কলকাতায় সি ভি রামন
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
সন্ধ্যাবেলা বৌবাজার স্ট্রিট আর কলেজ স্ট্রিট জংশনে ট্রাম থেকে নেমে এলেন এক দীর্ঘদেহী দক্ষিণ ভারতীয় তরুণ। সকালে তিনি অফিস যাওয়ার সময় ট্রাম থেকেই দেখেছিলেন একটা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। অল্পদিন তিনি কলকাতায় এসেছেন, তাঁর
স্কট লেনের ভাড়াবাড়ির থেকে বেশি দূরে নয় জায়গাটা। ২১০ নম্বর বৌবাজার (বর্তমানে
বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী) স্ট্রিটের বাড়িটার দরজা তাঁর জন্য খুলে দিলেন আশুবাবু, আশুতোষ
দে। তাঁকে নিয়ে গেলেন অমৃতলাল সরকারের কাছে। আগন্তুক কোনো রকম ভূমিকা না করেই
জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাইরে লেখা আছে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স। কিন্তু ভিতরে তো কাউকে কাজ করতে দেখলাম না। এখানে
কী হয়?’
সালটা ছিল ১৯০৭। এভাবেই চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন ও ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের যোগাযোগের সূচনা, যে
যোগাযোগ বজায় থাকবে সাতাশ বছর। ১৮৭৬ সালে অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। ভারতীয়দের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার উদ্দেশ্য নিয়ে
শুরু হলেও অর্থাভাবে সে কাজ বিশেষ এগোয়নি। শুধুমাত্র বিজ্ঞান বিষয়ক কিছু বক্তৃতার
মধ্যে তা সীমাবদ্ধ ছিল। সেই হতাশা নিয়েই মহেন্দ্রলাল মারা যান ১৯০৪ সালে। তার তিন বছর পরে তাঁর ছেলে অমৃতলাল রামনকে
অ্যাসোসিয়েশনের ল্যাবরেটরি ব্যবহারের সাদর অনুমতি দিলেন। আরো একুশ বছর পরে রামন
মহেন্দ্রলালের স্বপ্নকে পূরণ করবেন। কলকাতা বাসের এই সময়টাকে রামন মনে করতেন তাঁর
জীবনের স্বর্ণযুগ।
রমানাথন চন্দ্রশেখরন আয়ার ও পার্বতী
আম্মালের দ্বিতীয় পুত্র চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন বা সি ভি রামনের জন্ম ১৮৮৮ সালের ৭
নভেম্বর। ১৮৯২ সালে চন্দ্রশেখরন বিশাখাপত্তনমে এক কলেজে বিজ্ঞান পড়ানো শুরু করেন।
সেখানেই রামনের শিক্ষাজীবনের শুরু। মাত্র এগারো বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাস করলেন রামন। বাবার
কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। মাদ্রাজে
সে সময় বিজ্ঞানেও বি এ ডিগ্রিই দেওয়া হত। রামন ছিলেন কলেজের সর্বকালের কনিষ্ঠতম ছাত্র। ১৯০৪ সালে বিএ এবং ১৯০৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে এমএ, দুটি
পরীক্ষাতেই প্রথম। ইতিমধ্যে রামন ছাপিয়ে ফেলেছেন তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র।
আলোকবিজ্ঞানের উপরে তাঁর সেই কাজ প্রকাশিত হল লন্ডনের ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে,
রামনের বয়স তখনো আঠারো হয়নি। পরীক্ষা দিলেন সরকারের ফিনান্সিয়াল সিভিল সার্ভিসে। এবারেও
প্রথম। এই সময়েই রামনের বিয়ে। দক্ষিণভারতীয় ব্রাহ্মণ সামাজিক রীতি নানাভাবে ভেঙেছিলেন রামন। নিজে পছন্দ
করেছিলেন তাঁর স্ত্রী লোকসুন্দরী আম্মালকে। ব্রাহ্মণ হলেও লোকসুন্দরীরা ছিলেন অন্য
গোষ্ঠীর। সর্বোপরি কোনো রকম পণ নিতে অস্বীকার করেছিলেন
