স্টার্ন-গার্লাক পরীক্ষার শতবর্ষ
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাস এক অর্থে নানা যুগান্তকারী পরীক্ষার ইতিহাস বললে খুব একটা ভুল হবে না। পতনশীল বস্তুর উপর করা গ্যালিলিওর পরীক্ষা, নিউটনের আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ, আলোর তরঙ্গধর্ম সংক্রান্ত ইয়ঙের পরীক্ষা, ইথারের অস্তিত্ব বিষয়ে মাইকেলসন ও মর্লের পরীক্ষা — এইরকম বহু পরীক্ষার কথা বলা যায় যারা পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের গতিপথকেই পাল্টে দিয়েছে। এই লেখাতে তেমন এক পরীক্ষার ইতিহাসের কথা আমরা আলোচনা করব। পদার্থবিজ্ঞানের সমস্ত ছাত্রকেই এই স্টার্ন-গার্লাক পরীক্ষার কথা পড়তে হয়, বইতে লেখা থাকে এই পরীক্ষা থেকে ইলেকট্রনের স্পিনের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়। ইলেকট্রনের স্পিনের কথা প্রথম বলেছিলেন জর্জ উলেনবাক ও স্যামুয়েল গাউডস্মিট, কিন্তু সেটা ১৯২৫ সালে। অটো স্টার্ন ও ওয়াল্টার গার্লাক তাঁদের যুগান্তকারী পরীক্ষাটি করেছিলেন ১৯২২ সালে, আমরা এখন তার শতবর্ষ পালন করছি। তাঁরা সত্যিই স্পিন আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু তখন বা তার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত স্পিনের কথা কারো মাথাতে আসেনি। মৌলিক কণার স্পিনের কথা প্রথম বলেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। আমরা জানি আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গবেষণাপত্রটি অনুবাদ করেছিলেন, আলোর কণা ফোটনের স্পিনের সেই কথাটি তিনি অনুবাদের সময় বাদ দিয়েছিলেন। কিন্তু সে ঘটনাও ১৯২৪ সালের, অর্থাৎ স্টার্ন-গার্লাক পরীক্ষার দু'বছর পরের ঘটনা।
অটো স্টার্ন |
ওয়াল্টার গার্লাক |
কোয়ান্টাম কথাটা আমরা সবাই শুনেছি। যে সমস্ত মৌলিক পরীক্ষা কোয়ান্টাম তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছিল, স্টার্ন ও গার্লাকের পরীক্ষা তাদের মধ্যে অন্যতম। কোয়ান্টাম তত্ত্বের সূচনা হয় ১৯০০ সালে যখন মাক্স প্লাঙ্ক কৃষ্ণবস্তু থেকে বিকিরণের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের শক্তি সবসময় একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের গুণিতক হিসাবে নির্গত বা শোষিত হয়। সেই ন্যূনতম পরিমাণকে তিনি নাম দিয়েছিলেন কোয়ান্টাম; যদি তরঙ্গের কম্পাঙ্ক n হয়, তবে সেই ন্যূনতম শক্তির মান হল hn, এখন h-কে আমরা বলি প্লাঙ্কের ধ্রুবক।
আলোও এক প্রকার তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ। ১৯০৫ সালে আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আলবার্ট আইনস্টাইন বলেন যে আলো যে শুধু নির্দিষ্ট পরিমাণের গুণিতক হিসাবে নির্গত বা শোষিত হয় তা না, ওই কোয়ান্টামের নির্দিষ্ট ভরবেগ আছে। এরপর ১৯১৩ সালে নিল্স বোর হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণালী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেখালেন যে পরমাণুতে ইলেকট্রনদের কৌণিক ভরবেগও একইভাবে একটা ন্যূনতম পরিমাণের গুণিতক হিসাবে পাওয়া যায়, এবং সেই ন্যূনতম পরিমাণ h/2p, অর্থাৎ তা প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ পরমাণুর ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগের মান হল nh/2p ; এখানে n=1,2,3... এইরকম ধনাত্মক পূর্ণসংখ্যা হতে পারে।
