Monday 14 August 2017

মাদাম কুরিঃ জীবন সংগ্রামের অন্য নাম

মাদাম কুরিঃ জীবনসংগ্রামের অন্য নাম


গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


       আমরা সবাই মাদাম মেরি কুরির নাম জানি। ১৯১১ সালে তিনি রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। সেই কথা মনে রাখতে ২০১১ সালকে আন্তর্জাতিক রসায়ন বিজ্ঞান বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিলো। জানতে ইচ্ছা করে প্রতি বছরই তো রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় – তাহলে মাদাম কুরির নোবেল পাওয়ার বছরকেই আলাদা করে কেন বেছে নেয়া হয়েছিলো? বড় বড় বিজ্ঞানী অনেক আছেন। বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতার প্রতি তাঁদের অবদানের কথা চিন্তা করলে আমাদের মাথা নত হয়ে আসে।কিন্তু তাদের মধ্যেও যাঁরা সংগ্রাম করে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেছেন, তাঁদের জীবন আমাদের কাছে প্রেরণা। মাদাম কুরি তেমনই একজন। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজ তাঁর সামনে নানা বাধার দেয়াল তুলেছিল, কারণ তিনি নারী। প্রতিকূল পরিস্থিতি ও দারিদ্র তাঁর বিজ্ঞান চর্চায় বারবার ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। সে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে তিনি তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।
মাদাম কুরি, ১৯০৪ (চিত্রঃ নোবেল আর্কাইভ)

