মন্দার ছোঁয়া ইতালির সব শহরগুলোতেই এসেছে ফ্লোরেন্সে ট্রেন থেকে নামবার আগে রফিকুল সরকার নামে এক বাংলাদেশীর সঙ্গে আলাপ হল। ফ্লোরেন্সে Santa Maria Novella-র (সেন্ট মেরির নতুন চার্চ – মাত্র সাড়ে ছশো বছরের পুরানো) কাছে উনি আজ দীর্ঘ সতেরো বছর ব্যবসার সূত্রে আছেন বারবার অনুরোধ করলেন আমরা ওনার বাসায় যেন যাই ওখানে আমরা শুধু চিত্রকলা, ভাস্কর্য দেখার জন্য যাচ্ছি, এটা উনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না উফিতজি, আকাদেমিয়া এসব বিখ্যাত আর্ট গ্যালারিগুলোর কথা এত বছর ওখানে থেকেও শোনেননি।
আদিগে

     আরনো নদীর দুপাশে আশি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে এই ছোট্ট শহর ফ্লোরেন্সে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল । নদীর খুব কাছেই একটা হোটেলে আমরা উঠেছিলাম। হোটেলের ঘরটা বেশ ছোটো হলেও আদব কায়দা আর আরামের দিক থেকে চমৎকার। বহু দিনের পুরানো কড়িবড়গার উঁচু ছাদের বাড়ি । আশেপাশে ছিল অনেক পাঁচশ বছরের বেশি পুরানো চার্চ আর বাড়ি আর অসংখ্য ছোটো ছোটো গলি। আমরা ওখানে আড়াই দিন ছিলাম। আমাদের হোটেলের পেছন দিকে একটা বিশাল আয়তনের কারুকার্জ করা ফটক দেখলাম। মনে হল ওখানে একসময়ে দূর্গ ছিল।  তার লাগোয়া কিছুটা প্রাচীরের অংশ এখনো অবশিষ্ঠ আছে । নিস্তব্ধ গলিগুলো যেন গ্রিক বা রোমের সভ্যতাকে এতদিন পরেও আঁকড়ে রেখেছে। নবজাগরণের সময় প্রাচীন গ্রিক সমাজের বলিষ্ঠ মানবতাবাদ ইউরোপের সমাজকে নতুন জীবনীশক্তি দেয় তার প্রভাব পড়ে সাহিত্যে, শিল্পে, অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে। সেই রেনেসাঁর জন্ম এই ফ্লোরেন্সে। এক অর্থে তাই ফ্লোরেন্স, একটা ছোট্ট শহর, জন্ম দিয়েছিল আধুনিক সভ্যতার। রেনেসাঁস এবং রিফর্মেশন এই দুই আন্দোলনই সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিতন্ত্রে রূপান্তরের সাক্ষী। সেই পর্বটি দীর্ঘকাল জুড়ে পরিব্যাপ্ত ছিল। দ্বাদশ শতাব্দী থেকেই শহরে টাকাপয়সার লেনদেন–ভিত্তিক বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদনের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াটি চালু হয়ে গিয়েছিল। এবং তা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে। ইতালি থেকে শুরু করে দক্ষিণ জার্মানি এবং রাইন নদী সংলগ্ন এলাকার বিস্তৃত ভূমিখণ্ডে প্রভাব বিস্তার করে অর্থনীতির এই নতুন রূপ। ইতালিতেই ভেনিস, জেনোয়া, ফ্লোরেন্স,  মিলানের মতো বড় বড় শহর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাধীন হয়ে ওঠে
পন্টে ভেচ্চিও

      

পৌঁছানোর পর প্রথম দিন দুপুরে নদীর ধার বরাবর হাঁটতে বেশ লাগছিল। আমরা একটা বিখ্যাত ব্রিজ পন্টে ভেচ্চিওতে এসে পড়লাম। চারদিকটা বেশ মেলা মেলা ভাব।  অনুভব করলাম ওখানে দলে দলে হাজির দেশ-বিদেশের মানুষের শরীরী ভাষাকে। হাতে আঁকা দারুণ সব ছবি রাস্তায় রেখে নিগ্রো ছেলেরা বিক্রী করছে। ব্রিজ বরাবর দুধারে চোখ ঝলসানো সারি সারি সোনার দোকান। জমিয়ে আড্ডা গান বাজনা হচ্ছে; বেশ একটা জমজমাট ভাব। মনোরম পরিবেশে আরনো নদীতে ডুবন্ত সূর্যকে সাক্ষী 
এখানেই গল্প করতেন শেলী-কিটস-বায়রন

মেনে ছবি তোলার হুড়োহুড়ি, আর মোবাইলে নিজস্বী তোলার ঠেলাঠেলিতে মনে হচ্ছিল, কবি শেলী-কিটস-বায়রন বুঝি ঐ ব্রিজটার মাথায় বসে গল্প করছে। হ্যাঁ,
 সত্যি সত্যিই একসময়ে ওখানে বসে এইসব দিকপাল কবিরা ভূমধ্যসাগরীয় সূর্যের উষ্ণতায় শরীর-মন সিঞ্চিত করে কবিতার রং মাখতেন। 





    পরদিন ব্রেকফাস্টের পরই আমরা বেড়িয়ে পড়লাম সেই বহু প্রতীক্ষিত উফিতজি গ্যালারির দিকে যেখানে রেনেসাঁর অসামান্য নান্দনিক ও মননশীল সভ্যতার নিদর্শন সযত্নে রাখা আছে।টিকিট আমাদের যাবার আগে থেকেই ইন্টারনেটে কাটা ছিল, তাই লাইন দিতে হয় নি। ভেতরে প্রায় চার ঘন্টার মত ছিলাম, তার দশগুণ সময়েও দেখা শেষ হতো না কত ছবির কথা আলাদা করে বলব! লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা ‘The Annunciation” ছবিটি খুবই বিখ্যাত। বাইবেলে আছে দেবদূত গ্যাব্রিয়েল স্বর্গ  থেকে নেমে এসে যখন ঘোষণা করছেন যে মাতা মেরি  ঈশ্বরের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করতে চলেছেন; সেই ঘোষণা পর্বটিকে ‘Annunciation’ বলে। এটা ফ্লোরেন্টাইন চিত্রকলার একটা প্রিয় বিষয়বস্তু-- অনেক শিল্পীর তুলিতেই আঁকা হয়েছে।  সব ছবিতেই মেরির বিস্ময় ফুটে উঠেছে। লিয়োনার্দো ফ্লোরেন্সের খ্যাতিমান শিল্পী ভেরোচ্চিয়োর কাছে কিশোর বয়সে আঁকা শিখতে যান। ভেরোচ্চিয়ো ছিলেন গুণগ্রাহী ও হৃদয়বান শিক্ষাগুরু। ঐ সময় বায়না পেয়ে তিনি সেন্ট জন যিশুকে ব্যাপটাইজ করার ছবি আঁকছিলেন। কিশোর শিষ্যকে গুরু ঐ প্রকাণ্ড চিত্রের একাংশে অবস্থিত একটি দেবশিশুর আলেখ্য আঁকার সুযোগ দিলেন। সম্পূর্ণ ছবিটা আঁকা শেষ হলে দেখা গেল ঐ ছোট্টো অংশটাই সবচেয়ে ভালো হয়েছে কিন্তু এতে গুরু ক্ষুব্ধ হননি। সকল প্রতিভার বহুমুখীনতার বিচারে লিয়োনার্দো ছিলেন সম্ভবত সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মনীষা। এই গ্যালারিতে ওনার আরও একটা বিখ্যাত ছবি হল ‘Adoration of the Magi’, যেটা আমরা একাধিক জায়গায় বিভিন্ন শিল্পীর তুলিতে দেখেছি।
Annunciation - লিওনার্দো 
      উফিতজিতে বতিচেল্লির আঁকা ছবিগুলো সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হল ১৪৮৪-৮৬ সালে আঁকা ‘বার্থ অফ ভেনাস’ ছবিটি।  ছবিতে সৌন্দর্য ও ভালবাসার রোমান দেবী পূর্ণ যুবতী ভেনাস অপার সৌন্দর্য নিয়ে নগ্নিকারূপে সমুদ্রের ফেনা থেকে জন্ম নিচ্ছেন। সমুদ্রের ওপর একটা বিশাল ঝিনুকের ওপর তিনি দাঁড়িয়ে, পশ্চিমা বায়ুর উপদেবতা জাফিরাস ও অরা তাঁকে নিয়ে চলেছে সাইপ্রাস দ্বীপে এত বছর পরেও রঙের ঔজ্জ্বল্য এতটুকু কমেনি। শিল্পী তাঁর সব ছবিতেই স্বাভাবিকত্বের চেয়ে জটিল কল্পনাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। বতিচেল্লি সর্বপ্রথম ধর্মের প্রভাব মুক্ত হয়ে রেনেসাঁর এক অনন্যসাধারণ  ধ্রুপদী নগ্নিকা চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন এই ছবিতে ওই ঘরে ওনার অন্যান্য বিখ্যাত ছবিগুলি হল ‘Spring, ‘Pallas and Centaur’, ‘Virgin and Child’, ‘Return of Judith to Bethulia’ ইত্যাদি। 

