Sunday, 12 June 2022

গ্রন্থবীক্ষণঃ পৃথিবী প্রাণ ও মহাকাশ

'একুশ শতক' প্রকাশিত 'পৃথিবী প্রাণ ও মহাকাশ' সংকলনে বিজ্ঞান বিষয়ক মোট আটতিরিশটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ভূমিকাতে লেখক সিদ্ধার্থ রায় লিখেছেন যে লেখাগুলি চার বছর ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে; তাদের চারটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে ভৌত বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূবিজ্ঞান, এবং জীবন বিজ্ঞান। এই শ্রেণিবিভাগকে তর্কাতীত ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই; লেখক নিঃসন্দেহে কাজ চালানোর সুবিধার জন্যই এই ভাগ করেছেন। বিশেষ করে প্রথম দুটি বিভাগের মধ্যে অনেকখানিই মিল আছে। ভৌত বিজ্ঞান বিভাগে পদার্থের জন্ম বা অদৃশ্য বস্তু ও শক্তি বিষয়ক প্রবন্ধদুটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের মধ্যে রাখাই যেত। তার থেকেও বড় কথা হল যে আধুনিক বিজ্ঞানে নানা শাখার মধ্যে আন্তঃবিভাগীয় সম্পর্ক বিশেষ জরুরি; এই সংকলনের অনেকগুলি প্রবন্ধ থেকে তার পরিচয় মেলে।


ভৌত বিজ্ঞান অংশে প্রথম দুটি প্রবন্ধে লেখক আলোচনা করেছেন বিজ্ঞান ঠিক কী, এবং তা কেমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে। বিজ্ঞানচর্চার নিঃসন্দেহে বহু পুরানো; আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এই প্রসঙ্গে স্মরণ করি দেবীপ্রসাদ চট্টোপধ্যায়ের বিখ্যাত গ্রন্থ 'History of Science and Technology in Ancient India’-এর কথা। তা সত্ত্বেও যদি বিজ্ঞানের সরলরৈখিক বিকাশের কোনো কাহিনি লিখতে হয়, সম্ভবত এই বইয়ের মতোই তা শুরু হবে গ্রিক সভ্যতা থেকে। প্রথম প্রবন্ধ থেকে আমরা দেখি যে আধুনিক বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষানিরীক্ষা ও আরোহী যুক্তিজালের উপর; পরীক্ষার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার পদ্ধতিকেই ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। সামান্য হলেও তার সূচনা প্রাচীন গ্রিক সভ্যতাতেই দেখা যায়; অবশ্য মনে রাখতে হবে সেই সভ্যতা আধুনিক গ্রিস দেশের সীমানা অতিক্রম করে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। প্রাচীন গ্রিকদের মতো পরিমাপের উপর জোর অন্য কোনো সভ্যতা সম্ভবত দেয়নি; সংকলনের অন্য এক প্রবন্ধে প্রাচীন গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কিভাবে পৃথিবী সূর্য ও চন্দ্রের মাপ করেছিলেন তার সুন্দর বর্ণনা আছে। গ্রিক সভ্যতার পতনের পরে মধ্যযুগে ইউরোপের অন্ধকার সময়ে আরবরা বিজ্ঞানচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে থেকে আবার ইউরোপেই ফিরে গিয়েই সে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল; আজকের আধুনিক সমাজ তারই ফলশ্রুতি। প্রবন্ধগুলিতে সেই কথা চমৎকার ভাবে উঠে এসেছে। দ্বিতীয় প্রবন্ধটির নাম বিজ্ঞানচর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হলেও সেখানে মূলত ভৌত বিজ্ঞানের কথাই এসেছে। সেটাই স্বাভাবিক, আধুনিক বিজ্ঞান বলতে যা বুঝি, ভৌত বিজ্ঞানই প্রথম সেই পর্যায়ে পৌঁছেছিল।

