ভালোলাগা বই: The sky is for everyone: Women astronomers in their own words
Edited by Virginia Trimble and David A. Weintraub, Princeton University Press, 2022
অন্যান্য অনেক সামাজিক ক্ষেত্রের মতোই বিজ্ঞান বহুদিন পর্যন্ত পুরুষদের একচেটিয়া অধিকারেই ছিল। বিশেষ করে আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে তা ছিল আরো বেশি করে সত্য, কারণ একটা ন্যূনতম শিক্ষা ছাড়া তার অঙ্গনে প্রবেশাধিকার মেলে না। ইউরোপে নবজাগরণের পরে ঈশ্বরের পরিবর্তে শিল্প সংস্কৃতির কেন্দ্র অধিকার করল প্রকৃতি ও মানুষ; তার পরেই প্রকৃতি সম্পর্কে ঔৎসুক্য বৃদ্ধি পেল এবং আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা হল। কিন্তু শিক্ষাদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ছিল মূলত চার্চের নিয়ন্ত্রণে, ফলে সেখানে পরিবর্তন এসেছে বাইরের সমাজের থেকে অনেক ধীরগতিতে। তাই নারীদের শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশাধিকার পেতে সময় লেগেছে। আমরা দেখতে পাই যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ব্রিটেনের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে নারীদের স্নাতক স্তরে পড়ার অধিকার দিয়েছে, কারণ তা পুরানো ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে বাঁধা ছিল না। আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম ইউরোপে, কিন্তু দু'একটি সীমিতক্ষেত্র ছাড়া বিংশ শতাব্দীর আগে সেখানেও নারীদের সন্ধান পাওয়া যাবে না, কারণ শিক্ষা ছাড়া বিজ্ঞান গবেষণা সম্ভব নয়।
তবু তার মধ্যেও দু-একটি ব্যতিক্রম পাওয়া যায়, এবং তা বিশেষ করে দেখা যায় জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে। সেখানেও মহিলাদের প্রবেশ ঘটেছে কখনও স্বামী, কখনও ভাই, কখনো বা অন্য কোনো আত্মীয়ের হাত ধরে। লুক্রেশিয়া ছিলেন এক যুগের সেরা জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেলের বোন, মেরি সমারভিল ও লিন্ডসে হাগিন্সকে উৎসাহ দিয়েছিলেন তাঁদের স্বামীরা। তাঁদের গবেষোণা কখনোই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়নি, তা ছিল নিতান্ত ব্যক্তিগত প্রয়াস। এভাবেই ঊনবিংশ শতাব্দী শেষ হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি তার কারণ হিসাবে যদি একজনকে নির্দেশ করতে হয় তাহলে নিঃসন্দেহে আসবে মেরি কুরির নাম। মেরির পাশেও তাঁর স্বামী ছিলেন, কিন্তু পথপ্রদর্শক বা উৎসাহদাতা নয়, সহকর্মী হিসাবে। তবে মেরির কর্মক্ষেত্র ছিল নিউক্লিয় বিজ্ঞান। জ্যোতির্বিদ্যাতেও নতুন যুগের সূচনা হচ্ছিল, কিন্তু তা সকলের অলক্ষ্যে, যখন জ্যোতির্বিদ্যাতে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হার্ভার্ড মানমন্দিরে একদল নারী কাজ শুরু করেছিলেন। সমকাল তাঁদের বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকার করেনি, কিন্তু উইলামিনা ফ্লেমিং, অ্যানি জাম্প ক্যানন, বা হেনরিয়েটা লেভিটের অবদান জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে সন্দেহ নেই।
