Saturday, 28 November 2020

দারুচিনির দ্বীপ পর্ব ৩- অনুরাধাপুরা ও ডাম্বুলা

  


দারুচিনির দ্বীপ

পর্ব ৩- অনুরাধাপুরা ও ডাম্বুলা

                                শম্পা গাঙ্গুলী

দ্বিতীয় পর্বঃ পোলোন্নারুয়া ও মিনেরিয়া

    পরের দিন লাগেজ গুছিয়ে আমরা রওনা দিলাম অনুরাধাপুরার দিকে। একটা কথা জানানো হয়নি। শ্রীলঙ্কার সব রাস্তাঘাটই শুধু যে পরিষ্কার তা নয়, কোথাও রাস্তা একটুও খানাখন্দ নেই। যদি হয়ও তা সঙ্গে সঙ্গে মেরামতির ব্যবস্থা করা হয়। দেখলামও এরকম কয়েকটা জায়গায়। কোথাও কোনো জঞ্জালের স্তুপ চোখে পড়ল না ওই কটা দিনে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করায় বলল, এদেশে একটা মানুষও অশিক্ষিত থাকে না। উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা বেশি না হলেও প্রাথমিক শিক্ষার ওপর খুব জোর দেওয়া হয়। আর এখানে বেকারত্বও কম

       প্রাচীনকালে প্রায় ৩৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই অনুরাধাপুরা শ্রীলঙ্কার রাজধানী ছিল। খ্রিস্টিয় তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দি নাগাদ বৌদ্ধ শ্রমণ পণ্ডিতরা অনুরাধাপুরার মহাবিহারে বসে প্রাচীন শিলালিপি ও পুঁথি ঘেঁটে সিংহলীদের জাতিগত উৎস সম্পর্কে পালি ভাষায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন বিভিন্ন গ্রন্থে। সেগুলোর মধ্যে মহাবংশ, দীপবংশ, থুপাবংশ এবং কুলবংশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই গ্রন্থগুলো অনুসারে প্রাচীন ভারত ভূখণ্ড থেকে ইন্দো-আর্য অভিবাসনের মাধ্যমেই এদেশের জাতিগত উৎপত্তি ঘটে। মহাবংশ ও দীপবংশ পুরাণ অনুযায়ী প্রাচীন সিংহলের প্রথম রাজা ছিলেন বিজয়সিংহ তিনি তাঁর রাজত্বের নাম দেন তাম্রবর্ণি, অর্থাৎ তামার মতো রং, যা বর্তমানে তাম্বপন্নি তিনি ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে এসে রাজত্ব স্থাপন করেন। তাঁর জন্মবৃত্তান্ত অদ্ভুত, বলা যায় গ্রীক পুরাণের মত। মহাবংশে কথিত আছে বিজয়ের বাবার নাম ছিল সিংহবাহু। তাঁর হাত-পাগুলো নাকি সিংহের মত ছিল। শরীরেও সিংহের মত শক্তি। তিনি ভারতের সিংহপুরা নামে এক রাজ্যের রাজা ছিলেন। কেউ কেউ বলেন সিংহপুরা ছিল প্রাচীন বঙ্গ বা কলিঙ্গের কোনো প্রদেশ। আবার কারো কারো মতে এটি গুজরাটের একটি অঞ্চল। সিংহবাহুর মা সুপ্পাদেবী বঙ্গদেশের রাজকন্যা ছিলেন। কুমারী অবস্থায় তিনি একদল যাযাবরের সঙ্গে জঙ্গলে পালিয়ে যান। গল্প আছে সেখানে বনের পশুরাজের সঙ্গে তাঁর মিলনের ফলে একটি কন্যা ও একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। ঐ পুত্র হল সিংহবাহু। সিংহবাহুর জ্যেষ্ঠ সন্তান বিজয়। পরবর্তীকালে নানান দুষ্কর্মের জন্য যুবরাজ বিজয় এবং তাঁর সাতশো অনুগামী ভারত থেকে বিতাড়িত হন। তাঁরা জাহাজে করে পালিয়ে শ্রীলঙ্কায় আসেন ও এখানে রাজত্ব স্থাপন করেন। বিজয় যেদিন শ্রীলঙ্কায় পা রাখেন, উত্তর ভারতে সেদিনই গৌতম বুদ্ধ দেহত্যাগ করেন।  কথিত আছে বুদ্ধ বিজয়কে রক্ষা করতে ও তার মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটাতে স্বর্গে দেবতা ইন্দ্রকে অনুরোধ  করেন এখানেই গল্পের শেষ নয়। ইন্দ্র একজন দেবদূতকে পাঠান বিজয়কে সাহায্য করতে। তিনি তপস্বীর বেশে এসে তাঁকে এক মন্ত্রপূত তাগা দেন। এই তাগার বলে বিজয় যক্ষীণী কন্যা কুভেনির সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করেন ও নিজের সঙ্গীদের মুক্ত করেন। এরপর কুভেনির সাহায্যে তিনি সমস্ত যক্ষকে পরাজিত করেন। পরে তিনি কুভেনিকে বিয়ে করেন আমাদের কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই রাজাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন,
                আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ হেলায় লঙ্কা করিয়া জয়
                সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্যের পরিচয়।
তবে ভারতের ইতিহাসে এই গল্পের কোনো সমর্থন নেই। পরে রাজা দেবনামপিয়তিস্যের (খ্রিস্ট পূর্ব ৩০৭-২৬৭) সময় শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে সবচেয়ে বেশি। সম্রাট অশোকের ছেলে মাহিন্দ (মহেন্দ্র) ও মেয়ে সঙ্ঘমিত্রা শ্রীলঙ্কায় এসেছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করতে। সেই সময়ে সন্ন্যাসী মাহিন্দ রাজা দেবনামপিয়তিস্যকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দেন ও তাঁকে শিষ্য রূপে গ্রহণ করেন। 
   
