ইউ এফ ও থেকে সেতুসদ্রম
– বিজ্ঞানের মোড়কে অবিজ্ঞান
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
মনে পড়ে এই কয়েকদিন আগে
কোনো এক বিশেষ টেলিভিশন চ্যানেলে সন্ধ্যাবেলা আকাশে উড়ন্ত এক অচেনা আলোর ছবি
দেখিয়ে হুলুস্থুলু ফেলে দিয়েছিল? দিনটা ছিল অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখ। বড়বড় করে
লেখা হল কলকাতার আকাশে ইউ এফ ও? অন্য অনেকের মতো আমিও জনৈক ব্যক্তির
হ্যান্ডিক্যামে তোলা ছবি দেখেছিলাম। তার সঙ্গে ছিল আগে কবে কোথায় ইউ এফ ও দেখা
গেছে তার ফর্দ। ছবি দেখে অবশ্য সেটা কোন বস্তুর তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। দু এক
দিন পরে জানা গেল ওটা আসলে শুক্র গ্রহের ছবি।
খবরের কাগজে ব্যাখ্যাটা পড়ে
একটু অবাকই হয়েছিলাম, কারণ আমার ধারণা ছিল শুক্ৰ সবাই চেনেন। সূর্য আর চাঁদ ছাড়া
আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হল শুক্ৰ— তাকে ইউ এফ ও বলে ভুল করাটা একটু
অস্বাভাবিকই মনে হয়েছিল আমার। পরে জানলাম। এই প্রথম নয়, আগেও অনেকেই এই একই
ভুলের শিকার হয়েছেন। ১৯৭৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার গভর্নর জিমি
কার্টার, যিনি পরবর্তীকালে সে দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, একই ভুল করেন। এমনকি
১৯৬৬ সালে পেনসিলভানিয়ার পুলিশের একবার ঘণ্টায় একশ মাইল বেগে গাড়িতে করে শুক্রগ্রহকে
তাড়া করারও রেকর্ড আছে। হ্যান্ডিক্যামে তোলা শুক্রের ছবিকে আগেও ইউ এফ ও বলে ভুল
হয়েছে। কলকাতায় ইউ এফ ও-র আপাতত এখানেই ইতি। তবে সেই চ্যানেলে ভাষ্যকারের গভীর
গলায় ইউ এফ ও-র তালিকা আবৃত্তি শুনে এ বিষয়ে কিছু লেখার লোভ সামলাতে পারছি না।
ইউ এফ ও অর্থাৎ (Unidentified
Flying Object) বা অজানা উড়ন্ত বস্তু। তবে Flying Saucer বা উড়ন্ত চাকি নামটাই
বোধহয় বেশি চলে। এখানে একটা পার্থক্য আছে – ইউ এফ ও নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে
তারা অজানা, কিন্তু উড়ন্ত চাকি কৃত্রিম ছাড়া হওয়া সম্ভব নয়। সাধারণভাবে উড়ন্ত
চাকি বলতে অন্য গ্রহের মহাকাশযানই মনে করা হয়। তবে এমন মতও পড়েছি যেখানে বলা
হয়েছে পৃথিবীটা আসলে ফাঁপা, তার ভিতরে আর এক সভ্যতা অবস্থান করছে। ইউ এফ ও-গুলোকে
তারাই পাঠায়। টিভিতে শুনলাম অ্যারিস্টটল নাকি ইউ এফ ও দেখেছিলেন – হবেও বা। তবে
অনেক কিছুকেই মানুষ ইউ এফ ও বলে ভুল করে – তার মধ্যে শুক্র বা বৃহস্পতি গ্ৰহ,
ধূমকেতু, উল্কা ইত্যাদি যেমন আছে, তেমনি আছে ঘুড়ি, বেলুন, কৃত্রিম উপগ্রহ,
এরোপ্লেন, অরোরা বোরিয়ালিস বা মেরু জ্যোতি, এমন আরো অনেক কিছু। মাটির সার্চলাইটের
আলো মেঘে পড়ে উড়ন্ত চাকি বলে ভুল হওয়ার নজির আছে। প্লেনের জানলায় রোদ পড়ে ইউ
এফ ও মনে হয়েছে। পাখির ডানায় অস্তগামী সূর্যের আলো পড়ে বিভ্রমের সৃষ্টি হয়েছে।
একথা মনেও করবেন না যে
অ্যারিস্টটলই প্রথম ইউ এফ ও দেখেছিলেন। পঞ্চাশ হাজার আগের বছরের গুহাচিত্রে উড়ন্ত
চাকি খুঁজে পেয়েছেন অনেকে। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, তখন এরিক ফন দানিকেন বলে এক
ভদ্রলোকের লেখা কয়েকটি বই নিয়ে বেশ হইচই পড়েছিল। তাতে দানিকেন দেখানোর চেষ্টা
করেছিলেন যে কয়েক হাজার বছর আগে গ্রহান্তরের প্রাণীরা পৃথিবীতে এসেছিল। আর আমাদের