       তাঁর জীবনের একটা ঘটনার কথা বলে শুরু করা যাক। ১৯১০ সালে নভেম্বর মাসে ফ্রেঞ্চ আকাদেমি অফ সায়েন্সে পদার্থবিদ্যা বিভাগে একটি সদস্যপদ খালি হয়। মাদাম কুরি তার সাত বছর আগে পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পেয়েছেন। ফ্রান্সের সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় প্যারি বিশ্ববিদ্যালয় বা সরবোনে তিনি পড়ান। কাজেই তাঁর যোগ্যতা নিয়ে কারো সন্দেহ থাকতে পারে না। মাদাম যে এ ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিলেন তা নয়, কিন্তু বন্ধুবান্ধব ও অনুরাগীদের আগ্রহে তিনি দরখাস্ত করেন। তাঁর প্রতিযোগী ছিলেন এদুয়ার্দ ব্রানলি নামের অপর এক পদার্থবিদ। কে এই ব্ৰানিলি?
       এদুয়ার্দ ব্রানলির নাম এখন খুব বেশী লোক জানেন না। তিনি প্রথম বেতার গ্রাহক যন্ত্র বা রেডিও রিসিভার তৈরি করেন। মার্কনি রেডিও আবিষ্কারের জন্য ১৯০৯ সালে নোবেল পুরস্কার পান। আমরা সবাই এখন জানি যে রেডিও আবিষ্কার মার্কনির একক কৃতিত্ব নয়, তার পিছনে জগদীশচন্দ্ৰ বোসের অবদান কম নয়। সে যা হোক, ফরাসিরা অন্তত মনে করতো যে ব্রানলিকে অন্যায় ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। রোমান ক্যাথলিক ধর্মের শীর্ষ ধর্মগুরু পোপ তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। প্যারি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে তিনি ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর চাকরি নিয়েছিলেন।
       আমরা নিশ্চয় ভাবব দুজনের মধ্যে কোন প্রার্থীর বিজ্ঞানে অবদান বেশী তাই নিয়েই নিশ্চয় আলোচনা চলবে। আসলে কিন্তু হল ঠিক উল্টো। এক দল বিজ্ঞানী মাদামের বিরোধিতা করলেন — একমাত্র কারণ তিনি নারী। তাদের কাছে বিজ্ঞান গবেষণাগার পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত। মাদামের সাফল্যের ইতিহাস তাঁদের মনে একান্ত মূল্যহীন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন আর একদল যাঁরা মাদামের মুক্ত চিন্তাকে মেনে নিতে প্ৰস্তুত ছিলেন না। ব্রানলিকে তাঁরা সমর্থন করেন। কারণ তিনি ধর্মনিষ্ঠ খ্রিস্টান।
       অন্যদিকে মাদাম কুরি ধর্মে বিশেষ বিশ্বাসী ছিলেন না, তাঁর এগারো বছর বয়সে তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই তিনি ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। মাদামকে এমন কথাও শুনতে হয়েছিল যে তিনি পোলিশ ইহুদি, যদিও ইহুদি তিনি ছিলেন না। পোল্যান্ডে জন্ম হলেও তাঁর উচ্চতর পড়াশোনা ও গবেষণা সমস্তই প্যারিতে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারি ছিল সবচেয়ে মুক্ত ও প্রগতিশীল সংস্কৃতির পীঠস্থানদের অন্যতম। স্বাধীনতা, সাম্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ফরাসি বিপ্লবের সেই আঁতুড়ঘরে নারী বলে বা ধর্ম নিয়ে উৎসাহী বিশ্বাসী নয় বলে এক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীকেও তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
       ১৯১১ সালের ২৩ শে জানুয়ারি নির্বাচন হয়। মাত্র দু ভোটে মাদাম কুরি পরাজিত হন। নির্বাচনে মাদামকে হারানোর জন্য নানা অসৎ পথেরও সাহায্য তাঁর বিপক্ষকে নিতে হয়েছিল। এর পরে তাঁর চরিত্র নিয়েও কুৎসা প্রচার শুরু হয়েছিল। এমনকি তাঁর বাড়িও আক্রান্ত হয়েছিল। তাতে মাদামের কিছু আসে যায় নি। শুরুতেই বলেছি সে বছর তিনি রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। এবার আর কারোর সঙ্গে ভাগ করে নয়, দুটি নতুন মৌল পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কারের জন্য তিনি একাই পুরস্কারটি জয় করেন। তবে মাদাম নোবেল বক্তৃতার সময় মনে করিয়ে দেন যে তাঁর এই কৃতিত্বের সমান অংশীদার ছিলেন তাঁর স্বামী পিয়ের কুরি। পিয়ের ১৯০৬ সালে মারা যান। মৃত্যুর পরে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় না, তাই তাঁর নাম এবারে মাদামের পাশে লেখা ছিল না।
