Friday, 4 September 2020

বিষুবরেখার দক্ষিণে প্রথমবার (৪)






  







 

বিষুবরেখার দক্ষিণে প্রথমবার                   (৪ )

এই লেখার আগের পর্বগুলিঃ 

বিষুবরেখার দক্ষিণে প্রথমবার (১)- সিডনি 

বিষুবরেখার দক্ষিণে প্রথমবার (২)- কেয়ার্ন্স

বিষুবরেখার দক্ষিণে প্রথমবার (৩) - ফিলিপ আইল্যান্ড ও মেলবোর্ন (১)


মেলবোর্ন  থেকে শেপার্টন

এরপর যাব ঐতিহাসিক মেলবোর্ন ক্রিকেট মাঠে। হেঁটেই। ইয়ারা নদীর পাশ দিয়ে গল্প করতে করতে পৌঁছে গেলাম ইয়ারা পার্কে, যেখানে বিশ্বের দশম বৃহত্তম স্টেডিয়াম এমসিজি চাক্ষুষ করলাম। ১৮৫৩ সালে তৈরি হলেও এই স্টেডিয়াম ক্রমে ক্রমে অভিনবত্ব পেয়েছে। এই মাঠ দেখেছে ১৯৫৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক, ২০০৬ সালের কমনওয়েলথ গেমস, ১৯৯২ আর ২০১৫ সালের দুটো ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ১৮৭৭ সালের প্রথম টেস্ট ম্যাচ আর তার প্রায় এক শতাব্দী পরে ১৯৭১ সালের প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের সাক্ষীও এমসিজি।এছাড়া অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল, রাগবি, সকার ইত্যাদি এই মাঠে বহুবার খেলা হয়েছে।

এমসিজির বাইরে ডেনিস লিলির মূর্তি (বাঁদিকে) ও রড লেভার এরিনা (ডানদিকে)

একজন গাইড সহ মাঠ আর এমসিজির বিখ্যাত মিউজিয়াম ঘুরে দেখার জন্য অনলাইনে টিকিট ইন্দ্রনীলদার কল্যাণে আমাদের আগেই কাটা। ঢোকার মুখেই দেখি আগুন ঝরানো বোলার ডেনিস লিলির বিশাল মূর্তির সামনে অসংখ্য চিনা পর্যটকদের ছবি তোলার ভিড়---কেন সে উত্তর তারাই জানে! ভাবলাম ছবি তুলব, কিন্তু কাছে ঘেঁষার উপায় নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে এলাম, ফেরার পথে অবশ্য ছবি তুলতে ভুল হয়নি। ক্রিকেট বিশ্বের প্রবাদ পুরুষ ব্র্যাডম্যানের মূর্তিও আছে। তেন্ডুলকার ও ব্র্যাডম্যানের সাক্ষাৎকারের ছবি, অজিত ওয়াদেকর সহ বহু ভারতীয় ক্রিকেটারের ছবি ও ব্যবহৃত ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম ---সবই যত্ন করে সাজানো আছে। গাইডের সঙ্গে আমরা ও অন্যান্য দেশ থেকে আসা পর্যটকরা প্রথমে মাঠ পরিদর্শনকরলাম---সে এক দারুণ অনুভূতি। স্টেডিয়ামের সব কিছু গাইড ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন।ক্রিকেট ইতিহাসের প্রারম্ভিক সময় থেকে বহু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ধরা আছে নানা ছবিতে ও অন্যান্য সামগ্রীতে। এরপর ঢুকলাম স্টেডিয়াম সংলগ্ন স্পোর্টস মিউজিয়ামে।ডিজিটাল এক্সপিরিয়েন্স ল্যাবরেটরিতে মনে রাখার মত কিছু অভিজ্ঞতায় ঝুলি ভরলাম। শেন ওয়ার্নের লেজার মুভি যেন জীবন্ত। দুপুরের খাওয়া সারা হল ওখানকার রেস্তঁরাতেই, সকাল থেকে মেলবোর্ন শহরে ঘুরে ঘুরে আমরা তখন বড়ই ক্ষুধার্ত।

এমসিজির মাঠ

ফেরার পথে পড়ল মেলবোর্নের শিল্পকলা কেন্দ্র ফেডারেশন স্কোয়ার। শহরের মাঝখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে।২০০৯ সালে ‘ভার্চুয়াল টুরিস্ট ওয়ার্ল্ড’ এর র‍্যাঙ্কিং একে পঞ্চম ‘কুৎসিত বিল্ডিং’ এর শিরোপায় ভূষিত করা হয়েছিল। যুদ্ধকালীনবোমানিরোধীবাঙ্কারের অনুরূপ ‘সামরিক ছদ্মবেশী’ রঙের কারণে। তবে পর্যটক হিসাবে আমার কিন্তু মন্দ লাগেনি। উল্টোদিকেই মেলবোর্নের সবচেয়ে পুরানো পাবগুলোর একটা ইয়ং অ্যান্ড জ্যাকসন; গৌতমরা সেখানে ঢুকল বিয়ারের সন্ধানে। শতাব্দীপ্রাচীন পরিবেশকে ধরে রাখার চেষ্টা রয়েছে, তবে দামের দিক থেকে নিতান্তই আধুনিক।

সকালে যেখানে গাড়ি পার্ক করা ছিল শহর পরিক্রমা শেষে সেখানেই ফেরা। এবার যাত্রার একটা বিরাট আকর্ষণ হল পথ। ইন্দ্রনীলদা জানালো আমরা পথে জিলং হয়ে গ্রেট ওশান রোড ধরব। মেলবোর্ন শহর থেকে সোয়া ঘণ্টার রাস্তা টর্কি,যেখান থেকে বিখ্যাত গ্রেট ওশান রোড শুরু। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ পূর্ব উপকূল ধরে এই রাস্তা প্রায় ২৪১কিলোমিটার চলে গেছে এলানসফোর্ড পর্যন্ত। আমরা টর্কি ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়ে রাস্তারওপর দিয়ে কাঠের একটা বিশাল মেমোরিয়াল আর্চের সামনে থামলাম।