রামন।
ফিনান্সিয়াল সার্ভিসে রামনের প্রথম চাকরিস্থল
হল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা। কয়েক বছর পরেই কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরিত হবে। সেই সময় রামন যদি কাজ শুরু
করতেন, তাহলে তাঁর প্রথম পোস্টিং কলকাতাতে
হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মস্থান কলকাতা; রামনের সঙ্গে সেই শহরের যোগাযোগ রামন এবং ভারতের বিজ্ঞান দুপক্ষেরই প্রয়োজন ছিল।
গবেষণা শুরু করলেন রামন। সোমবার থেকে শনিবার প্রতিদিন
নিয়ম করে সকাল সাড়ে পাঁচটায় তিনি অ্যাসোসিয়েশনে যেতেন। পৌনে দশটায় বাড়ি ফিরতেন, কোনোরকমে চান খাওয়া সেরে ট্যাক্সি ধরে অফিস। অফিস থেকে পাঁচটায় বেরিয়ে
সোজা অ্যাসোসিয়েশন। রাত সাড়ে নটা থেকে দশটায় বাড়ি। রবিবার সারা দিন অ্যাসোসিয়েশন। গবেষণার সঙ্গী সহকারী
শুধুমাত্র আশুবাবু। গবেষণা শুরু করেছিলেন স্বনবিদ্যা বা শব্দবিজ্ঞান বিষয়ে। রামনের পরিবারে সঙ্গীতের চল
ছিল, তাঁর বাবা বেহালা বাজাতেন। ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের উপর
রামন অত্যন্ত মৌলিক কাজ করেছিলেন। রামনের উৎসাহে এমনকি কোনোদিন কলেজের চৌকাঠ না
পেরোনো আশুবাবুও একা গবেষণাপত্র ছাপিয়েছিলেন ব্রিটেনের প্রসিডিংস অফ দি রয়্যাল
সোসাইটিতে।
২১০ বৌবাজার স্ট্রিটের সেই বাড়ি
দেখতে দেখতে চলে গেল প্রায় সাত বছর। ইতিমধ্যে
অল্পদিনের জন্য রেঙ্গুন ও নাগপুরে বদলি হয়েছিলেন, গবেষণাতে অসুবিধা হয়েছিল। তবে
সেই বদলি নিতান্তই অল্পদিনের জন্য, আবার কলকাতাতে ফিরে এসেছেন। ইতিমধ্যে রামনের
জীবনে আর এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এলো। সেই কথা আলোচনার আগে কলকাতায় উচ্চশিক্ষার সেযুগের
পরিস্থিতি জেনে নেওয়া জরুরি।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন ১৯০৬ সালে, তারপরেই
বিশ্ববিদ্যালয়ে আটটি বিষয়ে এম এ পড়ানো শুরু করেছেন। এর আগে পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়ানো হত না, শুধুমাত্র ডিগ্রি দেওয়া হত। কলকাতায় সে সময় এমএসসি পড়ানো হত শুধু
প্রেসিডেন্সি কলেজে, ১৮৮৪ সালে তা শুরু হয়েছিল। আশুতোষের ইচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়ানো ও গবেষণা শুরু করবেন। কিন্তু বিদেশী সরকার তাঁকে এর জন্য কোনো সাহায্য করতে রাজি নয়। ভারতীয়দের বিজ্ঞান শিখিয়ে বিদেশী তাদের লাভ কী? শুধু বিজ্ঞান নয়, যে সব শিক্ষা শাসিতদের প্রশ্ন করতে শেখায়, ভাবতে শেখায় -- তা বিদেশী শাসনের পক্ষে বিপজ্জনক।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ইংরাজদের
স্কুলকলেজের বাইরে জাতীয় শিক্ষার জন্য অনেকেই সাহায্য করছিলেন, আশুতোষ তাঁদের কাছে
গেলেন। ব্যারিস্টার স্যার
তারকনাথ পালিত প্রায় সমস্ত সম্পত্তি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করলেন। এর পরিমাণ
হল সাড়ে চোদ্দ লক্ষ টাকা ও বালিগঞ্জে তাঁর নিজের বাড়ি। অন্য এক ব্যারিস্টার, স্যার রাসবিহারী ঘোষ, দুবারে মোট সাড়ে একুশ লক্ষ টাকা
দান করেছিলেন। সেদিনের এক টাকা আজকের
প্রায় পাঁচশো টাকার সমান। অর্থাৎ দুজনে মিলে আজকের হিসাবে একশো পঁচাত্তর কোটি
