সাহা সমীকরণঃ শতবর্ষ
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
আমরা সবাই মেঘনাদ সাহার নাম জানি, এও জানি
যে তিনি যে তাপ-আয়নন সমীকরণ আবিষ্কার করেছিলেন তা এখন তাঁর নামে পরিচিত। সাহা
সমীকরণ হল জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার এক মূল স্তম্ভ। শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারের বৈশিষ্ট্য হল
যে বিশেষ ক্ষেত্রের জন্য সে প্রতিষ্ঠিত তাকেও ছাড়িয়ে যাবে। সাহা সমীকরণের জন্যও
একথা সত্য। আজ থেকে একশো বছর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে গবেষণারত
তরুণ মেঘনাদ সাহা তাঁর সমীকরণটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মেঘনাদ সাহার জীবন পাঠকের অজানা নয়। ঢাকার
কাছে শেওড়াতলি গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর তাঁর জন্ম।
শুধুমাত্র নিজের জেদের জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট দুটি পরীক্ষাতেই তৃতীয়
হয়েছিলেন, সারা পূর্ববঙ্গের মধ্যে প্রথম। এরপর গণিত নিয়ে পড়ার জন্য প্রেসিডেন্সি
কলেজে ভর্তি হলেন, সহপাঠী পেলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। বিএসসি ও এমএসসিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয়
হয়েছিলেন মেঘনাদ, প্রথম সত্যেন্দ্রনাথ। এমএসসি পাস করার পরে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
দুই বন্ধুকে মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত বিজ্ঞান
কলেজে পড়ানোর নির্দেশ দেন, কিছুদিন গণিত বিভাগে কাটিয়ে তাঁরা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে
পড়ানো ও গবেষণা শুরু করেন। তার চার বছরের মধ্যে মেঘনাদ আবিষ্কার করেন তাঁর বিখ্যাত
সমীকরণ যা নক্ষত্রদের অভ্যন্তরকে বোঝার চাবিকাঠি আমাদের হাতে তুলে দেয়। অল্প দিন
বিদেশের গবেষণাগারে কাটিয়ে ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯২৩
সালে তিনি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। চোদ্দ বছর পরে আবার কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ফিরে আসেন। সেখানেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স যা এখন তাঁর নামাঙ্কিত। ১৯৫৬ সালের ১৬
ফেব্রুয়ারি তাঁর জীবনাবসান হয়।
মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ দুজনেই নামে ছিলেন সি ভি
রমনের সহকারী, কিন্তু তাঁরা স্বাধীন ভাবেই কাজ করতেন। রমনও তাঁদের সেই নিয়ে কখনো
কিছু বলেন নি। গবেষণার ক্ষেত্রে সাধারণত একজন গাইড থাকেন যিনি দিকনির্দেশ করে দেন।
সেইরকম কেউ ছিলেন না, মেঘনাদ তাই বিকিরণ, স্থিতিস্থাপকতা, ইলেকট্রন তত্ত্ব এরকম নানা
বিষয়ে গবেষণা করছেন।
সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে একসঙ্গে গ্যাসের আণবিক গতি তত্ত্ব নিয়েও একটা গবেষণা
করেছিলেন। বিকিরণ ও তার চাপ সংক্রান্ত থিসিস
জমা দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি পান। মেঘনাদই বিজ্ঞান কলেজে পদার্থবিদ্যা
বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট।
১৯১৯ সালে ক্লাসে তাপগততত্ত্বে রাসয়ানিক বিক্রিয়া পড়ানোর
সময় জার্মান বিজ্ঞানী এগার্টের একটি গবেষণাপত্র তাঁর নজরে আসে। এগার্ট নক্ষত্রের ভিতরে উচ্চ তাপমাত্রায় পরমাণু ও আয়নের
ভেঙে যাওয়াকে তাপগতিতত্ত্বে রাসয়ানিক বিক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। মেঘনাদ
দেখলেন যে এগার্টের পদ্ধতিতে কয়েক বছর আগে আবিষ্কৃত নিলস বোরের পরমাণুর মডেল
ব্যবহার করা প্রয়োজন। বোরের মডেলে পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রনগুলি কয়েকটি
শক্তিস্তরে থাকতে পারে।
একটি
চিঠি। প্রেরক হেনরি নরিস রাসেল, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
প্রাপক মেঘনাদ সাহা।
“সৌর কলঙ্কের বর্ণালী বিশ্লেষণ করে ক্ষার ধাতুর অস্তিত্ব নিয়ে
আপনার ভবিষ্যৎবাণী পুরোপুরি মিলে গেছে। সূর্যে রুবিডিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
আমরা আপনার অন্যান্য সিদ্ধান্তগুলোও পরীক্ষা করে দেখছি।’
আর্থার
এডিংটন ছাত্রী সিসিলিয়া পেইনের উচ্ছ্বাস দেখে মনে মনে হাসলেন। ‘নক্ষত্রে
হাইড্রোজেনের পরিমাণ বেশি বলতে তুমি নিশ্চয় নক্ষত্রের বাইরের তলে বলতে চাইছ, ভিতরে
নয়।’
বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টের কথার প্রতিবাদ করতে
পেইনের গলা একটুও কাঁপল না। ‘না, আমি তারাদের অভ্যন্তরের কথাই বলছি। আপনিও রাসেলের
মতো একই ভুল করছেন। আপনি যদি মাউন্ট উইলসনের দূরবীন থেকে তারাদের বর্ণালীর যা
হিসাব পাওয়া গেছে, তা সাহার সমীকরণে বসান, একটাই সিদ্ধান্ত হয়। নক্ষত্রদের ভরের
নিরানব্বই শতাংশই হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম। ঠিক
আছে, আপনারা দুজনেই যখন বলছেন, আমি আমার থিসিসে হাইড্রোজেন আর হিলিয়ামের মাপটার
উপর জোর দেব না। কিন্তু, দেখে নেবেন, আমি ঠিকই বলছি। সাহার সমীকরণ থেকে আমরা
নক্ষত্ররা কী দিয়ে তৈরি, তা জানতে পারছি।’
‘তাই যদি হয়, তাহলে সাহা সমীকরণ হবে দূরবিন আবিষ্কারের পরে
জ্যোতির্বিজ্ঞানে সেরা দশ আবিষ্কারের একটা।’
এডিংটন নিজের মনেই ভাবলেন।
আমরা সবাই বর্ণালী কথাটা
শুনেছি। বর্ণালীতে আলো বিভিন্ন রঙে ভেঙে যায়। বিভিন্ন রঙের আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য
আলাদা আলাদা। সূর্যের বা অন্যান্য নক্ষত্রের আলোর বর্ণালীতে আমরা উজ্জ্বল
পশ্চাৎপটের ওপর কালো কালো দাগ দেখতে পাই। এই ধরনের বর্ণালীকে বলে শোষণ বর্ণালী। এর
উৎস কী? বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ বিভিন্ন
রঙের আলো শোষণ করে। সূর্যের কেন্দ্রের অঞ্চল (যেখানে
নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়াতে তাপ উৎপন্ন হয় বলে আমরা এখন জানি) প্রচণ্ড উত্তপ্ত, সেখান থেকে আলো বেরোয়। সূর্যের একদম বাইরের স্তর
আলোকমণ্ডল (photosphere) ও বর্ণমণ্ডল (chromosphere) যে সমস্ত মৌল আছে, তারা তাদের চরিত্র অনুযায়ী কোনো
