Saturday 15 October 2022

আইসোটোপ আবিষ্কার ও দুই বিজ্ঞানী

 

আইসোটোপ আবিষ্কার ও দুই বিজ্ঞানী

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

আজ তোমাদের দুই বিজ্ঞানীর গল্প শোনাব, তাঁদের নাম ফ্রান্সিস অ্যাস্টন ও ফ্রেডরিক সডি। দুজনের মধ্যে অনেক মিল ছিল; দুজনেরই জন্ম ইংল্যান্ডে, একদিন আগে পরে। দুজনে রসায়নে পরপর দু'বছরের জন্য নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন, কিন্তু তাঁরা পুরস্কারটি গ্রহণ করেছিলেন একই দিনে, আজ থেকে একশো বছর আগে। দুজনের বিষয়ও এক, আইসসোটোপ বিষয়ে গবেষণার জন্য তাঁরা পুরস্কার পেয়েছিলেন। দুজনের জীবনের গল্পের মধ্যে কিন্তু তফাত ছিল আকাশপাতাল।

গল্প শুরু করার আগে দেখে নিই আইসোটোপ কাকে বলে। কোনো নির্দিষ্ট মৌলের নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা নির্দিষ্ট, কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা আলাদা আলাদা হতে পারে তাদের বলে ঐ মৌলের আইসোটোপ। যেমন ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসে আছে ৯২টা প্রোটন। ইউরেনিয়াম-২৩৮ আইসোটোপের নিউক্লিয়াসে আছে ১৪৬টা নিউট্রন আর ইউরেনিয়াম-২৩৫ আইসোটোপের নিউক্লিয়াসে আছে ১৪৩টা নিউট্রন। ভরসংখ্যা হলো কোনো পরমাণুতে প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা। মৌলিক পদার্থের রাসায়নিক ধর্ম প্রোটনের সংখ্যার উপর নির্ভর করে, তাই একই মৌলের সমস্ত আইসোটোপের রাসায়নিক ধর্মে কোনো তফাত নেই। একই রকম ভাবে হাইড্রোজেনের তিনটে আইসোটোপ আছে, যাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা প্রোটন আছে, কিন্তু তাদের ভর সংখ্যা এক, দুই বা তিন। তবে মনে রেখো আমরা যে সময়ের গল্প বলছি তখন প্রোটন, নিউট্রন, নিউক্লিয়াস এ সমস্ত সবে আবিষ্কার হচ্ছে। আর্নেস্ট রাদারফোর্ড পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন ১৯১১ সালে। মেন্দেলিয়েভের পর্যায়সারণীতে প্রতিটি মৌল নির্দিষ্ট ঘরে বসে, সেই ঘরের নম্বরকে বলা হত পারমাণবিক সংখ্যা। পরে বোঝা যায় যে সেই সংখ্যাটাই হল মৌলের নিউক্লিয়াসের প্রোটনের সংখ্যা। চ্যাডউইক নিউট্রন আবিষ্কার করেন ১৯৩২ সালে, সে অবশ্য আমাদের গল্পের অনেক পরের ঘটনা। আরো একটা কথা আমাদের আলোচনাতে আসবে, পারমাণবিক গুরুত্ব। খুব জটিলতার মধ্যে না গিয়ে বলতে পারি যে কোন মৌলের পরমাণুর ভর সব থেকে হালকা মৌল হাইড্রোজেনের পরমাণুর ভরের যতগুণ তাকে বলে তার পারমাণবিক গুরুত্ব; যেমন রসায়নবিদরা ক্লোরিনের পারমাণবিক গুরুত্ব মেপে পেয়েছিলেন ৩৫.৫।

এবারে আসল গল্প শুরু করা যাক। ফ্রান্সিস অ্যাস্টনের জন্ম ১৮৭৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের কাছে একটা ছোট্ট গ্রাম ক্যামোমাইল গ্রিনে। তাঁর বাবার নাম উইলিয়াম, মায়ের নাম ছিল ফ্যানি। ফ্যানির বাবা আইজ্যাক হলিসের ছিল বন্দুক তৈরির ব্যাবসা। উইলিয়াম ছিলেন চাষী, পাশাপাশি তাঁর ছিল ছোটখাটো একটা ব্যাবসা। সাত ভাইবোনের মধ্যে অ্যাস্টন ছিলেন তৃতীয়।

