শম্পা গাঙ্গুলী
হোটেল থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে আমরা সবাই সমুদ্রের পাড়ের উঁচু রাস্তা ধরে হাঁটছি। মাঝে মাঝে ছবি তোলার বিরতি। একটা অদ্ভুত ভাস্কর্য চোখ টানল। সূর্যের ঝকঝকে আলোয় আপাতভাবে শান্ত পোতাশ্রয়ের চিকচিকে জল আর দাঁড়িয়ে থাকা সুসজ্জিত মালবাহী বিশাল বিশাল জাহাজগুলো আমাকে উঁচু রাস্তা থেকে সমুদ্রের পাড়ে টেনে নামাল। আমার দেখাদেখি ঝুলনও নামল ঢালু ঘাসের কার্পেট বেয়ে। অপূর্ব দৃশ্য।
সিডনি হারবারের রৌদ্রকরোজ্জ্বল সমুদ্র |
একা |
এবং কয়েকজন |
আমাদের লক্ষ্য লেডি ম্যাকুয়ারির চেয়ার। আমাদের মত সব পর্যটকের লক্ষ্যও তাই। সিডনির স্বাভাবিক পোতাশ্রয়ের উপদ্বীপ অংশের একদম শেষ বিন্দুতে সেই চেয়ার। উপরের রাস্তা থেকে খাড়াইভাবে নেমে আসা বেলেপাথরকে খোদাই করে বিশাল একটা হাতলছাড়া আরামকেদারার রূপ দিয়েছে। ১৮১০ সালে জেলের একদল বন্দী এর রূপকার। সেইসময় নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের গভর্নর ছিলেন মেজর জেনারেল লকলান ম্যাকুয়ারি। তাঁর স্ত্রী লেডি ম্যাকুয়ারির স্মৃতিতে ঐ চেয়ারটি খোদাই করা হয়েছিল। উপদ্বীপের ঐ শেষ বিন্দুতে বসে লেডি ম্যাকুয়ারি আশপাশের শোভা উপভোগ করতেন আর ব্রিটিশ জাহাজগুলো দেখতেন, যেগুলো পোতাশ্রয়ে এসে ভিড়ত। আমি আর ঝুলন সেখানে আগে পৌঁছলেও ওপরের রাস্তা ধরে আসা আমাদের দলের অন্যরাও একটু পরেই এসে গেল।পাথরের চেয়ারের গায়ে খোদাই পড়ে জানলাম যে উঁচু রাস্তা দিয়ে সবাই ওখানে পৌঁছল, সেটার নামও মিসেস ম্যাকুয়ারিস রোড, আর চেয়ারটা তৈরি শেষ হয়েছিল ১৮১৬ সালের জুন মাসে। ওর সামনে দাঁড়ালে পশ্চিমে পৃথিবী বিখ্যাত সিডনি অপেরা হাউস আর উত্তর-পশ্চিমে হারবার ব্রিজ। নিউইয়র্কের হেল গেট ব্রিজের অনুকরণে এটি তৈরি হয়। পৃথিবীর উচ্চতম এবং সবচেয়ে চওড়া স্টিলের ব্রিজ। সূর্যের আলোয় চকচকে নীল সমুদ্রের বুকে অপেরা হাউস, হারবার ব্রিজকে পশ্চাৎপটে রেখে প্রচুর ছবি তোলা হল। আমরা ভেবেছিলাম হোটেলের থেকে বেরিয়ে ম্যাপ দেখতে হবে, কিন্তু এই জায়গাটা আসতে তার আর প্রয়োজন হয়নি। সমুদ্রকে অনুসরণ করেই পৌঁছে গেছি।
লেডি ম্যাকুয়ারির চেয়ার |
সিডনির পথের মাঝে এক অদ্ভুত শিল্পকলা |
ঐন্দ্রিলা আমাদের কলেজ জীবনের বন্ধু, অনেকদিন ধরে চাইছিল আমরা আর অনির্বাণের পরিবার ওর বাড়ি যাই। কলেজ জীবনে অনির্বাণ, গৌতম ছিল ওর ক্লাসমেট। আর আমি ছিলাম ব্যাচমেট। এখন ঐন্দ্রিলা আর ওর স্বামী ইন্দ্রনীলদা থাকে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের কাছে শেপার্টনে। অনির্বাণের সঙ্গে ওর স্ত্রী ঝুলন আর ওদের ছেলে মুনু। অভিজিতরাও আমাদের সঙ্গী হল। অভিজিৎ আর কাবেরীও আমাদের পুরানো বন্ধু, কলেজে আমাদের থেকে জুনিয়র। ওদের ছেলে আহেল। সব মিলিয়ে আটজনের দল। সেই শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের দল। ঠিক হল, প্রথমে সিডনি, তারপর কেয়ার্ন্স এবং সবশেষে মেলবোর্ন হয়ে ঐন্দ্রিলাদের বাড়ি শেপার্টন। ২০১৮-এর অক্টোবরের ১৮ তারিখ সিডনির টিকিট কাটা হল আমাদের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রবল উত্তেজনা। অনির্বাণের ছেলে মুনুর পাসপোর্টের ভ্যালিডিটি ছমাসের কম হওয়ায় পাসপোর্ট রিনিউ করিয়ে সেটা হাতে পাওয়া নিয়ে খুব সমস্যায় পড়তে হল। ঝুলন তো ধরেই নিল ছেলের ভিসা না হওয়ায় ওদের যাওয়া বাতিল করতে হচ্ছে।কিন্তু অবশেষে শেষ মুহূর্তে পাসপোর্ট এল এবং দুর্গা পুজোর সময় বলে সময়ের অনেক আগেই আমরা সবাই দমদম এয়ারপোর্টে হাজিরা দিলাম। এয়ার এশিয়ার ফ্লাইট ধরে কুয়ালালামপুর হয়ে সিডনি। এয়ারপোর্টেই গৌতমদের কলেজের প্রাক্তন ছাত্র প্রীতমের সঙ্গে দেখা। তার বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছেই, সে চলেছে জাপান, পড়াশোনার কাজে।
আবার ফিরে আসি সিডনিতে। আমি আর গৌতম ওই চত্বরের বোটানিকাল গার্ডেনে স্বেচ্ছায় হারালাম। সমুদ্রের ধার দিয়ে অপেরা হাউসের দিকে এগিয়ে যাওয়া আমাদের দলের বাকিদের আশ্বাস দিলাম ঘুরপথে গেলেও আমরা ঠিক সময়ে অন্যদের ছুঁয়ে ফেলব।অপূর্ব পরিকল্পনায় বিশাল বাগানটা সাজানো। আর্থার জ্যাক্স নামে একজন শিল্পীর তৈরি এক অনবদ্য সৃষ্টির সামনে আমরা থমকে দাঁড়ালাম। শিল্পীর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা নেই। এক মেয়ে ঘোড়া ও তার শাবক।এত জীবন্ত ভাস্কর্য পৃথিবীতে বোধহয় খুব কমই আছে। এমনিতে গৌতম খুব একটা নিজের ছবি তুলতে আগ্রহী হয় না। কিন্তু দেখলাম ভাস্কর্যটির সামনে দাঁড়িয়ে সানন্দে ছবি তুলল।
জীবন্ত এই ভাস্কর্যের সামনে গৌতম |
কুইন্সল্যান্ড বটল ট্রি |
পাশেই চোখে পড়ল একটা বড় গাছ। আরে, এই এডিনাম গাছ আমার বাগানেও আছে! কিন্তু তার উচ্চতা দু ফুট। আর এটার উচ্চতা প্রায় চল্লিশ ফুট। গুঁড়িটা যত মোটা হবে এই গাছের তত শোভা। এই গাছটার গুঁড়িটাও প্রায় চল্লিশ ফুট পরিধি হবে। কাছে গিয়ে দেখলাম এটা এডিনাম নয়। এর নাম কুইন্সল্যাণ্ড বটল ট্রি। এরকম আরও অসংখ্য বিরল প্রজাতির গাছে ভরা বোটানিকাল গার্ডেন।
ঝাড়ুদার পাখি |
এক জায়গায় দেখি পরপর কয়েকটা সাজানো রেস্তরাঁ। সে তো ঠিক আছে। কিন্তু প্রত্যেকটাতে রেস্তরাঁর সামনে অতিথিদের অভ্যর্থনায় দাঁড়িয়ে আছে একটি বা দুটি করে সারস জাতীয় সুন্দর পাখি। পায়ে কোনো শিকল নেই, মনে তাদের কোন ভয়ডরেরও বালাই নেই। আইবিস পাখি। কাছে গিয়ে ছবি তুললে কোনো আপত্তি করল না। লোকের এঁটো পাতগুলো দিব্যি চেটেপুটে সাফ করছে। আমাদের দেশের ঝাড়ুদার পাখি কাক সুশ্রী নয় বলে কি এখানকার রেস্তরাঁ মালিকরা তাদের এমন অনুমোদন দেয় না? নাকি ওদেশের মানুষ অনেক বেশি প্রকৃতি প্রেমিক!
