মেঘনাদ সাহাঃ এক সমাজ সচেতন বিজ্ঞানী
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
সাধারণভাবে
কোনো বিজ্ঞানীর নাম শুনলেই আমাদের অনেকের মনে আসে এমন একজন
মানুষের কথা যিনি হয় ল্যাবরেটরিতে গবেষণাতে ব্যস্ত নয়তো অঙ্ক কষে
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনের
চেষ্টায় ব্রতী। বাইরের সমাজ সম্পর্কে তাঁর ধারণা নেই, উৎসাহও নেই। এর সেরা উদাহরণ
হিসাবে প্রায়ই শোনা যায় আলবার্ট
আইনস্টাইনের নাম। প্রায় কোনো বিজ্ঞানীর
ক্ষেত্রেই এটা সত্যি নয়, আইনস্টাইনের জন্য তো নয়ই। বিজ্ঞানীরা অধিকাংশ সময়েই সমাজ সম্পর্কে
যথেষ্ট সচেতন। তবু তাঁদের মধ্যেও এক এক জন বিজ্ঞানী আছেন যাঁদের সমাজের প্রতি
দায়বদ্ধতার কথা আলাদা করে বলতেই হয়। আমাদের দেশে এই রকম দুজন বিজ্ঞানীর নাম আমরা
সবাই জানি, প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও মেঘনাদ সাহা। মেঘনাদ সাহার জন্মের একশো পঁচিশ বছর
উপলক্ষে তাঁর জীবনের এই দিক নিয়ে এই লেখায় সংক্ষেপে আলোচনার চেষ্টা করব।
মেঘনাদ সাহার
বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে আলোচনার সুযোগ এই প্রবন্ধে বিশেষ নেই, সংক্ষেপে কয়েকটা কথা বলা
যাক। মেঘনাদের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিখ্যাত সাহা আয়নন সমীকরণ। সূর্য বা অন্যান্য
নক্ষত্রের মধ্যে যে মৌলিক পদার্থ থাকে, প্রচণ্ড তাপমাত্রায় তাদের পরমাণুরা
ইলেকট্রন হারিয়ে আয়নিত হয়ে যায়। এই আয়ননের পরিমাণ কেমনভাবে নক্ষত্রের তাপমাত্রা ও
গ্যাসের চাপের উপর নির্ভর করে, তা অঙ্ক কষে বার করেছিলেন মেঘনাদ। তাঁর গবেষণা থেকেই আমরা নক্ষত্রের ভিতরে চাপ,
তাপমাত্রা ইত্যাদি ভৌত অবস্থা জানতে পারি। সাহা আয়নন সমীকরণের সাফল্য অনেক। এখানে
তাদের মধ্যে শুধু একটা বলাই যথেষ্ট, এর থেকেই জানা গেছে যে
সূর্য ও অন্য নক্ষত্ররা যে পদার্থ দিয়ে তৈরি, তার নিরানব্বই শতাংশই দুটো মৌল -- হাইড্রোজেন
ও হিলিয়াম। অর্থাৎ মহাবিশ্ব কোন কোন মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি, তা সাহা সমীকরণ থেকেই
বোঝা গিয়েছিল, যদিও সুযোগের অভাবে সেই কাজটা মেঘনাদ করে উঠতে পারেন নি। সিসিলিয়া
পেইন নামের এক বিজ্ঞানী সাহা সমীকরণ ব্যবহার করে এই কাজটা করেছিলেন। আজও
নক্ষত্রদের সম্পর্কে তত্ত্বীয় গবেষণা করতে গেলে অনেক জায়গায় সাহা সমীকরণ অত্যন্ত
প্রয়োজনীয়। এ ছাড়াও নক্ষত্রের ক্ষেত্রে বিকিরণের চাপ সম্পর্কে তিনি গুরুত্বপূর্ণ
গবেষণা করেছিলেন যা পরে বিজ্ঞানের এক নতুন শাখার জন্ম দেয়। তাই এ কথা সম্পূর্ণ
সত্য যে তাঁর গবেষণা অ্যাস্ট্রোফিজিক্স অর্থাৎ জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে এক নতুন
যুগের সূচনা করেছিল। এর বাইরেও নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা, রেডিও জ্যোতির্বিদ্যা,
রেডিও তরঙ্গের প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর মৌলিক কাজ আছে। নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম বেশ কয়েকবার
মনোনীত হয়েছিল, কিন্তু ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত কোনো জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীই নোবেলের
যোগ্য বলে বিবেচিত হননি। বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান তৈরি ও পরিচালনাতেও তাঁর দক্ষতা অনস্বীকার্য। এমন
একজন বিজ্ঞানী, সারা পৃথিবীতে যাঁর খ্যাতি, তিনি ইচ্ছা করলেই সারাজীবন শুধু
গবেষণাতেই মন দিতে পারতেন, তাঁর সতীর্থরা কেউ কেউ তা করেছিলেন। মেঘনাদ কিন্তু