কোনো তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে, ফলে সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের
আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় অপেক্ষাকৃত অনেক কম পরিমাণে। বর্ণালীতে সেই সমস্ত
তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জায়গায় কালো দাগগুলো দেখতে পাওয়া যায়। তাই সূর্যের বা অন্য
নক্ষত্রের শোষণ বর্ণালী বিশ্লেষণ করে কোন কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জায়গায় কালো দাগ
অর্থাৎ অন্ধকার, তা দেখে কোন কোন মৌলের পরমাণু সেখানে আছে তা
বলা সম্ভব।
বর্ণালীর চরিত্র বিশ্লেষণ করে হার্ভার্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকরা নক্ষত্রদের কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করেছিলেন। তাদের নাম দেওয়া
হয় O, B, A, F, G, K এবং M। রঙের দিক থেকে বললে
O শ্রেণির তারা নীল, তার
পর রঙ ক্রমশ লালের দিকে যায়। M তারা লাল। কিন্তু এই শ্রেণি
বিভাগের সঙ্গে তারকাদের গঠন বা ভৌত প্রকৃতির সম্পর্ক কী সে বিষয়ে কোনো ধারণা
আমাদের ছিল না। অবশেষে ভিনের সূত্র ব্যবহার করে তারার বর্ণালী বিশ্লেষণ করে
তারাদের উপরিতলের তাপমাত্রা সম্ভব হয়। তখন বোঝা গেল যে O তারাদের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশী। তারপর তাপমাত্রা কমতে থাকে। M
তারাদের তাপমাত্রা সবচেয়ে কম। গত শতাব্দীর একদম শুরুতে বর্ণালীর
চরিত্র বিশ্লেষণ করে জার্মানিতে এজনার হার্জস্প্রুং ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
হেনরি নরিস রাসেল তারাদের ঔজ্জ্বল্য ও তাদের বাইরের পিঠের তাপমাত্রার মধ্যে একটা
সম্পর্ক খুঁজে পান।
তারাদের
শ্রেণি অর্থাৎ তাপমাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন মৌলের শোষণ বর্ণালীর চরিত্রের পরিবর্তন হয়। বিভিন্ন মৌল বা আয়নের তীব্রতার হ্রাস বৃদ্ধি ও হার্ভার্ড
শ্রেণি বা তাপমাত্রার সম্পর্ক আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। যেমন O শ্রেণির
তারাদের বর্ণালিতে হিলিয়ামের শোষণ রেখা খুব শক্তিশালী। অন্যদিকে K বা M তারাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধাতুর রেখা খুবই
তীব্র। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে আয়নের কথা। নিস্তড়িৎ পরমাণু থেকে নক্ষত্রের
অভ্যন্তরের উচ্চ তাপমাত্রায় ইলেকট্রন বেরিয়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে পরমাণুটি আয়নে
পরিণত হবে। এই ধরনের আয়নদের রেখাও বর্ণালীতে পাওয়া যাচ্ছিল। কোনো ভাবেই নক্ষত্রদের
তাপমাত্রার সঙ্গে তার বর্ণালীর সম্পর্ক বোঝা যাচ্ছিল না। মেঘনাদ সাহা এই নিয়ে
চিন্তা করছিলেন। অন্য একটা সমস্যা তাঁকে ভাবিয়েছিল। সূর্যের সবচেয়ে বাইরের অংশ হল
বর্ণমণ্ডল, সেখানে ক্যালসিয়াম আয়নের রেখা দেখতে পাওয়া যায়। অথচ তার ভিতরের অংশ হল
আলোকমণ্ডল, সেখানে ক্যালসিয়াম আয়ন নয়, নিস্তড়িৎ ক্যালসিয়াম পরমাণুর রেখা দেখা যায়।
এর কারণ কী হতে পারে?