টাকার বেশি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছিলেন। সেই দানেই শুরু হল
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান কলেজ। প্রথমেই যে কটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা
হল, তার মধ্যে ছিল পদার্থবিজ্ঞান। রাজাবাজারে পালিতের বাগানবাড়িতে তৈরি হল কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজ। ঠিকানা ৯২ আপার সার্কুলার (বর্তমানে আচার্য
প্রফুল্লচন্দ্র) রোড। ২৭ মার্চ ১৯১৪ তার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন আশুতোষ। ১৯১৬
সালের ১ জুলাই পদার্থবিদ্যা বিভাগে পঠনপাঠন শুরু হয়।
আপার সার্কুলার রোডে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজ
পালিত ও ঘোষের শর্ত ছিল তাঁদের দানের
টাকায় কয়েকটি অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করতে হবে। সেই মতো অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ের
সঙ্গে সঙ্গে পদার্থবিদ্যা বিভাগে পালিত অধ্যাপক এবং ঘোষ অধ্যাপক পদ সৃষ্টি হয়। তাঁদের
দানের শর্ত অনুযায়ী এই পদের অধ্যাপকদের ভারতীয় হতেই হবে। মাত্র কয়েক বছর আগে
স্বামী বিবেকানন্দের প্রেরণায় জামসেদজী টাটার উৎসাহে বাঙ্গালোরে তৈরি হয়েছিল
ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স। কিন্তু প্রথম দিকে সেখানে ইংল্যান্ড থেকে আসা
দ্বিতীয় শ্রেণির বিজ্ঞানীরাই মূলত চাকরি পেয়েছিল, তার ফলে সেখানে গবেষণার মান ছিল
খুবই নিচু। ভারতীয় অধ্যাপকরা যাতে বিশ্বমানের গবেষণা করতে পারেন, সে জন্য চাকরি
পাওয়ার পরে প্রয়োজনে বিদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দু’বছর গবেষণা করার কথা দানের
শর্তে ছিল। তাঁরা সেজন্য সবেতন ছুটি পেতেন। এছাড়া বিভিন্ন বিভাগে কয়েকটি গবেষক বা
রিসার্চ ফেলোর পদ চালু করা হয়।
১৯১৪ সালের ২৪শে জানুয়ারি পালিত গভর্নিং বডির সভাতে পদার্থবিজ্ঞানে সি ভি রামন
এবং রসায়নে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে পালিত অধ্যাপকের পদে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত
নেওয়া হয়। সেই সভাতে সদস্য ছিলেন উপাচার্য স্যার আশুতোষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার
পি ব্রুল, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, ডাক্তার নীলরতন সরকার, রেভারেন্ড জে ওয়াট,
বিচারপতি বি কে মল্লিক এবং লর্ড সত্যপ্রসন্ন সিনহা। সেই দিনই কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট এক সভায় এই নিয়োগে সম্মতি দেয়। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি
সেনেটে কয়েকজন ইউরোপীয় সদস্য নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি তোলেন। ফলে ভোটাভুটি হয়,
ভোটে আশুতোষের প্রস্তাব জেতে। আশুতোষের ইচ্ছা ছিল জগদীশচন্দ্রকে পদার্থবিজ্ঞানে
অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা, কিন্তু তিনি রাজি হননি।
একা একা আংশিক সময়ে খুব সামান্য পরিকাঠামোর মধ্যে গবেষণা করেও রামন যথেষ্ট পরিচিতি
লাভ করেছিলেন, না হলে আশুতোষের চোখ তাঁর উপরে পড়ত না। তখনই রামন মোট বাইশটা গবেষণা