ল্যাবরেটরির চার দেয়ালের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেন নি।
মেঘনাদের জন্ম
হয়েছিল ঢাকার কাছে শেওড়াতলি গ্রামে ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাইমারি পাস করার পরে দূরের
অন্য এক গ্রামের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েটে সারা পূর্ববঙ্গের
মধ্যে প্রথম। এরপর বাংলার রাজধানী কলকাতা, প্রেসিডেন্সি কলেজ। সেখানে সহপাঠী পেয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। তাঁরা
দুজনেরই বিষয় ছিল গণিত। বিএসসি ও এমএসসিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিলেন
মেঘনাদ, প্রথম সত্যেন্দ্রনাথ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শুরু হয়েছে পদার্থবিদ্যা
বিভাগ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আদেশে সেখানে পড়ানো ও গবেষণা শুরু করেন দুই বন্ধু। তার
চার বছরের মধ্যেই মেঘনাদ আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত সমীকরণ, তখন তাঁর বয়স
মাত্র ছাব্বিশ বছর। চোদ্দ বছর এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন, তারপর
আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। সেখানেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, যা এখন তাঁর নামে নামাঙ্কিত।
এই কয়েক লাইনের জীবন আলেখ্যের মধ্যে লুকিয়ে
আছে এক হার না মানা চরিত্র, দুঃখকষ্টের আগুনে তৈরি হওয়া ইস্পাত। জাতপাতের হিসাবে
তাঁরা ছিলেন বৈশ্য সাহা, অর্থাৎ তথাকথিত নিচু জাতের। মেঘনাদের বাবা জগন্নাথের ছিল
একটা ছোটো মুদির দোকান। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার, ছেলেকে প্রাইমারির পরে পড়ানোর ক্ষমতা জগন্নাথের
ছিল না, গ্রামে তার কোনো সুযোগও ছিলও না। দূরের গ্রামে এক ডাক্তারের বাড়িতে মেঘনাদ
পড়াশোনার জন্য থাকতেন, বিনিময়ে তাদের বাড়ির কিছু কাজ করতে হত। ভালো
রেজাল্ট করার জন্য স্কলারশিপ নিয়ে ঢাকার স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু ছোটলাট
যেদিন স্কুলে আসবেন সেদিন খালি পায়ে আসার জন্য তাঁকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়।
মেঘনাদ বলার সুযোগও পাননি যে কোনোদিনই তিনি স্কুলে জুতো পরে আসেন না, কারণ তা কেনার
ক্ষমতা তাঁর নেই। অন্য একটি স্কুলে তাঁর জায়গা হয়। তাঁর ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফিয়ের জন্য
তাঁর মা ভুবনেশ্বরীকে হাতের বালা বিক্রি করতে হয়েছিল। হিন্দু হস্টেলে সকলের সঙ্গে
বসে খাওয়ার অনুমতি ছিল না, স্কুলে ও কলেজে সরস্বতী পুজোর মণ্ডপ থেকে তাঁকে বার করে
দেওয়া হয়েছিল। বিদেশের তুলনায় ভারতে গবেষণার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। তার উপর আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান সি ভি রমনের সঙ্গে তাঁর কোনোদিনই সম্পর্ক ভালো ছিল
না, তাই পরীক্ষাগার ব্যবহারের সুযোগ কলকাতায় বিশেষ পান নি। এলাহাবাদেও গবেষণার
পরিকাঠামো ছিল খুবই অনুন্নত। এই সমস্ত অসুবিধার মধ্যেই মেঘনাদ সর্বোচ্চ মানের কাজ
করে গেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানচর্চাই তাঁর জীবনের সব নয়। নিজে ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র ও অবজ্ঞার মধ্যে মানুষ হয়েছিলেন বলেই হয়তো তিনি সারা
জীবনই দেশের ও দেশের মানুষের কথা ভেবেছেন।
জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন মেঘনাদ। কখনো ভোলেন নি যে
নিচু জাতে জন্ম বলে হিন্দু হস্টেলে তাঁর সকলের সঙ্গে খাওয়ার অধিকার ছিল না। তাই
বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের কাছে দাবি তুলেছিলেন যে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সমস্ত
হস্টেলে যে কোনো রকম জাতপাত ভিত্তিক থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে। নিজের
গ্রামে পড়ার সুযোগ হয়নি। যখন সামর্থ্য হয়েছে, সেখানে নিজের মায়ের নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিজের বাড়িতে দুঃস্থ ছাত্রদের রেখে পড়াশোনা করিয়েছেন।
নিজে বিদেশে গবেষণার সুযোগ বিশেষ পাননি, তাঁর ছাত্রদের জন্য সে ব্যবস্থা করেছেন।
নিজে যে সমস্ত সুযোগ পাননি, অন্যরা তার থেকে যেন
বঞ্চিত না হয় সেজন্য তাঁর যথাসাধ্য চেষ্টা ছিল।
নিজের ছাত্র,
আত্মীয়, কাছের মানুষদের উন্নতির চেষ্টার মধ্যেই মেঘনাদের প্রয়াস সীমাবদ্ধ ছিল না।
তাঁর প্রসারিত দৃষ্টির ভিতরে ছিল দেশের ভবিষ্যৎ। আমরা যে
সময়ের কথা বলছি, সেই সময় আমাদের দেশ বিদেশী শাসনের অধীন। মেঘনাদের মতো কোনো প্রকৃত
দেশপ্রেমিক সে কথা ভুলে যেতে পারেন না। ছাত্রজীবন থেকেই বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন
সমিতি ও যুগান্তর দলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। পুলিস সে কথা জানত বলে
সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসার অনুমতি তিনি পাননি। বাঘা যতীনই তাঁকে নির্দেশ
দিয়েছিলেন সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ না নিয়ে বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে দেশের
মুখ উজ্জ্বল করতে। তিনি যখন ১৯২১ সালে জার্মানিতে গিয়েছিলেন, প্রবাসী বিপ্লবীদের
সঙ্গে, বিশেষ করে কমিউনিস্ট নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়েছিল। সেই বছরই মানবেন্দ্রনাথের প্রতিনিধি নলিনী গুপ্ত
ভারতে এসেছিলেন, মেঘনাদের মাধ্যমেই যুগান্তর দলের বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। এ সমস্ত সংবাদ ব্রিটিশের পুলিসের অজানা ছিল না। এই সব কারণে তাঁর ইংল্যান্ডের
রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হওয়া কয়েক বছর পিছিয়ে গিয়েছিল। এই সমস্ত হলো মেঘনাদের সরাসরি
স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের উদাহরণ। মেঘনাদ কলকাতা ছাড়ার পরে সম্ভবত বিপ্লবীদের
সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সরাসরি সংগ্রামে অংশগ্রহণ ছাড়াও
মেঘনাদের মতো মানুষের পক্ষে দেশের সেবা করা সম্ভব। তিনি নিজেও মনে করেছিলেন যে
একজন বিজ্ঞানী হিসাবে দেশকে, আরো ভালোভাবে বললে, দেশের মানুষকে সেবার করার অন্য
রাস্তাই তাঁর কাছে শ্রেয়। সেই কথায় আমরা আসব, তবে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি তাঁর
সহানুভূতি সারাজীবনই ছিল। এলাহাবাদে তাঁর ছাত্র বাসন্তীদুলাল নাগচৌধুরি বিপ্লবী
আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁকে বোঝালেন পড়াশোনা করাটা কতটা জরুরি, তারপর
পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে নিজের বাড়িতেই লুকিয়ে রেখেছিলেন।
মেঘনাদের
দেশের কাজে হাতেখড়ি কলেজ জীবনে। তিনি ছিলেন গণিতের ছাত্র, তবে যে শিক্ষক কলেজে তাঁকে
সবচেয়ে প্রভাবিত করেছিলেন, তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র। কলেজে পড়ার সময় দামোদরে
বন্যা হয়েছিল, প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর ছাত্রদের নিয়ে বন্যাত্রাণে গিয়েছিলেন। মেঘনাদ স্বচক্ষে
দেখেছিলেন বন্যার ভয়াল রূপ। এই ঘটনার দশ বছর পরে উত্তরবঙ্গে ভয়ঙ্কর বন্যার সময়
