Tuesday 15 August 2017

প্লুটো



নতুন দিগন্ত:  প্লুটো

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় 



শিল্পীর চোখে প্লুটো থেকে চ্যারন ও সূর্য (চিত্র:NASA/Southwest Research
Institute/Alex Parker)

      উপরের ছবিটা ফটো নয়, শিল্পীর আঁকা। এক ফালি বাঁকা চাঁদ ছোট্ট সূর্যের আলোতে আলোকিত। আমাদের সৌরজগতের কোথায় এই ছবিটা সত্যি হতে পারে বলতে পার? কোথাকার আকাশে উপগ্রহের চেহারা সূর্যের থেকে অনেক বড়? এ হল বামন গ্রহ (Dwarf planet) প্লুটো, এখনো পর্যন্ত আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে দূরের যে সদস্যকে খুব কাছ থেকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। ১৯ জানুয়ারি ২০০৬, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে যাত্রা শুরু করেছিল মহাকাশযান নিউ হরাইজন অর্থাৎ নতুন দিগন্ত। দীর্ঘ সাড়ে নয় বছর যাত্রার পর সে প্লুটোর সবচেয়ে কাছে পৌঁছয় ২০১৫ সালের ১৪ জুলাইসেখান থেকে পাঠায় ছবিসহ নানা তথ্যশুধু প্লুটো নয়, নিউ হরাইজন তার থেকেও আরো দূরে অনুসন্ধান চালাচ্ছেসৌরজগতের সৃষ্টি ও গঠন নিয়ে অনেক নতুন খবর দিয়েছে সে

      প্লুটোকে আমরা ছোটবেলায় গ্রহই বলতাম। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন ২৪ আগস্ট ২০০৬ ভোটাভুটির মাধ্যমে স্থির করে যে প্লুটো এখন থেকে আর গ্রহ নয়, তাকে বামন গ্রহ বলতে হবে। সৌরজগতে গ্রহের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে আট। বামন গ্রহের সংখ্যা বর্তমানে পাঁচ তবে এটা আরো বাড়তে পারে বলে অনুমান। গ্রহের যে সংজ্ঞা তাঁরা ঠিক করেছেন তা হল যে তাকে নিজের অভিকর্ষের টানে গোলাকার হতে হবে এবং তার কক্ষপথের আশেপাশের বস্তুকে আকর্ষণের মাধ্যমে নিজের কাছে টেনে নিতে হবে। আমরা জানি প্লুটো নেপচুনের কক্ষপথের ভিতরে চলে আসে, তার মানে তা নেপচুনকে আকর্ষণ করতে পারে নি। তাই প্লুটো আর গ্রহ নয়। অন্য বামন গ্রহগুলো হল হল সিয়ারিজ, হাউমিয়া, মাকেমাকে ও এরিসএদের মধ্যে সিয়ারিজ হল মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যের গ্রহাণুপুঞ্জের বৃহত্তম সদস্য, বাকিদের কথা পরে বলছি।



শিল্পীর চোখে নিউ হরাইজন, প্লুটো ও চ্যারন (চিত্র: NASA/Johns Hopkins University Applied Physics Laboratory/Southwest Research Institute

      বিজ্ঞানীরা ভেবেছেন প্লুটোর সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন দরকার। তা না হলে ভবিষ্যতে আরো যে সমস্ত বস্তু সূর্যের চারপাশে আবিষ্কার হবে তাদের নামকরণে সমস্যা হতে পারে। এমন ঘটনা নতুন নয়, সিয়ারিজকে প্রথমে গ্রহই বলা হত, পরে কাছাকাছি আরো গ্রহাণু পাওয়ার পরে তা পাল্টানো হয়। সাধারণ লোকের কিছু প্রশ্ন আছে। প্লুটো নেপচুনকে সরাতে পারেনি বলে যদি গ্রহ না হয়, তাহলে নেপচুনই বা গ্রহ কেন? সেও তো প্লুটোকে সরাতে পারে নি। কিছু বিজ্ঞানী তো মনে করিয়ে দিয়েছেন যে এমনকি গ্রহরাজ বৃহস্পতিও তার কক্ষপথকে পরিষ্কার করতে পারে নি, প্রায় একই কক্ষপথে অনেক ছোটো ছোটো গ্রহাণু আছে। গ্রহের সংজ্ঞা ঠিক করার সময় প্লুটোকে ব্যতিক্রম হিসাবে রেখে দিলে কি চলত না? এই ধরণের বিতর্ক ছাড়াও প্লুটো কিন্তু বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের বস্তু। তা না হলে এত খরচ করে আর মহাকাশযান পাঠানো কেন?