ইসুরুমুনিয়া বিহারের পাশে
        আমরা অনুরাধাপুরাতে প্রথমেই গেলাম ইসুরুমুনিয়া বিহার দেখতে যেটি রাজা দেবনামপিয়তিস্যের সময়ে তৈরি। এটি শ্রীলঙ্কার প্রাচীনতম বৌদ্ধ মন্দিরগুলির অন্যতম। এখানে বেলে পাথরে খোদাই করা কিছু বিখ্যাত মূর্তি সংরক্ষিত আছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ‘Isurumuniya Lovers’। ষষ্ঠ শতকের  গুপ্ত স্টাইল। একজন পুরুষের কোলে একটি মহিলা বসে। মহিলাটির ডান বাহুর একটি আঙুল সামনের দিকে তোলা যা তার ভীরুতা ও লজ্জাকে প্রকাশ করছে। কিন্তু পুরুষটি নির্বিকার নির্লজ্জভাবে বসে আছে। কথিত আছে এঁরা হলেন রাজা দুতুগামুনুর ছেলে সালিয়া ও তার প্রেমিকা অশোকমালা, যিনি নাকি খুব নিচু জাতের ছিলেন। শোনা যায় অশোকমালাকে পাবার জন্য সালিয়া নাকি হেলায় সিংহাসন পরিত্যাগ করেছিলেন
        ইসুরুমুনিয়ার প্রেমিকযুগল
       
বোধিবৃক্ষ মন্দিরের বাইরে
বোধিবৃক্ষ, অনুরাধাপুরা
        এর পর আমরা বোধিবৃক্ষ মন্দির দেখতে গেলাম। এটি শ্রীলঙ্কার অত্যন্ত পবিত্র স্থান। দুহাজার বছরের পুরনো বুদ্ধগয়ার সেই আসল বোধিবৃক্ষ যার তলায় বসে শাক্যমুনি বোধি লাভ করেন, তার একটি চারা এখানে কাটিং করে বসানো হয়েছিল সম্রাট অশোকের কন্যা সন্ন্যাসিনী সঙ্ঘমিত্রা ভারত থেকে যখন শ্রীলঙ্কায় আসেন, সেই চারা এনে অনুরাধাপুরায় এই জায়গাটায় প্রথম পুঁতেছিলেন। বুদ্ধগয়ার মূল বোধিবৃক্ষটি মারা গেলে এর থেকেই আবার কলম কেটে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় পরে আবার এই গাছ থেকে আরও কাটিং শ্রীলঙ্কায় বিভিন্ন জায়গায় বসান হয়। এমনকি ইসুরুমুনিয়ার অশ্বত্থ গাছটিও এরই কলম। এরপর আমরা গেলাম রুয়ানোয়েলিসায়া। শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড়ো প্রাচীন বৌদ্ধস্তুপ। রাজা দুতুগামুনু ১৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ এটি স্থাপন করেন। এটি পৃথিবীর অন্যতম উঁচু স্তুপ। উচ্চতা ৩৩৮ ফুট ও পরিধিতে ৯৫১ ফুট। এটি একসময়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সংস্কারের পর সম্পূর্ণ ধবধবে সাদা রঙে এটি অসাধারণ দেখতে হয়েছে।