এক জায়গায় দেখি অনেক পুরানো একটা বটগাছ। গাছের পাশে একটা বোর্ডে কবি এইলিন চঙের লেখা একটা কবিতা। এইলিন চঙ সিডনির রয়াল বোটানিকাল গার্ডেনের পোয়েট ইন রেসিডেন্স ছিলেন। রাজাদের রাজসভা আলো করে কবিরা থাকতেন, রাজাদের প্রশংসা করার জন্য। কিন্তু একটা বাগানের গাছেদের জন্যও একজন কবি? এটা আমাদের ভাবনার বাইরে ছিল। এই মহিলা কবির বয়স খুবই কম। ১৯৮০ সালে সিঙ্গাপুরে তাঁর জন্ম। সাতাশ বছর বয়সে তিনি অস্ট্রেলিয়াতে চলে আসেন। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার প্রথম সারির কবি। সিডনির জনসংখ্যার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল পঁয়তাল্লিশ শতাংশ লোকের জন্ম অস্ট্রেলিয়ার বাইরে এবং আরো আশ্চর্যের বিষয় হল এই শহরে প্রায় আড়াইশো ভাষার চল আছে। পঁয়ত্রিশ শতাংশের বেশি লোকের মাতৃভাষা ইংরাজি নয়। বিবিধ ভাষা আর সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে এই শহরটাতে।
এক জায়গায় দেখি একটা পদ্ম-পুকুর। তার পাশেই এই বাগানের প্রধান জলাশয়টা আছে। সেখানে পাওয়া যায় অনেক ইল মাছ। এগুলো লঙ ফিন ইল প্রজাতির। বেশ কয়েকবার জলাশয়টা পরিষ্কার করার সময়ে মাছগুলোকে বার করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো আবার এখানে এই মিষ্টি জলে চলে আসে। কি অদ্ভুত! ভাবছিলাম, এটা কিভাবে সম্ভব! সমুদ্র তো প্রায় একশো মিটার দূরে। ইল মাছেদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে এক চমৎকার তথ্য জানলাম। এরা আসলে মিষ্টি জলের মাছ। চরিত্রে কিছুটা আমাদের সাধের ইলিশের মত হলেও ইলিশের বিপরীতগামী। এরা ষাট বছর অবধি বাঁচে। মেয়ে মাছ ডিম পাড়ার সময়ে এরা সিডনির মিষ্টি জল থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের উত্তর-পূর্ব দিকে প্রায় দুহাজার কিলোমিটার পাড়ি দেয় নির্জন নিউ ক্যালিডোনিয়া দ্বীপে। এক সঙ্গে প্রায় এক থেকে দু কোটি ডিম পাড়ে। ডিম পেড়েই এরা মারা যায়। সেখানে লার্ভাগুলো যখন বড় হয় তখন তাদের দাঁত থাকে। মীনগুলো জলের স্রোতে মূল ভূখণ্ডের পাড়ে আসে। তারা একটু বড় হলেই তাদের দাঁত খসে যায়। চারা মাছগুলো তখন ডাঙার মিষ্টি জলে ঢুকে পড়ে। যে কোন বাধা অতিক্রম করেই তরুণ মাছের দল নদী, জলাশয়ে চলে আসে। নদীর বাঁধ থাকলে সেটা যেমন টপকায়, তেমনি ঘাসের লনও। পূর্ণ বয়স্ক হয় এই সব মিষ্টি জলেই। প্রায় ষাট বছর বয়স হলে তারা আবার সমুদ্রে পাড়ি দেয় ডিম পাড়ার জন্য। সেজন্যই স্বাভাবিক কারণেই বাগানের এই মিষ্টি জলের আশয় এতই পছন্দ যে পরিষ্কারের সময়ে বার বার এদের বার করে সমুদ্রে ছেড়ে দিলেও এরা তীর থেকে উঠে এসে বাগানের ঘাসের লন টপকে আবার ঢুকে পড়ে জলাশয়ে কৈশোর, যৌবন কাটাবার টানে।
পিছনে সিডনি হারবার ব্রিজ |