      কেন বিজ্ঞানীরা প্লুটো বা সৌরজগতের বাইরের অংশ নিয়ে এত কৌতূহলী? সে কথা জানার আগে প্লুটো আবিষ্কারের গল্প আর নিউ হরাইজন অভিযানের আগে পর্যন্ত প্লুটো সম্বন্ধে কী জানা আছে অল্প কথায় বলে নেয়া যাক। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত আমরা আটটা গ্রহের কথা জানতাম। তাদের মধ্যে সবচেয়ে দূরের গ্রহ নেপচুনের কক্ষপথ নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র দিয়ে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। তাই অনেক বিজ্ঞানী ভেবেছিলেন যে আরো দূরে অজানা এক গ্রহ আছে যার টানে নেপচুনের চলার পথ পাল্টে যাচ্ছে। কক্ষপথ যা হওয়া উচিত, আর দূরবিন দিয়ে পর্যবেক্ষণ থেকে যা পাওযা গেছে, তাদের মধ্যে পার্থক্য থেকে বিজ্ঞানীরা নতুন গ্রহের অবস্থান আর ভর বার করার চেষ্টা করেছিলেন। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, নেপচুনও এইভাবে ইউরেনাসের কক্ষপথের পরিবর্তন থেকে আবিষ্কৃত হয়েছিল। ১৯০৫ সাল থেকে খোঁজ চলছিল তাই আরো একটি গ্রহের যা নেপচুনকে আকর্ষণ করছে। অবশেষে লাওয়েল মানমন্দিরে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লাইড টমবাউ (Clyde Tombaugh) ১৯৩০ সালে প্লুটোকে আবিষ্কার করেন। প্লুটো অবস্থান বিজ্ঞানীরা অঙ্ক কষে যা বলে ছিলেন তার সঙ্গে মোটামুটি মিলেও গিয়েছিল। কিন্তু আমরা এখন জানি নেপচুনের কক্ষপথ পরিবর্তনে প্লুটোর ভূমিকা সামান্যই, আর তাছাড়া তখনকার পর্যবেক্ষণে প্রচুর ভুল ছিল। তাই অঙ্কের সঙ্গে প্লুটো অবস্থান মিলে যাওয়া একেবারেই সমাপতন।


প্লুটোর আবিষ্কর্তা ক্লাইড টমবাউ

      সূর্য থেকে প্লুটোর গড় দূরত্ব প্রায় ছ’শ কোটি কিলোমিটার। দূরত্বটা এতই বেশি যে সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার বেগে গেলেও সূর্য থেকে আলো প্লুটোতে পৌঁছতে সময় নেয় প্রায় ছ ঘণ্টাতুলনায় পৃথিবীতে পৌঁছতে আলোর লাগে সাড়ে আট মিনিট। বিজ্ঞানী কেপলার আবিষ্কার করেছিলেন গ্রহরা সূর্যকে উপবৃত্তাকার পথে প্ৰদক্ষিণ করে। তবে বুধ ছাড়া বাকি সব গ্রহের কক্ষপথই প্রায় বৃত্তাকার। জ্যামিতিতে উপবৃত্তের উৎকেন্দ্রিকতা বলে একটা ধর্ম আছে যা দিয়ে উপবৃত্ত ও বৃত্তের মধ্যে পার্থক্য মাপা হয়। যার উৎকেন্দ্রিকতা যত কম, সে তত বৃত্তের কাছাকাছি যায়। যেমন পৃথিবীর কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতা ০.০১৭। প্লুটোর উৎকেন্দ্রিকতা প্রায় ০.২৫। প্লুটো যখন সূর্যের সবচেয়ে কাছে আসে তখন সূর্য থেকে তার দূরত্ব পৃথিবী ও সূর্যের গড় দূরত্বের ৩০ গুণ; যখন সবচেয়ে দূরে থাকে তখন তা বেড়ে হয়ে যায় ৫০ গুণ। এজন্য প্লুটো কখনো কখনো নেপচুনের থেকে সূর্যের বেশি কাছে চলে আসে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৯, এই সময় নেপচুন ছিল প্লুটোর থেকে দূরে। আবার এমন ঘটনা ঘটবে ২২৩১ সালে। প্লুটোর কক্ষপথ অন্য এক দিক থেকেও গ্রহদের থেকে আলাদা, তারা যে তলে ঘোরে, প্লুটোর কক্ষপথ তার সঙ্গে ১৭ ডিগ্রি কোণ করে আছে। সূর্যের চারদিকে ঘুরতে প্লুটোর সময় লাগে প্ৰায় ২৪৮ বছর

