বিষুবরেখার দক্ষিণে প্রথমবার
ফিলিপ আইল্যান্ড ও মেলবোর্ন (১)
এই লেখার আগের পর্বগুলিঃ
বিষুবরেখার দক্ষিণে প্রথমবার (১) - সিডনি
বিষুবরেখার দক্ষিণে প্রথমবার (২) - কেয়ার্ন্স
আগেই বলেছি,ঐন্দ্রিলা
গৌতম অনির্বাণ আর আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী, বিবাহ সূত্রে এখন অস্ট্রেলিয়ায়।
ইন্দ্রনীলদা মেলবোর্নের কাছে শেপার্টনের একজন নামজাদা সাইকিয়াট্রিস্ট।বলা যায় মূলত
ঐন্দ্রিলার প্রবল ইচ্ছা আর দীর্ঘ এক বছরের পরিকল্পনায় আমাদের অস্ট্রেলিয়া সফর
সম্ভব হয়েছে। মেলবোর্নে পৌঁছানো থেকে ফেরা পর্যন্ত সব পরিকল্পনা ঐন্দ্রিলাদের।
এয়ারপোর্টে নামলাম, ওরা গাড়ি নিয়ে হাজির। আমাদের আটজন দুটো গাড়িতে ভাগ হয়ে উঠলাম। গাড়ি
ছুটল ফিলিপ দ্বীপের অভিমুখে। দুটো গাড়িতেই ঐন্দ্রিলা আমাদের জন্য নানা ধরনের স্যান্ডউইচ
আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল। প্রত্যেকের নাম লেখা জলের বোতলও ছিল। গল্প করতে
করতে যাত্রা।বিশাল চওড়া রাস্তাতে অনেকগুলো করে লেন। একসঙ্গে ছটা আটটা গাড়ি পাশাপাশি
ছুটতে পারে। সুন্দর সাজানো শহর দেখতে দেখতে আমরা চললাম। রাস্তার দুধারে উঁচু উঁচু নয়েজ ব্যারিয়ার। শহরকে শব্দ দূষণের হাত থেকে বাঁচানোর কৌশল। আমাদের তাড়া ছিল। ফিলিপ
দ্বীপের সিলদের দেখার জন্য জাহাজ ছাড়বে দুপুর দুটোয়।ইন্দ্রনীলদা আমাদের জন্য আগে
থেকেই অনলাইনে সিল রকে যাবার টিকিট কেটে রেখেছিল। একটু দেরি হলেই সিলক্রুজ ফসকে
যাবে।
মেলবোর্নের একশ চল্লিশ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পূর্বে বাস প্রণালীর উত্তর দিকে ফিলিপ দ্বীপ। অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এই দ্বীপ ছশো চল্লিশ মিটার লম্বা একটা ব্রিজ দিয়ে জোড়া। ভারি সুন্দর দেখতে ব্রিজটা পেরোলাম। একসময় ওটা নাকি কাঠের ছিল! পরে কংক্রিট হয়েছে। আমরা হাজির ফিলিপ দ্বীপের ছোট্ট শহর কাউজ-এ। কাউজ উচ্চারণের ‘জ’ টা হল পরশুরামের Zআনতি পার না-র Z। কাউজ জেটিতে জাহাজে তুলে দিয়ে তবে ইন্দ্রনীলদারা নিশ্চিন্ত হল। এমনিতেই ভীষণ ঠাণ্ডা লাগছিল।জাহাজ ছাড়তেই শুরু হল দক্ষিণ মেরু থেকে ছুটে আসা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আন্টার্টিকার সামুদ্রিক হাওয়ার দাপট।সব উড়িয়ে নিয়ে যাবার যোগাড়। আমরা দ্বীপটার উত্তর-পশ্চিম উপকূল ঘেঁষে সিল কলোনির ঠিকানা সিল রক খুঁজে পেতে চললাম আরও দক্ষিণ-পশ্চিম সমুদ্রে।