জ্যোতির্বিদ্যাতে মহিলাদের অংশগ্রহণের সূচনার ইতিহাস অনেক জায়গায় পাওয়া যাবে। যা পাওয়া যাবে না, তা হল সেই ইতিহাস যাঁরা সৃষ্টি করেছিলেন তাঁদের নিজেদের ভাষায় নিজেদের কথা; সে সময় তা জানার চেষ্টা কেউ করেননি। এখন আর সেই সুযোগ নেই, তাই তাঁদের সংগ্রামকে বাইরে থেকেই দেখে আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আমাদের আলোচ্য বইয়ের সম্পাদকদ্বয় ঠিক করেছেন যে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি তাঁরা হতে দেবেন না। তাই পাঁচ দশকব্যাপী সময়কালের সাঁইত্রিশজন নারী জ্যোতির্বিদদের নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তাঁরা বইতে সংগ্রহ করেছেন। একজন সম্পাদক, ভার্জিনিয়া ট্রিম্বল (পিএইচডি ১৯৬৮), এই ইতিহাসের এক মুখ্য চরিত্রও বটে। বই শুরু হয়েছে অ্যানে পাইন কাউলির স্মৃতিকথা দিয়ে, তিনি ডক্টরেট করেছিলেন ১৯৬৩ সালে। শেষ চরিত্রটি হলে ওয়াইলেন গোমেজ ম্যাকুয়েও চিউ, তাঁর ডক্টরেটের সাল ২০১০। মাঝের এই সাতচল্লিশ বছরের ইতিহাস বাঁধা পড়েছে দুটি সূত্রে। একটিতে আছে জ্যোতির্বিদ্যার অগ্রগতির কাহিনি, অন্যটিতে ধরা পড়েছে সেই বিজ্ঞানের জগতে নারীদের পদসঞ্চারের ইতিহাস; প্রথমটি শুধুই এগিয়ে চলার গল্প, সেখানে দ্বিতীয় সূত্রটির মতো পিছুটান নেই, নেই বারবার এগিয়ে গিয়েও পিছিয়ে পড়ার কথা। তাই এই বই শুধু বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীর কাহিনি নয়, সমাজ ও বিজ্ঞানের আন্তঃসম্পর্কের দলিল।
স্বাভাবিকভাবেই এই সাঁইতিরিশজন বিজ্ঞানীর প্রত্যেকেই সফল, তা না হলে তাঁদের কাহিনি বইতে স্থান পেত না। পরিবারের সমর্থন অবশ্যই তাঁরা পেয়েছিলেন। পড়তে পড়তে প্রশ্ন জাগে, এমন অনেকেই নিশ্চয় ছিলেন বা এখনো আছেন, যাঁরা অনায়াসেই এই বইতে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারতেন, কিন্তু সামাজিক বাধার বা পারিবারিক সমস্যার জন্য গবেষণা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন, অথবা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য নিজেদের কৃতিত্বের স্বীকৃতি পাননি? তাঁদের ইতিহাস কোথাও লেখা থাকবে না।
নারী হিসাবে বিজ্ঞানের জগতকে কেমন লাগে? গ্যাব্রিয়েল গঞ্জালেজ (পিএইচডি ১৯৯৫) লিখেছেন যে এই প্রশ্ন তাঁর কাছে অনেকবার এসেছে। অন্যদের লেখার মধ্যেও নিজেদের মতো করে এই অনুচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়াস আছে। কিংবদন্তী জ্যোতির্বিদ জোসেলিন বেল বার্নেল (পিএইচডি ১৯৬৮) অন্যত্র বলেছিলেন যে কোনো বিষয়ে প্রথম যে নারীরা কাজ শুরু করেন, তাঁদের পুরুষের সমকক্ষ হলেই চলবে না, টিকে থাকতে গেলে তাঁদের পুরুষদের থেকেও এগিয়ে থাকতে হবে। জোসেলিনের মতো প্রথম যুগের বিজ্ঞানীরা পরের যুগের নারীদের কাছে একাধারে রোল মডেল ও মেন্টর। জোসেলিনের মতো নারীদের বিজ্ঞানগবেষণাতে অংশগ্রহণ ষাটের দশকে ছিল ব্যতিক্রম, পঞ্চাশ বছরে পরে তা হয়তো নিয়মে পরিণত হয়েছে। তা সত্ত্বেও আমাদের আলোচ্য বইয়ের অনেক বিজ্ঞানীই ইম্পোস্টার সিন্ড্রোমের শিকার, তাঁদের মনে হয়েছে যে তাঁরা যেন বিজ্ঞান গবেষণাতে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী, এখানে তাঁদের অধিকার নেই। ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে মেরি কুরির নোবেল পুরস্কারের একশো বছর পরেও বিজ্ঞান গবেষণার জগৎ নারীদের আত্মীকৃত করতে পারেনি!