ফ্রেডেরিক সডি জন্মেছিলেন অ্যাস্টনের ঠিক পরের দিন ইংল্যান্ডের ইস্টবোর্নে। ইস্টবোর্ন হল ইংল্যান্ডের একফম দক্ষিণে সমুদ্রের ধারের এক শহর, সেখানে লোকে ছুটি কাটাতে যায়। সডিরাও সাত ভাইবোন, সডি ছিলেন সবার ছোটো। সডির বাবা ছিলেন বেশ সচ্ছল ব্যাবসাদার। 

ফ্রান্সিস অ্যাস্টন


ফ্রেডেরিক সডি

অ্যাস্টনের বিজ্ঞান বিষয়ে কৌতূহল ছিল ছোটবেলা থেকে। তাঁর জীবনের প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণা খুবই গোপনে করা হয়েছিল, তার একমাত্র সাক্ষী ছিলেন তাঁর ছোট বোন হেলেন। একটা পরিত্যক্ত শুয়োরের খোঁয়াড়ে সালফিউরিক অ্যাসিড আর দস্তার টুকরো দিয়ে করা সেই পরীক্ষাতে নিশ্চয় হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি হয়েছিল, তবে হেলেনের সে কথা মনে নেই। পরে তাঁদের আস্তাবলের উপরে একটা মাচা হয়েছিল অ্যাস্টনের পরীক্ষাগার; হেলেন আর আরও ছোট বোন মেরি অ্যাস্টনের বাজি ও ফানুস বানানো, তড়িৎকুণ্ডলীর জন্য তার পাকানো ইত্যাদি নানা যুগান্তকারী গবেষণা উৎসাহ নিয়ে দেখতে যেতেন।

সডিদের পরিবারে ধর্ম নিয়ে আলোচনাই বেশি হত। কিন্তু সডিরও অ্যাস্টনের মতোই ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞানে আগ্রহ ছিল, তাঁদের পরিবারে তিনিই এ ব্যাপারে প্রথম। তিনি স্থানীয় স্কুলে পড়েছিলেন, উনিশ বছর বয়সেই তিনি মার্টন কলেজে ভর্তি হন। এর মধ্যেই দু'জন রয়্যাল সোসাইটির ফেলোর সঙ্গে তাঁর কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। রসায়নে তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র ছিল অ্যামোনিয়া ও কার্বন ডাই অক্সাইডের কিছু ধর্ম বিষয়ে, সেটি যখন প্রকাশিত হয় তখন তাঁর বয়স মাত্র সতেরো। অক্সফোর্ডে দু'বছর পড়াশোনা করার পরে ১৮৯৮ সালে বিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে অনার্স ডিগ্রি নিয়ে পাস করলেন সডি, তারপরে আরো দু'বছর সেখানে স্বাধীনভাবে গবেষণা করেছিলেন। সে সময় জৈব রসায়ন বিষয়ে তিনি কাজ করেছিলেন।

সডি অক্সফোর্ডে পড়েছিলেন, কারণ সে সময় ইংল্যান্ডের সমস্ত ভালো ছাত্রই অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বা অন্তত লন্ডনে পড়তে যাওয়ার চেষ্টা করত। অ্যাস্টনের সে সুযোগ হয়নি। তাঁর পড়াশোনা গ্রামের স্কুলে, তারপরে ম্যাসন কলেজে, তখন বিশেষ কেউ তার নাম জানত না। সেই সময় তিনি কাঠের ও কাচের কাজ শিখেছিলেন, তা পরে তাঁর গবেষণাতে বিশেষ সাহায্য করেছিল। অ্যাস্টনও ১৮৯৮ সালেই কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন নিয়ে পাস করেছিলেন। পরের বছর জীবনের প্রথম গবেষণাপত্র ছাপান। তাঁরও সেই সময়ে উৎসাহ ছিল জৈব রসায়ন বিষয়ে, গবেষণার জন্য একটা বৃত্তিও পেয়েছিলেন। টার্টারিক অ্যাসিড বিষয়ে তাঁর সেই গবেষণা ১৯০১ সালে প্রকাশিত হয়। তবে চাকরির সুযোগ জুটছে না বলে বাবার ইচ্ছাতে তিনি মদ তৈরির বিষয়ে শিক্ষানবীশি করেন। বাবার পক্ষেও ছেলেকে বেশিদিন সাহায্য করা সম্ভব ছিল না, তাই ১৯০০ সালে তিনি মদ তৈরির এক কারখানাতে কেমিস্টের চাকরি নেন।