প্রফুল্লচন্দ্রকে সভাপতি করে ত্রাণ সংগ্রহের জন্য কমিটি তৈরি হয় তাঁরই চেষ্টায়,
তিনি নিজেই হয়েছিলেন সম্পাদক। এই সময়েই তরুণ সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়,
সুভাষ ত্রাণ নিয়ে উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলেন। ১৯২২ সালের সেই বন্যার কারণ আলোচনা করে তিনি দেখিয়েছিলেন যে রেলপথ নির্মাণের
জন্য জলের স্বাভাবিক গতিপথ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, তার ফলেই বন্যা প্রলয়ঙ্কর রূপ
নিয়েছে। মেঘনাদ সাহা লিখলেন, ‘রাজশাহীতে রেলপথের সুবিধার জন্য চাষিকে বলি দেওয়া
হল।’ ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’ পত্রিকার কথা পরে আসবে, তাতে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধে
বন্যা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন। মেঘনাদের লেখালেখির ফলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে বন্যা
নিয়ন্ত্রণের দাবি উঠে আসে এবং শেষপর্যন্ত ১৯৪৩ সালে সরকার দামোদরের বন্যা বিষয়ে এক
কমিটি তৈরি করেন, মেঘনাদ হয়েছিলেন তার সদস্য। এই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই
পরবর্তীকালে দামোদর ভ্যালি প্রকল্প রূপায়িত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত মেঘনাদের
অনেকগুলি সুপারিশ শেষপর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি, তার ফল আমরা আজ পর্যন্ত ভোগ করছি।
মেঘনাদের নিজের
কথায়, ১৯৩০-এর দশকে তিনি বিজ্ঞানের গজদন্ত মিনার থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। বিজ্ঞানীদের
সংগঠিত করার কাজ এই সময়ই শুরু করেছিলেন। প্রথমেই এলাহাবাদে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সায়েন্স অ্যাকাডেমি।
তাকে সর্বভারতীয় রূপ দিতে গিয়ে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তার উত্তরাধিকার
আমরা আজও বয়ে নিয়ে চলেছি একই দেশে এলাহাবাদ, দিল্লি ও বাঙ্গালোরে তিনটি আলাদা আলাদা সায়েন্স অ্যাকাডেমির মাধ্যমে। কলকাতায় দুটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন, ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি ও ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশন।
বিখ্যাত বিজ্ঞানী জন ডেসমন্ড বার্নাল ও জোসেফ নিডহ্যামের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে
তৈরি করেছিলেন বিজ্ঞানকর্মীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ সায়েন্টিফিক ওয়ার্কার্স।
বিজ্ঞানীদের এই সমস্ত সংগঠনের কথা আলোচনার সুযোগ এই প্রবন্ধে নেই। সায়েন্স নিউজ
অ্যাসোসিয়েশন থেকে শুরু করা ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’ পত্রিকার নাম আলাদা করে করতে হয়,
যার কথা এই লেখায় আগে এসেছে। মেঘনাদের লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞান সম্পর্কিত খবর এবং দেশের ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে
ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মতামত প্রচার করা। আজ পর্যন্ত নিয়মিত তা প্রকাশিত হয়ে চলছে।
উনিশশো তিরিশের দশকটা দেশের ইতিহাসেও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
গান্ধীজী ও কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশ উত্তাল। ব্রিটিশ শাসকরা
ভারতকে স্বাধীনতা দিতে কোনোমতেই রাজি নয়। তবে মেঘনাদ সহ কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মনে
হচ্ছিল যে স্বাধীনতা শুধু সময়ের অপেক্ষা, কিন্তু স্বাধীন ভারত বিকাশের কোন পথ বেছে