পূর্বপুরুষদের উন্নত প্ৰযুক্তি দিয়ে সাহায্য করেছিল। তাদের দেখেই মানুষ দেবতার
কল্পনা করেছে। প্রমাণ ? আমার সামনে দানিকেনের লেখা একটা বই খোলা আছে, তাতে দেখছি
প্রাচীন ব্যাবিলনের এক মূর্তির ছবি। সে যে চাপা প্যান্টটি পড়ে আছে, তার সঙ্গে
আজকের সাঁতারের পোশাকের সাদৃশ্য আছে – অতএব… স্বীকার করছি যে বইটিতে এটিই একমাত্র প্রমাণ তা নয়,
কিন্তু এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার। দানিকেন বা তাঁর মতাবলম্বীরা কেন জানিনা
বিশ্বাস করেন যে পাঁচ হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা আমাদের থেকে অনেক কম
বুদ্ধিমান ছিল, তারা কখনো সাঁতারের পোশাক বানাতে পারে ? সুতরাং ভিন গ্রহের
প্রাণীরা নিশ্চয় চাপা প্যান্ট পরে মানুষের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। (আমি কিন্তু
সেই প্ৰাণীদের পোশাকের ফ্যাশন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।) তাই দেখে সে
সময়ের শিল্পী ধারণাটা পেয়েছিলেন।
এই মতে যাঁরা বিশ্বাস করেন,
বিবর্তন সম্পর্কে যে আসলে কোনো ধারণাই নেই, তা বোঝা শক্ত নয়। প্ৰজাতির উন্নয়ন
ঘটে ডারউইনের পথে হাজার হাজার প্রজন্ম ধরে, তাতে সময় লাগে লক্ষ কোটি বছর। কিন্তু
প্ৰযুক্তির বিকাশ ঘটে লামার্কের পদ্ধতিতে, একটি মাত্র প্রজন্মে। বিষয়টা আর একটু
স্পষ্ট করে দেখা যাক। মিউটেশন বা পরিব্যক্তির মাধ্যমে জীবের নতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি
হয়, কিন্তু তা কখনোই নির্দিষ্ট দিকে হয় না, পুরোপুরি র্যানডম। যেমন, জলচর
মেরুদণ্ডী প্রাণীর স্থলচর হওয়ার জন্য ফুলকার জায়গায় প্রয়োজন হয়েছিল ফুসফুসের।
কিন্তু তার জন্য লেগেছিল বহু সময়। কারণ যে পরিব্যক্তি ফুলকাকে ফুসফুসে রূপান্তরিত
হতে সাহায্য করে তার সম্ভাবনা যতটা, তার ঠিক উল্টো পরিব্যক্তিরও সম্ভাবনা প্রায়
ততটাই। তাহলে ফুসফুস সৃষ্টি হয়েছিল কেমন করে ? হয়েছিল, কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচন
বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে প্ৰথম ধরনের পরিব্যক্তিকে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু তার জন্য বহু
প্ৰজন্ম অতিবাহিত হতে হয়েছিল। বিবর্তনের ইতিহাস সেই সাক্ষ্য বহন করে।
অন্যদিকে প্রযুক্তির বিবর্তন
কখনোই র্যানডম নয়। প্রথম এরোপ্লেন বানাতে অনেক সময় লেগেছিল, কিন্তু একবার
বানানোর পর দ্বিতীয়বার আর আগের ভুলগুলির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। তাই
প্রযুক্তির বিবর্তন অনেক গুণ বেশি দ্রুত। গত পাঁচ হাজার বছরে মানুষের মস্তিষ্কের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয় নি। ব্যাবিলনের সময়কার আমার
পূর্বপুরুষ আমার মতোই বা আমার থেকেও বেশি বুদ্ধি রাখতেন। হাজার হাজার বছর ধরে যা
হয়েছে তা হল বিজ্ঞান ও সেই সঙ্গে প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতি। এরোপ্লেন বা
কম্পিউটার আমরা বানাতে পারি। কারণ গত কয়েক হাজার বছরের পুঞ্জিত জ্ঞান আমাদের
নাগালের মধ্যে। সাঁতারের পোশাক বানানোর জন্য তার প্রয়োজন হয় না।
এমন আরো অনেক ‘প্ৰমাণ’ বইটার
পাতায় পাতায় ছড়ানো। মানুষের দেহে পোকার মাথা, ডানাওয়ালা সিংহ, তারকাখচিত
