Thursday, 9 July 2020

বিষুবরেখার দক্ষিণে প্রথমবার (২) - কেয়ার্ন্স


বিষুবরেখার দক্ষিণে প্রথমবার 

(২)- কেয়ার্ন্স

শম্পা গাঙ্গুলী

এই লেখার আগের পর্ব সিডনি

পরদিন প্লেনে চেপে কেয়ার্ন্স। ঘণ্টা তিনেকের পথ। এয়ারপোর্ট থেকে একটা বড় গাড়িতে আমরা আটজনের দল লাগেজ সমেত ধরে গেলাম। ড্রাইভার পাঞ্জাবি। বেশ মিশুকে। হোটেল হাইডস আগে থেকেই অনলাইনে বুক করাই ছিল। এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো আর বড় হোটেল। তবে অনেকটা অংশ পরে বাড়ানো হয়েছে, আধুনিক ভাবে সাজানো সেই দিকটা। হোটেলটার মূল অংশটা অতি প্রাচীন, তৈরির সময় থেকে একই রকম রেখে সংরক্ষিত আছে---সাবেকি আমলের আসবাব ঐতিহ্য যেন আরও বাড়িয়েছে।

হাইডস হোটেল ও তার একতলায় আইরিশ পাব

কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের কেয়ার্ন্সের মূল আকর্ষণ দুটো। প্রথমটা হল পৃথিবী বিখ্যাত অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলের গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। দ্বিতীয়টা হল অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলের ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বৃষ্টি অরণ্য। দুটোই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। কেয়ার্ন্সে আমরা তিনদিন ছিলাম। প্রথম রাতে আমার ঘুমই এলো না। দুটো কারণে। প্রথমত পরের দিন গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ দেখতে যাবার উত্তেজনায়। দ্বিতীয়ত, হোটেলে পুরানো অংশটায় আমি আর গৌতম ছিলাম, তার ঠিক নিচে একটা আইরিশ পাব, যেখানে কিছু বিদেশি ছেলেমেয়ের সারা রাত নাচ গান হৈ হল্লা আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।


পরদিন ‘রিফ ম্যাজিক’ ক্যাটামেরানে করে আমরা রওনা দেব প্রবাল প্রাচীর দর্শনে। টিকিট আমাদের অনেক আগেই কাটা ছিল।প্রত্যেকের টিকিটের দাম পড়েছিল দুশো ঊনচল্লিশ ডলার করে। এই ডলার হল অস্ট্রেলিয়ান ডলার, এর দাম তখন ছিল পঞ্চাশ টাকার একটু বেশি। ক্যাটামেরানে করে নানা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে সারাদিনের ঘোরা। উপকূলের কাছাকাছি ফ্রিঞ্জ রিফ এখন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। বিশ্ব উষ্ণায়নে সমুদ্র জলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং মানুষের অন্যান্য নানা ক্রিয়াকলাপ এর জন্য দায়ী। আমরা গেলাম আউটার ব্যারিয়ার রিফে। সকাল আটটায় মার্লিন জেটিতে পৌঁছলাম, ক্যাটামেরান ছেড়ে দিল নটায় ।



গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের পথে  
            

চারদিকের উন্মুক্ত প্রশান্ত মহাসাগরের গাঢ় নীল জলের শোভা উপভোগ করতে করতে প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে আমরা আউটার ব্যারিয়ার রিফে মেরিন ওয়ার্ল্ড অ্যাক্টিভিটি প্লাটফর্মে পৌঁছলাম। জাহাজের দুলুনিতে বমি হবার আশঙ্কায় অনেকেই দেখলাম জাহাজের একতলার পেছনে গিয়ে ভিড় করেছে। গৌতম ছাড়া আমাদের মধ্যে আর কারোর এমন অসুবিধা হয়নি। জাহাজের দোতলার ডেকে একজন মাঝবয়সী মহিলার সঙ্গে আলাপ হল। ব্যাঙ্গালোরে থাকেন। আমাদের দলের কেউ প্রবাল প্রাচীর দেখতে জলে নামব কিনা জানতে চাইলেন। আমার আগ্রহ ছিল। কিন্তু সাঁতার জানি না বিন্দুমাত্র। বারাসাতে বাবার বসত বাড়ির কাছে পাইওনিয়রের সানবাঁধানো পুকুরে বাবা আমার ছোটবেলায় গ্রীষ্মের বা পুজোর ছুটিতে নিয়ে গেলে বেশ কয়েক বার প্রয়াস চলেছে আমাকে সাঁতার শেখানোর। কোমরে গামছা বেঁধে বা কলার ভেলায় বা টায়ারে করে ভাসিয়ে। কিন্তু বাঁধানো পাড় আঁকড়ে কোমর জলে পা ছোঁড়ার বেশি এগোয়নি। সেই আমি কোন সাহসে বলুন তো প্রশান্ত মহাসাগরে ঝাঁপ দেব!

