Monday, 3 October 2022

ইলেকট্রন আবিষ্কারের ১২৫ বছর ও নোবেলজয়ী পিতাপুত্র

ইলেকট্রন আবিষ্কারের ১২৫ বছর ও নোবেলজয়ী পিতাপুত্র

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কারগুলোর কথা বললে নিশ্চয় নোবেলের কথা সবার আগে তোমাদের মনে আসবে। এই পুরস্কার যাঁরা জিতেছেন, তাঁদের কৃতিত্বের কথা মানতে কোনো আপত্তি থাকে না। বিজ্ঞানে সাতবার এমন ঘটেছে যে নোবেল পুরস্কারজয়ীর সন্তানও নোবেল পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের কথা তোমরা নিশ্চয় জানো। পিয়ের ও মেরি কুরি তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ক গবেষণার জন্য নোবেল জিতেছিলেন ১৯০৩ সালে, মেরি একা রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান ১৯১১ সালে। আবার তাঁদের মেয়ে আইরিন ও তাঁর স্বামী ফ্রেডরিক জোলিও ১৯৩৫ সালে রসায়নে পুরস্কার জিতেছিলেন। ঠিক একশো বছর আগে ১৯২২ সালে নিল্‌স বোর পদার্থবিজ্ঞানে পুরস্কার জিতেছিলেন, তাঁর ছেলে আগি বোর একই বিষয়ে পুরস্কার জিতেছিলেন ১৯৭৫ সালে। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরো কয়েকবার এমন ঘটেছে। ১৯২৪ সালে মানে সিগবান এবং ১৯৮১ সালে তাঁর ছেলে কাই সিগবান পুরস্কার জিতেছিলেন। ১৯১৫ সালে উইলিয়াম ব্র্যাগ ও তাঁর ছেলে লরেন্স ব্র্যাগ পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছিলেন।

সবসময় যে বাবা বা সন্তান পুরস্কার একই বিষয়ে পেয়েছেন তা নয়। ১৯২৯ সালে রসায়নে পুরস্কার জিতেছিলেন হান্স ফন অয়লার-চেলপিন, আবার তাঁর ছেলে উলফ ফন অয়লার শারীরবিদ্যার নোবেল জেতেন ১৯৭০ সালে। ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটেছিল কর্নবার্গ পরিবারে। ২০০৬ সালের রসায়নে পুরস্কার পেয়েছিলেন ছেলে রজার, আর বাবা আর্থার শারীরবিদ্যাতে পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৫৯ সালে। এই লেখাতে আমরা আর এক পিতাপুত্রের কথা শুনব। দুজনেই পদার্থবিজ্ঞানে পুরস্কার পেয়েছিলেন, একজন ১৯০৬ সালে, অন্যজন ১৯৩৭ সালে। তাঁরা একই বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন, কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও দুটো সিদ্ধান্তই কিন্তু সঠিক। সেই দুই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হলেন জোসেফ জন টমসন ও তাঁর ছেলে জর্জ প্যাজেট টমসন। সুবিধার জন্য তাঁদের জেজে ও জিপি নামে ডাকা হত, আমরাও তাই করব। জেজে তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কারটি করেছিলেন ঠিক একশো পঁচিশ বছর আগে ১৮৯৭ সালে। জিপির যে বিখ্যাত পরীক্ষাটি পদার্থবিদ্যার ছাত্রদের পড়তেই হয় সেটি তিনি করেছিলেন ১৯২৭ সালে।

জেজে জন্মেছিলেন ১৮৫৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে। তাঁর বাবার ছিল পুরানো বইয়ের ব্যাবসা। টমসন ছোটবেলাতে এত প্রতিভার পরিচয় দেন যে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে তাঁকে স্থানীয় আওয়েন কলেজে ভর্তি করা হয়। এখন সেই কলেজ ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ১৮৭৬ সালে জেজে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ১৮৮০ সালে সেখান থেকে বিএ এবং ১৮৮৩ সালে এমএ পাস করেন। তার পরের বছর তাঁকে কেমব্রিজের পদার্থবিদ্যাতে ক্যাভেন্ডিশ অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা হয়। সে সময় অন্য এক অধ্যাপক মন্তব্য করেছিলেন, 'অবস্থা এমন যে বাচ্চা ছেলেদেরও প্রফেসর করতে হচ্ছে!'