১৯১৯ সাল। মেঘনাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে
পদার্থবিদ্যার ক্লাসে তাপগতিতত্ত্ব পড়াচ্ছিলেন। রাসয়ানিক বিক্রিয়ার বিষয় পড়াতে
গিয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জার্মান বিজ্ঞানী এগার্টের একটি প্রবন্ধ। ১৯২০ সালে philosophical Magazine – এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধ সাহা যে সমীকরণ
দেন, তা পরবর্তী কালে সাহা আয়নের সমীকরণ (Saha
Ionization Equation) হিসেবে পরিচিত হয়েছে। সাহা ধরে নেন সূর্যের
মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রার জন্য পরমাণুরা আয়ন ও ইলেকট্রনে ভেঙে যায় এবং একই সঙ্গে আয়ন ও
ইলেকট্রন যুক্ত হয়ে পরমাণু গঠন করে। এই দুই বিক্রিয়া তাপীয় সাম্যাবস্থায় থাকে। সাহার গবেষণার বৈশিষ্ট্য
হল যে চিরায়ত তাপগতিবিদ্যা ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে টেনে দেখান পরমাণুর
আয়নন বিভব (ionization potential) এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা নেয়। কোনো পরমাণুকে আয়ন ইলেকট্রনে ভাঙতে গেলে যে পরিমাণ শক্তি দিতে
হয়, তাকে বলে আয়নন বিভব।
সাহার সমীকরণের রূপটি হল
log x2P/(1-x2) = -u/4.571T +2.5 logT - 6.5

সমীকরণ থেকে সাহা দেখাতে পারলেন
যে সূর্যের বর্ণমণ্ডলে তাপমাত্রা, চাপ ও অন্যান্য ভৌত অবস্থা
এমন যে সেখানে সমস্ত ক্যালসিয়াম পরমাণু একটি করে ইলেকট্রন ছেড়ে আয়নিত হয়ে যায়। আবার কেন্দ্রের আরো
কাছের আলোকমণ্ডলে তাপমাত্রা বেশী বটে, কিন্তু
চাপও অনেক বেশী। তাই সেখানে ক্যালসিয়াম পরমাণুর ইলেকট্রন ছাড়ার সম্ভাবনা কম। ফলে আলোকমণ্ডলের বর্ণালীতে
নিস্তড়িৎ ক্যালসিয়াম পরমাণুর এবং বর্ণমণ্ডলে আয়নের চিহ্ন দেখার সম্ভাবনা বেশি।
সাহার গবেষণা আরো এক সমস্যার সমাধান
করলো। সূর্যে রুবিডিয়াম, সিজিয়াম
ইত্যাদি ধাতুর চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সাহা বললেন এদের আয়নন
বিভব কম, তাই এরা সহজে আয়নিত হয়ে যায়। কোন মৌলের আয়ন যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের
আলো শোষণ করে তা ঐ মৌলের পরমাণুর থেকে আলাদা। আয়নিত হয়নি এমন অবস্থায়
ঐ মৌলের পরমাণুর চিহ্ন পেতে হলে অপেক্ষাকৃত শীতল অঞ্চলে দেখতে হবে। সৌর কলঙ্কের তাপমাত্রা
কম, তাই সেখান থেকে আসা আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করলে
রুবিডিয়ামের চিহ্ন পাওয়া যাবে। অচিরেই দেখা গেল সাহার কথা ঠিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি নরিস রাসেল সৌরকলঙ্কের বর্ণালীতে রুবিডিয়ামকে
খুঁজে পেলেন।
সাহা এই সময় অপর একটি গবেষণা পত্র
প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন। এর অল্প পরেই তিনি ইংল্যান্ডে আলফ্রেড ফাউলারের ল্যাবরেটরিতে
যান। ফাউলারের পরামর্শে তিনি গবেষণাপত্রটি নতুন করে লেখেন। বিদেশের পরীক্ষাগারে
কাজ করার সুবাদে সাম্প্রতিকতম তথ্য ব্যবহারের সুযোগ তিনি পান। তার ফলে মূল তত্ত্বটি
অপরিবর্তিত থাকলেও প্রবন্ধটির মানের অনেক উন্নতি ঘটে। এটিও তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজের
মধ্যে অন্যতম।
এই প্রবন্ধে সাহা বিভিন্ন তারার
বর্ণালীর এক সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানীরা বহু তারার
বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তারাদের রঙের সঙ্গে তাপমাত্রার একটা সম্পর্ক ছিল বলে
