Monday 30 November 2020

দারুচিনির দ্বীপ পর্ব ৪- ক্যান্ডি ও নুয়ারা এলিয়া



 দারুচিনির দ্বীপ

পর্ব ৪- ক্যান্ডি ও নুয়ারা এলিয়া

                                 শম্পা গাঙ্গুলী

প্রথম পর্বঃ সিগিরিয়া

দ্বিতীয় পর্বঃ পোলোন্নারুয়া ও মিনেরিয়া

তৃতীয় পর্বঃ অনুরাধাপুরা ও ডাম্বুলা


        শ্রীলঙ্কায় প্রথম প্রাগৈতিহাসিক মানুষের আগমন ঘটেছিল অবশ্য দক্ষিণের রত্নপুরা জেলার বালাঙ্গোদায়। আজ থেকে চৌত্রিশ হাজার বছর আগে, মেসোলিথিক যুগে। পরবর্তীকালে অনেক রাজা এখানে ছোটো ছোটো রাজ্য শাসন করেছেন পরে ভারতের চোল রাজত্বের অধীনে আসে এই দেশ  চোল রাজারা সব ছোটো রাজ্যগুলোকে একসঙ্গে একছাতার তলায় এনে ৯৯৩-১০৭৭ সাল, এই সময়কালে রাজত্ব  চালায়। ষোড়শ শতক নাগাদ উপকূল এলাকায় পর্তুগিজদের কলোনি গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ডাচ, ব্রিটিশরা ঢুকে পড়ে এই দেশে বাণিজ্য করতে। ১৮০৩ সালে ব্রিটিশরা প্রথম ক্যাণ্ডি যুদ্ধের পর অনায়াসে ক্যাণ্ডি রাজ্য দখল করে নেয়। ১৮১৫ সালে দ্বিতীয় ক্যাণ্ডি যুদ্ধের পর পরাক্রমশালী ব্রিটিশদের হাতে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতার সূর্য হয় অস্তমিত ব্রিটিশরা এদেশে চা, কফি, রাবার এইসব চাষের জন্য পাহাড়ের ঢালগুলোয় উত্তম অনুকূল পরিবেশ পেল। ফলে ভারতের মতোই এদেশেও বাগিচা ফসল ফলিয়ে সারা পৃথিবীতে একচেটিয়া ভাবে বাণিজ্য করে মুনাফা লুঠতে লাগল। প্রচুর শ্রমিক আনল ভারতের তামিল রাজ্য থেকে। তারপর চলল শোষণ আর নিপীড়নের রাজনীতি। এ ইতিহাস আমাদের মত ভুক্তভোগীদের অজানা থাকার কথা নয়। তখন এ দেশের জনসংখ্যার দশ শতাংশই ভারত থেকে আনা শ্রমিক যা হোক সিংহলের স্বাধীনতার আন্দোলনের কথায় আমি যাচ্ছি না, তাহলে এ লেখা শেষ হবে না। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি এদেশ স্বাধীন হয়।   
আমরা চলেছি ডাম্বুলা ছেড়ে আরও দক্ষিণে ক্যাণ্ডির পথে। পোলোন্নারুয়া বা অনুরাধাপুরার মত অত প্রাচীনত্বের ছোঁয়া না থাকলেও ব্রিটিশরা দেশটা দখল করার আগে ক্যাণ্ডি ছিল এদেশের শেষ স্বাধীন রাজধানী। আমাদের যাবার পথটাও বেশ সুন্দর। কিন্তু দারুণ গরম। এসি গাড়িতে বসেও সকলের কেন জানি না খুব হাঁস-ফাঁস অবস্থা। একটা মশলা বাগানে ঢুকেছিলাম। দেশটার নাম তো দারুচিনির দ্বীপ, তাই মশলা কিনব ভাবলাম সবাই। একজন গাইড ঘুরে ঘুরে আমাদের সব ভেষজ উদ্ভিদ আর মশলার গাছগুলো চেনাচ্ছিল, আর   বার করছে আর টপাটপ কত সব ভেষজ গুণে ভরা জড়িবুটি কিনছে। গাইড আমাদেরও