বিজ্ঞানের টুকরো খবর
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
নোবেল পুরস্কার
প্রতি বছর অক্টোবর মাসে নোবেল বিজয়ীদের নাম
ঘোষণা করা হয়। আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুযায়ী বিজ্ঞানের তিন বিষয়ে
নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় – শারীরবিদ্যা বা চিকিৎসাশাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান এবং
রসায়ন। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানমহল কৌতূহলের সঙ্গে পুরস্কারের ঘোষণার অপেক্ষা করে।
এই বছর শারীরবিদ্যা বা চিকিৎসাশাস্ত্রে
যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেমস অ্যালিসন ও জাপানের
তাসুকু হনজো। তাঁরা মারণ রোগ ক্যানসারের চিকিৎসার এক নতুন পথ দেখিয়েছেন। ক্যানসার চিকিৎসার সাধারণ ব্যবহৃত পদ্ধতির
মধ্যে পড়ে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, সার্জারি ও হরমোনথেরাপি। এই সমস্ত পদ্ধতিতে
ক্যানসারের কোশগুলিকে বাইরে থেকে বিভিন্ন ভাবে নষ্ট করা হয়। মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েই আক্রমণ ঘটিয়ে ক্যানসারের কোশগুলিকে ধ্বংস করার পথ
অনেকদিন ধরেই খোঁজা হচ্ছিল, কিন্তু কখনো কখনো কাজ করলেও অধিকাংশ সময়েই সেই সব পথ
ব্যর্থ হত। অ্যালিসন ও হনজো দেখান যে কোনো কোনো প্রোটিন শরীরের প্রতিরোধ শক্তির
উপর ব্রেকের মতো কাজ করে এবং ক্যানসার কোশ ধংস করার পথে বাধা দেয়। এই প্রোটিনদের দমন করতে পারলে শরীরের
প্রতিরোধ শক্তি নিজেই ক্যানসারকে প্রতিহত করতে পারবে। যে সমস্ত ওষুধ এই প্রোটিনের
কাজে বাধা দেয়, তাদের বলে চেকপয়েন্ট ইনহিবিটর। গত শতাব্দীর শেষ দশকে আবিষ্কৃত এই
পদ্ধতি বর্তমানে বেশ কয়েক রকম ক্যানসার চিকিৎসাতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
পদার্থবিদ্যার
নোবেল পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থার অ্যাশকিন,
ফ্রান্সের জিরার্ড ম্যুরো এবং কানাডার ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড। অ্যাশকিন এখনো পর্যন্ত
সবচেয়ে বেশি বয়সে নোবেল পুরস্কার পেলেন, পুরস্কার ঘোষণার সময়েই তাঁর বয়স ছিয়ানব্বই
পেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড
হলেন তৃতীয় মহিলা যিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেলেন। এর আগে ১৯০২ সালে মেরি কুরি
এবং ১৯৬৩ সালে মারিয়া গোপার্ট মায়ার এই সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। অ্যাশকিন লেজারের
সাহায্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা, ভাইরাস এমনকি পরমাণুকে আলাদা আলাদা করে সরানোর
পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন – একে বলে অপটিক্যাল টুইজার অর্থাৎ আলোর চিমটা। ১৯৮৭ সালে
আবিষ্কৃত এই পদ্ধতি বিকিরণের চাপকে ব্যবহার করে। জীববিজ্ঞানে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে তাঁর
আবিষ্কার। ম্যুরো ও তাঁর ছাত্রী স্ট্রিকল্যান্ডও
লেজারের উপর গবেষণার জন্যই সম্মানিত হয়েছেন। তাঁদের আবিষ্কৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে
বর্তমানে লেজার পালসের সময়কাল এক সেকেন্ডের একহাজার কোটি কোটি ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত
কমানো সম্ভব হয়েছে, ফলে ওই স্বল্প সময়ের জন্য তার শক্তি বেড়ে হয়েছে একশো কোটি
মেগাওয়াটেরও বেশি। ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে তথ্য
সংরক্ষণ, নতুন ধরণের পদার্থ নির্মাণ, অতি দ্রুত রাসয়ানিক বিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ,
চোখের লেজার চিকিৎসা সহ নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগছে ১৯৮৫ সালে করা এই গবেষণা।
প্রসঙ্গত এটি ছিল ডোনা স্ট্রিকল্যান্ডের প্রথম প্রকাশিত গবেষণাপত্র।