বিখ্যাত এই রাস্তাটার সম্পর্কে কিছু সুন্দর মুরাল আর তথ্য জানলাম আর্চের ধারের ফলক থেকে।প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড থেকে যাওয়া সৈনিকরা যুদ্ধশেষে বিজয়ী হয়ে দেশে ফিরেছিল বটে, কিন্তুপুরনো পেশাতে তাদের জায়গা হারিয়েছিল। সৈনিকদের কাজে নিযুক্ত করার জন্য একটা পরিকল্পনা করা হয়। যে সব বীর সেনারা যুদ্ধে মারা যান তাদের স্মৃতিতে ‘গ্রেট ওশান রোড’ নামে একটা ট্রাস্ট ১৯১৭ সালে গঠিত হয়।মানুষের স্বেচ্ছা দানে ভরে ওঠে এই ট্রাস্ট। যুদ্ধ শেষে প্রায় তিন হাজার প্রাক্তন সেনা শাবল গাঁইতি নিয়ে প্রবল উদ্যমে নেমে পড়লেন আশপাশের সম্পদ কাজে লাগিয়ে বিখ্যাত ঐতিহাসিক রাস্তা তৈরিতে।নিহত বীর সেনাদের স্মৃতিতে এই রাস্তার প্রথম অংশ শেষ হওয়ার পর ১৯৩৬ সালের অক্টোবর মাসে অস্ট্রেলি সরকার এই রাস্তা তৈরির দায়িত্ব হাতে নেয়।এই মহৎ উদ্যোগকে সেলাম জানালাম।

মেমোরিয়াল আর্চ, গ্রেট ওশান রোড

নীলাম্বুরাশির অতন্দ্র তরঙ্গের ফাঁকে ফাঁকে শুভ্র ফেনিল সমুদ্রতটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কলমন্দ্রমুখরা পৃথিবীর দিকে চেয়ে খানিক থমকালাম! বিস্ময়ে বিমূঢ়! চারিদিকের নির্জনতার মাঝে পাথুরে ব্যাসল্ট উপকূলে নীল সমুদ্র যেন আসমানের নীলকে টক্কর দিতে চাইছে।বড় বড় ঢেউয়ের মাথা খাড়াই পাথরে অনবরত ধাক্কা খেয়ে ফোয়ারার মত ফেটে চৌচির। সারি সারি সমুদ্র সফেন হামাগুড়ি দিয়ে ঢালু পাড়ে ক্রমশ উঠে আসছে।সেদিন রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশের নিচে ভরা জোয়ারের খেলার সাক্ষী কেবল বুঝি আমরাই ছিলাম। উঁচু পাড়েদাঁড়িয়ে অসীম দিগন্তকে ছোঁয়া অনন্ত-সমুদ্রে বিভোর হলাম।অবশেষে ঘোর কাটিয়ে সঙ্গের খাবার গুলোর সদ্ব্যবহার, আর কিছু ফটো সেশন। ইন্দ্রনীলদাসবার ছবি আলাদা আলাদা করে তুলল।

লর্নের সমুদ্রসৈকত

       সন্ধ্যা নাগাদ আমরা সমুদ্র পাড়ের লর্ন নামে একটা জায়গায় পৌঁছলাম। রাতটুকু সেখানে কাটানোর জন্য ইন্দ্রনীলদা আগে থেকেই একটা দারুণ হোটেল বুক করে রেখেছিল।হোটেল থেকে সমুদ্র একেবারে সামনেই। চমৎকার ভিউ।হোটেলে খানিক বিশ্রাম, কফি সহ খানিক আড্ডা দিয়ে সূর্য ডোবার রক্তিম মুহূর্তে আবার ঝোড়ো হাওয়ার দামাল সমুদ্রের ক্রমাগত গর্জনরত ঢেউ আমাদের ঘরছাড়া করল।ওখানেরেস্তরাঁর সংখ্যা কম আর তারা তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায়, তাদেরই মধ্যে সাজানো-গোছানো একটাতে লণ্ঠনের আলোয় আমরা জমিয়ে ডিনার সারলাম।তারপর রাতের সমুদ্রকে একেবারে কাছ থেকে অনুভব করে ফিরলাম। আমরা সবাই বেশ খানিকক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে সমুদ্র গর্জন শুনলাম। উদ্দাম উত্তাল সেই রাতের সমুদ্র যেন বাতাসের স্পর্ধায় মাতাল হয়ে ধৈর্য হারিয়েছিল। বুঝলাম নির্জন লর্ন কেন ইন্দ্রনীলদাদের খুব পছন্দের জায়গা!অতন্দ্র তরঙ্গের সাক্ষী হতে আগে বেশ কয়েকবার এসেছে ওরা।

লর্নের হোটেলে আড্ডা


পরদিন সকালে সমুদ্র ধরে যেতে যেতে একটা অদ্ভুত সুন্দর জায়গায় ইন্দ্রনীলদা গাড়ি দাঁড় করালো। সমুদ্রতট অসংখ্য ছোট বড় রক-পুলে ভরা। মানে কঠিন ব্যাসল্ট পাথরে ছোট বড় অগুনতি গর্ত।কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবীর বাইরের খোলটা তৈরি হওয়ার সময়ে সমুদ্রের তলাটাও নানা বৈচিত্র্যময় টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছিল। পৃথিবীর ভেতর থেকে গরম ম্যাগমা অসংখ্য ছোট বড় ফাটল দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে জমাট বেঁধেছিল। ফুটন্ত তরল লাভার স্রোত আছড়ে পড়া সমুদ্রফেনার মতো চারিদিকে ছিটকে পড়েছিল। লাভা স্রোতের ভেতরে বুদবুদ হয়ে আটকে থাকা গরম বাষ্প বাইরের ঠাণ্ডা আবহাওয়ার ছোঁয়ায় ফেটে চারপাশের শীতলতায় নানা ছিদ্র যুক্ত হয়ে বা গর্তের আকারে জমে যায়। ব্যাসল্ট উপকূলে অসংখ্য ছোট বড় জমাট হয়ে যাওয়া গর্তগুলো জোয়ারের ঢেউয়ের আসা যাওয়ার পথে পাথরের মধ্যে জলভর্তি গর্ত বা রক-পুল হয়ে আছে। নানা জলজ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণের স্পন্দনে! নিরিবিলিতে।