পোশাক, এসব মূর্তিই নাকি ভিনগ্রহের প্রাণীর পৃথিবীতে আসার অভ্রান্ত নিদর্শন। মানতে
হবে আমাদের পূর্বপুরুষদের কল্পনাশক্তি ছিল এতই কম যে সিংহের দেহে ডানা লাগানোর
আগেও তাদের ডানাওয়ালা সিংহ দেখতেই হত। ঐ বইয়ের একটা ছবির ক্যাপশন হুবহু তুলে দিই।
চার নম্বর ছবির পাশে লেখা আছে ‘মহান সাইরাস (৬০০ খৃঃ পূঃ) এর আদেশে নির্মিত চার
ডানাওয়ালা মূর্তি। এ চিত্রে উড্ডয়ন ক্ষমতা আরোপ করা হয়েছে রাজাকে, কিন্তু সে
কালের কেউ তো উড্ডীন জীব দেখে নি।” একথা সত্যি বলে বিশ্বাস করতে গেলে মেনে নিতে
হবে যে পাখি, বাদুড়, ফড়িং সবই গৌতম বুদ্ধের পরে পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে।
সন্দিহান পাঠক মিলিয়ে নেবেন, বইটির নাম “আমার পৃথিবী – প্রাচীন দেবতার অন্বেষণে’।
অনুবাদক অজিত দত্ত, প্রকাশক লোকায়ত প্রকাশন, দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রকাশকাল ১৯৭৭ ৷
প্ৰসঙ্গত বলে রাখি দানিকেন অনেক জায়গায় প্রমাণ জাল করেছেন বলেও ধরা পড়েছেন। তবে
বই বিক্রি তাতে আটকায় নি।
ফিরে আসি আধুনিক কালে। উড়ন্ত
চাকির রূপকথার আধুনিক যুগের সূচনা হিসাবে ১৯৪৭ সালকে চিহ্নিত করা যায়। এক মার্কিন
বিমান থেকে নটি থালার মতো বস্তু উড়তে দেখার ঘটনা চারিদিকে আলোড়ন ফেলেছিল। তার পর
বহু লোক উড়ন্ত চাকি দেখেছেন বলে রিপোর্ট করেন, কেউ কেউ এমনকি তার আরোহীদের সঙ্গে
সাক্ষাৎ করেন। তাদের চাকিতে উঠে মঙ্গল বা শুক্র গ্রহে ঘুরে আসারও খবর আছে। তবে যখন
জানা গেল যে মঙ্গল এক অতি শুষ্ক শীতল মরুভূমি আর শুক্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রায় সিসা
গলে যাবে, তখন ভিনগ্রহে মধুচন্দ্রিমা যাপনের বা ছুটি কাটানোর উৎসাহে একটু ভাঁটা
পড়ে।
কেন যুক্তিবাদীরা উড়ন্ত
চাকির অস্তিত্বে সন্দিহান? একটা মাত্র কারণ দেখা যাক। উড়ন্ত চাকি সংক্রান্ত
প্ৰায় সব কটি ঘটনায় যে সাধারণ বর্ণনাগুলি পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে
উল্লেখযোগ্য হল তাদের অতি দ্রুত বেগ, হঠাৎ দিক পরিবর্তন এবং নিঃশব্দ চলাফেরার
ক্ষমতা। এখানেই খটকা লাগে। যেরকম জোরে চাকিরা ব্রেক করে ও দিক পাল্টায় তাতে যে
কোনো বস্তু, তা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া উচিত। তকের
খাতিরে যদি ধরে নিই যে উন্নততর সভ্যতার পক্ষে অত্যন্ত শক্তিশালী যান বানানো সম্ভব
কিংবা তারা নিউটনের গতিসূত্রগুলিকে অগ্রাহ্য করার কায়দা জানে, তাতেও সমস্যাটার
সমাধান হয়না। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে প্ৰায় সব সময়েই শোনা যায় কেমন অসাধারণ
নিঃশব্দে চাকিগুলি চলাফেরা করে। আসলে আমরা সবাই জানি যে গাড়ি আওয়াজ করে না, তারা
লড়ঝড়ে বিকট শব্দ করা গাড়ির থেকে অনেক ভালো। তার থেকে সহজেই মনে হয় আমাদের কান
ফাটানো আওয়াজের প্লেন, হেলিকপ্টার বা রকেট থেকে নিঃশব্দ চাকি অনেকগুণ উন্নত।
চাকির গতিবেগ অনেকেই বলেছেন ঘণ্টায় বারোশো কিলোমিটার থেকে তিরিশ হাজার
কিলোমিটারেরও বেশি (যদিও কিভাবে বেগ মাপা গেলো তা কখনোই পরিষ্কার নয়)। যদি
সবচেয়ে কম বেগও ধরি, তাহলেও এত দ্রুত কোনো বস্তু বাতাসের মধ্যে দিয়ে গেলে
হাওয়ার সঙ্গে ধাক্কায় যে শকওয়েভ অর্থাৎ প্রচণ্ড আলোড়ন ও শব্দ সৃষ্টি করবে:
তাতে কয়েকশো গজের মধ্যে মানুষের দাঁড়িয়ে থাকা তো দূরের কথা, বাড়ি ঘর ভেঙে পড়ে
যাওয়া একেবারে নিশ্চিত। এর সঙ্গে ইঞ্জিনের আওয়াজের কোনো সম্পর্ক নেই। এরকম আরো
সমস্যা প্ৰায় সব প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণেই আছে। তাছাড়াও এই মহাবিশ্বের বিশালত্বকে
মাথায় রাখলে পৃথিবীর মতো ছায়াপথের বাইরের দিকের কোনো গ্রহে এই অল্প সময়ের মধ্যে
এত ভিনগ্রহের আগন্তুকের আনাগোনা অবাস্তব মনে হওয়া স্বাভাবিক।
১৯৫০ সাল নাগাদ উড়ন্ত চাকি
নিয়ে উন্মাদনা শিখরে উঠেছিল। আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশের সরকার বিজ্ঞানী ও সামরিক
বাহিনীর অফিসারদের নিয়ে এবিষয়ে খতিয়ে দেখার জন্য অনুসন্ধান কমিটিও গঠন করেছিল,
তাদের কোনো রিপোর্টেই ভিনগ্রহের প্রাণীদের কথা পাওয়া যায় নি। বিশ্বাসীরা অবশ্য
অন্য কথা বলেন। তাদের দুরকম মত আছে। একদল বলেন যে সরকার ষড়যন্ত্র করে সব
তথ্যপ্রমাণ গোপন করেছে। সমস্ত সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত।
তাঁদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই যা আপনি বিবেচনা করতে পারবেন – সবই তো সরকার চেপে
রেখেছে। বিজ্ঞানের যুক্তি তাঁরা শুনতে নারাজ, কাজেই সে নিয়ে আলোচনা দীর্ঘায়িত
করে কোনো লাভ নেই।
অন্য এক দল মানুষ আছেন যাঁরা
শুরু করেন এই সমস্ত রিপোর্ট থেকেই। এ কথা সত্যি বিভিন্ন সময়ে যে হাজারেরও বেশি
ঘটনা বিষয়ে অনুসন্ধান করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সবগুলির ব্যাখ্যা সঠিক ভাবে দেওয়া
সম্ভব হয়নি। ভুল করা, দৃষ্টিবিভ্রম, অলীকদর্শন বা জালিয়াতি, এসব বাদ দিলেও শতকরা
দুভাগ ঘটনা থাকে যাদের কারণ আমাদের জানা নেই। বিশ্বাসীরা বলেন যে ঐ ঘটনাগুলির
একমাত্র ব্যাখ্যা হওয়া সম্ভব ভিন গ্রহের আগন্তুক। তাঁরা প্রায়ই বলেন যে অমুক
বৈজ্ঞানিক বা তমুক তদন্তকারী সংস্থা এই ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি, সুতরাং
এর পিছনে কোনো সাধারণ কারণ থাকতেই পারে না।
আমি একথা বলছি না যে তাঁদের
বক্তব্য নিঃসন্দেহে ভুল। এমন হতেও পারে যে সত্যিই কোনো একটা বিশেষ ঘটনার জন্য
হয়তো ভিনগ্রহের আগন্তুকরাই দায়ী। সমস্যা হল যে এদের মধ্যে কোনো ঘটনারই পরম্পর
নিরপেক্ষ কোনো প্ৰত্যক্ষদর্শী নেই। ফলে সত্যতা যাচাই করা শক্ত। কিন্তু এই প্রসঙ্গে
বিজ্ঞানের একটা দিক মনে রাখতেই হবে, তা হল যুক্তিগ্রাহ্য সংশয় বা Logical
Skepticism। ঘটনার কোনো সাধারণ ব্যাখ্যা এই মুহূর্তে দেয়া যাচ্ছে না বলে যে সেরকম
কোনো ব্যাখ্যা হতেই পারেনা, তা নয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনেক সময়ই এত ভাসাভাসা
হয় যে তার থেকে সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায় না। তাই অসাধারণ নতুন কোনো
ব্যাখ্যার আগে ভাবতে হবে যে অপর কোনো অতি সাধারণ কারণ থাকতে পারে কি না।
বিশ্বাসীরা প্রায়ই বলেন যে প্রমাণ করা যাবে। না যে ইউ এফ ও-টি মহাকাশযান নয়। এই
ধরনের কুযুক্তিকে তৰ্কশাস্ত্ৰে বলে argumentum ad ignorantiam। কোন দাবী, এক মাত্র
তা মিথ্যা প্রমাণ করা যাচ্ছে না, এই কারণেই সত্য হতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না
ভিন গ্রহের প্রাণী ইউ এফ ও-র কারণ বলে প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা মেনে