পত্র প্রকাশ করেছেন, যার মধ্যে ষোলটা বিদেশের সেরা জার্নালগুলিতে। ঠিক আগের বছর
মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে গবেষণার জন্য বিশেষ পুরস্কার দিয়েছে। আশুতোষ অবশ্য
অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, আগে তিনি গণিত বিষয়ে বেশ কয়েকবার সেখানে
বক্তৃতা দিয়েছেন। সেই সূত্রেই রামনের নাম তাঁর কাছে অপরিচিত ছিল না। সেনেটে তাঁর
নিয়োগের পক্ষে জোর সওয়াল করেছিলেন আশুতোষ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো
মহেন্দ্রনাথ রায়।
রামন যে চাকরি করতেন, তাঁর মাইনে বেড়ে দাঁড়াত
মাসে দুহাজার টাকা। পালিত অধ্যাপকের পদে পাবেন আটশো টাকা, বাড়িভাড়া বাবদ আরো দু’শো টাকা। শুধু তাই নয়, মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই রামনের সাফল্যে সবাই নিশ্চিত ছিলেন যে
এক সময় তিনি ফিনান্সিয়াল সার্ভিসে শীর্ষস্থানে উঠবেন এবং ভাইসরয়ের কাউন্সিলের
সদস্য হবেন। কোনো ভারতীয়ের পক্ষে সরকারি স্তরে তা ছিল সর্বোচ্চ সম্মান। রামন অধ্যাপক পদে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে সামান্যও দ্বিধা করেননি, শুধু বলেছিলেন যে দেশের বাইরে দু’বছর গবেষণার শর্ত তুলে না
নিলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে যোগ দিতে পারবেন না। তাছাড়া তিনি জানতে
চেয়েছিলেন যে পড়ানো তাঁর পক্ষে বাধ্যতামূলক কিনা। বিশ্ববিদ্যালয় জানায় যে তাঁর জন্য বিদেশে গবেষণা
বা ক্লাস নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। সরকারি চাকরি ছেড়ে আসার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের
অনুমতি লেগেছিল, তা পাওয়ার পরে ১৯১৭ সালের ২ জুলাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
চিঠিতে যাই লিখুন, রামন প্রথম থেকেই ইলেকট্রন তত্ত্বের উপর ক্লাস নিয়েছিলেন। তবে
সবসময়ই তাঁর গবেষণার প্রধান জায়গা ছিল অ্যাসোসিয়েশন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পরে রামন পুরোপুরি গবেষণাতে মন দিতে পারলেন।
অবশ্য ভারতবর্ষের নানা জায়গায় পড়ানো, বিদেশে কনফারেন্সে যোগদান ও ল্যাবরেটরি
পরিদর্শন, বিভিন্ন সরকারি কমিটিতে অংশগ্রহণ ছাড়াও বিভাগীয় প্রধান হিসাবে তাঁকে
অনেক দায়িত্ব পালন করতে হত। ১৯৩৩ সালের ১ এপ্রিল রামন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে
যান। তিনি বাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের ডাইরেক্টর হিসাবে যোগ
দেন। মাঝের ষোল বছর তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রামনের জীবন একেবারে মসৃণ ছিল তা
নয়। অর্থবরাদ্দের সীমাবদ্ধতার জন্য সকল অধ্যাপকের গবেষণাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। সে
সময় পদার্থবিদ্যা বিভাগে একই সঙ্গে তিন নক্ষত্র বিরাজ করতেন। রামন বিভাগে যোগদান
করার আগে থেকেই সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা দুজনেই ছিলেন পালিত অধ্যাপকের
সহকারী। তবে তাঁরা কখনোই রামনের সঙ্গে কোনো গবেষণা করেন নি, রামনও কোনোদিন তাঁদের এই