লর্নের বেলাভূমিতে 



আমরা যে যার মতো করে সাবধানী অনুসন্ধিৎসু হয়ে নানা রঙের স্যাঁতস্যাঁতে শ্যাওলা মাখা তটের বৈচিত্র্য দেখতে লাগলাম। সঙ্গে ছবি তোলা। জোয়ারের টানে জলোচ্ছ্বাস বেশি। দূরে দিগন্তে আকাশের নীল ফিকে। মাথার ওপরের নীলাম্বর তার সবটুকু রঙ ঢেলে নীচের জলধিকে নীলাম্বরী করেছে। দূরের আধাডুবো পাথরগুলোর কচ্ছপের পিঠের মত সমুদ্রমুখী ঢাল বেয়ে বিরামহীন ভাবে লহরীর পর লহরী সাদা ফেনারধূমায়মান চূড়া যেন ছুঁতে চাইছে ওপরের মেঘগুলোকে। তারপর সশব্দে আছড়ে পড়ছে পাথুরে তটে। স্বচ্ছ জলের ফেনায় সিক্ত উপলে প্রতিটা ঢেউ রেখে যাচ্ছে মহীসোপান থেকে বয়ে আনা ক্ষুদ্র জলজ কোনো জীবন্ত উদ্ভিদ বা কীটের স্বাক্ষর। সেই গেঁড়ি গুগলি বা শ্যাওলা কাছেপিঠের রক-পুলে চটজলদি ডেরা খুঁজে নিতে না পারলেই আবার দ্বিধাহীন উদ্দেশ্যহীন হয়ে ভেসে যাচ্ছে সমুদ্রমুখী পরবর্তী ঢেউয়ের টানে। এই কর্মকাণ্ড সেই আদিকাল থেকেই তো হয়ে চলেছে! এইসব দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটল। আগুয়ান একটা ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রুত পিছু হাঁটতে গিয়ে গৌতম শ্যাওলা ধরা পাথরে পা পিছলে ভূপতিত হল।হাতের ক্যামেরা ফসকেপাথরে ধাক্কা খেয়ে নোনা জলে নিমজ্জন ও বিকল হওয়া আটকানো গেল না। মনটা আমার খারাপ হলেও ক্যামেরার মালিকের হল না। বৌয়ের মতোই ক্যামেরারও পুরানো হলে কদর কমে। যা হোক ইন্দ্রনীলদা স্ট্যান্ড লাগিয়ে নিজের ক্যামেরায় প্রচুর ছবি তুলল।

অপরূপা  লর্ন


আবার যাত্রা শুরু, দক্ষিণ পূর্ব উপকূল ধরে আরও দক্ষিণে।ছুটন্ত গাড়ির থেকে দেখছি সমুদ্রের নীল কত ধরনের! আকাশের নীল আর তার ফাঁকে ফাঁকে ভেসে যাওয়া কখনো সাদা কখনো ধুসর মেঘ প্রতিনিয়ত প্রতিবিম্বিত হয়ে সমুদ্রের নানা অংশে নানা ধরণের নীলের উৎসব!


ট্রি টপ

খানিক যাওয়ার পর আমরা উপকূল থেকে সরে এসে ঢুকে পড়লাম এক শীতল নাতিশীতোষ্ণ বৃষ্টি অরণ্যে, অটোয়ে পাহাড়ি এলাকায়। ঢোকার মুখেই দেখি পাহাড়ের ঢালে বুনো ফুলের প্রাকৃতিক সমারোহ। শুধু তাই নয়, আমাদের অভ্যর্থনায় পায়ের তলায় সবুজ গালিচা পাতা আর দুপাশে স্যালুট জানাচ্ছে সারি সারি সুউচ্চ সবুজ সেনানীর দল। কলকল্লোলিনী উচ্ছল নীল সমুদ্র ছেড়ে ঢুকে পড়লাম ছায়াঘন নিবিড় বনে। আমরা এখানে গাছের মাথা দিয়ে হাঁটব। অটওয়ে ট্রি-টপ ওয়াকিং। ছ’শো মিটার লম্বা পথ বনের মধ্যে এঁকে বেঁকে ঢুকে গেছে। নীচের থেকে ২৫ মিটার উচ্চতায় সুদীর্ঘ রেলিং-এর মাধ্যমে।অভিনব অভিজ্ঞতা। রেলিং ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখি সত্যিই উঁচু উঁচু গাছগুলোর মগডালের পাশে পাশে বা কখনো একেবারে চূড়া ছুঁয়ে হেঁটে চলেছি। একেবারে অবিশ্বাস্য! অনেকটা নীচে বনের স্যাঁতস্যাঁতে মাটি ঢেকে আছে নানা প্রজাতির মস, ফার্ন, আর ঘন ঝোপে। লতানে গুল্ম বড় বড় মহীরুহকে জড়িয়ে ওপরের দিকে চাঁদোয়া তৈরি করেছে। 

সামনে এক জায়গায় দেখি বিশাল উঁচু এক টাওয়ার। প্যাঁচালো সিঁড়ি বেয়ে তার উপরে উঠতে বেশ রোমাঞ্চ! তার একদম উপরে উঠে নীচের আর চারদিকের পাহাড়ঘেরা বনভূমির দৃশ্য অভূতপূর্ব। কত প্রাচীন গাছ বিশাল উচ্চতায় দাঁড়িয়ে। তাদের মাথাও আমাদের দৃষ্টিগোচর। টাওয়ার থেকে নেমে আরেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। অত উঁচু আর দীর্ঘ রেলিং-এর একটা লম্বা অংশ দেখি ক্যান্টিলিভার হয়ে নীচের বনভূমির ওপর ঝুলে আছে। সেদিকটায় খুব বেশি পর্যটক ভয়ে যাচ্ছে না। শরীরের ওজনে সেটা ভীষণ কাঁপছে।আমাদের দলেরও সবাই গেল না। আমি ঝুলন আর ঐন্দ্রিলা ঐ লম্বা ঝুলন্ত রেলিং-এর শেষ প্রান্তে গিয়ে গৌতমকে দিয়ে ছবি তোলালাম। আমাদের ওজনে আর হাওয়ার দোলায় দেখি ভাল মত দোল খাচ্ছি। কেউ কেউ আবার লাফাচ্ছে শেষ প্রান্তে পৌঁছে,বলাই বাহুল্য সেই অভিজ্ঞতা আরও সাংঘাতিক! তলা দিয়ে তির তির করে বয়ে যাচ্ছে একটা পাহাড়ি ঝোরা।