নেবে তা সেই মুহূর্তেই স্থির করাটা খুব জরুরি। ঠিক করার সময় এসেছে দেশের কোটি কোটি
নিরন্ন মানুষের মঙ্গল কেমনভাবে হবে। মেঘনাদ সেই মানুষদের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছেন।
দেশের ভবিষ্যৎ বিকাশ বিষয়ে কংগ্রেসের মূল ধারার
দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মেঘনাদের তীব্র আপত্তি ছিল। গান্ধীজীর অনুসরণ করে কংগ্রেস
মনে করত চরকা ও কুটিরশিল্পই দেশের সামনে একমাত্র পথ। মেঘনাদের মত সম্পূর্ণ আলাদা। তরুণ
রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার চোখ-ধাঁধানো সাফল্য অন্যান্য
পিছিয়ে পড়া দেশকে এগোনোর পথের দিশা দেখাচ্ছে। সেই পথ হল শিল্পায়নের পথ, বিজ্ঞানকে
যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে পরিকল্পনা মাফিক ব্যাপক অংশের জনগণের উন্নয়নের পথ। তাঁর
আদর্শ শিক্ষক প্রফুল্লচন্দ্র তাঁকে বলেছিলেন যে একটা দেশ কত এগিয়ে, তা তার
সালফিউরিক অ্যাসিড ও ইস্পাত তৈরির পরিমাণ থেকে বোঝা যায়। প্রফুল্লচন্দ্র নিজে
রসায়ন শিল্পের জন্য বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। অথচ মেঘনাদ দেখছেন যে
যুক্তপ্রদেশের কংগ্রেসি মন্ত্রীসভার শিল্পমন্ত্রী কৈলাসনাথ কাটজু একটা দেশলাই
বানানোর কারখানার উদ্বোধন করে দেশ শিল্পের পথে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে বলে
আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন। মেঘনাদ উপলব্ধি
করেছিলেন যে কংগ্রেসকে বোঝাতে হবে দেশের বিশাল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের
জীবনযাত্রার মানের উন্নতির জন্য অবশ্য প্রয়োজন হল ভারি শিল্প। ১৯৩৮ সালে দেখা করলেন নবনির্বাচিত কংগ্রেস
সভাপতি সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে। সুভাষচন্দ্র জানতেন দেশের উন্নতি বিষয়ে মেঘনাদের মত,
১৯২২ সালে বঙ্গীয় যুবক সম্মেলনে সুভাষই তাঁকে সভাপতি হতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
সেখানে ভাষণে মেঘনাদ একই কথা বলেছিলেন।
‘সায়েন্স এন্ড
কালচার পত্রিকায়’ নিবন্ধের পর নিবন্ধ লিখে পরিকল্পনার গুরুত্ব বোঝাতে লাগলেন
মেঘনাদ। তাঁরই পরামর্শে সুভাষচন্দ্র তৈরি করলেন জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি। সভাপতি
হওয়ার জন্য জহরলাল নেহরুকে অনুরোধ করলেন মেঘনাদ। জহরলাল রাজি হলেও সাহার সন্দেহ
গেল না, গান্ধীজীকে কতটা অগ্রাহ্য করতে পারবেন তিনি? তাই এমন একজনের শরণাপন্ন হলেন
যাঁর কথা গান্ধী বা নেহরু কেউই উড়িয়ে দিতে পারবেন না। জার্মানিতে তাঁর সঙ্গে
রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ
জানিয়েছিলেন। সতের বছর পরে সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করার সময় হল। রবীন্দ্রনাথও দেশের
উন্নয়ন বিষয়ে তাঁর মত শুনে মুগ্ধ হলেন, জহরলালকে চিঠি দিলেন।
এইসময় আরো
একটা ঘটনা ঘটল যা আজকের দিনে হয়তো আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। শান্তিনিকেতনে বক্তৃতাতে
তিনি বলেছিলেন, ‘যে সব প্রাচীন
আদর্শ বিজ্ঞাননির্ভর নয়, তাদের অবলম্বন করে আমরা দিনের পর দিন পিছিয়ে যাচ্ছি।’ সেই বক্তব্য ছাপা হওয়া মাত্র হিন্দু ধর্মের ধ্বজাধারীদের আক্রমণের মুখে
পড়লেন, তাঁরা মেঘনাদকে বললেন বেদের মধ্যেই সমস্ত আধুনিক বিজ্ঞানকে পাওয়া যাবে।
খরশান ব্যঙ্গে উত্তর এলো, ‘কোনও লব্ধপ্রতিষ্ঠ
উকিল আমি কি বৈজ্ঞানিক
কাজ করিয়াছি জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি প্রথম জীবনের উৎসাহভরে তাঁহাকে আমার