অনেক উৎসাহিত করল কিছু কেনার জন্য। টাকে চুল গজানো থেকে শুরু করে শরীরের যে কোন অংশে লোম তোলা, যাবতীয় রোগ নিরাময় করা, বার্ধক্য রোধ করা--- সব ঔষধই মজুত ছিল সে বাগানে। গৌতমের হাতের একটা অংশে ভেষজ তেল একফোটা লাগিয়ে, লোম তুলে দিয়ে, হাতেনাতে প্রমাণও দিল। গৌতম টাকে চুল গজানোর বিষয়ে সম্ভবত আগ্রহী ছিল, কিন্তু যা সব দাম শুনলাম তাতে মাথার ফাঁক ঢাকতে গিয়ে পকেট ফাঁকা হবার যোগাড়। বাগানের ছোটো ছো্টো ছাউনির ভেতর দেখি বিদেশীরা ঐ সব দুর্মুল্য তেল দিয়ে সারা শরীর মালিশ করাচ্ছে। নেংটি পরিয়ে, সাদা চামড়াগুলোর পিঠে চটাস চটাস থাপ্পড় কষিয়ে ভালই ব্যাবসা চলছে। একজন পঞ্চাশোর্ধ সাহেব আর তার তরুণী সঙ্গিনীর ওপর দেখি একটা ছাউনিতে চলছে এরকমই পরীক্ষা নিরীক্ষা। মনে মনে ভাবলাম এই বয়সে সাহেব হয়ত মালিশ করে বয়সটাকে কিছুদিন আটকাবে; কিন্তু তার সঙ্গিনী!  অল্পবয়সীদের চামড়ায় ভেষজ বেশি তাড়াতাড়ি কাজ করবে। তখন তাকে যদি বায়ো কি তেয়ো মনে হয়? তবে যে সাহেবের পার্শ্ববর্তিনীটি নাতনি-সম ঠেকবে!
আবার যাত্রা শুরু হল। বাইরের তাপমাত্রা প্রচণ্ড বেশি হলেও বাগানে এতক্ষণ  ছায়াতে তবু ভালো ছিলাম। কিন্তু এসি গাড়িতে উঠেই ফের সকলের গরম লাগতে শুরু করল। কিছুতেই বুঝতে পারছি না কারণটা। রাস্তায় সবাই ডাব খেলাম। অনেকটা পথ তখনও বাকি। ড্রাইভার দুবার গাড়ি দাঁড় করিয়ে চেক করল ভালভাবে। বাইরে প্রায় চল্লিশ ডিগ্রীর বেশি তাপমাত্রা। সেজন্যই তো এসি গাড়ি। কিন্তু ভেতরে আমরা ঘামছি। দুপুরে রাস্তায় লাঞ্চ করে গাড়িতে উঠে গরমের জন্য আমি আর আহেল মিলে এসির ঠাণ্ডাটা ড্রাইভারের অগোচরে বাড়াতে চেয়েছিলাম খালি। তাতে কি করে উল্টো ফল হবে? পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ক্যাণ্ডি শহরের কাছাকাছি এসে গেছি।  গৌতম সেদিন খুব গরম ছিল বলে চটি পরে গাড়িতে উঠেছিল। ঐ গরমেও পিছনের সিট ফাঁকা পেয়ে পা তুলে শুয়ে অনেকক্ষণ নাক ডাকাচ্ছিল। ক্যাণ্ডি শহরে গাড়ি ঢুকতেই তড়াক করে উঠে, খালি পা সিটের তলায় ফেলে বসেই বলল, পায়ের তলায় গরম হাওয়া বইছে কেন? গরম হাওয়া শুনেই ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে পিছনে তাকিয়ে দেখে বলল, হিটারের সুইচটা কেউ অন করে দিয়েছিল। ওটা শীতকালের জন্য। সবাই মুখচাওয়া-চাওয়ি করছে, একমাত্র আমি আর আহেল ব্যাপারটা ধরতে পারলাম। চুপিচুপি এসির ঠাণ্ডা বাড়াতে গিয়ে এই কাণ্ড করেছি। দোষটা স্বীকার করলাম। সবাই মিলে গালাগাল দিল, আর ফাইন হল, খাওয়াতে হবে।   

