হাইজেনবার্গ
:
এক
বিতর্কিত বিজ্ঞানী
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
(১)
এই
মুহূর্তে আমরা পদার্থবিজ্ঞানে
সব থেকে সফল তত্ত্ব কোয়ান্টাম
বলবিদ্যার শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে
দাঁড়িয়ে আছি। ১৯২৫ সালে তরুণ
জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ার্নার
হাইজেনবার্গ কোয়ান্টাম
বলবিদ্যার জন্ম দিয়েছিলেন
বলে ধরা যেতে পারে। অপর এক
জার্মান বিজ্ঞানী এরউইন
শ্রয়ডিঙ্গার সম্পূর্ণ অন্য
এক পথ ধরেছিলেন,
তাই
তিনিও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার
অন্যতম জনক। কেউ কেউ ফরাসি
বিজ্ঞানী লুই দ্য ব্রয়লিকেও
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আরেকজন
জনক বলেন,
কারণ
তিনি প্রথম কণা ও তরঙ্গকে এক
করে দেখেছিলেন। এঁদের গবেষণার
প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে সাহায্য
করেছিলেন হাইজেনবার্গের
শিক্ষক মাক্স বর্ন,
হাইজেনবার্গের
গবেষণাতেও তাঁর অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা আছে। তা সত্ত্বেও
আমাদের এই লেখার কেন্দ্রীয়
চরিত্র হাইজেনবার্গকে ঘিরেই
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্মের
ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে বললে
বাড়িয়ে বলা হবে না।
কোয়ান্টাম
বিপ্লবের নায়কদের অনেকের
জীবনও কম চমকপ্রদ নয়। কোয়াটাম
তত্ত্বের প্রথম যুগের মাত্র
দু’টি মৌলিক আবিষ্কার,
বোস
সংখ্যায়ন ও কম্পটন বিচ্ছুরণ,
ইউরোপের
বাইরে হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানের
সব থেকে বৈপ্লবিক যুগ মিলে
গেছে ইউরোপের তথা পৃথিবীর
ইতিহাসের অস্থিরতম রাজনৈতিক
সময়ের সঙ্গে। সেই বিপ্লবের
সঙ্গে যুক্ত ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের
প্রায় সকলকেই দু’টি বিশ্বযুদ্ধ,
জার্মানি
ও ইতালির ফ্যাসিবাদী শাসনের
মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে,
কয়েকজন
পরমাণু অস্ত্র প্রকল্পের
সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। হয়তো
বিজ্ঞানচর্চা মনের প্রসার
ঘটায়,
তাই
দেখা যায় এঁদের অনেকেই নিজেদের
মতো করে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের,
ফ্যাসিবাদের
বা পরমাণু বোমা ব্যবহারের
বিরুদ্ধাচরণ করেছেন,
তবে
ব্যতিক্রমও আছে। কোয়ান্টাম
বলবিদ্যার মূল কুশীলবদের
অনেকেই তিরিশ বছর বয়সের আগেই
মৌলিক অবদান রেখেছেন,
বিজ্ঞানীদের
বয়সের বিচারে তাঁদের তরুণই
বলতে হয়। তারুণ্যের স্পর্ধাতেই
তাঁরা হয়তো প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানের
বিরোধিতা করতে পেরেছিলেন।
সেই বিরোধিতা শুধু বিজ্ঞান
নয়,
অনেক
সময় প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক বা
সামাজিক কর্তৃত্বকেও অস্বীকার
করার সাহস জুগিয়েছিল। হাইজেনবার্গ
কিন্তু এঁদের মধ্যে ব্যতিক্রম,
বিজ্ঞানের
ক্ষেত্রে বিপ্লবী হলেও সামাজিক
ক্ষেত্রে সেই সাহস তিনি দেখাতে
পারেন নি।
ওয়ার্নার
হাইজেনবার্গের জন্ম ১৯০১
সালের ৫ ডিসেম্বর জার্মানির
ওয়ার্জবুর্গে। তাঁর বাবা
কাস্পার ছিলেন স্কুল শিক্ষক,
মায়ের
নাম অ্যানে। কয়েক বছর পর কাস্পার
মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন
বিভাগে অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
সেই কারণে হাইজেনবার্গ মিউনিখে
পড়াশোনা করেন। বাবার সূত্রের
দর্শনের সঙ্গে তাঁর পরিচয়,
আমরা
দেখব যে তা তাঁর গবেষণাতেও
কাজে লেগেছিল।
প্রথম
বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর পরাজয়ের
পরে মিউনিখে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র
স্থাপিত হয়েছিল,
সৈন্য