      ১৯৭৮ সালে ২২ জুন মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেমস ক্রিস্টি ও রবার্ট হ্যারিংটন আবিষ্কার করেন যে প্লুটোর একটা চাঁদ আছেএই উপগ্রহের নাম দেয়া হল চ্যারন। প্লুটো ও তার চাঁদের আয়তন খুব কাছাকাছি, প্লুটোর ব্যাস হল ২,৩৮০ কিলোমিটার, আর চ্যারনের ১,২০০ কিলোমিটার। তাদের মধ্যে দূরত্ব হল মাত্র ১৯,০০০ কিলোমিটারপ্লুটো শুধু যে গ্রহদের থেকে ছোট তা নয়, আমাদের চাঁদ সমেত সৌরজগতে সাতটা উপগ্রহ আছে যারা প্লুটোর থেকে বড়। প্লুটোর ভর পৃথিবীর সাড়ে চারশো ভাগের এক ভাগ আর চ্যারনের ভর প্লুটোর আট ভাগের এক ভাগ। গ্রহ এবং উপগ্রহের মধ্যে এত কাছাকাছি ভর সৌরজগতে আর কোথাও নেই। প্লুটোর মাধ্যাকর্ষণও একেবারেই দুর্বল। তোমাদের কারো ওজন পঞ্চাশ কিলো হলে, প্লুটোতে তার ওজন হবে সাড়ে তিন কিলো। তাই পৃথিবীতে সে যদি সাড়ে তিন ফুট লাফাতে পারে, প্লুটোতে লাফাবে পঞ্চাশ ফুট। এখানে একটা কথা বলে রাখি, এত দূরে আছে বলে প্লুটো বা চ্যারনের সম্বন্ধে তথ্যগুলিতে কিছু ভুল ছিলনিউ হরাইজন অনেক বেশি নির্ভুল খবর আমাদের দিয়েছে।

      প্লুটো-চ্যারনের ভর এত কাছাকাছি হওয়ার জন্য এবং তাদের মধ্যে দূরত্ব এত কম বলে এমন এক বৈশিষ্ট্য তাদের আছে যা সৌরজগতে আর নেই। আমাদের চাঁদ নিজের চারদিকে ঘুরতে যত সময় নেয়, পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতেও একইসময় নেয়। সেজন্য আমরা চাঁদের শুধু একটা দিকই দেখতে পাই। তেমনি চাঁদের আকাশে পৃথিবীকে সবসময় একই জায়গায় দেখা যায়। পৃথিবীর আকর্ষণের জন্য আস্তে আস্তে চাঁদের ঘূর্ণন বেগ হ্রাস পেয়েছে। প্লুটোর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো অদ্ভুত। প্লুটো-চ্যারনের নিজেদের মধ্যে টানাপড়েনের জন্য প্লুটো ও চ্যারন, দুজনেরই ঘূর্ণন বেগই হ্রাস পেয়েছে। তাই ঠিক পৃথিবীর চাঁদের মতো চ্যারন প্লুটোর চারদিকে যে সময় নিয়ে ঘোরে, নিজের অক্ষের উপরেও সেই সময়ে এক বার পাক খায়। প্লুটো নিজেও একই সময়ে নিজের অক্ষের চারপাশে একবার ঘুরে আসে। তার ফলে চ্যারনের আকাশে যেমন প্লুটো সবসময় এক জায়গায় স্থির থাকে আর তার একটা দিকই দেখা যায়, ঠিক তেমনি প্লুটোর আকাশেও চ্যারন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে একটাই মুখ দেখায়। প্লুটোর এক দিন হল পৃথিবীর ৬.৪ দিনের সমান। আরো একটা খবর জানা গেছে। তোমাদের মধ্যে অনেকে হয়তো জানো মহাকাশে একটা দূরবীন বসানো হয়েছিল যার নাম হাবল দূরবিনসেই দূরবিনের ছবি থেকে জানা গেছে যে প্লুটোর আরো চারটে ছোটো ছোটো চাঁদ আছে। তাদের নাম দেয়া হয়েছে হাইড্রা, নিক্স, কেরবেরস ও স্টিক্স  

   
হাবল দূরবীন থেকে প্লুটো, চ্যারন, হাইড্রা ও নিক্স। (চিত্র: NASA, ESA, H. Weaver JHUAPL. A. Stern SwRI, and the HST Pluto Companion Search Team)