রাজপ্রাসাদ, ক্যান্ডি

বিকেল গড়িয়ে ক্যাণ্ডি পৌঁছোলাম। এবার গন্তব্য ক্যাণ্ডির বিখ্যাত রাজপ্রাসাদ। ভিতরে আছে একটি স্বর্ণ-মন্দির, নাম শ্রী দালাদা মালিগাওয়া, যেখানে বুদ্ধের দাঁত সংরক্ষিত আছে।

ক্যাণ্ডির রাজপ্রাসাদের শিল্পকলা কোনোভাবেই প্রাচীনত্বের দিক থেকে পোলোন্নারুয়া বা অনুরাধাপুরার সঙ্গে  তুলনীয় নয়, কিন্তু তাও অনুপম
। প্রধানত কাঠ, পাথর, আর কাদামাটি দিয়ে প্রাসাদটা তৈরি। বড় বড় কাঠের ঘরগুলোর বিশাল বিশাল কাঠের দরজায় এত সূক্ষ্ম হাতির দাঁতের কারুকাজ খুব কমই দেখেছি। ঘরগুলোর ভেতরে বৌদ্ধ ও হিন্দুদের উপাসনার নানান মূর্তি রাখা আছে। সেগুলো প্রধানত মাটি, কাঠ প্রভৃতি সাধারণ সামগ্রী দিয়ে তৈরি। কিন্তু মূর্তিশিল্পের অলঙ্করণ অসাধারণ। উজ্জ্বল রঙের প্রলেপ, সোনা-রূপা-তামা ইত্যাদি নানান ধাতব পাতের ব্যবহার, হাতির দাঁতের কারুকার্য, আর সর্বোপরি নানান দামি দামি পাথরের ব্যবহার সংগ্রহশালার ঘরগুলোকে একটা নান্দনিক ছোঁয়া দিয়েছে। মূর্তি ছাড়াও ঘরগুলোতে সংরক্ষিত আছে প্রাচীন পালি ও সিংহলী ভাষার শিলালিপি, পুঁথি ইতাদি নানা সামগ্রী।



ওপরের ছাদ ও দেওয়ালে সোনার পাতের ওপর সূক্ষ্ম কাজ ও মণিমুক্তা খচিত দারুণ সুসজ্জিত সুপ্রশস্ত সুড়ঙ্গ, তার মধ্যে দিয়ে আমরা গেলাম প্রাসাদের অন্দর-মহলে।

শ্রী দালাদা মালিগাওয়া বৌদ্ধদের সেই পবিত্র মন্দির যেখানে বুদ্ধের স্মরণিকা রাখা আছে। সেই মন্দির, যা দেখার জন্য দেশ বিদেশের লোক ছুটে আসে। সেই মন্দির, যেখানে ২৫ জানুয়ারি, ১৯৯৮ এই দেশের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে তিনজন আত্মঘাতী এল টি টি ই জঙ্গি রাজপ্রাসাদের প্রবেশ পথ দিয়ে অতর্কিতে একটি ট্রাক নিয়ে ঢুকে পড়ে বোমা ছুঁড়ে পাথরের তৈরি মন্দিরের ঢোকার মুখের সবচেয়ে নিচের চাতালটি এক্কেবারে নষ্ট করে দেয়। পরে সেটিকে আবার নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। সেখানে দেখলাম একদল ড্রাম-বাদক দুপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে সুরের তালে তালে ড্রাম বাজাচ্ছে। চাতালের দ্বিতীয় ধাপে একপাশে সিংহাসনে উপবিষ্ট ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মূর্তি চারিদিক আলোকিত করে আছেন। একটু দূরে ধ্যানমগ্ন নিরাভরণ শ্বেতপাথরের বুদ্ধ বসে আছেন অপর একটি সিংহাসনে। দেখে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। বুদ্ধের এই দ্বৈত মূর্তির মাঝে চাতালের সবচেয়ে ওপরের ধাপে রাখা আছে আরেকটি সুসজ্জিত সিংহাসন। তার ওপরে  সোনার চাদরের চাঁদোয়া। সিংহাসনটির চারপাশটা সোনার তারের সূক্ষ্ম জাল দিয়ে ঘেরা। সেখানে হাতির দাঁতের কারুকার্যে ভরা একটা বিশাল গম্বুজাকৃতির সিন্দুক। তার ভিতর  আছে পরপর আরও সাতটি সিন্দুক। সবচেয়ে ভিতরের সোনার সিন্দুকটাতে রাখা আছে বুদ্ধের দাঁতের সেই অমূল্য স্মৃতি-স্মারক। এই সিংহাসনটির শোভা একশো গুণ বাড়িয়েছে দুপাশে ঝুলে থাকা দুটি বিশাল গজদন্ত। দেয়ালে ত্রিপিটকের লিপি সমন্বিত প্রাচীন তালপাতা মন্দিরটার ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তুলেছে।