প্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছিলেন এই বিজ্ঞানীরা? পথিকৃৎরা ছিলেন, তারও আগে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল বিদ্যালয়; কিন্তু সেখানেও ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে প্রভেদ ছিল খুবই সাধারণ। প্রায় প্রত্যেকেই সকৃতজ্ঞভাবে পুরুষ সহকর্মী বা শিক্ষকদের সমর্থনের কথা উল্লেখ করেছেন, অথচ সেই পুরুষরাই সমবেতভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সময় নারীদের প্রতি বৈষম্যকে সমর্থন করেছেন! আমরা প্রত্যেকেই বিশেষের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও সেই অনুভবকে সাধারণের উপর প্রতিস্থাপিত করতে কুণ্ঠাবোধ করি কেন, মনস্তত্ত্ববিদরা তার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন। ডারা নর্মান (পিএইচডি ১৯৯৯) সঠিকভাবেই বলেছেন, নিজেদের গবেষণার আহরিত তথ্য যাতে ব্যক্তিগত পক্ষপাতের দ্বারা প্রভাবিত না হয় তার জন্য বিজ্ঞানীরা সর্বদাই সচেষ্ট, কিন্তু সেই চেষ্টা পেশাগত ক্ষেত্রে প্রয়োগের কথা সব সময় তাঁদের মাথায় আসে না।
বিজ্ঞানীদের মধ্যে একমাত্র ক্যারোল মান্ডেল (পিএইচডি ১৯৯৫) রাজনৈতিক সদিচ্ছার উল্লেখ করেছেন। রাজনীতিবিদরা অন্য গ্রহের মানুষ নন, আমাদের সমাজের থেকেই তাঁরা উঠে এসেছেন, সমাজের আশাআকাঙ্ক্ষার তাঁরা প্রতিভূ। সেই অর্থে সেই সদিচ্ছা সমাজেরই প্রতিফলন, এবং স্পশটভাবে না বললেও বইয়ের অনেক লেখাতেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথম যুগের অধিকাংশ নারীবিজ্ঞানীই ছিলেন অবিবাহিত; একই সঙ্গে পেশা এবং সন্তান প্রতিপালন ও সংসার রক্ষার সামাজিক চাহিদাকে মেটাতে তাঁরা সক্ষম হননি। পরের বিজ্ঞানীরা অনেক সময়েই একই পেশার মধ্যেই জীবনের সঙ্গীকে খুঁজে নিয়েছেন। আধুনিক কালে অবশ্য সেই বাঁধাবাধির অবসান ঘটেছে; কিন্তু এখনও সন্তান প্রতিপালনকে মুখ্য স্থান তাঁদের দিতে হচ্ছে। তার পিছনে জৈবিক কারণ অবশ্যই আছে, কিন্তু সমাজের চাপও উপেক্ষণীয় নয়। এই 'টু বডি প্রবলেম'-এর সঠিক সমাধানের অভাবে আমরা কত প্রতিভাকে হারাচ্ছি, তার হিসাব নেই।
আরো একটা সাধারণ সূত্র বইতে লক্ষণীয়, সম্ভবত লিঙ্গগত সংখ্যালঘু অংশ থেকে আসার ফলেই জাতিগত বর্ণগত বা ধর্মীয় সংখযালঘুদের প্রতি নারী বিজ্ঞানীদের সহানুভূতিও নানা ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় প্যাট্রিসিয়া হুইটলক (পিএইচডি ১৯৭৬)-এর কথা, যিনি বিদেশী হয়েও দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য দূর করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন, এবং যাতে সেই বৈষম্য দূর করার ভোটে অংশ নিতে পারেন, সেজন্য সেদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