তদানীন্তন গবেষণা সম্বন্ধে সবিশেষ বর্ণনা দেই। তিনি দুই-এক মিনিট পর পরই বলিয়া
উঠিতে লাগিলেন, ‘এ আর নূতন কি হইল, এ সমস্তই ব্যাদে আছে।’ ... বলিলাম, ‘মহাশয় এসব তত্ত্ব বেদের কোন অংশে
আছে...।’ তিনি বলিলেন, ‘আমি ত
কখনও ‘ব্যাদ’ পড়ি নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমরা নূতন বিজ্ঞানে যাহা করিয়াছ
বলিয়া দাবি কর সমস্তই ‘ব্যাদে’ আছে।’ সঙ্গে ছিল প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র সম্পর্কে
দীর্ঘ আলোচনা। ভুল মানুষকে আক্রমণের লক্ষ্য বেছে নিয়েছেন বুঝে চুপ করে গেলেন
প্রাচীনপন্থীরা। আজ যখন প্রাচীন শাস্ত্রে আধুনিক বিজ্ঞানের সমস্ত অগ্রগতিকে খুঁজে
পাওয়ার কথা সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যেই বলা হচ্ছে, মেঘনাদ
সাহার মতো মানুষকে আমাদের বড়ো দরকার।
জাতীয় পরিকল্পনা
কমিটির কাজ খুব এগোয়নি, কারণ নেহরু কিছুদিনের মধ্যেই কারাবন্দী হলেন। পরের বছর
সুভাষচন্দ্র গান্ধীজীর মত অগ্রাহ্য করে আবার সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন ও
নির্বাচিত হলেন। কিন্তু গান্ধীজীর বিরোধিতা করে বেশিদিন তিনি সভাপতি পদে থাকতে
পারলেন না, পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। মেঘনাদের কলেজের বন্ধু রসায়নবিদ জ্ঞানচন্দ্র
ঘোষ এবং ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বেশ্বরাইয়া ছাড়া অল্প কয়েকজন বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদই
পরাধীন ভারতে এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছিলেন। তবে দেশের উন্নতিতে কমিটির প্রভাব
নিঃসন্দেহে সুদূরপ্রসারী, কারণ এরই উত্তরসূরি স্বাধীন ভারতের প্ল্যানিং কমিশন।
মেঘনাদের চিন্তা থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী জহরলাল এই কমিশনকে তৈরি করেন,
যদিও মেঘনাদের সেখনে বিশেষ স্থান হয়নি। নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও স্বাধীনতার পর
দেশের অগ্রগতিতে প্ল্যানিং কমিশনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্য
এর অবলুপ্তি ঘটিয়েছে।
দেশের বিজ্ঞানীদের স্বাধীনতা আন্দোলনের থেকে গা-বাঁচানোর
সুবিধাবাদী মনোভাব মেঘনাদ পরিকল্পনা কমিটির বাইরেও দেখবেন। কলকাতায় ভারতীয় বিজ্ঞান
কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতি হয়েছিলেন নেহরু। তিনি জেলে বন্দী ছিলেন, মেঘনাদের
পরামর্শে তাঁর ছবি চেয়ারে রেখে সভা চালানো হয়েছিল। কিন্তু দেশের বিখ্যাত
বিজ্ঞানীদের কেউই প্রায় সেই অধিবেশনে আসেন নি। পরে নেহরুর সঙ্গে যখন তাঁর মতবিরোধ
তীব্র, তখন তিনি নেহরুকে সেই কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে অবশ্য কোনো ফল হয়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই ভারতীয় শিল্পের উপর
ব্রিটেনের নির্ভরতা বাড়তে থাকে। শিল্পে বিজ্ঞান গবেষণার প্রয়োগের জন্য তৈরি হয়েছিল
বোর্ড অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ যা পরে কাউন্সিলে পরিবর্তিত হয়।
মেঘনাদ প্রথম থেকেই সদস্য, অধিকর্তা তাঁর এক পুরানো বন্ধু রসায়নবিদ শান্তিস্বরূপ
ভাটনগর। কিন্তু ভাটনগরের লক্ষ্য কয়েকটা কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, তাদের
মধ্যেই গবেষণা সীমাবদ্ধ থাকবে। নেহরু ও কংগ্রেসও তাঁরই মতের সমর্থক। মেঘনাদ এই
কেন্দ্রীকরণের তীব্র বিরোধিতা করলেন, তাঁর বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়দের বঞ্চিত করে এই
