Monday 3 October 2022

মানুষ নিলস্‌ বোরঃ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির শতবর্ষে

 

মানুষ নিলস্‌ বোরঃ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির শতবর্ষে

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সাল ছিল আইনস্টাইনের নোবেল পুরস্কারের শতবর্ষ, আলোকতড়িৎ ক্রিয়া সংক্রান্ত ব্যাখ্যার জন্য ১৯২১ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর এই গবেষণাই আলোর কোয়ান্টাম বা ফোটনের ধারণার জন্ম দিয়েছিল। ১৯২১ সালে কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নে কাউকেই পুরস্কার দেওয়া হয়নি। পরের বছর অর্থাৎ ১৯২২ সালের পুরস্কারগুলির সঙ্গে ওই দুই বিষয়ের আগের বছরের পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল। আইনস্টাইন পুরস্কার নিতে যাননি, তিনি তখন জাপানে। তাঁর হয়ে পুরস্কারটি প্রহণ করেছিলেন সুইডেনে জার্মানির রাষ্ট্রদূত। এই কাহিনি অনেকেরই জানা, সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকাতেও আগে এই বিষয়ে লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

নিলস বোর (৭ অক্টোবর ১৯৮৫ - ১৮ নভেম্বর ১৯৬২)

আইনস্টাইন না থাকলেও ১৯২২ সালের ১০ ডিসেম্বর স্টকহোলমে উপস্থিত ছিলেন সেই বছরের পুরস্কার প্রাপক নিল্‌স বোর। পরমাণুর গঠন সম্পর্কে তাঁর গবেষণার জন্য তাঁকে মনোনীত করা হয়েছিল। কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্ম ১৯০০ সালে, ১৯২৫ সালে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত সেই তত্ত্বই বিজ্ঞানীরা অনুসরণ করতেন। কোয়ান্টাম তত্ত্বের মূল স্তম্ভ চারটি। ১৯০০ সালে মাক্স প্লাঙ্ক কৃষ্ণবস্তুর থেকে বেরোনো বিকিরণের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে শক্তি ছোটো ছোটো প্যাকেটে নির্গত হয়, এর তিনি নাম দিয়েছিলেন কোয়ান্টাম। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা হল কোয়ান্টাম তত্ত্বের দ্বিতীয় প্রয়োগ। ১৯১৩ সালে নিল্‌স বোর পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কোয়ান্টামের কথা এনেছিলেন, এর জন্যই তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কোয়ান্টাম তত্ত্বের চতুর্থ স্তম্ভটি হল সত্যেন্দ্রনাথ বোস ও আইনস্টাইনের পরিসংখ্যান। 

দুই বন্ধু, বোর ও আইনস্টাইন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিতর্কে দুই পক্ষে ছিলেন

 

এই লেখাতে বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা বিশেষ নেই। নিল্‌স বোর শুধু নিজে বিজ্ঞান গবেষণা করেছিলেন তা নয়, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্মে তিনি ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেও সারা জীবন তিনি সেই তত্ত্বকে স্বীকার করতে পারেননি; বারবার তিনি নানা ভাবে তাকে ভুল বা অসম্পূর্ণ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর আক্রমণের মুখে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার হয়ে রক্ষণ সামলেছিলেন তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু বোর। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, পল ডিরাক, উলফগ্যাং পাউলির মতো কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তরুণ স্রষ্টারা কোপেনহেগেনে বোরের সঙ্গে কাজ করেছিলেন, বোরের সঙ্গে আলোচনা তাঁদের চিন্তাভাবনাকে সঠিক পথে চালনা করেছে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার চোখধাঁধানো সাফল্য সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা এখনো তার নিহিতার্থ সম্পর্কে একমত নন। তবে অধিকাংশ বিজ্ঞানীই কাজের সুবিধার জন্য যে অর্থটিকে ধরে নেন, সেই কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার মূলে আছেন নিল্‌স বোর। বোরের জীবনকালের মধ্যে শুধু পদার্থবিদ্যা নয়, মানুষের ইতিহাসেও অনেক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। তিনি সে সবের সাক্ষী ছিলেন, কখনো কখনো তিনি সেই পরিবর্তনে অংশও নিয়েছিলেন। তাঁর সেই ঘটনাবহুল জীবনের কিছু কথা আমরা এই লেখাতে স্মরণ করব।