নিয়ে কিছু বলেন নি। সত্যেন্দ্রনাথ ১৯২১ সালে ঢাকা চলে যান, তিনি যখন কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন তার অনেক আগেই রামন কলকাতা ছেড়েছেন। রামনের সঙ্গে
সত্যেন্দ্রনাথের বিশেষ কোনো মনোমালিন্য ছিল না। বয়সে তরুণ হলেও মেঘনাদ তাঁর সাহা
সমীকরণের জন্য রামনের আগেই বিশ্বখ্যাতি লাভ করেন। ১৯২১ সালে তিনি পদার্থবিদ্যা
বিভাগে খয়রা অধ্যাপক পদে যোগ দেন। বিশেষ করে গবেষণার সুযোগসুবিধা নিয়ে তাঁর সঙ্গে
রামনের বারবার বিরোধ বেঁধেছিল। সেই বিবাদে আশুতোষকে বা তৎকালীন উপাচার্যকে
মধ্যস্থতা করতে হয়েছিল। তামিল ব্রাহ্মণ রামনের হিমালয়প্রমাণ অহং এবং সমাজের
নিচুস্তর থেকে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় উঠে আসা মেঘনাদের স্বাভিমানকে মেলানোর কোনো জায়গা
খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। শেষ পর্যন্ত গবেষণার সুযোগের অভাবে মেঘনাদ ১৯২৩ সালে
কলকাতা ছেড়ে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। রামন কলকাতা ছাড়ার কয়েক বছর পরে তিনি
ফিরে আসেন।
রামন প্রধানত আলো ও শব্দ বিষয়ে গবেষণা করতেন। সারা দেশ থেকে তাঁর কাছে বহু
ছাত্র গবেষণার জন্য আসত। তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিশিরকুমার
মিত্র, বিধুভূষণ রায়, ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ, ব্রজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুকুমারচন্দ্র সরকার। তাঁর অন্য ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
হলেন কে আর রমানাথন, কে এস কৃষ্ণন, এল এ রামদাস প্রমুখ। রমানাথন আমেদাবাদের
ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রথম অধিকর্তা হয়েছিলেন। কৃষ্ণন হয়েছিলেন দিল্লীর
ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরির প্রথম অধিকর্তা। বেশ কয়েকবার ইউরোপ ও আমেরিকাতে যান রামন, রামন
এফেক্ট আবিষ্কারের আগেই তিনি সেখানকার বিজ্ঞানী মহলে বিশেষ সমাদর লাভ করেছিলেন।
বিদেশ থেকে বিজ্ঞানীরা ভারতে এলে তাঁর সঙ্গে অবশ্যই দেখা করতেন।
বিজ্ঞান কলেজে রক্ষিত রামনের পিয়ানো
রামনের গবেষণার পরিচয় দেয়া এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, আমরা শুধু রামন এফেক্ট বা
রামন ক্রিয়া আবিষ্কারের ইতিহাসের কথা সংক্ষেপে দেখব। কাল্টিভেশনের ল্যাবরেটরিতে
তিনি তাঁর নামাঙ্কিত এফেক্টকে চিহ্নিত করেছিলেন। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন কে
এস কৃষ্ণন। ১৯২১ সালে প্রথমবার ইউরোপ যাত্রা করেন রামন। ফেরার সময় জাহাজ থেকে সমুদ্রের জল দেখে তাঁর মনে
প্রশ্ন জাগে সমুদ্র নীল কেন? আকাশের রঙ কেন নীল তার কারণ বায়ুমণ্ডল কর্তৃক আলোর
বিচ্ছুরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন লর্ড র্যালে।
তিনি বলেছিলেন যে সমুদ্রের রঙ আসলে আকাশের রঙের প্রতিফলন। নানাভাবে রামন নিশ্চিত
হলেন তা নয়। তিনি দেখালেন যে সমুদ্রের জল নিজেই আলোকে বিচ্ছুরণ
করে বলেই সমুদ্রের জলের রঙ নীল। এর পর থেকে তিনি আলোর বিচ্ছুরণ নিয়ে আগ্রহী হয়ে
পড়েন।
দু বছর পরে রামন ও তাঁর ছাত্র রমানাথন জল ও অ্যালকোহল
কর্তৃক আলোর বিচ্ছুরণ সংক্রান্ত পরীক্ষানিরীক্ষার সময় এক নতুন রঙের আলোর খুব ক্ষীণ