নেওয়াই বাস্তবসম্মত যে তার কোনো সাধারণ ব্যাখ্যা আছে; আমরা ব্যাপারটা সম্পর্কে
সমস্ত তথ্য জানিনা বলে আমরা এখনি সেটা খুঁজে পাচ্ছি না।
এই দলের মানুষদের নিয়ে
সমস্যাটা হল যে এঁরা ইউ এফ ওটি যে মহাকাশযান নয় তা প্রমাণের ভার আপনার উপরই ছেড়ে
দেবেন। কিন্তু আপনি যে যুক্তিকে প্রামাণ্য মনে করবেন, তাঁরা তাকে স্বীকার করবেন না।
একটা উদাহরণ নেয়া যাক। কলকাতার ইউ এফ ওটিকে আপনার প্রতিবেশী দেখেছেন। আপনি তার
কাছে জেনে নিলেন। সেটি আকাশের কোন দিকে কোন কোণে কতক্ষণ ছিল । তারপর বার করে নিলেন
যে সেদিন আকাশে ঐ দিকে ঐ সময়ের জন্য কোন জ্যোতিষ্ক অবস্থান করছিল। আপনি দেখলেন যে
শুক্রগ্রহের সঙ্গে তা পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই আপনার
মনে হল যে শুক্রকেই ইউ এফ ও বলে ভুল হয়েছে। বিশ্বাসী কিন্তু বলবেন যে, ওটি যে
মহাকাশযান নয়। তার কোনো প্ৰমাণ কোথায় – সেদিন উড়ন্ত চাকি আর শুক্রগ্রহ হয়তো
আপনার প্রতিবেশীর কাছে একই সরলরেখায় অবস্থান করছিল বটে, কিন্তু তিনি শুক্রকে
দেখতে পান নি, উড়ন্ত চাকিই দেখেছেন। আপনি বলার চেষ্টা করলেন যে একই কোণের
ব্যাপারটা অন্য জায়গা থেকে দেখলে তো সত্যি হবে না। তাহলে আর কেউ চাকিকে দেখতে
পায়নি কেন ? তাদের তো আর শুক্র আর চাকিটাকে গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা ছিল না ।
(শুক্র অনেক দূরে, আপনার শহরের সকলের কাছেই একই সময়ে সে একই কোণ উৎপন্ন করে।
কিন্তু কাছের বস্তু, যেমন প্লেন বা চাকি, তার জন্য একথাটা খাটবে না।) বিশ্বাসীর
বিজয়গর্বে উত্তর, কিন্তু আর কেউ তো ইউ এফ ও-টির দিকে তাকায়নি – তাকালেই তারা
দেখতে পেত। কাজেই বিশ্বাসীকে মানানোর মতো প্রমাণ জোগাড় করা আপনার সাধ্যের বাইরে।
এই দুই দলের লোকই বিজ্ঞান
নয়, মূলত অবিজ্ঞান নিয়ে বেশি। উৎসাহী। বৈজ্ঞানিকের যুক্তি তাঁরা মানতে নারাজ।
অপর কেউ কেউ আছেন যাঁরা এই দলদুটির কোনোটাতেই পড়ে না। অথচ উড়ন্ত চাকি নিয়ে
মাতামাতিতে অগ্রগণ্য। একটু ভাল ভাবে দেখলেই বোঝা যায় তাদের স্বার্থ। উড়ন্ত চাকি,
বারমুডা ট্র্যাঙ্গলের তথাকথিত রহস্য বা হারিয়ে যাওয়া আটলান্টিস নিয়ে বই বাজারে
চলে ভালো, তার সুযোগ তাঁরা নিতে চান। The Flying Saucers Have Landed নামের একটি
বই একসময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর লেখকদ্বয় তো চাঁদের পিছন দিকে, যে দিকটা
আমরা দেখতে পাইনা সেদিকে, বিরাট শহর দেখেছিলেন; শুক্র গ্রহের অধিবাসীর সঙ্গে আলাপ
করেছিলেন। (তখনো পর্যন্ত আমাদের জানা ছিল না যে শুক্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্ৰায়
পাঁচশো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড)। বিশ্বাসীরা সেই ধরনের বই লক্ষ লক্ষ কিনেছেন। একা
দানিকেনেরই বই বিক্রি হয়েছে সাড়ে তিন কোটির বেশি। লাভ করা হয়েছে তা বলাই
বাহুল্য।
কেন এত মানুষ ভিনগ্রহের
প্রাণীর পৃথিবীতে আসার কথায় বিশ্বাস করতে চান ? আকাশে ইউ এফ ও দেখলে দৈনন্দিন
জীবনে কি সুবিধা হবে যার জন্য সাধারণ অফিসের বা দোকানের কর্মচারী থেকে কখনো কখনো
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী পর্যন্ত এই চাকি-ম্যানিয়াতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন ?