 বতিচেল্লির বার্থ অফ ভেনাস, ফ্লোরেন্স

স্প্রিং
Pallas and Centaur
    



মিকেলাঞ্জেলোর বন্ধু  ডোনির বিয়ে উপলক্ষে তাঁর আঁকা ‘Holy Family’ এখানে আছে। এছাড়া আরও কয়েকটা মনে রাখার মত ছবি হল, র‍্যাফায়েলের আঁকা ‘Madonna of the finch’; টিশিয়ানের আঁকা ‘Flora’ , ‘Venus Of Urbino’. পেরুজিনোর ‘Pieta’  বেশ কিছু প্রাচীন গ্রিক, রোমান মূর্তি মনে হয়েছে জীবন্ত। তার মধ্যে উভয়লিঙ্গ বা ‘Humphrodite’; মেদিচি ভেনাস গ্রিকদের সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতে, গান-কবিতা-শিল্প-তীরন্দাজির দেবতা অ্যাপোলোর মূর্তি উল্লেখযোগ্য। ইতালির বাইরের অনেক শিল্পীর ছবিও দেখলাম। এল গ্রেকো, ফ্রানসেসকো গয়া, রেমব্রান্ট, রুবেন্স – আর কতো নাম বলবো!
     
 হার্মফ্রোডাইট
হারকিউলিস ও সেন্টাউর- প্রথম শতাব্দী

Sleeping Arianna


ভেনাস অফ উর্নিনো

     উফিতজি গ্যালারিতে অত ছবি আর মূর্তি পরপর দেখে মাথা ভীষণ ঝিমঝিম করছিল। বাইরে বেড়িয়েও দেখি দারুণ সব মূর্তি।  তার মধ্যে সমুদ্রের রোমান দেবতা নেপচুন এবং পার্সিউসকে মনে আছে।  আর দেখেছিলাম ব্যাপ্টিস্ট্রির দরজা। তিনটে ব্রোঞ্জের দরজার মধ্যে দুটো বানিয়েছিলেন ঘিলবার্তি, সময় লেগেছিল একুশ বছর। মিকেলাঞ্জেলো যে দরজার নাম দিয়েছিলেন স্বর্গের দরজা, তার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম।


পার্সিউস

নেপচুন


















ঘিলবার্তির তৈরি দরজা

এবার আমরা রওনা দিলাম পিসা। লোকাল ট্রেনে এক ঘন্টার একটু বেশি সময়ের মধ্যে নব্বই কিমি পেরোলাম। রাস্তায় বৃষ্টি পেলাম। হাতে সময় কম থাকায় বিখ্যাত হেলানো টাওয়ারের ভেতর ঢোকা হয়নি। গল্পআছে ঐ টাওয়ারের ওপর থেকে গ্যালিলিও একটা স্মরণীয় পরীক্ষা করে বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন। উনি টাওয়ারের ওপর থেকে একসঙ্গে ভারি আর হাল্কা বস্তু ফেলে দেখিয়ে দেন ভর আলাদা হলেও দুটোই একসঙ্গে নীচে পড়বে। গৌতম অবশ্য বলল, ওটা গল্পই -- গ্যালিলিও পরীক্ষাটা করেছিলেন, তবে হেলানো মিনার থেকে নয়। সেদিন পিসার থেকে ফেরার সময় সারা রাস্তা বৃষ্টি পেলাম। বৃষ্টিভেজা বিকেলে জমাট ঠাণ্ডায় আইস্ক্রীম খেতে খেতে স্টেশন পর্যন্ত দুজনে একই ছাতায়  ফেরাটা বহুদিন  পর কলেজের দিনগুলো মনে করালো


বৃষ্টির বিকেলে হেলানো টাওয়ার, পিসা
      পরের দিন ছিল আগস্ট মাসের প্রথম রবিবার। সারা বছর ইতালিতে মাসের প্রথম রবিবারগুলো সমস্ত জাতীয় গ্যালারিগুলোতে কোনো টিকিট লাগে না। কেবলমাত্র ভ্যাটিকান সিটি আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে ধরা হয়, সেখানে এই নিয়ম চলে না। পরের দিন সকাল সকাল আকাদেমিয়ায় ঢুকে পড়ব ভেবেছিলাম কিন্তু গিয়ে দেখি বিশাল লাইন। চড়া রোদে প্রায় এক ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তবেই জীবন সার্থক করে তোলার সুযোগ পেলাম। একেবারে সামনেই রয়েছে গিয়ামবোলোনার অসামান্য ভাস্কর্য ‘Rape of the Sabine Women’. এর ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে রোম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার ঊষাকালে, অর্থাৎ ৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চলে যেতে হবে। সেই সময়ে রোমের অধিবাসীরা ‘সাবাইন’ উপজাতির মহিলাদের ধরে এনে বিয়ে করত। ল্যাটিন ভাষায় কথাটা ‘Raptio’ অর্থাৎ ‘অপহরণ’ থেকে অপভ্রংশ হয়ে ‘Rape’ কথাটা এসেছে।
Rape of the Sabine Women