ব্যাঙ্গালোরের মহিলা মোটামুটি সাঁতার জানেন। তাঁর আমেরিকাবাসী ছেলে বলে দিয়েছেন যে অস্ট্রেলিয়া গেলে গ্রেট ব্যারিয়ারে স্কুবা ডাইভিং-এর সাহস না হলেও অবশ্যই অন্তত যেন স্নুবা ডাইভিং করেন। নইলে জীবন বৃথা। উনি বললেন সাঁতার না জানলেও অল্প সময়ের ট্রেনিং নিয়ে গাইডের সাহায্যে স্নুবা ডাইভিং করা যায়। শুনে আমার উৎসাহ বাড়ল। ভাবলাম জীবনে দ্বিতীয়বার তো প্রবাল প্রাচীরের কাছাকাছি আসব না। সাবমারসিবলের গ্লাস বটম বোটে করে প্রবাল দেখব তার একটু পরেই। কিন্তু জলে নেমে প্রবালদের ছুঁতে তো পারব না! আন্দামানে স্নরকেলিং করেছিলাম। তাতে তো মাথাটা জলের সামান্য নিচে রেখে প্রবাল দেখা। খানিক দোলাচলের পর সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম। গৌতম তো আশাই করেনি। আমার অ্যাডভেঞ্চার প্রীতি দেখে ও ঘাবড়ে গেল। আমাদের দলে গৌতমই একমাত্র সাঁতার জানে। তাই স্কুবা করবে ভেবেছিল। সেখানে পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে জলের তলায় নিজের মত ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখা যায়। কিন্তু আমি স্নুবা করব শুনে ও ওর সিদ্ধান্ত বদল করল---আমার সঙ্গেই থাকবে। স্নুবার খরচ মাথা পিছু একশ পঁচিশ ডলার। আমরা আধঘণ্টার একটা ট্রেনিং নিলাম। জানলাম স্নুবা হল স্কুবা ডাইভিং আর স্নরকেলিং এর মাঝামাঝি। অর্থাৎ গাইড আমাদের জলের প্রায় পনের ফিট তলায় নামাবে। মুখে মাস্ক পরানো থাকবে। মাস্কের লাগোয়া লম্বা পাইপের মাধ্যমে জলের তলায় আমাদের মাছেদের মত সাঁতার আর শ্বাস প্রশ্বাস চালাতে হবে। কোন কারণে মাস্ক খুলে গেলে বিপদ সংকেত দেখালে গাইড জলের ওপরে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।পায়ে মাছেদের মত ফিন মানে পাখনা আর গায়ে ওদের দেওয়া ওয়েট স্যুট পরতে হবে।


সব প্রস্তুতি সেরে আমাদের গাইড টমাসের হাত ধরে এবার জলে নিমজ্জন। জলের তলায় যত নামছি সে যে কী অনুভূতি আমি কথায় বর্ণনা দিতে পারব না। আমাদের দুজনের মাঝখানে গাইড। চারপাশে ছোট বড় নানান মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেশ কিছুটা নামার পর গাইড আমাদের হাত ছেড়ে দিল। পায়ের তলায় দেখি প্রবালের ঢিবি। আমার তো ভয় পাবার কথা। কিন্তু ভয়ের বদলে শরীরে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ অনুভূত হল। গৌতম আমার হাত শক্ত করে ধরল। পায়ের পাতার লম্বা পাখনা নাড়িয়ে আমরা সমুদ্রের তলায় মাছেদের মত শ্বাস নিতে নিতে নানান রং বেরঙের মাছেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। যেন কোন খেয়ালি শিল্পীর তুলির টানে নানা উজ্জ্বল জীবন্ত জল-প্রজাপতি! আর পায়ের নিচে চারিপাশে এক আশ্চর্য স্বপ্নের ফুল বাগান সাজিয়ে তুলেছে নানা আকার ও রঙের প্রবাল। গৌতম পাথুরে প্রবালের ওপর দাঁড়াল। কলকাতা থেকে সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের তলায় পৃথিবী বিখ্যাত প্রবাল প্রাচীর ছুঁল। আমিও। খুব সাবধানে! চারপাশে জীবন্ত প্রবালের জলে দোল খাওয়া রাশি রাশি সূক্ষ্ম শুঁড়ের অনুভূতি এড়িয়ে পাথুরে কঙ্কালে। মনে নীল আর্মস্ট্রং-এর অনুভূতি। হঠাৎ বিপত্তি। পায়ের নীচে জীবন্ত প্রবাল আর পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া একটা অদ্ভুত প্রজাতির মাছ দেখতে গিয়ে আমার মুখের মাস্ক গেল সরে। অনেকটা নোনা জল খেলাম। সাহায্যের জন্য টমাসকে ইশারা করতেই সে হাজির। তাড়াতাড়ি জলের ওপর নিয়ে গেল। জলের ওপর কিছুক্ষণ ভেসে থেকে আবার নামলাম। কী ভীষণ উত্তেজনা! জলের তলায় টমাসের সঙ্গে আমাদের দুজনের বেশ কয়েকটা ছবিও তুলে নিল রিফ ম্যাজিকের ফটোগ্রাফার।

