নারীজাগরণে রোকেয়া
শম্পা গাঙ্গুলী
আজকের নিবন্ধে আমি ছাত্রীদের কাছে এমন একজন স্বতন্ত্র সাহসী
মনের পরিচয় তুলে ধরতে চাই যিনি তাঁর একক প্রয়াসে বাঙালী মুসলমানের অন্তঃপুরে আধুনিক শিক্ষার আলো যতখানি
পৌঁছে দিয়েছেন, আঘাত দিয়ে জড়তা কাটিয়ে দিতে চেয়েছেন সমাজের বিবেকের কর্মচেতনাকে জাগাবার
চেষ্টায় - তেমনটা এই একশো বছরে বাঙালী মুসলমান নারীদের জন্য আর কেউ করেননি।
রোকেয়া
সাখাওয়াত হোসেনের কথা আজ তোমাদের বলব। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর বর্তমান
বাংলাদেশের রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। বাবা জাহিরুদ্দিন মহম্মদ আবু আলি হায়দার সাবের ছিলেন
একজন উচ্চশিক্ষিত সম্ভ্রান্ত জমিদার। রোকেয়ার মায়ের নাম রাহাতুন্নেসা সাবেরা
চৌধুরাণী। রোকেয়ার জীবনে তাঁর বড় ভাই ইব্রাহিম আর বড় বোন করিমুন্নিসার প্রভাব ছিল
অনেকখানি। তখনকার উচ্চবংশের মুসলমানদের মধ্যে আরবি ও পারসির বাইরে অন্য কোনো ভাষা
শিক্ষা একটা দুরূহ ব্যাপার ছিল। সে সময়ের নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আধুনিকমনস্ক বড়
ভাই ইব্রাহিম তাঁর দুই বোন রোকেয়া আর করিমুন্নিসাকে গোপনে বাংলা ও ইংরাজি ভাষা
শেখান। করিমুন্নিসা পরে বাংলাতে কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করেন।
১৮৯৬ সালে ষোলো
বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় একজন চল্লিশ বছর বয়সী উচ্চশিক্ষিত উর্দুভাষী মুসলমান খান
বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি তখন পরাধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের ভাগলপুর
জেলার (বর্তমান বিহারের অন্তর্গত) ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই
উদার মনোভাবাপন্ন এবং নারী শিক্ষা প্রসারে উৎসাহী। তখনকার কট্টর মুসলমান সমাজ ব্যবস্থার
মধ্যে দাঁড়িয়েও তিনি তাঁর স্ত্রীকে বাংলা ও ইংরাজি ভাষা শিখতে এবং বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ লিখতে
অনুপ্রাণিত করেছিলেন। রোকেয়ার ভেতর যে সুপ্ত প্রতিভা ছিল তার আবিষ্কার ও প্রকাশে
স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।
রোকেয়া শুরু করলেন সাহিত্য চর্চা। ১৯০২ সালে লিখলেন তাঁর
প্রথম উপন্যাস ‘পিপাসা’। এরপর ১৯০৫ সালে ‘মতিচুর’। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য
রচনা হল ‘Sultana’s
Dream’ যার অনুদিত রূপ ১৯০৮ সালে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে বই প্রকাশিত
হয়। এই বইটিকে বাংলার তথা বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যের একটি মাইলফলক ধরা হয়। ১৯২৪
সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাস। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় ‘অবরোধ-বাসিনী’।
বাংলায়
নারী
শিক্ষা
বিস্তারে
শিক্ষাবিদ
বেগম
রোকেয়ার
অবদান
অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন একাধারে বঙ্গ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান নারীবাদী লেখক ও সমাজ-সংস্কারক। নারী শিক্ষার প্রসার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তিনি লিখে গেছেন শক্ত হাতে। মেয়েদের
জন্য
বেশকিছু
স্কুল
স্থাপন
করেছেন। অনেক দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে এসব স্কুলে মেয়েদের নিয়ে আসার জন্য। দ্বারে