পাঠিয়ে তাকে উৎখাত করা হয়।
তরুণ হাইজেনবার্গ সেই যুদ্ধে
সোভিয়েত বিরোধী অতিদক্ষিণপন্থীদের
সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন,
যদিও
রিপোর্ট লেখা ছাড়া তাঁর বিশেষ
কোনো কাজ ছিল না। তবে সেই
যোগাযোগ বহু বছর বজায় ছিল।
১৯২০ সালে মিউনিখ জিমন্যাসিয়াম
থেকে উত্তীর্ণ হন হাইজেনবার্গ,
ভালো
ফল করার জন্য বৃত্তি পান। তাঁর
পছন্দের বিষয় ছিল গণিত,
কিন্তু
সেই বিভাগের ইন্টারভিউতে
তিনি খুবই খারাপ করেন। কাস্পার
তখন মিউনিখের বিখ্যাত
পদার্থবিজ্ঞানী আর্নল্ড
সমারফেল্ডের সঙ্গে ছেলের
যোগাযোগ করিয়ে দেন,
সমারফেল্ড
তাঁকে ছাত্র হিসাবে নিতে রজি
হন।
সমারফেল্ড
তাঁকে বলেছিলেন যে উলফগ্যাং
পাউলিই তাঁর সব সেরা ছাত্র।
হাইজেনবার্গ পাউলির সঙ্গে
বন্ধুত্ব করেন,
পাউলিই
কোয়ান্টাম তত্ত্বের দিকে
তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
হাইজেনবার্গ প্রথমেই পরমাণুর
বর্ণালীর উপর চৌম্বকক্ষেত্রের
ক্রিয়ার ব্যাখ্যা দেওয়ার
চেষ্টা করেছিলেন। সেই ব্যাখ্যা
ঠিক ছিল না,
কিন্তু
প্রবাদপ্রতিম পদার্থবিজ্ঞানী
নিল্স বোর সহ কোয়ান্টাম
তত্ত্বে গবেষণারত অন্য
বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ
করেছিল। তার কারণ তরুণ হাইজেনবার্গ
চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান বিশেষ
জানতেন না,
ফলে
তিনি এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন
যা অন্যদের পক্ষে চিন্তা করা
সম্ভব হয়নি।
বোর
এই রকম তরুণ বিজ্ঞানীদেরই
সন্ধান করতেন। ১৯২২ সালে
জার্মানির গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে
বোর ও হাইজেনবার্গের দেখা
হল। বোরের বক্তৃতা শুনে
হাইজেনবার্গ সেই বিষয়ে কিছু
মন্তব্য করেন। বক্তৃতার পরে
বোর তাঁকে তাঁর সঙ্গে কিছু
দূর হাঁটার আমন্ত্রণ জানান।
কাছের এক পাহাড়ের চূড়াতে
তাঁদের সেই অভিযান সময় নিয়েছিল
তিন ঘণ্টা। হাইজেনবার্গের
নিজের কথাতে,
বিজ্ঞানে
তাঁর আসল জীবনের সেই ছিল শুরু,
বোর
তাঁকে বলেন যে কোয়ান্টাম
তত্ত্ব নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট
নন। কোয়ান্টাম তত্ত্বের অন্যতম
স্রষ্টা বোর যদি সেই তত্ত্ব
নিয়ে সন্তুষ্ট না হন,
তাহলে
নিশ্চয় সেখানে অনেক কিছু করার
সুযোগ আছে। বোর তাঁকে কোপেনহাগেনে
আমন্ত্রণ জানান।
কিন্তু
সেই সময় কোপেনহাগেন যাওয়ার
সুযোগ হাইজেনবার্জের হয়নি।
সমারফেল্ড কিছুদিনের জন্য
আমেরিকা গিয়েছিলেন,
তিনি
হাইজেনবার্গকে মাক্স বর্নের
কাছে গটিনগেনে পাঠিয়েছিলেন।
১৯২৩-এর
শেষদিকে হাইজেনবার্গ মিউনিখে
গেলেন,
এবার
ডক্টরেট পরীক্ষার ইন্টারভিউ।
পরীক্ষক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী
উইলহেল্ম ভীন জিজ্ঞাসা করলেন
টেলিস্কোপের মতো আলোকযন্ত্রের
বিভেদন কত অর্থাৎ তা দিয়ে কত
ছোট কোণ মাপা যায়?
এটা
অতি সাধারণ প্রশ্ন,
কিন্তু
হাইজেনবার্গ তার উত্তর জানেন
না। ব্যাটারি কেমন করে কাজ
করে?
হাইজেনবার্গের
কোনো ধারণাই নেই। এই সব পুরানো
বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর কোনো আগ্রহ
কোনোদিন ছিল না। ভীন হাইজেনবার্গকে
পাস করাতেই রাজি ছিলেন না,
সমারফেল্ডের
হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত
হাইজেনবার্গ তৃতীয় শ্রেণির
ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন। কোয়ান্টাম
বলবিদ্যা আবিষ্কারের পরে ভীন
তাঁকে এক আলোচনাসভাতে এমন
তীব্রভাবে আক্রমণ করেছিলেন
যে হাইজেনবার্গ মানসিকভাবে
ভেঙে পড়েছিলেন।
অপমানিত
হাইজেনবার্গ পরীক্ষার দিন
সন্ধ্যাবেলাতেই মিউনিখ ছাড়লেন।
বর্ন এত তাড়াতাড়ি তাঁকে গটিনগেনে
দেখে অবাক হয়ে গেলেন। হাইজেনবার্গ
জিজ্ঞাসা করলেন বর্ন কি কোনো
তৃতীয় শ্রেণির ডক্টরেটকে
তাঁর সহকারী হিসাবে নেবেন?