       আজ পর্যন্ত দুবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মাত্র চার জন – মাদাম কুরিই তাঁদের মধ্যে প্রথম। এই বিরল সম্মান যিনি পেয়েছেন, তাঁকে সামান্য আকাদেমির সদস্যপদ নিয়ে চিন্তিত হতে হবে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদেরই দিতে হবে। আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে বিজ্ঞান নিজে যুক্তি মেনে চলতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানীরাও মানুষ। যে সমাজের তাঁরা অংশ, তা তাঁদের চিন্তাভাবনাকে অনেকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। নারীরা যে বুদ্ধিতে পুরুষদের সমান, তা মেনে নিতে সে সময়ের সমাজ তৈরি ছিল না। তারই প্রতিফলন পড়েছিল বিজ্ঞানীদের আচরণেও। কিন্তু ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে এই ভুল ভাঙতে ফ্রেঞ্চ আকাদেমির আরো পঞ্চাশ বছরের বেশী সময় লেগেছিল। ১৯৬২ সালে প্রথম কোনো মহিলাকে সদস্য পদ পান – তাঁর নাম মার্গারিট পেরি, তিনি মাদামের কাছেই গবেষণা করে ডক্টরেট পেয়েছিলেন।
       তবে লড়াই মাদামের কাছে নতুন নয়— আরো অনেক বেশি। কষ্ট তাঁকে জীবনে করতে হয়েছিল। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮৬৭ সালের ৭ই নভেম্বর পোল্যান্ডের ওয়ারশতে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো ছিলেন তিনি। নাম ছিল মারিয়া স্ক্লোদোভস্কা। সবাই আদর করে বলতো মানিয়া। সে সময় পোল্যান্ড স্বাধীন ছিল না। – প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও জারের শাসনাধীন রাশিয়ার মধ্যে দেশটা ভাগ হয়ে গিয়েছিল। ওয়ারশ ছিল রাশিয়ার অধীনে। পোল্যান্ডের সংস্কৃতি ধ্বংস করতে রাশিয়ান শাসকদের চেষ্টার শেষ ছিল না। স্কুলে পোলিশ ভাষায় পড়ানো হতো না। গোটা পোল্যান্ডে কোনো আধুনিক ল্যাবরেটরি ছিল না। বাবা ভ্ৰাদিশ্লাভ ছিলেন অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যাতে পণ্ডিত। কিন্তু পোল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর জন্য তার চাকরি যায়। তারপরে অনেক কম মাইনের একটা চাকরি জোটে বটে, কিন্তু সংসার চালানো তাঁর পক্ষে বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। দারিদ্রের জন্যই তাঁর বড়ো মেয়ের শৈশবেই মৃত্যু হয়। স্ত্রী ব্রোনিস্লাভাও যক্ষ্মা রোগে প্রায় বিনা চিকিৎসাতে মারা যান।
       এর মধ্যেও চলছে ছোটো মানিয়ার পড়াশোনা – সব পরীক্ষাতেই প্রথম যে নাম, তা হল মারিয়া স্ক্লোদোভস্কা। কিন্তু ষোলো বছর বয়সে স্কুল পাস করার পরে পড়াশোনায় ছেদ টানতে হয়। গোটা পোল্যান্ডে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। মানিয়া ও তার দিদি ব্রোনিয়া, দুজনেরই পড়ার ইচ্ছা খুব, কিন্তু উপায় কী? মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিতে, কিন্তু সেখানে পড়ার খরচ, আসবে কোথা থেকে? তখন পোল্যান্ডে গোপনে কয়েকজন তরুণ তরুণী মিলে পড়াশোনা করতেন। ধরা পড়লে শাস্তি নিশ্চিত, তাই লুকিয়ে আজ এক বাড়িতে কাল অপর এক বাড়িতে তাঁরা মিলিত হতেন। এর নাম ছিল ভাসমান বিশ্ববিদ্যালয়। দুই বোনই তাতে যোগ দেন, কিন্তু সে আর কতটুকু? দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে?
       মানিয়ার মাথায় একটা পরিকল্পনা এলো – দিদিকে বললেন, “তুই প্যারিতে পড়তে যা। আমি কাজ করে তোকে টাকা পাঠাবো। যখন তুই রোজগার করতে পারবি, তখন তুই আমার খরচ দিবি৷” দিদি এক মত নয়, “আমি কেন? তুই তো আগে পড়তে যেতে পারিস।” মানিয়া বোঝালেন, “তোর বয়স কুড়ি, আমার সতেরো। তোরই আগে পড়তে যাওয়া দরকার।’
ব্রোনিয়া ও মানিয়া (বাঁদিকে), ১৮৮৬

