Saturday, 19 August 2017

মায়া ক্যালেন্ডার

মায়া ক্যালেন্ডার
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
       যাক, ভালোয় ভালোয় দিনটা কেটে গেলো। কোন দিনটা? কেন? একুশে ডিসেম্বর, ২০১২। ঐ দিন তো মায়া ক্যালেন্ডার শেষ হয়ে গেলো। তাই, সবাই বলছিল যে ঐ দিনটাই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।
       এই পর্যন্ত পড়ে নিশ্চয় ভাবছেন আরো এগোবেন কিনা। আপনাদের দোষ দেবো না। আমি হলেও হয়তো তাই করতাম। সত্যিই তো পৃথিবী ধ্বংস হয়নি। কিন্তু এই ধরনের কথা হয়তো শুনেছেন। কখনো ভেবেছেন কী ক্যালেন্ডার শেষ হল মানে কী? একটা বছর শেষ হয়ে গেলে আর একটা নতুন বছর আসে। ২০১২ শেষ হল, ২০১৩ সাল এলো। ক্যালেন্ডার শেষ হল কেন বলা হচ্ছে?
       আসলে মায়া ক্যালেন্ডারটা একটু জটিল। আমরা সাধারণত যেভাবে বছর গুনি, মায়া সভ্যতাতে ঠিক তেমনভাবে হিসেব করা হতো না। আসুন দেখি মায়া সভ্যতা কেমন ভাবে দিনের হিসেব রাখতো।
মায়া সভ্যতার সবচেয়ে পরিচিত চিহ্ন, পিরামিড