      
    এরপর বলব সেই মূর্তিটার কথা যেটা দেখার জন্য পৃথিবীশুদ্ধু পর্যটক বারে বারে এখানে ফিরে আসতে চান আমি নিশ্চিত যেটার সামনে দাঁড়ালে আমারই মত সবাই মুগ্ধ বিস্ময়ে অন্তত পাঁচ মিনিট অসাড়, বিমুঢ় হয়ে পড়বে। যে বিশাল হলঘরটায় এই স্ট্যাচুটা রাখা আছে, সেখানে আর অন্য কোনো মূর্তি স্থান পায়নি। হ্যাঁ, আমি মিকেলাঞ্জেলোর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘ডেভিড’ এর কথা বলছি। একটা উঁচু স্তম্ভের ওপর পাঁচ মিটারের চেয়ে বেশি লম্বা মূর্তিটা দাঁড়িয়ে। ডেভিড হচ্ছে বাইবেলের গল্পে ইজরায়েলের সেই দুঃসাহসী রাখাল বালক যে গোলিয়াথ নামে ভয়ংকর এক দানবকে বধ করে পরে ইজরায়েলের রাজা হয়েছিল। মিকেলাঞ্জেলোর  নিহসন্দেহে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর। এছাড়াও তিনি ছিলেন চিত্রশিল্পী, কবি ও স্থপতি। তাঁর  জীবনী পড়ে জেনেছি কি অদম্য প্রচেষ্টা আর অধ্যবসায় ছিল তাঁর পাথরের ওপর খোদাই কাজে। ফ্লোরেন্সের শাসকরা ছিলেন শিল্পপ্রেমিক। ঘটনাচক্রে মিকেলাঞ্জেলো যুবরাজ লোরেঞ্জোর নজরে আসেন এবং তাঁর সহযোগিতায় বহু বড় বড় মানুষের  সঙ্গে পরিচিত হন। ক্রমশ প্রাচীন গ্রিসের শিল্পকলা এবং ভাস্কর্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ জাগে ডেভিডের মূর্তির পাঁজরার হাড়, হাত-পায়ের  বলিষ্ঠ পেশী, অপূর্ব মুখমণ্ডলের শক্ত চোয়ালের হাড়; পাথরের চামড়ার মোড়কে এতটাই জীবন্ত, যেন মেদহীন এক গ্রিক সুপুরুষ যুবক সামনে  দাঁড়িয়ে। মিকেলাঞ্জেলোর রাতের পর রাত চলে যেতেন তাঁর বাড়ির কাছাকাছি একটা গির্জা সংলগ্ন  হাসপাতালের মর্গে। সেখানে একা একা বিভিন্ন বয়সের মৃতদেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ব্যবচ্ছেদ করতেন। চামড়ার তলায় পেশীগুলো, শিরা-উপশিরা, ধমনী কিভাবে থাকে, কিভাবে কাজ করে, সেটা পর্যবেক্ষণ করতেন, এনাটমি শিখতেন। ভাবা যায়! হাত-পা থেকে শুরু করে শরীরের সব অংশের সঞ্চালন কতখানি গভীরে গিয়ে উপলব্ধি করলে তবেই না ছেনির নিরন্তর ঘায়ে পাথরের প্রতিটি অংশ তাঁর ছোঁয়ায় জেগে উঠত, কথা বলত। ডেভিডের সামনে আমারই মত অনেকেই বহুক্ষণ বাকশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অল্প বয়সী চিনা বংশোদ্ভূত ছেলে কিছুতেই তার বিস্ময় কাটাতে পারছিল না। ছেলেটি অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। গ্রাজুয়েশনের পরীক্ষা দিয়ে, সম্পূর্ণ একা একা দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছে। হংকং–সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক হয়ে প্যারিস, রোম পর্যন্ত দেখা হয়ে গেছে। ফ্লোরেন্স থেকে পরদিন মিলান যাবে। তারপর অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে গিয়ে বলল চাকরি খুঁজবে। চিনা অনেক মেয়েদেরও দেখলাম ঐ রকম একা একা ঘুরে ঘুরে একটার পর একটা গ্যালারি দেখছে। 
মিকেলাঞ্জেলোর অমর সৃষ্টি ডেভিড, ফ্লোরেন্স
      চতুর্দশ শতাব্দীতেই ‘হিউম্যানিস্ট’ আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল ইতালিতে। পেত্রার্ক আর বোকাচ্চিও ছিলেন এর প্রবক্তা। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার অর্থই হল যাজকতন্ত্র সম্বন্ধে সামন্ততান্ত্রিক ধারণাগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে সমাজ সম্বন্ধে অপেক্ষাকৃত ধর্মনিরপেক্ষ একটা মনোভাব গ্রহণ করা।  ইতালিতে প্রথমে এজন্য চার্চের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার দরকার হয়নি। তামাম খ্রিস্টান দুনিয়ার দানে  সুপুষ্ট ছিল রোমের পোপের তহবিল। অতীতের অর্থনীতি, শিল্পকলা, চিন্তাভাবনা – এসবের মধ্যযুগীয় রূপগুলি চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়ে আসে এক নতুন সংস্কৃতি -- যার অর্থনীতি পুঁজিতান্ত্রিক, যার শিল্পকলা ও সাহিত্য প্রাচীন গ্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত, প্রকৃতির প্রতি যার দৃষ্টি বিজ্ঞান নির্ভর। আধুনিক ব্যাঙ্কিং প্রথা চালু হয়েছিল এই ফ্লোরেন্সেই এখানকার মেদিচি পরিবার প্রধানত পোপের ব্যাঙ্কার ছিল । পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ফ্লোরেন্সের রাষ্ট্রনৈতিক ইতিহাস, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও শিল্পকলার স্ফুরণের সঙ্গে ওতোপ্রেতভাবে জড়িত এই পরিবার। সামান্য অবস্থা থেকে ব্যবসা ও ব্যাঙ্কিং-এর মাধ্যমে তাঁরা বিরাট সম্পদের অধিকারী হন। তারা বণিক স্তর থেকেই উন্নতি লাভ করে ‘প্রিন্স’ রূপে শাসক পদ পেতেন
      আকাদেমিয়া থেকে বেরিয়ে আমরা এরপর সেই মেদিচিদের চ্যাপেলে ঢুকলাম। সেখানে মিকেলাঞ্জেলোর –‘Madonna and ChildDawnDuskDay, ‘Night’  এর মত আরও কিছু অসাধারণ ভাষ্কর্য দেখলাম। মিকেলাঞ্জেলোর সব নারীমূর্তিগুলিতেই  কেমন যেন একটা পুরুষালি ভাব ফুটে উঠেছে। মনে হয় মানবশরীরের পেশীসমূহের অবস্থান অত বিশদে হাতে-কলমে পর্যবেক্ষণ করার ফলে তার প্রভাব তাঁর কাজে পড়েছে।

জিউলানো দি মেডিচি
নাইট

্লরেঞ্জো দি মেদিচি

ডন

ডাস্ক


      সেখান থেকে আমরা গেলাম সান্তা ক্রোসে চার্চে । সামনে দান্তের মূর্তিটা খুব জীবন্ত। গ্যালিলিওর মিউজিয়াম হয়ে গেলাম সান্তা মারিয়া নভেলা গির্জায় সেই বাংলাদেশী ব্যবসায়ী সরকারের দোকানে গিয়ে ওনার সঙ্গে দেখা করলাম উনি আমাদের পরের দিন দুপুরে মাংস- ভাত খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছিলেন।  ফ্লোরেন্সে  কেবলই বিভিন্ন রকমের পিৎজা খেতে খেতে আমারও মনটা ‘ভাত’- ‘ভাত’  করছিল বটে , কিন্তু পরদিন সকাল সাড়ে দশটায় আমাদের ফ্লোরেন্স থেকে রোম যাবার ট্রেন, তাই আর ওখানে বাঙালির হাতের রান্না খাওয়া হল না। সেইদিনই  সব গ্যালারিগুলো ফ্রি দুপুরের দিকে  বিনে পয়সার টিকিট কেটে লম্বা লাইনে বহুক্ষণ  দাঁড়িয়ে তবে ফ্লোরেন্সের রাজপ্রাসাদ পিট্টি প্যালেসে প্রবেশাধিকার পেলাম। সেখানেও অনেকগুলো গ্যালারি আছে- মর্ডান আর্টের গ্যালারি যেমন আছে তেমনি আছে রেনেসাঁর শিল্পেরও সেখনেও তিশিয়ান, বোতিচেল্লি, তিনতোরেত্তো, র‍্যাফায়েল – এদের মত শিল্পীদের অনেক ছবি আছে। আগের দিন বৃষ্টি হওয়ায় আমরা ওর সংলগ্ন ববোলি গার্ডেনে ঢুকতে পারিনি।
পিট্টি প্যালেসের ছাদ আঁকা ছবি, মূর্তি ও দেয়ালচিত্র