রকের কাছাকাছি যেতেই দেখি শয়ে শয়ে সিল। জাহাজ ওদের আরও কাছাকাছি গেল, সিলরা এলো আমাদের দৃষ্টির নাগালে। সমুদ্রে জেগে ওঠা আশপাশের ব্যাসল্ট-পাথুরে ছোট ছোট দ্বীপগুলোতে কত শত সিল---শুয়ে বসে গা এলিয়ে, কিংবা গড়িমসি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সূর্যের আলো ধূসর রঙের তেল চকচকে চামড়ায় রূপালি আভা ঠিকরে তুলছিল। অনেকগুলো আবার তীর থেকে ডিগবাজি খেয়ে জলে নেমে সাঁতার কাটছিল। কেউ কেউ আমাদের জাহাজটার একেবারে কাছে। ডাঙায় এরা হাঁটে টলমল করে। একেবারে স্বচ্ছন্দ নয়। কিন্তু জলে এরাখু ব সাবলীল। জাহাজের মাইকে ওখানকার সিলদের সম্পর্কে অনেক তথ্য দিচ্ছিল। ভিডিওতেওদেখাচ্ছিল। পুরুষ সিলগুলো অনেক বড়। লম্বায় আড়াই মিটার, ওজন সাড়ে তিনশ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। মেয়ে সিলরা লম্বায় একশো দশ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। বাচ্চা সিলগুলো দ্বীপের পাড়ে এসে খেলছিল। জন্মানোর পর সিলের বাচ্চারা ছ’মাস অবধি শুধু মায়ের দুধই খায়। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ কখনো তাদের রূপোলী গায়ে সাদা ফেনা মাখিয়ে দিচ্ছিল। কোনোটা আবার ঢেউয়ের তোড়ে আছাড় খেয়ে জলে পড়ছে আর হুটোপুটি করে এবড়ো খেবড়ো পাড় ধরে ডাঙায় উঠতে চাইছে। মনে পড়ে গেল কিপলিঙের সেই বিখ্যাত গল্প‘হোয়াইট সিল’; মা সিল যেখানে গান গেয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতো….
‘ You mustn’t swim till you’re six
weeks old,
Or your head will be sunk by your
heels;
And summer gales and killer whales
Are bad for baby seals.’
নিশ্চয় ছ'সপ্তাহের বেশি বয়স বলেই এই সিলটার মা একে জলে নামতে দিয়েছে
ঊনবিংশ শতকের গোড়া পর্যন্ত চামড়ার জন্য এখানকার সিলদের শিকার করা হত। ফলে তাদের সংখ্যা
কমতে শুরু করেছিল।মাছ ধরার ট্রলারের জালে আটকা পড়ে বা প্লাস্টিক দূষণেও অনেক সিল মারা
যেত। কিন্তু ফিলিপ দ্বীপের নেচার পার্ক কেন্দ্রের অন্তর্গত নবিস নামক সংস্থা এখন
এদের দেখভাল করে। ফিলিপ দ্বীপের প্রায় তিরিশ হাজার ফার সিল বাসিন্দা অস্ট্রেলিয়ার
সবচেয়ে বড় সিল কলোনি গড়ে তুলেছে।
সিল রক
ঘণ্টা দুয়েক পরে আমরা যখন ফিরলাম দেখি জেটিতে ঐন্দ্রিলা আর ইন্দ্রনীলদা হাজির। সেদিন রাতে থাকার মোটেল আগে থেকে বুক করে রেখেছিল, এই দুঘণ্টা সময়ের মধ্যে ওরা চেক ইন করে এসেছে। আবার দুটো গাড়িতে উঠলাম মোটেলের পথে। কে জানত আমাদের জন্য দারুণ এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে! দেখি আমাদের গাড়ি দুটো ফিলিপ দ্বীপের গ্রাঁ প্রি সার্কিটের ভিতর ঢুকল। এখানে কেন? ইন্দ্রনীলদা জানাল যে আমাদের সবাইকে গো কার্ট ট্র্যাকে গাড়ি চালাতে হবে।ফর্মুলা ওয়ানের কার রেস দেখেছি টিভিতে।মাথায় হেলমেট আর গায়ে লাইফ জ্যাকেট পরে প্রচণ্ড গতিতে ট্র্যাকে গাড়ি ছোটাতে হয়। সর্বনাশ! আমি আর গৌতম সাইকেলের বেশি কিছু চালাতেই পারি না।