যা হোক ফেরাটা কিন্তু ওপরের রেলিং দিয়ে নয়। বনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে। যে যার মতো পর্যবেক্ষণ করতে করতে এগিয়ে যাওয়া আর ছবি তোলা। আমি একটা বিশাল উঁচু মাউন্টেন অ্যাশের সামনে গৌতমকে দাঁড় করিয়ে ছবি তুললাম গাছটার সঙ্গে মানুষের উচ্চতার তুলনামূলক বিচার করতে। গাছটা অন্তত আশি মিটারের বেশি উঁচু হবে। ধুসর রঙের প্রকাণ্ড মোটা কাণ্ড। প্রাচীনত্বের নিদর্শন হিসাবে তলার অনেকটা অংশ গাঢ় খয়েরি রঙের মোটা বাকলের মোজা পরে আছে যেন! তলার স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা মাটি পেয়ে ফার্ন গাছগুলো দোতলা বাড়ির সমান উঁচু আর বিরাট বিরাট আকৃতি নিয়েছে। আর কত ধরনের ফার্ন! এক জায়গায় দেখি সাইন বোর্ডে লেখা ক্যাঙারু ফার্ন। অদ্ভুত দেখতে। অনেক মহীরুহের কাণ্ড ঢেকে আছে নানা আকৃতি আর রঙের ছত্রাক আর মস দিয়ে।ওপর থেকে দেখা সেই পাহাড়ি ঝোরাটার পাশ দিয়ে এবার যাওয়া। ছায়া ঘনিয়ে আছে  বনে বনে।চুরি করে ঢুকে পড়া হাওয়া এঁকেবেঁকে গাছের পাতায় পাতায় আর পাথরে ঠোক্কর খেয়ে কুলকুল করে বয়ে যাওয়া ঝোরাটার জলে মৃদু শিহরণ জাগিয়ে যাচ্ছে! অরণ্যের নিবিড় শ্যামলিমা একান্ত গোপনে ডুব দিচ্ছে সেই শিহরণে। তার তালে তাল মিলিয়ে জলকেলি আর দৈনন্দিন ব্যস্ততায় মেতেছে কলস্বনা একদল খেচর।আমরা বেশ গড়িমসি করে চারপাশ দেখতে দেখতে ফিরলাম। অরণ্যের বাইরে ঘাসের গালিচায় খানকতক গ্রুপ ছবি আর খাওয়া দাওয়া।তারপর আমাদের দশজনের দলকে নিয়ে দুটো গাড়ির আবার সমুদ্রমুখী ছোটা।


অটওয়ে


গিবসন স্টেপস্‌

কেপ অটওয়ে পেরিয়ে আরও দক্ষিণমুখী।হাজির হলাম অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া প্রদেশের দক্ষিণ উপকূলে।পোর্ট ক্যাম্পবেল ন্যাশনাল পার্কে। গিবসন স্টেপস্ নামে একটা জায়গায় আমরা থামলাম।দুপুরের আলোয় সমুদ্র এখানে ময়ূরকণ্ঠী নীল। সমুদ্র পাড় অসম্ভব খাড়াই।প্রায় ৭০-৮০ মিটার উঁচু। ৮৬টা খাড়াই সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের তটভূমিতে।আমি গৌতম আর ইন্দ্রনীলদা ছাড়া দলের অন্যরা নামল না। নীচে নেমে যে অসামান্য প্রকৃতিকে সামনে পেলাম তা ভোলার নয়। অঞ্চলটা পুরোটা চুনাপাথরের। হাজার হাজার বছর ধরে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়েছে পাড়ে। নোনা জলের সাথে চুনাপাথর রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ক্রমাগত ক্ষয়ে এইরকম খাড়াই পাড় সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন যুগের জমাট বাঁধা চুনাপাথর আর কাদামাটির স্তরগুলো চিত্রবিচিত্র রঙে উপকূল ঘেঁষেধাপে ধাপে খাড়াই হয়ে উঠে গেছে।সামনের আপাত শান্ত নীল-সবুজে মেশা সমুদ্রগুচ্ছ গুচ্ছ সাদা ফেনা রাশি দিয়ে বালুকাময় তট বারবার ধুয়ে দিচ্ছে। তট বরাবর একটু এগিয়ে দেখি একটা গ্রটো। মানে পাড়ের একটা খাড়াই অংশ সমুদ্রে আধা ডুবে আছে। সমুদ্রের নোনা জল ক্রমাগত তার গায়ে আছড়ে পড়েক্ষইয়ে দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে পাথরের মাঝখানটাকে। তারপর কালক্রমে ওপরের ছাদটাও গেছে ধসে। ঢিবির মতো জলের ওপর জেগে থাকা পাথরে উঠে ইন্দ্রনীলদার ছবি তোলার কেরামতিতে প্রায় দুশো মিটার দূরের কুড়ি ফুট উঁচু মিনারের চূড়া আমাদের দুজনের ঊর্ধ্ববাহুর আঙুলের স্পর্শে এনে ফেললাম। কিন্তু ওখান থেকে ফেরার সময় বিপত্তি। একটা আগ্রাসী ঢেউ আমাদের পিছন পানে ধাওয়া করে খাড়াই চুনাপাথরের পাড়ের প্রাচীরে কোণঠাসা করে একেবারে জবজবে করে ভিজিয়ে ছাড়ল। খুব মজা পেলাম ঢেউটার কাছে হার মেনে।


টুয়েল্ভ এপোস্টলসের অবশিষ্টাংশ


আর একটু এগিয়ে যেতেই দেখি দূরে দূরে সমুদ্রের মাঝে বিশাল উঁচু উঁচু কিছু স্তম্ভ নানান আকৃতি আর আয়তনে দাঁড়িয়ে আছে।ভাবছিলাম, সমুদ্রের মাঝে কাছে-দূরে নানা আকৃতি আর উচ্চতার স্তম্ভের ভাস্কর্যের কারিগর তো প্রকৃতি নিজেই! প্রশান্ত মহাসাগরের অশান্ত পূর্ব অস্ট্রেলিয়ানসমুদ্র-স্রোত পশ্চিমা বাতাসে চালিত হয়ে প্রবল গতিতে আছড়ে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার এই দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে।তার সঙ্গে আবার হাতে হাত মিলিয়ে লুটোপুটি করে ঘূর্ণির সৃষ্টি করে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোত। নরম চুনাপাথর শিলায় শতকের পর শতক ধরে প্রতিনিয়ত নানা দিক থেকে অজস্র খামখেয়ালি ঢেউয়ের কর্মকাণ্ড! সমুদ্র মাঝে সৃষ্টি করেছে নৈসর্গিক স্থাপত্য। কালের নিয়মে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে উপকূলের বিভিন্ন অংশ ক্ষয়ে ক্ষয়ে ধসে গেছে। কিছু কিছু অংশ ঋজু হয়ে সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে, মোকাবিলা করে চলেছে আগ্রাসী ঢেউয়ের।কয়েক দশক আগে পোর্ট ক্যাম্পবেলের পেশাদার সামুদ্রিক মৎস্যজীবীদের সংগঠনটুয়েলভ এপোস্টলস মেরিন ন্যাশনাল পার্ক সংগঠিত করে। উদ্দেশ্য -- প্রাকৃতিক ভাবে দৃষ্টিনন্দন এই মূর্তিগুলি যদি ধরে রাখা যায়। 