       সেই রকমই হল। ব্রোনিয়া প্যারির মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি হলেন। মানিয়া নিলেন বাচ্ছাদের পড়ানোর চাকরি। স্কুলে পড়ানো নয়, গভর্নেস হিসেবে ছাত্রের বাড়িতে থেকে তার দেখাশোনাও করতে হতো। এভাবেই কেটে গেলো প্ৰায় আট বছর। এর মধ্যে মানিয়া বই জোগাড় করে নিজে পড়াশোনার চেষ্টা করতেন। একই সঙ্গে গরিব চাষিদের ছেলেমেয়েদের সাক্ষর করানোর কাজও অনেক দিন করেছেন, যদিও জারের শাসনে সে কাজটা ছিল বেআইনি। ধরা পড়লে হয়তো শাস্তি হতো সাইবেরিয়াতে নির্বাসন।
       অবশেষে ১৮৯১ সালে মারিয়া রওনা হলেন প্যারি। ব্রোনিয়া এর মধ্যে বিয়ে করেছেন। অপর এক পোলিশ ডাক্তারকে। মানিয়া প্ৰথমে দিদির কাছেই উঠলেন। ভর্তি হলেন সরবোনে। সরবোন অর্থাৎ প্যারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ইউরোপের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। সেখানে তাঁর নাম লেখা হল মেরি স্ক্লোদোভস্কা।
       মেরি বুঝলেন যে সহপাঠীদের থেকে তিনি অনেক পিছিয়ে আছেন। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ পড়াশোনার বিশেষ সুযোগ গত আট বছরে তিনি পাননি। তার উপরে পড়তে হয় ফরাসি ভাষায়, যেটা তাঁর মাতৃভাষা নয়। দিদির সঙ্গে থাকলে সামাজিকতার জন্য পড়ার কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে। তাই অনেক কষ্ট হলেও আলাদা একটা ঘর নিলেন। অনেকদিন এমন হয়েছে যে না খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। জামাইবাবু খবর পেয়ে এসে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন। প্যারির প্রচণ্ড শীতে যখন আগুন জ্বালানোর পয়সা থাকতো না, তখন একমাত্র উপায় ছিল যত পোশাক আছে এক সঙ্গে পরে নেয়া, যদি ঠাণ্ডাটা একটু কম লাগে। এর মধ্যে চলছে পড়াশোনা। প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞান পড়ার জন্য। পরে মনে হল অঙ্কটাও পড়ে নিলেও তো হয়। ১৮৯৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি পরীক্ষার ফল বেরোল। প্রথম হয়েছেন মেরি স্ক্লোদোভস্কা। পরের বছর অঙ্কে দ্বিতীয়। ইতিমধ্যে একটা বৃত্তি পেয়েছিলেন, তাই একটু হলেও কষ্টটা কমেছে। চাকরি পাওয়ার পরে প্রথম সুযোগেই মেরি বৃত্তির সমস্ত পয়সা ফিরত দিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও সে রকম কোনো শর্ত ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন যে তাঁর মতো অসুবিধায় পড়া অন্য কোনো ছাত্ৰ যেন সুযোগটা পায়।
       ক্লাসের পড়াশোনা তো শেষ হল, এখন চান গবেষণা করতে। কিন্তু সুযোগ কোথায়? গোটা ফ্রান্সে তখন পর্যন্ত কোনো নারী কোনো বিষয়ে ডক্টরেট করেন নি। এমনকি কেউ আছেন যিনি মেরিকে কাজ করতে একটু জায়গা দেবেন? এসময় আলাপ হল পিয়ের কুরি নামের এক পদার্থবিজ্ঞানীর সঙ্গে। তিনি প্যারির মিউনিসিপ্যাল স্কুলে পড়ান। তখনই পদার্থবিদ হিসেবে পিয়ারের বেশ সুনাম হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন যে চৌম্বক পদার্থ একটি নিদিষ্ট তাপমাত্রাতে হঠাৎ অচৌম্বক পদার্থে পরিণত হয়। তাঁর সম্মানে একে আমরা কুরি তাপমাত্রা বলি। তিনি ও তাঁর ভাই জ্যাক এক নতুন অত্যন্ত সুবেদী ইলেকট্রোমিটার বানিয়েছেন। ইলেকট্রোমিটার হল বৈদ্যুতিক আধান বা চার্জ মাপার যন্ত্র। মেরি ও পিয়ের, দুজনের আরো অনেক মিল ছিল। পিয়ের ধর্মে বিশ্বাস করেন না। তাঁর পরিবার চিরকালই উদারপন্থী। তাঁর বাবা ইউজিন ১৮৪৮ ও ১৮৭১ –এর বিপ্লবে সাধারণ মানুষের পক্ষ নিয়েছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন।
       দুজনেরই দুজনকে ভালো লেগে গেলো। পিয়েরের যে কাজ করার অনেক বড়ো গবেষণাগার ছিল তা নয়, তবু তাঁর ছোটো ঘরের মধ্যেই মেরিরও একটু জায়গা হল। এক বছর পরে ১৮৯৫ সালে তাঁদের বিয়ে হল। একেবারেই ধাৰ্মিক আচারবিহীন ছিল সেই অনুষ্ঠান। এক আত্মীয় মেরিকে বিয়ের পোশাকটা কিনে দিতে চেয়েছিলেন। খ্রিস্টানদের বিয়ের পোশাক সাধারণত সাদা রঙের হয়। মারি তাঁকে অনুরোধ করেন গাঢ় রঙের পোশাক দিতে, কারণ তাঁর তখন বাইরে পরার আর মাত্র একটাই পোশাক ছিল। ঘন নীল রঙের সেই পোশাক তিনি বহুদিন ল্যাবরেটরিতে ব্যবহার করেছিলেন।
       মেরির উৎসাহে পিয়ের ডক্টরেটের থিসিস জমা দিলেন। ডক্টরেট পাওয়ার পরে তাঁর পদোন্নতি হয়। কিন্তু গবেষণার সুযোগ বাড়ল। না। একটা ছোটো ঘরে মেরি কাজ শুরু করেছিলেন। সেখানে জায়গা না হওয়ায় বাইরে একটা প্রায় চালার মতো ঘরকে তাঁরা দুজনে ল্যাবরেটরি বানিয়ে নেন। কী করছিলেন মেরি?
গবেষণাগারে পিয়ের ও মেরি

       ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে পদার্থবিজ্ঞানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হয়েছিলো। রন্টজেন আবিষ্কার করেন এক্স-রশ্মি। তার পরেই আঁরি বেকারেল দেখেন যে ইউরেনিয়াম থেকে খুব বেশী শক্তি নিয়ে কিছু রশ্মি বার হয়। একে বলা হল তেজস্ক্রিয়তা বা রেডিওঅ্যাক্টিভিটি। এক্স-রশ্মি বিজ্ঞানীদের আকর্ষণ কেড়ে নিলেও তারা বেকারেলের কাজ নিয়ে ততটা সচেতন ছিলেন না। মেরি বেকারেলেরই কাছে কাজ শুরু করলেন এই বিষয়ে। রেডিওঅ্যাক্টিভিটি শব্দটাও মেরিরই বানানো।
       মেরি আবিষ্কার করলেন যে ইউরেনিয়াম একা নয়, থোরিয়ামও আরো এক মৌলিক পদার্থ যার তেজস্ক্রিয়তা ধর্ম আছে। তিনি দেখালেন যে তেজস্ক্রিয়তা ইউরেনিয়াম বা থোরিয়াম মৌলেরই ধর্ম। এই ধাতু দুটি মৌলিক পদার্থ হিসবেই থাকুক, কিংবা অন্য মৌলের সঙ্গে মিলে যৌগ তৈরি করুক, তেজস্ক্রিয়তার কোনো পরিবর্তন হয় না। বেকারেলও একই কথা বলেছিলেন, মেরি সেটা প্রমাণ করে দেখান। এই কাজে তাঁর সহায় হয়েছিলো পিয়েরের আবিষ্কার করা ইলেকট্রোমিটার।
       মেরি আরো একধাপ এগিয়ে গেলেন, তিনি বললেন যে তেজস্ক্রিয়তা আসলে ইউরেনিয়াম পরমাণুর ধর্ম। আমরা তো স্কুলেই এ কথা পড়েছি। আমরা জানি যে এটা আসলে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ধর্ম। নিউক্লিয়াস আবিষ্কার কিন্তু আরো প্ৰায় পনের বছর পরের ঘটনা। মেরি যখন একথা বলছেন, তখন পরমাণুর অস্তিত্বে যে সমস্ত বিজ্ঞানী বিশ্বাস করতেন তা নয়। পরমাণুর ভিতর থেকে যদি তেজস্ক্রিয় রশ্মি বেরোয়, তাহলে নিশ্চয় পরমাণুর ভিতরের গঠনটা খুব সরল নয় – বিজ্ঞানীদের অধিকাংশের পক্ষে এই কথাটা মেনে নেওয়া সহজ হয়নি। প্রায় একই সময়ে ইংল্যান্ডে জে জে টমসন দেখিয়েছেন যে পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রন নামে এক কণা থাকে। টমসন লিখেছেন যে তিনি রয়্যাল সোসাইটিতে তাঁর আবিষ্কারের কথা ঘোষণার পরে জনৈক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী তাঁকে বলেছিলেন যে টমসন নিশ্চয় তাঁদের সঙ্গে মজা করছেন। সে সময় তাই তেজস্ক্রিয়তা যে পরমাণুর ধর্ম তা বলা মোটেই সহজ ছিল না। মেরির এই আবিষ্কারের কথা ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স-এ ঘোষণা করেন তাঁর শিক্ষক গ্যাব্রিয়েল লিপম্যান। দিনটা ছিল ১৮৯৮ সালের ১২ এপ্রিল। মেরি উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু একমাত্র সদস্যদেরই অ্যাকাডেমিতে বলার অধিকার ছিল। 
      লিপম্যান মেরিকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। তাঁর পরীক্ষাগারেই তিনি গবেষণা শুরু করেছিলেন, সেই  সূত্রেই পিয়েরের সঙ্গে মেরির আলাপ হয়। লিপম্যান মেরির ডক্টরাল কমিটির সভাপতি ছিলেন, তিনিই পরে মেরির নাম ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমির জন্য প্রস্তাব করেন। রঙীন ছবি তোলার পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ১৯০৮ সালে লিপম্যান পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
       ইউরেনিয়াম প্রকৃতিতে যে আকরিক থেকে পাওয়া যায়, তার নাম পিচব্লেন্ড। মেরি দেখলেন পিচব্লেন্ড যতটা তেজস্ক্রিয়, তা শুধু ইউরেনিয়াম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। মেরির আবিষ্কারে উৎসাহিত হয়ে পিয়েরও তাঁর সঙ্গে কাজ শুরু করলেন। বিজ্ঞানের জগতে সবচেয়ে সফল ও সবচেয়ে বিখ্যাত দাম্পত্য উদ্যোগের সূচনা এভাবে মেরির আবিষ্কার থেকেই শুরু হল। কিন্তু আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। এর মধ্যে ১৮৯৮ সালে তাঁদের প্রথম কন্যা আইরিনের জন্ম হয়েছে। এই আইরিন পরবর্তীকালে তাঁর স্বামী ফ্রেডরিক জোলিওর সঙ্গে নোবেল পুরস্কার পান। আইরিন হবেন বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জয়ী দ্বিতীয় মহিলা, যদিও তাঁর মা তা দেখার জন্য বেঁচে থাকবেন না।
       নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করে কুরিরা নিশ্চিত হলেন যে নতুন কোনো তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ এর মধ্যে আছে। অনেক চেষ্টার পরে একটি মৌলিক পদার্থের অস্তিত্ব প্রমাণে তাঁরা সক্ষম হলেন। পিয়ের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী নাম দেবে এই নতুন মৌলের? মেরি মুহূর্তের জন্য ভাবলেন। তাঁর মনে পড়ে গেলো তাঁর স্বদেশ পোল্যান্ডের কথা – সেই স্বদেশ যা তিন বিদেশী শক্তির হাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন, যার অস্তিত্ব পৃথিবীর মানচিত্রে নেই। তাই নতুন মৌলের নাম হল পোলোনিয়াম সেটা ছিল ১৮৯৮ সালের মাঝামাঝি।
একই ফ্রেমে তিন নোবেলজয়ী, পিয়ের, আইরিন ও মেরি

       কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কুরিরা দেখলেন যে পোলোনিয়াম দিয়েও পিচব্লেন্ডের তেজস্ক্রিয়তা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছেনা। নিশ্চয় আরো কোনো নতুন মৌলিক পদার্থ তার মধ্যে আছে। চলল আরো প্ৰয়াস। মাদাম কুরি তাঁর ডায়েরিতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা লিখে রাখতেন। একদিন লিখেছেন আইরিন হাঁটতে শিখেছে। কিছুদিন পরে আইরিনের যে পনেরটি দাঁত বেরিয়েছে সে কথাও লেখা আছে। মাঝখানের পাতাটিতে লেখা আছে যে তাঁরা নতুন একটি মৌল আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছেন। তার নাম তাঁরা দিলেন রেডিয়াম। এর তেজস্ক্রিয়তা ইউরেনিয়ামের থেকে অনেক বেশি। প্ৰচণ্ড কষ্ট তাঁদের করতে হয়েছিল। কাজ শুরুর সময় তারা ভেবেছিলেন এক টন পিচব্লেন্ড থেকে অন্তত দশ কিলো রেডিয়াম পাবেন। বাস্তবে পেলেন এক গ্রামের অর্ধেকেরও কম। পরিমাণ যতই কম হোক, ঊনবিংশ শতকের শেষে নতুন মৌল আবিষ্কার করা যে কোনো রসায়ন বিজ্ঞানীর কাছে ছিল কৃতিত্বের শেষ কথা। সেই কাজে কুরিরা সফল হয়েছেন এক বার নয়, দু-দুবার। রেডন মৌলটা তাঁরাই প্রথম দেখেছিলেন, যদিও চিনতে পারেন নি। এখনো পর্যন্ত তাঁরা গবেষণার জন্য কোনো রকম আর্থিক সাহায্য কাছে পান নি। সমস্ত খরচা চলতো পিয়েরের সামান্য মাইনে থেকে।
       পিয়ের এর আগে সরবোনে চাকরির চেষ্টা করেও বিফল হয়েছেন। অনেক কম যোগ্যতা সম্পন্ন একজন সেই চাকরিটা পেয়েছেন। এমন সময় সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সেখানে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানালো। মাইনে ভালো, সুযোগ সুবিধা অনেক, এবং সবার উপরে আকর্ষণ হল মেরির জন্যও একটা পদ তাঁরা ভেবে রেখেছেন। কুরিরা প্রথমে ফ্রান্স ছাড়ার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেললেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁরা ভেবে দেখলেন যে এর ফলে তাদের গবেষণার ক্ষতি হবে। সমস্ত যন্ত্রপাতি তো ফ্রান্সে ফেলে যেতে হবে। কয়েকজন বিশিষ্ট ফরাসি বিজ্ঞানী, যাঁদের মধ্যে একজন হলেন বিখ্যাত আঁরি পঁয়কেয়ার, কুরিদের দেশ ছাড়ার সম্ভাবনাতে বিচলিত হয়ে বিষয়টা নিয়ে উদ্যোগী হলেন। সরবোনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক প্রতিষ্ঠানে পিয়েরের চাকরি হল। মেরিরও একটা মেয়েদের স্কুলে পড়ানোর কাজ জুটল।
       আর্থিক অবস্থা একটু ভালো হলেও ফ্রান্সে যথাযোগ্য সম্মান জুটছে না। ফ্রেঞ্চ আকাদেমির সদস্যপদের জন্য পিয়েরের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলো। নিশ্চয় মনে পড়ছে। পরবর্তীকালে মাদাম কুরির জীবনে কী ঘটেছিল! পিয়েরের শুভানুধ্যায়ীরা কয়েকজন তাঁর কাজের জন্য ফ্রান্সের রাষ্ট্ৰীয় সম্মান লিজিয়ন অফ অনার দেওয়ার প্রস্তাব করেন। পিয়ের বিজ্ঞানীদের জন্য এই সমস্ত সম্মানের পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি লিখে পাঠালেন যে সম্মানের চেয়ে গবেষণাগারের প্রয়োজন তাঁর কাছে অনেক বেশী। পরবর্তীকালে মাদাম কুরিও এই সম্মান প্রত্যাখ্যান করেন।
       ১৯০৩ সাল। মেরি ডক্টরেট উপাধি পেলেন। সে দিনটা ছিল ২৫ জুন। ফ্রান্সের প্রথম মহিলা ডক্টরেট! দিদি ব্রোনিয়ার আগ্রহে মেরি একটা নতুন পোশাক করালেন। সেটাও কালো রঙের, সেটাও দীর্ঘদিন গবেষণাগারে ব্যবহার হয়েছিলো। মেরির বাবা এর মধ্যে মারা গেছেন। দিদিও ফিরে গেছেন পোল্যান্ডে, সেখান থেকে তিনি এই অনুষ্ঠানের জন্য প্যারিতে এসেছিলেন। মেরির পরীক্ষকরা বললেন যে এই উপাধির জন্য মেরির মতো ভালো কাজ আগে কেউ করেন নি। ভুল তাঁরা বলেন নি। সে বছরই নোবেল পুরস্কার ভাগ করে দেওয়া হল বেকরেল ও কুরি দম্পতির মধ্যে। কুরিরা অবশ্য অসুস্থতা ও কাজের চাপের জন্য ব্যক্তিগত ভাবে পুরস্কার নিতে যেতে পারেন নি।
       মেরির নোবেল জয়ের পিছনে একটা ইতিহাস আছে। তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে কাজের জন্য বেকরেল ও পিয়েরের নাম মনোনীত হয়েছিল। পিয়ের তা জানতে পেরে নোবেল কমিটিকে লেখেন যে তাঁর মতে মেরিও তাঁর কৃতিত্বের সমান অংশীদার। নোবেল কমিটি তাঁর যুক্তি মেনে নেয়। ১৯০১ সালে, অর্থাৎ নোবেল পুরস্কারের প্রথম বছরেই মেরির নামে একটি মনোনয়ন জমা পড়েছিল। বৌশার্ড নামের জনৈক চিকিৎসক তাঁর নাম প্ৰস্তাব করেছিলেন। সেই প্ৰস্তাবের উপর ভিত্তি করে মেরির নাম তালিকায় ঢোকানো হল।
       জানতে ইচ্ছে করে যে মেরির নাম কেন বাদ পড়েছিলো। রসায়নবিদরা বলেছিলেন যে এই পুরস্কার নতুন মৌলিক পদার্থ আবিষ্কারের জন্য নয়। তাঁরা রসায়নে নোবেল পুরস্কারের জন্য কুরিদের নাম আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন, কিন্তু নতুন মৌল সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বেকারেলের পরে যখন পিয়েরের নাম আসে, তখন কি মেরির নাম মনে আসাটা উচিত ছিল না? নাকি মহিলা বলে তাঁকে প্ৰথমে উপেক্ষা করা হয়েছিল? অনুরূপ আর এক ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। ১৯০৩ সালেই ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটিতে তাঁরা দুজনে উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু মেরির সেখানে বক্তৃতা দেওয়ার অধিকার ছিল না।