গাইডের সাথে সমুদ্রতলে গৌতম ও আমি

এর মধ্যে আরেক বিপত্তি। জলের তলায় তো কথা বলা যায় না, তাই হাতের সঙ্কেতের সাহায্যে কাজ চালাতে হয়, সেগুলো আমাদের আগে বলে দিয়েছিল। সমুদ্রের তলায় আমরা যখন নানা অজানা অনুভূতি আর অভিজ্ঞতায় বিভোর-- গৌতমকে টমাস জিজ্ঞাসা করেছিল কেমন লাগছে। ফেসবুকের বুড়ো আঙুল তোলা লাইক চিহ্নের সঙ্গে সকলেই পরিচিত। গৌতম তাই দেখাল, ভুলে গিয়েছিল যে জলের তলায় ওই সঙ্কেতের মানে আমি উপরে যেতে চাই, টমাস সোজা গৌতমের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ওকে টেনে উপরে তুলে দিল। আবার সেখান থেকে টমাসকে কথায় বুঝিয়ে নিচে নামা।

গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রবাল প্রাচীর। প্রায় তিন হাজার আলাদা আলাদা রিফ নিয়ে এই প্রাচীর তৈরি। অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলের কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের উপকূল ঘেঁসে এই কোরাল সাগর। প্রবাল পলিপস নামে এক ক্ষুদ্র জলজ জীবের শরীরের নীচের অংশ থেকে ক্যালসিয়াম কার্বনেট নিঃসৃত হয়ে জমাট বেঁধে স্টোন কোরাল বা পাথুরে প্রবালের কঙ্কাল তৈরি করে। এই ভাবে প্রায় দু কোটি বছর আগে থেকে এই অঞ্চলে সমুদ্রের তলায় কোটি কোটি পলিপস উপনিবেশ গড়ে তুলেছে। মৃত কঙ্কাল রাজ্যের উপর জীবিত উপনিবেশ বেড়েই চলেছে। মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর যে কটা উল্লেখযোগ্য বস্তু দৃশ্যমান তার মধ্যে গ্রেট ব্যারিয়াব রিফ অন্যতম।এখানে অনেক রকমের প্রজাতির অস্তিত্ব আছে। ১৯৮১ সালে এটাকে বিশ্ব হেরিটেজ সাইটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর এর দেখভাল করে অস্ট্রেলিয়ান মেরিন পার্ক অথরিটি।

কিন্তু ঐতিহ্যবাহী প্রবাল প্রাচীর ‘গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে’র স্বাস্থ্য বর্তমানে গভীর সঙ্কটে। সরকারের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, এই রিফের অবস্থা ‘খারাপ’ থেকে ‘আরও খারাপ’ হয়ে গিয়েছে। গবেষকদের কথায়, ‘প্রবাল প্রাচীর বাঁচানোর কাজ এতটা কঠিন কখনো ছিল না’। এর জন্য দায়ী করা হয়েছে মানুষের কর্মকাণ্ড এবং তার জেরে বেড়ে চলা বিশ্বের তাপমাত্রা এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে। ২৩০০ কিলোমিটার বিস্তৃত এই প্রাচীরে নতুন প্রবাল তৈরি প্রায় ৯০ শতাংশ কমে গিয়েছে। যেগুলি আছে, তার অবস্থাও বেশ খারাপ। অস্ট্রেলিয়ার আইন অনুযায়ী, পাঁচ বছর অন্তর এই গ্রেট রিফের স্বাস্থ্য নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করতে হয়। ২০০৯ সালে প্রকাশিত প্রথম রিপোর্টে বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, ‘এটি যে পরিস্থিতিতে রয়েছে তাতে ভালোও হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে’। ২০১৪-র রিপোর্টে প্রথম বিপদের ইঙ্গিত দেওয়া হয়। ২০১৯-এর রিপোর্টে তো চরম বার্তা দিয়ে দিল। গবেষকদের মতে, সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে। সে সময়ে এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে যায় সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা। যার জেরে প্রবাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, একে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা প্রাণীকুলও বিপদে পড়ে।


জলের তলার নানা ছবি

প্রবাল প্রাচীরের এই সঙ্কটের জন্য পরিবেশবিদদের অনেকে অস্ট্রেলিয়া সরকারের উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, দশ বছর সময় পেয়েও কোনও সদর্থক পদক্ষেপ করতে পারেনি সরকার। প্রধানমন্ত্রী চাইলে বিষয়টা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে দরবার করতে পারতেন। গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন কমাতে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারতেন। কিন্তু বিষয়টা গুরুত্ব না দেওয়ায় ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। আমাদের জাহাজের একটা দল নানা ভিডিও, ছবির  মাধ্যমে এই সঙ্কট বোঝালেন। দিনে দিনে পৃথিবী গরম হওয়ার জন্য সমুদ্রের জল গরম হচ্ছে, লবণের পরিমাণ বাড়ছে। কোথাও আবার বরফ গলা জলে জলতল বেড়ে পাড় ধুয়ে প্রবাল নষ্ট করছে। ঝড় এবং দূষণ বাড়ছে, উষ্ণ সমুদ্রস্রোত এল নিনো আসছে আরো ঘনঘন। পরিবেশের এরকম বেয়াড়া রকমের পরিবর্তন প্রবাল প্রাচীর নষ্ট করছে। বিশেষত উপকূল সংলগ্ন ফ্রিঞ্জ কোরাল প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। উষ্ণায়নের জন্য কোরাল ব্লিচিং এর কথাও জানলাম। প্রবাল পলিপসের কোশে zooxanthellae নামক এক ধরনের মিথোজীবী এককোশী জীব থাকে যারা সূর্যের আলোয় সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে ও প্রবালের পলিপদের প্রায় নব্বই শতাংশ শক্তি যোগায়। কিন্তু উষ্ণতা বাড়লে এই শক্তিদায়ী  zooxanthellae কোরাল থেকে বেরিয়ে যায়। একেই বলে কোরাল ব্লিচিং