নিল্‌স বোরের জন্ম ১৮৮৫ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে। তাঁরা ছিলেন দুই ভাই। ছোট ভাই হারাল্ড গণিতবিদ হিসাবে বিখ্যাত হয়েছিলেন, কিন্তু দেশে তাঁর খাতি ছিল অন্য কারণে। দুই ভাইই ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন। হারাল্ড ডেনমার্কের জাতীয় দলে খেলেছিলেন, ১৯০২ সালের দ্বিতীয় অলিম্পিকে ডেনমার্কের রুপোজয়ী দলের তিনি ছিলেন সদস্য। নিল্‌সও ভালো খেলতেন, কিন্তু তাঁর পক্ষে জাতীয় দল পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। একবার এক জার্মান ক্লাব কোপেনহেগেনে এসেছে, বিপক্ষ দলের গোলরক্ষক নিল্‌স। জার্মান দলটি রক্ষণাত্মক খেলছে, ফলে নিলসের বিশেষ কাজ নেই। তিনি একটা অঙ্কের সমাধান নিয়ে চিন্তা করতে ব্যস্ত, হঠাৎ দর্শকদের চিৎকারে তাঁর সম্বিত ফেরে। বিপক্ষের অর্ধ থেকে ক্লিয়ার করা একটা বল গড়াতে গড়াতে গোলে প্রায় ঢুকে যাচ্ছিল, নিল্‌স তাড়াতাড়ি গিয়ে বাঁচালেন। স্বাভাবিকভাবেই এইরকম খেলোয়াড়ের পক্ষে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব নয়।

কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করার পরে তিনি কেমব্রিজে ইলেকট্রনের আবিষ্কর্তা জে জে টমসনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়েছিলেন। বৃত্তি দিয়েছিল ডেনমার্কের বিখ্যাত বিয়ার প্রস্তুতকারক সংস্থা কার্লসবার্গের এক ফাউন্ডেশন। পরে সেই ফাউন্ডেশন তাঁর গবেষণাতে অনেকভাবে সাহায্য করেছিল। এমনকি ১৯৩১ সাল থেকে তিনি সেই ফাউন্ডেশনের দেওয়া বাড়িতেই থাকতেন, বাড়িতে কল খুললেই বিয়ার পাওয়া যেত। বোর টমসনের পরমাণুর মডেল নিয়ে আলোচনা করতে উৎসাহী ছিলেন। কেমব্রিজে তাঁর সঙ্গে টমসনের প্রথম সাক্ষাৎকারকে বোর এইভাবে বর্ণনা করেছেন, "আমি তখন ইংরাজিতে খুব সড়গড় ছিলাম না। আমি টমসনের একটা লেখা দেখিয়ে তাঁকে বলেছিলাম এটা ভুল, কিন্তু কেন যে ভুল তা ইংরাজিতে বুঝিয়ে বলতে পারিনি। টমসন এই রকম অভিযোগের ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহী হননি।" টমসনের সঙ্গে গবেষণার বিশেষ সুযোগ হয়নি, এই সময়েই পরমাণুর নিউক্লিয়াসের আবিষ্কর্তা আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের সঙ্গে বোরের আলাপ হয়, বোর কেমব্রিজ ছেড়ে ম্যানচেস্টারে রাদারফোর্ডের ল্যাবরেটরিতে কয়েকমাস কাটান।

রাদারফোর্ডের সঙ্গে আলাপ বোরের কাজে লেগেছিল। রাদারফোর্ডের পরমাণুর মডেলের কেন্দ্রে আছে নিউক্লিয়াস, তার চারপাশে ইলেকট্রনরা আবর্তন করে। বোর এই মডেল থেকে শুরু করেন। পদার্থবিদ্যার হিসাবে এই রকম পরমাণু একেবারেই স্থায়ী নয়, অল্প সময়ের মধ্যেই ইলেকট্রনদের নিউক্লিয়াসে মধ্যে পড়ে যাওয়ার কথা। ১৯২৫ সালে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আবিষ্কারের আগে এই সমস্যার সমাধান হবে না। বোর ধরে নিলেন যে ইলেকট্রনরা কয়েকটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে স্থায়ীভাবেই আবর্তন করতে পারে। সেই কক্ষপথগুলিও কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বোর দেখালেন যে তাঁর মডেল সরলতম পরমাণু হাইড্রোজেন সম্পর্কে আমাদের নানা পর্যবেক্ষণকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে। ১৯১৩ সালের এই কাজের জন্যই বোর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। পরবর্তীকালে আণবিক ও নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানে বোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর ছেলে আগি বোর নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যাতে গবেষণার জন্য ১৯৭৫ সালে নোবেল পুরস্কার পাবেন, তা দেখার জন্য বাবা অবশ্য বেঁচে ছিলেন না।

নোবেল পদকের সঙ্গে বোরের সম্পর্ক নিয়ে কয়েকটা গল্প বলা যাক। ১৯৪০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফিনল্যাণ্ডের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধ শেষের পর ফিনল্যাণ্ডের ত্রাণকার্যের সহায়তার জন্য বোর ১৯৪০ সালে পদকটি নিলামে তোলেন। অজ্ঞাত পরিচয় এক ক্রেতা সেটিকে কিনে পরে আবার ডেনমার্কের এক মিউজিয়ামে দান করে দেন।