      প্লুটো আর তার উপগ্রহগুলোর নাম এলো কোথা থেকে? প্লুটো হল গ্রিক পুরাণের পাতালপুরীর বা মৃত্যুলোকের দেবতা। অক্সফোর্ডের এগার বছর বয়সের ছোট্ট মেয়ে ভেনিশিয়া বার্নি এই নামটা লাওয়েল মানমন্দিরে পাঠিয়েছিল। লাওয়েল মানমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পার্সিভ্যাল লাওয়েল। তাঁর নাম ও পদবীর প্রথম দুই অক্ষর হল P L, প্লুটোর নামের প্রথম দু অক্ষরই তাই। তাই সেই নামটাকেই পছন্দ করা হল২০১৭ সালে ভেনিশিয়ার নামে প্লুটোর বুকে এক গহ্বরের নাম দেওয়া হয়েছে বার্নি গহ্বর। স্টিক্স হল পাতালপুরীর নদী, মৃতদের আত্মাকে সেই নদী পার করায় যে মাঝি তার নাম চ্যারন। তবে মাঝি চ্যারনের গ্রিক উচ্চারণ হল কারেন, আর উপগ্রহের ক্ষেত্রে প্রথম ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণটা ‘চ’ আর “শ’-এর মাঝামাঝি। নিক্স হল রাত্রির দেবী ও চ্যারনের মা। হাইড্রা হল পাতালপুরীর পাহারাদার ন’মাথাওয়ালা সাপ। কেরবেরসও পাতালপুরীর প্রবেশদ্বারের পাহারাদার, সে হল হাইড্রার ভাই, তিন মাথাওয়ালা কুকুর। সাপের ভাই কুকুর! পুরাণকারদের কল্পনাশক্তির অন্তত অভাব ছিল না। নিক্স আর হাইড্রা আবিষ্কার হয়েছিল ২০০৫ সালে, তাদের নামকরণের সময় নিউ হরাইজন মহাকাশযানের আদ্যক্ষর N আর H, এই দুটো মনে রাখা হয়েছিল। কেরবেরসকে খুঁজে পাওয়া যায় ২০১১ সালে, আর স্টিক্সকে ২০১২ সালে। তাদের নাম দেওয়ার সময়ে ভোট নেওয়া হয়েছিল, তবে পাতালপুরীর সঙ্গে যুক্ত নয় বলে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া ভালকানকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। চ্যারন ছাড়া বাকি উপগ্রহগুলো একেবারেই পাথরের টুকরো যাদের মাপ মোটামুটি দশ থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার।
      এবার দেখা যাক কেন প্লুটোকে নিয়ে বিজ্ঞানীরা এত চিন্তিত। সত্যি কথা বলতে প্লুটো এতই ছোট যে অনেকেই একে গ্রহ বলতে রাজি ছিলেন না। সৌরজগতে ভিতরের দিকে যে গ্রহগুলো আছে, অর্থাৎ বুধ, শুক্ৰ, পৃথিবী ও মঙ্গল, তাদের গঠন হল পাথুরে। এর পর আছে গ্যাস দানব গ্রহেরা, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন। প্লুটো এদের সবার থেকে আলাদা। প্লুটোর ঘনত্ব হল জলের মোটামুটি দুগুণ। এর থেকে অনুমান করা গিয়েছিল যে প্লুটো ধূমকেতুদের মতো পাথর আর বরফ দিয়ে তৈরি। পরবর্তীকালে প্লুটো, মাকেমাকে বা হাউমিয়ার থেকে প্রতিফলিত আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় বরফ শুধু জলের নয়, নাইট্রোজেন, মিথেন আর অ্যামোনিয়া গ্যাসও জমাট বেঁধে আছে। সেজন্য অনেকে একে ধূমকেতুর মধ্যে ফেলতে চাইছিলেন। তোমাদের মনে হতে পারে, ধূমকেতুর তো লেজ থাকে। আসলে সূর্যের কাছে এলে তাপে ধূমকেতুর বরফ গলে যায়, তারপর সৌর বায়ু ও আলোর চাপে তা তৈরি করে সেই বিশাল লেজ।  নেপচুন পেরিয়ে গেলে এরকম অনেক ছোটো বড় পাথরের টুকরো বা বরফে তৈরি ধূমকেতু দেখা যায়। যে বিজ্ঞানী এটা প্রথম বলেছিলেন, সেই জেরার্ড কাইপারের নামে নেপচুনের ওপাশের সৌরজগতের একটা অঞ্চলকে বলা হয় কাইপার বেল্ট। এখানে অন্তত কয়েক লক্ষ এরকম ধূমকেতু আছে।
      প্লুটোকে গ্ৰহ না বলার আরেক কারণ হল কাইপার বেল্টের কোনো কোনো সদস্যের খোঁজ পাওয়া গেছে যারা বেশ বড়। এখানেই আছে আরো দুটো বামন গ্রহ; মাকেমাকে আর হাউমিয়ার ব্যাস প্লুটোর অর্ধেকের থেকে বেশি। আরো দূরে আছে এরিস, সে আয়তনে প্রায় প্লুটোর সমান। এদের সঙ্গে প্লুটোর অনেক মিল আছে। এরা সবাই বরফ আর পাথর দিয়ে তৈরি, এদের সকলের কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতা বেশি। শুধু তাই নয়, এদের সকলের কক্ষপথ অন্য সব গ্রহ যে তলে ঘোরে, তার সঙ্গে অনেকটা কোণ করে আছে। একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কাইপার বেল্টের সদস্যরা আলোকপাত করতে পারে। এদের মধ্যে বরফের পরিমাণ এত বেশি যে পৃথিবীতে জল এলো কোথা থেকে, সে রহস্যের সমাধান সূত্র হয়তো এদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
      কাইপার বেল্ট নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহের শেষ নেই। তাঁরা মনে করেন। শুধু জলের উৎসের নয়, সৌরজগৎ সৃষ্টির ব্যাখ্যার চাবিকাঠিও লুকিয়ে আছে। এখানে। সৌরজগৎ কী ভাবে তৈরি হয়েছিল? সাড়ে চারশো কোটি বছরেরও বেশি আগে ছিল এক বিশাল ধুলো ও গ্যাসের মেঘ যা মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে জমাট বেঁধে সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ তৈরি। এত কোটি কোটি বছরে সৌরজগতের ভিতরের দিকের বড় পাথরের টুকরোর এত ধাক্কাধাক্কি হয়েছে যে গোড়ায় তারা কেমন ছিল তা বোঝার আর উপায় নেই। কিন্তু কাইপার বেল্টের সদস্যরা একজন আরেকজনের থেকে অনেক দূরে দূরে আছে, তাই তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে অনেক কম। সেজন্য তাদের মধ্যে সেই প্ৰাথমিক দশা অনেকাংশে এখনো বজায় আছে। বস্তুত এদের গ্রহের আদি অবস্থা বা ভ্রূণ বলা যেতে পারে। এদের থেকে সৌরজগৎ সৃষ্টির ব্যাপারে অনেক খবর পাওয়া যাবে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী
      প্লুটোর আরো এক বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানীদের আকর্ষণ করেছে। প্লুটোর খুব পাতলা হলেও একটা বায়ুমণ্ডল আছে যা মূলত নাইট্রোজেন দিয়ে তৈরি। পৃথিবী ছাড়া আর মাত্র তিনটি গ্রহ বা উপগ্রহের বায়ুমণ্ডল নাইট্রোজেন ভিত্তিক। তাই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল কী ভাবে তৈরি হল সে নিয়ে খবর হয়তো প্লুটো দিতে পারবে। কিন্তু সে খবর পেতে গেলে প্লুটোর কাছে যেতে হত তাড়াতাড়ি। প্লুটো পৃষ্ঠে তাপমাত্রা মোটামুটি ২৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এখন প্লুটো সূর্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। প্লুটো যখন সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে, তখন সূর্য থেকে প্রতি বর্গমিটারে যে শক্তি পায়, তা পৃথিবীতে প্রতি বর্গমিটারে যা পড়ে তার ন’শ ভাগের এক ভাগ। সবচেয়ে দূরে যখন যায় তখন এই পরিমাণটা হয়ে যাবে আড়াই হাজার ভাগের এক ভাগ। ফলে তাপমাত্রা এখন আরো কমছে। আর কয়েক দশকের মধ্যে প্লুটোর সম্পূর্ণ বায়ুমণ্ডল জমাট বেঁধে যাবে। তখন আবার কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হবে।
      তাড়াতাড়ি প্লুটো পৌঁছনোর জন্য মহাকাশযান পাঠানো সহজ কথা নয়। রকেটে বেশি জ্বালানি দেয়া সম্ভব নয়, কারণ সেই জ্বালানিকেও তো বয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাই দূরে যে সমস্ত যান পাঠানো হয়, তারা এক বিশেষ ধরণের পথ অবলম্বন করে, যেখানে জ্বালানি লাগে কম কিন্তু সময় লাগে বেশি। কিন্তু ২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারির আগে উৎক্ষেপণ হয়েছে বলে এক বিশেষ সুযোগ পাওয়া গেছে। পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে নিউ হরাইজন যাত্রা করেছিল ঘণ্টায় ৫৮,০০০ কিলোমিটার বেগে। যত দূরে সে যাচ্ছে, তার বেগ তত কমছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ নিউ হরাইজন বৃহস্পতির পাশ দিয়ে গিয়েছিল, তখন বৃহস্পতির মাধ্যাকর্ষণকে গুলতির মতো ব্যবহার করে তার গতিবেগ বাড়ানো হয়েছিল ঘণ্টায় ১৪,০০০ কিলোমিটার। ২ ফেব্রুয়ারির পরে উৎক্ষেপণ হলে যান আর বৃহস্পতির পাশ দিয়ে যেত না। প্লুটো পৌছতে সময় লাগত পাঁচ বছর বেশি। আর ১৫ ফেব্রুয়ারির পরে যাত্রা শুরু হলে সময় লেগে যেত একশ বছরেরও বেশি। তাই এই সুযোগ না নিতে পারলে আরো কয়েকশো বছর অপেক্ষা করতে হত। প্লুটো অভিযানের জন্য অর্থ সাহায্য মার্কিন সরকার একসময় বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল বোধহয় এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। শখের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের দাবীতে শেষপর্যন্ত ৭৫ কোটি ডলার পায় মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা (NASA) সম্ভব হয় এই অভিযান ।
      ২০১৫ সালের ১৪ই জুলাই প্লুটো-চ্যারনের যুগ্মগ্রহের খুব কাছ দিয়ে যানটি বেরিয়ে যায়সেখানে থামার কোনো উপায় ছিল না, কারণ জ্বালানি তখন প্রায় শেষ। তোমরা হয়তো ভাবছ থামতে আবার জ্বালানি লাগবে কেন। যারা ওপরের দিকের ক্লাসে পড়া তারা জানো নিউটনের গতিসূত্রে বলা হয়েছে বাইরে থেকে বলপ্রয়োগ না করলে বস্তু থামবে না। মহাকাশে তো যানের উপর কোনো ঘর্ষণজনিত বাধা নেইতাই থামার উপায় হল রকেটকে উল্টো করে চালানোযারা লঞ্চ বা স্টিমারে চেপেছ তাদের নিশ্চয় মনে আছে তীরের কাছে এলে জলযানকে উল্টোদিকে চালাতে হয়। গ্রহের বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণকে ব্যবহার করেও ব্রেক করা যায়। কিন্তু প্লুটোর বায়ুমণ্ডল অনেক পাতলা তাই সে সুযোগ নেই। প্লুটো থেকে ১২,৫০০ কিলোমিটার দূর দিয়ে আর ঠিক চোদ্দ মিনিট পর চ্যারনের থেকে ২৯,০০০ কিলোমিটার দূর দিয়ে ঘণ্টায় ৫০,০০০ কিলোমিটারের বেশি বেগে বেরিয়ে যায় নিউ হরাইজন। মাঝে যন্ত্রপাতিতে কিছু সমস্যা হয়েছিল, কিন্তু সৌভাগ্যবশত বিজ্ঞানীরা তা কাটিয়ে ওঠেন।
      তোমরা নিশ্চয় বুঝতেই পেরেছ যে মহাকাশযানে কোন মানুষ ছিল নাদূরের অভিযানে মানুষ পাঠানো এখনো আমাদের সাধ্যের বাইরে। প্লুটো বা চ্যারন কী দিয়ে তৈরি তা জানার জন্য যানে ছিল দৃশ্য আলো, অবলোহিত ও অতিবেগুনি রশ্মিবিশ্লেষক যন্ত্র। ছিল টেলিস্কোপিক ক্যামেরা, সৌরবায়ু ও প্লুটোর বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষক যন্ত্র। এরা সবই কাজে লেগেছে প্লুটোর কাছে যাওয়ার পর। কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বানানো একটি যন্ত্র সারা পথ ধরে মহাজাগতিক ধূলিকণা বিশ্লেষণ করতে করতে গেছেএই সব অত্যাধুনিক যন্ত্র থেকে যা তথ্য পাওয়া গেছে তার বিশ্লেষণ এখনো চলছে, আরো বহু বছর লাগবে এই কাজে। তার থেকে সৌরজগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আরো অনেক বাড়বে সন্দেহ নেই। যানের মধ্যে রাখা আছে প্লুটো আবিষ্কারক টমবাউয়ের চিতাভষ্ম।
      অল্প কথায় দেখে নেয়া যাক প্লুটো সম্পর্কে কী নতুন খবর দিয়েছে নিউ হরাইজন। প্রথমত বলতেই হয় যে সমস্ত ছবি পাঠিয়েছে তাদের কথা। তোমরা নাসার ওয়েবসাইটে ক্লিক করে দেখে নিতে পারো। প্লুটোর বিষুবরেখার কাছে মাথা তুলেছে পর্বতশ্রেণী, যার সর্বোচ্চ উচ্চতা ছ’কিলোমিটার। ওই পুঁচকে গ্রহে প্রায় এভারেস্টের কাছাকাছি উঁচু পাহাড়! এই পর্বতশ্রেণির নাম দেওয়া হয়েছে তেনজিং মন্টিজপাশেই আছে হিলারি মন্টিজকাদের নামে এই নাম নিশ্চয় তোমাদের বলতে হবে না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে এই পর্বতশ্রেণির বয়স মাত্র দশ কোটি বছর, আমাদের সৌরজগতের বয়স সাড়ে চারশো কোটি বছরের তুলনায় শিশু।  