বোরের মডেল তড়িৎ বা চৌম্বকক্ষেত্রে হাইড্রোজেন পরমাণুর থেকে নির্গত বর্ণালীর সমস্ত চরিত্র ব্যাখ্যা করতে পারছিল না। আর্নল্ড সমারফেল্ড ও পিটার ডিবাই আলাদা আলাদাভাবে দেখান যে শুধুমাত্র কৌণিক ভরবেগ nh/2p ধরে নিলেই এই সমস্ত চরিত্রের ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। বাইরে থেকে কোনো তড়িৎক্ষেত্র বা চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করলে ইলেকট্রনের আবর্তনতল ওই ক্ষেত্রের সঙ্গে কয়েকটি নির্দিষ্ট কোণ করে থাকবে, এবং সেই কোণগুলির মানও প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, এই অনুমানও জরুরি। কোয়ান্টাম সংক্রান্ত আগের ধারণাগুলির থেকে এই বিষয়টা অনেকটাই আলাদা বলে মনে করা হচ্ছিল। এখানে কোনো বিশেষ রাশির নয়, ইলেকট্রনের কক্ষপথ কোন দিকে থাকবে সে কথা বলা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে তারও কতকগুলো নির্দিষ্ট অভিমুখ আছে। সেজন্য এই ধারণাকে বলা হল স্পেস বা স্থান কোয়ান্টাইজেশন। একে অভিমুখের কোয়ান্টাইজেশনও বলা হত, স্টার্ন ও গার্লাক তাঁদের গবেষণাপত্রে তাই লিখেছিলেন। এই কথাটা আরো অর্থবহ হলেও বর্তমানে বিশেষ ব্যবহার হয় না।
অটো স্টার্নের জন্ম ১৮৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি ১৭ জার্মানির সোহারুতে। তাঁর বাবা অস্কার ছিলেন শস্য ব্যবসায়ী, মায়ের নাম ইউজেনিয়া। ১৯১২ সালে ব্রসলাউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ভৌত রসায়ন বিষয়ে ডক্টরেট করেন। আইনস্টাইনের খ্যাতিতে আকৃষ্ট হয়ে তিনি প্রথমে প্রাগে ও পরে জুরিখে তাঁর সঙ্গে কিছুদিন কাটান, সেই সময়েই তিনি পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক সমস্যাগুলির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাঁকে সৈন্যদলে যোগ দিতে হয়, তবে তার মধ্যেও তিনি পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিলেন। যুদ্ধের পরে তিনি ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে মাক্স বর্নের সহকারী হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ও ওয়াল্টার গার্লাক যে পরীক্ষাটি করেছিলেন, সেটিই এই অধ্যায়ে আমাদের আলোচ্য।
ওয়াল্টার গার্লাকের জন্ম জার্মানির বিয়েব্রিখ শহরে ১৮৮৯ সালের ১ আগস্ট। তাঁর বাবা ভ্যালেন্টিন, মাতের নাম মেরি। তাঁর পড়াশনা টুবিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনিও স্টার্নের মতোই ১৯১২ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি পান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সৈন্যবাহিনিতে কাজ করার সময়ে তিনিও পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন।
স্টার্ন ও গার্লাক যে পরীক্ষাটা করেছিলেন, সেটা বুঝতে গেলে আমাদের সে সময় কোয়ান্টাম তত্ত্বের অবস্থা কিছুটা জেনে নিতে হবে। বোরের পরমাণু মডেল ছিল সে সময়ের শ্রেষ্ঠ মডেল, সেই অনুযায়ী ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে। ইলেকট্রনের আধান বা বা চার্জ আছে, সুতরাং সেই গতি নিশ্চয় একটা তড়িৎপ্রবাহের সৃষ্টি করে। আমরা জানি যে তড়িৎপ্রবাহ চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করে,তড়িৎচুম্বক তৈরিতে তা ব্যবহার করা হয়। একইভাবে ইলেকট্রনের গতি একটা চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করবে, ফলে পরমাণু চুম্বকের মতো ব্যবহার করবে। তার যে চৌম্বক ভ্রামক বা ম্যাগনেটিক মোমেন্ট সৃষ্টি হবে, বোরের তত্ত্ব থেকে তার মান নির্ণয় করা যায়। এর যে ক্ষুদ্রতম মান, তা হল
mB=(e/2m)(h/2p)