রোমের পথে পথেঃ                                                   
      পরদিন আমরা  সুপারফাস্ট ‘Fresia Argento’ (রূপালি তির) ট্রেনে ৩১৫ কিমি পথ মাত্র দেড় ঘন্টায় অতিক্রম করলাম। ভেতরের ডিসপ্লে বোর্ড দেখাচ্ছিল ট্রেনের গতি ঘন্টায় ২৫০ কিমি  ট্রেনে আমাদের উল্টোদিকে একটি অল্পবয়সি মেয়ে মন দিয়ে বই পড়ে যাচ্ছে। মুখে কোনো প্রসাধন নেই। খোলা চুলে আঁকাবাঁকা সিথি নিয়ে চুপচাপ জুস খেতে খেতে বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছে। হঠাৎ দেখি অন্য সিট থেকে একটি অল্পবয়সি ছেলে উঠে এসে কি যেন বলল; আর মেয়েটাও চঞ্চলা হরিণীর মত ছোটাছুটি করে খোঁজাখুঁজি শুরু করল। মেয়েটার পাশাপাশি ছেলেটা আর তাদের সঙ্গে এক মাঝবয়সি সুবেশিনী মহিলা, সবাই মিলে তাদের নিজেদের সিটের আশপাশ তন্নতন্ন করে কি যেন খুঁজেই চলেছে। জিজ্ঞাসা করায় মেয়েটি বলল, তাদের ওই ট্রেনের টিকিটগুলো কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। সেই শুনে আমরাও ট্রেনের বাঙ্কের ওপর, সিটের তলায় খুঁজতে শুরু করি। প্রায় দশ মিনিট পরেও খুঁজে পাওয়া গেল না।  ওরা সবাই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। হঠাৎ দেখি চেকার আসছে। মেয়েটির কপালে তখন ওই ঠাণ্ডাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম। টিকিট না দেখাতে পারলে শুনলাম ২০০ ইউরো করে এক এক জনের জরিমানা। আমাদেরই রীতিমত টেনশন হচ্ছে তখন। মাঝবয়সি ওই মহিলাটি মেয়েটির মা। ছেলেটি ওনার সঙ্গে বসেছিলেন। টিটি যখন প্রায় ছেলেটির সিটের কাছে, তখন আচমকাই ছেলেটি তাদের উল্টোদিকের একটা ফাঁকা সিট থেকে তাদেরই লাগেজের স্তুপের মধ্যে থেকে টিকিটগুলো উদ্ধার করল। কামরার সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
      মেয়েটিও আবার আমাদের উল্টোদিকের সিটে এসে বসল। আমরা ওকে টিকিট খুঁজতে সাহায্য করেছি বলে বারে বারে ধন্যবাদ দিতে লাগল। পরিচয় হতে গল্প জমে উঠল। নাম লিসা। সুইডেনের বাসিন্দা। ওর মায়ের পাশে বসা ছেলেটি ওর ভাই কিনা জানতে চাওয়ায় বলল, ছেলেটি ওর বয়ফ্রেণ্ড। ভাবলাম ছেলেটি নিজের গার্লফ্রেণ্ডকে ছেড়ে গার্লফ্রেণ্ড-এর মায়ের সাথে সারাক্ষণ বসে আছে! মেয়েটি বলল, সুইডেনে বছরের ন মাসই বরফে ঢাকা থাকে বলে জলবায়ুটা খুবই একঘেয়ে। তাই মাঝেমধ্যেই ওরা ভূমধ্যসাগরের কোনো দেশে চলে আসে। ক্রান্তীয় জলবায়ুর রোদে পোড়া বাসিন্দা হলেও বুঝতে অসুবিধা হল না যে ভূমধ্যসাগরের রোদ্দুর ওদের মত মেরুপ্রদেশের লোকেদের কাছে খুবই লোভনীয়। ভারতে এলে আগ্রার তাজমহল আর অজন্তা-ইলোরা দেখার ইচ্ছে লিসার
মোজেস
      রোমে আমাদের থাকবার হোটেলটা ‘Angelinibedrooms’ দারুণ জায়গায়। আমাদের ঘরটার নাম ‘ভেনাস’। এক কথায় অসাধারণ। সেদিনই আমরা  মোজেসের এর মূর্তি দেখতে গেলাম কাছেই ভিঞ্চলির সেন্ট পিটারের গির্জায়, যেটা আসলে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস এর সমাধির জন্য মিকেলাঞ্জেলো বানিয়েছিলেন। কাছাকাছি একটা দোকান থেকে এক একটা ৩৬ ইউরো করে দুটো ‘রোমা পাস’ সংগ্রহ করলাম  তাতে তিন দিনের জন্য সরকারী বাস ও মেট্রো সারাদিন ধরে কোনো পয়সা লাগে না, আর যে কোনো  দুটো মিউজিয়ামে ওই টিকিটেই ঢোকা যাবে। সঙ্গে পেলাম রোমের গাইড ম্যাপ। আমাদের হোটেলের খুব কাছেই ছিল একটা বিখ্যাত গির্জা, সান্তা মারিয়া ম্যাগিওরে। তার ভিতরটাও দেখার মতো।
চার্চ অফ সান্তা মারিয়া ম্যাগিওরে, রোম
      পরের দিন সকালেই আমাদের লক্ষ্য হল যা দেখার জন্য দেশী বিদেশী পর্যটকেরা আকুল হয়ে থাকেন সেই পৃথিবী বিখ্যাত কলোসিয়াম। এটা রোমান আমলে নির্মিত একটা বিশেষ অ্যাম্ফিথিয়েটার। তেরো বছর (৬৯-৮২ খ্রি) ধরে ফ্লেভিয়ান সম্রাটদের অর্থানুকুল্যে রোম শহরের ভেতর এই তিনতলা সৌধটি তৈরি হয়। এই ছাদহীন ডিম্বাকৃতি অ্যাম্ফিথিয়েটারে মাঝখানের রঙ্গভূমিকে ঘিরে ধাপে ধাপে উঠে গেছে পঞ্চাশ হাজার দর্শকের আসন। মাঝখানের জায়গাটায় বন্দী অথবা দাসযোদ্ধা মানে গ্ল্যাডিয়েটারদের দ্বন্দ্বযুদ্ধে বা বন্যজন্তুর সঙ্গে আমৃত্যু লড়াই করে দর্শকদের আমোদ দিতে হত। রোম সাম্রাজ্যের বিলাস-বাসন এতই আকাশচুম্বী হয়েছিল যে কলোসিয়ামে বছরে ১০০ দিনের উপর এই মৃত্যু উৎসব পালন করা হত। ভেরোনার এরিনা অ্যাম্ফিথিয়েটারেও ঐ একই নারকীয় খেলা চলত। কিন্তু বিভৎসতার মাত্রায়, উল্লাসের ফোয়ারায় আর প্রমোদকারীদের ভিড়ে এ ছিল বহুগুণ বেশি। কলোসিয়াম তাই মানব সভ্যতার এক লজ্জাজনক কলঙ্কময় ইতিহাসের স্মারক  বারবার ভূমিকম্পে এখন এর অনেকটা অংশই  ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে।    
কলোসিয়াম, রোম
      কলোসিয়াম থেকে বেরিয়ে সামনেই ‘রোমান ফোরাম, প্রাচীন রোমের কেন্দ্র। ঢোকার মুখে দেখলাম  কনস্টানটাইনের আর্চ বা তোরণ। কনস্টানটাইন ছিলেন প্রথম খ্রিস্টান রোমান সম্রাট। ৩১৫ খ্রিস্টাব্দে রোম সম্রাটের বিজয় যাত্রার স্মারক হিসাবে তৈরি এই তোরণ পরবর্তীকালের অসংখ্য অনুকরণের জন্ম দিয়েছে। দিল্লির ‘ইণ্ডিয়া গেট’, মুম্বায়ের ‘গেটওয়ে অফ ইণ্ডিয়া’ – সবারই প্রেরণা এই আর্চ।
কনস্টানটাইনের আর্চ
      রোমান ফোরামে  ঢুকে মনে হল আমরা রোম সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি। তিনদিকে প্যালাটিন, ক্যাপিটলাইন আর এসক্যুইলাইন পাহাড়ে  ঘেরা বিশাল উপত্যকার নিম্নভূমিটা একসময়ে ছিল অস্বাস্থ্যকর জলাজমি সম্রাট অগাস্টাসের সময়ে এটি সুন্দর নর্দমাযুক্ত একটা বিশাল বাজার অঞ্চলে পরিণত  হয়। এখানে শুধু বাণিজ্যিক লেনদেনের প্রধান জায়গাগুলোই ছিল না, নানান রোমান দেবদেবীর মন্দিরও ছিল। যেমন  ওখানকার ‘ভেস্তা’র মন্দির, রোমের খুব প্রাচীন  মন্দিরগুলোর মধ্যে একটা। সেখানে আগুনকে খুব পবিত্র মানা হত। সেজন্য সবসময়ে ঐ মন্দিরের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে রাখা হত। আর ওখানকার পূজারী হত কুমারী মেয়েরা। জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর তাঁকে দেবতা বানিয়ে ওখানে ‘দিভাস জুলিয়াস’ নামে মন্দির তৈরি হয়েছিল। এছাড়া আছে স্যাটার্ন এবং ভেস্পাসিয়ানের মন্দির ’Temple of Divus Romulus’ সম্রাট ম্যাক্সেন্টিয়াস শুরু করেছিলেন, শেষ করেন সম্রাট কনস্টানটাইন । আরও দুটি আর্চের কথা মনে পড়ছে। একটা হচ্ছে রোমান ফোরামের উওর-পূর্ব কোণে, ‘Arch of Severus’. অন্যটা হল ‘Arch of Titus’ ফোরামের একেবারে পূর্ব প্রান্তে। 
রোমান ফোরাম
      সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতিতে রাজনীতি ও সমাজে এক প্রধান শক্তি হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের আত্মপ্রকাশ ঘটে খ্রিস্টিয় প্রথম কয়েক শতাব্দীতে।  রোমের পদানত জাতিসমূহের মধ্যে ইহুদিরা ছিল সবচেয়ে নিপীড়িত, সবচেয়ে বিদ্রোহী রোমের শাসন যখন সাধারণ মানুষের এবং  ক্রীতদাসদের কাছে  দুঃসহ হয়ে উঠেছিল, তাদের আশ্রয়স্থল হয়েছিল ইহুদিদের খ্রিস্টধর্ম। সবচেয়ে শাসকের অত্যাচার যত বাড়ে, খ্রিস্টধর্মের প্রতি জনসমর্থনও ততই বৃদ্ধি পায়। অবশেষে ৩১২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কনস্টানটাইন নিজেই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হন। ফোরামের সমস্ত বিখ্যাত নিদর্শনই বোধহয় তার আগের যুগের।
      রোমান ফোরামের ঠিক উলটো দিকেই প্যালাটিন পাহাড় ধাপে ধাপে উঠে গেছে। ওখানে বিভিন্ন সম্রাটদের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ ঘুরে ঘুরে দেখতে অনেকটা সময় লেগে গেল। পাহাড়ের ওপর থেকে নীচের ‘Circus Maximus’ টা দারুণ লাগছিল। প্রায় দেড় লক্ষ দর্শকের আসন ছিল ওই ডিম্বাকৃতি বিশাল মাঠটায়। চোখ বন্ধ করলে বেশ অনুভব করতে পারছিলাম, সেই সময়কার হাজার হাজার দর্শকের  হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ছে ঐ মাঠটা, যেখানে ঘোড়ায় টানা রথের চাকার ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলেছে প্রতিযোগিতায় নামা রথগুলি। মনে পড়ে গেল বেন হুর সিনেমার সেই বিখ্যাত চ্যারিয়ট রেসের কথা  