রকম গবেষণার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হবে না। একবার কমিটি থেকে পদত্যাগও করলেন।
কিন্তু স্বাধীন ভারতেও সরকারের নীতি পাল্টালো না, অথচ সারা পৃথিবীর সমস্ত উন্নত
দেশে গবেষণা হয় মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজ মেঘনাদের মতকে অগ্রাহ্য করার দাম আমাদের
দিতে হচ্ছে বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়ে। বিরোধের ক্ষেত্র এই একটা ছিল না। ভাটনগর তৈল অনুসন্ধান পুরোপুরি বিদেশী কোম্পানির হাতে
তুলে দিচ্ছেন, মেঘনাদের বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ দেশের হাতে থাকা প্রয়োজন। মেঘনাদ
চিরকালই দেশে স্বাধীন গবেষণার পক্ষপাতী। সংঘাত অনিবার্য। ভাটনগর ক্ষমতাশালীদের কাছের
লোক, সাহার বক্তব্য তাই নীতি পরিবর্তন করতে পারে না।
অন্যদিকে পরমাণু শক্তি গবেষণার জন্য ১৯৪৫
সালে তৈরি হয়েছিল অ্যাটমিক এনার্জি রিসার্চ কমিটি। কোনোদিন নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে
গবেষণা না করলেও নেহরুর সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে সভাপতি হয়েছেন হোমি জাহাঙ্গির
ভাবা। মেঘনাদই ভারতে প্রথম পরমাণু শক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে লেখালেখি শুরু
করেছিলেন। তিনি নিজে দীর্ঘদিন এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন, ভারতে প্রথম সে বিষয়ে
পড়াশোনা ও গবেষণা শুরু হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরই তত্ত্বাবধানে, সেখানে
তিনি তৈরি করছেন ভারতের প্রথম সাইক্লোট্রন যন্ত্র। তিনি হয়েছেন কমিটির সাধারণ
সদস্য। ভাবাও ভাটনগরের মতোই গবেষণার কেন্দ্রীকরণের পক্ষে, তিনি চাইছেন পরমাণু
শক্তি বিষয়ে সমস্ত গবেষণা বম্বেকে কেন্দ্র করে হোক। কলকাতার
ভাগ্যে কিছুই জুটছে না। ভাবার লক্ষ্য এখনই পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন, মেঘনাদ জানেন যে নিজেদের গবেষণার উপর দাঁড়িয়ে
পরমাণু শক্তির ব্যবহার করতে ভারতের কয়েক দশক লাগবে। বিদেশ থেকে সহায়তা পেতে গেলে
তাদের শর্ত মতো চলতে হবে। তাই তিনি ধীরে ধীরে ভারতীয়
বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদদের উপর নির্ভর করে এগোনোর পক্ষপাতী। মেঘনাদ পরমাণু গবেষণাতে অনাবশ্যক
গোপনীয়তার ঘেরাটোপের বিরোধী, অথচ জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে পরমাণু গবেষণা
সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য গোপন রাখা হচ্ছে। ভাবার কার্যকলাপে বিরক্ত মেঘনাদ নেহরুর কাছে নালিশ করেছেন,
কোনো ফল হয়নি। একসময় বিরক্ত হয়ে ছাত্রকে
চিঠিতে লিখেই ফেললেন,
‘পণ্ডিতজীকে ক্ষমতালোভীরা ঘিরে রেখে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে।’ ১৯৪৮ সালে যখন পরমাণু শক্তি আয়োগ তৈরি হয়, মেঘনাদ তার
সদস্য হতে অস্বীকার করলেন। সদস্য হয়ে লাভ কী, তাঁর মতামতের কোনো দামই দেওয়া হচ্ছে
না।
দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু দেশের উন্নতির জন্য বিজ্ঞান
গবেষণার গুরুত্ব নিয়ে মেঘনাদ কোনো কথা বলার জায়গা পাচ্ছেন না। তাহলে কি হেরে গেলেন
মেঘনাদ? পালিয়ে যাওয়া তাঁর ধাতে নেই। প্রথম লোকসভা নির্বাচনে উত্তর কলকাতা থেকে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন মেঘনাদ। গান্ধীজীর চরকা ও কুটির শিল্পনীতির বিরোধিতা করে
তাকে বিজ্ঞানবিরোধী ও পশ্চাৎমুখী বলেছেন, কংগ্রেসের টিকিট তাঁর পাওয়ার কোনো
প্রশ্নই নেই। বামপন্থীদের সমর্থনে নির্দল হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কংগ্রেসের