বাকি দলের সঙ্গে আমরা যখন আবার মিশে গেলাম, আমাদের অনুপস্থিতি নিয়ে কেউ অনুযোগ করল না। প্রতিবারই বেড়াতে গিয়ে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাঝে মাঝে হারিয়ে গিয়ে বেশি ঘুরপথে হাঁটা আমরা পছন্দ করি সে কথা আমাদের এই দল দিব্যি জানে। তাই বিচক্ষণ গ্রুপ লিডার অভিজিত বা এই দলের অন্যদের সঙ্গে ঘুরে আমরা বেশ আনন্দ পাই।
অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে আদিম মানুষের অস্তিত্ব ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা বিভিন্নভাবে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। সে কথা আমার লেখায় পরে আবার আসবে। সিডনিতে তিরিশ হাজার বছর আগে আদিবাসীদের অস্তিত্ব ছিল। ১৭৭০ সালে বিখ্যাত অভিযাত্রী জেমস কুক প্রথম অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে আসেন। এখন যেখানে সিডনি, তার ঠিক দক্ষিণে একটা খাঁড়িতে উনি জাহাজ নোঙর করেন। সেই খাঁড়ির এখন নাম বোটানি বে। সেই সময় ব্রিটেনের সরকার বন্দীদের দ্বীপান্তর করার জন্য জায়গা খুঁজছিল। কুকের অভিযানের সংবাদ পেয়ে সর্বপ্রথম এখানেই ক্যাপ্টেন ফিলিপের নেতৃত্বে কয়েকটা জাহাজ ভর্তি করে বন্দী পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বোটানি বে জায়গাটা বসবাসের অযোগ্য হওয়ায় বন্দিদের সিডনি কোভের পোর্ট জ্যাকসনে স্থানান্তরিত করা হয় ১৭৮৮ সালে। সেই থেকে অপরাধীদের অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো শুরু হয়। এভাবেই এই মহাদেশের প্রথম উপনিবেশ হিসাবে সিডনির জন্ম।
স্বাভাবিকভাবেই শহরটা খুব তাড়াতাড়ি নানা অপরাধমূলক কাজে ভরে যেতে লাগল। প্রথম যুগের একজন অপরাধীর কথা বলি। আয়ারল্যাণ্ডের ডাবলিন শহরের ডোন্যাহো নামে আঠারো বছরের অপরাধমূলক কাজে জড়িত এক বন্দীকে এই শহরে ১৮২৫ সালে আনা হল। বন্দীদের জোর করে কাজ করানো হত। সে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে সিডনি হাইওয়েতে বেশ কয়েকটা দুঃসাহসী ডাকাতি করে নিউ সাউথ ওয়েলসের অন্য বন্দীদের চোখে আর গরীব মানুষের কাছে রাতারাতি নায়ক হয়ে উঠল। দুঃসাহসিকতার জন্য তাকে অন্য বন্দিরা ‘বোল্ড জ্যাক’ নামে ডাকত। সিডনির খবরের কাগজগুলোর শিরোনামে চলে এলো জ্যাক। দলবল সহ ধরা পড়ল। ফাঁসির আদেশও হল। কিন্তু সে জেল থেকে পালায়। অবশেষে ১৮৩০ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সিডনি অপেরা হাউসের দিকে আমরা এগোতে লাগলাম। রাতের কালো আকাশ আর সমুদ্রের মিলনস্থলে আলো ঝলমলে অপেরা হাউসের ছবি আমাদের ছোটবেলা থেকেই খুব চেনা। ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে কুইজের ভিজুয়াল রাউন্ডের চেনা প্রশ্ন। সিডনি বন্দরের বেনেলং পয়েন্টের নীলাম্বুরাশিতে নৌকার অসংখ্য সুদৃশ্য পালের পিছনের এই সৌধটিবিশ্বের কোটি কোটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে জেগে আছে, ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ২০০৭ সালে জায়গা করে নিয়েছে। জান উটজান নামের ডেনমার্কের এক স্থাপত্যবিদ সিডনি অপেরা হাউসের নকশা তৈরি করেন।