হিটলারের ফ্যাসিস্ট পার্টি জার্মানিতে ইহুদিদের উপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল, আইনস্টাইন সহ অনেক বিজ্ঞানী প্রাণ বাঁচাতে জার্মানি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নোবেলজয়ী জার্মান বিজ্ঞানী মাক্স ফন লউ অনেক ইহুদিকে দেশ ছাড়তে সাহায্য করেছিলেন। যে কোনো সময় নাৎসিদের আক্রমণের মুখোমুখি হতে পারেন, এই অবস্থাতে নোবেল পদকটি তিনি গোপনে বোরের কাছে পাঠিয়ে দেন। আর এক নোবেলজয়ী জেমস ফ্রাঙ্ক নিজে ছিলেন ইহুদি, তিনি প্রকাশ্যে হিটলারের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়। জার্মানি থেকে বিদেশে সোনা নিয়ে যাওয়া ছিল বেআইনি, ধরা পড়লে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারত। তাই ফ্রাঙ্ক নিজের সঙ্গে মেডেলটি নিয়ে যাওয়ার সাহস পাননি। সেটিও গোপনে বোরের কাছে পৌঁছয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪০ সালের ৯ই এপ্রিল জার্মানি বিনা প্ররোচনায় ডেনমার্ক আক্রমণ করে। মাত্র ছ ঘন্টার মধ্যেই রাজধানী কোপেনহেগেন সমেত গোটা দেশ জার্মান সৈন্যদের অধীনে চলে যায়। নিলস বোর যে শুধু ইহুদি বিজ্ঞানীদের সাহায্য করছিলেন তা নয়, তাঁর মা ছিলেন ইহুদি। তাই তিনি যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন। নোবেল মেডেলদুটি লুকানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন রসায়নবিদ জর্জ ডি হেভেসি, তিনি অ্যাসিডে মেডেলদুটি গলিয়ে ফেলেন। জার্মানরা বোরের ইনস্টিটিউটে তল্লাসি চালালেও সেগুলির হদিস পায়নি। বোর ও ডি হেভেসি পরে গোপনে ডেনমার্ক ছাড়েন। যুদ্ধের পরে ফিরে গিয়ে ডি হেভেসি আবার সেই সোনাটা উদ্ধার করে নোবেল কমিটিকে পাঠিয়ে দেন, কমিটি তার থেকে পদক বানিয়ে ফন লউ ও ফ্রাঙ্ককে দেয়। ইতিমধ্যে ১৯৪৩ সালে ডি হেভেসি রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

১৯৩৯ সালের রসায়নের পুরস্কারের জন্য বোর ডি হেভেসিকে মনোনীত করেছিলেন। বোর বিভিন্ন সময়ে মোট উনিশজন বিজ্ঞানীকে নোবেলের জন্য মনোনীত করেছিলেন, তঁদের মধ্যে চারজন ছাড়া সবাই কখনো না কখনো এই পুরস্কার জিতেছিলেন। এই চারজনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন লিজে মাইটনার, নিউক্লিয় ফিশন বা বিভাজন আবিষ্কারের জন্য বোর তাঁকে তিনবার মনোনীত করেন। বিভাজন বিক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল অটো হানকে। হান ও মাইটইনারের যৌথ গবেষণাতেই বিভাজন বিক্রিয়া আবিষ্কার হয়েছিল। অনেকেই মনে করে যে মাইটনারকে পুরস্কার না দেওয়াটা অন্যায়, এবং তার পিছনে অন্যতম কারণ যে তিনি নারী। আমরা আবার এই কথাতে ফিরে আসব।

নারীদের বা পশ্চিম ইউরোপ বা আমেরিকার বাইরের বিজ্ঞানীদের অবদানকে ছোট করে দেখার একটা প্রবণতা সেই সময় ছিল, এখনও তা পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। বোর ছিলেন এই সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। সোভিয়েত বিজ্ঞানী পিওতর কাপিৎজাকে চারবার ও লেভ লান্দাউকে দু’বার নোবেল পুরস্কারের জন্য তিনি মনোনীত করেন। সি ভি রামন ১৯২৮ সালে বিখ্যাত রামন বিক্ষেপ আবিষ্কার করেছিলেন, তার পরের দুই বছরই বোর তাঁকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছিলেন। এঁরা তিনজনেই বিভিন্ন সময় পুরস্কারটি পান।