সডি ১৯০০ সালে কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদের জন্য আবেদন করেছিলেন। তিনি ছিলেন একটু খামখেয়ালি প্রকৃতির, তিনি সোজা টরন্টোতে চলে যান। অভিজ্ঞতা কম বলে চাকরিটা তাঁর হয়নি। তবে কানাডারই মন্ট্রিল শহরে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে সডি চাকরি পেলেন। অধ্যাপক নয়, ডেমোনস্ট্রেটরের চাকরি, মাইনে বছরে মাত্র একশো পাউন্ড। সডির বাবা অবশ্য তাঁকে আর্থিক সাহায্য পাঠাতেন, সেজন্য সডির খুব একটা অসুবিধা হয়নি। সেই সময়েই ম্যাকগিলে পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপক পদে যোগ দিলেন তরুণ বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। সডি তাঁর সঙ্গে কাজ শুরু করেন।

১৯০০ থেকে ১৯০৩ সাল অ্যাস্টন চাকরি করেছেন মদ তৈরির কারখানাতে। সেই তিন বছর ম্যাকগিলে গবেষণা করে রাদারফোর্ড ও সডি তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে নতুন দিগন্ত খুলে দিলেন। তাঁদের গবেষণা থেকে বোঝা গেল যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বেরোনোর সময় এক মৌল অন্য মৌলে পরিবর্তিত হয়। ১৯০৮ সালে রাদারফোর্ড রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তার পিছনে সডির সঙ্গে তাঁর গবেষণার গুরুত্ব কম ছিল না।

১৯০৩ সালে সডি ব্রিটেনে ফিরে এসে বিখ্যাত বিজ্ঞানী উইলিয়াম র‍্যামজের সঙ্গে কাজ শুরু করেছিলেন। নিষ্ক্রিয় গ্যাস আবিষ্কারের স্বীকৃতিতে র‍্যামজে ১৯০৪ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। র‍্যামজে ও সডি দেখান যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণে যে আলফা কণা নির্গত হয় তা প্রকৃতপক্ষে নিষ্ক্রিয় গ্যাস হিলিয়ামের আয়নিত রূপ। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, এই গ্যাস র‍্যামজেই পৃথিবীতে প্রথম খুঁজে পেয়েছিলেন। গ্যাসটি কিন্তু প্রথম পর্যবেক্ষণ হয়েছিল সূর্যের মধ্যে, এবং ১৮৬৮ সালে ভারত থেকে এক সূর্যগ্রহণের সময় তাকে প্রথম দেখা গিয়েছিল।

অ্যাস্টন ১৯০৩ সালে চাকরি ছেড়ে আবার ম্যাসন কলেজে গবেষণা শুরু করেন। অবশ্য ততদিনে তা হয়েছে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়। তার আগেই কিন্তু তিনি নিজের চেষ্টাতে তড়িৎ মোক্ষণ নল বা ডিসচার্জ টিউব নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। এই নলের ভিতরের কম চাপে গ্যাস ভরে তার মধ্যে দিয়ে তড়িৎ পাঠানো হয়। আমাদের চেনা টিউবলাইট বা সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্প এইরকম নল। জে জে টমসন তড়িৎ পাঠিয়ে দেখেছিলেন যে ঋণাত্মক তড়িৎদ্বার বা ক্যাথোড থেকে ধনাত্মক তড়িৎদ্বার বা অ্যানোডের দিকে এক অতি হালকা ঋণাত্মক আধানের কণার স্রোত প্রবাহিত হয়, তিনি সেই কণার নাম দিয়েছিলেন ইলেকট্রন। নিজে নিজে গবেষণা করে অ্যাস্টন মোক্ষণ নলে আরো কিছু পর্যবেক্ষণ করেছিলেন; বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সেই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান। ১৯০৯ সালে তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই পদার্থবিজ্ঞানে লেকচারার হয়েছিলেন, কিন্তু এক বছরের মধ্যেই টমসনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে তাঁর সহকারী হিসাবে যোগ দেন। এখানেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়, জীবনের বাকি পঁয়ত্রিশ বছর তিনি কেমব্রিজেই কাটাবেন।