চিহ্ন দেখতে পান। এর উৎস তাঁরা বুঝতে পারেন নি, ভেবেছিলেন যে তাঁদের ব্যবহৃত
স্যাম্পল হয়তো যথেষ্ট বিশুদ্ধ নয়।
প্রসঙ্গত বলে রাখি যে আলো হল
তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ, বিভিন্ন রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা। ১৯২৫ সালে কৃষ্ণনও
একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। ১৯২৭ সালে অপর এক ছাত্র ভেঙ্কটেশ্বরন দেখেন যে গ্লিসারিন
কর্তৃক বিচ্ছুরিত সূর্যের আলোর রঙ হওয়া উচিত ছিল নীল, কিন্তু তা হয়েছে সবুজ। রামন
বুঝতে পারেন যে তিনি এক বিরাট আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি এসে গেছেন। কৃষ্ণনকে তিনি
পরীক্ষা শুরু করতে নির্দেশ দেন। সেটা ছিল ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ২৮
ফেব্রুয়ারি বোঝা গেল যে বিচ্ছুরিত আলোতে এক নতুন রঙের আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে।
আবিষ্কৃত হল রামন এফেক্ট। পাঁচ বছর আগে অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী অ্যাডলফ স্মেকাল
তাত্ত্বিকভাবে এই নতুন রঙের আলোর কথা ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। কোয়ান্টম তত্ত্ব থেকে
রামন এফেক্টকে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু সেই সময় এই ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করা
মোটেই সহজ ছিল না। রামন এফেক্ট এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে আবিষ্কারের দু বছরের মধ্যেই
তার উপর দুশোর বেশি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছিল।
রামন ও রামন এফেক্ট আবিষ্কারে
ব্যবহৃত বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র
রামন প্রথম থেকেই তাঁর আবিষ্কারের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি পরের দিনই অর্থাৎ ২৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতার
স্টেটসম্যান খবরের কাগজে এই আবিষ্কারের খবর প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ৮ মার্চ রামন নেচার পত্রিকায় তাঁর আবিষ্কারের বিষয়ে এককভাবে গবেষণা পত্র পাঠান।
৩১ মার্চ তা প্রকাশিত হয়। তিনি বিদেশী
বিজ্ঞানীদের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করেছিলেন। সুইডেনের নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী মানে
সিগবান এবং জার্মান বিজ্ঞানী আর্নল্ড সমারফেল্ড তাঁর গবেষণার প্রশংসা করে চিঠি
দিয়েছিলেন। রামনের এই দ্রুততার প্রয়োজন ছিল, কারণ মে মাসেই দুই সোভিয়েত বিজ্ঞানী
মেন্ডেলশাম ও ল্যান্ডসবার্গ এই বিষয়ে তাদের গবেষণা প্রকাশ করেন। তাঁরা এমনকি রামনের
আগেই এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাতে অবশ্য রামনের কৃতিত্ব বিন্দুমাত্র খাটো হয়
না। রামন তাঁদের গবেষণার বিষয় জানতেন না। সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা যদি তাঁদের কাজের
গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকতেন ও তাঁদের পরীক্ষার ফল বিষয়ে নিশ্চিত হতেন, তাহলে