একে বলা হয় বোর ম্যাগনেটন। এখানে হল e ইলেকট্রনের আধান ও m তার ভর। শেষের (h/2p) রাশিটি বোরের তত্ত্বে ইলেকট্রনের ভরবেগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যে ইলেকট্রনের কক্ষপথের বোর কোয়ান্টাম সংখ্যা n, তার চৌম্বক ভ্রামক হবে nmB।
স্টার্ন প্রথম প্রথম বোরের মডেলকে পছন্দ করতেন না, তিনি ও মাক্স ফন লউ ১৯১৩ সালে সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে বোর ঠিক প্রমাণিত হলে তাঁরা পদার্থবিজ্ঞানের জগৎ ছেড়ে দেবেন। পরে স্টার্ন কিছুটা মত পাল্টান। স্পেস কোয়ান্টাইজেশনের ধারণা অনুযায়ী যদি কোনো পরমাণুর উপরে চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করা হয়, তাহলে পরমাণুর আবর্তনতল চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে নির্দিষ্ট কয়েকটি মাত্র কোণ করবে। স্টার্ন বুঝতে পারলেন যে সমস্ত পরমাণুর গঠন হাইড্রোজেনের মতো, তাদের চৌম্বক ভ্রামক যে ইলেকট্রনের কক্ষপথ থেকে আসবে তার n কোয়ান্টাম সংখ্যার মান হল 1। অর্থাৎ তার কৌণিক ভরবেগ হল h/2p, সুতরাং চৌম্বক ভ্রামকের মান হবে mB। সেই পরমাণুর উপর এই চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করলে পরমাণুর আবর্তনতল তার সঙ্গে দুটি কোণ করতে পারে। প্রথম ক্ষেত্রে পরমাণুর চৌম্বক ভ্রামকটি হয় চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে সমান্তরালভাবে থাকবে অর্থাৎ দুজনের এক দিকে মুখ করে থাকবে। দ্বিতীয়ক্ষেত্রে তারা বিষমান্তরাল ভাবে(anti-parallel) থাকবে, দুজনে ঠিক বিপরীতদিকে মুখ করে থাকবে।
নিচের ছবি থেকে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। পরমাণুতে ইলেকট্রনের আবর্তনের ফলে সে উত্তর(N) ও দক্ষিণ(S) মেরুযুক্ত চুম্বকের মতো কাজ করবে। সেই ক্ষুদ্র চুম্বক ও বাইরের চৌম্বক ক্ষেত্র নিচের পরমাণুর মতো বিপরীত মুখ করে থাকবে নয়তো উপরের পরমাণুর মতো একই দিকে মুখ করে থাকবে। দুই ক্ষেত্রে চৌম্বকক্ষেত্র পরমাণুর উপরে আলাদা আলাদা বল প্রয়োগ করবে, ফলে তাদের হয়তো আলাদা করা সম্ভব হবে। তাহলে স্পেস কোয়ান্টাইজেশন সত্যিই ঘটে কিনা তা প্রমাণ হবে। শুধু তাই নয়, বলের পরিমাণ নির্ণয় করে বোর ম্যাগনেটনের মানও পরীক্ষামূলকভাবে নির্ণয় করা যাবে। পরমাণু চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে লম্বভাবে থাকতে পারে কিনা তা নিয়ে অবশ্য বিজ্ঞানীরা নিশ্চিন্ত ছিলেন না।
স্টার্ন অণু ও পরমাণুকে রশ্মির মতো ব্যবহার করে গ্যাসের কণাদের বেগ মাপার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি বুঝলেন একই পদ্ধতি ব্যবহার করে স্পেস কোয়ান্টাইজেশন দেখা সম্ভব। তিনি কথাটা প্রথম তুলেছিলেন তাঁর সিনিয়র মাক্স বর্নের কাছে, কিন্তু বর্ন তাঁকে নিরুৎসাহ করার চেষ্টা করেন। বর্নের মনে হয়েছিল যে স্পেস কোয়ান্টাইজেশন ইলেকট্রনের গতিবিধি হিসাব রাখার জন্য একটা পদ্ধতি মাত্র, বাস্তবে তার অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। পরে পিটার ডিবাইও গার্লাককে একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু স্টার্ন দমে যাননি, বর্ন আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে স্টার্ন তাঁকে বলেন তিনি একবার চেষ্টা করে দেখতে চান। তিনি সঙ্গী পেলেন ওয়াল্টার গার্লাককে। দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে তাঁরা একটা যন্ত্র বানিয়েছিলেন। আমরা নিচের ছবিতে তাঁদের যন্ত্রের একটা সহজরূপ দেখিয়েছি।