শ্রী দালাদা মালিগাওয়া, ক্যান্ডি

     বুদ্ধের পরিনির্বাণ লাভের পর তাঁর দাঁতের স্মরণিকা নিয়ে একটা ইতিহাস আছে। তিনি খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৫৪৩ সালে দেহত্যাগ করেন। বর্তমান বিহার রাজ্যের অন্তর্গত কুশিনগরে তাঁকে দাহ করা হয়। তাঁর শিষ্যা খেমা চিতা-ভস্ম থেকে তাঁর বাঁদিকের মাড়ির আক্কেল দাঁত সংগ্রহ করেন। তিনি এই স্মরণিকাটির যথাযথ সম্মান প্রদানের জন্য শ্রদ্ধাপূর্বক রাজা ব্রহ্মদত্তকে নিবেদন করেন। রাজা এটিকে দন্তপুরীর (বর্তমানে উড়িষ্যার পুরী) মন্দিরে সংরক্ষিত রাখেন। ধীরে ধীরে একটা ধারণা জন্মায়, যে এই স্মরণিকার অধিকারী হবে  সে-ই রাজ্য শাসনের ঐশ্বরিক ক্ষমতা অর্জন করবে। বুদ্ধের মৃত্যুর আটশো বছর পর কলিঙ্গের রাজা গুহশিব  এবং ক্ষত্রিয় পাণ্ডুর মধ্যে এই স্মারণিকাটির অধিকার নিয়ে যুদ্ধ বাধে। দাতাবংশ থেকে তা জানা যায়। শোনা যায় গুহশিবের কন্যা হেমমালা ও তার স্বামী এই স্মরণিকাটি রক্ষা করার জন্য শ্রীলঙ্কায় নিয়ে আসেন কীর্তি শ্রী মেঘাবন্নের রাজত্বকালে (৩০১-৩২৮ খ্রিস্টাব্দ)। ক্রমান্বয়ে বছরের পর বছর এই স্মরণিকাটি করায়ত্ত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজার মধ্যে চলেছে রাজনৈতিক লড়াই। বুদ্ধের পবিত্র দাঁতের পরিক্রমণের সে ইতিহাস আজ নাই বা বিবৃত করলাম; কিন্তু এটুকু জানিয়ে রাখি, যিনি যখনই এই স্মরণিকাটি অর্জন করতে পেরেছেন, তিনি তখনই সেটার ওপর অভিভাবকত্ব দেখিয়েছেন, আধিপত্য করেছেন এবং সেটা সযত্নে সসম্মানে রেখেছেন। এটির জন্য মন্দির তৈরি হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনায়। শ্রীলঙ্কাতে প্রথমে তা ছিল অনুরাধাপুরার ইসুরুমুনিয়াতে যার কথা আগে লিখেছি। পোলোন্নারুয়া ও অনুরাধাপুরার আরো একাধিক চৈত্যে তা রক্ষিত ছিল, তাদের ভগ্নাবশেষ আমরা দেখেছি বিখ্যাত বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী ফাহিয়েন ও হিউ এন সাঙ অনুরাধাপুরাতে এই পবিত্র স্মরণিকা দেখেছিলেন ও সে সম্পর্কে দীর্ঘ বর্ণনা লিখে গেছেন।


বর্তমানে ক্যাণ্ডির এই প্রাসাদ-মন্দিরে মালওয়াত্তে ও অসগিরিয়া এই দুই মহাবিহারের দু দল বৌদ্ধ ভিক্ষু দিনে তিনবার অর্থাৎ সকালে, দুপুরে ও সন্ধ্যায় এই পবিত্র স্মৃতি চিহ্নটির পূজার্চনা করেন মন্দিরের অন্দর কক্ষে। প্রতি বুধবার স্নান করান সুগন্ধি জলে ভেষজ মিশিয়ে। তারপর সেই জল বিতরণ করা হয় উপস্থিত ভক্তদের মধ্যে। বছরে একবার জুলাই মাসে এই স্মরণিকা নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা হয় ও তাতে বহু বিদেশীসহ অনেক সাধারণ মানুষ  যোগদান করেন।