বড় জোর রিকশা। অভিজিত স্কুটার পর্যন্ত। অনির্বাণ রে রে করে উঠল। ইন্দ্রনীলদা আমাদের বিন্দুমাত্র না জানিয়ে কী করে এমন একটা বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু ইন্দ্রনীলদা নাছোড়। আমাদের প্রত্যেককে গাড়ির প্রতিযোগিতায় নামাবেই। ভাবলাম যা আছে কপালে! একটা বড় স্ক্রিনের মাধ্যমে আমাদের প্রশিক্ষণ হল। হেলমেট পরে সবাই প্রস্তুত হলাম। ফরমুলা ওয়ানের মতই গাড়িগুলো দেখতে। কিন্তু এগুলোর কেবল স্টিয়ারিং আর এক্সিলারেটর আছে। কোনো গিয়ার নেই। আমাদের বেশিরভাগের তখন অন্ধের কিবা দিন কিবা রাতের মতো অবস্থা। সমুদ্রের পাড়ে সাড়ে সাতশ মিটার লম্বা আঁকাবাঁকা পথ সামনে।সিটে বসে বেল্ট বাঁধার পর ওখানকার একজন এসে একে একে আমাদের গাড়িগুলো স্টার্ট করিয়ে দিল। আঁকাবাঁকা পথে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জোরে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের কাছে দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠল। একে অপরকে ধাক্কা মারছি। আমি তো বেশ কয়েকবার বাঁকের মুখে গাড়ির গতি কমাতে ভুলে গিয়ে পাশের রাবারের ব্যারিয়ারে ধাক্কা মেরেছি। শেষ রাউন্ড হবার পর যখন সবাই আবার স্টার্টিং পয়েন্টে এসে গাড়ি দাঁড় করাচ্ছি, তখন দেখা গেল গৌতমের গাড়িতে প্রথমে মুনু তারপর তার বাবা অনির্বাণ এসে ধাক্কা মারল, একেবারে জেনেটিক ব্যাপার। প্রতিযোগিতায় প্রথম হল ইন্দ্রনীলদা। দ্বিতীয় আহেল। তৃতীয় মুনু। আমাদের দলের বাইরেও তিনজন প্রতিযোগী ছিল, এগারোজনের মধ্যে অনির্বাণ এগারো নম্বর স্থান পেল। আমি হলাম দশম। প্রথম তিন স্থানাধিকারীকে ভিক্টরি স্ট্যান্ডে তুলে হর্ষধ্বনিতে ছবি তোলা হল,নাইবা হল মাইকেল শ্যুমাখার বা লুইস হ্যামিল্টন। আমরা অসফল হলেও উত্তেজনা ও মজা পেয়েছি প্রচুর।
গো কার্টে আমি (উপরে) ও ভিক্টরি স্ট্যান্ডে বিজয়ীরা (নিচে)
এবার আমাদের মোটর ছুটল মোটেলের দিকে। সেদিন রাতে সেখানেই থাকা। খানিক বিশ্রাম নিয়ে আমরা সেদিন রাতে যাব পেঙ্গুইনস প্যারেড দেখতে। ঐন্দ্রিলা আমাদের বলে দিল ফিলিপ দ্বীপের দক্ষিণে সমুদ্রের ধারে পেঙ্গুইনদের দর্শন পেতে আমাদের অনেক সন্ধে পর্যন্ত থাকতে হবে।সেখানে কুমেরু সাগর থেকে তীব্র ঠাণ্ডা হাওয়া দেয়। যার যত গরম জামা আছে যেন কাজে লাগাই। আমরাও সেইমতো তৈরি হয়ে রওনা দিলাম।
ইন্দ্রনীলদা পেঙ্গুইনস প্যারেডের
বুকিং আগে থেকেই করে রেখেছিল। পৌঁছে দেখি বিশাল ভিড়।তখনো পুরোপুরি সন্ধে নামেনি। সমুদ্রের ধার পর্যন্ত যেতে গেলে অনেকটা রাস্তা দুপাশে রেলিং লাগানো কাঠের তক্তার
ব্রিজের ওপর দিয়ে যেতে হবে। ব্রিজের দুপাশে ঘাসের জঙ্গল। তাতে পেঙ্গুইনদেরঅসংখ্য
কৃত্রিম বাসা। সমুদ্রের ধারেও অনেকটা জায়গা জুড়ে কাঠের গ্যালারী।সেটা প্রায় ভরে
গেছে। আমরা দুটো গ্যালারীর মাঝখান দিয়ে চলে গেলাম একেবারে সমুদ্র সৈকতে। তখন ভাঁটার