কোপেনহেগেনে যে গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন বোর, বিজ্ঞানীদের জন্য তার দ্বার ছিল অবারিত। ১৯২৪ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক বিধুভূষণ রায় বা জাপানের বিজ্ঞানী ইওশিও নিশিনা। কী হলে কী হতে পারত, এই নিয়ে আলোচনা সাধারণত নিরর্থক, তবুও একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। ফোটনের সংখ্যায়ন সংক্রান্ত তাঁর সেই বিখ্যাত গবেষণাপত্রদুটি সত্যেন্দ্রনাথ ১৯২৪ সালে পাঠিয়েছিলেন আইনস্টাইনকে। আইনস্টাইন সেগুলি ইংরাজি থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। তার অল্পদিন পরেই সত্যেন্দ্রনাথ ইউরোপ গিয়েছিলেন। এক বছর ফ্রান্সে কাটিয়ে তিনি যান বার্লিনে আইনস্টাইনের কাছে। আইনস্টাইন ইতিমধ্যে সত্যেন্দ্রনাথের কাজকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাই আমরা অনেকে সেই গবেষণাকে বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন বলি। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ যখন বার্লিন যান তখন আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা ছেড়ে দিয়েছেন। আগেই বলেছি তিনি কখনো কোয়ান্টাম তত্ত্বকে সম্পূর্ণ মনে করেননি। পিছনে তাকিয়ে মনে হয় সত্যেন্দ্রনাথের স্বাভাবিক গন্তব্যস্থল ছিল কোপেনহেগেন।

কল্পনাকে আরো একটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রথম আবিষ্কর্তা ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ছিলেন জার্মানির গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাক্স বর্নের সহকারী; একই সঙ্গে তিনি বোরের প্রতিষ্ঠানেও কাজ করতেন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অঙ্কে একটা খুব অদ্ভুত বিষয় এসেছিল, তার তাৎপর্য হাইজেনবার্গ প্রথমে বুঝতে পারেননি। পরে বর্ন বোঝেন যে সেটি গণিতের ম্যাট্রিক্স শাখার সঙ্গে যুক্ত, যে কারণে হাইজেনবার্গের তত্ত্বকে বলা হত ম্যাট্রিক্স বলবিদ্যা। এখন পদার্থবিদ্যার ছাত্রছাত্রীদের কাছে ম্যাট্রিক্স অবশ্যপাঠ্য, কিন্তু তখন প্রায় কোনো পদার্থবিজ্ঞানীই সে সম্পর্কে বিশেষ খবর রাখতেন না; বর্নেরও কিছুদিন সময় লেগেছিল। পদার্থবিজ্ঞানী হলেও সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন গণিতের ছাত্র, ম্যাট্রিক্সের কথাটা তাঁর মনে হয়তো আগেই আসত। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্মের সময় সত্যেন্দ্রনাথ বার্লিনে, কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব সম্পর্কে মনোভাবের জন্য আইনস্টাইন সেই সমস্ত অগ্রগতির থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন, ফলে সত্যেন্দ্রনাথেরও সেই সুযোগ আসেনি। তিনি যদি কোপেনহেগেনে যেতেন তাহলে হয়তো কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্মের সঙ্গে তাঁর নামও জড়িয়ে থাকত।

আবার বাস্তবে ফিরে আসি। তরুণ বিজ্ঞানীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য বোর সুপরিচিত ছিলেন। শুধু হাইজেনবার্গ নয়, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্মের সঙ্গে যুক্ত এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার, উলফগ্যাং পাউলি, পল ডিরাক — সবাই বোরের সঙ্গে এই বিষয়ে নানা সময়ে আলোচনা করেছিলেন। বিশেষ করে বলতে হয় হাইজেনবার্গের কথা, বোরের সঙ্গে সাক্ষাতে বা চিঠিপত্রের মাধ্যমে আলোচনা তাঁকে সাহায্য করেছিল। এই প্রসঙ্গেই আসে বিজ্ঞানের ইতিহাসের এক অমীমাংসিত সংলাপের কথা। 

 