তারপর অন্য একটা ভয়ের কথা শুনলাম। প্রবালদের জীবন যাপন এবং বংশ বৃদ্ধি বিপন্ন করে তুলেছ এক ধরনের কাঁটাওয়ালা বিশাল তারামাছ --- যাদের নাম Crown of thorns starfish. উপক্রান্তীয় সমুদ্রের উপকূলে এরা ঘন বসতি গড়ে তুলছে। চট করে মনে পড়ে গেল প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে লেখা প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘কাঁটা’ গল্পটা। বিষাক্ত এই তারামাছের কবলে পড়ে কিভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস হচ্ছে, তা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেই ঘনাদার ঐ গল্পের সূচনা। প্রশান্ত মহাসাগরের এই ভয়ঙ্কর অ্যাকান্থ্যাস্টার প্লানচি-যার আরেক নাম ‘কাঁটার মুকুট’---তার প্রভাবে প্যাসিফিক একেবারে ডেড সি হয়ে যেত, যদি না ঘনাদা ক্যারোলিন দ্বীপপুঞ্জের ইফালিক অ্যাটলে এক দুর্ধর্ষ অভিযানে গিয়ে টাইটন চোরাচালানদের ধরতেন। মাপ করবেন, আমি গল্পের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম। কিন্তু অত দিন আগেও প্রেমেন্দ্র মিত্র যে আশঙ্কার কথা বলেছিলেন, তার বৈজ্ঞানিক সত্যতা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। হাত দেড়েক চওড়া এই তারা মাছের ষোল থেকে একুশটা পর্যন্ত বাহু হয়। সমস্তটাই সাংঘাতিক কাঁটায় ভরা। সে কাঁটায়  এমন বিষ থাকে যা গায়ে ফুটলে শরীর অসাড় হয়ে যায়। রক্তবীজের মত এ অভিশাপের বংশ বৃদ্ধি ঘটছে, এ কাঁটার মুকুটের খিদে এমন রাক্ষুসে যে এদের একটা ঝাঁক মাসে আধ মাইল প্রবাল প্রাচীর সাফ করে ফেলতে পারে, আর করছেও তাই। ট্রাইটন শামুক তারই যম। শৈশবেই অ্যাকান্থ্যাস্টার প্লানচি খেয়ে ফেলে তাদের বংশ বৃদ্ধি করতে দেয় না। তারা এই কাঁটায় ভরা তারা মাছেদের গন্ধ পেয়ে তাদের দিকে চলে যায়। উল্টোদিকে এ অ্যাকান্থ্যাস্টার প্লানচিও এদের গন্ধ পেয়ে দূরে পালাতে চায়। মুশকিল হচ্ছে এই ট্রাইটন শামুক সত্যিই লুপ্তপ্রায়, কিন্তু বিরল নয়। গবেষণা করে প্রবাল প্রাচীর অঞ্চলে এদের প্রজনন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।

জল থেকে উঠে দেখি ঝুলন আর মুনু স্নরকেলিং করছে। গৌতমও গেল সেদিকে। আমরা জাহাজে রাজকীয় লাঞ্চ সারলাম। অনেক ধরনের কাঁচা মাছ খেলাম। সুশি। বমির ভয়ে গৌতম বিশেষ কিছু খেল না। দুপুরে সাবমারসিবল ও গ্লাসবটম বোটে করে আরও দূরের সমুদ্রের তলার প্রবালদের আর রঙিন মাছেদের রাজ্যে গেলাম। মন ভরে উঠল। অ্যাক্টিভিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে ওরা বিভিন্ন মাছেদেরও খাবার দিল। ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ জড়ো হচ্ছিল। ওয়ালি নামে ওদের একটা বিরাট প্রায় পোষা মাছ নানা রকমের খেলা দেখাচ্ছিল পর্যটকদের। বিকেলে ফেরার সময় দেখি জলের তলায় পর্যটকদের যে সব ছবি ওরা তুলেছিল তার ব্লুপ্রিন্ট ডিসপ্লেতে রেখেছে। স্কুবা বা স্নুবা যারা করেছিল তারা প্রায় সবাই কিনছে। আমিও আমাদের জলের তলার ছবিগুলোর একটা কিনে নিলাম চড়া দামে, পঁচিশ ডলার দিয়ে---পর্যটক হিসাবে অমূল্য স্মৃতির মূল্য দিতে।

