Saturday, 19 November 2022

গ্যালিলিওর ভুল

 


গ্যালিলিওর ভুল

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       ‘ম্যাডাম? আপনার কয়েক মিনিট সময় হবে?’ দরজা ঠেলে সোম মুখ বাড়াল।

       সোম আমাদের ডিভিশনের সবচেয়ে জুনিয়র স্টাফ, এমএসসি পাস করেই সবে গত বছর জয়েন করেছে। ছেলেটা সত্যিই ব্রিলিয়ান্ট সন্দেহ নেই। আমি নিজে ওর ইন্টারভিউতে ছিলাম, অসাধারণ ভালো করেছিল। আমি শেষকালে মজা করেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তোমার নামের সঙ্গে মিল আছে, এমন জায়গায় কাজ করবে?’  এক মুহূর্ত না ভেবে উত্তর দিয়েছিল, ‘নিশ্চয়।’ এক বছরও হয়নি চাকরিতে ঢুকেছে, এর মধ্যেই মাঝে মাঝে মনে হয় যে ওকে ছাড়া আমাদের লুনার ডিভিশনের অর্ধেক কাজ বন্ধ হয়ে যাবে।

       আজ আমি সত্যিই ব্যস্ত। চাঁদে মানুষ নেমেছিল সেই কবে, তারপর শুধু আমেরিকাই আরও কয়েকটা মিশন পাঠিয়েছিল। তাও অনেক বছর হয়ে গেল। চাঁদে শেষবার মানুষের পা পড়ার পর পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে, আর কেউ চেষ্টাও করেনি। এত বছর পরে আমরা আবার চাঁদে মানুষ পাঠাব। আমাদের যান কোথায় নামবে ঠিক করতে হবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে। তবু সোম যখন বলছে, নিশ্চয় দরকারি কথা। ‘এসো।

       সোম চেয়ারে বসে বলল, ‘আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই।’

       আমি কম্পিউটারের দিকে হাত বাড়ালাম। সোম বলল, ‘না না, এখনো কিছু পাঠাইনি আপনাকে। আমার ল্যাপটপে আছে। সত্যি কথা বলতে কি, নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না কী করব। প্রিন্ট আউট নিয়ে এসেছি।’ আমার দিকে কয়েকটা কাগজ এগিয়ে দিল।

       উপরের কাগজটা হাতে নিলাম। চাঁদের ফটো। এ ছবি আমার প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। চোখ বুজে  এঁকে দিতে পারি। তবে এটা অষ্টমীতে তোলা আধখানা চাঁদের ছবি, বাকিটা অন্ধকারে ঢাকা। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।

       ‘এবার এটা দেখুন।’

       একটা পুরানো বইয়ের পাতার কপি, সেখানেও অর্ধেক চাঁদ, হাতে আঁকা। চাঁদের বুকের উল্কা গহ্বর, পাহাড় এগুলো দেখানো হয়েছে। ফটোগ্রাফের মতো নয়, কিন্তু বেশ ভালো। ‘এটা কোথা থেকে পেলে?’

       ‘এটা গ্যালিলিওর সাইদেরাস নানসিয়াস বই থেকে পেয়েছি।’ ওরে বাবা, সে তো খুব বিখ্যাত বই। তার মানে গ্যালিলিও দূরবিন দিয়ে  চাঁদ দেখে যে ম্যাপ এঁকেছিলেন, এটা সেই ছবি। আমি পড়িনি, তবে এটা খুব ভালো জানি যে বিজ্ঞানের ইতিহাসে সেই বইয়ের বিরাট ভূমিকা আছে। কিন্তু সোম এটা আমাকে দেখাতে এনেছে কেন?

       ‘দুটোর মধ্যে তফাতটা দেখতে পাচ্ছেন?’

       গ্যালিলিওর ছবিটা ভালো করে দেখলাম। ‘আরে, মাঝখানের এই বড় গহ্বরটা কোথা থেকে এলো? এরকম কিছু তো চাঁদে নেই।’ গ্যালিলিও অবশ্য গহ্বর বলেননি, ওগুলোকে সমুদ্র ভেবেছিলেন।

       ‘ঠিক। বিজ্ঞানের ঐতিহাসিকরা মনে করেন গ্যালিলিও ইচ্ছে করে ওই গহ্বরটাকে বড় করে এঁকেছিলেন, যাতে ছবিটা বেশ চমকপ্রদ হয়। এবার পরের কাগজটা দেখুন।’

       পরের কাগজটাও অর্ধেক চাঁদের হাতে আঁকা ছবি। ‘এটাও কি ওই একই বইয়ের?’

       না, এটা টমাস হ্যারিয়ট বলে এক ইংরেজের আঁকা। বিষয়টা খেয়াল করেছেন?’

       ‘হ্যাঁ, এখানেও ঠিক একই জায়গায় একটা গহ্বর আছে। তাতে কি হল? হয়তো গ্যালিলিওর বই দেখেই ছবিটা এঁকেছিল।’

       ‘এই ছবিটা ১৬১০ সালের ১৭ জুলাই আঁকা, গ্যালিলিওর বইটা প্রকাশিত হয়েছিল সে বছর মার্চ মাসে। হতেই পারে ম্যাপটা গ্যালিলিওর বই দেখে আঁকা। হ্যারিয়ট ছিলেন জ্যোতির্বিদ, তিনি নিশ্চয় গ্যালিলিওর বইটা পড়েছিলেন। হ্যারিয়ট বেশ বড় বিজ্ঞানী ছিলেন, বস্তুর পতনের সূত্রগুলো তিনিও আবিষ্কার করেছিলেন। গ্যালিলিও সূত্রগুলো ছাপিয়েছিলেন, তিনি ছাপান নি।  তিনি নিজেই ১৬০৯ সালের জুলাই মাস থেকেই দূরবিন দিয়ে চাঁদ পর্যবেক্ষণ করছিলেন আর এঁকে রাখছিলেন, মানে গ্যালিলিওরও আগে। তবে তিনি বইতে ছাপাননি বলে বহু বছর পরে এসব কথা জানা গেছে।  এক বছর আগে তাঁর আঁকা ছবিতেও কিন্তু এই গহ্বরের মতো একটা কিছু আছে বলেই আমার মনে হচ্ছে, আপনি দেখুন।’

       পরের ছবিটা অত ডিটেল্‌ড নয়, কিন্তু মনে হল একই জায়গায় একটা গহ্বর মতো আছে। নাকি সোমের কথা শুনে আমি প্রভাবিত হলাম? ‘বুঝলাম। কিংবা বুঝিনি। কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের কাজের কী সম্পর্ক? আমি এ দেখে কী করব?’