সার্কাস ম্যাক্সিমাস
      খ্রিস্টিয় প্রথম দুই শতাব্দীতে রোম সাম্রাজ্য যখন ক্ষমতার শিখরে, তখন তা ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম রাষ্ট্র। সামরিক ও নাগরিক সংগঠন, বাণিজ্য পরিসর ও মাত্রার দিক থেকে সে যে চরম সীমা স্পর্শ করে, বহু শতাব্দী ধরে কারোর পক্ষে তা অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্র ছিল ক্যাপিটলাইন হিল। সেখানেই বিশাল একটা মিউজিয়ামে ঢুকলাম। কত যে স্থাপত্য, ভাস্কর্য দেখলাম তার বিশদ বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। ওঠার সিঁড়িগুলো আর ওপরের বিরাট চাতালটার সুন্দর নকসা মিকেলাঞ্জেলোর  মস্তিষ্ক প্রসূত। প্রচুর ব্রোঞ্জের মূর্তি আছে। কনস্টানটাইন এর কলোসাল মূর্তির একটা হাত আর মাথাটা রাখা আছে। কলোসাল মানে সাধারণ মানুষের থেকে অন্তত ছয়-সাত গুণ বড় আয়তনের  মূর্তি। আমরা বিখ্যাত ‘Capitoline Venus’-কে এ ঘর ও ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। খোঁজাখুঁজির সময়ে লিফটে করে ওঠানামা করতে করতে  হঠাৎ দেখি এখন সদ্য সদ্য খনন কাজ চলছে এমন অংশ দিয়ে আমাদের লিফটটা নামছে। মনে হচ্ছিল, আমরা যেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের মত কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ভিতর ঢুকে পড়েছি। হাঁটতে হাঁটতে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে গিয়ে মাটির তলায় গেলাম সেখানে সবে সবে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। বুঝলাম ঐ অংশে সত্যি সত্যি নতুন নতুন জিনিস এখনো  খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চলছে। যা হোক আমাদের এই অভিজ্ঞতাটা একটু অন্য রকম হল।
      ‘Capitoline Venus’-কে অনেক পরে দেখলাম ‘The Cabinet of Venus’ নামে একটা ঘরে আলাদা করে রাখা-- অন্য কোন মূর্তি সে ঘরে নেই। এক কথায় অসাধারণ। অন্য একটা ঘরে দেখলাম রোমাস ও রোমিউলাসের ব্রোঞ্জ মূর্তি লোককথায় আছে রিমাস ও রোমিউলাস হল দুই ভাই যারা রোম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। জন্মের পর থেকে একটা মা নেকড়ে তার নিজের বুকের দুধ খাইয়ে এদের বড় করেছিল। ঘরের একদম মাঝখানে শোভা পাচ্ছে, ব্রোঞ্জের একটা প্রকাণ্ড মা নেকড়ে; আর তার বুকের দুধ পান করছে ওই দুই শিশু। একটা কথা বলে রাখি, ইউরোপের ইতিহাস ও লোককথা এত প্রাচীন আর সমৃদ্ধ যে সেগুলো না জানলে মিউজিয়ামগুলো ঘুরতে মনে হয় ভালই লাগবে না। 


ক্যাপিটলাইন ভেনাস, রোম

  রিমাস ও রোমিউলাসের মূর্তি
      অন্য একটা ঘরে অনেক গ্রিক পণ্ডিতের আবক্ষ মূর্তি রাখা আছে। ডেমোক্রেটাস, সক্রেটিস, প্লেটো, আরিস্টটল, আর্কিমিডিস, ইউক্লিড, সোফোক্লেস -- কেউ বাদ নেই। দারুণ সুন্দর সুন্দর সব ছবি আঁকা আছে – টিশিয়ান, তিনতোরেত্তো, গুইডো, রেনি এবং আরও অনেকের । অত মনে রাখা সম্ভবও নয়, লেখাও যাবে না।  বড় কাঁচের একটা হলঘরে অনেক নিদর্শনের মাঝে মনে রাখার মতো ছিল সবচেয়ে পুরানো রোমান একটা ব্রোঞ্জের মূর্তি। ঘোড়ার পিঠের ওপর বিখ্যাত সম্রাট স্টইক দার্শনিক মারকাস অরিলিয়াস

মার্কাস অরেলিয়াস
       ওখান থেকে বেরিয়ে খাওয়া দাওয়া করে আমরা হাঁটা লাগালাম পিয়াজা নাভোনার দিকে। একটা কথা বলি, রোমকে যেমন বলা হয় ‘City Of Seven Hills’, তেমনি আমার মনে হয় বলা উচিত ‘City of Fountains’.  রোম শহরে পানীয় জলের ব্যবস্থা খুবই ভালো। কিছুদূর গেলেই দেখি এক বা একাধিক কৃত্রিম ঝর্ণা। কিন্তু কোনোটাই যেমন তেমন নয়-- শিল্প- ভাষ্কর্যের যাদুকাঠির ছোঁয়া সেগুলোতেও আছে পুরোমাত্রায়। সারাদিন ঝর্ণাগুলোর চারপাশে দেশী বিদেশী লোকজন গিজগিজ করছে  বিকেল বেলা থেকে রাত পর্যন্ত  আলোর রোশনাইতে  ভিড় আরও বাড়তে থাকে। পিয়াজা নাভোনা এলাকাটাকে আ্মার মনে হল বলতে পারি একটা ‘Fountain Complex’ ; যেমন বলে থাকি ‘Market Complex’, ‘Industrial Complex’  ইত্যাদি  ওখানে ‘Fountain Of Four Rivers’ নামে একটা বিখ্যাত ঝর্ণা আছে । সেখানে চারটে মূর্তির  থেকে বেরিয়ে আসা জলধারাগুলো চার মহাদেশের চারটে নদী দানিয়ুব, গঙ্গা, নীল এবং রায়ো ডি লা প্লাটাকে বুঝিয়েছে পাশেই আরোও কয়েকটা, ঝর্ণা দেখলাম, যেমন ‘ Fountain of Neptune’, ‘Fountain of the Moor’
Fountain Of Four Rivers



Fountain of the Moor

 পিয়াজা নাভোনা ছাড়িয়ে একটু এগোলেই দেখি ‘Pantheon’ নামে বিশাল ডোম আকৃতির মাথা বিশিষ্ট একটা মন্দির। ‘Pantheon’ মানে ‘সকল দেবতার মন্দির’। রোমান দেবতাদের জন্য তৈরি হলেও এখন সেখানে খ্রিস্টধর্মের রমরমা। মন্দিরটা একাধিক বার আগুন লেগে ধ্বংস হয়ে গেছে আর ততবার ওটাকে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরের মাথার ওই অতবড় গম্বুজাকৃতি ছাদটা্র গঠন-প্রযুক্তি তাক লাগিয়ে দেয়।
প্যান্থিয়ন