সুখের সময়ে হাইজেনবার্গ ও বোর, কোপেনহেগেন ১৯৩৪

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির পরমাণু অস্ত্র প্রকল্পের মূল দায়িত্বে ছিলেন হাইজেনবার্গ। ১৯৪১ সালে তিনি বোরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। হাইজেনবার্গ নাৎসি ছিলেন না, কিন্তু সেই সময় অন্তত যুদ্ধে জার্মানির উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। ডেনমার্ক তখন জার্মানির অধিকৃত, এক সময়কার দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগীর মধ্যে তখন মাথা তুলেছে বিজয়ী ও পদানত দেশের নাগরিককে বিভেদকারী দুর্লঙ্ঘ্য দেওয়াল। তাঁরা পরমাণু শক্তি বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন, কিন্তু ঠিক কী কথা হয়েছিল দুজনের মধ্যে, তা নিয়ে পরে দুজনে একমত হতে পারেননি। বোর তাঁর ছেলে আগিকে বলেছিলেন হাইজেনবার্গ আভাস দেন যে তিনি পরমাণু অস্ত্র নিয়ে কাজ করছেন, কিন্তু কোন কারণে তিনি দেখা করতে এসেছেন তা বলেননি। বোর তাঁকে বলেছেন সেই মুহূর্তে প্রযুক্তিগত ভাবে পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ অসম্ভব। হাইজেনবার্গ তাঁকে বলেন, তিনি যে কাজে হাত দিয়েছেন তা সম্ভব বুঝেই দিয়েছেন। হাইজেনবার্গ পরে বলেন যে যুদ্ধে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের কথা শুনে বোর এত বিচলিত হয়ে পড়েন যে তিনি পরের কোনো কথা বুঝতেই পারেন নি। হাইজেনবার্গ তাঁকে বলতে চেয়েছিলেন যে সেই কাজের জন্য প্রচুর পরিশ্রম প্রয়োজন, এবং বোর যদি বিষয়টিকে অনৈতিক মনে করেন তাহলে জার্মান বিজ্ঞানীরা সেই কাজ করবেন না। এমন কথাও এসেছে যে হাইজেনবার্গ চেয়েছিলেন সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা পরমাণু অস্ত্র থেকে হাত গুটিয়ে নিন, বোরের মারফত সেই আবেদন সকলের কাছে পৌঁছোক। আগি বোর বলেছেন এই ধরনের কোনো কথা হয়নি। অনেক বছর পরে ঐতিহাসিকদের চাপে নিল্‌স বোর আর্কাইভ হাইজেনবার্গকে লেখা কিন্তু না পাঠানো বোরের এক চিঠি প্রকাশ করে। সেখানে বোরও স্পষ্টই লিখেছেন এমন কোনো কথা হয়নি। কিন্তু ঠিক কোন কথা বলতে হাইজেনবার্গ বোরের কাছে গিয়েছিলেন তা এখনও প্রহেলিকা। অনেকের মতে বোরকে ভয় দেখিয়ে জার্মান পক্ষে টানা হয়তো হাইজেনবার্গের উদ্দেশ্য ছিল। তাই যদি হয় তাহলে পরের ঘটনাক্রম থেকে বোঝা যাবে ঠিক বিপরীত ফল হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকার নিয়ে লেখা নাটক 'কোপেনহেগেন' খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।

হাইজেনবার্গ অবশ্যই জানতেন যে বোর জার্মানিত্যাগী ইহুদি বিজ্ঞানীদের সাহায্য করছেন। এ বিষয়ে বোরের প্রয়াসের অনেকটাই আমাদের অজানা, কারণ জার্মানি ডেনমার্ক দখলের পরে নিরাপত্তার স্বার্থে সেই বিষয়ে সমস্ত কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। অন্যত্র পাওয়া কাগজপত্র থেকে জানা যায় যে আমেরিকার রকফেলার ফাউন্ডেশন বোরের অনুরোধেই ডি হেভেসি, জেমস ফ্রাঙ্ক, লিজে মাইটনারের মতো অনেক বিজ্ঞানীর জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছিল। ডেনমার্কের মতো ছোট্ট দেশের পক্ষে সবাইকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব ছিল না, তবে অনেক বিজ্ঞানীই অন্য দেশে আশ্রয় খোঁজার সময় কোপেনহেগেনে বোরের ইন্সটিটিউটে জায়গা পেয়েছিলেন।

সেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিলেন লিজে মাইটনারের দিদির ছেলে অটো ফ্রিশ। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ফ্রিশ সুইডেনে মাইটনারের সঙ্গে দেখা করতে যান, মাইটনারের জার্মান সহকর্মী অটো হান তখন নিউক্লিয় বিভাজন আবিষ্কারের কথা তাঁকে জানিয়েছেন। হান যে সমস্ত পরীক্ষানিরীক্ষা করে বিভাজন আবিষ্কার করেন, তাতে তাঁরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আগে বোরের ডাকে সাড়া না দিলেও তাঁর আসন্ন গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে ১৯৩৮ সালে গোপনে জার্মানি ছেড়েছিলেন মাইটনার। ফ্রিশ ও মাইটনার প্রথম বিভাজনের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন। ফ্রিশ মারফত বোর সেই বিষয়ে জানতে পারেন। তার পরের দিনই তিনি আমেরিকা রওনা হন, তাঁর মারফত বিভাজনের বিষয়ে মাইটনার ও ফ্রিশের গবেষণাপত্র প্রকাশের আগেই আমেরিকার বিজ্ঞানীদের কাছে সেই খবর পৌঁছে যায়। আমেরিকাতে বিজ্ঞানী জন হুইলার ও বোর একত্রে আলোচনা করে নিউক্লিয় বিভাজনের যে মডেল তৈরি করেন, আজও বিভাজনের ব্যাখ্যাতে সেটিই মূল কাঠামোর কাজ করে। সেই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর, ঠিক যেদিন জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।