ওয়ালি - মেরিন ওয়ার্ল্ডের  পোষা মাছ

পরদিন যাব কেয়ার্ন্সের দ্বিতীয় আকর্ষণ, কুরান্ডার জঙ্গলে। কেয়ার্ন্স শহর থেকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার দূরে একেবারে উত্তর কুইন্সল্যান্ডে। কুরান্ডা হেরিটেজ ট্রেনে আমাদের টিকিট অনেকদিন আগেই কাটা ছিল। ঐতিহ্যশালী এই ট্রেনে চাপার আগে তাই স্মৃতির আখর হল নিজেদের তোলা অসংখ্য ছবি। সমুদ্রতল থেকে প্রায় চারশো মিটার উঁচুতে পাহাড় ঘেরা ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুসন্ধান হদিশ দেয়, ইউরোপীয় উপনিবেশ গড়ে ওঠার আগে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার আদিম মানুষের কাছে অঞ্চলটা ছিল প্ল্যাটিপাসের দেশ। প্ল্যাটিপাস হল একিডনা ছাড়া একমাত্র স্তন্যপায়ী যারা ডিম পাড়ে। অস্ট্রেলিয়ারা  আদিবাসীদের গল্পে আছে  উভচর প্রাণী হংস-চঞ্চু অর্থাৎ প্ল্যাটিপাসের জন্ম হয়েছিল বাইলারগুন আর ডারুর মিলনে। বাইলারগুন হল র‍্যাকালি, অর্থাৎ জলের ইঁদুর। সে ডারু হাঁসকে পছন্দ করে বউ করে এনেছিল। ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকের একটা ম্যাসকট ছিল এই প্ল্যাটিপাস। তাছাড়া এরা আছে অস্ট্রেলিয়ার মুদ্রায়, স্ট্যাম্পে, গানে।

কুরান্ডা হল অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীদের গ্রাম। এই মহাদেশে এদের বলে অ্যাবরিজিনাল পিপল। অন্য অনেক দেশের মতোই এখানেও আদি অধিবাসীরা পরবর্তীকালে আসা ইউরোপীয়দের চাপে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতে মানুষের পা প্রথম কবে পড়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। ধারণা করা হয় পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ বছর আগে আধুনিক মানুষ এই মহাদেশের মূল ভূখণ্ডে পা রেখেছিল। মানবজাতির জন্মস্থান হল আফ্রিকা মহাদেশ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন সেখান থেকে বেশ কয়েকবার মাইগ্রেশন বা পরিযানের ফলে সারা পৃথিবীতে মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে। আধুনিক মানুষ অর্থাৎ হোমো স্যাপিয়েন্সেরও মাইগ্রেশনের একাধিক ঢেউ আসে। তার প্রথমটির একটা অংশ মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ভারতে এসেছিল। তাদেরই বংশধররা আবার বর্তমান মায়ানমার হয়ে মালয় উপদ্বীপের রাস্তা ধরে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপে বসতি স্থাপন করে। অবশ্যই তখন দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা মানুষের ক্ষমতার বাইরে, কিন্তু দ্বীপ থেকে দ্বীপে ক্যানোজাতীয় নৌকার মারফত যোগাযোগ ছিল। তাছাড়া তুষার যুগের সময় সমুদ্রতল ছিল আরো নিচে, ফলে দ্বীপগুলোর মধ্যে দূরত্ব ছিল আজকের থেকে কম। এভাবেই নৌকাতে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ থেকে অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডে পৌঁছেছিল মানুষ। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ দিকে রয়েছে বৃহৎ দ্বীপ তাসমানিয়া। চল্লিশ হাজার বছর আগে তুষার যুগে সেও মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ল্যান্ডব্রিজ বা ভূমি-সেতু দিয়ে যুক্ত ছিল। যেমন সেই সময় শ্রীলঙ্কাও একই রকম ভাবে জোড়া ছিল ভারতের সঙ্গে। অস্ট্রেলিয়া থেকে ভূমি-সেতু ধরে তাসমানিয়াতে পৌঁছেছিল আধুনিক মানুষ।

       আধুনিক কালে জেনেটিক বিশ্লেষণ প্রত্নতত্ত্ববিদদের এই সমস্ত প্রকল্পের পক্ষে জোরালো সমর্থন জুগিয়েছে। আমাদের দেহকোশে দুই জায়গায় ডিএনএ আছে, নিউক্লিয়াসে ও মাইটোকনড্রিয়াতে। নিউক্লিয়াসের ডিএনএ-র অর্ধেক আসে বাবার দেহ থেকে, অর্ধেক যোগায় মায়ের ডিম্বাণু। তাই প্রতি প্রজন্মে সেই ডিএনএ-র জিনবিন্যাসে পরিবর্তন হয়। মাইটোকনড্রিয়ার ডিএনএর উৎস শুধুই ডিম্বাণু, তাই মায়ের থেকে সন্তানের দেহকোশে তা অপরিবর্তিতভাবে সঞ্চালিত হয়। বংশ পরম্পরাতে তার কোনো পরিবর্তন হয় না। এ জন্য একমাত্র মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ বিশ্লেষণ করেই আধুনিক মানুষের জন্মস্থান যে আফ্রিকা তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের সকলের সেই আদি মাতার নাম দেওয়া হয়েছে লুসি,  তার মাইটোকনড্রিয়ার ডিএনএ আমরা সবাই বহন করছি। ফিলিপাইন্স, ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার অধিবাসীদের ও অ্যাবরিজিন পিপলদের মাইটোকনড্রিয়ার তুলনা করেই বোঝা সম্ভব হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীরা কতদিন আগে মূল জনগোষ্ঠীর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল।