       ‘ম্যাডাম, এমন যদি হয় যে ওখানে একটা বড় গহ্বর গ্যালিলিও আর হ্যারিয়টের সময় ছিল, কিন্তু এখন আর নেই।’

       আমি কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম, তারপর হাসিতে ফেটে পড়লাম। ‘সোম, তুমি বড্ড বেশি চাপ নিচ্ছ। কদিন ছুটি নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে এসো।’

       ‘আমি জানতাম আপনি এই কথাই বলবেন। কিন্তু কেন একটু বুঝিয়ে দিন।’

       গ্যালিলিওর বইয়ের ছবির কপিটা হাতে নিলাম। ‘এই গহ্বরটা অন্তত চারশো কিলোমিটার চওড়া।’ চাঁদের ব্যাস আমার জানা, তার থেকে আন্দাজ করলাম।

       ‘চারশো পঁচিশ কিলোমিটার,’ সোম সঙ্গে সঙ্গে বলল।

       ‘তাহলে চারশো পঁচিশ কিলোমিটার চওড়া একটা খাদ কি উবে গেল নাকি? নতুন গহ্বর তৈরি হতে পারে, কিন্তু পুরানোগুলো কোথায় যাবে?’  চাঁদের বুকে গহ্বরগুলো তৈরি হয়েছিল বড় বড় গ্রহাণু আর উল্কার সঙ্গে ধাক্কা লাগার ফলে। গত চারশো বছরের মধ্যে আর একটা বড় সংঘর্ষ হয়ে থাকতেও পারে, যদিও সেরকম কোনো রিপোর্ট নেই। কিন্তু সব সময় তো চাঁদকে পৃথিবী থেকে দেখা যায় না, তাই তর্কের খাতিরে নতুন গহ্বর সৃষ্টির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু চাঁদে নদী সমুদ্র বায়ুমণ্ডল নেই, ভূমিকম্প হয় না, সেখানে একবার কোনো গহ্বর তৈরি হলে তা চিরকালের জন্যই থেকে যাবে।

       ‘আমারও সেটাই প্রশ্ন,’ সোম উত্তর দিল।

       ‘ভুল দেখেছিলেন, বা ভুল এঁকেছিলেন, এটাই মেনে নিতে হবে। প্রথমদিকের টেলিস্কোপ নিশ্চয় খুব নির্ভরযোগ্য ছিল না। গ্যালিলিও একটু প্রচার ভালোবাসতেন, সেইজন্যই ছবিটাতে গহ্বরটা বাড়িয়ে দেখিয়েছিলেন। তুমিই তো বললে যে লোকজন তাই মনে করে।’

       ‘গ্যালিলিও প্রচার ভালোবাসতেন সেটা ঠিক, কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি কোনো কিছু বাড়িয়ে বলতেন বলে মনে হয় না।’ সে কথাটা হয়তো ঠিক। মাত্র কয়েকবছর হল গ্যালিলিওর নোট থেকে দেখা গেছে যে তিনি নেপচুন গ্রহকে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারেননি বলে কাউকে জানান নি। তার প্রায় আড়াইশো বছর পরে গ্রহটা আবিষ্কার হয়। ‘সোম, তুমি কী বলতে চাইছ, আরও একটু পরিষ্কার করে বলো।

       ‘ম্যাডাম, এমন যদি হয় যে,’ এক মুহূর্ত থেমে সোম আবার শুরু করল। ‘এমন তো হতেও পারে যে এর মধ্যে ওই গহ্বরটা কেউ বুজিয়ে দিয়েছে।’

       আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, ‘চারশো কিলোমিটার চওড়া একটা গর্ত বুজিয়ে দিয়েছে! কে বুজিয়ে দিয়েছে?’

       ‘মানে, পৃথিবীতে অন্য গ্রহের প্রাণীদের আসার কথা তো কত শোনা যায়, হয়তো তার মধ্যে একটা সত্যি হতেই পারে। হয়তো সেই প্রাণীরাই ...’ 

       না:, এবার সত্যিই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। ‘সোম, ওসব কল্পবিজ্ঞানের গল্পে পাওয়া যায়, বাস্তবে নয়। যদি এসেও থাকে, তাদের কাজকর্ম নেই, খামোখা চাঁদের বুকে একটা গহ্বর বন্ধ করে যাবে কেন? আর পশ্চিমবঙ্গের থেকে বড় একটা গহ্বর বোজানো কি সম্ভব? এইরকম একটা কাজ চাঁদের বুকে হল অথচ  কারোর সেটা চোখে পড়ল না, এতবার চাঁদে অভিযান গেল কিন্তু কেউ কিছু দেখতে পেল না – এ আবার হয় নাকি?’

       ‘ম্যাডাম, আপনি ভালোই জানেন, মাসের মধ্যে অনেকটা সময় চাঁদের ওই অংশটা অন্ধকারে ঢাকা থাকে। খুব ভালো দূরবিন তৈরি হওয়ার আগে সেই সময় সেখানে কী হচ্ছে কারোর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। ওই জায়গাটার কাছাকাছি কোনো চন্দ্র অভিযান হয়নি। ভিনগ্রহবাসীরা কী পারে আর কী পারে না, তা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব? কেন একটা খাদ বুজিয়েছে তা আমি কী করে বলব? হয়তো ওর নিচে ভিনগ্রহীরা একটা স্টেশন বানিয়েছে, সেখানে থেকে আমাদের উপর নজর রাখছে। আমরাও চাঁদে স্থায়ী স্টেশনে তৈরির কথা ভাবছি, সেটা তো মাটির নিচেই করতে হবে।’