বর্ন
উত্তর দিলেন যে তিনি নিশ্চিত
হাইজেনবার্গ ভবিষ্যতে সফল
হবেন,
এই
বিপর্যয় নিতান্তই সাময়িক।
কোপেনহাগেন থেকে আবার আমন্ত্রণ
এলো,
১৯২৪
সালের ১৫ মার্চ হাইজেনবার্গ
বোরের ইনস্টিটিউটে পৌঁছলেন।
কোয়ান্টাম তত্ত্বের ত্রিভুজের
তিনটি শীর্ষবিন্দু;
মিউনিখে
সমারফেল্ড,
গটিনগেনে
বর্ন,
কোপেনহাগেনে
বোর — হাইজেনবার্গ ত্রিভুজটি
সম্পূর্ণ করলেন। অনেক পরে
তিনি বলবেন,
‘সমারফেল্ডের
থেকে শিখেছি আশাবাদ,
বর্নের
থেকে অঙ্ক,
বোরের
থেকে পদার্থবিদ্যা।“ হয়তো
এই মন্তব্য সেই সময়ে সারা
পৃথিবীতে পদার্থবিদ্যার সেরা
শিক্ষক সমারফেল্ডের প্রতি
সুবিচার করেনিi।
অথবা হয়তো সত্যিই সমারফেল্ড
কেন,
পৃথিবীর
কোনো শিক্ষকেরই কোয়ান্টাম
বলবিদ্যার ভবিষ্যৎ জনক
হাইজেনবার্গকে আধুনিক
পদার্থবিদ্যাতে শেখানোর মতো
কিছু ছিল না।
বোরের
ইনস্টিটিউট,
কিন্তু
হাইজেনবার্গের সঙ্গে প্রথম
কদিন বোরের দেখা হয়নি। একদিন
সকালে অফিসের দরজাতে টোকা
পড়ল,
বোর
জিজ্ঞাসা করতে এসেছে হাইজেনবার্গ
তাঁর সঙ্গে কয়েক দিনের জন্য
হাঁটতে যেতে রাজি কিনা।
হাইজেনবার্গ রাজি;
তিনদিনের
পদব্রজে ভ্রমণে দু’জনে দেড়শো
কিলোমিটারের বেশি হাঁটলেন।
পদার্থবিদ্যা তাঁদের আলোচনাতে
এসেছিল,
কিন্তু
তার থেকেও বেশি এসেছিল তরুণ
হাইজেনবার্গের জীবনকথা।
হাইজেনবার্গ জানতেন না যে
পাউলি বোরকে লিখে পাঠিয়েছেন
তাঁর নতুন অতিথিটি এক বিরল
প্রতিভা। পাউলির সার্টিফিকেট
বোরের কাছে খুবই মূল্যবান
ছিল,
তাই
তিন দিন তিনি হাইজেনবার্গকে
বুঝতে খরচ করলেন। এই পরিশ্রম
বিফলে যায়নি,
হাইজেনবার্গের
আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে তা
সাহায্য করেছিল। গটিনগেন ও
কোপেনহাগেন,
এই
দুই জায়গার মধ্যেই হাইজেনবার্গ
সময় কাটাচ্ছিলেন।
বোর,
বর্ন
ও সমারফেল্ড ছাড়াও আরো একজন
হাইজেনবার্গকে প্রভাবিত
করছিলেন,
তিনি
আর্ন্সট মাখ। খ্রিস্ট ধর্মে
শিশুর নামকরণের সময় গডফাদারের
এক বিশেষ ভূমিকা আছে,
হাইজেনবার্গের
গডফাদার ছিলেন সে যুগে বিজ্ঞান
দর্শনের শ্রেষ্ঠ প্রতিভূ
মাখ,
তিনি
ছিলেন কাস্পারের সহকর্মী ও
বন্ধু। বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ
তত্ত্ব নির্মানের সময় মাখের
দর্শন আইনস্টাইনের কাজে
লেগেছিল,
যদিও
পরবর্তীকালে তিনি তাতে বিশ্বাস
হারিয়ে ফেলেন। মাখের দর্শনকে
বলা হয় পজিটিভিজম বা দৃষ্টবাদ,
তার
মূল কথা হল যা দেখা যায় না
বিজ্ঞানে তা নিয়ে আলোচনার
কোনো অর্থ নেই। মাখ এমনকি
পরমাণুর অস্তিত্বে বিশ্বাস
করতেন না। এই পর্যায়ে হাইজেনবার্গের
চিন্তা মাখের পথে চলেছিল।
১৯২৪
সালের ডিসেম্বর মাসে পাউলি
বোরকে চিঠিতে লিখেছিলেন যে
আমাদের পরিচিত গতিবিদ্যার
ধারণা থেকেই আমরা পরমাণুর
মধ্যে ইলেকট্রনের কক্ষপথ
কল্পনা করেছি,
অণুপরমাণুর
ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণের উপর
নির্ভর করে আমাদের ধারণাকেই
পরিবর্তন করতে হবে। তার আগেও
তিনি ইলেকট্রনের কক্ষপথের
কথা আদৌ বলা যায় কিনা তা নিয়েই
সন্দেহপ্রকাশ করেছিলেন।
পাউলি এবং হাইজেনবার্গ দু’জনেই
এই সময়ে চিরায়ত পদার্থবিদ্যার
কাঠামোর বাইরে বেরোতে চাইছিলেন।
প্রথম সফল হলেন হাইজেনবার্গ,
মাখের
দর্শন তাঁকে পথ দেখাল। পরমাণুর
মধ্যে ইলেকট্রনের কক্ষপথের
কল্পনা এসেছিল বোরের মডেল
থেকে। সেই মডেল চিরায়ত
পদার্থবিদ্যা দিয়েই ইলেকট্রনের
আবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে
চেয়েছিল। মাখের দর্শনের
অনুসারী হাইজেনবার্গের মনে
হল এই পদ্ধতির কোনো অর্থ নেই,
কারণ
প্রদক্ষিণরত ইলেকট্রনকে দেখা
সম্ভব নয়। একমাত্র যে সব রাশি
দেখা বা পরিমাপ করা যায়,
পরমাণুকে
তাদের সাপেক্ষেই বুঝতে হবে।
হাইজেনবার্গ
এই সময় হে ফিভারে আক্রান্ত
হয়ে পড়েন। ইউরোপে বসন্তকালে
এই রোগ খুব সাধারণ ঘটনা,
পরাগ
রেণুতে অ্যালার্জি এর জন্য
দায়ী। বাড়াবাড়ি হওয়াতে
হাইজেনবার্গ হেলগোল্যান্ড
দ্বীপে আশ্রয় নিলেন। সেটা
ছিল ১৯২৫ সালের জুন মাস।
হেলগোল্যান্ড উত্তর সাগরে
এক পাথুরে দ্বীপ,
গাছপালা
সেখানে বিশেষ নেই,
তাই
পরাগরেণুর সমস্যা নেই। সেই