বোঝা যাচ্ছিল। যেমন নীল তারারা বেশী উত্তপ্ত, লাল তারাদের তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু তার সঙ্গে তারাদের
মধ্যে ভিন্ন মৌলের পরমাণুর শোষণ বর্ণালীর সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সাহা দেখান যে তাঁর
সমীকরণ সহজেই তারার তাপমাত্রার সঙ্গে শোষণ বর্ণালীর সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে পারে। যেমন অতি উত্তপ্ত তারাতে
সমস্ত হাইড্রোজেন আয়নিত হয়ে যায়, ফলে হাইড্রোজেনের
শোষণ তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ঐ তারাদের বর্ণালীতে থাকে না। আমরা জানি যে ধাতুর
আয়নন বিভবের মান কম, সুতরাং অপেক্ষাকৃত কম
তাপমাত্রাতেই ধাতু আয়নিত হয়ে যায়। কোনো সাধারণ পরমাণু এবং তার আয়নের
শোষণ তরঙ্গদৈর্ঘ্য কিন্তু এক নয়। যদি তারার তাপমাত্রা এতই কম হয় যে কোনো ধাতুর পরমাণু
আয়নিত না হয়ে অস্তিত্ব বজায় থাকতে পারে, একমাত্র
তখনই এই তারার বর্ণালীতে ধাতুর পরমাণুর শোষণের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। এভাবে সাহার কাজের ফলে
এক দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আগে মনে করা হত যে বিভিন্ন তারার উপাদান হয়তো আলাদা। এখন বোঝা গেল যে তা
নয়, তারাদের বর্ণালীর পার্থক্য হয় মূলত তাদের তাপমাত্রার
পার্থক্যের জন্য।
সাহা সমীকরণ আমাদের নক্ষত্রের
ভিতরে বিভিন্ন অংশে চাপ ও তাপ নির্ণয় করার সুযোগ করে দিল। শুধু তাই নয়, এই সমীকরণ
থেকেই আমরা নক্ষত্ররা কী কী মৌলিক পদার্থও দিয়ে তৈরি তা বার করতে পারি। আমরা
দেখেছি যে সমীকরণ থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে সমস্ত নক্ষত্রের উপাদানই এক। কোন মৌল কত
পরিমাণে আছে, তা জানার জন্য এর আগে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। যেমন
এক পদ্ধতিতে ধরা হয়েছিল যে মৌলের শোষণ রেখার তীব্রতা যত বেশি, তার পরিমাণও তত বেশি। হেনরি নরিস রাসেল দেখলেন যে পৃথিবীর উপরিভাগে ভূত্বকে
যে ছটি মৌল সবচেয়ে বেশি আছে, সৌর বর্ণালীতে তাদের
তীব্রতার মান খুব বেশি। তাই একটা ধারণা জন্মেছিল যে সূর্য ও পৃথিবী আসলে একই
উপাদান দিয়ে তৈরি। রাসেলেরও আগে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে হেনরি রোল্যান্ড বলেছিলেন
যে পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি সূর্যের মতো হত, তাহলে
তার বর্ণালীও সূর্যের মতোই হত।
আমরা দেখে নিই এই ছটি মৌল কী কী। ভূত্বকে অক্সিজেন আছে
৪৬.১ শতাংশ, সিলিকন আছে ২৮.২ শতাংশ, অ্যালুমিনিয়াম ৮.২ শতাংশ, লোহা ৫.৬ শতাংশ,
ক্যালসিয়াম ৪.১ শতাংশ ও সোডিয়াম আছে ২.৪ শতাংশ। সূর্যের বর্ণালী বিশ্লেষণ করে যে
ঠিক এই সংখ্যাগুলোই পাওয়া যাচ্ছিল তা নয়, কিন্তু তাদের মধ্যে মিল ছিল। সাহার
সমীকরণ কিন্তু অন্য কথা বলছিল, আর সে কথা বুঝতে পেরেছিলেন এক তরুণী বিজ্ঞানী সিসিলিয়া
পেইন।
সাহার সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছিল যে
নক্ষত্রের ভিতর সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আছে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। অথচ পৃথিবীতে
হাইড্রোজেনের পরিমাণ খুব কম, হিলিয়াম নেই বললেই চলে। মেঘনাদ সমেত প্রায় কোনো
বিজ্ঞানীই তাই বিশ্বাস করতে পারেন নি, ভেবেছিলেন যে কোনো কারণে হয়তো এই দুটি
গ্যাসের জন্য সাহা সমীকরণ কাজ করে না। সিসিলিয়া পেইন ছিলে বিখ্যাত
জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের ছাত্রী, তিনি হেনরি রাসেলের সঙ্গেও কাজ করছিলেন।
তিনিই প্রথম জোর দিয়ে বলেন যে সাহা সমীকরণ ঠিক, সূর্য সহ অধিকাংশ নক্ষত্রের মূল
উপাদান হল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। এ ব্যাপারে তিনি এডিংটন ও রাসেল দুজনের সঙ্গেই
দ্বিমত পোষণ করেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল পেইনই ঠিক, সূর্যের মোট ভরের আটানব্বই
শতাংশই হল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। শুধু সূর্য কেন, আধুনিক কালে আমরা জানি যে
মহাবিশ্বের মধ্যে সাধারণ যে সমস্ত পদার্থ আছে, তারও প্রায় ৭৪ শতাংশ হল হাইড্রোজেন
ও প্রায় ২৪ শতাংশ হিলিয়াম। বাকি সমস্ত মৌলের পরিমাণ মাত্র দুই শতাংশ।
হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পরিমাপের গুরুত্ব
জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে খুব বেশি। প্রথমত সূর্য সহ অধিকাংশ নক্ষত্রের
অভ্যন্তরে নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়ায়
চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস মিলে তৈরি করে একটি হিলিয়াম পরমাণুর
নিউক্লিয়াস। এই প্রক্রিয়ায় যে
শক্তি উৎপন্ন হয় তাই হল নক্ষত্র থেকে যে তাপ বা আলো বেরোয় তার উৎস। নক্ষত্রের মূল
উপাদান যে হাইড্রোজেন তা না জানলে আমরা কোনোদিনই নক্ষত্রদের শক্তি আসে কোথা থেকে
তা বুঝতে পারতাম না। তেমনি বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের সময় হাইড্রোজেন থেকে
হিলিয়াম তৈরি হয়েছিল। সেই সময় মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ও ঘনত্ব আমরা বিশ্বে
হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের অনুপাত থেকে বুঝতে পারি। এ সবই অবশ্য সাহার গবেষণার অনেক
পরের ঘটনা।
তাই সাহার এই গবেষণা তাই জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার
ক্ষেত্রে যুগান্তর ঘটিয়েছিল বললে মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না। দেড় দশক পরে ১৯৩৬ সালে Oxford University Press থেকে প্রকাশিত Theoretical
Astrophysics গ্রন্থে লেখক রোসল্যান্ড লিখছেন, ‘…. It was
the Indian Physicist Meghnad Saha who (1920) first attempted to develop a
consistent theory of the spectral sequence of the stars from the point of view
of atomic theory. …..From that time dates the hope that a thorough analysis of
stellar spectra will afford complete information about the state of the stellar
atmospheres, not only as regards the chemical composition, but also as regards
the temperature and various deviations from a state of thermal equilibrium, the
density distribution of the various elements, the value of gravity in the
atmosphere and its state of motion. The impetus given to Astrophysics by Saha’s
work can scarcely be overestimated, as nearly all later progress in this field
has been influenced by it and much of the subsequent work has the character of
refinements of Saha’s ideas.’ সংক্ষেপে বলা যায় যে সাহার গবেষণাই তাদের
অভ্যন্তরের ভৌত অবস্থা সম্পর্কে অনেক সঠিক তথ্য পাওয়ার পথ খুলে দেয় এবং জ্যোতির্পদার্থবিদ্যাকে