       কেন এক ডাক্তার মেরির নাম প্রস্তাব করেছিলেন? কুরিদের কাজ চিরকালই ডাক্তারদের খুব পছন্দের, কারণ ক্যান্সারের চিকিৎসাতে রেডিয়াম প্রায় প্রথম থেকে ব্যবহার হচ্ছিলো। কুরিরা পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম বার করার পদ্ধতির কোনো অংশ যদি পেটেন্ট নিতেন, তাহলে চিরকালের জন্য তাঁদের আর্থিক সমস্যা দূর হতো। কিন্তু দুজনেই বিশ্বাস করতেন যে বিজ্ঞানে সমস্ত মানুষের অধিকার, তাই তাঁরা পেটেন্ট নেওয়ার কোনো চেষ্টা করেন নি।
       নোবেল পুরস্কারের পর সরবোনে পিয়েরের অধ্যাপনার চাকরি জুটল। অনেক টালবাহানার পর তাঁর গবেষণাগার তৈরি করতেও সরকার রাজি হলেন। মাইনে বছরে দশ হাজার ফ্রাঁ। মেরিও কাজ করার সুযোগ পেলেন। তবে অধ্যাপক নয়, গবেষণাগারের প্রধান হিসেবে। মাইনে চব্বিশশো ফ্রাঁ। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
       ১৯০৬ সালে এক পথ দুর্ঘটনাতে পিয়েরের মৃত্যু হয়। এর আগে তাঁদের দ্বিতীয় মেয়ে ইভ জন্মেছে। মাদাম অত্যন্ত দুঃখ পেলেও নিজেকে শক্ত করলেন। ফরাসি সরকার মাদামকে পেনশন দিতে চাইলে তা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। কাজ না করে অর্থ তিনি নেবেন না। বন্ধুদের চেষ্টায় সরবোনে পিয়েরের জায়গায় তাঁকে নিয়োগ করা হয়। ফ্রান্সের ইতিহাসে প্ৰথম অধ্যাপিকা।
       কাজ বন্ধ রইল না। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে মাদাম পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম আলাদা করতে সক্ষম হলেন। এর পরই ১৯১১ সালে তাঁকে রসায়নে গড়ে ওঠে। রেডিয়াম ইন্সটিটিউট। এখন সেখানে দেড় হাজারেরও বেশী লোক কাজ করেন। সারা পৃথিবী থেকে তরুণ গবেষকরা মাদামের সঙ্গে কাজ করার জন্য সেখানে যেতেন। আমাদের সত্যেন্দ্রনাথ বসুও তাদের মধ্যে একজন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মোবাইল এক্স-রে ভ্যানে মাদাম কুরি
       প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মাদাম আহত সৈনিকদের সেবায় নিজেকে নিয়োগ করেন। এক বন্ধুকে চিঠিতে তিনি লিখছেন যে পোল্যান্ডের জন্য যখন কাজ করা সেই মুহূর্তে সম্ভব নয়, তখন তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্বদেশের জন্যই আত্মনিয়োগ করবেন। দুই মেয়েও তাঁর সঙ্গে যোগ দেয়। মাদাম যুদ্ধক্ষেত্রে হাসপাতালে এক্স-রে করার ব্যবস্থা করেন। তার ফলে যে কত সৈন্যের প্রাণ বেঁচেছিল তা বলা বাহুল্য। তাঁর দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কারের সমস্ত টাকা তিনি দেশের স্বার্থে গঠিত এক ফাণ্ডে গচ্ছিত রাখেন, যদিও তিনি ভালোই জানতেন যে টাকাগুলো আর ফেরত পাওয়া যাবে না। তাঁর নোবেল পদকগুলোও তিনি জমা দিতে গিয়েছিলেন – সোনাটা সরকার গলিয়ে ব্যবহার করতে পারবে। আমাদের সৌভাগ্য যে ফরাসি সরকার সেগুলো গ্ৰহণ করে নি।
       মাদাম শেষ জীবনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন বিজ্ঞানীরা তেজস্ক্রিয়তার বিপদ সম্পর্কে আজকের মতো সচেতন ছিলেন না। মাদাম কুরির নোটবই আজও বিশেষ রেডিয়েশন নিরোধী পোশাক না পড়ে নাড়াচাড়া করা যায় না। মাদাম সারা কর্মজীবন তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে কাজ করেছেন। শেষ পর্যন্ত তার থেকে যে রোগ হয়, তাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। দিনটা ছিল ১৯৩৪ সালের ৪ঠা জুলাই। তাঁকে তাঁর স্বামী পিয়েরের পাশে সমাহিত করা হয়। ষাট বছর পর ১৯৯৫ সালে, ফ্রান্সের বিশিষ্ট মানুষদের যেখানে শেষ সমাধি, সেই প্যারির প্যান্থিয়নে তাঁদের দুজনকে আবার সমাহিত করা হয়েছে। মেরিই প্রথম মহিলা যিনি নিজের কৃতিত্বে সেখানে স্থান করে নিয়েছেন।
       যদি কয়েকটি কথায় বিজ্ঞানে মাদামের দানকে চিহ্নিত করতে হয়, তাহলে বলতে হবে যে তাঁর কাজের ফলেই নিউক্লিয় বিজ্ঞানের সম্ভাবনার কথা বিজ্ঞানীদের মাথায় আসে। পরমাণু যে বিরাট শক্তির ভাণ্ডার, তা দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার গঠন সম্পর্কে আমাদের কৌতূহলী করে তুলেছিলেন। রেডিয়োকেমিস্ট্রি বিজ্ঞানের তিনিই পথিকৃৎ। তাঁর আবিষ্কারের ফলেই আরো বহু তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে রেডিয়াম দিয়েই ক্যান্সারের চিকিৎসা প্ৰথম সম্ভব হয়েছিল।
       আইনস্টাইন ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি লিখেছেন যে মাদামই তাঁর জানা একমাত্র ব্যক্তি যিনি খ্যাতি অর্জন করার পরও এক বিন্দু পাল্টান নি। অনেক পরে পঞ্চাশের দশকে এক সাক্ষাতকারে তিনি আরো বলেছিলেন যে শুধু বিজ্ঞান বা মানব সভ্যতায় অবদান নয়, মাদামের নৈতিকতা, বিচার শক্তি ও চরিত্রের দৃঢ়তার জন্যও তিনি তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে রেখে আইনস্টাইনের মন্তব্য, ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীরা যদি মাদামের মতো বিনয়ী হতেন, হয়তো পরিস্থিতি অন্যরকম হতো।
১৯২৭ সালের সলভে কনফারেন্সঃ সে সময় বিজ্ঞানের সবচেয়ে বিখ্যাত এই কনফারেন্সে মাদাম কুরিই ছিলেন একমাত্র মহিলা