 মনে প্রশ্ন জাগে যে অস্ট্রেলিয়াতে মানুষের পদার্পণ কি নিছকই দুর্ঘটনা? এমন কি হয়েছিল যে মাছ ধরতে বেরিয়ে কয়েকটা নৌকা ঝড়ের দাপটে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে পৌঁছেছিল, আর ফিরতে পারেনি? তারাই কি অস্ট্রেলিয়ার সব আদি অধিবাসীদের পূর্বপুরুষ? জেনেটিক ভেরিয়েশন বিশ্লেষণ করে বোঝা গেছে যে তা নয়। যে আদি গোষ্ঠী থেকে সমস্ত অ্যাবরিজিনদের জন্ম, তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ছিল অন্তত একহাজার। তার সঙ্গে পুরুষদের সংখ্যাটাও যোগ করতে হবে। এতজন মানুষ নিশ্চয় আকস্মিকভাবে অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে ওঠেনি, তার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল পরিকল্পনার।

আদি অধিবাসীরা ছিল মূলত হান্টার-গ্যাদারার অর্থাৎ শিকারী-সংগ্রহকারী। ছোট ছোট অনেক গোষ্ঠীতে তারা বিভক্ত ছিল। তারা ছিল যাযাবর বা আধা যাযাবর। আদি গোষ্ঠী ‘জ্যাবুগে’রা কুরান্ডাতে বাস করছে প্রায় দশ হাজার বছর। পশু শিকার করে আর মাছ ধরে বছরের পর বছর দিব্যি তাদের চলে যাচ্ছিল। কিন্তু ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সোনার ও টিনের খনির সন্ধান শ্বেতাঙ্গদের টেনে আনল এই গহন বনে। ১৮৮৬ সালে কেয়ার্ন্স থেকে হার্বারটন অবধি রেলপথ তৈরির কাজ শুরু হল, কাজে লেগেছিল  প্রায় পনেরোশো শ্রমিক। শ্বেতাঙ্গদের অনুপ্রবেশের আগে জ্যাবুগেরা সংখ্যায় প্রায় চার-পাঁচ হাজার ছিল, কিন্তু তথাকথিত সভ্য মানুষদের সাথে তাদের অস্তিত্বের লড়াই শুরু হওয়ার পর তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা তছনছ হয়ে গেল। ১৮৯০ সালের মাঝামাঝি স্পীওয়া হত্যাকাণ্ড তার সাক্ষী। তারা সংখ্যায় কমতে লাগল। ১৮৯৬ সাল থেকে এখানে পাহাড়ের গায়ে কফি চাষ শুরু করল ইউরোপিয়ানরা। সেখানে শ্রমিক হিসাবে কাজ জুটল আদি অধিবাসীরদের। তিন প্রজন্ম ধরে শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য এদের ভিটেমাটির জন্য লড়াইয়ে নামতে বাধ্য করেছে। জীবন যাপন, ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বন্ধন সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। তাদের এই দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অবশেষে ১৯৯৩ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকার ওই অঞ্চলে ‘জ্যাবুগে’ সম্প্রদায়ের কিছু অধিকার স্বীকার করে নিয়েছে। তাদের নিজেদের ঐতিহ্য বজায় রেখে চিরাচরিত পদ্ধতিতে জীবন যাপনের অধিকার তাদের থাকবে।বব্যারন গিরিখাত বামা পরিকল্পনা তারা ২০১৮ সালে সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। সেটা মানা হলে এই সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের লড়াইটা কিছুটা সুনিশ্চিত হবে, বিলুপ্তি কিছুদিনের জন্য হলেও পিছোবে।

ঐতিহ্যবাহী কুরান্ডা রেলে ভ্রমণের স্মৃতি          

সেইসব লড়াকু মানুষদের গ্রাম কুরান্ডাতে যাচ্ছি ভেবে বেশ রোমাঞ্চ হতে লাগল ট্রেনে উঠেই। ট্রেনটার ভিতরে  নানান ছবি এই অঞ্চলের ইতিহাসকে তুলে ধরেছিল। একই সঙ্গে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ছিল সেই যুগের বর্ণনা আমাদের সফরকে আরো সমৃদ্ধ করেছিল।  জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেনযাত্রার সুযোগ আগেও হয়েছে, তবে এত দীর্ঘ নয়। ব্যারন জলপ্রপাতের স্টেশনে ট্রেন বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ালো। আমরা সবাই ট্রেন থেকে নেমে পায়ে-চলা ব্রিজে উঠে আরও খানিকটা পথ জঙ্গলের ওপর দিয়ে পেরিয়ে ব্যারন গিরিখাতের বেশ কাছাকাছি পৌঁছলাম। চারপাশে জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের শোভা, ব্যারন নদীর জলপ্রপাতও চমৎকার! তবে হিমালয়ের রূপের বৈচিত্র্যের সঙ্গে এর তুলনা চলে না।