সময়। ঐন্দ্রিলা ওর একটা বিশাল ঝোলা থেকে দুটো শতরঞ্চি বার করল ঠাণ্ডা ভিজে বালিতে
পেতে বসার জন্য। সমুদ্রের যত কাছে বসা যাবে সন্ধের মুখে সমুদ্র থেকে উঠে আসা
পেঙ্গুইনের দলগুলোকে তত ভাল পর্যবেক্ষণ করা যাবে। ঐন্দ্রিলা বাড়ি
থেকে বেরোনোর আগে মেলবোর্ন এয়ারপোর্ট থেকে ওদের গাড়িতে উঠে আমরা আটজন কি খাব তার
ব্যবস্থা যেমন করে রেখেছিল, তেমনি
পেঙ্গুইনস প্যারেডে এসে ভিজে বালিতে কী পেতে বসব সেটাও মাথায় রেখেছিল। এটাই
ঐন্দ্রিলার বৈশিষ্ট্য। বুঝলাম এসব হচ্ছে এক বছর ধরে আগাম পরিকল্পনা করার ফল।
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া প্রদেশের
ফিলিপ দ্বীপের এই সামারল্যান্ড উপদ্বীপের প্রধান আকর্ষণ সিল আর পেঙ্গুইন বছরে
প্রায় ছয় লাখ পর্যটক টেনে আনে। এই দ্বীপের জনসংখ্যা দশ হাজারের মত। কিন্তু
গ্রীষ্মের সময় পর্যটকের ভিড়ে চারগুণ বেড়ে যায়। কয়েক দশক আগে পেঙ্গুইনের সংখ্যা
অনেক কমে গিয়েছিল। এর কারণ অনেকগুলো। ওখানকার সমুদ্রে পেঙ্গুইনের প্রধান খাদ্য
পিলচার্ট মাছের মড়ক লেগেছিল। এছাড়া দক্ষিণে সমুদ্রের ধারে কৃষিজমি প্রসারণ, ঘরবাড়ি
তৈরি ইত্যাদি নানা কারণে সংখ্যাটা কমেছিল। কিন্তু এখানকার নেচার পার্ক সংস্থা নানা
পদক্ষেপ নেয়। নতুন করে সামারল্যান্ড অঞ্চলটা সংরক্ষণ করা শুরু করে। সরকারি তরফে বায়-ব্যাক
পরিকল্পনার মাধ্যমে সমুদ্রের কাছাকাছি জমি জায়গাগুলো সরকার আবার কিনে নিয়ে মনুষ্য
বসতি শূন্য করা হয়। পেঙ্গুইনদের কলোনিতে অসংখ্য কৃত্রিম বাসা বানিয়ে অঞ্চলটা
নতুন করে সাজানো হয়। এর ফলে লিটল পেঙ্গুইন, যাদের সংখ্যা আশির দশকের গোড়ায় একসময়ে বারো
হাজারে নেমে গিয়েছিল, সেটা বেড়ে একত্রিশ হাজারে পৌঁছে গেছে। অস্ট্রেলিয়া জনবিরল
দেশ বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
সমুদ্রতীরে পেঙ্গুইনদের অপেক্ষায় নীরব জনতা
সন্ধে অনেকক্ষণ নেমে গেছে। আকাশে তবুও সূর্যের শেষ রেশ যেন মেখে আছে। সমুদ্রের ধারে প্রবল কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। উপদ্বীপের শেষ প্রান্তে গ্রানাইট পাথরের পাহাড়ের ঢালে ঢেউয়ের সাদা ফেনা আছড়ে পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। পেঙ্গুইনদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমরা সকলে প্রায় জমে গেছি।বহু জনতার মাঝেও এক অপূর্ব নিস্তব্ধতা। আমাদের ডান দিকে দূরে সমুদ্রের বুকে আড়াআড়ি ভাবে ঢেউ খেলে জেগে আছে অনেকগুলো ব্যাসল্ট পাথরের পাহাড়ের সীমারেখা। সেই শেষ পাহাড়টার সমুদ্রমুখী ঢালে- যেখানে নীরব নিশি তার আঁধার কেশভার নামিয়ে দিয়েছে---হঠাৎ দেখি পাহাড়ের আড়াল থেকে ঢেউয়ের মাথায় জেগে উঠল কতকগুলো কালো কালো বিন্দু। পরের ঢেউয়ের দোলায় দেখা দিল আরও কয়েকটা। এভাবে পরের পর ঢেউয়ের ছন্দের তালে তালে দেখি অসংখ্য কালো বিন্দু জেগে উঠছে। আলো আঁধারের মধ্যে তাদের আবির্ভাব।