অন্যরা তো বটেই, জেজে নিজেও একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরি ছিল ব্রিটেনের সব থেকে বিখ্যাত পরীক্ষাগার, সেটা চালনার দায়িত্ব দেওয়া হল মাত্র আটাশ বছর বয়সী জেজেকে, যিনি পরীক্ষানিরীক্ষা নয়, পদার্থবিদ্যার অঙ্ক ও তত্ত্বের জন্য পরিচিত ছিলেন। তবে যাঁরা তাঁকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা ভুল করেননি; সে কথায় আমরা এখনি আসছি।

উনিশ শতকের একদম শেষে বিজ্ঞানীরা একটা নতুন পরীক্ষা করছিলেন। একটা নলের ভিতর থেকে যতটা সম্ভব হাওয়া বার করে নেওয়া হল। নলের দুপাশে দুটো তড়িৎদ্বার বা ইলেকট্রোড আছে। নলের দুই প্রান্তের দেয়ালে প্রতিপ্রভ বা ফ্লুরোসেন্ট পদার্থ লাগানো থাকে, তাকে উত্তেজিত করলে আলো বেরোয়। এবার নলের দুই ইলেকট্রোডের সঙ্গে যদি একটা শক্তিশালী ব্যাটারির দুই প্রান্তকে যোগ করা হয়, দেখা যায় বর্তনীর মধ্যে দিয়ে তড়িৎপ্রবাহ হচ্ছে। ধনাত্মক তড়িৎদ্বারের পিছনের দেওয়ালে একটা উজ্জ্বল বিন্দু দেখা যায়, বোঝা যাচ্ছে যে প্রতিপ্রভ পদার্থের উপর কোনো একটা অদৃশ্য রশ্মি গিয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানীদের মনে হল যে নল থেকে যখন সমস্ত গ্যাস বার করে নেয়া হচ্ছে, তখন এই রশ্মির সঙ্গে নিশ্চয় গ্যাসের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে কি এটা তড়িতের কোনো মৌলিক রূপ? তবে সবাই এ বিষয়ে একমত ছিলেন না। সবে তখন এক্স- রশ্মি আবিষ্কার হয়েছে, তাকেও তো চোখে দেখা যায় না। আমরা জানি এক্স-রশ্মি একরকম আলো, বা বিজ্ঞানের ভাষায় তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। অনেক বিজ্ঞানী মনে করছিলেন, এই নতুন রশ্মিটাও আলোরই আর এক রূপ।

ঋণাত্মক ইলেকট্রোড বা ক্যাথোড থেকে এই রশ্মিটা বার হয়ে ধনাত্মক ইলেকট্রোড বা অ্যানোডের দিকে যায় বলে রশ্মিটার নাম দেয়া হল ক্যাথোড রশ্মি। জেজে টমসন দেখলেন এই অদৃশ্য রশ্মির উপর যদি তড়িৎ বা চুম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করা হয়: তাহলে রশ্মির পথ বেঁকে যায়। তার মানে ক্যাথোড রশ্মির আধান বা বৈদ্যুতিক চার্জ আছে। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের বৈদ্যুতিক আধান থাকা সম্ভব নয়, আধান থাকে এক মাত্র কোনো কণার। টমসন কণাটার আধান বা তার ভর কোনোটাই মাপতে পারলেন না। আসলে সেগুলো এতই ছোটো যে সে সময় তাদের মাপার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু তিনি কণার অন্য একটা গুণ বা ধর্ম মাপতে সক্ষম হলেন। তড়িৎ বা চুম্বক ক্ষেত্রে রশ্মিটা কতটা বেঁকে যায় বা বিক্ষিপ্ত হয়; সেটা মেপে তিনি কণার আধানকে তার ভর দিয়ে ভাগ করলে যে সংখ্যাটা পাওয়া যায়, সেটা বার করলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন যে তাঁর ক্যাথোড বা অ্যানোড তড়িৎদ্বার যে ধাতু দিয়েই তৈরি হোক না কেন, এই সংখ্যাটার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। তার মানে হল যে সমস্ত পদার্থের মধ্যেই এই নতুন কণাটা আছে। তাছাড়া আধান ও ভরের অনুপাত থেকে এটাও বোঝা গিয়েছিলো যে নতুন কণাটা খুবই হাল্কা। রসায়ন থেকে আমাদের পরমাণুর ভর ও আধানের অনুপাত সম্পর্কে একটা ধারণা ছিল। সবচেয়ে হাল্কা যে পরমাণু হাইড্রোজেন, নতুন কণাটার ভর তার মোটামুটি দুহাজার ভাগের এক ভাগ। টমসন বুঝতে পারলেন যে পরমাণু ভেঙে এই কণাটা আসছে। বিদ্যুৎ বা ইলেকট্রসিটি বয়ে নিয়ে যায় বলে এর নাম ঠিক হল ইলেকট্রন।
 

