বোধবিজ্ঞান – কগনেটিভ সায়েন্স-এর একটি পর্যালোচনা
লেখক: শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
প্রকাশক: সাহিত্য সংসদ
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০২৫
মূল্য: ৩০০ টাকা
বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলে, নানা ধারায় সে ভাগ হয়ে নতুন নতুন বিষয়ের জন্ম দেয়। মধ্যযুগে যার নাম ছিল ন্যাচারাল ফিলোসফি বা প্রাকৃতিক দর্শন, তা পরবর্তীকালে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা জীববিদ্যা ইত্যাদি শাখাতে বিভক্ত হয়েছে। প্রতিটি শাখা আবার নানা উপশাখার জন্ম দিয়েছে। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের আর এক নতুন চরিত্রের বিকাশ আমরা প্রত্যক্ষ করছি দেখছি নানা শাখা এসে এক জায়গায় মিলে সম্পূর্ণ নতুন এক ক্ষেত্রের জন্ম দিচ্ছে। তেমনই এক নতুন বিষয় হল বোধবিজ্ঞান বা কগনেটিভ সায়েন্স, যেখানে এসে মিলেছে কম্পিউটার বিজ্ঞান, তথ্যবিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মনোবিদ্যা, নৃবিজ্ঞান সহ আরো নানা আপাত-সম্পর্কহীন বিষয়। আমার সীমিত জ্ঞানে এই বিষয়ে সাধারণের জন্য লেখা কোনো বইয়ের কথা আমার জানা নেই। জ্ঞানচর্চার এই অপেক্ষাকৃত নবীন ক্ষেত্রটি নিয়ে বাংলা ভাষাতে বই প্রকাশ করার জন্য লেখক ও প্রকাশককে ধন্যবাদ জানাই।
আমাদের মস্তিষ্ক সম্পর্কে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে, তা সত্ত্বেও অনেক কিছুই এখনো আমাদের অজানা থেকে গেছে। যন্ত্র বা 'মনুষ্যেতর' প্রাণীর ক্ষেত্রে যেভাবে ব্যবচ্ছেদ করে অনুসন্ধান করা যায়, মানব মস্তিষ্কের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। অবশ্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও ব্যবচ্ছেদ নিয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন উঠেছে, এবং তা মোটেই তুচ্ছ নয়। মস্তিষ্ক সম্পর্কে গবেষণা, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্যবিজ্ঞান, এই তিনের মিলনে আধুনিক বোধবিজ্ঞানের জন্ম। ক্ষেত্রটি নতুন বলেই সূচনাতে লেখক তিনটি অধ্যায় বোধবিজ্ঞান কী, এবং তার উৎস কোথা থেকে তা নিয়ে ব্যয় করেছেন। শুরুর কাজ চালানোর জন্য তিনি বোধবিজ্ঞান সম্পর্কে একটা ধারণাকে প্রথমেই সংজ্ঞায়িত করেছেন। প্রাথমিকভাবে তা মানবদেহের সঙ্গে সংযুক্ত, কিন্তু বিষয় থেকে যত বিষয়ান্তরে গেছেন, ততই সেই ধারণাটা আরো বিমূর্ত রূপ নিয়েছে। এই প্রসঙ্গে আসে চোমস্কির সার্বজনীন ব্যাকরণের কথা, যা হয়তো মানুষের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে না। চোমস্কি দেখিয়েছেন, Poverty of stimulus বা উদ্দীপনের অভাব সত্ত্বেও শিশুরা ভাষা শিখতে সক্ষম; অর্থাৎ ব্যাকরণের হয়তো ভাষানিরপেক্ষ অস্তিত্ব আছে। সেই ধারণা থেকেই মনে হয় যে বোধবিজ্ঞানকে আর শুধুমাত্র মানবিকীবিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সমীচীন নয়, প্রকৃতিবিজ্ঞানের বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যেই তার চর্চা করতে হবে।
কম্পিউটার বলতে আমরা সাধারণত প্রযুক্তির কথাই ভাবি। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় তার অভাবনীয় উন্নতির কথা, যার ফলে এখন বিশাল বিশাল তথ্যভাণ্ডারকে মুহূর্তের মধ্যে বিশ্লেষণ ও ব্যবহার করা যাচ্ছে। লেখক চার্লস ব্যাবেজ, অ্যালান টুরিং বা জন ফন নয়ম্যানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন; ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে এই বিশেষ বিষয়টিতে অন্তত প্রযুক্তির আগে প্রয়োজন হয়েছে বিজ্ঞানের, যা প্রযুক্তি বিকাশের পথ দেখিয়েছে। ব্যাবেজের যুগে তাঁর পরিকল্পিত অ্যানালিটিক ইঞ্জিন বানানো সম্ভব হয়নি, কিন্তু কম্পিউটার প্রযুক্তি সেই মৌলিক কাঠামোকে স্বীকার করেই অগ্রসর হয়েছে। আধুনিক কম্পিউটারের কর্মপদ্ধতি ইউনিভার্সাল টুরিং মেশিনের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছিল, এক অর্থে সমস্ত আধুনিক কম্পিউটারই হল ইউনিভার্সাল টুরিং মেশিনের রূপভেদ।