আমাদের সকলের মনের কোণে যেন এক অনুরণন জাগিয়ে আনন্দবিপ্লব ঘটে চলেছে। কাছে আসতে দেখি দলে দলে ক্ষুদে পেঙ্গুইনরা জল থেকে ডাঙায় উঠে টলমল করে আমাদের সামনে দিয়ে যেন প্যারেড করতে করতে সৈকত অতিক্রম করে তাদের বাসার দিকে হেঁটে চলেছে। অপেক্ষমান বিপুল জনতাকে উপেক্ষা করে। আমরা নির্বাক বিস্ময়ে তাদের পিছু নিয়ে কাঠের ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকি। উচ্চতায় মাত্র তেত্রিশ থেকে তেতাল্লিশ সেন্টিমিটার। শক্ত কালো ঠোঁট। পিঠের দিক গাঢ় নীল পালকে ঢাকা যা ক্রমশ ধূসর হয়ে মিশেছে রুপালি-সাদা পেটের দিকে। দেখতে নিশ্চয় সুন্দর -- কিন্তু সেই সৌন্দর্য ফ্যাশন নয়, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। সমুদ্রে এরা যখন ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার কাটে এই রকম গায়ের রং এদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে। পেটের দিকটা রুপালি-সাদা বলে জলের তলার দিকের প্রাণীরা ওপর থেকে সূর্যের আলোর প্রতিফলনে এদের শরীর দেখতে পায় না। আবার জলের ওপরে যখন ভাসে তখন এদের পিঠের গাঢ় নীল রঙের পালক সমুদ্রের নীল জলের সঙ্গে এমনভাবে মিশে থাকে যে আকাশের চিল বা বাজপাখির মত শিকারী পাখিরা এদের দেখতে পায় না। জলে এরা ঘণ্টায় প্রায় আড়াই কিলোমিটার গতিতে সাঁতার কাটে। এখানে প্রায় দুহাজার পেঙ্গুইনের বাস। প্রতিদিন সন্ধের পর যখন আকাশের বা ডাঙার শত্রুর আশঙ্কা কম থাকে তখন এরা সৈকত অতিক্রম করে বাসায় ফেরে। হাঁটার সময়ে এরা একে অপরকে সম্ভাষণ করে, নানা রকমের শব্দ করে একে অপরের সঙ্গে গল্প করতে করতে এগিয়ে যায়। কোনো সঙ্গী পিছিয়ে গেলে দল তার জন্য অপেক্ষা করে। বাসায় ঢুকে রাত্রিটুকু বিশ্রামের পরই পরদিন অনেক ভোরে তারা আবার অজানা সমুদ্রে পাড়ি দেয় নির্ভীক ভাবে। অতি উৎসাহী এই মনুষ্যকুলের জন্য তাদের না আছে কোন আগ্রহ, না আছে বিরক্তি বা ভয়।
লিটল পেঙ্গুইন (উপরে) ও রাতের আলোতে পেঙ্গুইনস প্যারেড
পেঙ্গুইনস প্যারেড থেকে ফিরতে আমাদের বেশ রাত হল; বেশিরভাগ রেস্তঁরা দেখি বন্ধ। অবশেষে কোনোক্রমেএকটা দোকান থেকে পিৎজা কিনে আমরা কমফর্ট রিসর্টে ঢুকলাম। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা চলল। রাতের স্বপ্নে পেঙ্গুইন আর সিলদের সঙ্গে সাঁতার।
পরেরদিন সকালে মেলবোর্ন শহরের দিকে
রওনা। প্রথমেই কুইন ভিক্টোরিয়া মার্কেট,দক্ষিণ গোলার্ধের সবচেয়ে বড় খোলা বাজার।
প্রায় সতেরো একর এলাকা নিয়ে দারুণ এক পরিকল্পিত ব্যাপার। ইন্দ্রনীলদা আর ঐন্দ্রিলা
