প্রয়াত হলেন কোয়ার্কের আবিষ্কর্তা মারে গেল-ম্যান
মারে গেল-ম্যান (১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ -২৪ মে, ২০১৯)[By I, Joi, CC BY 2.5] |
প্রয়াত
হলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী মারে গেল-ম্যান। সাধারণ মানুষের মধ্যে তিনি হয়তো খুব পরিচিত
ছিলেন না, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধের সেরা পদার্থবিজ্ঞানীদের কোনো
তালিকা থেকেই তাঁর নাম বাদ যাবে না। বিজ্ঞানের ইতিহাসে কণাদ বা ডেমোক্রিটাস যে
পরমাণুবাদের সূচনা করেছিলেন, তার সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ রূপ হল মৌলিক কণার কোয়ার্ক
মডেল। সেই তত্ত্বে যাঁর সবচেয়ে বেশি অবদান তিনি মারে গেল-ম্যান।
গেল-ম্যানের
জন্ম ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে। তাঁর পরিবার পূর্ব
ইউরোপ থেকে আমেরিকাতে এসেছিল। মহামন্দার সময় তাঁরা তীব্র আর্থিক দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যান। তবে গেল-ম্যান শিশু বয়স থেকেই ছিলেন প্রতিভাবান, তিনি
ছাত্রবৃত্তির সুযোগে পড়াশোনা চালাতে পেরেছিলেন। ১৯৪৮ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
পদার্থবিদ্যা নিয়ে স্নাতক হবার পরে তিনি মাত্র বাইশ বছর বয়সে ১৯৫১ সালে
ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে ডক্টরেট করেন, সুপারভাইসর ছিলেন বিখ্যাত
বিজ্ঞানী ভিক্টর ভাইসকফ। তাঁর প্রতিভার দিকে দৃষ্টি পড়েছিল বিজ্ঞানী রবার্ট
ওপেনহাইমারের। তিনি গেল-ম্যানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান
চর্চার সবথেকে বিখ্যাত কেন্দ্র প্রিন্সটনের ইন্সটিটিউট অফ অ্যাডভ্যান্সড সায়েন্সে
আমন্ত্রণ জানান। ১৯৫৪ সালে গেল-ম্যান শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে তিনি
বিখ্যাত বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মির সঙ্গে কাজ করেছিলেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত তিনি
ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে।
উনিশশো
চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে পরীক্ষামূলক কণাপদার্থবিজ্ঞানের দ্রুত অগ্রগতি ঘটেছিল। মহাজাগতিক
রশ্মির মধ্যে অনেক নতুন ক্ষণস্থায়ী কণার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল। এই কণাদের নানা
ধর্ম বিজ্ঞানীদের সমস্যায় ফেলেছিল। কিছু কণা
ছিল যাদের জীবনকাল এক সেকেন্ডের এক হাজার কোটি ভাগের এক ভাগ। শুনতে খুব কম মনে
হলেও বিজ্ঞানীদের কাছে তা ছিল অপ্রত্যাশিত রকম বেশি, তত্ত্ব অনুযায়ী এই সমস্ত কণার
আয়ু হওয়া উচিত ছিল এক সেকেন্ডের একশো কোটি কোটি কোটি ভাগের এক ভাগের কাছাকাছি। এর কারণ হিসাবে গেল-ম্যান ১৯৫৩ সালে এই
দীর্ঘস্থায়ী কণাদের জন্য স্ট্রেঞ্জনেস নামের এক নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যার প্রস্তাব
করেন। মোট চার রকম বল
আছে, স্ট্রং ফোর্স বা পীন বল, তড়িৎচৌম্বক বল, উইক ফোর্স বা ক্ষীণ বল এবং মাধ্যাকর্ষণ।
এদের মধ্যে চতুর্থটি খুবই দুর্বল, তাকে হিসাবে আনার প্রয়োজন নেই। গেল-ম্যান বলেন
কোনো স্ট্রেঞ্জ কণা যখন ভেঙে যায়, তখন তার স্ট্রেঞ্জনেস সংখ্যার পরিবর্তন ঘটে। পীন
বল বা তড়িৎচৌম্বক বল স্ট্রেঞ্জনেস সংখ্যার পরিবর্তন ঘটাতে পারে না, তা পারে