সডি তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণার জন্য ইতিমধ্যেই বেশ পরিচিতি লাভ করেছিলেন, ১৯০৪ সালে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ভৌত রসায়নের অধ্যাপক নিয়োগ করে। সডি সেখানে তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যান। ১৯১৫ সালে তিনি যোগ দেন এবার্ডিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই সময়েই তিনি মৌলের আইসোটোপ আবিষ্কার করেন, কেমনভাবে তা দেখা যাক।

তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে আলফা বিটা ও গামা এই তিন ধরনের বিকিরণ বেরোয়। ১৯১৩ সালে সডি ও অপর এক বিজ্ঞানী কাসিমির ফাইয়ান্স আলাদা আলাদা ভাবে বলেন যে আলফা ক্ষয়ে মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা দুই এবং পারমাণবিক গুরুত্ব চার কমে। বিটা ক্ষয়ে পারমাণবিক গুরুত্ব পালটায় না, কিন্তু পারমাণবিক সংখ্যা এক বাড়ে। এই সূত্রকে বলা হয় ফাইয়ান্স-সডি সূত্র।

বিজ্ঞানীরা ভাবতেন যে কোনো মৌলের সমস্ত পরমাণুর ভর সমান। সুতরাং পারমাণবিক ভর আলাদা হলে মৌলগুলোও আলাদা। তাই রসায়নবিদরা মৌলের পারমাণবিক গুরুত্ব খুব যত্ন নিয়ে মাপতেন। যখন বোঝা গেল তেজস্ক্রিয়াতে এক মৌল অন্য মৌলে রূপান্তরিত হচ্ছে, তখন মনে করা হলো যে অনেক আলাদা আলাদা মৌল পাওয়া যাচ্ছে। দু'একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। থোরিয়াম থেকে আলফা ক্ষয়ের মাধ্যমে যে মৌল পাওয়া গিয়েছিলে, তার নাম দেওয়া হয়েছিলে মেসোথোরিয়াম-I। এখন আমরা জানি যে থোরিয়াম-২৩২ আলফা ক্ষয়ের মাধ্যমে হয় রেডিয়াম-২২৮, সেটাকেই মেসোথোরিয়াম-I বলা হচ্ছিল। আবার ইউরেনিয়াম-২৩৮-এর ক্ষয় থেকে পাওয়া যায় রেডিয়াম-২২৬, মেরি ও পিয়ের কুরি এই আইসোটোপটাকেই আবিষ্কার করেছিলেন। মৌলটা একই, এরা রেডিয়ামের আলাদা আলাদা আইসোটোপ কিন্তু সেই সময় এ কথা জানা ছিল না। থোরিয়াম ও ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক গুরুত্ব জানা ছিল, ফাইয়ান্স-সডি সূত্র থেকে বোঝা যাচ্ছিল ইউরেনিয়াম থেকে পাওয়া রেডিয়াম এবং থোরিয়াম থেকে পাওয়া মেসোথোরিয়ামের পারমাণবিক গুরুত্ব আলাদা। তাই মনে করা হচ্ছিল মেসোথোরিয়াম-I একটা নতুন মৌল। তেমনি তার থেকে পরপর দুবার বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে হয় যথাক্রমে অ্যাক্টিনিয়াম-২২৮ ও থোরিয়াম-২২৮। এই দুটোর নাম দেওয়া হয়েছিল মেসোথোরিয়াম-II ও রেডিওথোরিয়াম।