রসায়নে নোবেল
পুরস্কার পেয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রান্সেস আর্নল্ড এবং সেদেশেরই জর্জ
স্মিথ ও ব্রিটেনের গ্রেগরি উইন্টার।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের অনুরূপ পদ্ধতিতে এনজাইমের বিবর্তন নিয়ে গবেষণার জন্য
পুরস্কার পেয়েছেন আর্নল্ড। প্রাকৃতিক নির্বাচন হয় শ্লথ গতিতে, তার কোনো বিশেষ অভিমুখ
থাকে না। আর্নল্ডের পদ্ধতিকে বলে ডাইরেক্টেড ইভল্যুশন অর্থাৎ নির্দেশিত বিবর্তন। ১৯৯৩
সাল নাগাদ এভাবে তিনি এমন সমস্ত নতুন উৎসেচক তৈরি করতে সক্ষম হন যারা নানা জৈব
বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। আর্নল্ড পঞ্চম মহিলা যিনি রসায়নে নোবেল পুরস্কার
পেয়েছেন। স্মিথ ও উইন্টার পেপটাইড ও অ্যান্টিবডির ফাজ ডিসপ্লে বিষয়ে কাজের জন্য
সম্মানিত হয়েছেন। তাঁদের গবেষণাতে ব্যাকটেরিওফাজ
ভাইরাসের জিনের মধ্যে কোনো বিশেষ প্রোটিন সংশ্লেষের জিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যাতে
ভাইরাসের বাইরের দেওয়ালে সেই প্রোটিন তৈরি হয়। প্রোটিন-প্রোটিন, প্রোটিন-পেপটাইড
বা প্রোটিন-ডিএনএর মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য এই পদ্ধতিকে ব্যবহার করা
হয়। স্মিথ ১৯৮৫ সালে প্রথম ফাজ ডিসপ্লের ব্যবহার করেন, অন্যদিকে উইন্টার তার পরের
বছর থেকে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে মানুষ ছাড়া অন্য প্রজাতির জীবের অ্যান্টিবডিকে
মানুষের শরীরে ব্যবহারের উপযোগী করেছেন। প্রোটিন ইঞ্জিনিয়ারিঙের মাধ্যমে নতুন নতুন
ওষুধসহ অন্যান্য নানা উপযোগী পদার্থ তৈরিতে সাহায্য করছে আর্নল্ড, স্মিথ ও
উইন্টারের গবেষণা।
ভাটনগর পুরস্কার
ভারতবর্ষে
বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ সম্মান হল ভাটনগর পুরস্কার। কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল
রিসার্চ বা সিএসআইআরের প্রথম অধিকর্তা শান্তিস্বরূপ ভাটনগরের নামাঙ্কিত এই
পুরস্কার দেওয়া হয় সাতটি বিষয়ে -- জীববিজ্ঞান, রসায়ন, প্রযুক্তি, গণিত,
চিকিৎসাশাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান এবং পৃথিবী, বায়ুমণ্ডল ও সমুদ্রবিষয়ক বিজ্ঞানে।
প্রাপকের বয়স পঁয়তাল্লিশের কম হতে হবে এবং তাঁর গবেষণার মুখ্য অংশ ভারতেই নির্বাহিত
হতে হবে। প্রতিবছর ২৬ সেপ্টেম্বর সিএসআইআরের পক্ষে সংস্থার মুখ্য অধিকর্তা
পুরস্কার প্রাপকদের নাম ঘোষণা করেন।
এই বছর
জীববিদ্যাতে পুরস্কার পেয়েছেন বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের গণেশ
নাগরাজু এবং ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন এন্ড রিসার্চ বা আইআইএসইআর
পুনে কেন্দ্রের টমাস পুকাডিল। রসায়নে পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছেন আইআইএসইআর কলকাতা
কেন্দ্রের রাহুল ব্যানার্জি ও স্বাধীন কুমার মন্ডল। প্রযুক্তিতে পুরস্কার পেয়েছেন
ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি বা বা আইআইটি মুম্বাইয়ের অমিত আগরওয়াল ও অশ্বিন
অনিল গুমাস্তে। গণিত বিষয়ক পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছেন দুটি আইআইটির দুই গবেষক –
দিল্লীর অমিত কুমার ও কানপুরের নিতিন সাক্সেনা। চিকিৎসার জন্য পুরস্কার পেয়েছেন
বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ এন্ড নিউরোসায়েন্সেসের গণেশ
বেঙ্কটসুব্রহ্মনিয়ান। পদার্থবিজ্ঞানে পুরস্কার পেয়েছেন এলাহাবাদের হরিশচন্দ্র
রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অদিতি সেন দে এবং বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের
অম্বরীশ ঘোষ। পৃথিবী সংক্রান্ত বিজ্ঞানবিষয়ে পুরস্কার পেয়েছেন দুই বিজ্ঞানী, গোয়ার