প্লুটোর বুকে মাথা তুলেছে তেনজিং পর্বতশ্রেণি (সামনে বাঁদিকে), হিলারি পর্বতশ্রেণি (দূরে)। ডানদিকে রয়েছে স্পুটনিক প্ল্যানিশিয়া (চিত্রঃ NASA/Johns Hopkins University Applied Physics Laboratory/Southwest Research Institute)
      বয়স মাপে কেমন করে? যুগযুগ ধরে উল্কা ইত্যাদির সঙ্গে সংঘর্ষে প্লুটোর বুকে গহ্বর তৈরি হচ্ছে। পৃথিবীতেও তা হচ্ছে, কিন্তু সমুদ্র ও বায়ুস্রোত তা ঢাকা দিয়ে দেয়। চাঁদে এ সব নেই, তাই চাঁদের বুকে যুগযুগের সংঘর্ষের চিহ্ন রয়ে গেছে। সেই গহ্বরের সংখ্যা থেকে প্লুটোর বুকে ভূতাত্ত্বিক গঠনের বয়স মাপা যায়। কিন্তু প্লুটোর অভ্যন্তর তো তার অনেক দিন আগে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার কথা, তাহলে এই পর্বতশ্রেণি সৃষ্টি হল কেমন করে আমাদের জানা নেই। আছে বরফে ঢাকা প্রায় আট লক্ষ বর্গকিলোমিটার ব্যাপী এলাকা  স্পুটনিক প্ল্যানিশিয়া, যা হিল টমবাউ রিজিওর অংশ। এখানেও কোনো গহ্বর নেই, মনে হচ্ছে এর বয়স এক কোটি বছরেরও কম। এখানেই সৌরজগতের সবচেয়ে বড় হিমবাহের সন্ধান পাওয়া গেছে, কিন্তু জলের বরফের নয়, এ হল জমাট বাঁধা নাইট্রোজেনের হিমবাহ।  জলের বরফ আছে, কিন্তু -২৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় তা জমে শক্ত পাথরের রূপ নিয়েছে। মিথেনের পরিমাণ যা আশা করা হয়েছিল, তার থেকে অনেক কম। প্লুটোতে সম্ভবত শীতল আগ্নেয়গিরি আছে। গলিত ম্যাগমা নয়, তারা নাইট্রোজেন, অ্যামোনিয়া বা জলের বরফ উদ্‌গিরণ করে।
      প্লুটোতে বায়ুমণ্ডল আছে আগেই জানা ছিল, নিউ হরাইজন জানিয়েছে তার চাপ পৃথিবীর সমুদ্রতলের বায়ুচাপের এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ। অবশ্য প্লুটো সূর্য থেকে যত দূরে যাবে, বায়ুচাপ তত কমবে। সেই বায়ুমণ্ডলে আছে মূলত নাইট্রোজেন, তাছাড়া পাওয়া যাবে কার্বন মনোক্সাইড আর মিথেন। বায়ুমণ্ডলের রং নীল, কিন্তু তার কারণ এখনো নিশ্চিত জানা নেই। প্লুটোর কম অভিকর্ষের জন্য বায়ুমণ্ডলের অণুদের মহাকাশে মিলিয়ে যাওয়ার কথা। নিউ হরাইজন জানিয়েছে যে আগে যা হিসাব করা হয়েছিল, প্লুটো থেকে গ্যাসের অণু বেরিয়ে যাচ্ছে আসলে তার হাজার ভাগেরও কম।  