দ্বারে
ঘুরে
অভিভাবকদের
অনুরোধ
করেছেন
যাতে
তারা
মেয়েদের
স্কুলে
পাঠান। এমনকি মেয়েদের নিরাপত্তা ও পর্দার নিশ্চয়তা দিতে বেগম রোকেয়া ফিটন গাড়ি (ঘোড়ার গাড়ি) ও মোটর বাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। এ গাড়িগুলো সম্পূর্ণভাবে পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকত। তার
পরও
রক্ষণশীলরা
যখনই
সুযোগ
পেয়েছে, বেগম
রোকেয়াকে
আক্রমণ
করতে
ছাড়েনি।
তাঁর কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৯১১ সালে কলকাতায় মাত্র আটজন
ছাত্রী নিয়ে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা। ১৯১৫ সালে পঞ্চম শ্রেণি
শুরু হল স্কুলে। স্কুলটি উচ্চ প্রাইমারি বিদ্যালয়ে উন্নীত হল। ছাত্রী সংখ্যাও
বাড়তে বাড়তে হল চুরাশি। ১৯২৭ সালে তাঁর স্কুলটি উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ে পরিণত হল। কিন্ডারগার্ডেন
শাখারও প্রবর্তন ঘটল। ছাত্রী সংখ্যাও বাড়ল। বেগম
রোকেয়ার
কাজ
এগিয়ে
নিয়ে
গিয়েছিলেন
অনুজপ্রতিম
শিক্ষক, সমাজকর্মী
এবং
সংসদ
সদস্য
শামসুন্নাহার
মাহমুদ। তার বাবা ফজলুল করিম সে সময় পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্নাতক।
রোকেয়ার শিক্ষার আদর্শ কিন্তু একেবারেই রক্ষণশীল ছিল না, ছিল
আধুনিক। তিনি তাঁর সমাজের থেকে বহুগুণ অগ্রসর ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাস্থ্য
রক্ষার জন্য শারীরিক ব্যায়াম চর্চার প্রয়োজন; আর প্রয়োজন বিশুদ্ধ বাতাসের।’ আজকে
আমরা যে সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার কথা বলি, রোকেয়ার কথাতে তার প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
রোকেয়া ছিলেন ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম আমূল
নারীবাদী এক মহান নারী ব্যক্তিত্ব। তাঁর সময়ে নারীদের এতই করুণ দশা ছিল যে তিনি
নারীকে নিকৃষ্ট জীবের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বলেছিলেন- “আপনারা শুনিয়া হয়ত
আশ্চর্য্য হইবেন যে, আমি আজ বাইশ বৎসর
ধরিয়া ভারতের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীবের জন্য রোদন করিতেছি। ভারতের সর্বাপেক্ষা
নিকৃষ্ট জীব কাহারা জানেন? সে জীব ভারত-নারী। এই জীবগুলির জন্য কখনো কাহারো প্রাণ
কাঁদে নাই। পশুর জন্য চিন্তা করিবারও লোক আছে। তাই যত্র-তত্র পশুক্লেশ নিবারণী
সমিতি দেখিতে পাই। কিন্তু আমাদের ন্যায় অবরোধ-বন্দিনী নারী জাতির জন্য কাঁদিবার
একটি লোকও এ ভূভারতে নাই।” তখন মুসলমান নারীর জন্য শিক্ষার্জন নিষিদ্ধ ছিল, এবং
অবরোধ-বন্দী নারীকে ঘরের মধ্যেও অপর নারীর সামনে পর্দা করতে হত। সেই বীভৎস অবরোধ
প্রথার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা তিনি এভাবে করেন- “জমিদার বাড়িতে এক জমিদার
কন্যা দুপুরবেলা আঙিনায় মুখ ধুইতেছিলেন। আলতার মা পাশে দাঁড়িয়া জল ঢালিয়া দিতেছিল।
ঠিক সেই সময় এক লম্বা চওড়া কাবুলি স্ত্রীলোক আঙিনায় আসিয়া উপস্থিত। হায় হায় সে কি
বিপদ! আলতার মা চেঁচাইয়া উঠিল- বাড়ির ভিতর পুরুষ মানুষ! স্ত্রীলোকটি হাসিয়া জানাইল--
সে পুরুষ নয়। জমিদার কন্যা প্রাণপণে ঊর্ধ্বশ্বাসে গৃহাভ্যন্তরে ছুটিয়া গিয়া
হাঁপাইতে হাঁপাইতে ও কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন-- পাজামা-পরা একটা মেয়েমানুষ আসিয়াছে।