টুয়েল্ভ অ্যাপোস্টলস
চুনাপাথরের গুহা, গ্রতো


কিন্তু প্রকৃতি তো তার নিজ নিয়মেই চলবে। বারোটা মূর্তি এখন কমে কমে সাতটাতে এসে দাঁড়িয়েছে। অষ্টম এপোস্টল ধসে গেছে ২০০৫ সালে। একটু এগিয়ে যেতে শুনলাম সামনেই লন্ডন ব্রিজ আছে। ভাবলাম এখানে লন্ডনব্রিজ কেন? সে তো লন্ডনে দেখেছি! সমুদ্রের ওপর ব্রিজ কিভাবে সম্ভব?দেখি ঐরকম একটা চুনাপাথরের স্তম্ভ ব্রিজের মত সমুদ্রে অনেকটা প্রসারিত। ব্রিজেরমাঝের অনেকটা অংশ সমুদ্র গ্রাস করেছে। এ প্রসঙ্গে ইন্দ্রনীলদা একটা গল্প বলল। ১৯৯০ সালে দুজন পর্যটক ঐ আর্চের শেষ প্রান্তে গিয়ে সমুদ্র শোভা দেখছিলেন। হঠাৎ খিলানের মাঝের অনেকটা অংশ ধসে যায়।তারা আটকা পড়েন বেশ অনেকক্ষণ। পরে হেলিকপ্টার গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। কল্পনা করুন তো সেই সময় তাঁদের মনের অবস্থা!

লন্ডন ব্রিজ




এরপর আবার যাত্রা শুরু।আমরা অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণে প্রিন্সেস রাজপথ দিয়ে ছুটে চলেছি। রাস্তাটাই এত সুন্দর যে মন ভরে ওঠে। দুপাশে সারি সারি গাছ দিয়ে সুসজ্জিত, দারুণ দারুণ নানা রঙের ফুলের গাছ। ইন্দ্রনীলদার পাশে বসে সামনের রাস্তা, আকাশের নীল সাদার খেলা দেখতে দেখতে নানান গল্প মজায় মেতে উঠলাম। পথে বিশাল এলাকা জুড়ে একটা ফার্ম হাউস। মিশ্র কৃষি বা শুষ্ক কৃষি চাষের মাধ্যমে এই খামারগুলোতে একই সঙ্গে গরু,শুয়োর,ভেড়াএইসব পশু পালন হয়। দিগন্ত বিস্তৃত চারণভূমি।দূরে সারি সারি আকাশচুম্বী উইন্ড-মিলের ঘূর্ণায়মান পাখা। লোক সংখ্যা কম বলে সবটাই কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, রিপার,হেডার,বড় বড় ট্রাক্টর ইত্যাদি নানান আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে ব্যাপক কৃষি পদ্ধতিতে চাষ। শস্যাবর্তের মাধ্যমে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন।খামারের মাঝে খামারমালিকের একটা সুন্দর বাড়ি। বিশুদ্ধ গ্রামীণ কৃষিবলয়ে ঢুকে পড়েছি। মনে পড়ছিল ছোটবেলাকার স্মৃতির খাঁজে ফিকে হয়ে যাওয়া আমাদের গ্রাম বাংলার ছবি।বাবার মামার বাড়ি আটঘড়া বলে একটা গ্রামে খুব ছোটবেলায় গিয়েছিলাম। সেই আমার প্রথম গরুর গাড়ি চড়া। খড়ের ছাউনি দিয়ে ঘেরা গোলা ভরা ধান!ছায়া সুনিবিড়। সরস। ঠাসাঠাসি করা মাটির বাড়ি আর আল দিয়ে ঘেরা ছোট ছোট ভাগের জমি।বিস্মৃতির তল থেকে হাতড়ানো ছোটবেলার গ্রামের স্মৃতির সঙ্গে এদেশের গ্রামকে একেবারেই মেলানো যাবে না। তফাৎ জনসংখ্যা, প্রযুক্তি আর আর্থিক সংগতির নিরিখে।তফাত জলবায়ুরও।আমাদের যেমন জমির ওপর মানুষের চাপ অনেক বেশি বলে কৃষকের মাথাপিছু আয় খুব কম, এখানে তার সম্পূর্ণ উল্টো। এক একটা কৃষি খামারেই এক একটা গ্রাম। চারিদিকে মনুষ্যবিহীন মাঠে থরে থরে নানান ফসলের সম্ভার।ফলে, ফুলে শস্যশ্যামলায় বেশিটাই উদ্বৃত্ত। আবার কেন জানি মনে পড়ে গেল আমাদের গ্রাম বাংলার ক্রমাগত পাল্টে যাওয়া ছবি।সেই ছোটবেলার স্মৃতির গ্রাম আর কি খুঁজে পাব নিজের দেশেই? ক্রমশ শুকিয়ে আসা চাকরির বাজার আর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাবৃদ্ধির বিপ্রতীপ টানে চাষের জমির রাতারাতি চিত্রবদল আমাদের দেশেও।

Oindrila's Dream House

শেপার্টনে ঐন্দ্রিলাদের বাড়িতে পৌঁছতে আমাদের প্রায় বিকেল গড়াল। বাড়িতে ঢোকা থেকে শুরু হল আমাদের চমকের পালা।আগে কোনোদিন ওর কাছে বাড়ির গল্প শুনিনি। কিন্তু আমরা যাব বলে ও প্রায় একবছর আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েছে। কোথায় কোথায় ঘোরাবে তার পরিকল্পনা করেছে। বাংলো ধাঁচের বিশাল দোতলা বাড়ি। বাড়ি না বলে স্বপ্নপুরী বলাই ভাল। প্রতিটা অংশ এত রুচিসম্মত ভাবে সাজানো যে চোখ ফেরানো যায় না। আমরা সবাই হতবাক। নিজেদের লাগেজগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখার পর বসার ঘরের সোফায় বসে মনে হল আমরা ঢুকেই বুঝি ঘরটাকে নোংরা করতে শুরু করলাম। চা কফি সহ আড্ডা জমে উঠল। তারপর তিনটি পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট করে গুছিয়ে রাখা ঘর আর তার লাগোয়া বাথরুম দেখে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। যে কোন ফাইভ স্টার হোটেলের ঘরকে হার মানাবে।