তাঁরা নিশ্চয় আরো আগেই গবেষণাপত্র প্রকাশ করতেন। রামনকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত
করার সময় নোবেল কমিটি এই নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন, কাজেই রামনই যে পুরস্কারের
যোগ্য প্রাপক তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮ স্টেটসম্যান
পত্রিকাতে প্রকাশিত সংবাদ
রামন এফেক্ট ব্যবহার করলে বিশ্লেষণের সময় নমুনার কোনো ক্ষতি হয় না। তাই
রাসয়ানিক বা গঠন বিশ্লেষণের সময় রামন এফেক্টের কার্যকারিতা দিন দিন বেড়েই
চলেছে। লেজার আবিষ্কারের পরে লেজার রামন
বিশ্লেষণ আরো নানা জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
রসায়ন শিল্পে, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে, ভূতত্ত্বে, ঔষধ শিল্পে। জীববিদ্যা,
ইলেকট্রনিক্স – কত জায়গায় যে রামন এফেক্ট কাজে লাগছে তা লিখে শেষ করা যাবে না।
১৯৩০ সালে রামন নোবেল পুরস্কার পান, এশিয়ার প্রথম বিজ্ঞানী যিনি এই সম্মান লাভ
করেছিলেন। পুরস্কারের প্রস্তাবক ছিলেন দশজন বিজ্ঞানী। তাঁদের মধ্যে ছিলে
ছ’জন নোবেলজয়ী -- নিলস বোর, আর্নেস্ট
রাদারফোর্ড, লুই দ ব্রয়লি, জোহানেস স্টার্ক, চার্লস উইলসন ও জাঁ পেরিন। রামন
নোবেল পুরস্কার নিতে রওনা হন ১৯৩০ সালের ২১শে নভেম্বর, সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি
ঘোষণা করেছিল।
২১০ নম্বর বৌবাজার স্ট্রিটের বাড়িটা আর নেই, সেখানে তৈরি হয়েছে গোয়েঙ্কা কলেজ।
কাল্টিভেশন স্থানান্তরিত হয়ে চলে গেছে যাদবপুরে। তা এখন কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত
প্রতিষ্ঠান। বাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের অধিকর্তা হওয়ার ডাক
পেয়ে রামন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছিলেন
নিজের ইচ্ছায়, কিন্তু অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিচ্ছেদ খুব সুখের হয়নি।
সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে এই লেখা অনেক দীর্ঘ হয়ে পড়বে। শুধুমাত্র এটুকু বলাই
যথেষ্ট যে সেই ইতিহাস রামন বা কলকাতার শিক্ষামহলের তৎকালীন নেতৃত্ব, কারোর পক্ষেই গৌরবের
নয়। আরো ছত্রিশ বছর বাঁচলেও একবার কলকাতা
ছাড়ার পরে রামন আর কোনোদিন কলকাতায় পদার্পণ করেননি।
প্রকাশঃ সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনা পত্রিকার শারদীয় সংখ্যা, ১৪২৫, পরিমার্জিত
খুব ভালো।
ReplyDeleteখুব সুন্দর . বেশ ভাল লাগলো..ধন্যবাদ.
ReplyDeleteThanks. It was highly interesting
ReplyDeleteখুব মূল্যবান তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। সবারই পড়া উচিত।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো, স্যার। পড়ে সমৃদ্ধ হলাম 🙏
ReplyDeleteখুবই ভালো লেখা I ভারতীয় বিজ্ঞানের এক স্বর্ণযুগের সম্পর্কে এই লেখা নিঃসন্দেহে গবেষণার ক্ষেত্রে আরও বেশি করে নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করুক I
ReplyDelete..so Raman effect' s applicarion spreading the " all sky "...for being friendly with the reactants...Goutam gave a panoromic view of R E...in his " camera obscura"...
ReplyDelete