       মনে রাখবেন মায়া সভ্যতা হল মধ্য আমেরিকার, এখন সেই জায়গা মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, এল সালভাডোর, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া, কোস্টা রিকা, এই সমস্ত দেশের মধ্যে পড়ে। মায়া সভ্যতার সবচেয়ে উন্নতির সময় ছিল খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতক থেকে নবম শতক। আমাদের মতো সপ্তাহ, মাসের হিসাব তাদের সঙ্গে মিলবে না। কারণ মায়া সভ্যতার সঙ্গে ইউরোপ আর এশিয়ার যোগাযোগ ছিল না। তবে ৩৬৫ দিনে এক বছর, এই হিসাবটা সাধারণত মিলে যাওয়ার কথা। কারণটাও সহজ, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরতে যত সময় নেয়, তাকেই আমরা এক বছর ধরি। সময়টা মোটামুটি ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড। মনে রাখতে হবে এই সময়ের দৈর্ঘ্যটা আস্তে আস্তে বাড়ছে।
       মায়ারা তিনরকম ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতো। সেগুলোর হিসেব আলাদা আলাদা। সবচেয়ে ছোটো বছরটার নাম ছিল সলকিন (Tzolkin)। ২৬০ দিনে এক সলকিন বছর। কেন ২৬০ দিন? বিশেষজ্ঞরা একমত হতে পারেন নি। সেই নিয়ে আলোচনা করতে গেলে শেষ হবে না। মায়া সভ্যতা সম্পর্কে আমরা খুব কম জানি। স্পেনের সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণে মায়া সভ্যতা, যা তখন এমনিই পতনোন্মুখ, তা ধ্বংস হয়ে যায়। খুব কম তথ্যই আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে।
       সলকিনের জন্য মায়ারা দুরকম হিসেবে দিন গুনতো। একটাতে মোট তেরোটা দিন ছিল যাদের ১ থেকে ১৩ পর্যন্ত সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হতো। অন্যটাতে কুড়িটা দিনের নাম ছিল। পাঠক নিশ্চয় খেয়াল করেছেন যে সলকিনকে বারো বা অন্যকোনো রকম মাসে ভাগ করা হয়নি। প্ৰত্যেকটা দিনকে একটা সংখ্যা আর একটা নাম দিয়ে চিহ্নিত করা হতো। তার মানে ১৩ × ২০ = ২৬০ দিন পরে হিসাবটা আবার নতুন করে শুরু হতো। সেই হিসেবে সলকিনে ২৬০ দিন ছিল। সলকিন সাধারণত ধর্মীয় বা যাদুবিদ্যাতে কাজে লাগতো।
       মায়ারা কী তাহলে ৩৬৫ দিনের সৌর বছরের হিসেব রাখতো না? সৌর বছর কেন দরকার, তা নিশ্চয় কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। বর্ষা বা শীত তো আর সলকিন মেনে আসবে না। কাজেই চাষবাস, শিকার – এ সমস্তের জন্য সৌর বছরের হিসাব না করলে চলে না। হাব (Haab) বলে আর একটা বছর ছিল, তাতে ছিল ৩৬৫ দিন। হাবে আঠারোটা মাস ছিল, যার প্রত্যেকটাতে ছিল কুড়িটা দিন। সব শেষে পাঁচটা দিন যোগ করা হতো। ঐ দিনগুলোকে অশুভ মনে করা হতো।
       প্ৰসঙ্গত বলে রাখি মায়ারা দীর্ঘদিন ধরে গ্রহ তারাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেছিলো। তাই তারা বুঝেছিল যে ৩৬৫ দিনে ঠিক এক বছর হয় না। একটা হিসেব বলছে যে তারা বছরের দৈর্ঘ্য যা বার করেছিলো তার সঙ্গে আধুনিক হিসেবের তফাত কুড়ি সেকেন্ডেরও কম। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন যে এতটা মিলে যাওয়া সমাপতন নেহাতই অর্থাৎ কিছুটা ভুল করে হয়ে গেছে। এ নিয়ে বিতর্ক চলছে।
       একটা তারিখ ধরি, মনে করুন ১ লা জানুয়ারি। ২০১২ আর ২০১৩ সালে এই দুটো তারিখকে আলাদা করি বছরের সংখ্যা ধরে। মায়ারা বছরের সংখ্যার হিসেব রাখতো না। হাব আর সলকিন বাহান্ন বছর (বা হাব) পরে পরে মিলে যায়। তার মানে যদি কোনো দিনকে একই সঙ্গে সলকিন ও হাবের হিসাবে দেখানো যায়, তাহলে বাহান্ন বছরের মধ্যে যে কোনো দিনকে ঠিকঠাক ভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব। বাহান্ন বছর পরে আবার ঐ সলকিন ও হাবের মাপটা ফিরে আসবে। কিন্তু মায়া সভ্যতা এতে সন্তুষ্ট হয়নি। তারা একটা দীর্ঘ হিসাব কল্পনা করেছিলো। দেখা যাক সেটা কী রকম।