       এই কথাবার্তা শেষ করার সময় এসেছে। ‘সোম তোমার কথা শুনলাম। সে যাই হোক, তার সঙ্গে আমাদের ডিভিশনের কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। আজ সন্ধে হয়ে গেছে, বাড়ি যাও। কাল থেকে মন দিয়ে অফিসের কাজ কোরো।’

       ‘ম্যাডাম, আমি বলতে চাইছিলাম যে আমরা কী ওই জায়গাটার কাছাকাছি কোনো ল্যান্ডিং স্পট বাছতে পারি? তাহলে প্রমাণ হয়ে যাবে আমার কথা ঠিক না ভুল।’

       ‘দেখো সোম, আমি যদি এই সমস্ত কথা রিপোর্টে লিখে, লোকে আমাকে পাগল বলবে।’

       ‘না ম্যাডাম, এসব কথা লিখবেন না। আমি নিশ্চিত যে সেই প্রাণীরা আমাদের উপর নজর রাখে। সেই জন্যই আমি আপনাকে মেল করিনি। যারা অন্য নক্ষত্র থেকে আসতে পারে, আমাদের উপর নজর রাখা, আমাদের মেলের এনক্রিপশন ভাঙা ওদের কাছে জলভাত। আমি যা বুঝেছি, সবই আমার ল্যাপটপে আছে। কিন্তু মেলে পাঠাব না।’

       একবছর একসঙ্গে কাজ করলাম, সোমটা যে এত প্যারানয়েড জানা ছিল না। অবশ্য ব্রিলিয়ান্ট লোকজন একটু আনস্টেবল হয়। ‘সে কথা যদি তোলো, তুমি যে এত কথা আমাকে বললে, আমার ঘরের ক্যামেরা তো চালু আছে, সমস্ত রেকর্ড হয়েছে। সেটাও তো তাহলে তোমার ইটিরা দেখে নিতে পারে। তাহলে?’

       সোম উঠে দাঁড়ালো, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ভয়ে। ‘আপনার ক্যামেরা চালু ছিল? আমাদের সব ফাইলই তো ডিভিশনের মেন কম্পিউটারে যায়, সেটা তো ইন্টারনেটে কানেক্টেড। তাহলে তো?‘

       এতো পুরো বেহেড হয়ে গেছে। আমি ওকে ঠাণ্ডা করার জন্য বলি, ‘তাহলে তো কী? সেটাতে কি বাইরে থেকে অ্যাক্সেস করা যায় নাকি? চিন্তা কোরো না, তুমি বাড়ি যাও, আমি ফাইলটা মুছে দেব।’

       ‘এখনি মুছে দিন, ম্যাডাম। হয়তো অলরেডি দেরি হয়ে গেছে, তবু এখনি মুছে দিন। আমার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে লুনার ডিভিশনের উপর নিশ্চয় নজর আছে। আমাদের ফায়ারওয়াল ভেঙে কম্পিউটারে অ্যাক্সেস করা ওদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়।’

       আমি একটু কড়া হলাম। ‘দেখো সোম, অনেকক্ষণ তোমায় সময় দিয়েছি। আমার অনেক কাজ আছে। আমি বলেছি তো ফাইলটা মুছে দেব। সেরকম বুঝলে তুমি কদিন ছুটির আবেদন করতে পারো, আমি অ্যাপ্রুভ করে দেব। এখন তুমি আসতে পারো।’

       সোম আরও কিছুক্ষণ আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, আমি আর পাত্তা দিইনি। মনে মনে ঠিক করে রাখলাম, কালকেই ডিভিশনের সাইকিয়াট্রিস্টকে বলব সোমের সঙ্গে কথা বলতে। আমি কাজে মন দিলাম, সোমকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলেছি ফাইলটা মুছে দেব, নিশ্চয় দেব। কিন্তু পরে করলেও চলবে।

       অনেক কাজই ছিল, বাড়ি যেতে দেরি হচ্ছে। অফিসের সবাই বেরিয়ে গেছে, আমি একাই কাজ করে যাচ্ছি। ঘণ্টা চারেক পরে মোবাইলটা বেজে উঠল। আমার ডেপুটি চৌধুরি ফোন করেছে।

       ‘ম্যাডাম, আপনি শুনেছেন? একটা খারাপ খবর আছে। সোমের গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে, ওকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু তার আগেই মারা গেছে।’

       ‘সে কি, সোম তো খুব সাবধানী ড্রাইভার।’ ওর মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না, আমার হয়তো ওকে আজ গাড়ি চালাতে বারণ করা উচিত ছিল।

       ‘না, পুলিস বলছে ড্রাইভারের দোষ নয়। হঠাৎ করে গাড়ির সমস্ত ইলেক্ট্রনিক্স ক্র্যাশ করেছে।  আধুনিক গাড়ি পুরোপুরি ইলেক্ট্রনিক্স কন্ট্রোল্‌ড, তাই সোম একেবারেই সামলাতে পারেনি। সোজা গিয়ে একটা দেয়ালে ধাক্কা মেরেছে। এরকম ইলেক্ট্রনিকালি ডেড গাড়ি নাকি পুলিসের কেউ আগে দেখেনি। আরও স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার হল যে ওর ল্যাপটপটা ছিল পিছনের সিটে। সেটার ফিজিক্যালি কোনো ক্ষতি হয়নি, কিন্তু সেটাও ইলেক্ট্রনিকালি ডেড। একই সঙ্গে এরকম কি করে হতে পারে কেউ বুঝতে পারছে না।’

       আমি মোবাইলটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। কথা বলতে পারছিলাম না।

       ‘ম্যাডাম, আপনি ঠিক আছেন তো?’ চৌধুরির গলাটা উদ্বিগ্ন শোনাল।

       মোবাইলটা টেবিলে রেখে আমি কম্পিউটার থেকে সিকিউরিটি সিস্টেমে লগ ইন করলাম। আমার ঘরের ক্যামেরার বিকেলের ফাইলটা আরেকবার দেখি।

       ‘ম্যাডাম, ম্যাডাম,’ চৌধুরি ডাকছে। আমি আতিপাতি করে খুঁজে চলেছি, কিন্তু ফাইলটা নেই। আমার আগেই কেউ সেটা মুছে দিয়েছে।