জে জে টমসন

১৮৯৭ সালের ২৯শে এপ্রিল, শুক্রবার জেজে লন্ডনের রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে তিনি তাঁর আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন। প্রথমে অনেক বিজ্ঞানীরই টমসনকে মেনে নিতে আপত্তি ছিল। তাঁদের অনেকেই পরমাণুবাদেই বিশ্বাস করতেন না। আবার প্রাচীন যুগ থেকে যে সব দার্শনিক পরমাণুর কথা বলতেন, তাঁরা বলতেন পরমাণুকে আর ভাঙা যায় না। টমসনের কথা মানতে গেলে ধরে নিতে হবে পরমাণুর শুধু যে অস্তিত্ব আছে তা নয়, তাকে ভাঙাও যায়। জনৈক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী (টমসন তাঁর নাম করেননি) টমসনকে পরে বলেছিলেন যে তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন টমসন সকলের সঙ্গে মজা করছেন। তবে নানা পরীক্ষানিরীক্ষার পরে সবাই নিশ্চিত হলেন যে টমসনই ঠিক বলছেন। ইলেকট্রনই আমাদের আবিষ্কৃত প্রথম মৌলিক কণা। ১৯০৬ সালে টমসন তাঁর আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেন।

টমসনের অন্য গবেষণার কথা এখানে বললাম না, শুধু ইলেকট্রন আবিষ্কারই তাঁকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর করে রাখবে। কিন্তু একটা কথা না বললে টমসনের পরিচয় অসম্পূর্ণ থেকে যায়। শিক্ষক টমসন তাঁর ছাত্র বা তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের বিজ্ঞানে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তাঁর সহযোগীদের মধ্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন দশজন — চার্লস বার্কলা, চার্লস উইলসন, আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, ফ্রান্সিস অ্যাস্টন, আওয়েন রিচার্ডসন, পিতা-পুত্র উইলিয়াম ও লরেন্স ব্র্যাগ, মাক্স বর্ন, নিল্‌স বোর এবং তাঁর ছেলে জিপি টমসন। আমাদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার প্রথম অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু তাঁর সঙ্গে কাজ করেছিলেন।

এবার আসি জিপি টমসনের কথায়। কেমব্রিজ ১৮৮২ সাল থেকে মহিলাদের বক্তৃতা ও ক্লাস শোনার অধিকার দেয়, রোজ প্যাজেট সেই সুযোগ নিয়েছিলেন। সেখানেই জেজে টমসনের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, তাঁদের বিয়ে হয় ১৮৯০ সালে। তাঁদের ছেলে জর্জ হলেন পদার্থবিজ্ঞানী; মেয়ে জোয়ান হন বিশিষ্ট লেখিকা। জর্জের জন্ম হয় ১৮৯২ সালের ৩ মে। তাঁর পড়াশোনা ট্রিনিটি কলেজেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য পড়াশোনাতে ছেদ পড়ে, তিনি ফ্রান্সে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার পরে যুদ্ধের সময় বিমান সংক্রান্ত গবেষণাতে যোগ দেন। যুদ্ধের পরে তিনি কেমব্রিজে ফিরে আসেন। তারপরে এবার্ডিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন; সেখানেই তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত পরীক্ষাটি করেন। কিন্তু তার গুরুত্ব বুঝতে গেলে আমাদের বিজ্ঞানে সেই সময়ের পরিস্থিতি একটু জানতে হবে।
 