কিছুক্ষণ পর স্নান করে মায়ের সাথে ফোনে গল্প করতে করতে ডাইনিং হলের কাঁচের দরজা ঠেলে হলের ভেতর ঢুকেছি -- অন্যদের আড্ডায় সামিল হওয়ার জন্য উদগ্রীব! অন্যমনস্কতায় হঠাৎ আমার মহাভারতে ইন্দ্রপ্রস্থে দুর্যোধনের দশা। অত বড় আস্ত একটা সুইমিং পুল দেখেও আমি ভাবলাম সামনে ওটা জল নয়, অন্য কিছু। চেতনা ধাক্কা খেল যখন ফোনে কথা বলতে বলতে পুলের প্রান্তে এসে জলে পড়ে যাওয়া আর অন্যদের হাসির খোরাক হওয়া থেকে নিজেকে কোনোক্রমে বাঁচালাম।এর পরের চমক আরও অভিনব। ডিনারের আগে দেখি ঐন্দ্রিলা আমাদের তিনটি পরিবারের হাতে তার নিজের বানানো সেইদিনের মেনু কার্ড ধরিয়ে দিল। হরেক রকমের মেনু লেখা তাতে। আরে এইসব ও কখন রান্না করলো? আমাদের সঙ্গে তো ওরা দুজনেই দুদিন ধরে ঘুরছে। জানলাম বাড়ি থেকে বেরোবার আগেই ও সব রান্না সেরে রেখে গেছে। পরদিন সকালে আরও চমকালাম যখন বাড়ির পেছনের বিশাল বাগানটায় উঁকি দিলাম। কত রকমের গোলাপ ফুটে আছে। আছে আরও নানান ফুল আর ফলের গাছ।বাগানের এক প্রান্তে একটা বড় লন টেনিস কোর্ট।




ঐন্দ্রিলাদের বাড়ির বাগানে এক পেল্লাই টেনিস কোর্ট

পরদিন সকালের জলখাবার সেরে আমরা ঘুরতে বেড়িয়ে পড়লাম। আঙুর খেতের ভেতরে একটা ওয়াইনারিতে। তাহবিল্ক ওয়াইনারি।মাটির তলায় অন্ধকার ঠাণ্ডা সেলারে সারি সারি কাঠের পিপে রাখা।কিভাবে বছরের পর বছর ঐরকম ঠাণ্ডা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে আঙুরগুলোকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে পচিয়ে রেড ওয়াইন, হোয়াইট ওয়াইন, স্পার্কলিং ওয়াইন প্রস্তুত করা হয় তার বর্ণনা শুনলাম। দেখলাম ইন্দ্রনীলদাও এই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ।বিভিন্ন ধরণের ওয়াইনের স্বাদ নেওয়ার জন্য দোকানদার প্রস্তাব দিল। ঐন্দ্রিলা, আহেল আর মুনু ছাড়া প্রত্যেকেই এই সুযোগ কাজে লাগালাম।


গোলবার্নের তীরে
মিচেলটন ওয়াইনারি

এরপর আরো একটা ওয়াইনারিতে গেলাম। মিচেলটন ওয়াইনারি। চারপাশের বিস্তীর্ণ দ্রাক্ষাখেত দেখলাম ওয়াইনারির মাঝে একটা টাওয়ারে চড়ে। সেখানে গোলবার্ননদীর ধারে একটা সুন্দর রেস্তরাঁর বাইরের টেরাসে দুপুরের খাবারের জন্য ইন্দ্রনীলদা আগে থেকে টেবিল বুক করেছিল। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে লতানো আঙুর গাছ,কল্পনায় ভেবে নিন তার থেকে অসংখ্য আঙুরের থোকা ঝুলছে। সে আঙুর ফল টক না মিষ্টি তা পাঠকই ঠিক করুক। আসলে দ্রাক্ষাফলের লোভ দেখিয়ে টেনে নিয়ে যেতে চাই সেদিনের দ্বিপ্রাহরিক আহারের আসরে।হোটেলের বাইরের টেরাসের লম্বা টেবিলের এক প্রান্তে বসেছিল ইন্দ্রনীলদা। অন্য প্রান্তে কাবেরী।বাকি আটজন আড়াআড়ি, মুখোমুখি। মাথার ওপরের লতানো আঙুর গাছের ফাঁক দিয়ে চুরি করে হালকা রোদ্দুরের ফলা সকলের চোখে মুখে। আমেজটাই অন্যরকম ছিল সেদিন। খাওয়া শেষে পাশের লনে ইন্দ্রনীলদা আমাদের নানা ধরনের গেম খেলাল। খেলার অনেক রকম রসদ ছিল ওখানে।গোলবার্ন নদীর ধারে ছবিও তোলা হল।












ফেরার পথে ইন্দ্রনীলদা পেট্রল পাম্পের মত একটা জায়গায় গাড়ি থামাল। ভাবলাম বুঝি তেল ভরবে।হঠাৎ দেখি আহেল আর মুনু দুজনে আমাদের গাড়ি দুটো জলের স্প্রেয়ার দিয়ে ধুচ্ছে।পাঁচ মিনিট করে সময় বেঁধে দিয়েছে ইন্দ্রনীলদা। ঐ সময়র মধ্যে কে কত ভাল গাড়ি ধুতে পারে। আমরা বাকিরা গাড়ির ভেতর থেকে ওদের দুজনের তৎপরতা দেখে মজা পেলাম।বড়দের গল্পের মাঝে ছেলেদুটো খানিক ঝিমিয়ে পড়েছে দেখে তাদের চাঙ্গা করে দিল।বাড়ি ফিরে চলল হরেক রকম খাওয়া, সুইমিং পুলে ঝাঁপানো,পুলের জ্যাকুজিতে গরম জলের ফোয়ারাতে আরাম করে গা ভাসানো, নানান হাসি গল্প।