গাড়িদুটো পার্ক করে সবার আগে মার্কেটের একটা বড় আকর্ষণ মাংস আর মাছের দোকানগুলোতে
নিয়ে গেল।নানা রঙের,নানা প্রজাতির টাটকা বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ, অনেক ধরনের মাংস
সম্ভার থরে থরে এত সুন্দর করে দোকানের শো-কেসগুলোতে সাজানো যে সেগুলোর ছবি তুলে আর
নাম দেখতে দেখতে আমাদের অনেকটা সময় কাটল। সবকিছু তাজা রাখার জন্য সবজি, মাছ, মাংস বা দুগ্ধজাত পদার্থের
এলাকাগুলো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা করে রাখা থাকে। আমরা নিজেদের মতো করে প্রায় দুঘণ্টা ওই বিশাল বাজার ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সবাই কিছু কিছু সুভেনির কিনল।
আমার আর গৌতমের নজর পড়েছিল বুমেরাঙের দিকে, ছোটবেলা থেকে যেগুলোর গল্প অনেক
শুনেছি। লক্ষ্য করলাম সাদা চামড়ার
বিক্রেতা খুব কম। ক্রেতাও তাই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকের ভিড়
বাজারে।
ভিক্টোরিয়া মার্কেটে জিভে জল আনা খাবার
ওখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মেলবোর্ন সেন্ট্রাল শপিং প্লাজা চত্বরে। একটা সুসজ্জিত মার্কেট কমপ্লেক্স। ভেতরে একটা বিখ্যাত পেল্লাই সাইজের গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকের নিচে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে ছবি তোলা।
গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকের পিছনে
মেলবোর্ন শহরের কেন্দ্র অঞ্চলে ট্রামে চড়তে কোনো পয়সা লাগে না। শহরের ভিতরে যাতে কম গাড়ি ঢোকে সে জন্য এই ব্যবস্থা। সদা ব্যস্ত এই শহরকে যানজট বা দূষণের হাত থেকে কিছুটা রেহাই দিতে এই অভিনব কায়দাটা বেশ লাগল। আমরাও ট্রামে চেপে কিছুটা গেলাম। তারপর হেঁটে বিখ্যাত হোসিয়র লেন। গ্রাফিটি রোড। নিউ ইয়র্ক শহরের গ্রাফিটি রোডের অনুপ্রেরণায় মেলবোর্ন শহরে এই রাস্তার প্রদর্শনের জন্ম। হেঁটে দারুণ অনুভূতি। নাম না জানা কম বয়সী ছেলেমেয়েরা রঙিন স্টিকার শিল্প,পোস্টার শিল্প তুলির টানে রাস্তাটার দুধারের দেওয়াল ভরিয়ে তুলেছে। যৌথ মালিকানা এবং ‘DIY’ (do it yourself) নৈতিকতার দৃঢ় অনুভূতি ও সচেতনতা নিয়ে এই আন্দোলনের শুরু। এই শিল্প প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পের বিরুদ্ধে জেহাদ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল একুশ শতকের গোড়ায়। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী তকমা পরবর্তীকালে ধরে রাখা যায়নি। দেশ বিদেশের অনেক নামী দামী শিল্পীর হাতের ছোঁয়া এখানে পড়েছে।
গ্রাফিটি রোডে ঐন্দ্রিলার সঙ্গে
প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকার (এপ্রিল- জুলাই), ২০২০
এই লেখার পরের পর্বঃ
No comments:
Post a Comment