নিউ হরাইজন থেকে চ্যারন (চিত্রঃNASA/JHUAPL/SwRI)
      চ্যারনের বুকে উল্কা গহ্বরের সংখ্যা খুব কম। বোঝা যায় যে চ্যারনের পৃষ্ঠতলের বয়স বেশি নয়, পুরানো উল্কার ক্ষত ঢাকা পড়ে গেছে। কেমন করে নতুন তল তৈরি হয়েছে, বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন না। চ্যারনে এক খাত পাওয়া গেছে, যা পৃথিবীর গভীরতম গিরিখাত গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের থেকে দ্বিগুণ গভীর আর চারগুণ লম্বা। বিজ্ঞানীদের অনুমান চ্যারনের অভ্যন্তরে ছিল জলের মহাসমুদ্র, তা জমে গিয়ে চ্যারনের বাইরের আবরণ ফাটিয়ে এই গিরিখাত সৃষ্টি করেছে। চ্যারনের উত্তর মেরুর রং লালচে। কেউ কেউ বলেছেন প্লুটো থেকে বেরিয়ে যাওয়া মিথেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি গ্যাস চ্যারনের টানে ধরা পড়েছে; সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে তা এক ধরনের জৈব অণু গঠন করেছে, তাই এই রং। চ্যারন বা হাইড্রার ছবি থেকে মনে হচ্ছে সেখানে জলের বরফ আছে।