স্টার্ন ও গার্লাক তাঁদের পরীক্ষাতে রূপার পরমাণুকে ব্যবহার করেছিলেন। এখানে বাঁদিকের উৎস থেকে রূপার পরমাণুগুলি রশ্মি বা বিমের আকারে বেরিয়ে আসছে। উত্তর (N) ও দক্ষিণ (S) দুই চুম্বক মেরুর মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় তা চৌম্বক ক্ষেত্রের সমান্তরাল ও বিষমান্তরাল এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। চৌম্বক ক্ষেত্রটি অসমসত্ত্ব (inhomogeneous) হওয়া প্রয়োজন, সেইজন্য চুম্বকের উত্তর মেরুটিকে কীলকাকার নেওয়া হয়েছে। সমান্তরাল ও বিষমান্তরাল অভিমুখের পরমাণুর উপর চৌম্বক ক্ষেত্র ভিন্ন ভিন্ন বল প্রয়োগ করছে, ফলে পর্দাতে রূপার পরমাণুগুলি দুটি পরষ্পর বিচ্ছিন্ন রেখাতে গিয়ে পড়ছে। যদি স্পেস কোয়ান্টাইজেশনের অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে পরমাণুগুলি শুধুমাত্র সমান্তরাল ও বিষমান্তরাল নয়, মাঝের যে কোনো কোণেও অবস্থান করতে পারত। সেক্ষেত্রে দুই পাশের দুই রেখার মাঝেও রূপার পরমাণু গিয়ে পড়ত এবং পর্দাতে একটা চওড়া ছোপ দেখা যেত। যদি পরমাণু চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে লম্বভাবে অবস্থান করতে পারত তাহলে মাঝেও একটা রেখা পাওয়া যেত। পরীক্ষা থেকে বোঝা গেল তাও সম্ভব নয়। দুই রেখার মাঝের দূরত্ব মেপে রূপার পরমাণুর চৌম্বক ভ্রামকের মানও পাওয়া গেল, এবং তা বোরের মাপের সঙ্গে মিলে গেল।
এখানে একটা মজার গল্প বলি। রূপার পরমাণুর পথ যাতে বায়ুর অণুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে দিক পরিবর্তন না করে, সেজন্য যন্ত্রটাকে একটা বায়ুশূন্য বাক্সের মধ্যে রাখতে হয়। প্রথমে স্টার্ন ও গার্লাক বাক্সের মধ্যের একটা পাতের উপরেই রূপার পরমাণুগুলি ফেলছিলেন। পরীক্ষার পরে সেই পাতটাকে বার করে এনে গার্লাক তাতে রূপার কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছিলেন না, তিনি স্টার্নকে সেটি দেখতে দেন। স্টার্ন খুব কাছ থেকে দেখতে গিয়ে দেখলেন যে রূপার চিহ্ন আস্তে আস্তে কালো হয়ে ফুটে উঠল। তিনি লিখছেন যে তিনি খুব চুরুট খেতেন। তাঁর মাইনে ছিল খুব কম, সেজন্য সস্তার চুরুট ছাড়া গতি নেই। সস্তার চুরুটে গন্ধক থাকে, তাঁর নিঃশ্বাসের সঙ্গে সেই গন্ধক গিয়ে রূপার সঙ্গে বিক্রিয়া করে কালো রঙের সিলভার সালফাইড যৌগ গঠন করেছে। এর পর থেকে তাঁরা ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার শুরু করেন।
এই পরীক্ষার পরে স্পেস কোয়ান্টাইজেশন নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ রইল না। আইনস্টাইন বোর সহত বহু বিজ্ঞানী তাঁদের পরীক্ষার প্রশংসা করেন। উলফগ্যাং পাউলি মজা করে বলেন যে এবার বোরের মডেলে অবিশ্বাসী স্টার্নও তাঁর মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হবেন।
আমাদের কাহিনি কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। ১৯২৫ সালে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ও এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার পৃথকভাবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মূল সমীকরণ আবিষ্কার করেন। তখন বোঝা গেল স্টার্ন-গার্লাক পরীক্ষাতে রূপার যে বিশেষ ইলেকট্রনটির কক্ষপথের উপর চৌম্বকক্ষেত্র কাজ করেছে, তার কৌণিক ভরবেগ আসলে শূন্য। কৌণিক ভরবেগ শূন্য হলে চৌম্বক ভ্রামকও শূন্য হবে, সুতরাং চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে তার কোনো ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা নেই। তাহলে স্টার্ন ও গার্লাক যে রূপার পরমাণুগুলিকে চৌম্বক ক্ষেত্রে দুভাগে ভাগ হয়ে যেতে দেখেছিলেন সেটা কেমন করে হল?