প্রায় নির্জন দ্বীপে হাইজেনবার্গ
আলোর রেখা দেখতে পেলেন।
উত্তেজনায় হাইজেনবার্গ সাধারণ
পাটিগণিতেও ভুল করতে শুরু
করলেন। সারারাত জেগে তিনি
শেষ পর্যন্ত দেখলেন যে তাঁর
তত্ত্ব একেবারে সঠিক উত্তরই
দিচ্ছে।
পাঠকের
কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি যে
বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানের
উল্লেখযোগ্যতম কাজের মধ্যে
পড়লেও হাইজেনবার্গের এই
গবেষণার ব্যাখ্যা এই লেখাতে
সম্ভব নয়। জটিল গণিতের প্রয়োজন
তো আছেই,
তাছাড়াও
এই গবেষণাপত্রটি একশো বছরে
পরেও আমাদের অনেকের কাছেই
এখনো প্রহেলিকা। বিংশ শতাব্দীর
দ্বিতীয়ার্ধে কোয়ান্টাম
তত্ত্বে যাঁরা সব থেকে বেশি
অবদান রেখেছেন,
তাঁদের
একজন নোবেল পুরস্কারজয়ী
বিজ্ঞানী স্টিভেন ভাইনবার্গ
এই গবেষণাপত্রটি সম্পর্কে
বলেছেন,
“‘If the reader is
mystified at what Heisenberg was doing, he or she is not alone. I
have tried several times to read the paper that Heisenberg wrote on
returning from Helgoland, and, although I think I understand quantum
mechanics, I have never understood Heisenberg’s motivations for the
mathematical steps in his paper. Theoretical physicists in their most
successful work tend to play one of two roles: they are either sages
or magicians....It is usually not difficult to understand the papers
of sage-physicists, but the papers of magician physicists are often
incomprehensible. In that sense, Heisenberg’s 1925 paper was pure
magic. ... Perhaps we should not look too closely at Heisenberg’s
first paper......’(S. Weinberg, Dreams of a Final Theory, New York,
Pantheon, 1992)।
আমিও মহাজনের পরামর্শ মেনে
হাইজেনবার্গের প্রথম গবেষণাপত্রটির
পরিচয় দূর থেকেই দিলাম।
রাত
তখন তিনটে,
আর
ঘুমোনোর প্রশ্নই ওঠে না।
হাইজেনবার্গ হাঁটতে বেরোলেন।
রাস্তায় অন্য কোনো মানুষ নেই,
এমনকি
সদা উপস্থিত শঙ্খচিলরাও তখনো
ঘুম থেকে ওঠেনি। দ্বীপের
উত্তরতম প্রান্তে এক পাথরের
ঢিপি আছে,
হাইজেনবার্গ
তার উপর উঠে বসলেন,
একটু
পরেই সুর্য উঠল,
তার
প্রথম আলো এসে পড়ল সমুদ্রের
বুকে। হাইজেনবার্গের গবেষণাও
আলোকিত করল তাঁর সমকালীন
পদার্থবিজ্ঞানের জটিলতম
সমস্যাকে।
তাঁর
অঙ্কে একটা অদ্ভুত সমস্যার
মুখোমুখি হয়েছিলেন হাইজেনবার্গ।
যদি কোনো কণার অবস্থানকে x
ও
ভরবেগকে p
দিয়ে
দেখাই,
তাহলে
এই দু’য়ের গুণফল হবে xp।
সাধারণ বুদ্ধি বলে এই গুণফল
কোনটা আগে কোনটা পরে তার উপর
নির্ভর করে না,
দুইকে
তিন দিয়ে গুণ করলে যা পাব,
তিনকে
দুই দিয়ে গুণ করলে অন্য কিছু
পাওয়া সম্ভব নয়। হাইজেনবার্গের
তত্ত্বে কিন্তু xp
এবং
px
সমান
নয়। এই সমস্যার কোনো ব্যাখ্যা
হাইজেনবার্গ সেই সময় দিতে
পারেন নি। পরে পল ডিরাক ও
হাইজেনবার্গ পৃথক পৃথকভাবে
দেখাবেন যে এই বিষয়টাই হল
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রাণ।
এই ভরবেগ বা অবস্থান কোনো
রাশির মান নয়,
পরিমাপের
পদ্ধতি;
তাই
কোন রাশি আগে মাপা হচ্ছে,
তার
উপরে গুণফল নির্ভর করে।
হে
ফিভার ভুলে গিয়ে হাইজেনবার্গ
হেলগোল্যান্ড ছাড়লেন,
প্রথম
গন্তব্য হামবুর্গ,
সেখানে
আছেন বন্ধু পাউলি। কেউ যদি
হাইজেনবার্গকে ভুল প্রমাণ
করতে পারেন,
তিনি
পাউলি। পাউলি উৎসাহ দিলেন,
হাইজেনবার্গ
গবেষণাপত্রের আকারে তাঁর
চিন্তাকে লিখতে শুরু করলেন।
তখনো হাইজানবার্গ সন্দিহান,
জুন
মাসের শেষে তিনি বাবাকে চিঠিতে
লিখছেন,
আমার
কাজ বিশেষ এগোচ্ছে না। একই
সময়ে পাউলিকে গবেষণাপত্রটির
কপি পাঠালেন। পাউলি অত্যন্ত
উত্তেজিত,
কোয়ান্টাম
তত্ত্বের গোলকধাঁধার শেষে
আলো দেখা যাচ্ছে। কয়েকদিন
পরেই হাইজেনবার্গ বর্নকে
গবেষণাপত্রটি দিলেন। জানালেন,
এই
‘পাগলামি’ কোথাও ছাপার জন্য
পাঠানোর সাহস তাঁর নেই। বর্ন
কী বলেন?
দুদিন
পরে বর্ন সেই প্রবন্ধ খুললেন।
কৌতূহল তাঁর ছিলই,
হাইজেনবার্গ
তো নিজের মতামত জানাতে কখনো
কুণ্ঠা বোধ করেন না,
তিনি
কেন এই রকম করছেন?