সিডনির জগৎবিখ্যাত অপেরা হাউস ও হার্বার ব্রিজ |
যুবরাজ-যুবরাণীর জন্য অপেক্ষা |
অপেরা হাউসের কাছাকাছি পৌঁছতেই দেখি সেখানে অনেক লোকের জমায়েত। বোঝাই যায় বিশেষ কেউ আসবে সেদিন ওখানে। অস্ট্রেলিয়া স্বাধীন দেশ, কিন্তু তার রাষ্ট্রপ্রধান ব্রিটেনের রাণী। শুনলাম একটু পরেই নাকি যুবরাজ হ্যারি আর তার বউ মেগান আসবে সেখানে। আমাদের তাড়া ছিল, তাই যুবরাজ-যুবরাণীর সঙ্গে দেখা না করেই এগিয়ে গেলাম। ক্যাটামেরানে করে যাব ডার্লিং হারবারের কাছে বারাঙ্গারু। সেখান থেকে ‘সি লাইফ’, যেখানে সামুদ্রিক প্রাণী সম্পদের অমূল্য ভাণ্ডারের নমুনা আছে।
সিডনি হার্বার ব্রিজের তলা দিয়েই যেতে হল ক্যাটামেরানে, ছবি তোলার অনেক সুযোগ পাওয়া গেল। সি লাইফকে বাইরে থেকে দেখে বোঝাই যায়না যে ভেতরে অত বড় এক্যোরিয়াম! বিশাল পরিসর, আর মাটির নিচে অনেকগুলো তলা পর্যন্ত যাতায়াত করার অবকাশ, ভেতরের সংগ্রহশালাটাকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। প্রথমেই ঢুকে দেখি একটা অংশে লেখা ‘শিপ রেক’। সমুদ্রের তলায় জাহাজডুবি হলে সেই ভাঙা জাহাজের বিভিন্ন অংশে ধীরে ধীরে যে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী, উদ্ভিদের কলোনি গড়ে ওঠে তার বিশদ নমুনা। নানা ধরনের শামুক, ঝিনুক, ছোট ছোট মাছ, প্রাণী, উদ্ভিদ ইত্যাদি। নয়ন জুড়ানো বিভিন্ন ধরনের রঙিন প্রবাল- যেমন সান কোরাল, হ্যামার কোরাল ও আরও নানা প্রবাল দেখে মনে পড়ছিল ছোটবেলার একটা গল্প। ছোটবেলায় মামার বাড়িতে গেলে দাদু টাইটানিক জাহাজডুবির গল্প বলত নাতি নাতনিদের। ঠোঁটে ডান হাত ঠেকিয়ে দাদু একটা জাহাজের জোরাল লম্বা ভোঁ দিয়ে জাহাজটাকে সমুদ্রে ভাসাত। তারপর নানা গল্পের জাল বুনে শেষে রাতের অন্ধকারে হিমশৈলে প্রবল ধাক্কা মেরে জাহাজটা যখন ডুবত তখন দুপুর গড়িয়ে সন্ধে নামত। তারপর ডুবন্ত জাহাজের আনাচে কানাচে মৎস্য কন্যা, রঙিন মাছ আর প্রবালদের গল্প আমাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিত। কতবার যে ওই গল্পটা শুনেছি! সি লাইফে ডুবন্ত জাহাজের নানা রঙের প্রবাল,মাছ, সামুদ্রিক সাজানো প্রাণ সম্ভার লিখতে বসে দাদুর বলা গল্পটা আর তার সঙ্গের কল্পনারাজ্য---যেন ছোটবেলার গল্পলোকে ঢুকে পড়লাম।
\
রঙিন প্রবাল |
|