লেখার শুরুতেই বলেছি যে ১৯২৫ সালে ইলেকট্রনের স্পিন আবিষ্কার হয়েছিল। স্পিনকেও আমরা এক ধরনের কৌণিক ভরবেগ বলতে পারি, তবে তা একান্তই মৌলিক কণার ধর্ম, তার সঙ্গে কোনো ঘুর্ণনের কোনো সম্পর্ক নেই। স্টার্ন ও গার্লাক সেই স্পিনের জন্য যে স্পেস কোয়ান্টাইজেশন হয় তা দেখতে পেয়েছিলেন। ইলেকট্রনের স্পিনের মান হল h/4p। আমরা দেখেছি স্টার্ন ও গার্লাক রূপার ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগের ক্ষেত্রে ঠিক এর দ্বিগুণ মান ধরেছিলেন। তাহলে তাঁদের পরীক্ষাতে পাওয়া দুই রেখার মধ্যের দূরত্ব অর্ধেক হওয়া উচিত ছিল, তা হয় নি কেন? তার কারণ ইলেকট্রনের চৌম্বক ভ্রামক পেতে গেলে দুই দিয়ে গুণ করতে হয়; কেন সে কথা অবশ্য তখন বোঝা যায়নি। পল ডিরাক আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে মিলিয়ে যে ১৯২৮ সালে যে সমীকরণ আবিষ্কার করেন, তা থেকেই এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ঘটনাচক্রেই স্টার্ন ও গার্লাকের হিসাব পরীক্ষার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল।
পরবর্তীকালে স্টার্ন ও গার্লাকের তৈরি যন্ত্রের বহু উন্নতি করা হয়েছে। ১৯৩৩ সালে স্টার্ন ও রাগনার ফ্রিশ প্রায় একই পদ্ধতিতে প্রোটনের চৌম্বক ভ্রামক নির্ণয় করেন। ১৯৪৩ সালে স্টার্নের নোবেল পুরস্কারে সেই কথার উল্লেখ করা হয়েছিল, স্পেস কোয়ান্টাইজেশনের উল্লেখ ছিল না। ইতিমধ্যে অবশ্য ইহুদি স্টার্নকে নাৎসিদের আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচাতে জার্মানি ছেড়ে আমেরিকা চলে যেতে হয়েছিল।
এমন কি হতে পারে যে স্টার্ন ও গার্লাক তাঁদের পরীক্ষার ব্যাখ্যাতে যে ভুল করেছিলেন তার জন্যই নোবেল কমিটি সেই পরীক্ষার উল্লেখ করেনি? কমিটির পক্ষে বক্তৃতাতে কিন্তু কমিটির জনৈক সদস্য সেই পরীক্ষার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। অবশ্য এই বিশেষ পরীক্ষাটি বাদ দিলেও স্টার্নের নোবেল পুরস্কার নিয়ে কথা উঠতে পারে না। বিভিন্ন সময়ে তাঁর নামে মোট ৮২টি নোবেল মনোনয়ন জমা পড়েছিল, অন্য যে কোনো নোবেল পুরস্কারজয়ীর থেকে অনেক বেশি। ১৯৩৪ সালে স্টার্ন নিউট্রনের চৌম্বক ভ্রামকের মানও নির্ণয় করেছিলেন। প্রোটন ও নিউট্রনের চৌম্বক ভ্রামকের যে মান পাওয়া গিয়েছিলে, তা তখনকার তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়নি। অনেক বছর পরে বোঝা যায় প্রোটন ও নিউট্রন আসলে মৌলিক কণা নয়, তারা তিনটি কোয়ার্ক নামের কণা দিয়ে তৈরি। এই তত্ত্বের পক্ষে অন্যতম যুক্তি ছিল এই কণাদের চৌম্বক ভ্রামকের মান যা অন্য কোনো ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমাদের খুব চেনা এমআরআই বা ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং যন্ত্রেও স্টার্ন ও গার্লাকের সেই প্রাথমিক পরীক্ষার পরিবর্তিত ও উন্নত রূপ ব্যবহার করা হয়।