       ফোনটা কেটে গেল। চোখের সামনে এনে দেখলাম সেটা একেবারে ডেড। অথচ একটু আগেও ফিফটি পার্সেন্ট চার্জ ছিল।

       ফোনটা থেমে যাওয়ার পরে ফাঁকা অফিসের নৈঃশব্দটা মনের উপর চেপে বসছিল। হঠাৎ একটা খড়খড় আওয়াজে চমকে উঠলাম। টেবিলের এককোণে পড়ে ছিল সোমের কাগজগুলো, সবার উপরে গ্যালিলিওর আঁকা চাঁদের ছবিটা। আমার ঘরের দরজা বন্ধ, তবু হঠাৎ কোথা থেকে একটা দমকা হাওয়া এসে সেটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

প্রকাশ- ছোটদের কলরব ২০২২

        

Friday, 18 November 2022

নিল্‌স বোরের নোবেল পুরস্কারঃ শতবর্ষ

 

নিল্‌স বোরের নোবেল পুরস্কারঃ শতবর্ষ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


১৯২২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন নিল্‌স বোর। অবশ্য ১৯২১ সালের ঐ বিষয়ের নোবেল পুরস্কারও একই সঙ্গে ঘোষণা করা হয়েছিল, এবং সেই পুরস্কার পেয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। আইনস্টাইন পুরস্কার জিতেছিলেন আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা দেওয়া জন্য, নিল্‌স বোর নোবেল পেয়েছিলেন পরমাণুর গঠন ও তার থেকে তার বর্ণালীর ব্যাখ্যার স্বীকৃতিতে। এই দুটিকেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের দুটি মৌলিক স্তম্ভ বলে ধরা হয়।

একই দিনে একই মঞ্চ থেকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্য দুটি নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল, এই ঘটনা আপতিক নয়। কোয়ান্টাম তত্ত্ব তখন পদার্থবিজ্ঞানীদের মনোযোগ অধিকার করে রেখেছিল। কৃষ্ণ বস্তুর থেকে নির্গত তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের বিকিরণের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১৯০০ সালে মাক্স প্লাঙ্ক প্রথম কোয়ান্টাম তত্ত্বের ব্যবহার করেন। প্লাঙ্ক দেখান যে বিকিরণ বা শোষণের সময় তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের শক্তির পরিমাণ যেমন খুশি হতে পারে না; একটা নির্দিষ্ট ন্যূনতম পরিমাণের গুণিতক পরিমাণ শক্তি নির্গত বা শোষিত হয়। এই ন্যূনতম শক্তির পরিমাণকে প্লাঙ্ক বললেন কোয়ান্টাম। যদি তরঙ্গের কম্পাঙ্ক n হয়, তাহলে কোয়ান্টামের মাপ হল hn। এখানে h একটি ধ্রুবক, এখন আমরা তাকে বলি প্লাঙ্কের ধ্রুবক। আলোও এক ধরনের তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ; পাঁচ বছর পরে আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আইনস্টাইন দেখান যে এই কোয়ান্টামের নির্দিষ্ট ভরবেগ আছে, অর্থাৎ সে কণার মতো আচরণ করে। এত সত্ত্বেও খুব কম বিজ্ঞানীই কোয়ান্টামে বিশ্বাস করতেন বা তা নিয়ে উৎসাহী ছিলেন। তার কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীর পদার্থবিদ্যার কাঠামোর মধ্যে কোয়ান্টামকে জায়গা করে দেওয়া সম্ভব ছিল না। কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ বা আলোকতড়িৎ বিক্রিয়ার মতো সামান্য দু'একটি ঘটনার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এতদিনের শিক্ষা বা জ্ঞানকে বিসর্জন দিতে বিজ্ঞানীরা তৈরি ছিলেন না।

 

বোর ও আইনস্টাইন 



নিল্‌স বোরের জন্ম ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ১৮৮৫ সালে। কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করার পরে তিনি ইলেকট্রনের আবিষ্কর্তা জে জে টমসনের সঙ্গে গবেষণা করার জন্য ১৯১১ সালে কেমব্রিজে যান। তিনি ঠিক করেছিলেন যে পরমাণুর গঠন বিষয়ে গবেষণা করবেন, কিন্তু বিশেষ এগোতে পারছিলেন না। এই সময়েই তাঁর সঙ্গে আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের আলাপ হয়। রাদারফোর্ড তার কয়েকমাস আগে পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেছেন। বোর ঠিক করলেন ম্যানচেস্টারে রাদারফোর্ডের সঙ্গে কাজ করবেন।

নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের আগে চালু ছিল টমসনের পরমাণুর মডেল, তাতে ধরে নেওয়া হত কিছুটা ধনাত্মক আধানযুক্ত আয়তনের মধ্যে ইলেকট্রনগুলি ইতস্তত বসানো আছে। পরমাণু ও আলফা রশ্মির মধ্যে বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে রাদারফোর্ড দেখেন যে পরমাণূর গঠন একেবারেই অন্যরকম। নিউক্লিয়াস পরমাণুর কেন্দ্রে অবস্থান করে। নিউক্লিয়াদের ব্যাস পরমাণুর ব্যাসের দশ হাজার ভাগের এক ভাগের কাছাকাছি, অর্থাৎ পরমাণুর থেকে নিউক্লিয়াস অনেক ছোট। কিন্তু এর মধ্যেই আছে নিউক্লিয়াসের প্রায় সমস্ত ভর এবং সম্পূর্ণ ধনাত্মক আধান বা পজিটিভ চার্জ। ইলেকট্রনের ভর নিউক্লিয়াসের দু' হাজার ভাগের এক ভাগের কাছাকাছি, তারা নিউক্লিয়াসকে প্রদক্ষিণ করে। এই মডেলটা অনেকটা আমাদের সৌরমণ্ডলের সূর্য ও গ্রহদের গতিবিধির সঙ্গে মিলে যায়।

রাদারফোর্ডের মডেল সেই সময়ে বিশেষ পরিচিতি পায়নি। ১৯১১ সালের প্রথম সলভে কনফারেন্সে রাদারফোর্ড নিউক্লিয়াস নিয়ে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি। পরের বছর প্রকাশিত রাদারফোর্ডের লেখা ৬৭০ পৃষ্ঠার এক বইতে নিউক্লিয়াসের জন্য বরাদ্দ ছিল তিন পৃষ্ঠা। তাই ম্যানচেস্টার না গেলে বোর হয়তো পরমাণুর এই মডেলের সঙ্গে খুব একটা পরিচিত হতেন না। নিউক্লিয়াস আবিষ্কারকে পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারগুলির মধ্যে ধরা হয়; তাহলে রাদারফোর্ডের নিজের এই নিরুত্তাপ ভাবের কারণ কী ছিল?