ব্যারন জলপ্রপাত      

কুমীরের মাংসের সসেজ

জঙ্গল আর পাহাড়ের বুক চিরে প্রায় দেড় ঘণ্টা ট্রেন যাত্রার পর আমরা কুরান্ডা গ্রামে ঢুকলাম। খুব হতাশ হলাম। কোনো আদিবাসী গ্রামের লেশমাত্র নেই। একজন আদিবাসী দেখলাম মাটিতে বসে ডিজেরিডু বাজাচ্ছে, তার সারা গায়ে নানা রঙের আঁকিবুঁকি কাটা। প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরানো এই বাদ্যযন্ত্র ইউক্যালিপটাস গাছের কাণ্ড দিয়ে তৈরি হয়। উই পোকায় খাওয়া ফাঁপা কাণ্ড আদি অধিবাসীরা বনের মধ্যে খুঁজে বেড়ায়। কাণ্ডের ভেতরটা পুরো ফাঁকা করে বিশাল বাঁশির মত এই যন্ত্র এরা তৈরি করে, বাঁশির মত করেই বাজায়। কিন্তু ঐ একজন ছাড়া আর কোনো আদিবাসী আমাদের চোখে পড়ল না। চারদিকে কারুশিল্প কলা, আর্ট গ্যালারি, মনিহারি দোকান বাজার আর রেস্তরাঁ চড়া দামে পসরা সাজিয়ে পর্যটকদের ঠকাচ্ছে। আমি খুব মুষড়ে পড়লাম। এত টাকা খরচ করে এই দেখার আশায় নিশ্চয়ই আসিনি। আর আসার পথের প্রকৃতি খুবই সুন্দর ঠিকই। কিন্তু সুউচ্চ হিমালয় তার কোণায় কোণায় আপন খেয়ালে এর চেয়ে ঢের বেশি সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে সেজে থাকে সারা বছর। আমি আর ঝুলন সুন্দরভাবে সাজানো একটা পার্কে বসে সুখ-দুঃখের গল্পে মাতলাম। আমাদের খিদে নেই জেনে অন্যরা খুঁজে খুঁজে একটা জার্মান দোকানে গিয়ে কুমীর আর এমু পাখির মাংস দিয়ে লাঞ্চ সারল।



গৌতমের তোলা প্রজাপতির ছবি

দক্ষিণ গোলার্ধের সবচেয়ে বড় প্রজাপতির সংরক্ষণশালা কুরান্ডাতে। সেখানে প্রায় পনেরশো ধরণের ক্রান্তীয় প্রজাপতির বাস। তাদের প্রজনন পরীক্ষাগারেও বহু প্রজাতির প্রজাপতির গুটিপোকা থেকে প্রজাপতি হবার বিভিন্ন পর্যায়গুলো দেখার মত। সব জেনেও আমার ওখানে ঢুকতে মন চাইল না। কুরান্ডা গ্রাম নিয়ে মনের হতাশাটা কিছুতেই কাটছিল না। ভাবলাম ব্যাঙ্গালোরে আমার দেখা প্রজাপতি সংরক্ষণশালার থেকে এখানে বেশি কিছু পাব না, তাই ঐ স্মৃতিটাই ঝালাতে লাগলাম। আধ ঘণ্টা পর আমাদের দলের বাকিরা যখন বাইরে বেরিয়ে এলো, আলাদা কোন তৃপ্তির ছাপ ওদের চোখে মুখে পেলাম না। একমাত্র ঝুলনের গায়ে দু দু’বার প্রজাপতি বসেছিল বলে অনির্বাণকে একটু চিন্তিত দেখলাম। ওখানে ‘বার্ড ওয়ার্ল্ড’ নামে পাখির একটা সংরক্ষণশালাও ছিল। তাতে নাকি সাড়ে তিনশোর বেশি রকমের বিরল প্রজাতির পাখি উড়ে বেড়ায়। আমাজন অরণ্যের বিখ্যাত ম্যাকাও আছে। ক্যাসুয়েরি, লরিকিট, কাকাতুয়াও হাজির। কিন্তু ঢোকার ফি এক একজনের সাড়ে উনিশ ডলার। একটু আগেই চোদ্দ ডলার করে প্রজাপতি দেখেছে সবাই। তাছাড়া মেলবোর্নে গিয়ে আমাদের একটা চিড়িয়াখানা দেখার পরিকল্পনা আছে। তাই ওখান থেকে ফেরার জন্য তৈরি হলাম।