      সেখান থেকে বেরিয়ে দেখি বিভিন্ন গলি দিয়ে পিলপিল করে লোকজন সবাই একদিকেই  যাচ্ছে। আমরাও রোমা পাসের ম্যাপ হাতে মেলে ধরে সেই দিকে এগোতে লাগলাম। গন্তব্যস্থল আরও একটা অনবদ্য ঝর্ণাধারা। একটা বিশাল এলাকা জুড়ে একটা প্রাসাদের সামনে, নেপচুন প্রাসাদ যার নাম; তার সামনে  নানা রঙের আলোর বর্ণালীর মাঝে নানান দেব-দেবীর মধ্য থেকে নিসৃত হচ্ছে আলোকের ঝর্ণাধারা। আমরা ট্রেভি ঝর্ণার সামনে পৌঁছেছি। সন্ধে নামার মুখে ওই নানা রঙের রামধনুর সামনে বেশ খানিক্ষণ বসে রইলাম।
      পরদিন আমরা ইতালির রাজধানী রোম শহরের মাঝে অবস্থিত বিশ্বের ক্ষুদ্রতম সার্বভৌম রাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটির মিউজিয়ামে গেলাম। টিকিট আমাদের অনেক আগেই ইন্টারনেটে কাটা ছিল। এই শহরের সার্বভৌম শাসক হচ্ছেন সারা বিশ্বের রোমান ক্যাথলিকদের ধর্মগুরু ও রোমের বিশপ, পোপ। বিশ্বের এই ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্রে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম গির্জা -- সেন্ট পিটার্স এই গির্জার বাগানের উত্তরে রয়েছে প্রশাসনিক সদনগুলি, বেলভেদিয়ার উদ্যান। এই উদ্যানের পশ্চিমে আছে ধর্মগুরুদের প্রাসাদসমূহ আর তার তারপরেই ভ্যাটিকান উদ্যান- এই এলাকাই এই রাষ্ট্রের অর্ধেক জুড়ে অবস্থান করছে। ভ্যাটিকান প্রাসাদের চারপাশে রয়েছে বিশাল উঁচু প্রাচীর।

ভ্যাটিকানের বারান্দার সুসজ্জিত সোনার কাজ করা ছাদ

      অসাধারণ সুসজ্জিত ওই প্রাসাদে ঢুকতেই দেখলাম দর্শকদের সুবিধার্থে একটা অনেক চওড়া ‘helicoidal ramp’, যাতে প্রদর্শনীর ঘরগুলো সহজেই পৌঁছানো যায়। ১৬৫ মিটার লম্বা এই র‍্যাম্প মৃদু ঢালে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে চলে গেছে অত উঁচু প্রাসাদের ওপরের তলা পর্যন্ত । ভ্যাটিকানের সংগ্রহশালাগুলি বিশ্বের জগদ্বিখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রহ, গ্রিক ভাস্কর্য কীর্তির নিদশর্ন, রেনেসাঁ চিত্রের অমূল্য সংগ্রহ দিয়ে ভর্তি। এখানে লিয়োনার্দো, গিয়োত্তো, কারাভাজ্জো, পেরুজিনো, বতিচেল্লি, পুস্যাঁ এবং আরও অনেক শিল্পীর আঁকা ছবি আছে। একটা প্রাসাদে পরপর কয়েকটা ঘর রাফায়েল ও তাঁর সহকর্মীদের দ্বারা অলংকৃত। একটা ঘরের নাম ‘Signature Room’ এই ঘরে পোপ সরকারী নথিপত্র সই করেন। সেখানে ঢুকতেই চোখ টানলো রাফায়েল এর অনন্য চিত্র ‘School Of Athens’; যেখানে প্লেটো আর এরিস্টোটালকে ঘিরে আছেন অনেক গুণী, বিজ্ঞ পণ্ডিত, দার্শনিক, শিল্পীরা। প্রায় সকলের মুখই রাফায়েল তাঁর পরিচিত ব্যক্তিত্বদের থেকে নিয়েছেন, নিজেও ছিলেন তার মধ্যে। প্লেটোকে চিত্রিত করার জন্য লিয়োনার্দোর মুখ বেছে নিয়েছিলেন শিল্পী। রাফায়েলের অন্যান্য ছবিগুলো – যেমন , ‘Expulsion Of Heliodorus From The Temple’ , ‘Coronation Of Charlemagne’, ‘Baptism Of Constantine’, ‘Dispute of the Blessed Sacrament’, ‘Battle of The Milvian Bridge’ , ‘Apparition Of The Cross’, সবই খুব নাম করা। সব ঘরেই এত জাপানি, চিনা ও অন্যান্য বিদেশীদের ভিড় যে নড়াই যাচ্ছিল না। অন্য ঘরে রাখা রাফায়েলের আর এক বিখ্যাত ছবি, ‘Transfiguration’-এ যিশুর স্বর্গপথে যাওয়ার দৃশ্য বর্ণনা করা আছে। মনে আছে মর্ডান আর্টের একটা গ্যালারিতে বিশেষ কোনো কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না; তবে রঁদার ‘Thinker’ আর স্যালভাদোর দালির ‘Angelic Landscape’, মার্ক সাগাল এর ‘খ্রিস্টের স্বীকারোক্তি’,  ভ্যান গগের ‘পিয়েতা’, এবং আরও অনেক  ছবি মনকে বেশ নাড়া দিয়েছিল।  
Thinker
Angelic Landscape

      বেলভেদিয়ার উদ্যানে অভূতপূর্ব কিছু  গ্রিক, রোমান মূর্তি মনের কোনে এখনো মাঝে মাঝে উঁকি মারে। প্রাচীনকালের যতগুলো মূর্তি এখনো অক্ষত আছে, তার মধ্যে খুব বিখ্যাত হল  ‘Lacoon’। ইলিয়াড মহাকাব্যে ট্রয়ের যুদ্ধের কথা আছে। জ্যোতিষী লাকুন ছিলেন ট্রোজানদের পক্ষে দশ বছর যুদ্ধের পরও গ্রিকরা ট্রোজানদের হারাতে পারছিল না। তারা তখন একটা বিশাল কাঠের ঘোড়া রেখে দিয়ে পালানোর ভান করে। জ্যোতিষী লাকুন ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন ট্রোজানরা যেন ওই ঘোড়াটা কোনোভাবেই দেশের ভেতর না আনে। গ্রিক দেবতা এথেনা ও পসাইদন ভয়ঙ্কর দুটো সাপ পাঠিয়ে লাকুন আর তার দুই ছেলেকে মেরে ফেলে। ট্রোজানরা যুদ্ধে জিতে গেছে ভেবে ওই কাঠের ঘোড়াটা নগরের ভেতর ঢুকিয়ে নেয় তার ভেতর লুকিয়ে থাকা গ্রিক সৈন্যরা বেরিয়ে এসে রাতের অন্ধকারে ফিরে আসা গ্রিক বাহিনীর জন্য নগরের দরজা খুলে দেয়। ট্রয় নগর ধবংস করে তারা। ছোটোবেলায় পড়া ইলিয়াড মহাকাব্যের গল্প এই ভাস্কর্য দেখার পর মনে পড়ে গেল। গ্রিক পুরাণ পড়া যেন এতদিনে সার্থক হল। এছাড়া আছে গ্রিক দেবতা অ্যাপোলো, আফ্রোদিতে, নরকের প্রহরী ভয়ঙ্কর কুকুর সেরবেরাসের মূর্তি গ্রিক পুরাণের মেডুসার  গল্প আমরা তো সবাই জানি। মেডুসা ছিলেন অপরূপা সুন্দরী। সমুদ্রের দেবতা পসাইডন তাঁকে দেবী এথেনার মন্দিরে ধর্ষণ করেন। নিজে কোনো অপরাধ না করলেও দেবতাদের ক্রোধ থেকে মেডুসা রেহাই পাননি। রুষ্ট দেবী এথেনার অভিশাপে তাঁর মাথার চুলগুলো অগুনতি সাপে পরিণত হয়, মুখ হয়ে যায়  বীভৎস চোখের দিকে যে কেউ তাকালেই মুহূর্তের মধ্যে সে পাথরে পরিণত হত। দেবতাদের রাজা জিউসের ছেলে বীর পারসিউস তখন মেডুসার দিকে সরাসরি না তাকিয়ে একটা ঢালে প্রতিচ্ছবি দেখে তাঁর মুণ্ডচ্ছেদ করেন। বেলভেদিয়ার উদ্যানে মেডুসার কাটা মাথা হাতে নিয়ে পারসিউসের মূর্তি দেখা মাত্র সেই গল্পটা চট করে মনে পড়ে গেল। অ্যাপোলোর মূর্তি দেখে মনে পড়ল, আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন  করেছিলেন ্মানুষ না থাকলেও কি এই মূর্তি সুন্দর থাকবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, না।
পার্সিয়ুস