নিউক্লিয় বিভাজনের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে বোর যুদ্ধে সব পক্ষের নজরে ছিলেন। হাইজেনবার্গের কথা আগে বলেছি। জার্মানির ডেনমার্ক অধিকারের পরেই তখনো পর্যন্ত যুদ্ধে নিরপেক্ষ আমেরিকা থেকে বোরের কাছে অনেক আমন্ত্রণ এসে পৌঁছায়, কিন্তু বোর প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশ গুপ্তচরেরা বোরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেই গোপন অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছিল ২১৩। খুব গোপনে ডেনমার্কের সামরিক বাহিনীর অফিসার ক্যাপ্টেন ভলমার গাইথের মাধ্যমে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী নিউট্রনের আবিষ্কারক জেমস চ্যাডউইকের এক চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এক গোছা চাবির মধ্যে ছিল একটি ফাঁপা চাবি, তার ভিতরে চিঠিটির মাইক্রোফিল্ম লুকানো ছিল। চিঠিতে চ্যাডউইক তাঁকে ব্রিটেনে আসার আমন্ত্রণ জানান। গোপন চিঠিতেও চ্যাডউইক নিউক্লিয় বিভাজনের কথা লিখতে সাহস করেননি, শুধু লিখেছিলেন যে এক বিশেষ সমস্যার সমাধানে তাঁরা বোরের সাহায্য চান। বোর বুঝতে ভুল করেননি, তিনি উত্তরে লেখেন এখনি পরমাণু শক্তির ব্যবহার সম্ভব নয় বলে তিনি বিশ্বাস করেন। বোরের উত্তরের মাইক্রোফিল্ম এক দাঁতের ডাক্তারের সাহায্যে বার্তা বাহকের ফাঁপা দাঁতের ভিতর ঢুকিয়ে দেন, সেইভাবে তা ব্রিটেনে পৌঁছায়।

চ্যাডউইকের চিঠি পাওয়ার আগে বোর মিত্রপক্ষের পরমাণু বোমা প্রকল্প সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই কিছু জানতেন না, কিন্তু হাইজেনবার্গের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে তাঁর মনে হয়েছিল প্রযুক্তিগতভাবে পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ হয়তো তখনই সম্ভব। চ্যাডউইককে চিঠি পাঠানো দু' সপ্তাহ পরে বোর আবার গাইথের সঙ্গে দেখা করেন, বলেন যে তিনি পরমাণু শক্তিকে ব্যবহারের এক পদ্ধতি ভেবেছেন। বোরের সেই চিঠি গোপন পথে চ্যাডউকের কাছে পৌঁছেছিল, যদিও সেই পদ্ধতি শেষ পর্যন্ত বোমা তৈরিতে বব্যবহার হয়নি।

সেই মুহূর্তে ডেনমার্ক ছাড়তে বোর রাজি হননি। বোরের মা ছিলেন ইহুদি, কিন্তু ডেনমার্কের ইহুদিদের উপর জার্মানি তখনো অত্যাচার শুরু করেনি। পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটল সেপ্টেম্বর মাসে। ২৮ সেপ্টেম্বর ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতিশীল এক উচ্চপদস্থ জার্মান অফিসার ডাকউইজ্‌ ডেনমার্কের গোপন প্রতিরোধ বাহিনীর নেতাদের জানিয়ে দেন ১ অক্টোবর সমস্ত ইহুদি ও ইহুদি বংশোদ্ভূতদের গ্রেপ্তার করা হবে। তাঁদের মধ্যে বোরের পরিবার অন্যতম। বোরকে সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রক আগেই সেই খবর দিয়েছিল। ২৯ সেপ্টেম্বর বোর ও তাঁর স্ত্রী মার্গরিথ, ভাই হারাল্ড ও হারাল্ডের ছেলে ওলেকে ডেনমার্কের প্রতিরোধবাহিনী নিরাপদে প্রথমে মাছধরা নৌকাতে ও পরে ট্রলারে করে সুইডেনে পৌঁছে দেয়। পরে দিনই বোরের ছেলেরাও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে সুইডেনে পালিয়ে যান। যুদ্ধের পরে পাওয়া কাগজপত্র থেকে জানা যায় বোরকে গ্রেপ্তার করে জার্মানিতে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল ২৯ আগস্ট, কিন্তু পরে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে তা কার্যকরী করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সৌভাগ্যক্রমে তার আগেই বোর পালাতে সক্ষম হন।