প্রবন্ধটি
সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে একই সঙ্গে
উত্তেজিত ও বিস্মিত করেছিল।
২৫ জুলাই তিনি সেটা জাইটশক্রিপ্ট
ফার ফিজিক পত্রিকাতে প্রকাশের
জন্য পাঠালেন।
বর্নের
মনে বার বার আসছিল,
কোথায়
এমন গুণ দেখেছেন যেখানে গুণফল
গুণকদের কোনটা আগে কোনটা পরে
তার উপর নির্ভর করে?
ইউরোপে
তখন হয়তো একজনই পদার্থবিজ্ঞানী
ছিলেন,
যিনি
ওই রাশিগুলোকে চিনতে পারতেন,
তিনি
মাক্স বর্ন। পদার্থবিজ্ঞানী
হলেও তাঁর পড়াশোনা গণিতে;
হঠাৎ
তাঁর মনে পড়ল গণিতে ম্যাট্রিক্স
হল ঠিক এই রকমই সারি,
এবং
দু’টি ম্যাট্রিক্সের গুণফল
তাদের ক্রমের উপর নির্ভর করে।
বর্ন তাঁর ছাত্র পাস্কাল
জর্ডানকে নিয়ে হাইজেনবার্গের
গবেষণাকে আরো স্পষ্ট রূপ
দেওয়ার কাজ শুরু করলেন।
হাইজেনবার্গ
আগে কোনোদিন ম্যাট্রিক্সের
কথা শোনেননি। তা সত্ত্বেও
হাইজেনবার্গের তত্ত্বের নাম
শেষ পর্যন্ত হল ম্যাট্রিক্স
বলবিদ্যা। হাইজেনবার্গও
বর্নদের সঙ্গে যোগ দেন,
তাঁদের
তিনজনের মিলিত প্রয়াস শেষ
পর্যন্ত কোয়ান্টাম বলবিদ্যার
জন্ম দিল। বর্ন প্রথমে পাউলিকে
সাহায্যের জন্য বলেছিলেন,
কিন্তু
পাউলি তাঁকে ফিরিয়ে দেন। তিনি
বলেন গণিতের উপর বেশী জোর দিলে
হাইজেনবার্গের এই নতুন
পদার্থবিদ্যার ক্ষতি হবে।
হাইজেনবার্গ-বর্ন-জর্ডানের
গবেষণার সমান্তরালে পাউলি
নতুন বলবিদ্যার এক চমৎকার
প্রয়োগ করলেন।
এই
নতুন বলবিদ্যা বিজ্ঞানীমহলে
মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম
দিল। আইনস্টাইন বন্ধু বিজ্ঞানী
পল এহ্রেনফেস্টকে লিখলেন
যে তাঁর এতে বিশ্বাস নেই।
কিছুদিন পরে বার্লিনে হাইজেনবার্গ
ও আইনস্টাইনের দেখা হবে,
সেখানে
তিনি তাঁর মতামত আবার জানাবেন।
হাইজেনবার্গের তত্ত্বে
ইলেকট্রনদের কক্ষপথের কোনো
প্রসঙ্গ আসতে পারে না,
কারণ
তা দেখা সম্ভব নয়। আইনস্টাইন
বিশ্বাস করেন যে না দেখা গেলেও
কক্ষপথ একটা আছে। হাইজেনবার্গ
বললেন তিনি আইনস্টাইনকেই
অনুসরণ করছেন,
মাখের
যে দর্শন অনুসারে যা দেখা যায়
না তাকে তিনি বাদ দিয়েছেন,
আইনস্টাইন
তো সেই দর্শন অনুসারেই আপেক্ষিকতার
তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে
নিজেই জানিয়েছেন। আইনস্টাইন
বললেন,
হয়তো
তিনি তা করেছিলেন,
কিন্তু
তা হলেও সেটা ভুল। হাইজেনবার্গের
কোনো যুক্তিই আইনস্টাইনের
মনে দাগ কাটল না।
ম্যাট্রিক্স
বলবিদ্যার তাৎপর্য নিয়ে আপত্তি
থাকলেও হাইজেনবার্গের কাজের
গুরুত্ব নিয়ে আইনস্টাইনের
সন্দেহ ছিল না,
যে
কারণে ১৯৩২ সালে তিনি হাইজেনবার্গের
নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য
মনোনীত করেন। বোর,
প্লাঙ্ক,
পাউলি,
ফ্রাঙ্ক
— কোয়ান্টাম তত্ত্বের মুখ্য
দিকপালদের অনেকেই তাঁর নাম
মনোনীত করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত
১৯৩২ সালের পদার্থবিজ্ঞানের
পুরস্কারটি এককভাবে হাইজেনবার্গ
পেলেন,
যদিও
সেটি পরের বছর ঘোষণা করা হয়েছিল।
এর পরেও তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্বে
অত্যন্ত মৌলিক অবদান রেখেছিলেন,
আমরা
আমাদের আলোচনা শুধু কোয়ান্টাম
তত্ত্বের জন্মের মধ্যেই
সীমাবদ্ধ রাখলাম।
বিজ্ঞানে
হাইজেনবার্গের সাফল্য নিয়ে
প্রশ্ন ওঠে না,
কিন্তু
তার বাইরে তিনি এক বহু বিতর্কিত
চরিত্র,
শুধুমাত্র
সাদা কালো রঙে তাঁকে দেখানো
সম্ভব নয়। খুব স্বল্প কথায়
আমরা তাঁর সম্পর্কে জেনে নিই।
যে বছর হাইজেনবার্গের নোবেল
পুরস্কারের ঘোষণা হয়,
সেই
১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে
হিটলার ও তাঁর নাৎসি বাহিনী
জার্মানিতে ক্ষমতায় আসে। বহু
ইহুদি বিজ্ঞানীর চাকরি যায়,
অনেকেই
দেশত্যাগ করেন। হাইজেনবার্গ
প্লাঙ্কের সঙ্গে দেখা করে
জার্মানি ত্যাগের বিষয়ে তাঁর
মত চান। প্লাঙ্ক তাঁকে বারণ
করেন,
প্রথমত,
সেক্ষেত্রে
যে ইহুদি বিজ্ঞানীদের বিদেশে
চাকরির সুযোগ কমে যাবে।
দ্বিতীয়ত,
প্লাঙ্ক
তখনো আশা রেখেছিলেন হিটলারের
মনের পরিবর্তন করিয়ে জার্মান
বিজ্ঞানকে বাঁচাতে পারবেন।