ভৌত বিজ্ঞান বিভাগের বাকি প্রবন্ধগুলিতে এসেছে বিশ্বে মৌলিক পদার্থের সৃষ্টি , তাদের আবিষ্কার, পরমাণু ও তার ভিতরের জগৎ, কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও আপেক্ষিকতাবাদ, এবং সবশেষে রহস্যময় অদৃশ্য বস্তু ও শক্তির কথা। 'পদার্থের জন্মরহস্য' প্রবন্ধে লেখক সুন্দরভাবে মৌলিক পদার্থের সৃষ্টির কথা সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে লোহার থেকে ভারি মৌল সৃষ্টির ক্ষেত্রে ধীরগতি বা এস-পদ্ধতির উল্লেখ থাকলে ভালো হত। 'মৌলিক পদার্থ আবিষ্কারর কাহিনি' প্রবন্ধে মৌলিক পদার্থ বিষয়ে আমাদের ধারণার পরিবর্তনের ইতিহাসের সঙ্গে মূলত তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কারের উপরেই জোর দেওয়া হয়েছে।

ঊনবিংশ শতকের শেষে ইলেকট্রন আবিষ্কার থেকে শুরু করে আধুনিক যুগে কোয়ার্ক আবিষ্কারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বা প্রায় এই সময়ে শুরু হওয়া কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতে পৌঁছানোর কাহিনি এসেছে দুটি প্রবন্ধে। এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতে তরঙ্গ সমীকরণ আবিষ্কার করেছিলেন, তার পিছনে দি ব্রয়লির তত্ত্বের অনুপ্রেরণার কথা লেখক উল্লেখ করেছেন। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করি শ্রয়ডিঙ্গার আইনস্টাইনকে লিখেছিলেন যে নব-আবিষ্কৃত বোস আইনস্টাইন পরিসংখ্যানে একটি প্রাথমিক স্তরের ভুল আছে। আইনস্টাইন তাঁকে সেই পরিসংখ্যানের মূল তত্ত্ব ধৈর্য ধরে ব্যাখ্যা করে লিখে পাঠিয়েছিলেন, সেই সূত্র ধরেই দি ব্রয়লির তত্ত্ব থেকে শুরু করে শ্রয়ডিঙ্গার তরঙ্গ সমীকরণে পৌঁছেছিলেন।

একই লেখাতে অনিশ্চয়তা নীতি প্রসঙ্গে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের উল্লেখ এসেছে; তার বাইরেও মনে রাখতে হবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রথম সমীকরণ কিন্তু তাঁরই সৃষ্টি। অনিশ্চয়তা নীতি আধুনিক বিজ্ঞানের এক মূল স্তম্ভ। কিন্তু হাইজেনবার্গ নিজে আমাদের অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে তার ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়ে যে মাইক্রোস্কোপের কল্পনা করেছিলেন, অনেক বিজ্ঞানীর মতে সেটি অনিশ্চয়তা তত্ত্বকে ভুলভাবে প্রকাশ করেছে। তিনি বলেছিলেন কোনো ইলেকট্রনের গতির অবস্থা অর্থাৎ অবস্থান ও ভরবেগ মাপতে গেলে তার উপর ফোটন দিয়ে আঘাত করতে হবে, তার ফলে তার ভরবেগের ও অবস্থানের পরিবর্তন হবে। একেই তিনি অনিশ্চয়তার উৎস হিসাবে নির্দেশ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু বাস্তবে ইলেকট্রনের নির্দিষ্ট অবস্থান ও ভরবেগই থাকে না, পরিমাপের সঙ্গে তা যুক্ত নয়। ফোটন দিয়ে আঘাত না করলেও তা সত্য।

আপেক্ষিকতাবাদ সংক্রান্ত প্রবন্ধটিতে বিশেষ ও সাধারণ দুই আপেক্ষিকতার কথাই এসেছে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও আপেক্ষিকতাবাদ অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বিপরীতে যায়; তবে কোপার্নিকাসের সময় থেকেই বিজ্ঞানের ইতিহাস আমাদের অভিজ্ঞতার সাক্ষ্যকে সন্দেহ করতে শিখিয়েছে। বিশেষ আপেক্ষিকতার ক্ষেত্রে আলোচনাটা ভারি চমৎকার, তবে কিছুটা অপূর্ণ রয়ে গেল। যেমন লেখাতে আছে দ্রুতগামী ট্রেনকে বাইরে দাঁড়ানো দর্শক সংকুচিত হতে দেখবেন। ঠিক তেমনি গতিশীল ট্রেনের যাত্রীর কাছেও স্টেশনের দৈর্ঘ্য সংকুচিত হবে, সেই কথাটি স্পষ্ট করে লিখলে তত্ত্বের নাম আপেক্ষিকতা কেন তা বুঝতে সুবিধা হত। প্রবন্ধটি সম্ভবত কিছুদিন আগে লেখা, সেই কারণে সাধারণ আপেক্ষিকতার আলোচনাতে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের উল্লেখ আসেনি। অবশ্য তাতে কোনো অসুবিধা নেই, পরে জোতির্বিজ্ঞান বিভাগে এক প্রবন্ধে সেই কথা পাওয়া যাবে।

জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগে মহাবিশ্বের আয়তন ও গঠন বিষয়ে বিতর্ক এবং বিগ ব্যাং ও স্থিতাবস্থার তত্ত্বের বিরোধের কথা এসেছে। ঠিক তেমনি ভূবিজ্ঞান বিভাগটি শুরু হয়েছে পৃথিবীর বয়স সম্পর্কিত বিতর্ক দিয়ে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে শেষেরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তৎকালীন পদার্থবিজ্ঞান প্রয়োগ করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে লর্ড কেলভিন পৃথিবীর বয়স নির্ণয় করেছিলেন সর্বোচ্চ চল্লিশ কোটি বছর, পরে তিনি এই হিসাবকে আরো কমিয়ে দিয়েছিলেন। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন তত্ত্বের পক্ষে এই সময়কাল ছিল নিতান্তই কম। ডারউইন নিজে কেলভিনের গণনাকেই তাঁর তত্ত্বের সামনে সব থেকে বড় বাধা বলে মনে করতেন। এমনকি প্রাকৃতিক নির্বাচনের সহ আবিষ্কর্তা আলফ্রেড ওয়ালেসও কেলভিনের মত স্বীকার করে তাঁর তত্ত্বে পরিবর্তন করেছিলেন। কেলভিন কোথায় ভুল করেছিলেন এবং কেমনভাবে আমরা পৃথিবীর বয়স সম্পর্কে আধুনিক সিদ্ধান্তে পোঁছলাম তা নিয়ে সহজ ভাষায় আলোচনা করেছেন লেখক।

তারাদের বিবর্তন, ব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময়কর বস্তু, সৌরজগৎ, গ্রহ, ধূমকেতু ইত্যাদির কথা এসেছ কয়েকটি প্রবন্ধে। বিজ্ঞান কত দ্রুত এগোচ্ছে তা যেমন বুঝতে পারি, তেমনি আমাদের জ্ঞান যে এখনো কত সীমাবদ্ধ তারও পরিচয় পাওয়া যায় এই প্রবন্ধগুলি থেকে। একই কথা বলা যায় পরে পৃথিবীর অভ্যন্তরের গঠন সংক্রান্ত লেখাতে। লেখাগুলি পড়তে গিয়ে একটা কথা মনে পড়ে গেল। নোবেল কমিটি পালসার আবিষ্কারে শুধু অ্যান্টনি হিউয়িশের অবদানকে স্বীকৃতি দিলেও সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীমহল কিন্তু বিশ্বাস করে যে তাতে তাঁর ছাত্রী জোসেলিন বেল বার্নেলের অবদান কোন অংশেই কম নয়। ফ্রেড হয়েলের কথা আছে বইয়ের 'পদার্থের জন্ম রহস্য' প্রবন্ধে, তিনি জোসেলিনকে পুরস্কার না দেওয়ার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ভাগ্যের পরিহাসে কয়েক বছর পরে যখন নক্ষত্রের ভিতরে পদার্থের জন্ম বিষয়ে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, তখন হয়েলকেই বাদ দেওয়া হয়, অথচ সকলেই জানে যে এই তত্ত্বের মূল চিন্তাভাবনা তিনিই করেছিলেন।

ভূবিজ্ঞান বিভাগে মহাদেশীয় মহীসঞ্চরণ তত্ত্ব, আবহমণ্ডল, সমুদ্রমণ্ডল বা হিমযুগ নিয়ে আরো কয়েকটি প্রবন্ধ আছে। আলফ্রেড ওয়েগেনারের মহীসঞ্চরণ তত্ত্ব প্রথমে তেমন স্বীকৃতি না পেলেও পরে তা সকলে মেনে নিয়েছেন কেমনভাবে সেই স্বীকৃতি এল তার সুন্দর আলোচনা রয়েছে প্রবন্ধে। শেষ প্রবন্ধে জায়গা পেয়েছে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা - বিশ্বউষ্ণায়ন ও তার সম্ভাব্য প্রতিকার।