একমাত্র ক্ষীণ বল। নামেই বোঝা যাচ্ছে এই
বলের শক্তি খুব কম, সেজন্য কণার ভেঙে পড়ার হারও অনেক কম, তার স্থায়িত্বকাল বেশি। গেল-ম্যান তাঁর তত্ত্ব থেকে নতুন কিছু কণার কথা
বলেন, অচিরেই তাদের খুঁজে পাওয়া যায়।
১৯৫৮
সালে অপর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ফেইনম্যনের সঙ্গে তিনি ক্ষীণ বলের এক তত্ত্ব
প্রকাশ করেছিলেন। একই সময় ই সি জি সুদর্শন ও
রবার্ট মার্শাক অনুরূপ তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁদের তত্ত্ব ক্ষীণ বলের
সম্পর্কে সাম্প্রতিকতম আবিষ্কারকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়।
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পরের দুই দশকে অনেক নতুন নতুন কণাত্বরক তৈরি হয়েছিল যেখানে ইলেকট্রন
প্রোটন জাতীয় কণাদের উচ্চ শক্তিতে সংঘর্ষ ঘটানো হচ্ছিল। তার ফলে সৃষ্টি হচ্ছিল আরো
অনেক নতুন কণা। এত রকমের কণা আবিষ্কারের পরে তাদের শ্রেণিবিভাগের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল। একই
সঙ্গে মনে হচ্ছিল যে এই সমস্ত কণা, সবাই মৌলিক হতে পারে না। গেল-ম্যান এই নিয়ে
চিন্তা করছিলেন। এই কণাদের দুভাগে
ভাগ করা যায়। যে সমস্ত কণা পীন বলের বিক্রিয়াতে অংশ নেয় তাদের বলে হ্যাড্রন, যারা
নেয় না, তাদের বলে লেপ্টন। যেমন প্রোটন, নিউট্রন হল হ্যাড্রন, ইলেকট্রন হল লেপ্টন। ১৯৬১ সালে
গেল-ম্যান হ্যাড্রনদের শ্রেণিবিভাগের এক নতুন পদ্ধতি খুঁজে পান। এর ব্যাখ্যা জটিল
গণিত ছাড়া সম্ভব নয়। সহজ কথায় বললে, সবচেয়ে হালকা হ্যাড্রনদের আটটিকে এক দলে ফেলা
যায়। বৌদ্ধধর্মের অষ্টাঙ্গিক মার্গের কথা মনে রেখে গেল-ম্যান একে বলেন এইটফোল্ড
ওয়ে। এর ফলে পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্ম ও কণাপদার্থবিদ্যার
সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা শুরু হলে তিনি তাঁর খেয়ালের জন্য অনুতাপ করেছিলেন।
এইটফোল্ড
ওয়ে নজরকাড়া সাফল্য পায়। তার কারণ হিসাবে গেল-ম্যান ১৯৬৪ সালে বললেন প্রোটন
নিউট্রন আসলে মৌলিক কণিকা নয়, তারা প্রত্যেকে তিনটি করে কোয়ার্ক কণা দিয়ে তৈরি।
কোয়ার্ক শব্দটা তিনি পেয়েছিলেন জেমস জয়েসের ‘ফিনেগান্স ওয়েক’ উপন্যাসে। তাঁর
তত্ত্বে আপ, ডাউন ও স্ট্রেঞ্জ তিনরকমের কোয়ার্ক ছিল। এখন অবশ্য আমরা
জানি মোট ছ’রকমের কোয়ার্ক আছে। তাঁর এই মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি ১৯৬৯ সালে
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি কোয়ার্কদের কালার বলে আরও
এক ধর্মের কথা বলেন। রঙ বলতে আমরা যা
বুঝি তার সঙ্গে কালারের কোনো সম্পর্ক নেই। পীন বলের তত্ত্বের মূল স্তম্ভ এই কালার।
পরবর্তীকালে
গেল-ম্যান জটিল সিস্টেম বা তন্ত্রের বিজ্ঞান বিষয়ে উৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বই,
‘দি কোয়ার্ক এন্ড দি জাগুয়ার’ এ বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার পরিচয় বহন করে। পরিবেশ
আন্দোলনে অবদানের জন্য তিনি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে কণাপদার্থবিদ্যার
সবচেয়ে গৌরবময় যুগের এক মহীরুহের পতন ঘটল।
গৌতম
গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক জুন ২০১৯
গেল ম্যানের এই কোয়ার্ক তত্ত্বটি অজানা ছিল। খুব ভালো লেখা।
ReplyDelete