এখান থেকে আমরা গেলাম কাউন্সিল অফ চেম্বার বা রাজার মন্ত্রণালয় দেখতে যেখানে ক্যাণ্ডির রাজা মন্ত্রীদের নিয়ে সভা করতেন। তারপর একটা বিশাল লেকের ধার দিয়ে গিয়ে পাহাড়ের উপর অনেকটা উঠে আমাদের হোটেলটা পেলাম। প্রাকৃতিকভাবে শহরটা খুব সুন্দর। জায়গাটা তিনদিক পর্বত দিয়ে ঘেরা একটা উপত্যকায়। অতীতে চারদিকের ঘন বনভূমি আর পর্বত স্থানটাকে শত্রুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখত। শহরের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক দিয়ে বয়ে গেছে দেশটির দীর্ঘতম নদী মহাবলি। ভৌগোলিক দিক দিয়ে তাই শহরটার চারপাশের সীমানায় প্রাকৃতিক বাধা বা দুর্গ অনেকগুলো, যেমন- গিরিদুর্গ, বনদুর্গ, জলদুর্গ ও পঙ্কদুর্গ। প্রথম তিনটে দুর্গের কথা একটু আগেই লিখেছি। খালি পঙ্কদুর্গটা বলা বাকি। এখানে শহরটার চারদিকের বিশাল বিশাল জলাভূমির কথা বলা হয়েছে। ক্যাণ্ডির শেষ স্বাধীন রাজা বিক্রমরাজা সিংহের ইচ্ছা অনুযায়ী, এই রাজধানী শহরটাকে স্বর্গতুল্য করতে গিয়ে প্রাসাদের সামনের বিস্তীর্ণ কৃষিজমিকে এক বিশাল দিঘিতে পরিণত করা হয়। তাঁরই ইচ্ছা অনুযায়ী প্রাসাদের সামনের সেই দিঘিতে নীল আকাশের মেঘেদের ছায়া, আর চারপাশের গিরিশ্রেণি, বনরাজি--- সত্যিই শহরটাকে একদিন নৈসর্গিক শোভা দিয়েছিল। এখন এই ছোট্ট শহরটা হোটেল আর মনিহারী দোকান-বাজারে ভর্তি। প্রচুর বিদেশীদেরও ভিড় এখানে। সেদিন সবাই কিছুকিছু কেনাকাটা করলাম উঁচু পাঁচিলে ঘেরা দিঘিটার ধারে আমি আর গৌতম খানিক হাঁটলাম পরে একটা বড় হোটেলে জমিয়ে গল্পগুজব করতে করতে রাতের খাওয়া সারলাম।

 

পরদিন রওনা দিলাম নুয়ারা এলিয়া অর্থাৎ আলোর শহরের দিকে, আরও দক্ষিণে পার্বত্য প্রদেশে। এই পাহাড়ি অঞ্চলটি চা চাষের জন্য সবচেয়ে অনুকূল। আমরা পথে এখানকার সবচেয়ে বড় টি এস্টেটগুলোর একটাতে ঢুকেছিলাম। সুন্দর সুন্দর মোড়কে চা রাখা বিদেশে রপ্তানির জন্য। আমরা সবাই চা কিনলামও। ক্যাণ্ডি এবং নুয়ারা এলিয়া, দুটোই পাহাড়ি এলাকায় বলে আবহাওয়াটা মনোরম। এই জায়গাটাকে বলে লিটল ইংল্যান্ড। সেখানে পাহাড়ের ঢালে সুন্দর একটা লেকের ধারে আমরা বেশ অনেকক্ষণ কাটালাম। লেকটার নাম লেক গ্রেগরি, জলে অনেক পর্যটক বোটিং, ওয়াটার স্কুটারিং করছে। লেকের সামনের  সাজানো বাগানে বসে ওগুলো দেখে সময় কাটছিল ভালই। হঠাৎ দেখি  অনির্বাণ আর ঝুলনের মধ্যে কী নিয়ে যেন তর্কাতর্কি হচ্ছে। ঝুলন চাইছে ওয়াটার স্কুটারে চড়তে, আর অনির্বাণ একেবারেই নারাজ। বলছে, এই বয়সে বউ হারাতে ও কোনমতেই রাজি নয়।
লেক গ্রেগরি, নুয়ারা এলিয়া

ওখান থেকে বেরিয়ে আমরা আরও দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের দিকে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য হিক্কাদুয়ার সমুদ্র-সৈকত। পথে একটা দারুণ ঝর্ণা পড়ল। একটানা অনেকটা পথ বলে ড্রাইভার দুবার গাড়ি দাঁড় করাল। একবার হাইওয়ের ওপর একটা পেট্রল-পাম্পের কাছে যখন দাঁড়াল, পাশেই এয়ার কন্ডিশানড সুপার মার্কেটে দেখলাম অসাধারণ সব খোদাই করা কাঠের ঘর সাজানোর জিনিসপত্র। অন্তত একটা কারুকার্য করা কাঠের হাতি ওদেশ থেকে আনার বড়ই শখ ছিল। কিন্তু অস্বাভাবিক দাম, তাই আর কেনা হয়নি।


(সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকার ১৪২৪ সালের উৎসব সংখ্যায় প্রকাশিত)












No comments:

Post a Comment