১৯০৭ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী হার্বার্ট ম্যাককয় ও উইলিয়াম রস দেখেন যে থোরিয়াম ও রেডিওথোরিয়ামের রাসায়নিক ধর্মে কোনো পার্থক্য নেই। সডিই প্রথম বলেন যে এই ধরনের মৌল যাদের রাসয়ানিক ধর্ম একদম এক, তারা আসলে আলাদা আলাদা মৌল নয়। তিনি বললেন যে ইউরেনিয়ামের ক্ষয়শৃঙ্খলে ইউরেনিয়াম-২৩৮ থেকে শেষ পর্যন্ত সিসা-২০৬ তৈরি হচ্ছে। ঠিক তেমনি থোরিয়াম-২৩২ থেকে শেষ পর্যন্ত তৈরি হবে সিসা-২০৮। সাধারণ সিসার পারমাণবিক গুরুত্ব মেপে পাওয়া গিয়েছিল ২০৭.২। সডির যুক্তি, এই মানটা আসলে দুটো আলাদা ভরসংখ্যার গড়। ইউরেনিয়ামের ক্ষয়ের ফলে যে সিসা তৈরি হয় আর থোরিয়ামের ক্ষয়ের ফলে সে সিসা তৈরি হয়, তাদের পারমাণবিক গুরুত্ব মেপে প্রমাণ করা যাবে যে একই মৌলের পরমাণুর আলাদা আলাদা গুরুত্ব হওয়া সম্ভব। সডিই এদের নাম দিলেন আইসোটোপ।

ফিত্রে আসি অ্যাস্টনের কথায়। মোক্ষণ নলে তড়িৎপ্রবাহ পাঠিয়ে ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন টমসন। মোক্ষণ নলের ভিতরে যেমন ইলেকট্রনের প্রবাহ হয়, তেমনি গ্যাসের অণুগুলি সংঘর্ষের ফলে ইলেকট্রন ছেড়ে ধনাত্মক আয়ন তৈরি করে, তারা ইলেকট্রনের উল্টোদিকে অর্থাৎ অ্যানোড থেকে ক্যাথোডের দিকে প্রবাহিত হয়। একে বলা হত ধনাত্মক রশ্মি, টমসন এই বিষয়ে গবেষণা করছিলেন, অ্যাস্টনও তাঁর সঙ্গে যোগ দেন।

১৯১৪ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে অ্যাস্টন ও সডি দুজনেরই কাজ বিঘ্ন ঘটে। সডি তাঁর নিজের ল্যাবরেটরিতে যুদ্ধ সংক্রান্ত গবেষণা করেছিলেন। যুদ্ধের শেষদিকে ১৯১৮ সালে তিনি অক্সফোর্ডে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। অ্যাস্টন কাজ করেছিলেন যুদ্ধবিমান তৈরির এক কারখানাতে, একবার তিনি এক বিমান দুর্ঘটনাতেও পড়েন কিন্তু বেঁচে যান। যুদ্ধের পরে তিনি আবার গবেষণা শুরু করেন।