মনস্তত্ত্ববিদ মাইকেল শেরামার একটা ভারি উল্লেখযোগ্য কথা বলেছেন।
বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের আয়তন এত বিশাল যে কল্পনা করা যায় না। আমাদের তৈরি মহাকাশযান
ভয়েজার ঘণ্টায় ষাট হাজার কিলোমিটার বেগে যাচ্ছে। সবচেয়ে কাছের তারা প্রক্সিমা
সেন্টরাই-এর সমান দূরত্ব অতিক্রম করতে তার সময় লাগবে পঁচাত্তর হাজার বছরেরও বেশি।
সবচেয়ে কাছের তারায় যেতে যদি এত সময় লাগে, তাহলে তারাদের মধ্যে সশরীরে যোগাযোগ
করা কত কঠিন বুঝতেই পারছেন। মনে রাখতে হবে যে সব তারার গ্রহ আছে এমন নয়। আবার
গ্রহ থাকলেই প্ৰাণ তৈরি হবে কি না। আমরা জানি না, উন্নত সভ্যতার কথা ছেড়ে দিন।
বস্তুত পৃথিবীর বাইরে প্রাণ আছে কিনা সে বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। খুব উন্নত
সভ্যতা ছাড়া এই বিশাল বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। তাই যে
প্রাণীরা আমাদের পৃথিবীতে এসে যোগাযোগ করবে তারা আমাদের থেকে হয়তো লক্ষ বছর
এগিয়ে থাকবে। আগেই বলেছি বিজ্ঞান প্রযুক্তি লামর্কের পথ অনুসরণ করে অর্থাৎ তার
অগ্রগতির হার ক্রমশই বেড়ে চলে। সেকারণে গরুর গাড়ি থেকে এরোপ্লেন বানাতে সময়
লেগেছে দশ হাজার বছর আর সেখান থেকে মানুষ চাঁদে পৌঁছেছে মাত্র ছেষট্টি বছরে। তাই
লক্ষ বছর পরে বিজ্ঞান প্রযুক্তি কোথায় পেঁৗছোবে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। দেবতাদের
আমরা সাধারণত সর্বজ্ঞ বা সর্বশক্তিমান ভাবতে অভ্যস্ত। সেই উন্নত সভ্যতার প্রাণীরা
আমাদের কাছে কিন্তু দেবতাদের মতোই মনে হবে।
১৯৫০ এর দশকে দুই মহাশক্তি
আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন আরো বড় নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর প্রতিযোগিতা শুরু
করেছিল। তখন সাধারণ মানুষের মনে হত যে অল্প দিনের মধ্যেই যুদ্ধ বাঁধবে। আর তাতে
পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এরকম বিপদ থেকে বাঁচতে আগে মানুষ দেবতার শরণাপন্ন হত।
কিন্তু পশ্চিম দেশে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির চমকপ্ৰদ অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম মানুষের
মন থেকে পিছু হটেছে। তাই অনেকের কাছে আধুনিক যুগের নতুন দেবতার স্থান নিয়েছিল
অন্য গ্রহের উন্নত প্ৰাণী যে প্রাচীন কল্পনার দেবতার মতই শক্তিশালী। সে জন্যই
১৯৫০-এর দশকে উড়ন্ত চাকি নিয়ে মাতামাতি হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি। এখনো কিন্তু দূষণ
বা বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপদ থেকে বাঁচতে কিছু মানুষ ইউ এফ ও-র দিকে তাকিয়ে
আছে।
আমাদের দেশে কিন্তু
চাকি-ম্যানিয়া কখনোই বিদেশের, বিশেষ করে আমেরিকার পর্যায়ে পৌছোয়নি। আমার মনে হয়
তার একটা হল এশিয়ার প্রাচ্য দেশগুলি আধুনিক বিজ্ঞানপ্ৰযুক্তির জগতে অনেকটাই
পিছিয়ে। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের দেশে আমদানি করা বস্তু, তার জন্ম এদেশে হয়নি। তাই
বিজ্ঞান পড়লেও আমাদের মানসিকতা এখনো তাকে আত্মস্থ করতে পারেনি, বরঞ্চ অনেক সময়েই
হয়েছে বদহজম। তাই পশ্চিমের দেশগুলির মতো ধর্ম এখানে অতটা পিছিয়ে যায় নি, কখনো
কখনো সে অনেক আক্রমণাত্মক । তাই আমরা এখনো আমাদের বহুদিনের পরিচিত দেবদেবী,
গুরুফকিরদের উপরই ভরসা করি, মঙ্গলগ্রহ বা সিরিয়াস নক্ষত্রের সর্বশক্তিমান সবুজ
মানুষদের প্রয়োজন আমরা এখনো অনুভব করিনি।
তা বলে কিন্তু
গণ-হিস্টেরিয়াতে আমরাও কম যাই না। মনে পড়ে সারা দেশে গণেশের মূর্তির দুধ খাওয়ার
কথা ? সেখানেও কিন্তু বিজ্ঞানী থেকে সাধারণ মানুষ অনেকেই ঘটনার পরে পত্রপত্রিকায়
বা টিভি চ্যানেলে পদার্থবিদ্যার নিয়ম দিয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু তার
কয়েক বছরের মধ্যেই আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বোঝা গেল বিজ্ঞান আমাদের কাছে
বইয়ে পড়ার জিনিস, জীবনে প্রয়োগের নয়। আমরা যে বিজ্ঞান গবেষণাতে পৃথিবীতে
ক্রমশই পিছিয়ে যাচ্ছি তাতে আর আশ্চর্য কি ?