জীবন বিজ্ঞান বিভাগে আছে প্রাণের উদ্ভব, বিবর্তন, বংশগতি, মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে অনেকগুলি সুলিখিত প্রবন্ধ। বিজ্ঞানের ইতিহাসে উৎসুক পাঠকের কাছে বংশগতি আবিষ্কারের কাহিনি বেশ কৌতূহল জাগাবে। গ্রেগর জোহান মেণ্ডেল বংশগতির সূত্রগুলি আবিষ্কার করেছিলেন ১৮৬৬ সালে, কিন্তু তা কারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। চৌত্রিশ বছর পরে এক অদ্ভুত সমাপতনে তিন উদ্ভিদবিজ্ঞানী হুগো ডে ভ্রিস, এরিখ ফন সেরমাক ও কার্ল করেন্স আলাদা আলাদা ভাবে বংশগতির সূত্রগুলি পুনরাবিষ্কার করেন, এবং তারপরে তিনজনেই পুরানো গবেষণাপত্র খুঁজে মেন্ডেলের কাজের সন্ধান পেয়েছিলেন। মেন্ডেল জীবদ্দশাতে তার কাজের স্বীকৃতি পান নি। বিবর্তনতত্ত্বের ক্ষেত্রে একটা বড় সমালোচনা ছিল যে কোনো নতুন বৈশিষ্ট্য কয়েক প্রজন্ম পরেই মিলিয়ে যাবে। ধরা যাক কোনো জিরাফ একটু বেশি লম্বা গলা নিয়ে জন্মাল, কিন্তু তার মিলন ঘটবে অন্য জিরাফদের সঙ্গে যাদের সবার গলা ছোট। সে সময় ধারণা ছিল যে পরের প্রজন্মের সন্তানদের গলা নিশ্চয় সেইরকম লম্বা থাকবে না; অর্থাৎ ছোট হতে হতে কয়েক প্রজন্মের মধ্যে সেই বৈশিষ্ট্য লোপ পেয়ে যাবে। মেন্ডেলের গবেষণা এই সমস্যার সমাধান করেছিল, কিন্তু ১৮৬৬ সালের পরে আরো ষোল বছর জীবিত থাকলেও ডারউইন কখনো মেন্ডেলের সূত্র সম্পর্কে জানতে পারেননি।

১৮৫৮ সালে লিনিয়ান সোসাইটির একই সভায় চার্লস ডারউইন ও আলফ্রেড ওয়ালেসের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন সংক্রান্ত প্রবন্ধদুটি পড়া হয়েছিল অবশ্য একে সমাপতন বলা চলে না। ডারউইন বহুদিন আগে থেকেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা প্রকাশ্যে আনার ব্যাপারে ইতস্তত করছিলেন। তাঁর বন্ধুদের তিনি এই সংক্রান্ত লেখাগুলি পড়িয়েছিলেন। ইন্দোনেশিয়াতে গবেষণারত ওয়ালেস প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব ঘটনাচক্রে ডারইনের কাছে মতামতের জন্য পাঠিয়াছিলেন। ডারউইন সেই চিঠি পড়ে এমনও ভেবেছিলেন যে তাঁর লেখা আর তিনি প্রকাশ করবেন না। বন্ধুদের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত একই সঙ্গে দুজনের লেখা পড়া হয়। ডারউইন ইচ্ছা করলেই ওয়ালেসের চিঠির কথা গোপন রাখতে পারতেন। আবার ওয়ালেস মেনে নিয়েছিলেন যে প্রকাশ না করলেও ডারউইন তাঁর অনেক আগেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। দুই মহান বিজ্ঞানীর এই আচরণ আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ না করে পারে না।

পৃথিবীতে প্রাণ এমনভাবে এলো, ডিএনএর গঠন আবিষ্কার, প্রোটিন সংশ্লেষে জিনের ভূমিকা। বার্ধক্য ও মৃত্যু, ইত্যাদি নানা বিষয়ে গবেষণা গত একশো বছরে জীবন বিজ্ঞানকে কীভাবে আমূল পরিবর্তিত করেছে, সেই ইতিহাস এসেছে বিভিন্ন প্রবন্ধে। টিকা কেমনভাবে কাজ করে সেই বিষয়ে আলোচনা আছে 'জীবাণু, প্রতিষেধক ও অনাক্রম্যতা' প্রবন্ধে, এই অতিমারীর সময়ে সেটি অন্য গুরুত্ব বহন করে। অন্য প্রবন্ধগুলির মতোই সহজ ভাষাতে লেখক জীবন বিজ্ঞানের জটিল বিষয়কেও সহজবোধ্য করে তুলেছেন।