আইসোটোপ বিষয়ে অ্যাস্টনের গবেষণার কথায় পরে আসছি; তার আগে সেই সময় তাঁর সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা কী মনে করতেন দেখা যাক। অ্যাস্টন গবেষণার মাধ্যমে কেমব্রিজের বিএ ডিগ্রি পেয়েছিলেন ১৯১২ সালে, তখন তাঁর বয়স পাঁয়ত্রিশ। টমসন ছিলেন সে যুগের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী, তাঁর সঙ্গে কাজের যেমন সুবিধা আছে, তেমনি সমস্যাও আছে। অ্যাস্টনের নোবেল পুরস্কারের পরে মেঘনাদ সাহা লিখেছিলেন যে অ্যাস্টনের পরিচিত এক বিজ্ঞানী তাঁকে বলেন অ্যাস্টনের বিশেষ মাথা নেই, টমসনের বুদ্ধিতেই তিনি চলেন; অ্যাস্টন আসলে বিজ্ঞানী নন, মেকানিক মাত্র। এমনকি অ্যাস্টনের ঘনিষ্ঠ ও তিনি যে ল্যাবরেটরিতে কাজ করে নোবেল পেয়েছিলেন তার প্রধান আর্নেস্ট রাদারফোর্ডও তাঁর নোবেলের খবরে বিস্ময় চেপে রাখতে পারেননি। বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাস্টনের সঙ্গে আরো কয়েকজন বিজ্ঞানী একই জায়গায় কাজ করতেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন দুই বিখ্যাত বিজ্ঞানী চার্লস লিন্ডেমান ও টমসনের ছেলে ও পরবর্তীকালের নোবেল বিজয়ী জি পি টমসন। লিন্ডেমানের সঙ্গে অ্যাস্টনের প্রায়ই তর্ক লাগত। জি পি টমসন স্মৃতিচারণ করেছেন যে লিন্ডেমানের বিজ্ঞানের তত্ত্বে দখল ছিল বেশি, তিনি সব সময়েই জিততেন; কিন্তু অ্যাস্টন কিছুতেই নিজের মত থেকে নড়তেন না। তর্কের মধ্যে লিন্ডেমান একবার বলেছিলেন, "তুমি তো টমসনের ল্যাবরেটরিতে বোতল ধোয়ার চাকরি করো, তুমি এসব বুঝবে না।" কথাটা মজা করেই বলেছিলেন, অ্যাস্টনও কিছু মনে করেননি। তাঁদের আলোচনা নিয়ে দুজনে পরে একটা গবেষণাপত্রও লিখেছিলেন; কিন্তু বিজ্ঞানীমহলে অ্যাস্টনের পরিচিতি কী ছিল তা এই কথাটা থেকে বোঝা যায়।

কোনো কিছু নিয়ে লেগে থাকার ক্ষমতা কিন্তু অ্যাস্টনের ছিল অসাধারণ, যতক্ষণ না সমস্যাটার সমাধান হচ্ছে তিনি ছেড়ে দিতেন না। অ্যাস্টন তাঁর সঙ্গে যোগ দেওয়ার আগে টমসন ধনাত্মক রশ্মি নিয়ে প্রায় পাঁচ বছর কাজ করেও বিশেষ এগোতে পারেন নি। কাচ তৈরির বিষয়ে কাজ করার দক্ষতা অ্যাস্টনের কাজে লাগল, তিনি অনেক উন্নত মানের মোক্ষণ নল ও সংশ্লিষ্ট আরো অনেক যন্ত্রপাতি বানাতে শুরু করলেন। মোক্ষণ নলের মধ্যে নিয়ন গ্যাস নিয়ে কাজ করার সময় দেখা গেল দুই রকমের ধনাত্মক রশ্মি পাওয়া যাচ্ছে, যাদের ভরসংখ্যা হল ২০ ও ২২। তাঁরা প্রথমে ভেবেছিলেন যে তাঁরা এক নতুন মৌল পেয়েছেন, অ্যাস্টন তার নাম দেন মেটা-নিয়ন। মোটামুটি এই সময় থেকেই অ্যাস্টন স্বাধীন ভাবে গবেষণা শুরু করেন।

কোনো রকম রাসয়ানিক উপায়ে মেটা-নিয়নকে নিয়ন থেকে আলাদা করা গেল না। বর্ণালী বিশ্লেষণ হল মৌল চেনার সবসেরা উপায়, কিন্তু সেখানেও নিয়নের থেকে আলাদা করে মেটা-নিয়নের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। নিলস বোর, রাদারফোর্ড, টমসন, এবং অ্যাস্টন এই নিয়ে বিভিন সময়ে চিন্তাভাবনা করেছিলেন, তাঁরা অনুমান করলেন মেটা-নিয়ন কোনো নতুন মৌল নয়, নিয়নের আইসটোপ। সডি যেমন তেজস্ক্রিয় মৌলে আইসোটোপ খুঁজে পেয়েছেন, অ্যাস্টন ও টমসন নিয়নের মতো সাধারণ মৌলেও ঠিক একই চিহ্ন পেয়েছেন। কিন্তু অনুমান এক কথা, তার প্রমাণ আলাদা। সেই প্রমাণ পাওয়ার আগেই বিশ্বযুদ্ধ বাঁধে ও অ্যাস্টনের গবেষণা কয়েক বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।