তাঁর আশ্বাস পেয়ে হাইজেনবার্গ
ইহুদি মাক্স বর্নকে সেই এক
চিঠিতে সেই কথা লিখেছিলেন।
তিনি বর্নকে অপেক্ষা করার
পরামর্শ দিয়েছিলেন,
বুদ্ধিমান
বর্ন তাতে কর্ণপাত করেননি।
বলা বাহুল্য,
প্লাঙ্ক
বা হাইজেনবার্গ হিটলার তথা
নাৎসিদের তীব্র ইহুদি বিদ্বেষের
মাপ করতে পারেননি।
আইনস্টাইন
১৯৩২ সালের ডিসেম্বর মাসে
কিছুদিনের জন্য আমেরিকা
গিয়েছিলেন;
জার্মানিতে
ফেরা তাঁর আর হয়নি। আগে থেকেই
নাৎসিরা আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে
আক্রমণ শানাচ্ছিল আমরা দেখেছি,
এখন
তা চরমে ওঠে। বিশেষ করে আক্রান্ত
হয় তাঁর আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব।
হাইজেনবার্গ আপেক্ষিকতাবাদের
সমর্থনে মুখ খুলেছিলেন বলে
তাঁকে বিদ্রূপ করে শ্বেত ইহুদি
বলা হত। এরপরে লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে
আবার যখন অনেক অধ্যাপককে
পদচ্যুত করা হয়,
হাইজেনবার্গ
এক সভাতে তার প্রতিবাদ করেছিলেন।
কিন্তু তার বেশি এগোনোর কথা
হাইজেনবার্গ ভাবেননি,
মাকে
এই সময় এক চিঠিতে লিখেছিলেন
যে তিনি বিজ্ঞানের ক্ষুদ্র
গণ্ডির মধ্যেই কাজ করে যাবেন।
বাইরের পৃথিবীটা কুৎসিত,
কিন্তু
তাঁর কাজের ক্ষেত্রটা সুন্দর।
সমারফেল্ড
অবসর নেওয়ার পরে মিউনিখ
বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জায়গায়
হাইজেনবার্গের নাম ওঠে। তীব্র
বিরোধিতা আসে নাৎসিদের পক্ষ
থেকে,
শেষ
পর্যন্ত তাঁকে নেওয়া হয়নি।
হাইজেনবার্গের বিরুদ্ধে
কাগজপত্রে লেখালেখি এতই তীব্র
হয় যে শারীরিক আক্রমণের আশঙ্কা
দেখা দেয়। হাইজেনবার্গকে
নাৎসিবাদের সমর্থক বলা যায়
না,
কিন্তু
তরুণ বয়সে মিউনিখে অভ্যুত্থানের
সময় উগ্র জাত্যাভিমানীদের
সঙ্গে তাঁর যে যোগাযোগ হয়েছিল,
তা
তিনি বজায় রেখে চলেছিলেন। এই
সময়ে হাইজেনবার্গের মা নাৎসি
পার্টির গুণ্ডাবাহিনী এসএস-এর
শীর্ষ নেতা এবং জার্মানির
পুলিশবাহিনির সর্বাধিনায়ক
হাইনরিখ হিমলারের মায়ের সঙ্গে
দেখা করে ছেলের ব্যাপারে
সাহায্য চান। তাঁরা ছিলেন
পূর্বপরিচিত। এসএস-এর
কাগজ থেকেই হাইজেনবার্গের
বিরুদ্ধে তীব্রতম আক্রমণ
এসেছিল। হিমলার এসএস বাহিনীকে
নিরস্ত করেন,
একই
সঙ্গে হাইজেনবার্গকে এক চিঠিতে
তিনি তাঁর বিজ্ঞান গবেষণা ও
রাজনীতিকে পৃথক করার পরামর্শ
দেন।
১৯৩৮
সালের একদম শেষে নিউক্লিয়
বিভাজন বা ফিশন আবিষ্কার হয়।
বিভাজন আবিষ্কার নিউক্লিয়
শক্তির সম্ভাবনার দ্বার খুলে
দেয়। জার্মান সরকারও সে বিষয়ে
উদাসীন ছিল না,
তারা
প্রথমে নিউক্লিয় শক্তির
ব্যবহার এবং পরে তাকে অস্ত্র
হিসাবে প্রয়োগের জন্য গবেষণাতে
জোর দিয়েছিল। বার্লিনের কাইজার
উইলহেল্ম ইনস্টিটিউটে বিভাজন
বিক্রিয়া আবিষ্কার হয়েছিল,
১৯৪২
সালে হাইজেনবার্গ অটো হানের
সঙ্গে সেই সংস্থার যুগ্ম
অধিকর্তা হন। সেই বছরই নিউক্লিয়
অস্ত্র বিষয়ে গবেষণার সিদ্ধান্ত
নেওয়ার পরে জার্মান সরকারের
পক্ষ থেকে হাইজেনবার্গকে সেই
প্রকল্পের মূল দায়িত্ব দেওয়া
হয়। বোঝা যাচ্ছে যে তিনি আর
নাৎসিদের কাছে ব্রাত্য ছিলেন
না।
এই
প্রসঙ্গেই আসে বিজ্ঞানের
ইতিহাসের এক অমীমাংসিত সংলাপের
কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
সময় জার্মানির পরমাণু প্রকল্পের
মূল দায়িত্বে ছিলেন হাইজেনবার্গ।
১৯৪১ সালে তিনি বোরের সঙ্গে
দেখা করতে গিয়েছিলেন। হাইজেনবার্গ
নাৎসি ছিলেন না,
কিন্তু
সেই সময় অন্তত যুদ্ধে জার্মানির
উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। ডেনমার্ক
তখন জার্মানির অধিকৃত,
এক
সময়কার দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগীর
মধ্যে তখন মাথা তুলেছে বিজয়ী
ও পদানত দেশের নাগরিককে
বিভেদকারী দুর্লঙ্ঘ্য দেওয়াল।
তাঁরা পরমাণু শক্তি বিষয়ে
আলোচনা করেছিলেন,
কিন্তু
ঠিক কী কথা হয়েছিল দু’জনের
মধ্যে,
তা
নিয়ে পরে দু’জনে একমত হতে
পারেননি। বোর তাঁর ছেলে
পরবর্তীকালের নোবেলজয়ী আগি
বোরকে বলেছিলেন হাইজেনবার্গ
আভাস দেন যে তিনি পরমাণু অস্ত্র