জি পি টমসন

একটা কথা হয়তো তোমারা সবাই শুনেছ, কোয়ান্টাম। ১৯০০ সালে জার্মান বিজ্ঞানী মাক্স প্লাঙ্ক দেখেন কোনো বস্তুকে গরম করলে তার থেকে যখন আলো বেরোয়, তখন তা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের গুণিতকে বেরোয়। অর্থাৎ ধরো এক একক বা দুই একক বেরোবে, কিন্তু দেড় বা পৌনে দুই একক পাওয়া যাবে না। এই এককের তিনি নাম দিলেন কোয়ান্টাম। তারপরে ১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন দেখালেন যে আলোর এই কোয়ান্টাম একদম কণার মতো আচরণ করে। এতদিন পর্যন্ত জানা ছিল আলো হল সহজ কথায় ঢেউ, বিজ্ঞানীরা তাকে বলেন তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ। প্লাঙ্ক ও আইনস্টাইনের গবেষণা দেখাল আলো কণিকাও বটে। আলোর এই কণার নামই হল ফোটন।

নিশ্চয় বুঝতে পারছ কণিকা আর তরঙ্গের ধর্ম অনেকটা আলাদা। কণিকা হল বন্দুকের গুলির মতো, উৎস থেকে বেরিয়ে সোজা একদিকে যায়। তরঙ্গ আমরা সবাই দেখেছি, জলে ঢিল পড়লে চারদিকে ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। এ দুটো কখনো এক হতে পারে? আইনস্টাইন ও প্লাঙ্ক দেখালেন আলোর এই দুই রকমের ধর্মই আছে। এই বিষয়টা আজও যে আমরা পুরোপুরি বুঝতে পেরেছি তা নয়।

আলোর এই রকম অদ্ভূত ধর্ম নিয়ে যখন বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামাচ্ছেন, তখন ফরাসি বিজ্ঞানী লুই দ্য ব্রয়লি একটা আরো অদ্ভুত কথা বললেন। তাঁর মতে আলোর যেমন কণিকা ধর্ম আছে, ঠিক তেমনি সমস্ত কণিকারও তরঙ্গ ধর্ম আছে। শুধু কণা নয়, সমস্ত বস্তুরই তরঙ্গ ধর্ম আছে, কিন্তু আমরা সেটা দেখতে বা মাপতে পারি না। একমাত্র খুব কম ভরের বস্তুর জন্য সেটা দেখা যাবে।

বললেই তো তো হবে না, বিজ্ঞানে প্রমাণ করে দেখাতে হবে। ইলেকট্রন হল তখনো পর্যন্ত আমাদের জানা সব থেকে কম ভরের কণা, সুতরাং তার তরঙ্গ ধর্ম দেখা সব থেকে সহজ। আলাদা আলাদা ভাবে সেই কাজটা করলেন ব্রিটেনে জিপি টমসন ও আমেরিকাতে ক্লিন্টন ডেভিসন। জিপি ঠিক কী করেছিলেন সংক্ষেপে তোমাদের বলি।

কেমন করে কোনো কিছু তরঙ্গ না কণিকা তা বোঝা যাবে? তুমি একটা ঘরে বসে আছ, পাশের ঘর থেকে মা তোমার নাম ধরে ডাকলে তুমি শুনতে পাবে। তার কারণ শব্দ হল একরকমের তরঙ্গ। তরঙ্গের সামনে বাধা এলে সে বাঁকা পথে তাকে এড়িয়ে চলতে পারে, তাই সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে ঘুরে তোমার কাছে এসে পৌঁছাচ্ছে। বন্দুকের গুলি নিশ্চয় এইরকম পথে চলে না।   