ঠিক যেমন চাকি-ম্যানিয়াকে
পুঁজি করে বিদেশে বহু লোক অর্থ উপার্জন করে, আমাদের দেশেও সে রকম লোকের অভাব নেই।
প্রয়োজনে তারা বিজ্ঞানকে বিকৃত করতেও পিছপা হয় না। একটা সাম্প্রতিক ঘটনার কথা
মনে পড়ছে। ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে কয়েকটি আগ্রাসী হিন্দুত্ব প্রচারক
সংবাদমাধ্যম ও এন আর আই ওয়েব সাইটে হঠাৎ বলা হল যে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা
নাসা (NASA) মহাকাশ থেকে করা সার্ভেতে ভারত ও শ্ৰীলঙ্কার মধ্যের পক প্রণালীতে
সমুদ্রের তলায় এক প্রাচীন সেতুর চিহ্ন খুঁজে পেয়েছে। তার বয়স নাকি কার্বন ডেটিং
করে পাওয়া গেছে সতের লক্ষ বছর। নাসা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই এরকম কোনো খবরকে অস্বীকার
করে। কিন্তু তাতে কী ? মৌলবাদী হিন্দু সংগঠনগুলি একেই রামায়ণে লেখা
শ্ৰীীরামচন্দ্র নির্মিত লঙ্কা ও ভারতের মধ্যে সেতু বলে চিহ্নিত করে ও
শ্রীরামচন্দ্রের অস্তিত্বের প্রমাণ বলে প্রচার করতে শুরু করে।
২০০২ সালে কেন্দ্রে ছিল
ভারতীয় জনতা পাটি নেতৃত্বাধীন এন ডি এ সরকার। তারাই শুরু করেছিল সেতুসমুদ্রম
প্রকল্প যেখানে পক প্রণালীতে জাহাজ চলাচলের জন্য সমুদ্রে একটি চ্যানেল খোঁড়ার পরিকল্পনা
ছিল। এপর্যন্ত কোনো সমস্যা ছিল না। কারণ কেন্দ্ৰে ছিল হিন্দুত্ববাদী দল
নিয়ন্ত্রিত সরকার। কিন্তু ২০০৪ সালে সরকার পরিবর্তন হয়। এর পর রাষ্ট্ৰীয়
স্বয়ংসেবক সংঘের মতো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির ঘুম ভাঙে। ২০০৭ সালে তারা হঠাৎ
আবিষ্কার করে যে সেতুসমুদ্রম প্রকল্পে রামচন্দ্র নির্মিত সেতু ভেঙে ফেলা হবে।
ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যের উপর
এ এক চরম আঘাত। শুরু হয়ে গেল আন্দোলন। যোগ দিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির শীর্ষ
নেতৃত্বের অনেকে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ডঃ পুনীশ তানেজা নামের এক বিজ্ঞানীকে হাজির
করল। যিনি বললেন যে তাঁর গবেষণাতে প্ৰমাণ হয়ে গেছে। যে ঐ সেতু আসলে মানুষের তৈরি
এবং তার বয়স সতের লক্ষ পঞ্চাশ হাজার বছর। পরে জানা গেল। ঐ তথাকথিত বিজ্ঞানী আসলে
এক জালিয়াত। তারপরে সুপ্রিম কোর্টেও এই প্রকল্প নিয়ে মামলা হয়। বাকি ইতিহাস
হয়তো সকলের জানা, এই লেখাতে তার আর প্ৰয়োজন নেই।
কিভাবে নিজেদের স্বাৰ্থ
চরিতার্থ করতে বিজ্ঞানকে বিকৃত করা হয়। তার আদর্শ উদাহরণ হতে পারে এই ঘটনাক্ৰম।
মার্কিন মহাকাশ সংস্থার নাম দেওয়া হল যাতে বিশ্বাসযোগ্যভাবে হিন্দুধর্মের মহিমা
প্রচার করা সম্ভব হয়। পুরো প্রচারটার মধ্যে জালিয়াতি লক্ষ্য করার মতো। কোনো
ঐতিহাসিকই ভারতে আর্য সভ্যতাকে সিন্ধু সভ্যতার থেকে প্রাচীন বলে মনে করেন না।
সিন্ধু সভ্যতার বয়স ছ হাজার বছর। রামায়ণের ঘটনার সময়কালতো তার থেকে পুরোনো হতে
পারে না। তাহলে সতের লক্ষ বছরের কথা আসছে। কোথা থেকে ? আসলে রামচন্দ্রের যুগ হল
পৌরাণিক ত্রেতা যুগ। পুরাণের হিসাবে ধরলে সেটা ঐ সময়ই দাঁড়ায়। রামায়ণের ঘটনায়
কিছুটা ঐতিহাসিক উপাদান নিশ্চয় আছে, তবে সে জন্য তাকে ইতিহাস ভেবে নিলে মুশকিল।
কিন্তু কোনো মৌলবাদী সংগঠন তো আর ধর্মগ্রন্থের সত্যাসত্য বিচার করতে পারে না, তার
কাছে প্রতিটি লাইনই একেবারে ধ্রুব সত্য। তাই ভুলে যান যে ভারতে কেন, সারা পৃথিবীতে
পনের থেকে কুড়ি হাজার বছরের চেয়ে পুরোনো কোনো বড় জনবসতির নিদর্শন পাওয়া যায়
নি। মনেও রাখবেন না যে ঐ সময় নাগাদ তুষার যুগ শেষ হয় ও কৃষিকাজ আবিষ্কার হয়, আর
কৃষির আগে কোনো ভাবেই নগরপত্তন সম্ভব নয়। মেনে নিন ধর্মগ্রন্থে যা লেখা আছে তা
অক্ষরে অক্ষরে সঠিক।
এখানেই শেষ নয়। কার্বন ডেটিং