রাদারফোর্ড জানতেন তাঁর মডেলে একটা অত্যন্ত গভীর সমস্যা আছে। তিনি ধরেছেন ইলেকট্রনরা নিউক্লিয়াসকে প্রদক্ষিণ করে। যে কোনো বস্তু সমবেগে সরল রেখাতে না গেলে তার একটা ত্বরণ থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর তড়িৎচৌম্বক বিদ্যা দেখিয়েছে যে কোনো তড়িৎআধানের গতিতে যদি ত্বরণ থাকে, তাহলে তার থেকে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ বেরোয়। সেই তরঙ্গ কিছুটা শক্তি বহন করে, অর্থাৎ তাঁর মডেলে ইলেকট্রনের গতিশক্তি কমতে নাধ্য। সেক্ষেত্রে পরমাণুর ইলেকট্রনগুলির পক্ষে কোনোভাবেই নিউক্লিয়াসে আকর্ষণ চিরকাল উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না, তারা এক সময় নিউক্লিয়াসে ঝাঁপ দেবে এবং পরমাণু ধ্বংস হয়ে যাবে। হিসাব করে দেখা গিয়েছিল রাদারফোর্ডের মডেলে পরমাণুর স্থায়িত্বকাল এক সেকেন্ডের দশহাজার কোটি ভাগের এক ভাগের কাছাকাছি। রাদারফোর্ড অবশ্য বিশ্বাস করতেন যে ভবিষ্যতের গবেষণা এই সমস্যার সমাধান করবে। সেই কাজটা অংশত করলেন বোর, তবে সম্পূর্ণ সমাধান পেতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূচনা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বোর অল্পদিনই ম্যানচেস্টারে অল্পদিন ছিলেন, তারপর তিনি ডেনমার্কে ফিরে যান। টমসন ও রাদারফোর্ডের মডেলের স্থায়িত্ব বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা রাদারফোর্ডকে লিখেও পাঠিয়েছিলেন তিনি, যদিও তা তাঁর মৃত্যুর আগে প্রকাশিত হয়নি।

বোরের পরমাণুর মডেলে বর্ণালীর এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। নিউটন প্রথম বলেছিলেন সাদা রঙ হল নানা বর্ণের আলোর সমষ্টি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে গুস্তাভ কার্চফ ও রবার্ট বুনসেন দেখলেন কোনো মৌলিক পদার্থকে উত্তপ্ত করলে তার থেকে আলো বেরোয়। তার বর্ণালী বিশ্লেষণ করলে কতকগুলি উজ্জ্বল আলোর রেখা পাওয়া যায় যাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা। এই ধরনের বর্ণালীকে বলে রেখা বর্ণালী। প্রত্যেক মৌলিক পদার্থের রেখা বর্ণালীর চরিত্র পৃথক, এভাবে সহজেই মৌলিক পদার্থকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। শুধু তাই নয়, যদি সাদা আলোকে ওই মৌলিক পদার্থের বাষ্পের মধ্যে দিয়ে পাঠানো হয় তাহলে সেই আলোকতরঙ্গগুলিই শোষিত হয় যা তাদের উত্তপ্ত করে পাওয়া গিয়েছিল। রসায়নবিদদের কাজের অনেক সুবিধা করে দিয়েছিল কার্চফ ও বুনসেনের এই গবেষণা, কিন্তু সেই বর্ণালী কেমন করে সৃষ্টি হচ্ছে তা কোনোভাবেই বোঝা যাচ্ছিল না। ইলেকট্রন আবিষ্কারের পরে অনুমান করা হয়েছিল যে তার কম্পন হয়তো এই আলোর জন্ম দেয়, তবে তার পক্ষে কোনো প্রমাণ ছিল না। আগেই বলেছি আবর্তনরত ইলেকট্রনদের তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ অর্থাৎ আলো বিকিরণ করার কথা, কিন্তু তার জন্য এই রকম নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য পাওয়ার কোন সুযোগ নেই।

মৌলিক পদার্থ থেকে বেরোনো আলোর বর্ণালীর উৎস না জানতে পারলেও অনেকেই সেই সমস্ত রেখার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করার চেষ্টা করছিলেন। এর মধ্যে সব থেকে সফল হয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের গণিতবিদ ও স্কুলশিক্ষক জোহান জ্যাকব বামার। তিনি হাইড্রোজেন বর্ণালীর বিভিন্ন রেখার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মধ্যে এক খুব সহজ সম্পর্ক নির্ণয় করেছিলেন। আমরা আধুনিক রূপ ব্যবহার করে হাইড্রোজেনের রেখা বর্ণালীর তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলির জন্য সেই সম্পর্ককে লিখতে পারি

n = R(1/m2-1/n2)