কোয়ালা আর ক্যাঙ্গারুদের সঙ্গে

পরের দিন প্রথমে গেলাম কায়াব্রাম ফনা পার্কে।নানান আঞ্চলিক বন্য প্রাণীকুল অনেকটা জায়গা জুড়ে ইচ্ছে মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের কোয়ালা পেটিং থেকে ক্যাঙারু ফিডিং কিছুই বাদ যায়নি।মরুভূমির এবং প্রাদেশিক কিছু কিছু বন্য প্রাণী যেমন স্পটেড কুয়ল, উওম্ব্যাট ইত্যাদি এখানেই প্রথমবার দেখলাম।নানান প্রজাতির সাপের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার মরু অঞ্চলের কিছু বিষাক্ত সাপ আছে।ক্যাঙারুর জন্য আছে খোলা চারণভূমি, জঙ্গল।একটা নির্দিষ্ট সীমার পর তাদের বেশি কাছে যাওয়া বারণ এবং সবাই সেটা মানছেও। পাখিরালয়ে অনায়াসে ঢুকে পড়ে বিচিত্র সব ছিনতাইবাজদের খপ্পরেপড়লাম।নিজেদের ডেরায় মনুষ্য প্রবেশে পাখিরাভীত হওয়া তো দুরস্ত,বিন্দুমাত্র বিরক্ত বা বিচলিতও নয়। হলুদ ঝুঁটির একটা সাদা কাকাতুয়া তো দিব্যি ঝুলনের ব্যাগের চেন খুলে খাবার দাবার কিছু খুঁজে না পেয়ে আবার চেনটা টেনে বন্ধও করে দিল ভদ্রতা বশে।আরেক জায়গায় পাখিদের ডেরায় ঢুকতেইএকটা বাসন্তী-হলুদ বুকওয়ালা সবুজ তোতা ঝুলনের হাতে, মাথায় ঘুরে বেড়াতে লাগল; আমার গলার হার, কানের দুল ছিনতাই করার জন্য টানাটানি করতে লাগল।খুব মজাও পেলাম ওদের আচরণে।

কা‍ইয়াব্রামে গয়নাচোর


সকাল থেকে ঘোরাঘুরি, খাওয়া দাওয়ার পর এবার যাব ডুকি হিলস-এর দিকে। সেখানে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা প্রান্তর, দূরে দূরে ছোট ছোট টিলা। আমরা বিস্তীর্ণ ক্যানোলা খেতের মধ্য দিয়ে হেঁটে অনেকটা পথ পেরোলাম ডুকি হিলস পৌঁছানোর জন্য। আমাদের দলের সবাই অবশ্য অতটা হাঁটেনি।তারা পথের মাঝে মাঝেই বিশ্রামরত রইল।ডুকি পাহাড়ের মাথায় উঠে বহুদূর সীমাহীন খোলা প্রান্তরের ছবিটা এখনো স্পষ্ট আমার মনের চোখে ধরা আছে। এখানে এক সময় ইয়োর্টা ইয়োর্টা নামে উপজাতির মানুষের বসতি ছিল।গোলবার্ন আর মারে নদীর মাঝের অববাহিকায় তারা ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে বসবাস করত। এদের প্রযুক্তি নব্য প্রস্তর যুগেই আটকে ছিল।শিকার করে আর ফলমূল সংগ্রহ করে এরা বাঁচত। আত্মরক্ষার জন্য ছিল পাথরের তৈরি নানান অস্ত্র আর হাতিয়ার। ১৮৫০ সাল নাগাদ এদের সাথে ইউরোপিয়ানদের সাক্ষাৎ হয়অস্তিত্বের লড়াই চলে বহুদিন বিলুপ্তির পথে গেলেও এদের কিছু কিছু বংশধর এখনো বেঁচে আছে। অস্ট্রেলিয়ার নানান সম্প্রদায়ের মানুষের মূল স্রোতে মিশে গেছে।

ডুকি হিলসের পথে ক্যানোলা ক্ষেতে

'পথ এখনো শেষ হলো না'

সারা ট্রিপে আমাদের ফ্রেন্ড, ফিলোসফার এণ্ড সদা হাস্যময় গাইড- ইন্দ্রনীলদা
ডুকি হিল্‌স



বাড়ি ঢুকেই ইন্দ্রনীলদা প্রবল উদ্দমে লেগে পড়ল বার্বেকিউ প্রস্তুতিতে। বিশাল বাগানের একপাশেই বিরাট কর্মযজ্ঞ! ঊফ হরিণ, ক্যাঙারু, এমুর ঝলসানো মাংসের গন্ধে সারা বাগান ম ম! 
 সেদিনের ডিনারও অন্য দুদিনের মত শুরু হল নানান পানীয় দিয়ে, বহুক্ষণ ধরে চলল নানান সুস্বাদু খাদ্যসম্ভারের পরিবেশন, সঙ্গে অফুরান গল্প মজা। প্রতিদিনই বেড়িয়ে ফেরার পর আহেল আর মুনু নিজেদের মত করে সময় কাটাত। আহেল তো প্রতিদিন সন্ধের অনেকটা সময় পিয়ানো বাজাত।অভিজিৎ ওকে বাজানোর একটা লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল যা পূরণ করলে ও প্রতিদিন দু ডলার করে উপার্জন করতে পারবে।জেনে নেওয়া হয়নি অবশ্য সেই লক্ষ্যমাত্রায় ও কতটা পৌঁছেছিল।



        আগেই বলেছি অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীরা এখন সংখ্যালঘু। ইউরোপীয়রা আসার আগে অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা কত ছিল তা বলা সম্ভব নয়, অনুমান করা হয় তিন লক্ষ থেকে দশ লক্ষের মধ্যে। কিন্তু ইউরোপীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ তাদের জীবনে নানাভাবে অভিশাপ ডেকে এনেছিল। উত্তর আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার জনগোষ্ঠী ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল দীর্ঘকাল। ফলে পরবর্তীকালে যে সমস্ত রোগ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পরে, তার কোনো প্রতিরোধক ব্যবস্থা তাদের দেহে গড়ে ওঠেনি। ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে এসে যখন তাদের মধ্যে এই সমস্ত রোগ সংক্রমিত হয়, তাতে মৃত্যুর হার ছিল খুব বেশি। উত্তর আমেরিকাতে ইউরোপীয়রা ইচ্ছাকৃতভাবে রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে নানা রোগ সংক্রমণ ঘটিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়াতে তেমন কিছু হয়েছিল বলে শোনা যায় না, কিন্তু অনিচ্ছাকৃত সংক্রমণের ফলও হয়েছিল মারাত্মক। এমনি এক রোগ হল গুটি বসন্ত। এখন পৃথিবী থেকে তা নির্মূল হয়ে গেছে, কিন্তু একসময় তা ছিল মানুষের মৃত্যুর এক প্রধান কারণ। এবরিজিনাল মানুষদের মধ্যে গুটি বসন্ত প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ছিল না, ফলে কোনো কোনো গোষ্ঠীর এমনকি নব্বই শতাংশ মানুষ এই রোগে মারা যায়। ১৯৩০ সাল নাগাদ এখানকার আদি অধিবাসীদের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় পঞ্চাশ হাজারে। তাসমানিয়ার আদি অধিবাসীরা নির্মূল হয়ে গিয়েছিল।