কিন্তু পাশের ঘরে আলো জ্বাললেও তো তা এসে তোমার চোখে পড়ে না, তাহলে আলোকে তরঙ্গ বলছি কেন? এই বিষয়টা আরো একটু জটিল, খুব সহজ কথায় বলতে পারি বাধার সামনে কোনো তরঙ্গ কতটা বাঁকবে তা তার দৈর্ঘ্যের উপর নির্ভর করে। পুকুরে ঢিল ফেললে পরপর দুটো ঢেউয়ের মাথার মধ্যে যে দূরত্ব তাকে বলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য। শব্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্য হল কয়েক মিটার, আর চোখে দেখা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য হল গড়ে মোটামুটি এক মিটারের কুড়ি লক্ষ ভাগের এক ভাগ। তাই আলো দরজা দিয়ে তোমার চোখে এসে পড়ছে না। তার বাঁকা পথে চলা দেখতে ছিদ্রকেও খুব সূক্ষ্ম হতে হবে। সেই জন্যই আলো যে তরঙ্গ তা প্রমাণ করতে বিজ্ঞানীদের সময় লেগেছিল। এই বাঁকা পথে চলাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে অপবর্তন।

ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আরো অনেক ছোট, এক মিটারের দশ কোটি ভাগের এক ভাগের মতো (অবশ্য সেটা ইলেকট্রনের গতিশক্তির উপর নির্ভর করে)। তার অপবর্তন দেখতে আরো সূক্ষ্ম ছিদ্র লাগবে। এক্সরশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যও ওইরকম মানের হয়, পদার্থের পরমাণুদের মাঝের ফাঁকা জায়গাগুলোকে ছিদ্র হিসাবে ব্যবহার করে তার অপবর্তন দেখা সম্ভব হয়েছে। জিপি বুঝলেন যে তাঁকেও সেই পথই ধরতে হবে। ধাতুর পাতলা ফিল্মের উপরে উচ্চগতির ইলেকট্রনের স্রোত গিয়ে পড়ল, পিছনে রেখেছিলেন একটা ফটোগ্রাফিক প্লেট। অপবর্তন না হলে প্লেটের উপরে ইলেকট্রনরা একটা বিন্দুতে গিয়ে পড়ত, তা না হয়ে দেখা গেল প্লেটের উপর সুন্দর গোল গোল রিং তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ ইলেকট্রনেরও তরঙ্গ ধর্ম আছে। ডেভিসন একই সময়ে প্রায় একই রকম পরীক্ষা করেছিলেন,। দি ব্রয়লি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯২৯ সালে, তার আট বছর পরে জিপি ও ডেভিসন পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠলেন।

জিপি টমসনের এই কাজটা যে শুধু পদার্থের ধর্ম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বাড়িয়েছিল তা নয়, তার ব্যবহারিক প্রয়োগও প্রচুর। ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্ম ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ, যা আমাদের অতি ক্ষুদ্র বস্তু দেখতে সাহায্য করে। এ দেখা মানে অবশ্য চোখে দেখা নয়, পর্যবেক্ষণ বলা যেতে পারে। আধুনিক যুগে একই পদ্ধতিতে তৈরি হয়েছে স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ বা অ্যাটমিক ফোর্স মাইক্রোস্কোপ। ১৯৮৬ সালে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ উদ্ভাবনের জন্য আর্ন্সট রুস্কা ও স্ক্যানিং টানেলিং মাক্রোস্কোপের জন্য জার্ড বিনিচ ও হাইনরিখ রোহ্‌রারকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। এই সব নতুন অণুবীক্ষণ দিয়ে একক পরমাণুকে পর্যবেক্ষণ করাও সম্ভব।



প্রকাশ খুশির হাওয়া পূজাবার্ষিকী ১৪২৯ (2022)

No comments:

Post a Comment