এখানে m=1,2,3,... n=2,3,4,... হল ধনাত্মক পূর্ণ সংখ্যা এবং R একটি ধ্রুবক রাশি। পরে সুইডিশ বিজ্ঞানী জোহানেস রাইডবার্গ বামারের এই সূত্রটি বিভিন্ন মৌলের ক্ষেত্রে প্রয়োগের চেষ্টা করেছিলেন, তাঁর নামানুসারে R-কে বলা হয় রাইডবার্গ ধ্রুবক। ১৮৮৫ সালে বামার তাঁর গবেষণা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু সূত্রটি কেন পরমাণুর ক্ষেত্রে খাটে সে বিষয়ে পরের প্রায় তিন দশকে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারির মাসে বোরের বন্ধু হানসেন বামারের সূত্রের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সূত্রটি দেখা মাত্র বোর বুঝতে পারেন কোন পথে এগোতে হবে। তিনি আগেই অনুমান করেছিলেন যে প্লাঙ্কের কোয়ান্টামের সঙ্গে সম্ভবত পরমাণুর সম্পর্ক আছে, কারণ তিনি বুঝেছিলেন চিরায়ত পদার্থবিদ্যা থেকে কিছুতেই পরমাণুর গঠনের ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। পরমাণুর বর্ণালীতে কতকগুলি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য পাওয়া যাচ্ছে, এবং প্লাঙ্কের সূত্র অনুযায়ী সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি জড়িত। অর্থাৎ পরমাণুর মধ্যে শক্তিস্তর সম্ভবত অবিচ্ছিন্ন নয়। চিরায়ত পদার্থবিদ্যাতে শক্তি সবসময়েই অবিচ্ছিন্নভাবে আসে। শক্তি যদি ইলেকট্রনের বেগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়, তাহলে ইলেকট্রন নিশ্চয় পরমাণুর মধ্যে শুধুমাত্র কয়েকটি নির্দিষ্ট বেগ নিতে পারে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান থেকে তার ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়।


বোরের তত্ত্বের সরলতম রূপে আমরা ধরে নিতে পারি যে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারদিকে বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। সেক্ষেত্রে তার বেগ যদি v হয়, তার ভরবেগ হল mev। এখানে me হল ইলেকট্রনের ভর। কক্ষপথের ব্যাসার্ধ r হলে, কোণিক ভরবেগ হল L=mevr। বোর বলেন যে এর মান হবে L=nh/2p , যেখানে n=1,2,3... একটি ধনাত্মক পূর্ণ সংখ্যা।

নিউক্লিয়াসের আধান Ze হলে, সে ইলেকট্রনকে কুলম্বের সূত্র অনুযায়ী F=Ze2/r2 বলে আকর্ষণ করে, মনে রাখতে হলে ইলেক্ট্রনের আধান ঋণাত্মক -e ও নিউক্লিয়াসের আধান ধনাত্মক। হাইড্রোজেনের ক্ষেত্রে Z=1

এখন r ব্যাসার্ধের কক্ষপথে v বেগ নিয়ে গতিশীল ইলেকট্রনের কেন্দ্রাতীগ বল হল mv2/r=n2h2/4p2mr। কক্ষপথ স্থায়ী হওয়ার জন্য এই বলকে অবশ্যই আকর্ষণ বলের সমান হতে হবে। সুতরাং আমরা লিখতে পারি

Ze2/r2 = n2h2/4p2mr

r= 4p2meZe2/n2h2

দেখা যাচ্ছে যে ইলেকট্রন যে কোনো কক্ষপথে ঘুরতে পারে না, n-এর উপর নির্ভর করে তার কয়েকটি নির্দিষ্ট মান আছে।

ইলেকট্রনের স্থিতিশক্তির পরিমাণ হল -Ze2/r (শক্তির পরিমাণ ঋণাত্মক, কারণ এ আকর্ষণ বল থেকে আসছে।) এবং গতিশক্তি mev2/2= n2h2/2. প্রথম রাশিতে r-এর মান বসিয়ে এবং এই দুই শক্তিকে যোগ করে n-নম্বর বোর কক্ষপথে ইলেকট্রনের মোট শক্তির পরিমাণ পাই

En=-meZ2e4/2n2h2

দেখা যাচ্ছে শক্তির পরিমাণও যেরকম খুশি হতে পারে না, n-এর উপর নির্ভর করে তার কয়েকটি নির্দিষ্ট মান আছে। এখন যদি কোনো ইলেকট্রন n-নম্বর বোর কক্ষপথে থেকে m-নম্বর কক্ষপথে যায়, তাহলে তার যে পরিমাণ শক্তির পরিবর্তন হবে তা হল

Em-En=2mep2Z2e4/h2(1/m2-1/n2)

এই শক্তি আলো হিসাবে বেরিয়ে আসবে বা শোষিত হবে। সেই আলোর কম্পাঙ্ক হবে

n=2mep2Z2e4/h3(1/m2-1/n2)

হাইড্রোজেনের জন্য Z=1 । সুতরাং R=2mep2e4/2h3 লিখলে বামারের সূত্রের ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। ইলেকট্রনের ভর, আধান ও প্লাঙ্কের ধ্রুবকের মান বসালে রাইডবার্গের ধ্রুবকের মানও সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা গেল।



এখানে দুটি কথা বিশেষ করে বলতে হয় যা সাধারণত বিজ্ঞানের বইতে পাওয়া যায় না। বর্ণালীর সঙ্গে পরমাণুর গঠনকে যুক্ত করার কথা বোরের মাথাতেই প্রথম এসেছিল। তার আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন যে পরমাণু থেকে নির্গত আলোর কম্পাঙ্ক তড়িৎক্ষেত্রে পরমাণুর ইলেকট্রনের কম্পনের সঙ্গে সংযুক্ত। আমরা বলি বোর তাঁর মডেলকে হাইড্রোজেন পরমাণুতে প্রয়োগ করেছিলেন কারণ তা সব থেকে সরল পরমাণু; এর কেন্দ্রে আছে একটি প্রোটন ও বাইরে আছে একটি ইলেকট্রন। সেই সময় কিন্তু বিজ্ঞানীদের মধ্যে যে হাইড্রোজেন পরমাণুর গঠন নিয়ে ঐকমত্য ছিল তা নয়। বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের নাতি পদার্থবিজ্ঞানী চার্লস গ্যাল্টন ডারউইনের সঙ্গে ম্যানচেস্টারেই বোরের আলাপ হয়েছিল। তিনিও পরমাণুর গঠন নিয়ে কাজ করছিলেন, তিনি সেই সময়েই এক গবেষণাপত্রে লিখেছিলেন যে হাইড্রোজেন পরমাণুতে একাধিক ইলেকট্রন আছে। পরবর্তীকালে হাইড্রোজেন পরমাণুর গঠনের বিষয়ে ডারউইন এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন। কেমব্রিজে একই সময়ে নিকলসন বলে অপর এক বিজ্ঞানী বলেছিলেন হাইড্রোজেন পরমাণুতে তিনটি ইলেকট্রন আছে। বোর তার কিছুদিন আগে এক গবেষণাপত্রে লিখেছিলেন যে খুব সম্ভবত হাইড্রোজেন পরমাণুতেই একটি ইলেকট্রন আছে, তিনি সেই অনুযায়ীই মডেল তৈরি করেন।