এই জনসংখ্যা হ্রাসের মূল কারণ বসন্ত হলেও অন্য কারণগুলিকে অস্বীকার করা যাবে না। শ্বেতাঙ্গরা যখন বসতি স্থাপন শুরু করে, আদি অধিবাসীদের এলাকায় দখলদারি শুরু হয়। তারপরে নানা স্থানে সংঘর্ষ হয় যা সীমান্ত যুদ্ধ বলে পরিচিত। এই সমস্ত যুদ্ধ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া কঠিন, তবে অনুমান করা হয় দশ থেকে কুড়ি হাজার আদি অধিবাসী যুদ্ধে মারা যায়। পরবর্তীকালে সরকার ও চার্চ এবরিজিনাল পিপলদের মূলস্রোতে আনার জন্য নানা রকম নীতি অবলম্বন করেছিল, যাদের অনেকগুলি আধুনিক যুগে সমালোচনার মুখে পড়ে। বর্তমানে সরকার তাদের কিছু দাবি ও অধিকার স্বীকার করে নিচ্ছে, কুরান্ডা প্রসঙ্গে সেই কথা লিখেছি। শ্বেতাঙ্গ ও আদি অধিবাসীদের মধ্যে মিশ্রণও ঘটেছে। এখন অস্ট্রেলিয়ার সাড়ে সাত লক্ষ অধিবাসী নিজেদের আদি অধিবাসী বলে পরিচয় দেয়।

তিনদিন ছিলাম ঐন্দ্রিলাদের শেপার্টনেরবাড়ি, প্রতিদিনই রাতে আমাদের তিন পরিবারকে নতুন নতুন পদের সম্ভারে ভরা মেনু কার্ড এবং সেই মতো পরের পর সুস্বাদু খাবার সাজিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করেছে। বলাই বাহুল্য ইন্দ্রনীলদাও তার সমান সহযোগী ছিল।নিজস্ব বারে নিজের পছন্দের সেরা সেরা দেশি বিদেশি পানীয় আমাদের খাইয়েছে। নানান ভাবে সারাক্ষণ সবাইকে কিভাবে মজায়, আনন্দে মশগুল রাখা যায় সেই চেষ্টা করত, এত হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষ কমই দেখা যায়। আমাদের সকলের থেকে বয়সে কিছু বড় হলেও আলাপের পরে পরেই সে ফারাক একবারও অনুভব করিনি আমরা কেউ। ঐন্দ্রিলা তো একবছর ধরে পরিকল্পনা করে গেছে আমাদের কি ভাবে আপ্যায়ন করবে, কোথায় কোথায় নিয়ে যাবে, কী কী খাওয়াবে। ইন্দ্রনীলদার কাছে শুনলাম বছরে ৩৬৫ দিনে কোন রান্নাই নাকি দুবার করে না। এত রান্না ও শিখল কখন? শুধু নিত্য নতুন রান্না করাই নয়, একই সঙ্গে নিপুণ হাতে পেল্লাই অত বড় বাড়ির ঘর-দোর পরিষ্কার রাখা, ইন্দ্রনীলদার অফিস সামলানো, আবার রাইফেল চালানো---সেটাও পারে ও। দেশ বিদেশের পোস্টাল স্ট্যাম্প সংগ্রহ ওর নেশা। সেই সংগ্রহের বহরও আমাদের অবাক করেছে। কবেকার কলেজ জীবনের পরিচয় ওই চুপচাপ মেয়েটার সাথে। কিন্তু এত গুণের সমন্বয়!




ঐন্দ্রিলাদের বাড়ির খাওয়াদাওয়া-কেবল মেনুকার্ডে সীমাবদ্ধ ছিল না; দস্তুরমত প্রতিদিনের ডিনারে পরিবেশিত হয়েছিল


যে তিনদিন ছিলাম ওদের বাড়ি প্রতিদিনই ভোরবেলা আমি আর গৌতম ইন্দ্রনীলদার সঙ্গে হাঁটতে যেতাম কাছাকাছি একটা জঙ্গলে। একটা জীর্ণ আঁকাবাঁকা খালের পাশ দিয়ে। চারপাশ থেকে আসা নানা পাখির কলরবের মধ্যে ইন্দ্রনীলদা আলাদা আলাদা ভাবে চেনাতো কোনটা কোন পাখির ডাক। পায়ের তলার শুকনো পাতার খসখস থামিয়ে আমরা থমকিয়ে শুনতাম। আর থমকাতো একটা মা ক্যাঙারু। সে রোজ জঙ্গলের শেষ প্রান্তে রাস্তার কাছাকাছি এসে লোকালয়ের দিকে তাকিয়ে পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে কার অপেক্ষায় বুঝি অনেকক্ষণ দাঁড়াত। কুয়াশার ভিতর। জঙ্গলের মাটিতে শুকনো পাতায় আমাদের পায়ের শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে থমকাত। তারপর সজাগ হয়ে পেটের থলির বাচ্চাসহ দৌড় দিত পেছনের জঙ্গলে। ফিরে এসেছি অনেকদিন হয়ে গেল, সম্প্রতি শুনলাম অস্ট্রেলিয়াতে দাবানলের কথা। আপনারাও নিশ্চয় জানেন। আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসা ক্যাঙারুটা কেমন আছে কে জানে?

সকালের ভিজিটর

 

যে কোন জায়গায় বেড়ানোর পর সেখান থেকে ফিরে আসার সময়টা বড়ই বেদনার। ফেরার দিন ঐন্দ্রিলা আর ইন্দ্রনীলদা নিজেরা গাড়ি করে আমাদের পৌঁছে দিয়ে গেল মেলবোর্ন এয়ারপোর্টে। যেমনটা কদিন আগে নিতে এসেছিল। অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের অনেক মধুর স্মৃতি মনের কোনায় উঁকি দেবে বহুকাল। কিন্তু দাবানল ছাড়াও একটা দুঃস্বপ্নও মাঝে মাঝে কুরে কুরে বেড়াচ্ছে।পরিবেশ দূষণের কামড়ে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের অস্তিত্ব কতকাল থাকবে জানা নেই, কিন্তু তার স্বাস্থ্যের বেহাল দশা আমাদের চোখ এড়ায়নি। প্রাকৃতিক এই ঐতিহ্যকে সমূহ বিপদের হাত থেকে রক্ষা করা কেবলমাত্র পরিবেশবিদ আর বিজ্ঞানীদের কম্ম নয় একথা উপলব্ধি করার মত সচেতনতা বহু রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যেই আছে। কিন্তু সুইডেনবাসী গ্রেটা থুনবার্গের মত এগিয়ে আসে কজন?

  



 

সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকার আগস্ট ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত।


No comments:

Post a Comment