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই স্টার্ন ফ্রাঙ্কফুর্ট ছেড়েছিলেন। প্রথমে তিনি রস্টক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন, সেখান থেকে ফ্রাঙ্কফুর্টে এসে তিনি পরীক্ষাতে অংশ দিয়েছিলেন। অল্প দিন পরেই তিনি হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন ও সেখানে পরমাণু রশ্মির নতুন এক ল্যাবরেটরি তৈরি করেন। গার্লাক ফ্রাঙ্কফুর্ট ছাড়েন ১৯২৫ সালে, যোগ দেন টুবিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। চার বছর পরে তিনি মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হয়েছিলেন।
হিটলার ক্ষমতায় আসার পরে দুই সহযোগীর জীবন দুই পথে প্রবাহিত হয়েছিল। স্টার্ন ছিলেন ইহুদি, কাজেই তাঁর চাকরি গিয়েছিল। তিনি চলে যান আমেরিকা, সেখানে পিটসবার্গে কার্নেগি ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে তাঁর জন্য এক নতুন পদ সৃষ্টি করে হয়েছিল। সেখান থেকেই তিনি নোবেল পুরস্কারটি পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তিনি অবসর নিয়েছিলেন। জীবনে তিনি আর জার্মানিতে ফেরেননি। ১৯৬৯ সালে ১৭ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।
গার্লাক জার্মান পরমাণু গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৫ সালের মে মাসে মিত্রপক্ষ মিউনিখ দখল করলে তিনি বন্দি হন। সন্দেহ করা হয়েছিল যে তিনি জার্মান পরমাণু বোমা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি মুক্তি পান, দু'বছর বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পরে তিনি আবার মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান। ১৯৫৭ সালে তিনি সেখান থেকে অবসর নিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালের ১০ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।
প্রকাশ শারদীয় জ্ঞান ও বিজ্ঞান, ২০২২ (পরিবর্ধিত)
অত্যন্ত মূল্যবান প্রবন্ধ। সমৃদ্ধ হলাম।
ReplyDeleteতবে আমার একটি জিজ্ঞাসা আছে। তা হল, সত্যেন্দ্রনাথ বসু স্পিনের ধারণার আবিষ্কারক; কিন্তু আইনস্টাইন তাঁর গবেষণাপত্র থেকে সেটি কেটে দিয়েছিলেন, এই বহুলপরিচিত ধারণা কি সঠিক ?
1931 সালে লেখা রামন ও ভগবন্তমের পেপারে (C. V. Raman and S. Bhagavantam, “Experimental Proof of the Spin of the Photon,” Indian Journal of Physics, Vol. 6, 1931, pp. 353-366) সত্যেন্দ্রনাথ যে ফোটনের স্পিনের কথা বলেছিলেন তার উল্লেখ আছে, সে সময় আইনস্টাইন সহ সবাই জীবিত, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করেননি। পরোক্ষা সাক্ষ্যও আছে। কোপেনহেগেনে অভিনীত কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রধান চরিত্রদের নিয়ে জর্জ গ্যামোর লেখা মজার নাটকে ফোটনের স্পিন এসেছিল ভারতীয় শাড়ি পড়ে।
Delete