লাকুন
 অ্যাপোলো

      ওখান থেকে আমরা গেলাম ভ্যাটিকানে পোপের প্রধান প্রার্থনাগৃহ সিস্টিন চ্যাপেল  চ্যাপেলের সিলিং-এর ভিত্তিচিত্র মিকেলাঞ্জেলোর আঁকা। এখানে আছে  ‘Nine Episodes of Genesis’, যার মধ্যে ‘Creation of Adam and Eve’ নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বিখ্যাতবাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টি, মানুষের পতন ও নোয়ার গল্প ইত্যাদি, অনেক চিত্রের মধ্য দিয়ে রূপ দিয়েছেন তিনি মিকেলাঞ্জেলোর  জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ  চিত্রাঙ্কন কীর্তি ‘The Last Judgement’ এই রয়েছে এক পাশের দেয়ালে। সিস্তিন চ্যাপেলের ওই অতবড় হল ঘরটায়  তিল ধারণের জায়গা নেই। কিন্তু কোনো দর্শকের মুখে টুঁ শব্দ নেই। সকলে অপার বিস্ময়ে বাকশূন্য-বিমুগ্ধ হয়ে ছবিগুলো নিরীক্ষণ করে মনের খিদে মেটাচ্ছিল। দেখুন, আমরা কজন আর শিল্পীর তুলির টানের মানে পুরোপুরি বুঝি। কিন্তু অত বছরের পুরানো ছবি এত ভালোভাবে সংরক্ষণ করা আছে যে তা এতদিন পরেও আমাদের মত সাধারণ দর্শকদের কাছে অসম্ভব মনোগ্রাহী, অসম্ভব জীবন্ত।
আদমের সৃষ্টি, সিস্টিন চ্যাপেল
      ভ্যাটিকান মিউজিয়াম থেকে আমরা গেলাম সেন্ট পিটার্স গির্জা দেখার জন্য। কিন্তু প্রায় দেড়হাজার লোকের লাইন দেখে বাধ্য হয়ে ফেরত চলে এলাম। ফ্লোরেন্স আর রোমের সারা ট্রিপে আমরা ভালমত  ব্রেকফাস্ট করে বেরোতাম। তারপর সারাদিন যেখানে যা পেতাম। কিন্তু রাত্রের খাওয়াটা খেতাম জমিয়ে। ওইদিন তাড়াতাড়ি ফিরেছি ভ্যাটিকান দেখে। রোমে আমাদের হোটেলের পাশের চিনা রেস্তঁরাটার খাবার বেশ পছন্দ হয়েছিল। মালকিন একজন চিনা মহিলা। বেশ খাতির করেন। সারাদিন প্রচণ্ড পরিশ্রম করেন। তারই মধ্যে ছুটোছুটি করে নিজেই অর্ডার  লিখে নিয়ে যান।  বিদেশে  সব হোটেল বা রেস্তঁরায় ঢুকলে ওরা ওয়াইন (রেড/হোয়াইট) নেব কিনা প্রথমেই জানতে চায়। বিদেশীরা সবসময় ওয়াইন চায়। কারণ সাদা জলের দাম ওয়াইনের থেকে বেশি। আমরা অনায়াসে হোটেলের বেসিনের কলের জল খেতাম। সেই জলই বাইরে বেরোনোর সময় বোতলে ভরে সঙ্গে নিতাম। কোনো সমস্যা হয়নি। তাই তিন ইউরো দিয়ে একবোতল জল কিনতে বড্ড গায়ে লাগত। কিন্তু সঙ্গের ব্যাগ থে
কে জলের বোতলটাও যে বার করব তার ও উপায় নেই। কারণ গৌতম আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছে। ওখানে হোটেলে বসে হোটেলের থেকে জল না কিনে অন্য জল বার করে খাওয়া নাকি ডিসিপ্লিনের বাইরে পড়ে। অগত্যা জল কিনতেই হল।
      এদিকে খিদেতে অবস্থা খারাপ। বেশ কদিন পর দুপুরে হোটেলে খাচ্ছি বলে ভাত খাবার সুপ্ত ইচ্ছে জেগে উঠল। সাদা ভাতকে ওখানে বলে বিয়াঙ্কো রাইস। কিন্তু সাদা ভাতের সাথে ভালো লাগবে এমন খাবার খুঁজে পেলাম না। তাই সাদা ভাতের সঙ্গে কোনটা ভালো লাগবে মালকিনের কাছে জানতে চাইলাম। কিন্তু বিপত্তি ঘটল ভাষায়। উনি চিনা ভাষার বাইরে ভালো জানেন কেবল ইতালিয়ান। আর আমরা দুটোর কোনোটাই জানি না। ফলে যা হবার তাই হল। উনি ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে আমাদের বেশ গুছিয়ে বলতে শুরু করলেন সাদা ভাতের রন্ধন প্রণালী। হায় রে পোড়া কপাল! বাঙালীকে নাকি রোমে গিয়ে ভাত রাঁধা শিখতে হবে! ওনার বলা শেষ হলে আমরা যা মন-প্রাণ চায় অর্ডার দিয়ে খাওয়া সারলাম। আপনি ভাবুন না একবার, সাদা ভাতের সাথে গার্লিক পোলো (পোলো মানে মুরগির মাংস), বা ক্রাব রোস্ট বা ফ্রগ লেগ কেমন লাগতে পারে? তারপর আর একদিনও ভাত খাবার নামই করিনি ওখানে!
      সেদিন বিকেলের দিকে আমরা গেলাম ‘Spanish Steps’  দেখতে। অনেক উঁচুতে বানানো একটা বড় প্রাসাদের সামনে ১৭২৩-১৭২৬ সালে  বিশাল চওড়া অনেকগুলি সিঁড়ি, সিঁড়ির দুই ধারে আর মাঝে ফুলের শোভা। বহু লোক সিঁড়ির ধাপগুলোতে বসে গল্পগুজব করছে। আমরাও বসে খানিকক্ষণ গল্প করলাম, আইসক্রিম খেলাম। সামনের চাতালে আবার সুন্দর সুন্দর মুর্তির থেকে ফোয়ারায় জায়গাটার শোভা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। পাশেই ছিল কবি শেলির বাড়ি। বাইরে থেকে সেটা দেখলাম। এই বাড়িতেই তিনি শেষ করেছিলেন অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে মানবমুক্তির দিশারী তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘Prometheus Unbound’

সেন্ট পিটার্স
      আগের দিন আমরা সেন্ট পিটার্সে ঢুকতে পারিনি, তাই পরের দিন বেশ তাড়াতাড়ি  গেলাম।  দেখি প্রায় আগের দিনের মতই বড় লাইন। এক ঘন্টার বেশি লাইনে দাঁড়িয়ে তবে ব্যাসিলিকায় প্রবেশাধিকার পেলাম। আগেই বলেছি এটা রোমান ক্যাথালিকদের সবচেয়ে প্রধান চার্চ। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হল মিকেলাঞ্জেলোর বানানো ‘পিয়েতা’ মূর্তিটি, তাঁর প্রথম বড় শিল্পকর্ম (১৪৯৯ সাল)। ক্রশ থেকে নামানোর পর যিশুকে মাতা মেরি কোলে নিয়ে বসে আছেন। ডোমটা বারবার ভেঙে নতুন করে বানানো হয়েছে। এখনকার ডোমটার নক্সা মিকেলাঞ্জেলোর ডোমের ভেতরের ছাদে, দেওয়ালে অসাধারণ চিত্র।  ভেতরে বিভিন্ন সেন্টদের মূর্তি, পোপদের মূর্তি আছে। যিশুর সাক্ষাৎ শিষ্য প্রথম পোপ সেন্ট পিটার, যাঁর নামে এই গির্জা, তাঁর দেহাবশেষ এখানে সংরক্ষণ করে রাখা আছে বলে ক্যাথলিকদের বিশ্বাস গির্জার বাইরে এসে দেখি এক জায়গায় বেশ ভিড়-- পোপের পাহারাদার বিখ্যাত সুসজ্জিত ‘Swiss Guard’-দের প্যারেড করে ডিউটি বদল হচ্ছে। অভিনব লাগল। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পোপের নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল, তারপর পোপ বাহিনী ভেঙে দিয়ে ৫০ সদস্যের এক রক্ষীবাহিনীর ব্যবস্থা করেন। এই রক্ষীবাহিনীর সকলেই সুইজারল্যাণ্ডের নাগরিক। ষোড়শ শতাব্দীতে রক্ষীদের পোশাকের নক্সা করেন মিকেলাঞ্জেলো। 