বাস্তব কারণেই সাঁইত্রিশ জন বিজ্ঞানীর অধিকাংশই ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মানুষ। প্রায় সকলেই সেখানে পড়াশোনা করেছেন। দুইজন ভারতীয় বিজ্ঞানী স্থান পেয়েছেন, এবং তাঁদের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রিয়ম্বদা নটরাজন (পিএইচডি ১৯৯৯)-এর জন্ম এক মধ্যবিত্ত পরিবারে, বাবা মা দুজনেই শিক্ষাজগতের মানুষ। প্রিয়ম্বদার নিজের ভাষায়, ভাররবর্ষের অসম সমাজব্যবস্থাতে তিনি ‘birth lottery’ জিতেছিলেন। চেন্নাইয়ের বাসিন্দা হলেও স্কুল করেছেন দিল্লিতে, সেই সময়েই তাঁর বাড়িতে তাঁর জন্য ছিল পার্সোনাল কম্পিউটার। কলেজে পড়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ডক্টরেট করেছেন কেমব্রিজে। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীরা তাঁকে গাইড করেছেন। পুনম চন্দা (পিএইচডি ২০০৫) -র জন্ম উত্তরভারতের এক ছোট শহরে যেখানে লিঙ্গবৈষম্য ছিল ঘরেবাইরে প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ। মেয়েদের জীবনের ছিল দুটি ভাগ, বিয়ের আগে ও পরে, এবং প্রথম ভাগের বছরগুলি শুধুমাত্র বিয়ের প্রস্তুতি হিসাবেই ব্যবহার করা হত। বিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ করার জন্য পরিবারের ইচ্ছাকে অমান্য করতে হয়েছিল, পুনমের কাছে সে ছিল প্রথম সাহসী ঘোষণা। এমনকি তাঁর কলেজের শিক্ষিকাও তাঁকে গবেষণাতে যেতে বারণ করেছিলেন, কারণ বিয়েতে দেরি হলে তাঁর ভালো স্বামী জোটার সম্ভাবনা কমে যাবে। দেশের প্রথম শ্রেণির গবেষণা প্রতিষ্ঠানে তিনি নিজের যোগ্যতায় স্থান করে নিয়েছেন, কিন্তু সেই যোগ্যতা দেখানোর সুযোগ পাওয়ার জন্য তাঁকে ঘরেবাইরে সংগ্রাম করতে হয়েছে।
বইয়ের শেষ বিজ্ঞানী ওয়াইলেন গোমেজ ম্যাকুয়েও চিউ নানাভাবে 'বহিরাগত'। তিনি আমাদের মতোই তৃতীয় বিশ্বের এক দেশ মেক্সিকোর নাগরিক, সেখানে গবেষণার সুযোগ আমাদের দেশের থেকেও কম। সেই হিসাবে তিনি বিজ্ঞান জগতের কেন্দ্রে বহিরাগত। তিনি মহিলা, এবং জন্মসুত্রে চিনা, অর্থাৎ দু'ভাবে সমাজে বহিরাগত। পড়াশোনার জন্য ফ্রান্সে গিয়ে তিনি এক কালচারাল শক-এর মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি আবার নিজের দেশে ফিরে গেছেন, কিন্তু তাঁর নিজের কথায়, সেই ফিরে যাওয়াটাও কম 'শক' ছিল না।
বিজ্ঞানের কথা এই বইতে আছে। কখনোই তা খুব জটিল নয়, সাধারণ যে কোনো মানুষ সামান্য চেষ্টাতেই তার রসাস্বাদন করতে পারবেন। কিন্তু তা এই বইয়ের প্রাণ নয়, তা লুকিয়ে আছে ওই সাঁইত্রিশজনের জীবন সংগ্রাম ও অনুভূতির মধ্যে। এই ধরনের বই কেন আরো বেশি দরকার, তার কারণ বইয়ের সূচনাতে মাও সে তুঙের উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্ট, “Women hold up half the sky”।
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, মার্চ ২০২৪
No comments:
Post a Comment