করে বয়স পাওয়া গেছে বললে বক্তব্যটা বেশ শক্তিশালী হয়। দেখা যাক এখানে
জালিয়াতিটা কি রকম। কোনো প্ৰাণী বা উদ্ভিদ মারা যাওয়ার পর তার দেহাবশেষের কার্বন
ডেটিং করা সম্ভব, অজৈব পদার্থের নয়। পাথর সাধারণভাবে অজৈব। পাথর তৈরির সময় তাতে
কোনো জৈব পদার্থ মিশে গিয়ে থাকলে তবেই তার বয়স বার করে পাথরের বয়স নির্ণয়
সম্ভব। রামায়ণের গল্প অনুযায়ী অন্য জায়গা থেকে পাথর এনে সেতু বানানো হয়েছিল।
সেতুর বয়স পাওয়া যাবে কোথা থেকে ? তাছাড়া এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি বয়স মাপা
যায় বড়জোর পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার বছর, তার বেশি হলে এই পদ্ধতি কাজ করে না। সবচেয়ে বড় কথা
কার্বন ডেটিং-এর জন্য পদার্থ থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তা মাপতে হয় বা তার ভরের
বর্ণালী বিশ্লেষণ (mass spectroscopy) করতে হয়, মহাকাশ থেকে যা কখনোই সম্ভব নয়।
এই কথাগুলো আজকাল অনেক সময়
বিদ্যালয় স্তরের বইতে পাওয়া যায়, তাই একথা ভাবা শক্ত যে আমাদের দেশের অন্যতম
প্রধান রাজনৈতিক দলের কেউ একথা জানতেন না। আসলে তাদের প্রয়োজন কোনো একটা ইস্যু যা
মানুষকে নাড়া দেবে। তা করতে গিয়ে যদি আধুনিক বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ হয়, তাতে
অসুবিধা নেই। রাজনৈতিক স্বার্থে এমন উদাহরণ যে আমাদের দেশে সীমাবদ্ধ তা নয়।
জার্মানিতে হিটলারের আমলে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল যে
ইহুদিরা আর্যদের থেকে পৃথক ও অনুন্নত প্ৰজাতি। আমেরিকাতে দাস প্রথাকে একই ভাবে
সমর্থন করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
উড়ন্ত চাকি হল আধুনিক যুগের
কুসংস্কার – অবিজ্ঞান সেখানে বিজ্ঞানের পোশাকে উপস্থিত। গণেশের দুধ খাওয়ার সঙ্গে
তার মূলগত কোনো পার্থক্য নেই। অপর দিকে আধুনিক বিজ্ঞানের যে সম্মান প্রতিপত্তি
তাকে ব্যবহার করে বিজ্ঞানের নামে এক অবৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে হাজির করার উদাহরণ হল ঐ
রাম সেতু নিয়ে আন্দোলন। একটা কথা বলে নেয়া ভাল। সেতুসমুদ্রম প্রকল্প নিয়ে অনেক
পরিবেশবাদীর আপত্তি আছে – সে বিষয়ে কোনো আলোচনা বর্তমান নিবন্ধে করা হয়নি। সে
দিকে অবশ্যই দৃষ্টিপাত করা উচিত। কিন্তু তার সঙ্গে পৌরাণিক যুগকে যুক্ত করার কোনো
ভিত্তি নেই। প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক মানসিকতা, যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা।
(এখন পর্যাবরণ: পঞ্চম বর্ষ ২য় সংখ্যা, ২০০৮, পরিমাৰ্জিত)
"বিজ্ঞান হলো পর্যবেক্ষনের সাহায্যে আবিষ্কারের চেষ্টা। এর ভিত্তি যুক্তি-বিচার।......বিজ্ঞান বড় ধরনের ধরে নেওয়া মত থেকে শুরু করে না; শুরু করে নির্দ্দিষ্ট ঘটনা থেকে। এগুলো থেকে সাধারন নিয়মে পৌঁছয়। ...কিন্তু এটা কাজ করার একটা প্রকল্প হিসেবে দেখা হয়। যদি এটা ঠিক হয়, তাহলে এখনও পর্যন্ত না-দেখা কিছু ঘটনা ঘটা উচিৎ। যদি দেখা যায়, এগুলো অবশ্যই ঘটছে, তাহলে প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠিত হয়; না হলে বাতিল হয়ে যায়। ......তখন এটাকে আমরা তত্ত্ব বলতে পারি। নানা ধরনের তত্ত্ব...নতুন এবং আরও সাধারন প্রকল্পের ভিত হতে পারে। এগুলো সত্যি হলে আরও এগোনো যায়।......বিজ্ঞানে শেষ সিদ্ধান্ত বলতে একটা নির্দ্দিষ্ট সময়ের সিদ্ধান্তকে বোঝায়। পরবর্তী ধাপে এ-সবকে অন্য কোনো বৃহত্তম নিয়মের দৃষ্টান্ত বলে মনে করা হবে।......আজ কিংবা কাল বর্তমান তত্ত্বের রূপান্তর প্রয়োজন হতেই পারে। এই পরিবর্তন গুলো এমন যা তাকে আরও নিঁখুত করে। তখন পুরোনো তত্ত্ব আর কজে লাগে না।........."
ReplyDelete(Religion & Science)
BERTRAND RUSSELL