যাক ফিরে যাব সিডনির সি লাইফে। পাশের একটা অংশে দেখি লেখা ‘জুরাসিক সি’। জুরাসিক উপযুগে, অস্ট্রেলিয়ার সামুদ্রিক প্রাণের স্পন্দন যেন অনুভূত সেখানে। খুব সুন্দর দেখতে বিশাল বিশাল নটিলাস শামুক দেখলাম। আছে বিশাল বিশাল লাঙফিস। এদের ফুসফুস আছে। মাডস্কিপার কার্বোনিফেরাস যুগের বহু প্রাচীন মাছ। ইতিহাস বলে এরা ডাইনোসরের থেকেও প্রাচীন। এদের পাখনাগুলো ডানার মত। আবার মুখের সামনের দিকের অংশ পাখিদের মত। দেখলে মনে হবে রুপোলী রঙের একটা পাখি যেন জলের তলার কাদার ভেতর থেকে পোকা মাকড় খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। এদের সবাইকেই বলে জীবন্ত জীবাশ্ম।
লাঙফিশ |
মাডস্কিপার |
ড্রাগন বটে, তবে লম্বা মাত্র কয়েক ইঞ্চি |
পিলচার্ডের ঝাঁক |
এর পরের অংশটার নাম সিডনি হারবার। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ উপকুলের অগভীর সমুদ্রে পাথুরে সমুদ্রতলে বাস করে সামুদ্রিক ড্রাগন। এক জায়গায় দেখি অপূর্ব উজ্জ্বল নীল রঙের সামুদ্রিক ড্রাগন। গায়ে হলুদ ডোরা কাটা দাগ। কোনোটা আবার লাল। কোন শিল্পীর তুলির সূক্ষ্ম টান তাদের সারা শরীরে? শরীরের আকৃতিও কি শৈল্পিক? মন্থর গতিতে এক্যোরিয়ামের তলার পাথুরে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের শরীরেও নানা অংশে গাছের পাতার মত পাখনা। না, সেগুলো তাদের ঘোরাফেরায় সাহায্য করে না। শত্রুকে ফাঁকি দিতে তারা সহজেই জলের তলার জঙ্গলে মিশে গিয়ে ছদ্মবেশে থাকতে পারে। সৃষ্টি কতখানি নিপুণ! কত যত্নশীল! এই লিফি সি-ড্রাগন ছাড়াও দেখলাম উইডি সি-ড্রাগন। তারা অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলের অগভীর সমুদ্রের তলার ঘাসের জমিতে বাঁচে। মাত্র কয়েকইঞ্চি লম্বা এই দু ধরনের সামুদ্রিক ড্রাগনের ক্ষেত্রেই মেয়ে ড্রাগন পুরুষ ড্রাগনের লম্বা লেজের তলার দিকে একসঙ্গে অনেকগুলো ডিম পাড়ে। পুরুষ ড্রাগন ডিমগুলো প্রায় ন-সপ্তাহ ধারণ করে। তারপর ডিম ফুটে বাচ্চা বার হবার সময় হলে তারা এক দু দিন ধরে পাম্প করে, পাথরের গায়ে বা সমুদ্রের ঘাসের গায়ে লেজের ঝাপট মেরে নতুন সামুদ্রিক ড্রাগনের জন্ম দেয়। জন্মেই নতুন এই প্রজন্ম স্বাধীন। বাঁচার তাগিদে প্ল্যাঙ্কটনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। স্টোন ফিস, অস্ট্রেলিয়ান পিলচার্ট, ব্লু ট্যান সার্জেন ফিস, দু-রঙা এঞ্জেল মাছ, ক্লাউন মাছ, লেমন ড্যামসেল, পায়জামা স্কুইড ইত্যাদি ছিল সিডনি হারবারের প্রধান আকর্ষণ।