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওসেনোগ্রাফির পার্থসারথি চক্রবর্তী এবং তিরুপতির ন্যাশনাল
অ্যাটমোস্ফেরিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির মদিনেনি ভেঙ্কট রত্নম।
এই বছরের
প্রাপকদের মধ্যে একমাত্র মহিলা হলেন অদিতি সেন দে। শুধু তাই নয়, ভাটনগর পুরস্কারের
একষট্টি বছরের ইতিহাসে তাঁর আগে কোনো মহিলা পদার্থবিদ্যাতে এই পুরস্কার জেতেন নি।
এই বছর তেরোজন বিজেতার মধ্যে পাঁচজন বাঙালী। আমাদের গৌরবের কথা যে ভারতে বিজ্ঞানের
এই সর্বোচ্চ সম্মান প্রাপ্তির একষট্টি বছরের তালিকাতে পশ্চিমবঙ্গ অন্য সমস্ত
প্রদেশের থেকে অনেক এগিয়ে আছে। তবে মনে রাখতে হবে
বাঙালী প্রাপকদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে
যুক্ত, এবং সিংহভাগই পশ্চিমবঙ্গের বাইরে কর্মরত।
এ বছরের সমস্ত
বিজেতাই সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। দেখতে পাচ্ছি পুরস্কার প্রাপকদের অনেকেরই
কর্মস্থল আইআইটি, আইআইএসইআর, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ এন্ড
নিউরোসায়েন্সেস এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের মতো প্রতিষ্ঠান যেখানে একই
সঙ্গে শিক্ষাদান ও গবেষণা হয়। হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট মূলত গবেষণা
প্রতিষ্ঠান হলেও বর্তমানে সেখানে মাস্টার্স পড়ানো হয়। উন্নত দেশে প্রায় সমস্ত
বিজ্ঞান গবেষণাই কোনো না কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত হয়, বিজ্ঞানীদের প্রায়
সবাই ক্লাসে পড়ানোর সঙ্গে যুক্ত। আমাদের দেশে স্বাধীনতার আগে সমস্ত উল্লেখযোগ্য
গবেষণাই বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার পরে কেন্দ্রীয় সরকার কয়েকটি
কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করে এবং গবেষণার জন্য বরাদ্দ প্রায় সমস্ত অর্থই সেখানে
বিনিয়োগ করে। বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে গবেষণা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সে
সময় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এই নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। অনেকেই আমাদের দেশে
বিজ্ঞান গবেষণার উন্নতির শ্লথগতির জন্য দায়ী এই নীতিকে দায়ী করেন।
স্বাধীনতার
প্রায় ষাট বছর পরে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তাব্যক্তিদের হুঁশ ফেরে। অন্যান্য নানা
পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষাতে জোর দেওয়ার জন্য ২০০৭ সালে দেশের
বিভিন্ন অংশে কয়েকটি আইআইএসইআর বা ওই ধরনের প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়। অনেকগুলি নতুন
আইআইটিও শুরু হয়। তবে এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান প্রযুক্তির বাইরে চর্চার
বিশেষ সুযোগ নেই, তাই এতে মানববিদ্যা ও সমাজবিদ্যার হাল ফেরার আশা কম। অথচ সুসংহত
উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞান প্রযুক্তির পাশাপাশি এই সমস্ত বিষয়েও গবেষণা সমান জরুরি।
একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেই সমস্ত ধরনের চর্চা পাশাপাশি হওয়া সম্ভব। দুর্ভাগ্য
এই যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রতি সরকারের দৃষ্টি ফেরেনি। কোনো কেন্দ্রীয় বা
রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এ বছর ভাটনগর
পুরস্কারের তালিকাতে নেই, অন্যান্য বছরেও এর খুব একটা ব্যতিক্রম হয় না। অবশ্য
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিতে সমস্ত সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানেই
শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তবে তা পৃথক আলোচনার বিষয়।
প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক নভেম্বর ২০১৮