সুইডেনের রাজধানী স্টকহোল্‌মে বোরের জন্য এক ব্রিটিশ বিমান অপেক্ষা করছিল। কিন্তু বোর তখনি তাতে উঠতে রাজি হননি। তিনি সুইডেনের রাজা, রাজকুমার, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সরকারের অন্যন্য উচ্চপদাধিকারীদের সঙ্গে দেখা করে ডেনমার্কের ইহুদিদের জন্য সুইডেনে আশ্রয়ের জন্য তিনি অনুরোধ জানান। আগে থেকেই এই নিয়ে কথা চলছিল, বোরের অনুরোধ সিদ্ধান্তকে ত্বরান্বিত করেছিল। রাজার ঘোষণার আগে বোর সুইডেন ছাড়েননি। ২ অক্টোবর সুইডেনের রাজা পঞ্চম গুস্তাভ রেডিওতে ঘোষণা করে ডেনমার্কের ইহুদিদের আশ্রয়ের প্রতিশ্রুতি দেন। তার আগে থেকেই ডেনমার্কের সাধারণ নাগরিকরা ইহুদিদের আত্মগোপনে সাহায্য করছিল, এই ঘোষণার পরে ডেনমার্কের আটহাজারের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাতহাজার ইহুদি সুইডেনে আশ্রয় পান।

৬ অক্টোবর বোরকে ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এজন্য ব্রিটেন থেকে এক মসকিটো বোমারু বিমান পাঠানো হয়েছিল। কাছাকাছি বিমানবন্দরে মোতায়েন জার্মান বিমানের থেকে মসকিটো ছিল দ্রুতগামী, বেগ আরো বাড়ানোর জন্য মেশিনগান ও কামান খুলে ফেলা হয়েছিল। সে যুগের যুদ্ধবিমানের সঙ্গে আজকের তফাত অনেক। পাইলট ছাড়া বোমারু বিমানের ককপিটে কারোর জায়গা ছিল না, বোরকে প্যারাসুট পরে বোমা রাখার জায়গায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল। বোরকে পাইলট বুঝিয়ে দেন যে জার্মান বিমান এড়ানোর জন্য তাঁরা অনেক উপর দিয়ে যাবেন, পাইলট জানালেই তিনি যেন অক্সিজেন মুখোশ পড়েন। কিন্তু ইন্টারকমে বোরকে মুখোশ পড়তে বলার পর কোনো উত্তর না পেয়ে পাইলট বিমানকে অনেক নিচে দিয়ে চালাতে বাধ্য হন। নামার পরে বোর বলেন যে তিনি পুরো যাত্রাটা ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। আসলে হেলমেট ঠিক মতো ফিট না করাতে বোর পাইলটের কথা শুনতে পাননি, তিনি অক্সিজেনের অভাবে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।

ব্রিটেনে বোর টিউব অ্যালয় প্রোজেক্টে যোগ দেন। এই সাঙ্কেতিক নামের আড়ালে ব্রিটেন ও কানাডা যৌথভাবে পরমাণু বোমা বানানোর চেষ্টা করছিল। পরমাণু অস্ত্রের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার জন্য ব্রিটেনে Maud কমিটি তৈরি হয়েছিল, তার সুপারিশেই টিউব অ্যালয় প্রোজেক্ট চালু হয়। কমিটির নামকরণে বোরের একটা ভূমিকা আছে। জার্মানি যখন ডেনমার্ক আক্রমণ করে বোর ব্রিটেনে অটো ফ্রিশকে এক টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন, তার শেষ বাক্যটা ছিল, "Tell Cockcroft and Maud Ray Kent"। জন ককক্রফট এক বিখ্যাত নিউক্লিয় বিজ্ঞানী, পরবর্তীকালে নোবেল পুরস্কারজয়ী, কিন্তু Maud Ray Kent মানে কী কেউ বুঝতে পারেননি। অনেকে অনুমান করেন ওটা Maud নয়, Maid; এবার অক্ষরগুলো উল্টেপাল্টে হল Radium taken, অর্থাৎ বোর সঙ্কেতে জানাতে চেয়েছেন জার্মানরা সমস্ত তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে নিয়েছে। পরমাণু অস্ত্রে তেজস্ক্রিয় পদার্থ লাগে, সুতরাং বোর হয়তো জার্মানির পরমাণু অস্ত্রের কথা বলছেন। তাই অস্ত্রের সম্ভাবনা আলোচনার কমিটির নাম দেওয়া হয় MAUD কমিটি। বোর ব্রিটেনে আসার পরে বোঝা গেল কেন্টে তাঁর পুরানো বাড়িওয়ালি মড রে-কে খবর দেওয়ার জন্য বলেছিলেন।