যুদ্ধের সময় অন্য কাজের মধ্যেও অ্যাস্টন এই নিয়ে চিন্তা করছিলেন, লিন্ডেমানের সঙ্গে তাঁর এই নিয়েই আলোচনা হত। যুদ্ধের পরে কেমব্রিজে ফিরে তিনি ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে ১৯১৯ সালে আইসোটোপের পক্ষে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য যে যন্ত্র বানান, তা একশো বছর পরেও কলেজে বিজ্ঞানের ক্লাসে পড়ানো হয়, এবং পরিবর্তিত রূপে নিউক্লিয় গবেষণাতে ব্যবহার হয়। আলোর বর্ণালীর কথা আগে শুনেছি, অ্যাস্টন বানালেন ভরের বর্ণালীবিশ্লেষক (Mass spectrograph)। খুব জটিল আলোচনাতে যাব না; অ্যাস্টনের যন্ত্রে মৌলিক পদার্থের পরমাণুকে প্রথমে আয়নিত করা হয়, তারপর সেই আয়নকে তড়িৎক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে পাঠানো হয়। এর ফলে তাদের বেগ বেড়ে যায়। তারপর বেগের সঙ্গে লম্বভাবে একটি চুম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করে বিভিন্ন ভরের কণাদের আলাদা করা হয়; তারপর তাদের ফটোগ্রাফিক প্লেটের আলাদা আলাদা জায়গায় ফোকাস করা হয়। অ্যাস্টন দেখালেন যে প্রাকৃতিক নিয়নের মধ্যে দুটি আইসোটোপ আছে, তেমনি ক্লোরিনেরও দুটি আইসোটোপ আছে। অন্যান্য মৌলিক পদার্থের মধ্যে আবার বিভিন্ন সংখ্যায় আইসটোপ পাওয়া যায়। এর আগে পর্যন্ত পারমাণবিক গুরুত্ব প্রায়শই ভগ্নাংশে পাওয়া যেত, অ্যাস্টন দেখালেন যে এই ভগ্নাংশগুলি আসলে বিভিন্ন আইসোটোপের গড়, কিন্তু প্রতিটি আইসোটোপের ভরসংখ্যা আসলে পূর্ণ সংখ্যার খুব কাছাকাছি, সেটাকেই এখন আমরা বলি নিউক্লিয়াসের ভরসংখ্যা অর্থাৎ প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা। লেখার শুরুতেই ক্লোরিনের কথা বলেছিলাম, অ্যাস্টনই দেখিয়েছিলেন প্রাকৃতিক ক্লোরিনের মধ্যে পঁয়ত্রিশ ভরসংখ্যার আইসটোপ আছে পঁচাত্তর শতাংশ ও সাঁইত্রিশ ভরসংখ্যার আইসোটোপ আছে পঁচিশ শতাংশ। গড় করে পাওয়া যায় ৩৫., রসায়নবিদরা সেটাই পাচ্ছিলেন। এই আবিষ্কারের ফলেই নিউক্লিয়াস কী দিয়ে তৈরি তা পরবর্তীকালে বোঝা সম্ভব হয়। আগেই বলেছি পারমাণবিক গুরুত্ব ঠিকঠাক মাপার জন্য সে যুগের রসায়নবিদরা অনেক পরিশ্রম করতেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র এই সময় সডিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনারা এত খেটে পরমাণুর ওজন নির্ভুল্ভাবে বার করছেন, অ্যাস্টনের মত ঠিক হলে আপনাদের এত পরিশ্রম তো জলে গেল? সডি উত্তর দিয়েছিলেন, তা তো বটেই।

বিভিন্ন মৌলের মোট ২৮৭টি আইসোটোপ প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়; অ্যাস্টন তাদের মধ্যে ২১২টিকে এভাবে পৃথক পৃথক করে দেখিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে অ্যাস্টন তাঁর যন্ত্রের আরো অনেক উন্নতি করেছিলেন, তিনি দেখান নিউক্লিয়াসের ভর তাদের কণার মোট ভরের থেকে সামান্য কম, এই হল নিউক্লিয়াসের বন্ধনী শক্তি। আইনস্টাইনের বিখ্যাত ভর ও শক্তির সমতুল্যতা সূত্র E=mc2-এর এই হল প্রথম পরীক্ষামূলক প্রমাণ। বন্ধনীশক্তির মান ঋণাত্মক, সেকারণে নিউক্লিয়াসের ভর তার মধ্যের কণাদের ভরের থেকে একটু কম।

