Thursday 9 July 2020

অতিমারী – কুসংস্কার নয়, প্রয়োজন বিজ্ঞান

অতিমারী – কুসংস্কার নয়, প্রয়োজন বিজ্ঞান

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       বর্তমানে আমরা এক অতিমারীর ছায়াতে বাস করছি, পৃথিবীর প্রায় কোনো মানুষের এই রকম অভিজ্ঞতা নেই। একই মাত্রার রোগের কথা জানতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে এক শতাব্দী – সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটা নিশ্চিত যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে স্প্যানিশ ফ্লু কমপক্ষে দেড় কোটি লোকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, আসল সংখ্যাটা এর তিনগুণও হতে পারে। অনুমান করা হয় পৃথিবীর প্রতি তিন জন মানুষের এক জন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারও আগে ব্ল্যাক ডেথ প্লেগের জন্য মধ্যযুগে ইউরোপের অর্ধেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। বিউবোনিক প্লেগ, বসন্ত বা কলেরার কথাও সকলেরই জানা।

       মহামারী শব্দটার সঙ্গে সবাই পরিচিত ছিলাম, অতিমারী শব্দটা অনেকের কাছেই নতুন। মহামারী যখন অনেক দেশে বা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তার নাম হয় অতিমারী। বিভিন্ন দেশের মধ্যে আধুনিক উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্যই করোনা বা কোভিড-১৯ এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে। স্প্যানিশ ফ্লু যে সারা পৃথিবীতে থাবা বসিয়েছিল, তার কারণ হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশের মধ্যে সৈন্য চলাচল। ব্রিটিশ ভারত থেকে বাণিজ্য ও সৈন্য চলাচলের পথ ধরে কলেরা ইন্দোনেশিয়া থেকে রাশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। ইউরোপের এত মৃত্যু ঘটালেও ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ ভারতে আসেনি, তার কারণ মধ্য যুগে ভারত ও ইউরোপের মধ্যে যোগাযোগ ছিল খুবই কম। ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের যাওয়ার আগে অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার মানুষ বসন্ত রোগের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। 

       মহামারী বা অতিমারীতে মৃত্যু সংখ্যা সব সময়েই খুব বেশি। ১৯০০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষেই অন্তত আশি লক্ষ মানুষ কলেরার জন্য মারা যান। ১৯৭৯ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা হু বসন্ত রোগের ভাইরাসকে নির্মূল ঘোষণা করেছিল, তার আগে শুধু বিংশ শতাব্দীতেই বসন্ত রোগের জন্য তিরিশ থেকে পঞ্চাশ কোটি লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। অথচ গত চল্লিশ বছরে বার্ড ফ্লু, এইচআইভি, সিভিয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোম বা সার্স, ইবোলা, ম্যাড কাউ ডিজিজ ইত্যাদি রোগ অতিমারী হয়ে ওঠার আশঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।  করোনার বিপদকে ছোটো ভাবার কোনো কারণ নেই, কিন্তু দেখা যাচ্ছে এতে মৃত্যুর হার কালাজ্বর, কলেরা, বসন্ত বা স্প্যানিশ ফ্লু-এর থেকে অনেক কম। তার কারণ কী?

       গত একশো বছরে চিকিৎসা বিজ্ঞান দ্রুত এগিয়েছে। রোগের জন্য দায়ী জীবাণুকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তার ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কার, বা কালাজ্বরের ওষুধ উদ্ভাবনের জন্য শুধু আমাদের দেশেই কোটি কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়েছে।   আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে যুগান্তর এনেছে পেনিসিলিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক, যদিও তার অতিব্যবহারও বিপদ ডেকে আনছে। পেনিসিলিন আবিষ্কার হয়েছিল ১৯২৮ সালে, তার এক দশকের মধ্যে তার ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছিল।একই সঙ্গে  বোঝা গেছে যে জীবনযাত্রার চরিত্রও মহামারীর দ্রুত প্রসারের জন্য দায়ী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শত্রুর অস্ত্রে যত সৈন্য মারা গিয়েছিল, তার থেকে বেশি মারা গিয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লুতে। ট্রেঞ্চের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অল্প জায়গার মধ্যে অনেক সৈন্যকে থাকতে হয়েছিল – ফলে ফ্লুয়ের দ্রুত সংক্রমণ ঘটেছিল। কলেরাকে ছড়িয়ে পড়া থেকে আটকাতে গেলে ওষুধের থেকেও বেশি প্রয়োজন পরিশ্রুত জলের ব্যবস্থা। ম্যালেরিয়ার বা ডেঙ্গুর জন্য মশাকে দূরে রাখা জরুরি। এই খুব সাধারণ জ্ঞানের জন্যও কিন্তু বিজ্ঞান গবেষণার প্রয়োজন হয়েছিল।

       করোনার বিপদকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভাবতে হবে। তার থেকে রক্ষা পাওয়ার চাবিকাঠি বিজ্ঞানের হাতেই আছে। সারা পৃথিবী করোনা রোগের টিকা আবিষ্কারের জন্য গবেষকদের দিকে তাকিয়ে আছে। মাস্ক ব্যবহার, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া বা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং-এর মাধ্যমে সংক্রমণ কমানোর কথা আমাদের বিজ্ঞানই বলেছে। ইউরোপের বহু দেশ এই পদ্ধতি অবলম্বন করে করোনাকে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। ডাক্তাররা নানারকম ওষুধ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন, ফলে শুরুতে করোনাতে মৃত্যুর হার যা ছিল, এখন তার থেকে অনেক কমে এসেছে। 