মানুষের মন কে কি যন্ত্র হিসাবে দেখা যায়? এই আলোচনা প্রসঙ্গে দেখলাম মন যে ঠিক কী, তা নিয়ে এখনো কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। নানা যুগ তাদের কালের সর্বোচ্চ যন্ত্রকে মডেল হিসাবে রেখে মানুষের মনকে বুঝতে চেয়েছে। সেই কারণে চার্লস ব্যাবেজ ভিক্টোরিয়ার যুগে তাঁর প্রস্তাবিত কম্পিউটারকে ইঞ্জিন নাম দিয়েছিলেন; আধুনিক যুগে আমরা কম্পিউটারকে দিয়ে মানব মনের বিচার করার চেষ্টা করি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে মানুষের মন কি 'কম্পিউটেবল' বা 'গণনাক্ষম’ এই প্রশ্ন নিয়ে অনেক বিজ্ঞানীই চিন্তা করেছেন; অ্যালান টুরিং, রজার পেনরোজ বা কুর্ট গোডেল তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। যন্ত্র হোক বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা,তার পক্ষে কি সত্যিই মানব মনের প্রতিরূপ হওয়া সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের অজানা। তার একটা কারণ হল মানব মনেরও অনেক কিছুই এখনো আমাদের জ্ঞানের বাইরে। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে তা বিজ্ঞানের অতীত। তবে এ বিষয়ে আধুনিক চিন্তাভাবনা সম্প্রতিই শুরু হয়েছে, এখনো অনেকটা পথ আমাদের যেতে হবে।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনাতে বইটির অনেক দিকই তুলে ধরা সম্ভব হল না। বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্র বোধবিজ্ঞানে অবদান রেখেছে, বা বর্তমানেও রাখছে। তাদের অনেকগুলি সম্পর্কেই বর্তমান আলোচকের জ্ঞান নিতান্তই সীমিত। আধুনিক যুগ হলে ইন্টারডিসিপ্লিনারি বা আন্তঃবিভাগীয় গবেষণার যুগ। আমরা ক্রমশই বুঝতে পারছি যে বিজ্ঞানকে নানা ভাগ করে আমরা যে আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠে রাখতাম, সেগুলি নিতান্তই কৃত্রিম; বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব নেই। সেই কারণেই রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় জীববিজ্ঞানীকে, কম্পিউটার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পদার্থবিদ্যাতে পুরস্কার পান। যদি আপনি বিজ্ঞানের আধুনিকতম বিষয় নিয়ে উৎসাহী হন, তাহলে এই বইটি আপনার অবশ্যপাঠ্য। তবে মনে রাখবেন, ‘বোধবিজ্ঞান' এমন বই নয় যে খবরের কাগজের প্রবন্ধের মতো করে তাকে পড়া যাবে। যে সমস্ত বিষয়ের বই আমাদের মাতৃভাষাতে প্রথম প্রকাশিত হচ্ছে, তাদের ভাষা আপাতভাবে একটু কঠিন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রই আছে, যেখানে শব্দচয়ন মোটেই সরল নয়; কিন্তু বহু বছর ধরে সেই শব্দগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে বলে এখন আর আমাদের সেগুলি পড়তে সমস্যা হয় না। যে কোনো ভাষাতে যখন প্রথম কোনো বিষয় আলোচিত হয়, তখন অনেক শব্দই অচেনা ঠেকে। এমন বইকে আত্তীকরণের জন্য সময় দিতে হবে, তবে সেই সময় দিলে পাঠক যে লাভবান হবেন তাতে সন্দেহ নেই।
লেখক এই জটিল এবং নতুন বিষয়টিকে অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে দুই মলাটের মধ্যে উপস্থাপন করেছেন। বইটির মুদ্রণ খুবই সুন্দর, চোখে পড়ার মতো কোনো প্রমাদ নেই। অসাধারণ প্রচ্ছদ নির্মাণ করেছেন সৌম্যেন পাল। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলা জনপ্রিয় বিজ্ঞান বইয়ের তালিকার প্রথমদিকেই থাকবে 'বোধবিজ্ঞান'।
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশঃ জ্ঞান ও বিজ্ঞান আগস্ট ২০২৫
No comments:
Post a Comment