আরও ভিতরে ঢুকে আবার অবাক হলাম। এই অংশটার নাম দেখলাম শার্ক ভ্যালি। মনে হল এক অজানা সমুদ্রের তলায় পাড়ি দিয়েছি। একাধিক বিশাল বিশাল কাঁচের টানেল দিয়ে ঘোরের বশে যেন হেঁটে চলেছি। আমাদের চারপাশে সাম্রাজ্য চালাচ্ছে গভীর সমুদ্রের প্রাণীকুল। সমুদ্র মৃদু আলোকিত, তাই রক্ষে।প্রা য় ছয় ফুট লম্বা একটা বিশাল হাঙর হঠাৎ দেখি আমার মাথার ওপর কাঁচের ওপারে। মাথার ওপর দিয়ে যাবার সময় হাঁ করা মুখের বড় বড় রাক্ষুসে দাঁতগুলো নিচের মানুষগুলোর রক্ত জমাট করে দিচ্ছিল। সত্যি সত্যি অত বড় হাঙরের পেটের তলায় দাঁড়িয়ে আমারও একটা শিরশিরানি অনুভূতি হচ্ছিল। জানলাম ওটা পোর্ট জ্যাকসন হাঙর। বহু প্রাচীন বিশাল বিশাল সামুদ্রিক কচ্ছপ খুব ধীর গতিতে সাঁতার কাটছে। মনে পড়ে গেল পুরাণের একটা গল্প। দেবাসুর অমৃত উদ্ধার করতে গিয়ে মৈনাক পর্বতকে মন্থন দণ্ড হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। সমুদ্রে যাতে তলিয়ে না যায়, সেজন্য কূর্মাবতার সেই পর্বতকে তার পিঠে ধারণ করেছিলেন। একটা মাছ দেখলাম, শঙ্কর মাছের মত কাঁটাওয়ালা লম্বা লেজ। পিঠের দিক থেকে দেখলে ঈগল পাখির মত দেখতে। গাঢ় বিশাল পিঠে উজ্জ্বল সাদা গোল গোল স্পট। নাম হোয়াইট স্পটেড ঈগল রে। সোনালি রঙের গোল্ডেন ট্রেভালি, জায়েন্ট শভেল নোস, রিফ শার্ক, গ্রে নার্স শার্ক---এরকম নানা বড় প্রজাতির মাছ এখানে আছে।এখানে সবচেয়ে বড় প্রজাতির মাছ হল কুইন্সল্যাণ্ড গ্রোপার। এই মাছটা এত বড় যে হাঙরগুলোও ভয় পায়, একে এড়িয়ে চলে।
হাঙর হ্রদের বিভীষিকা |
কূর্মাবতার ও ঈগল রে |
এরপর তলার থেকে ওপরে উঠলাম, ডুগং আইল্যান্ডে। সমুদ্রের তলায় এরা হল একমাত্র স্তন্যপায়ী যারা পুরোপুরি শাকাহারী। ডুগং হচ্ছে মালয়েশিয়ান কথা, মানে সামুদ্রিক নারী ।প্রথমে ওঠার সময় এর বিশাল ছায়া দেখলাম। তারপর আসল চেহারা। নাম পিগ। লম্বায় দশ ফুট। ওজন চারশ কেজি। প্রতিদিন আশি কেজি করে এর সবজি লাগে। শুনলাম পিগের সঙ্গী উরু গত বছর মে মাসে মারা গেছে। অতীতে এদের দেখেই নাকি নাবিকরা মৎস্য-কন্যা বলে ভুল করত। পৃথিবীতে মোট তিনটি বন্দী ডুগং আছে। বাকি দুটি আছে ইন্দোনেশিয়া আর জাপানে।
জলের পাখি |
এবার নেমে এসে আমরা গেলাম পেঙ্গুইন এক্সপিডিশনে। অভিযানে যাবার আগে আমাদের একটা করে পশমের কোট পরিয়ে দিল। তারপর একটা নৌকায় চারজন করে বসে একটা বরফ শীতল মেরু প্রদেশের অভিযাত্রী দলের মত ঢুকে পড়লাম মেরুরাজ্যের পেঙ্গুইনদের কলোনিতে। নানা প্রজাতির, নানা বয়সের, নানা উচ্চতার পেঙ্গুইন ছোট ছোট দলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শরীরের তুলনায় ছোট ছোট পায়ে দুলে দুলে হাঁটি হাঁটি পা করে বেড়াচ্ছে। চারদিকের ছোট বড় ঢিবিগুলো বরফে ছেয়ে আছে। একে ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি, তার মধ্যে দেখি আমাদের নৌকা ভ্রমণের পথে এক জায়গায় ওপর থেকে ঝরনা নেমে আসছে। এ বাবা, ভিজে যাব তো! এমনটা ভাবছি। দেখি আমাদের নৌকাটা সেখানে পৌঁছাতেই ঝরনাটা থেমে গেল। চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ। এতগুলো পেঙ্গুইন, অথচ কোন কোলাহল নেই। কেমন শান্ত পরিবেশ। ডাঙায় এরা এত ধীরে হাঁটে। কিন্তু স্বচ্ছ জলের ভেতর দেখলাম এরা খুব দ্রুত সাঁতার কাটছে। পাখিরা যেমন ডানা দিয়ে আকাশে ওড়ে, এরাও তেমনি এরো-ডাইনামিক আকৃতির জন্য সমুদ্রের তলায় ডানার সাহায্যে ওড়ে বলা যায়। লিটল পেঙ্গুইন বাইরেও ছিল সাউথ কোস্ট শিপ রেকে। এখানে দেখলাম কিং পেঙ্গুইন আর জেন্টু পেঙ্গুইন। কিং পেঙ্গুইনই সব চেয়ে ভাল সাঁতারু।