মিকেলাঞ্জেলোর হাতে নির্মিত সেন্ট পিটার্স চার্চের ডোম

 
 পিয়েতা
      পরের দিন আমাদের রোম থেকে ফেরার পালা। সকাল সাড়ে এগারোটায় রোম এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাইট। মন না চাইলেও ফিরে আসতে হবে তিনতরেত্তোর দেশ থেকে। যদি জানতে চান প্রথম ইউরোপ দর্শনে কোন শহরটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে, বলব রোম। রোমে একদিকে যেমন আছে প্রাচীনত্বের হাতছানি; তেমনি আছে আধুনিকতার ছোঁয়া। কলোসিয়াম বা রোমান ফোরামে যখন ঢুকেছি, মনে হয়েছে পৌঁছে গেছি প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যে আবার আধুনিক রোমের রাস্তাঘাট, দোকান বাজার, হোটেলের খাবার দাবার, যানবাহনের সুবিধা সবই ভালো লেগেছে। ‘Angelinibedrooms’-এ আমাদের ঘর ‘ভেনাস’ ছিল ভীষণ সুন্দর। অ্যাটেন্ডেন্ট ছিলেন একজন মহিলা। আমাদের ঘরের বাইরের বারান্দায় ওঁর অফিস। আমরা যাবার পরপরই একটা ম্যাপ দিয়ে কোথায় কোথায় কীভাবে ঘুরব সব বুঝিয়ে দিলেন। প্রতিদিন ওই সুবেশিনী মহিলা গাড়ি চালিয়ে এসে অফিসে কাজ করতেন। ইন্টারনেটে বিভিন্ন দেশের লোকেদের সাথে ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে যোগাযোগ করতেন, স্কাইপেতে কথা বলতেন; আবার আমরা ঘুরতে বেড়িয়ে গেলে স্বয়ং উনিই সব ঘর, বাথরুম যত্ন করে পরিষ্কার করে দিতেন। ওখানে শ্রমের মূল্য এত বেশি যে কাজ সম্পর্কে কারোর কোনো ছুঁৎমার্গ নেই।
      জিনিসের দাম সব শহরেই বড্ড বেশি লেগেছে আমার। সেটা অবশ্য সত্তর দিয়ে গুণ করার জন্য। বুঝলেন না তো? ভেঙে বলি তাহলে। আমরা যখন ওখানে যাই, তখন এক ইউরো সমান ছিল আটাত্তর টাকা  ত্রিয়েস্তেতে পৌঁছে যা-ই কিনতে যাই, মনে হচ্ছিল ‘বাবা এত দাম!’ আসলে প্রথমবার বিদেশ যাওয়া, তাই অনভ্যস্ত আমি ওখানকার সবকিছুই ভারতীয় টাকার অঙ্কে হিসাব করে ফেলছিলাম। গৌতম আমাকে একদিন বকুনি লাগাল, ‘কোনো কিছু কেনবার সময় যতক্ষণ না তুমি ঐ সত্তর দিয়ে গুণ করা বন্ধ করছ, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি বেড়ানোটা উপভোগ করতে পারবে না। সত্তরের নামতা ভুলে যাও’ কিন্ত আপনাদের মিথ্যে বলে লাভ নেই-- কোনো জিনিস কেনার সময় ওকে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে আমি সেই গুণ করেই ফেলতাম।
      প্রথম ইউরোপ ভ্রমণের স্মৃতি কিছুদিন পর হয়তো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসবে; কিন্তু বেশ  কিছু প্রাচীন গ্রিক, রোমান মূর্তি ভোলবার নয়। চোখ বন্ধ করলেই যেন ভ্যাটিকানে র‍্যাফায়েলের আঁকা ছবিগুলো, বা সিস্তিন চ্যাপেলে মিকেলাঞ্জেলোর ‘The Last Judgement’ দেখতে পাই। একই দেব-দেবীর মূর্তি বা ছবি বিভিন্ন শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় বিভিন্ন রূপে ফুটে উঠেছে। যেমন বাক্কাস। কৃষি আর মদের এই রোমান দেবতাকে দেখেছি কোথাও মদের পেয়ালা হাতে আবার কোথাও এক থোকা আঙুরের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে বাক্কাস ছিলেন দেবতা জিউস আর সেমিলির সন্তান। সেমিলি মানব কন্যা হলেও অমর ছিলেন। জিউস-এর স্ত্রী হেরা চক্রান্ত করে সেমিলিকে বোঝান যে তিনি যেন জিউস-এর দেবতা রূপ দর্শন করতে চান। কিন্তু কোনো মানুষ জীবন্ত অবস্থায় কোনো দেবতাকে তার আসল রূপে দর্শন করতে পারে না। জিউসের তেজে সেমিলি দগ্ধ হয়ে যান। তখন জিউস নিজের জানুতে সেমিলির গর্ভের সন্তানকে সেলাই করে রাখেন। ঘটনাটির নয় মাস পর বাক্কাস-এর জন্ম। উনি রোমান দেবতা। মিকেলাঞ্জেলো গ্রিক মূর্তি রূপে এটি গড়লেও রোমান আবেগে তা ফুটিয়ে তুলেছেন।

     ফিরে এসেছি বেশ কিছুদিন হল। বেড়িয়ে আসার মধুর স্মৃতি মন্থন করতে ভালই লাগছিল। দেখা হলেই চেনা মানুষকে ওখানকার মত অভ্যাসবশত ‘Good morning’, ‘Hello’ এইসব বলছি। কিন্তু কাজের চাপে ক্রমশ সব ফিকে হচ্ছে। গতকাল হঠাৎ ঘুম ভাঙল একটা খারাপ স্বপ্নে। সারা রাত ধরে অসংখ্য সাইকেল মাথার ওপর দিয়ে বনবন করে কেবলই ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছুতেই নামছে না যে! তাতে না পারছি নিজে চাপতে, না পারছি কাউকে চাপাতে। কিন্তু ওগুলো না নামাতে পারলে আমার গর্দান যাবে। কী ভয়ংকর স্বপ্ন! ওগুলো ‘সবুজসাথী’ র সাইকেল। আসলে আগের দুদিন নাওয়া খাওয়া ভুলে স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রীদের নাম অনলাইনে ঢোকাতে পারিনি ওয়েবসাইটের সমস্যার জন্য। ফিরে আসার পরপরই ‘সবুজসাথী’ আর ‘সিসিএল’ এর সাঁড়াশি আক্রমণে আমি ক্লান্ত, বিপর্যস্ত; সঙ্গে শিক্ষাশ্রী-কন্যাশ্রীতো আছেই! তার মাঝেও কখনো কখনো  দেখতে পাই গগনচুম্বি ক্রেনে চেপে স্ফিংসের বিশাল মূর্তিগুলো আইদার মঞ্চে নেমে আসছে। এখনো চোখ বন্ধ করলেই মিকেলাঞ্জেলোর ‘ডেভিড’ কে বা ‘ক্যাপিটলাইন ভেনাসকে’ আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। হয়তো চিরকালই ঐ প্রাচীন গ্রিক-রোমান মূর্তি আমার চারপাশে থাকবে।


প্রকাশিতঃ সৃষ্টির একুশ শতক, জুন ও জুলাই সংখ্যা, ২০১৬