নিউ হরাইজন থেকে প্লুটোর উপগ্রহদের এইরকম দেখতে লেগেছে (চিত্রঃNASA/JHUAPL/SwRI)
      প্লুটোর সঙ্গে সাক্ষাতের পর মহাকাশযান কাইপার বেল্টের মধ্যে দিয়ে চলছে সেখানকার সদস্যদের সম্পর্কে আরো কিছুদিন যান নানা অজানা তথ্য পাঠাবে। তার থেকে সৌরজগতের উৎপত্তি সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানা যাবে। অনেক খবরও জানা যাবে ধূমকেতুদের সম্পর্কে। তার থেকে একটা বিশেষ আকর্ষণীয় বিষয়ে হয়তো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব তা হল পৃথিবীতে ডাইনোসরদের বিলুপ্তির কারণ। জীবাশ্ম প্রমাণ থেকে দেখা যায় যে সারা পৃথিবীতে ডাইনোসররা প্রায় একই সঙ্গে বিলুপ্ত হয়েছিল। অনেকে মনে করেন যে এর কারণ হল ঐ সময় পৃথিবীতে এক ধূমকেতু আঘাত করেছিল। তার ফলে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে তার ফলেই এই বিলুপ্তি। ধূমকেতুদের গঠন সম্বন্ধে জানতে পারলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি আল্টিমা থুলি নামের একটা কাইপার বেল্টের সদস্যকে মাত্র সাড়ে তিনহাজার কিলোমিটার দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করেছে নিউ হরাইজন।