নিয়ে কাজ করছেন,
কিন্তু
কোন কারণে তিনি দেখা করতে
এসেছেন তা বলেননি। বোর তাঁকে
বলেছেন সেই মুহূর্তে প্রযুক্তিগত
ভাবে পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ
অসম্ভব। হাইজেনবার্গ তাঁকে
বলেন,
তিনি
যে কাজে হাত দিয়েছেন তা সম্ভব
বুঝেই দিয়েছেন। হাইজেনবার্গ
পরে বলেন যে যুদ্ধে পরমাণু
অস্ত্রের ব্যবহারের কথা শুনে
বোর এত বিচলিত হয়ে পড়েন যে
তিনি পরের কোনো কথা বুঝতেই
পারেন নি। হাইজেনবার্গ তাঁকে
বলতে চেয়েছিলেন যে সেই কাজের
জন্য প্রচুর পরিশ্রম প্রয়োজন,
এবং
বোর যদি বিষয়টিকে অনৈতিক মনে
করেন তাহলে জার্মান বিজ্ঞানীরা
সেই কাজ করবেন না। এমন কথাও
এসেছে যে হাইজেনবার্গ চেয়েছিলেন
সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা
পরমাণু অস্ত্র থেকে হাত গুটিয়ে
নিন,
বোরের
মারফত সেই আবেদন সকলের কাছে
পৌঁছোক। আগি বোর বলেছেন এই
ধরনের কোনো কথা হয়নি। অনেক
বছর পরে ঐতিহাসিকদের চাপে
নিল্স বোর আর্কাইভ হাইজেনবার্গকে
লেখা কিন্তু না পাঠানো বোরের
এক চিঠি প্রকাশ করে। সেখানে
বোরও স্পষ্টই লিখেছেন এমন
কোনো কথা হয়নি। কিন্তু ঠিক
কোন কথা বলতে হাইজেনবার্গ
বোরের কাছে গিয়েছিলেন তা এখনও
প্রহেলিকা। অনেকের মতে বোরকে
ভয় দেখিয়ে জার্মান পক্ষে টানা
হয়তো হাইজেনবার্গের উদ্দেশ্য
ছিল। তাই যদি হয় তাহলে পরের
ঘটনাক্রম থেকে বোঝা যাবে ঠিক
বিপরীত ফল হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকার
নিয়ে লেখা নাটক 'কোপেনহাগেন'
খুবই
জনপ্রিয় হয়েছিল।
|
১৯৩৪ সালে হাইজেনবার্গ ও বোর
|
হাইজেনবার্গ
অবশ্যই জানতেন যে বোর জার্মানিত্যাগী
ইহুদি বিজ্ঞানীদের সাহায্য
করছেন। অনেক বিজ্ঞানীই অন্য
দেশে আশ্রয় খোঁজার সময় কোপেনহাগেনে
বোরের ইন্সটিটিউটে জায়গা
পেয়েছিলেন। বোর যুদ্ধে মিত্র
পক্ষের নজরেও ছিলেন। জার্মানির
ডেনমার্ক অধিকারের পরেই তখনো
পর্যন্ত যুদ্ধে নিরপেক্ষ
আমেরিকা থেকে বোরের কাছে অনেক
আমন্ত্রণ এসে পৌঁছায়,
কিন্তু
বোর প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৪৩
সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশ
গুপ্তচরেরা বোরের সঙ্গে
যোগাযোগ করেন। ডেনমার্কের
সামরিক বাহিনীর অফিসার ক্যাপ্টেন
ভলমার গাইথের মাধ্যমে ব্রিটিশ
বিজ্ঞানী নিউট্রনের আবিষ্কারক
জেমস চ্যাডউইকের এক চিঠি বোরের
কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এক গোছা
চাবির মধ্যে ছিল একটি ফাঁপা
চাবি,
তার
ভিতরে চিঠিটির মাইক্রোফিল্ম
লুকানো ছিল। চিঠিতে চ্যাডউইক
তাঁকে ব্রিটেনে আসার আমন্ত্রণ
জানান। গোপন চিঠিতেও চ্যাডউইক
নিউক্লিয় বিভাজনের কথা লিখতে
সাহস করেননি,
শুধু
লিখেছিলেন যে এক বিশেষ সমস্যার
সমাধানে তাঁরা বোরের সাহায্য
চান। বোর বুঝতে ভুল করেননি,
তিনি
উত্তরে লেখেন এখনি পরমাণু
শক্তির ব্যবহার সম্ভব নয় বলে
তিনি বিশ্বাস করেন। বোরের
উত্তরের ছবি তুলে তার মাইক্রোফিল্ম
এক দাঁতের ডাক্তারের সাহায্যে
ভলমার বার্তা বাহকের ফাঁপা
দাঁতের ভিতর ঢুকিয়ে দেন,
সেইভাবে
তা ব্রিটেনে পৌঁছায়।
চ্যাডউইকের
চিঠি পাওয়ার আগে বোর মিত্রপক্ষের
পরমাণু বোমা প্রকল্প সম্পর্কে
স্বাভাবিকভাবেই কিছু জানতেন
না,
কিন্তু
হাইজেনবার্গের সঙ্গে সাক্ষাতের
পরে তাঁর মনে হয়েছিল প্রযুক্তিগতভাবে
পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ হয়তো
তখনই সম্ভব। ফলে হাইজেনবার্গ
সম্ভবত যা চেয়েছিলেন,
ফল
হয় তার বিপরীত। চ্যাডউইককে
চিঠি পাঠানো দু’সপ্তাহ পরে
বোর আবার গাইথের সঙ্গে দেখা
করেন,
বলেন
যে তিনি পরমাণু শক্তিকে
ব্যবহারের এক পদ্ধতি ভেবেছেন।
বোরের সেই চিঠি গোপন পথে
চ্যাডউকের কাছে পৌঁছেছিল,
যদিও
সেই পদ্ধতি শেষ পর্যন্ত বোমা
তৈরিতে ব্যবহার হয়নি।
নাৎসি
জার্মানির পরমাণু অস্ত্র
নির্মান প্রয়াস সম্পর্কে বহু
লেখালেখি হয়েছে,
এবং
কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো
সম্ভব হয়নি। হাইজেনবার্গ কি
হিটলারের হাতে পরমাণু বোমা
তুলে দিতে চেয়েছিলেন?