       মায়ারা দিনকে বলতো কিন। কুড়ি কিনে এক উইনাল। আঠারো উইনালে এক টুন, কুটি টুনে এক কাটুন। কুড়ি কাটুনে এক বাকটুন। সহজ কথায় এক বাকটুনে ১৪৪০০০ দিন বা মোটামুটি ৩৯৪ বছর। এর চেয়ে বড়ো হিসেব সম্ভবত আছে, তার নাম পিকটুন। কতো বাকটুনে এক পিকটুন? পিকটুন আছে কিনা তা নিয়েই পণ্ডিতরা একমত নন, কাজেই পিকটুন কত বড়ো সে তর্ক শেষ হওয়ার নয়।
       আমাদের গল্পে এই কথাটা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আমরা এখনি দেখব। তবে একথা ঠিক, পিকটুন ছাড়াও দীর্ঘ বছরের হিসেবে চট করে কোনো তারিখ ঘুরে আসবে না। তাই মায়া পিরামিড বা অন্যান্য জায়গায় বাকটুন থেকে কিন, এই পাঁচটা চিহ্ন দিয়ে তারিখ খোদাই করে রাখা হতো। খেয়াল করবেন, পিকটুন লেখা থাকতো না বলেই মনে হয়- কারণ তার দরকার হতো না।
       পণ্ডিতেরা মনে করেন যে মায়া দীর্ঘ বছরের হিসেব শুরু হয়েছিলো আজকের গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেবে ১১ই আগস্ট, ৩১১৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। ভাববেন না যে মায়ারা ঐ দিন থেকে হিসেব রাখছে, সেটা শুরু হয়েছিলো অনেক পরে। মায়ারা বিশ্বাস করতো যে ঐ দিন বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিলো। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগের কোনো তারিখ মায়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে খোদাই করা দেখেন নি।
১১ই আগস্ট, ৩১১৪ খ্রিস্ট পূর্ব, মায়াদের মতে বিশ্ব সৃষ্টির দিন
       সে না হয় হল, কিন্তু ক্যালেন্ডারের শেষ কথাটা আসছে কোথা থেকে? ২০শে ডিসেম্বর, ২০১২ মায়া দীর্ঘ বছরের হিসেবে এই তারিখটা হল ১২ বাকটুন ১৯ কাটুন ১৯ টুনা ১৭ উইনাল ১৯ কিন। এটাকে সংক্ষেপে লেখা হয় ১২.১৯.১৯.১৭.১৯। মায়ারা দীর্ঘ বছরের হিসেব শূন্য থেকে শুরু করতো। তার মানে পরের দিনটা হল ১৩.০,০,০,০।
       তার পরের হিসেব নিয়ে পণ্ডিতরা একমত নন। কেউ বলেন যে যে দীর্ঘ বছরের হিসেবটা নতুন করে শুরু করতে হবে। তার কারণ মায়ারা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনটা ০.০.০.০.০ না লিখে ১৩.০.০.০.০ লিখেছে। কেন সে নিয়েও মতভেদ আছে। এটা সবাই মানেন যে ১৩ সংখ্যাটা মায়াদের কাছে বেশ মঙ্গলময় তাৎপর্য নিয়ে আসতো। সেই হিসেব ধরলে ২১শে ডিসেম্বর, ২০১২ বছরের হিসেব নতুন করে শুরু হওয়ার কথা। তার মানে পরের দিনটা হল ০.০.০.০.১। এই হিসেবেই ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১২ মায়া ক্যালেন্ডারের হিসেব শেষ হয়ে নতুন হিসেব শুরু হওয়ার কথা। অন্য কেউ আবার বলেন ক্যালেন্ডারে এর পরের দিন অর্থাৎ ২২শে ডিসেম্বর, ২০১২ মায়া হিসেবে হবে ১৩.০.০.০.১, এভাবে চলবে। যাঁরা এই কথা বলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন যে ১৪.০.০.০.০-এর পর (তারিখটা ২৬শে মার্চ, ২৪০৭) আর এগোবে না। পরের দিনটা হবে ১.০.০.০.১। এঁদেরে দুপক্ষেরই মতে একসময় বছর নতুন করে গুনতে শুরু করতে হবে। অন্য অনেকেই বলেন যে ২০ বাকটুনে এক পিকটুন, সুতরাং এই বাকটুনের হিসেব শেষ হয়ে এক পিকটুন হবে ১৩ই অক্টোবর, ৪৭৭২ তারিখে। তখন পাঁচটার বদলে ছটা চিহ্ন দিয়ে তারিখ লিখতে হবে। পিকটুনের চেয়েও বড়ো মাপ আছে। কাজেই বছর গোনা কখনোই নতুন করে শুরু হবে না। পণ্ডিতদের এই তর্ক শেষ হওয়ার নয়। তর্কটাও নেহাতই পণ্ডিতীয়, মায়াদেরও সাধারণ ভাবে এত দীর্ঘ সময় লেখার দরকার হতো না।
       কিন্তু মায়া বিশেষজ্ঞরা একটা বিষয়ে এক মত। এক বাকটুন যেদিন শেষ হল, সেদিন মায়াদের কাছে আনন্দের দিন, পৃথিবী ধ্বংস বা ঐ জাতীয় গল্প নেহাতই আধুনিক মানুষের কষ্ট কল্পনা যাকে ব্যবহার করে কেউ কেউ ব্যাবসা ফেঁদেছিলো। আবারও এরকম কোনো দিনের গল্প শীগগিরি শোনা যাবে। সেই দিনটাও ২০১২ সালের ২১শে ডিসেম্বরের মতো আসবে, আবার চলেও যাবে।
(প্ৰকাশ: নর্থ স্টার জানুয়ারি ২০১৩)









No comments:

Post a Comment