নিউ হরাইজনের ক্যামেরাতে ৬৭০০ কিলোমিটার দূর থেকে আল্টিমা থুলি (চিত্রঃNASA/Johns Hopkins Applied Physics Laboratory/Southwest Research Institute, National Optical Astronomy Observatory)
      সমস্ত যন্ত্রপাতি নিশ্চয় কিছুদিন পরে খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু যানের গতি স্তব্ধ হবে না। সূর্যের আকর্ষণে তাকে বেঁধে রাখা যাবে না। মহাশূন্যে কোনো উল্কা বা ধূমকেতুর সঙ্গে তার সংঘর্ষের সম্ভাবনাও প্রায় নেই বললেই চলে কারণ তারা সাধারণত অনেক দূরে দূরে থাকে। মানুষের তৈরি এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে দ্রুতগামী যান নিউ হরাইজন চলবে তার অনন্ত যাত্রাপথেহয়তো কয়েক কোটি বছর পরে অন্য কোনো নক্ষত্রের অন্য কোনো সভ্য প্রাণীর কাছে সে পৌঁছে দেবে পৃথিবীর মানুষের এই বার্তা আমরাও ব্ৰহ্মাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটনে ব্ৰতী। তখনো যদি মানব সভ্যতার অস্তিত্ব থাকে, তা হয়তো বা পাড়ি দিয়েছে অন্য নক্ষত্ৰলোকেও। এমন ভাবতে ইচ্ছা হয় যে ভবিষ্যতের মানুষেরই অন্য কোনো মহাকাশযানের সঙ্গে দেখা হতে পারে আজকের এই যানের। তখনকার মানুষ হয়তো বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে আরো অনেক দূর এগিয়ে গেছে। প্রাগৈতিহাসিক মানুষের সঙ্গে আধুনিক মানুষের যে তফাৎ আমাদের সঙ্গে আমাদের সেই ভবিষ্যতের পার্থক্য তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি হবে নিশ্চয়। সুদূর অতীত থেকে আসা এই বার্তাকে তারা কী দৃষ্টিতে দেখবে ? বিজ্ঞানীরা মনে করেন প্রযুক্তি সভ্যতার তিনটি স্তর আছে। আমরা এখন প্রথম ধাপের একেবারে শৈশবে অবস্থান করি। শিশুর প্রচেষ্টা বয়স্কদের প্রশ্ৰয় লাভ করে। আমাদের সাধ্য সামান্য হলেও শুধু উচ্চাশার বলে যে পথে আমরা পা বাড়িয়েছি, সেই পথেরই তো ভবিষ্যতের পথিক তারা। নিশ্চয় তারা এই চেষ্টাকে সম্ভ্রমের চোখেই দেখবে। মানুষ আর পশুর মধ্যে একটা বড় পার্থক্য হল পশু আকাশের নক্ষত্ৰজগৎ সম্বন্ধে উৎসাহী নয়। মনুষ্যত্বের সাধনাকে জ্ঞান লাভের প্রচেষ্টার থেকে আলাদা করা যায় না। সেই সাধনাতে তোমরা সবাই নিশ্চয় অংশীদার হবে।
(কিশোর ভারতী, জুলাই ২০০৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘সৌরজগতের সীমান্তপ্রহরী প্লুটো’ নামে। নিউ হরাইজন মিশন থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে পুনর্লিখিত)














No comments:

Post a Comment