গৃহকর্ত্রী ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন-- সে তোমাকে দেখিয়া ফেলে নাই তো? কন্যা
সরোদনে বলিল-- হ্যাঁ দেখিয়াছে। অপর মেয়েরা শশব্যস্তভাবে
দ্বারে অর্গল দিলেন। কেহ বাঘ ভাল্লুকের ভয়েও বোধ হয় এমন করিয়া কপাট বন্ধ করে না।‘
এমন অন্ধকারে ডুবে ছিল রোকেয়ার ভারতবর্ষ। সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের বুক চিরে তিনি
নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের দীপশিখাটি প্রজ্বলিত করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল নারীদের
স্বাবলম্বন। তিনি দাবি জানিয়েছিলেন যে, নারীকে দিতে হবে শিক্ষার্জনের ও
অর্থোপার্জনের অধিকার। তিনি পুরুষজাতির চোখে চোখ রেখে ঘোষণা করেছিলেন --- পুরুষের ঘর-সংসার করাই কেবল নারীর সারধর্ম নয়, নারী তার বুদ্ধি, মেধা,
প্রজ্ঞা ও শ্রম দিয়ে দেশের উন্নয়নে অংশ নিতে এবং দেশকে নেতৃত্ব প্রদান ও পরিচালনার
দায়িত্ব পালনে সক্ষম। তিনি দাবি করেছিলেন পুরুষের সমকক্ষতা এবং নারী-পুরুষের
সমানাধিকার। তিনি ‘স্বামী’ শব্দের তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, নারী পুরুষকে তার
স্বামী (প্রভু) মানবে কেন? স্বামী আর বলবে না, ‘স্বামী’র পরিবর্তে পুরুষকে
অর্ধাঙ্গ বলবে। এই ছিল রোকেয়ার নারী-স্বাধীনতা আন্দোলনের আসল রূপ, যা ছিল
পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ।
তিনি কার্যত বিদ্রোহ করেছিলেন নারীর প্রধান শত্রু
ধর্মের বিরুদ্ধেও। সকল ধর্মগ্রন্থই পুরুষ দ্বারা রচিত বলে পৃথিবীর সকল ধর্মকেই
নস্যাৎ ও অস্বীকার করেছিলেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে প্রচলিত
ধর্মই যে নারীর দাসত্ব বন্ধন দৃঢ় হতে দৃঢ়তর করেছে। তিনি সে কথা ‘মহিলা’ পত্রিকায় ‘অলঙ্কার না Badge of Slavery’ প্রবন্ধে
বলিষ্ঠ ভাষায় লিখেছিলেন। মুসলিম সমাজ ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ভূকম্পন সৃষ্টিকারী
তাঁর সেই দুঃসাহসিক
কথাটি এরূপঃ “‘ধর্ম’ই আমাদের
দাসত্ব বন্ধন দৃঢ় হতে দৃঢ়তর করিয়াছে, ‘ধর্মে’র দোহাই দিয়া
পুরুষ রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।”
রোকেয়া তাঁর
জন্মভূমিকে ভালবেসেছিলেন, ভালবেসেছিলেন তাঁর দেশের মানুষকে। তিনি মায়েদের বলতেন,সন্তানকে
আগে শেখাতে হবে সে ভারতবাসী, তারপর আসে ধর্মের পরিচিতি। দেশের উন্নতির জন্য হিন্দু
মুসলমানের মিলনের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি তুলে ধরেছিলেন। তাঁর সৌভাগ্য যে তিনি ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ
দেখে যাননি। বিশেষ করে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে নারী শিক্ষার বিস্তারে তিনি যে
জীবন উত্সর্গ করেছিলেন, তার মূলে তাঁর এই ভালবাসা। এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন,
মুসলমানদের যাবতীয় দৈন্য-দুর্দশার একমাত্র কারণ স্ত্রীশিক্ষায় ঔদাস্য। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি শুধুমাত্র শিক্ষাতেই সীমাবদ্ধ
থাকেনি। কৃষির উন্নতি, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার, শিল্পোন্নয়ন, এই সমস্ত বিষয়ে
তিনি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
তিনি
তাই প্রাতঃস্মরণীয় এক ভারতীয় মনীষী, আমাদের বাঙালী জাতির গর্ব।
No comments:
Post a Comment