১৯১৩ সালের মার্চ মাসে তিনি এ বিষয়ে তাঁর প্রথম গবেষণাপত্রটি লেখেন এবং ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য রাদারফোর্ডকে পাঠান। পরপর মোট তিনটি গবেষণাপত্র তিনি পাঠিয়েছিলেন। ১৯১৩ সালের জুলাই, সেপ্টেম্বর ও নভেম্বর মাসে ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হয়।

রাদারফোর্ডের মডেলে ইলেকট্রনগুলি নিউক্লিয়াসকে বৃত্তাকার কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে। বোর ধরে নিয়েছিলেন যে কক্ষপথগুলিতে ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগ (সহজ কথায় বললে নিউক্লিয়াস থেকে তার দূরত্ব ও তার ভরবেগের গুণফল) একটা নির্দিষ্ট ন্যূনতম মানের পূর্ণসংখ্যার গুণিতক হবে, ইলেকট্রন শুধুমাত্র সেই সমস্ত কক্ষপথেই থাকতে পারে। এই ন্যূনতম মানটা হল h/2p, তা প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। পরমাণুর ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগের মান nh/2p ; এখানে n=1,2,3... এইরকম ধনাত্মক পূর্ণসংখ্যা হতে পারে। একে বলে কোয়ান্টাম সংখ্যা; পরে আর এরকম অনেক কোয়ান্টাম সংখ্যার খোঁজ পাওয়া গেছে। বামারের সূত্রে n m হল ইলেকট্রনের দুটি কক্ষপথের কোয়ান্টাম সংখ্যা। ইলেকট্রন যখন এক কক্ষপথ থেকে অন্য কক্ষপথে যায় তখন শক্তি বিকিরণ বা শোষণ করে। কক্ষপথের ভরবেগ যখন নির্দিষ্ট, তখন সেই কক্ষপথে ইলেকট্রনের শক্তির পরিমাণও নির্দিষ্ট। সুতরাং পরমাণু যে শক্তি বিকিরণ বা শোষণ করে তা যা খুশি হতে পারে না, শুধুমাত্র দুটি শক্তিস্তরের মধ্যের পার্থক্যের সমান হতে বাধ্য। প্লাঙ্কের সূত্র দেখিয়েছে যে শক্তির সঙ্গে কম্পাঙ্কের সম্পর্ক আছে, অর্থাৎ তার বর্ণালীতে কয়েকটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কই পাওয়া যাবে। হাইড্রোজেন পরমাণুতে বোরের সূত্র প্রয়োগ করে অভাবনীয় সাফল্য পাওয়া গেল, বামার সুত্রের সঙ্গে অঙ্কের হিসাব পুরোপুরি মিলে গেল।

আরো এক জায়গায় বোরের মডেল অসাধারণ সাফল্য পেল। হিলিয়াম পরমাণুতে দুটি ইলেকট্রন থাকে, তার থেকে একটা বেরিয়ে গেলে হিলিয়াম আয়ন সৃষ্টি হয়। এর সঙ্গে হাইড্রোজেন পরমাণুর অনেক মিল আছে, দুয়েরই বাইরের কক্ষপথে আছে একটি করে ইলেকট্রন। তার বর্ণালীর সঙ্গে হাইড্রোজেন বর্ণালীর অনেকটা মিল আছে, কিন্তু কিছুটা ফারাকও আছে। বোরের মডেল সেই বর্ণালীর নিখুঁত ব্যাখ্যা দিল।

আমরা দেখেছি রাদারফোর্ডের মডেলের মূল সমস্যা ছিল যে ইলেকট্রন শক্তি বিকিরণ করে নিউক্লিয়াসের উপর পড়ে যাবে। বোর সেই সমস্যার সমাধান করলেন কেমন করে? তিনি শুরুতেই ধরে নিলেন যে ঐ নির্দিষ্ট কক্ষপথের ইলেকট্রন শক্তি বিকিরণ করে না। কেন এমন হবে তার উত্তর বোরের কাছে ছিল না। অনেক পরে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বোরকেই সমর্থন করবে, তবে তার জন্য ইলেকট্রনের কক্ষপথ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে বিসর্জন দিতে হবে। অন্য এক প্রশ্নের উত্তরও বোরের কাছে ছিল না। রাদারফোর্ড বোরকে প্রশ্ন করেছিলেন যে ধরা যাক ইলেকট্রন কোনো কক্ষপথ থেকে অন্য কোনো কক্ষপথে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে ইলেকট্রনকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি ছাড়তে হবে। ইলেকট্রন আগে থেকে কেমন করে জানবে কতটা শক্তি সে ত্যাগ করবে? কোয়ান্টাম বলবিদ্যা দেখাবে যে প্রশ্নটারই কোনো অর্থ নেই।