অনুরাধাপুরাতে পুণ্যার্থীদের দল (উপরে) এবং রুয়ানোয়েলিসিয়া (নিচে)
        বোধিবৃক্ষ মন্দির থেকে পায়ে হেঁটে রুয়ানোয়েলিসায়া যাবার পথেই পড়ল লোভামাহাপায়া রাজপ্রাসাদের  ভগ্নাবশেষ। রাজা দুতুগামুনু তিরিশ বছর ধরে ( খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ১৬১-১৩১) এই বিশাল নয় তলা (কাঠের) রাজপ্রাসাদটি তৈরি করেন। শোনা যায় দুর্মূল্য পাথর আর প্রবাল দিয়ে সাজানো  একাধিক তল বিশিষ্ট এই প্রাসাদটি ১৫০ ফুট উঁচু ছিল, যদিও আমার তা বিশ্বাস হলো না। প্রাসাদটি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থেও ১৫০ ফুট করে ছিল। এর বিশাল ছাদ সুসজ্জিত ছিল তামা ও ব্রোঞ্জের পাতে। প্রাসাদের পুরো কাঠামোটা দাঁড়িয়ে ছিল ষোলশো পিলারের ওপর বোঝাই যায়, ইতিহাসের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে ঐ প্রাসাদে। এখন আর প্রাসাদ বলতে কিছুই নেই। পড়ে আছে শুধু পিলারগুলো কোনো এক সময়ে আগুন লেগে এই প্রাসাদ ধ্বংস হয়ে যায়
লোভামাহাপায়া রাজপ্রাসাদের  পিলারের কয়েকটি
        অনুরাধাপুরা শহরটা খুব সুন্দর করে সাজানো। সারাদিন ধরে আমরা শহরের পুরানো অংশেই ঘুরে বেড়িয়েছি। ইতিহাসের এত গন্ধ আছে এই শহরে, না এলে জানতেই পারতাম না। বর্তমানে এটি ইউনেস্কো দ্বারা ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। আবার দেশটায় লৌহ-যুগের সূচনা হয়েছিল এই অনুরাধাপুরা শহরটায় ন’শো খ্রিস্টপূর্বাব্দ। বিরাট বসতি গড়ে উঠেছিল তখনই।  লৌহ যুগ পেরিয়ে আদিম কৃষিসভ্যতার বিকাশও এই অঞ্চলে ঘটেছিল দারুনভাবে।
    রের দিন হাবারানা থেকে মালপত্র নিয়ে আবার গাড়িতে উঠলাম। যাব আরো একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট, ডাম্বুলার স্বর্ণ  গুহা-মন্দিরে শ্রীলঙ্কা দ্বীপের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থিত ডাম্বুলাতে আছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি বৃহত্তম গুহা মন্দির। প্রাচীন কাল থেকেই উত্তরের শুষ্ক সমভূমির সঙ্গে কেন্দ্রের পার্বত্যভূমির সংযোগকারী একটি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পীঠস্থান। দ্বীপের পূর্ব-পশ্চিমের বাণিজ্যিক লেনদেনের কেন্দ্রবিন্দুও বটে। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই অঞ্চলের যুগ যুগ ধরে ক্রমান্বয়ে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে। শোনা যায় এই দেশে আদিম গুহামানবের বসতি প্রথম এখানেই ঘটেছিল। কিন্ত গুহামন্দিরটির সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের চোখ প্রচণ্ড ধাক্কা খেল, পাহাড়ের সামনেই দানবাকার এক বুদ্ধমূর্তি দেখে। মাপ করবেন আমার শব্দ চয়নকে গুহাটার প্রাচীনত্বের সঙ্গে বড়ই বেমানান কোরিয়া থেকে আনা ঐ মূর্তি। 



        পাহাড় বেয়ে অনেকটা উঠতে হলো। এখানেও আমাদের সঙ্গী ছিল বানরবাহিনী। গম্বুজাকৃতি বিশাল দুটি শিলাস্তুপের ওপর প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারগুলো। ছশ ফুট উঁচু আর দুহাজার ফুট লম্বা শিলাস্তুপের গুহাগুলি ছোটো বড় অনেকগুলো খোপে ভাগ করা পাথরের দেওয়াল দিয়ে।  গম্বুজের ওপরের পাথুরে ভূপ্রকৃতির দৃশ্য সত্যি দেখার মত। গুহার ভেতরগুলিতে বিভিন্ন মুদ্রায় স্বর্ণবর্ণ বুদ্ধমূর্তি ও দেয়ালচিত্র চারদিক আলো করে রেখেছে। মহারাজা বিহার হলো সবচেয়ে বড় গুহা। অত বছর আগের মুরাল চিত্র এখনো অক্ষত আছে কীভাবে  জানা নেই। গুহার পাথরের ছাদগুলো সামনের দিকে অনেকটা প্রসারিত বলে হয়তো রোদ, জল থেকে বছরের পর বছর রক্ষা পেয়েছে। প্রচুর দর্শনার্থীর ভিড়। কিন্তু কি অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। গুহার ভেতরের দেওয়ালে আর ছাদের ছবিও অসাধারণ
ডাম্বুলার গুহামন্দির





ডাম্বুলা গুহামন্দিরের ভিতরে বুদ্ধমূর্তিসমূহ
        গুহাগুলোর সামনে চওড়া চাতাল। সেখান থেকে অনেক নিচের উচ্ছল ডাম্বুলা নদী আর উল্টোদিকের পাহাড়ি বনভূমির দৃশ্য এপারের পাথুরে রুক্ষ ভূমির থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। শনশন করে বয়ে যাওয়া বাতাসে যেন ভেসে আসছে প্রাচীনকালের বৌদ্ধ শ্রমণদের মন্ত্রোচ্চারণ আর ধূপের আঘ্রাণ প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের অস্ত্রের নমুনা নাকি এখানকার মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে। সভ্যতার আদিকাল থেকে পরপর বিবর্তনের সব ঢেউগুলোই একদিন আছড়ে পড়েছিল এই ডাম্বুলায়। দূরের নদীটা হয়ত সেদিনও একই ভাবে বয়ে যেত! (ক্রমশ)

No comments:

Post a Comment