ওখান থেকে বেরিয়ে একটা জায়গায় দেখি লোকজন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু করছে। জায়গাটায় লেখা--- ডিসকভারি রক পুল। অর্থাৎ সমুদ্রের উপকূলে পাথুরে ভূমি হলে, ঢেউ আছড়ে পড়ে বা শিলা গঠনকালে সেখানে নানা আকারের ছোট বড় গর্ত তৈরি হয়। সেই গর্তগুলোতে নানা শামুক, সামুদ্রিক উদ্ভিদ, প্রাণী জন্মায়। স্টার ফিশ, নানা কীট দেখা যায়। এখানে দেখলাম তারই একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা করাচ্ছে। দর্শকদের রক পুলের প্রাণীদের হাতে করে নাড়াচাড়া করতে দিচ্ছে। আমরাও নানা প্রবাল কীট, মাছ হাতে নিলাম।
সিডনি স্কাইলাইন |
সি-লাইফ থেকে বেরিয়ে সিডনি শহরটাকে হেঁটে হেঁটে চক্কর মারলাম। সহায় গুগল ম্যাপ ভব! বিখ্যাত হাইড পার্কে ঢুকলাম। তখন ওখানে ফুড কার্নিভ্যাল উৎসব চলছিল। ভারতীয় পাঞ্জাবী ও মোগলাই খানাও হাজির ছিল বটে। নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক কেন্দ্র এটা। তাই প্রচুর দেশি বিদেশি লোকের সমাগম লক্ষ্য করলাম। ঝুলন, কাবেরী গেল ওদেশীয় খাবারের সঙ্গে আমাদের দেশজ খাবারের তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ করতে, বিদেশে পাড়ি দিয়েও আমাদের দেশীয় খাবারগুলো গন্ধে-বর্ণে কতটা অটুট ভারতীয় আছে, ইত্যাদি। আমি আর গৌতম বিখ্যাত সেন্ট মেরিজ ক্যাথিড্রালমুখী হলাম। উদ্দেশ্য চার্চটা বাইরে থেকে দেখে ক্যামেরা বন্দী করা। চার্চ সংলগ্ন পার্ক বিশাল এলাকা নিয়ে। অদ্ভুত সুন্দর কিছু গাছ দেখলাম। সারাদিন ধরে হাঁটার ধকল ছিল। তাই আমাদের দলের বাকিরা পার্কে বসে খানিক জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না। অস্ট্রেলিয়া বহুদিন ব্রিটেনের কলোনি ছিল বলেই বোধহয় অনেক কিছুই ব্রিটেনের নামানুসারে হয়েছে। যেমন এর আগে ছিল সেন্ট জেমস স্টেশন, এখন দেখলাম হাইড পার্ক। এই নামগুলো তো গতবছর লন্ডনেও দেখেছি! হাতে সময় কম, ফিরে লাগেজ গুছিয়ে পরদিন কেয়ার্ন্সের উদ্দেশ্যে রওনা। তাই হাইড পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে এসে আমরা হোটেলে ফিরলাম। মনে আছে গৌতম আর আমি রাতে একটা থাই রেস্তরাঁতে বেশ জমিয়ে ডিনার সেরেছিলাম, বাকিরা অবশ্য ক্লান্তির জন্য হোটেলেই ডিনার সেরেছিল।
সেন্ট মেরিজ ক্যাথিড্রাল ও তার সামনের মূর্তি (নিচে) |
No comments:
Post a Comment