তিনি
নিজে দাবি করেছিলেন যে জার্মান
বিজ্ঞানীরা সচেতনভাবেই এই
বিধ্বংসী মারণাস্ত্র বিষয়ক
গবেষণা থেকে বিরত থেকেছিলেন।
তাঁর পরমাণু প্রকল্পের কর্ণধার
হওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল
জার্মানির পরাজয়ের সঙ্গে
সঙ্গে জার্মানিতে পদার্থবিদ্যার
গবেষণার যাতে মৃত্যু না হয়
তা নিশ্চিত করা। এজন্য তিনি
বোমা গবেষণার নাম করে তরুণ
বিজ্ঞানীদের প্রাণ রক্ষা
করতে সৈন্যদল বার করে এনেছিলেন।
জার্মানির পরমাণু গবেষণা
কতদূর এগিয়েছে তা জানার জন্য
মার্কিন সৈন্যদলের সঙ্গে
ইউরোপে এসেছিলে অলসোস মিশন।
তার বৈজ্ঞানিক বিভাগের প্রধান
হাইজেনবার্গের পূর্বপরিচিত
স্যামুয়েল গৌডস্মিটের মত ছিল
যে জার্মান বিজ্ঞানীরা নিউক্লিয়
অস্ত্র তৈরির প্রাথমিক পর্যায়েও
পৌঁছাতে পারেননি,
এবং
তার পিছনে ছিল অনভিজ্ঞতা।
সেটাও অস্বাভাবিক নয়,
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ যার
মূল ভূখণ্ডে কোনো আক্রমণ
আসেনি,
সেখানেও
অস্ত্র তৈরি হতে লেগেছিল তিন
বছর,
এবং
তার জন্য যে প্রতিভার সমাবেশ
ঘটাতে হয়েছিল তা পৃথিবীর
ইতিহাসে আগে পরে কখনো ঘটেনি।
যুদ্ধরত জার্মানির পক্ষে সেই
প্রয়াস সম্ভব ছিল না,
একই
কারণে ব্রিটেনে গবেষণা শুরু
হলেও তা শেষ পর্যন্ত মার্কিন
প্রয়াসের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া
হয়। হাইজেনবার্গের একদা
সহকর্মী রুডলফ পিয়ের্লসের
মতে হাইজেনবার্গ ও অন্যান্য
জার্মান বিজ্ঞানীরা পরমাণু
বোমা বানানোর প্রযুক্তিগত
বাধাগুলিকে অনেক বড়ো ভেবেছিলেন।
তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন যে বোমা
বানানো সম্ভব নয়, সুতরাং
কোনো নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের
সম্মুখীন তাঁদের হতে হয় নি।
এই বিষয়ে ঐতিহাসিকরা একমত
হতে পারেননি। সব পক্ষের সমর্থনেই
অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন;
হয়তো
হাইজেনবার্গের চরিত্রের মতোই
এই ইতিহাসকেও কেবল সাদা কালোতে
লেখা যায় না।
গৌডস্মিটের
চেষ্টাতে হাইজেনবার্গ
ইঙ্গ-মার্কিন
বাহিনির কাছে আত্মসমর্পণ
করেছিলেন। যুদ্ধের পর তিনি
মাক্স প্লাঙ্ক ইন্সটিটিউটের
অধিকর্তা হন,
যুদ্ধবিধ্বস্ত
জার্মানিতে বিজ্ঞানচর্চা
আবার শুরু হওয়ার পিছনে তিনি
মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।
১৯৭৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তাঁর
মৃত্যু হয়।
আরো জানতে হলে
The
Historical Development of Quantum Mechanics- Jagdish Mehra and
Helmut Rechenberg, Springer, Vol 1 Parts 1 & 2, Vol 3 (1982);
Vol 5 Part 2 (1987)
The
Second Creation, Robert P. Crease and Charles P. Mann, Macmillan
Publishing Company, 1986
ঈশ্বরের
পাশা,
গৌতম
গঙ্গোপাধ্যায়,
জয়ঢাক,
২০২২
Physics
and Beyond. Werner Heisenberg, Translated from the German by Arnold
J. Pomerans, George Allen and Unwin, 1971
Helgoland,
Carlo Rovelli, Translated from the German by Erica Segre and Simon
Carnell, Allen Lane, 2020
The
Bohr: No More Uncertainty, William Sweet, Bulletin of the Atomic
Scientists, p 20, May/June 2002
প্রকাশঃ প্রতিবেশ পত্রিকা, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