প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হলেন মেঘনাদ। লোকসভাতে মেঘনাদ বিজ্ঞান গবেষণা শিক্ষা, নদী
পরিকল্পনা, শিল্পায়ন, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, পরমাণু শক্তি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে
বক্তব্য রেখেছেন। সংসদে নেহরুর সঙ্গে একাধিকবার তীব্র বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন মেঘনাদ। একসময়ে
নেহরুর ব্যক্তিগত আক্রমণের উত্তরে মেঘনাদ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘আমি হয়তো বিজ্ঞানে
সামান্যই কাজ করেছি, কিন্তু তবু আমার নাম শতাব্দীর পর শতাব্দী লোক মনে রাখবে। এখানকার অনেক রাজনীতিক কয়েক বছরের মধ্যেই বিস্মৃতির
অতলে তলিয়ে যাবেন।’ সংসদের বাইরে বিজ্ঞান ছাড়াও মেঘনাদ সাহার বিভিন্ন ভূমিকা আছে। দেশভাগের পরে
পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সমস্যা নিয়ে তিনি সংসদের বাইরে ও ভিতরে
বারবার সরব হয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝেছিলেন যে নির্দলীয় সদস্যদের কথার
কোনো গুরুত্ব নেই। নির্দল হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও সংসদের খাতায় তাঁর নামের পাশে লেখা আছে
ইউনিয়ন অফ সোশ্যালিস্টস এন্ড প্রগ্রেসিভস, দল বিচারে তিনি আরএসপির ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
সংসদ সদস্য হিসাবে পাঁচ বছর পূর্ণ করার আগেই আকস্মিক হৃদরোগে দিল্লিতে তাঁর মৃত্যু
হয়েছিল।
মেঘনাদের কাছে বিজ্ঞান শুধু নিছক জ্ঞানচর্চার বিষয় ছিল
না, তা ছিল সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। দেশের সমসাময়িক অন্য প্রায় সমস্ত বিজ্ঞানীর
থেকে তিনি এই ক্ষেত্রে পৃথক। রমনের মতো সমাজের উঁচু অংশের প্রতিনিধিত্ব তিনি করেন নি, ভাবার মতো সোনার চামচ
মুখে নিয়েও তাঁর জন্ম নয়। তাঁর মতো সমাজের নিচু স্তর থেকে উঠে এসে দেশের বিজ্ঞানীমহলে শীর্ষস্থান অধিকার
কেউ করেন নি। দারিদ্র্যকে তিনি ভিতর থেকে দেখেছিলেন, অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছিলেন
সমাজে তথাকথিত নিচু জাতের সমস্যা। মেঘনাদের বিজ্ঞানচর্চার আলোচনা এই নিবন্ধে বিশেষ করা হল না। সেখানেও বিদেশি বিজ্ঞানীদের মুরুব্বিয়ানা তাঁকে আহত করেছিল। একজন বিদেশি বিজ্ঞান ঐতিহাসিক একবার লিখেছেন সাহা সমীকরণ ইংল্যান্ডে বসে মেঘনাদ আবিষ্কার করেছিলেন,
মেঘনাদ তা জানা মাত্র তীব্র প্রতিবাদ জানান। মেঘনাদের কাছে বিজ্ঞানচর্চার অন্য একটা উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়রা যে বিদেশি বিজ্ঞানীদের
থেকে কোনো অংশে ন্যূন নয়, তা প্রতিষ্ঠা করা, অর্থাৎ তা দেশপ্রেমেরই একটা প্রকাশ।
দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাঁর জীবনের চালিকাশক্তি। পরাধীন দেশে প্রথমে
বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। যখন দেশের স্বাধীনতা কাছে এলো, তখন দেশের
ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে সামিল হতে চেয়েছিলেন। আবার যখন বুঝলেন স্বাধীন দেশের সরকার
দেশগঠনে বিজ্ঞানকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দিছে না, তখনই তাঁর নিজের মতকে প্রকাশ করার
উপযুক্ত জায়গা হিসাবে তিনি বেছে নিলেন সংসদকে। সমাজ পরিবর্তনের তাগিদ মেঘনাদ
সাহাকে পরীক্ষাগারের নিশ্চিন্ত জীবন থেকে বার করে এনেছিল। আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য
যে আমরা তাঁর সেই জীবনব্যাপী
সংগ্রামের যথাযথ
মূল্য দিতে পারিনি।
No comments:
Post a Comment