স্কাইরেল

ফেরাটার জন্য উত্তেজনা ছিল সকলেরই। কুরান্ডাতে যাওয়াটা ঐতিহ্যশালী ট্রেনে হলেও ফেরাটা রেখেছিলাম আকাশপথে, পরিবেশ-বান্ধব স্কাইরেলে। বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে বেশ কয়েকবার রোপওয়েতে চড়েছি, কিন্তু এ অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্বের প্রাচীনতম এক গভীর ঘন ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য--- যেখানে গা ছমছম করা পরিবেশে পুরানো কোনো কোনো গাছ হাজার হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রায় দুশো ফুট উচ্চতায় মাথা তুলে নানা বিবর্তনের ইতিহাসের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে, প্রকৃতির নানা জীবকে বংশানুক্রমে বাঁচিয়ে রেখেছে---তেমন এক অরণ্যের মাথার ওপর দিয়ে দেড় ঘণ্টা সময় ধরে সাড়ে সাত কিলোমিটার পথ অতিক্রম করা! খুব কম মানুষের কপালে এমন বিরল অভিজ্ঞতা জোটে। স্কাইরেলের কুরান্ডা স্টেশনে গন্ডোলা কেবল কারে ছজন করে বসার জায়গা। আমরা দলে আট। আমি আর গৌতম বাদে অন্যরা একটা কাঁচ দিয়ে ঘেরা গন্ডোলাতে চাপল। আমরা তার পরেরটায়। আমাদের সঙ্গে এক প্রবীণ ইংরেজ দম্পতি। স্মিথফিল্ড হল শেষ স্টেশন। মাঝপথে পাঁচশ পঁয়তাল্লিশ মিটার উচ্চতায় রেড পিক স্টেশনে নেমে কেবল কার পরিবর্তন করতে হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা চারজন সঙ্গী। নিচের বিস্তীর্ণ অরণ্যের মহীরুহের নিবিড় বনভূমি, গিরিমালা, নদী, দ্বীপ--- সব যেন স্বপ্নের জগৎ। বিশাল বিশাল লতাগুল্ম বড় বড় গাছগুলোকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রেখেছে, মাথায় চাঁদোয়ার মতো হয়ে কোনো কোনো জায়গায় বনের তলার দিকটা অন্ধকার করে দিয়েছে। অনেক নিচে পাহাড়ের খাদ, সাত-আটশো ফুট নিচে তো হবেই। গিরিখাতের ওপর দিয়ে যাবার সময় গন্ডোলাটা দুরন্ত হাওয়ায় ভয়ানক দুলছিল। ঘূর্ণির প্রবাহে মাঝে মাঝে থমকে যাচ্ছিল আমাদের আকাশযান। বুঝি বিকল হল ভেবে আমাদের হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যাবার জোগাড়।

আমাদের উল্টো দিকের ইংরেজ মহিলা অসম্ভব ভীতু। হাবভাব দেখে মনে হল তিনি জীবনের আসন্ন অন্তিম সময়ের প্রহর গুনছেন। সাহেবকে জড়িয়ে ধরে  ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে প্রশ্ন করলেন-‘Listen Thomas, why did you bring me here? If it falls whether it will fall over the canopy or on the ground?’


চিন্তান্বিত টমাস

 

অনেক উঁচু উঁচু গাছের মাথায় মাথায় এক অদ্ভুত ধরনের বিশাল পাখির বাসা দেখতে পেলাম। সরু লম্বা সাদা সাদা চাঁছা কাঠের তৈরি বড় বড় চুবড়ির মত দেখতে। রেড পিক স্টেশনে কেবল কার পাল্টাতে নামলাম। সেখানে আশপাশের ঘন বনের ভেতর দিয়ে ঝুলন্ত ব্রিজের ওপর দিয়ে আমরা অনেকটা পথ হাঁটলাম। চারদিকের নিস্তব্ধতায় আদিম গা ছমছমে অনুভূতি। রেড পিক থেকে ফেরার সময়ে সেই দম্পতিকে দেখি স্টেশনের তলায় হলঘরে বসে কী সব আলোচনা করছেন। কে জানে? আকাশপথ থেকে বনপথই হয়ত ঐ ইংরেজ মহিলার কাছে বেশি নিরাপদ। ফিরবেন নিশ্চয়ই! কিন্তু কী ভাবে? স্মিথফিল্ড স্টেশন অবধি বাকি পথটাও ফিরলাম ঐরকম শ্বাসরোধ করা অভিজ্ঞতায়। গন্ডোলা থেকে  দূরের নীল সমুদ্রকে দেখতে পাওয়াটা ছিল আমাদের বাড়তি পাওনা।


স্কাইরেল থেকে তোলা ছবি

কেয়ার্ন্সে গিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের জলের তলার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে প্রবাল দেখা আর তার পরের দিনই ক্রান্তীয় গভীর অরণ্যের দুশো আড়াইশো ফিট বৃক্ষরাজির ওপর দিয়ে আকাশপথে গন্ডোলায় ভ্রমণ, দুটোই আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। সেদিন রাতেও হোটেলের তলার আইরিশ পাব আমাকে ঘুমাতে দিল না। পরদিন মেলবোর্ন যাব। প্লেন সকাল সওয়া ছটায়। অনির্বাণের তাড়ায় আমরা অনেক আগে এয়ারপোর্টে ঢুকলাম। মেলবোর্নে আমাদের জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে ঐন্দ্রিলা আর ইন্দ্রনীলদা। (ক্রমশ)

প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, মার্চ, ২০২০

এই লেকার পরের পর্ব

বিষুবরেখার দক্ষিণে প্রথমবার - ফিলিপ আইল্যান্ড ও মেলবোর্ন (১)

বিষুবরেখার দক্ষিণে প্রথমবার (শেষ পর্ব)



No comments:

Post a Comment