অনেক দিক দিয়েই বোরের ধারণা ছিল সে যুগের পক্ষে দুঃসাহসী। বয়স্ক বিজ্ঞানীরা তাকে মেনে নিতে পারেননি। বোরের তত্ত্ব সম্পর্কে লর্ড র‍্যালের মতামত চাইলে তিনি বলেন, "আমি দেখেছি, কিন্তু এও দেখেছি যে ওটা আমার কোনো কাজে লাগবে না।" পরমাণুর গঠন সম্পর্কে ১৯১৪ এবং ১৯২৩ সালে লেখা বইতে জে জে টমসন বোরের মডেলের উল্লেখ করেননি। অপেক্ষাকৃত তরুণ বিজ্ঞানীরা অবশ্য তার তাৎপর্য বুঝতে পেরেছিলেন, বুঝেছিলেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব আমাদের প্রতিষ্ঠিত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে গেলেও তার অবশ্যই অন্তর্নিহিত কোনো সত্যতা আছে। সমারফেল্ড বোরকে তাঁর সাফল্যের জন্য চিঠিতে অভিনন্দন জানান। আইনস্টাইনও বোরের তত্ত্বকে এক বিরাট সাফল্য বলে অভিহিত করেন। বোরের বক্তৃতা শুনে ম্যাক্স বর্ন বলেন তিনি তার অনেক কিছু বুঝতে পারেননি, কিন্তু তার গভীরে যে সত্য আছে সে বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহে। ১৯১৭ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে বোরের সমর্থনে নোবেল কমিটির কাছে মোট একুশটি মনোনয়ন জমা পড়েছিল। তাঁর সমর্থকদের মধ্যে ছিলেন রাদারফোর্ড, প্লাঙ্ক, উইলহেল্ম রন্টজেন, মাক্স ফন লউ বা উইলিয়াম ব্র্যাগের মতো নোবেলজয়ীরা। ১৯২২ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার তাঁকে দেওয়া হয়।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রথম তিন প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে আইনস্টাইন বা প্লাঙ্ক কখনোই কোয়ান্টাম বিষয়ক ধারণাকেই শেষ কথা বলে মানতে রাজি হননি। নিল্‌স বোর কিন্তু প্রথম থেকেই বুঝেছিলেন অণু পরমাণুর জগতে চিরায়ত পদার্থবিদ্যা কাজ করবে না, সেখানে রাজত্ব করে কোয়ান্টাম। আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর এবিষয়ে বারবার বিতর্ক হয়েছিল, প্রতিবারই বোর সঠিক প্রমাণিত হয়েছিলেন। কোয়ান্টাম তত্ত্ব ছিল কতকগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন অনুমানের সমষ্টি; কিছুদূর পর্যন্ত তারা কাজ করত এবং বেশ কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা করত, কিন্তু সুসংহতভাবে কোনো কাঠামো তার ছিল না। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা সেই কাঠামো তৈরি করে, যদিও তার তাৎপর্য নিয়ে তর্ক এখনো চলছে। সেই কাঠামো তৈরিতে বোরের পরমাণুর মডেল এক উল্লেখযোগ্য ভুমিকা নিয়েছিল। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, পল ডিরাক, উলফগ্যাং পাউলি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নির্মাতাদের প্রায় সকলেই বোরের সান্নিধ্য ও আলোচনা থেকে উপকৃত হয়েছেন। কোপেনহাগেন এই সমস্ত তরুণ বিজ্ঞানীদের অবশ্য গন্তব্যের মধ্যে পড়েছিল।

কোয়ান্টাম তত্ত্বে বোরের আরো একটি অবদানের কথা উল্লেখ করি। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সব থেকে পরিচিত ব্যাখ্যাকে বলে কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা, এই বলবিদ্যাকে ব্যবহার কররার সময় প্রায় সমস্ত বিজ্ঞানীই চেতনে বা অচেতনে তা মেনে চলেন। বোরই এই ব্যাখ্যার সব থেকে বড় প্রবক্তা। কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার বিস্তারিত আলোচনা এই নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে করা সম্ভব নয়, এখনো সব বিজ্ঞানী তার সঠিক বক্তব্য বা সত্যতা নিয়েও একমত নন। বোর বলেছিলেন পরীক্ষা করে যা ফল পাওয়া যাচ্ছে, তার বাইরে অণুপরমাণুর জগৎ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়, সেখানে একই সঙ্গে অনেকরকম সম্ভাবনার অস্তিত্ব থাকে। পরমাণু বা মৌলিক কণার কিছু কিছু ধর্ম আছে যারা একই সঙ্গে প্রতিভাত হয় না, যেমন কোনো পরীক্ষাতেই একই সঙ্গে আলোর তরঙ্গ ও কণিকা ধর্ম দেখা যাবে না। তিনি সঙ্গতি সূত্রের কথাও বলেছিলেন; সেই অনুসারে কোনো সিস্টেমের কোয়ান্টাম সংখ্যা যখন খুব বড় হয়, তখন কোয়ান্টাম ও চিরায়ত পদার্থবিদ্যা একই রকম ফল দেয়। নিউক্লিয় বিজ্ঞানেও বোর উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। তাঁর ছেলে আগি বোর সেই বিষয়েই নোবেল পুরস্কার জেতেন।

শেষ করার আগে মানুষ বোর সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ডেনমার্ক দখল করে নিয়েছিল। বোরের মা ছিলেন ইহুদি, ইহুদিবিদ্বেষী নাৎসিরা বোর ও তাঁর পরিবারকে গ্রেফতার করবে বলে খবর পেয়ে বোর সপরিবারে সুইডেনে পালিয়ে যান। তাঁকে ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্লেন তৈরি ছিল, কিন্তু তিনি সুইডেনের রাজা ও সরকারের অন্য নেতৃত্বের সঙ্গে ইহুদিদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে কথা না বলে প্লেনে উঠতে রাজি হননি। অংশত তাঁর চেষ্টাতে সুইডেনের রাজা ডেনমার্কের ইহুদিদের আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা করেন। ডেনমার্কের অন্য নাগরিকদের সাহায্যে সাত হাজারের বেশি ইহুদি, অর্থাৎ ডেনমার্কের ইহুদি জনসংখ্যার প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ, সুইডেনে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। বোর ব্রিটেন হয়ে তিনি আমেরিকা গিয়েছিলেন, ব্রিটিশ ও মার্কিন পরমাণু বোমা তৈরির প্রকল্পের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। পরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের সঙ্গে দেখা করে তিনি পরমাণু অস্ত্রের উপরে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের উপরে জোর দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর মতামত অগ্রাহ্য হয়। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির প্রথম ধারণা তাঁর মাথাতেই এসেছিল, তিনিই শান্তির জন্য পরমাণু এই পুরস্কারের প্রথম প্রাপক। ১৯৬২ সালে ৭৭ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। 

প্রকাশ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার শারদীয় ২০২২

এই ব্লগের এই লেখাটাতে মানুষ বোর সম্পর্কে আরো কিছু কথা আছে।