অবশ্য যুদ্ধরত ব্রিটেনের পক্ষে বেশিদিন টিউব অ্যালয় প্রকল্প চালানো সম্ভব ছিল না, তা শেষ পর্যন্ত আমেরিকার পরমাণু বোমা প্রকল্প মানহাটানের অধীনে চলে যায়। নিল্‌স ও আগি বোর ডিসেম্বর মাসে আমেরিকা পৌঁছান, সেখানে নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের নাম দেওয়া হয় নিকোলাস ও জেমস বেকার। বোর নিজে মনে করতেন যে মানহাটান প্রকল্পে তিনি বিশেষ কোনো সহায়তা করেন নি, কিন্তু প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক অধিকর্তা রবার্ট ওপেনহাইমার লিখেছেন যে একটা ছোট্ট কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বোরের সহায়তা কাজে লেগেছিল।

বোর পরমাণু অস্ত্র বিষয়ে বেশি কাজ না করলেও যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে তার কী প্রভাব পড়বে সেই নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। মানহাটান প্রকল্পের কথা ইঙ্গমার্কিন পক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়ন বা অন্য মিত্র দেশকেও জানায়নি। বোর চেয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরমাণু অস্ত্রের কথা জানানো হোক এবং তার উপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ থাকুক। এই দাবি নিয়ে তিনি মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে দেখা করেন। তাতে অবশ্য কোনো ফল হয়নি, বরঞ্চ বোরের উপরে নজর রাখার সিদ্ধান্ত হয়। চার্চিল এমনকি বোরকে গ্রেপ্তারের কথাও ভেবেছিলেন। বোরের আশঙ্কা সত্যি হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পৃথিবী এক পারমাণবিক অস্ত্র দৌড়ের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধের পরে বোর ইউনাইটেড নেশনস্‌কে লেখা এক খোলা চিঠিতে আবারও আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেন। পরবর্তীকালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি গঠনের সময় মূলত তাঁর প্রস্তাবকেই অনুসরণ করা হয়েছিল। তিনি অ্যাটম্‌স ফর পিস পুরস্কারের প্রথম প্রাপক। বোর ছিলেন আন্তর্জাতিকতাতে বিশ্বাসী, উনিশশো তিরিশের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণের পরে সোভিয়েত ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর সপ্রশংস উক্তি দেশে সমালোচনার মুখে পরেছিল। নিল্‌স বোর ভারতে এসেছিলেন; ১৯৬০ সালে মুম্বাইতে সায়েন্স কংগ্রেসে তিনি যোগ দেন। তার পরে তিনি কলকাতাতে এসেছিলেন এবং সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোরের বয়স প্রায় ষাট ছুঁয়েছিল, তবু তাঁর সাহায্য পাওয়ার জন্য সব পক্ষ উদ্‌গ্রীব ছিলেন। পিওতর কাপিৎজার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নও ১৯৪৩ সালে তাঁকে গবেষণার সমস্ত রকম সুযোগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কাপিৎজা চিঠিতে লিখেছিলেন যে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা যথাসাধ্য যুদ্ধের কাজে সাহায্য করছেন; অনুচ্চারিত ছিল যে বোরের সহায়তা তাঁরা চান। কেন সবাই তাঁর সাহায্য চাইতেন তা নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জেমস ফ্রাঙ্কের এক সাক্ষাৎকার থেকে বোঝা যায়। জার্মানি ত্যাগের পরে ফ্রাঙ্ক কোপেনহেগেনে ছিলেন, তিনি কিছু পরীক্ষা করে যখনই বোরকে বলতে যেতেন, বোর সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে কী ঠিক কী ভুল তা বলে দিতেন। এত তাড়াতাড়ি বোর সমস্ত বিষয় বুঝে ফেলতেন যে শেষে ফ্রাঙ্ক নিজেই চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাততম পদার্থবিজ্ঞানীদের তালিকায় বোর একেবারে প্রথমদিকে থাকবেন। কিন্তু শুধু বিজ্ঞানী নয়, মানুষ বোরকেও আমরা বহুদিন শ্রদ্ধায় স্মরণ করব। 

 

প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, উৎসব সংখ্যা  

বোরের পরমানুর মডেল নিয়ে আরো একটু বেশি আলোচনা ব্লগের এই লেখাটাতে পাওয়া যাবে। 

3 comments:

  1. Thanks a lot. A very beautiful narration. I am enriched.

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো লেখাটা । অনেক অজানা তথ‍্য জানতে পারলাম ।

    ReplyDelete
  3. সুন্দর লেখা... 🤗

    ReplyDelete