একই মলাটে নানা বিষয়গুলি ধরা পড়ার ফলে পৃথিবীর বয়স, মহীসঞ্চরণ, বিবর্তন বা নক্ষত্রের ভিতরে শক্তির সৃষ্টির মতো বিষয়ের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কও মনোযোগী পাঠকের নজর এড়াবে না। সমস্ত প্রবন্ধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই, কিন্তু সবগুলিই তথ্যপূর্ণ ও সহজসরল ভাষাতে লেখা। প্রবন্ধগুলি বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত, সেগুলিকে একই জায়গাতে আনার ফলে কিছু কথার পুনরুক্তি হয়ে গেছে; সংকলনের সময় কিছুটা সম্পাদনা করলে ভালো হত। দু-একটি প্রবন্ধ যেন হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে; লেখাগুলি ভারি সুন্দর, তাই আরো কিছু পাওয়ার আশা ছিল। পত্রিকার ক্ষেত্রে দৈর্ঘ্যের সীমাবদ্ধতা থাকে, বইতে অন্তর্ভুক্তির সময় হয়তো একটু বিশদে আলোচনা করতে পারতেন লেখক। বইয়ের ছাপা সুন্দর, পাতা ও বাঁধাই চমৎকার। বেশ কয়েকটি বানান ভুল রয়ে গেছে, সেগুলি আশা করি পরবর্তী সংস্করণে সংশোধিত হবে। কিছু তথ্যগত প্রমাদও সংশোধন করা জরুরি। যেমন 'পরমাণু ও উপপরমাণু কণাদের জগৎ' প্রবন্ধে আছে মিউ মেসন নিউক্লিয়াসের স্থায়িত্বের জন্য দায়ী, কথাটা ঠিক নয়। সমস্ত হ্যাড্রন কণা তিনটি কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত নয়, মেসন কণাদের মধ্যে একটি কোয়ার্ক ও একটি প্রতিকোয়ার্ক থাকে। সবল বল প্রোটনদের মধ্যেও কাজ করে, তা তড়িৎচৌম্বক বলের থেকে শক্তিশালী বলেই নিউক্লিয়াস স্থায়ী। তবে এ সবই সামান্য ত্রুটি। বিষয়বৈচিত্রে ও লিখনশৈলীতে এই সংকলনটি বাংলা ভাষাতে সম্প্রতি প্রকাশিত বিজ্ঞান বিষয়ক বইদের মধ্যে প্রথম সারিতে জায়গা করে নেওয়ার যোগ্য।

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়



পৃথিবী প্রাণ ও মহাকাশ

সিদ্ধার্থ রায়

একুশ শতক

মূল্য ৫০০ টাকা



Sunday, 5 June 2022

ভুলে যাওয়া বিজ্ঞানী ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ

ভুলে যাওয়া বিজ্ঞানী ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


বিজ্ঞানের গবেষণাতে প্রায়শই আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের চোখধাঁধানো আলোতে ঢাকা পড়ে যান পার্শ্বচরিত্ররা। বিশেষ করে যাঁরা গবেষণার পরিকাঠামো নির্মাণে প্রাণপাত করেন, ইতিহাস প্রায়শই তাঁদের ভুলে যায়। অথচ তাঁদের প্রয়াস ছাড়া পরবর্তী প্রজন্মের পক্ষে কাজ শুরু করাই সম্ভব হত না। প্রায়-বিস্মৃত ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ, বা পি এন ঘোষ তেমনই এক ব্যক্তিত্ব। 

ফণীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৮৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগণার মজিলপুর গ্রামে। ছোটবেলাতেই তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে, তারপর বেশ কষ্টের মধ্যেই তাঁকে পড়াশোনা চালাতে হয়েছিল। বঙ্গবাসী কলেজে থেকে পদার্থবিদ্যার অনার্স নিয়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হওয়ার পরে স্নাতকোত্তর শিক্ষার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এম এ পরীক্ষাতেও প্রথম হওয়ার ফলে সরকারি চাকরির সুযোগ তাঁর সামনে এসেছিল। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা ছিল প্রযুক্তির দিকে, তাই জেসপ ইঞ্জিনিয়ারিঙ ওয়ার্ক্সে তিনি শিক্ষানবীশ হিসাবে কাজ শুরু করেন। তবে ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক অনটনের জন্য আপাতত আশা ছাড়তে হল, ১৯১০ সাল থেকে তিনি বঙ্গবাসী কলেজে পড়ানো শুরু করেন। একই সঙ্গে তিনি নানা শিল্পকে প্রযুক্তি বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। তাঁর পড়ানোর বিশেষ খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল, তাই আশুতোষের আগ্রহে ১৯১৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজ পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রথম দুই পূর্ণসময়ের শিক্ষকের মধ্যে একজন হিসাবে ১৯১৬ সালে যোগ দেন। মাইনে ছিল ২০০ টাকা, বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট ২৫ টাকা। একই সময়ে গবেষক হিসাবে যোগ দিয়ে যাঁরা পদার্থবিদ্যা বিভাগে ক্লাস নিতে শুরু করেন, তাঁদের মধ্যে দুজন আমাদের সুপরিচিত, মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

পরের বছর চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রামন বিভাগে পালিত অধ্যাপকের পদে যোগ দিলেন। ফণীন্দ্রনাথের তখন ৩৩ বছর বয়েস, গবেষণা শুরুর পক্ষে বয়সটা বেশিই। কিন্তু রমনের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি তাঁর সঙ্গে গবেষণা শুরু করেন। ১৯১৮ সালে রমনের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি প্রথম গবেষণাপত্র ছাপেন। নেচার পত্রিকাতে প্রকাশিত সেই চিঠিটির শিরোনাম ছিল, “Colour and Striae in Mica”। এই চিঠিতে লেখকদের ঠিকানা দেওয়া ছিল ২১০ বৌবাজার স্ট্রিট, সেটি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স-এর সেই সময়ের ঠিকানা। রামন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনেও কাজ করতেন। চিঠিটি ছোট হলেও নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লর্ড র‍্যালের মতো বিশেষজ্ঞের প্রশংসা পেয়েছিল; চিঠির ঠিক নিচে তাঁর যে মন্তব্য ছাপা হয়েছিল আর থেকে একটি বাক্য উদ্ধৃত করি। “Doubtless the Foucault method shows them in a more manner, and, in any case, the colour effects are novel, so far as I know, and worthy of a closer examination”এই বিষয়ে আরো বিস্তৃতভাবে কাজ করে ফণীন্দ্রনাথ পরের বছর এককভাবে প্রসিডিংস অফ দি রয়্যাল সোসাইটিতে একটি গবেষণাপত্র ছাপিয়েছিলেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে পালিত ল্যাবরেটরিতেই কাজটি হয়েছে, এবং লেখকের ঠিকানা ছিল বিজ্ঞান কলেজ। সেই বছরই ফিজিক্যাল রিভিউ পত্রিকাতে আরো একটি গবেষণাপত্র ছাপান পি এন ঘোষ। এই তিনটি ও ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের প্রসিডিংসে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের উপর ভিত্তি করে তিনি “The colours of the striae in mica and other optical investigations” থিসিস জমা দেন ও ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অফ ফিলোজফি ডিগ্রি পান।