এক পরিমাণগত বিজ্ঞানে পরিণত করে। বিখ্যাত আর্থার এডিংটনের মতে গ্যালিলিওর
টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সেরা দশটি আবিষ্কারের অন্যতম হল সাহা আয়নন
সমীকরণ।
একশ বছর পরেও সাহা সমীকরণ কোথায়
কোথায় আমাদের প্রয়োজন, সে বিষয়ে দু একটা কথা বলে শেষ করা যাক। নক্ষত্রের মডেল করতে
সাহা সমীকরণ দরকার হয় কারণ সেখানে আয়ন ও ইলেকট্রনের সংখ্যা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
নেয়। সাহার সমীকরণ পরমাণুর আয়নন ছাড়া অন্য কাজেও লাগে। যেমন কোনো কোনো বিক্রিয়াতে
পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন বা নিউট্রন যুক্ত হতে পারে, আবার একই সঙ্গে উচ্চ তাপমাত্রায় প্রোটন বা নিউট্রন নিউক্লিয়াস
থেকে বেরিয়েও যেতে পারে। নিউক্লিয়াসে প্রোটন বা নিউট্রনের একটা বন্ধনী শক্তি
আছে যা পরমাণুর আয়নন বিভবের সঙ্গে তুলনীয়। এই দুই বিপরীত প্রক্রিয়া যদি তাপীয়
সাম্যাবস্থায় থাকে তাহলে সাহা সমীকরণ ব্যবহার করা হয়। এ ধরণের বিক্রিয়া ঘটে
মহাকাশে এক্স রে বার্স্টার বা সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময়। বিশেষ করে
সুপারনোভা বিস্ফোরণ লোহার থেকে ভারি মৌল সৃষ্টির অন্যতম উৎস বলে আমরা মনে করি।
বিগ ব্যাঙের পরে মহাবিশ্বের বিবর্তন বুঝতে
বিভিন্ন স্তরে সাহা সমীকরণ প্রয়োগ করতে হয়। যেমন আদিতে তাপমাত্রা ও ঘনত্ব ছিল খুব
বেশি, তখন নিউট্রিনো ও ইলেকট্রনের বিক্রিয়ার মাধ্যমে নিউট্রন ও প্রোটন পরস্পরের
মধ্যে পরিবর্তিত হচ্ছিল। মহাবিশ্ব যত
প্রসারিত হচ্ছিল, তত শীতল হচ্ছিল। তাপমাত্রা একটু কমলে প্রোটন ও নিউট্রন মিলে তৈরি
করে ভারি হাইড্রোজেনের পরমাণু। এই দুই ঘটনাকেই আমরা আয়ননের অনুরূপ ভাবতে পারি।
আবার বিগ ব্যাঙের পরে দীর্ঘ সময় তাপমাত্রা ছিল পরমাণুর অস্তিত্বের পক্ষে বেশি।
একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রন যুক্ত হয়ে হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরি করে। উচ্চ
তাপমাত্রায় পরমাণু আবার ভেঙেও যেতে পারে।
ফলে এই সময়েও হাইড্রোজেন পরমাণু এবং প্রোটন-ইলেকট্রন তাপীয় সাম্যাবস্থায়
ছিল। তাই সাহা সমীকরণ এখানেও প্রযোজ্য।
মেঘনাদ সাহা তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ আবিষ্কার
করেছিলেন কলকাতাতে বসে, সে বিষয় গবেষণাপত্রগুলিও তিনি ভারত থেকেই প্রকাশের জন্য
প্রথম পাঠান। কিন্তু সেগুলি যখন প্রকাশিত হয়, তখন সাহা ফাউলারের গবেষণাগারে কাজ করেছিলেন। তাই বহুদিন পাশ্চাত্যে ধারণা ছিল যে সাহা ফাউলারের
অধীনে কাজ করেই তাঁর তাপ আয়নন সমীকরণ আবিষ্কার করেন। সাহার কাজের মূল অংশ
কিন্তু কলকাতায় বসে করা, পরে ফাউলারের গবেষণাগার থেকে অনেক নতুন তথ্য পাওয়ার ফলে
তিনি তাঁর সমীকরণের পক্ষে আরো বেশি প্রমাণ সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। অনেক অসুবিধার মধ্যে
প্রায় কোনো পরিকাঠামো ছাড়াই তিনি সর্বোচ্চ মানের গবেষণা করেছেন। শুধুমাত্র নক্ষত্র নয়, মহাবিশ্বের বিবর্তনের
ইতিহাস জানতে প্রয়োজন সাহা সমীকরণ। আবিষ্কারের একশো বছর পরেও তা সমান প্রাসঙ্গিক।
প্রকাশঃ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার, শারদ সংকলন ২০১৯
প্রকাশঃ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার, শারদ সংকলন ২০১৯
খুবই ভালো লাগল। কষ্ট লাগে এই আবিষ্কারের জন্য সাহা নোবেল পুরস্কার পাননি বলে।
ReplyDelete