       (প্ৰকাশ: জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার, জানুয়ারি ২০১৭, পরিমাৰ্জিত)













6 comments:

  1. ব্যতিক্রমী লেখা, ভাল লাগল |

    যদিও লেখক আমার পূর্ব পরিচিত তবুও "view my complete profile" টায় কিছু লেখা থাকা প্রয়োজন |

    আরো লেখার অপেক্ষায় রইলাম|

    Nilambar Bhuinya

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ। সাজেশনটা ভালো। আসলে আমরা দুজনেই ফেসবুকে লিঙ্কগুলো পোস্ট করি, সেখানে অনেক কথা লেখা আছে, তাই এখানে আরো কিছু লেখা হয়ে ওঠেনি।

      Delete
  2. "সমস্ত বিখ্যাত মানুষের মধ্যে মেরি কুরি ছিলেন ব্যাতিক্রমী ব্যাক্তিত্ব যাঁকে খ্যাতি আদর্শচ্যুত করতে পারে নি।": অ্যালবার্ট আইনস্টাইন

    ReplyDelete
  3. মাদা কুরিঃ জীবনী আগেওপড়েছি, তবে এই লেখাটা পড়ে আরোও নতুন কিছু জানলাম।

    ReplyDelete
  4. তপন কুমার বিশ্বাস5 July 2023 at 19:15

    খুব মূল্যবান রচনা। আমার কাছে মাদাম মেরি কুরি একজন নমস্য ব্যক্তিত্ত্ব। লক্ষ্যে অবিচল থেকে সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে জয়ী একজন আদর্শ মানুষ। তাঁর জীবনকাহিনী প্রেরণা যোগাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।

    মেরি কুরি

    ReplyDelete
  5. তপন কুমার বিশ্বাস5 July 2023 at 19:22

    মেরি কুরির জীবনী অধ্যয়ন করছি। মেরি কুরির শৈশব ও কৈশোর সম্পর্কে আমার একটি লেখা ইতিমধ্যে ' একপর্ণিকা ' পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। আপনার নজরে পড়ে থাকলে আপনার মতামত জানতে আগ্রহী। পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখার ইচ্ছা রয়েছে।

    ReplyDelete