ফ্রেডরিক সডির নাম প্রথমবার নোবেলের জন্য প্রস্তাবিত হয় ১৯০৮ সালে। মোট পাঁচবার তাঁর নাম নোবেল কমিটির কাছে এসেছিল, তার মধ্যে তিনবার পাঠিয়েছিলেন তাঁর এক সময়ের সহকর্মী রাদারফোর্ড। ১৯২১ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার কাউকে দেওয়া হয়নি, সেই পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯২২ সালে। রদারফোর্ডের ১৯২২ সালের মনোনয়নের উপর ভিত্তি করে সডিকে সেই পুরস্কার দেওয়া হয়। নোবেল কমিটি জানিয়েছিল তেজস্ক্রিয় পদার্থের রসায়ন এবং আইসোটোপের উৎস ও প্রকৃতি বিষয়ে গবেষণার জন্য তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানেও ১৯২১ সালের পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছিল ১৯২২ সালে, পেয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। ১৯২২ সালের পদার্থবিজ্ঞানের পুরস্কার পান নিল্‌স বোর।

অ্যাস্টনের নাম নোবেলের জন্য প্রস্তাবিত হয় ১৯২২ সালে। চারজন আলাদা আলাদাভাবে মনোনয়ন পাঠিয়েছিলেন; তাঁদের মধ্যে তিনজন পদার্থবিদ্যা ও একজন রসায়নের পুরস্কারের জন্য প্রস্তাব পাঠান। তা সত্ত্বেও নোবেল কমিটি অ্যাস্টনকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য রসায়নকে বেছে নেয়, সম্ভবত তার কারণ সেই বছর পদার্থবিদ্যার পুরস্কারের জন্য আলবার্ট আইনস্টাইন ও নিল্‌স বোরের মতো দিকপাল বিজ্ঞানীদের সমর্থনে অনেকগুলি প্রস্তাব জমা পড়েছিল। নোবেল কমিটি উল্লেখ করেছিল যে ভরের বর্ণালী বিশ্লেষক ব্যবহার করে তেজস্ক্রিয় নয় এমন সাধারণ মৌলের আইসটোপ আবিষ্কার এবং পরমাণুর ভর যে হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরের পূর্ণসংখ্যার গুণিতক তা দেখানোর জন্য তাঁকে সেই সম্মান দেওয়া হয়। ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে একই জাহাজে অ্যাস্টন ও সডি সুইডেনে যান, ১০ ডিসেম্বরে দুজনেই পুরস্কার গ্রহণ করেন। নোবেল বক্তৃতাতে দুজনেই অন্যের নাম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করেন।

আমরা দেখলাম যে আইসোটোপের দুই আবিষ্কারকের জীবনধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারাতে প্রবাহিত হয়েছিল। নোবেল পুরস্কারের অনেক আগে থেকেই সডি বিজ্ঞানী হিসাবে তাঁর কৃতিত্বের জন্য সুপরিচিত ছিলেন; ব্রিটেনের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তাঁকে পাওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব ছিল। ১৯২০ সালের আগে অ্যাস্টনের স্থায়ী চাকরি জোটেনি, সেই বছর তাঁকে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের ফেলো নির্বাচিত করা হয়। তিনি কখনোই অধ্যাপক পদে কাজের সুযোগ পাননি। দুই আবিষ্কারকের জীবন আমাদের দেখায় যে লক্ষ্যে পৌঁছানোর অনেক পথ আছে। প্রতিভার মতোই অধ্যবসায়, চেষ্টা ও উৎসাহ মানুষকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে। 

 

প্রকাশঃ  সায়ন্তনী শারদ সংখ্যা ১৪২৯ (২০২২)


No comments:

Post a Comment