       চিকিৎসা বিজ্ঞান যখন খুব একটা এগোয় নি, সেই সময়টা কেমন ছিল? তখন ঈশ্বর দেবতা বা মর্তে তাঁদের প্রতিনিধি বাবা পির সন্ত ওঝাদের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি ছিল না। কলেরা হলে তাই ওলাবিবি বা ওলাইচণ্ডীর পুজো করতে হত, বসন্ত হলে মা শীতলার কাছে হত্যে দিতে হত, কিংবা জলপড়া তেলপড়া ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হত। দুঃখের কথা স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থা সাধারণ গরীব মানুষের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। তাই কোথাও কোথাও মানুষ দৈবের কাছে আশ্রয় খুঁজছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

       আশ্চর্য লাগে যখন দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের থেকেও একই রকম আচরণ দেখতে পাওয়া যায়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার সময় একবার থালা বাটি বাজানোর আর একবার বিদ্যুতের আলো নেভানোর নিদান দিলেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা করোনা নিরাময়ের সংগ্রামের প্রথম সারিতে আছেন, থালা বাজিয়ে সম্মান দেখানোর পরিবর্তে তাঁদের দরকার ছিল পিপিই, মাস্ক ইত্যাদির। আলো নিভিয়ে করোনার বিরুদ্ধে দেশের ঐক্য দেখানো হল কিনা জানি না, তবে ইলেকট্রিসিটি গ্রিডের ইঞ্জিনিয়ারদের কয়েক রাতের ঘুম চলে গেল। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলেন নি যে হাততালি দিলে বা আলো নেভালে করোনা চলে যাবে, কিন্তু সোশাল মিডিয়া মুহূর্তের মধ্যেই করোনা ভাইরাসের উপর শব্দ বা আলোর প্রভাব নিয়ে অপবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাতে ভরে গেল; তাদের মধ্যে কয়েকটা আবার তথাকথিত গবেষণার জার্নালেও জায়গা করে নিলো। অবশ্য সেই জার্নালের নাম কোনো সিরিয়াস গবেষক কখনো শোনেননি, কিন্তু তাতে কী? আধুনিক যুগে কোনো ধারণাকে সত্য বলে ধরে নিতে সাক্ষ্যপ্রমাণের আর প্রয়োজন হয় না, বিশেষজ্ঞের জ্ঞান আর আমার অজ্ঞানতার মূল্য সমান। ফল যা হওয়ার তাই হল, অতিমারীর মধ্যে অকাল দেওয়ালির আবির্ভাব।

       এই ধরনের হাস্যকর সিদ্ধান্তের পিছনের কারণ জানি না, কিন্তু সন্দেহ নেই যে এর ফলে সমস্যার গভীরতা থেকে দৃষ্টি সরে যায়। বর্তমান সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তির সম্পর্ক খুব নিবিড় নয়। পুরাণে করোনা ভাইরাসের কথা খোঁজাতেই বোধ করি তাঁরা বেশি স্বচ্ছন্দ।  আধুনিক যুগের সমস্যার জটিলতা বোঝাতে অক্ষমতার জন্যই হঠাৎ লকডাউনের মতো সরল সমাধানের দিকে তাঁরা আকৃষ্ট হলেন। ভুলে গেলেন কোনো উন্নত দেশ শুধুমাত্র লকডাউনকেই করোনা প্রতিরোধের উপায় করেনি, তার সঙ্গে ব্যাপক পরীক্ষা, আইসোলেশন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। রাজনৈতিক নেতাদের এই দূরদৃষ্টির অভাব অন্যত্রও সংক্রমিত হয়েছে। নীতি আয়োগের সদস্য ইন্টারনেট থেকে পাওয়া একটি লেখচিত্র দেখিয়ে দাবি করলেন যে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দেশ থেকে করোনা নির্মূল হয়ে যাবে। সেই গ্রাফ থেকে ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছালে যে কোনো বিজ্ঞানের ছাত্র পরীক্ষাতে শূন্য পেত।

       করোনা রোধে বিজ্ঞানই পথ দেখাবে, অন্য কোনো উপায় নেই।  এমনিতেই আমরা মোট জাতীয় উৎপাদনের মাত্র ০.৬ শতাংশ বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণা খাতে খরচা করি; চীন, দক্ষিণ কোরিয়া বা তাইওয়ানের মতো এশীয় দেশগুলিও এর কয়েক গুণ বেশি ব্যয় করে। গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেই বরাদ্দও হয় স্থির হয়ে আছে, নয় কমছে।  এখন হঠাৎ করে বিজ্ঞানীদের দিকে তাকালেই বা গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ করলেই তার থেকে ফলের আশা করা যায় না, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।


প্রকাশঃ গণনাট্য, জানুয়ারি-এপ্রিল, ২০২০ সংখ্যা

                                                             

      

 

 


No comments:

Post a Comment