বিজ্ঞান কলেজে শুরু হয়েছিল ১৯১৪ সালে দুই ব্যারিস্টারের অর্থসাহায্যে; তারকনাথ পালিত দিয়েছিলেন প্রায় চোদ্দ লক্ষ টাকা, রাসবিহারী ঘোষ দিয়েছিলেন দশ লক্ষ টাকা। তাঁদের দুজনের সেই মোট দান আজকের হিসাবে একশো কোটি টাকারও অনেক বেশি। ১৯১৯ সালে রাসবিহারী ঘোষ আবার এগারো লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন, সেই টাকাতে ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের (Applied Physics Applied Chemistry) দুটি অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা হয়। ডক্টরেট করার পরেই ফণীন্দ্রনাথ ঘোষকে পদার্থবিদ্যাতে পাঁচশো টাকা বেতন ও একশো টাকা গৃহভাতাতে ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যার ঘোষ অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকাতে প্রযুক্তি কেন্দ্রে কাজ করার জন্য দু’বছরের ছুটির জন্য আবেদন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পূর্ণ বেতনে ছুটি অনুমোদন করে, একই সঙ্গে তাঁর বিদেশে খরচের জন্য তিন হাজার টাকা মঞ্জুর হয়। পরের বছর পি এন ঘোষ লন্ডন থেকে যন্ত্র কেনার জন্য একশো পাউন্ডের জন্য আবেদন করেন, ম্যানেজমেন্ট বোর্ড সেই অর্থও মঞ্জুর করে, শর্ত ছিল যন্ত্রটি হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি। জার্মানিতে সিমেন্স কোম্পানিতেও তিনি কিছুদিন কাটান। তিনি কলকাতাতে ফিরে আসেন ১৯২২ সালের নভেম্বর মাসে। অল্পদিন জার্মানিতে কাটালেও তিনি জার্মান ভাষাতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন।

১৯২৫ সালে থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যা আলাদা বিষয় হিসাবে পড়ানো শুরু হয়, তবে আলাদা বিভাগ হিসাবে তা রূপ নেয় ১৯৩০ সালে। কিন্তু বাস্তবে ফণীন্দ্রনাথ আলাদা বিভাগেই কাজ করছিলেন, ১৯২৪ সাল থেকেই দেখি সেনেট বা সিন্ডিকেটের কার্যবিবরণীতে ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যা বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। ফণীন্দ্রনাথকে নিজের হাতে করে ল্যাবরেটরি তৈরি করতে হয়েছিল। দীর্ঘদিন বিভাগে তাঁকে নিয়ে শিক্ষকের সংখ্যা ছিল মাত্র দুই। তাই হয়তো এই পর্বে তাঁর গবেষণাপত্রের সংখ্যা খুব বেশি নয়। ১৯২৯ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে তিনি ১৪টি গবেষণাপত্র ছাপিয়েছিলেন, তার মধ্যে চারটি যন্ত্রপাতি সংক্রান্ত, বাকিগুলি অণুর বর্ণালীবিশ্লেষণ বিষয়ে। একটি ছোট ঘর ও দুটি ডিসি মোটর দিয়ে শুরু করে তিনি যে ল্যাবরেটরি তৈরি করেছিলেন, ইউরোপ আমেরিকার বাইরে তার তুলনা সেই যুগে বিশেষ ছিল না। বর্ণালীবীক্ষণ, তড়িৎপ্রবাহ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি কাজ করতেন এবং ন্না যন্ত্র বানিয়েছিলেন। ১৯৪১ সালে বিজ্ঞান কংগ্রেসে তিনি পদার্থবিদ্যা বিভাগের সভাপতি হয়েছিলেন।

আজ যে শিল্প ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গাঁটছড়ার উপরে জোর দেওয়া হয়, আমাদের দেশে পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে সেই কাজটি প্রথম যাঁরা করেছিলেন, ফণীন্দ্রনাথ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি যে বিভাগের সূচনা করেছিলেন, তখন তা বিজ্ঞানের মধ্যে গণ্য হলেও বর্তমানে সেখানে বি টেক ও এম টেক পড়ানো হয়, গবেষণাও হয় প্রযুক্তি বিষয়ে। ফণীন্দ্রনাথ ইন্ডাস্ট্রিয়াল সার্ভে কমিটি অফ বেঙ্গল-এর সভাপতি ও বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ বোর্ডের সহ-সভাপতি হিসাবে কাজ করেছিলেন। ১৯৩৮ সালে মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি তৈরি করেছিল; পি এন ঘোষ তার বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সংক্রান্ত উপসমিতির সভাপতি হয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।


তথ্যসূত্রঃ


Phanindra Nath Ghosh, A. K. Sengupta, Biographical Memoirs of the Members of the Indian National Science Academy

The Dazzling Dawn: Physics Department of Calcutta University (1916-1936), Gautam Gangopadhyay, Anirban Kundu and Rajinder Singh, Shaker Verlag

Minutes of the Senate and Syndicate of the University of Calcutta for various years

 

প্রকাশঃ অণুমনস্ক ২০২২