Sunday 21 April 2024

পিটার হিগস (২৯ মে, ১৯২৯ - ৮ এপ্রিল, ২০২৪)

  

পিটার হিগস (২৯ মে, ১৯২৯ - ৮ এপ্রিল, ২০২৪) 


গত ৮ এপ্রিল প্রয়াত হলেন ২০১৩ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পিটার হিগস। তাঁর জন্ম হয় ইংল্যান্ডে ১৯২৯ সালের ২৯ মে। তাঁর পড়াশোনা ব্রিস্টলে, সেই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন কিংবদন্তী পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক। ডিরাকের বিভিন্ন কৃতিত্বের কথা শুনে তাঁর পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহ জন্মায়। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে তিনি পদার্থবিদ্যাতে বিএসসি, এমএসসি ও গবেষণা করে ডক্টরেট করেন। ১৯৬০ সাল থেকে তিনি এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন, ১৯৯৬ সালে অবসর নেওয়ার পরে তাঁকে সেই প্রতিষ্ঠানেই এমিরিটাস অধ্যাপক করা হয়। ২০১২ সালে সার্নের লার্জ হ্যাড্রনিক কোলাইডারে যে বোসন কণাটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, তার প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৬৪ সালে হিগস তার কথা প্রথম বলেছিলেন। সেই অত্যন্ত মৌলিক গবেষণার স্বীকৃতিতেই হিগসকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।

হিগসের গবেষণার তাৎপর্য অল্প কথায় বলা কঠিন। সংক্ষেপে বলা যায়, মৌলিক কণাদের জন্য আমাদের এখনো পর্যন্ত সব সেরা তত্ত্বের নাম হল স্ট্যান্ডার্ড মডেল। মহাবিশ্বে বল চার প্রকার, মাধ্যাকর্ষণ, তড়িৎচৌম্বক বল, পীন বা সবল বল এবং ক্ষীণ বা দুর্বল বল। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের মধ্যে প্রথমটিকে স্থান দেওয়া সম্ভব হয়নি, কিন্তু বাকি তিনটি বলের সাহায্যে মৌলিক কণারা কেমনভাবে নিজেদের মধ্যে ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া করে, তার ব্যাখ্যা স্ট্যান্ডার্ড মডেল থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু, এই মডেলের এক সমস্যা ছিল যে একমাত্র ভরশূন্য মৌলিক কণাদের জন্যই সে কাজ করে। কিন্তু ইলেকট্রন, মিউয়ন, বিভিন্ন কোয়ার্ক বা অন্য সমস্ত ভরযুক্ত মৌলিক কণাদের এই মডেলে জায়গা হবে কেমন করে?

এই সমস্যার সমাধানে প্রায় একই সময়ে কয়েক দল বিজ্ঞানী আলাদা আলাদা ভাবে প্রস্তাব করেন যে মৌলিক কণাগুলি আসলে ভরহীন, কিন্তু মহাবিশ্বে এমন এক বিশেষ ফিল্ড বা ক্ষেত্র আছে যার সঙ্গে ক্রিয়ার মাধ্যমে তারা বল পায়। এই ক্ষেত্রের নাম আমরা পরে দিয়েছি হিগস ক্ষেত্র। তার সঙ্গে যে কণার ক্রিয়ার পরিমাণ যত বেশি, তার ভর তত বেশি। বিজ্ঞানী মহলে একটা সুপরিচিত উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করা যাক। একটি ঘরের দুপাশে দুটি দরজা আছে; ঘরে বেশ কিছু লোক ইতস্তত ঘোরাফেরা করছেন। একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ যদি এক দরজা দিয়ে ঢুকে অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান, তাঁর বিশেষ সময় লাগবে না, কারণ তাঁর সঙ্গে কারোরই কথা হবে না। কিন্তু যদি এমন একজন ঢোকেন যাঁর কয়েকজনের সঙ্গে পরিচিতি আছে, স্বাভাবিকভাবেই তিনি দাঁড়িয়ে পড়ে বা গতি কমিয়ে অন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন, ফলে তাঁর ঘর পেরোতে সময় লাগবে। আর যদি প্রবেশকারী কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি হন, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে, সেলফি তুলতে, অটোগ্রাফ নিতে হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে; ফলে তাঁর অনেকটাই বেশি সময় লাগবে। আমাদের উপমাতে ঘরের মধ্যের মানুষজন হলেন হিগস ক্ষেত্র এবং প্রবেশকারী হলেন মৌলিক কণা; ক্ষেত্রের সঙ্গে ক্রিয়ার মাধ্যমে কণার ভরের সৃষ্টি হচ্ছে। ভরশূন্য কণা আলোর গতিতে চলাফেরা করে, ভর বৃদ্ধি পেলে তার বেগ কমে যায়। ক্রিয়া যত বেশি, ভরও তত বেশি।

প্রায় একই সময়ে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রাঁসোয়া আংলেয়ার ও রবার্ট ব্রাউট, এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটার হিগস, এবং লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের জেরাল্ড গুরালনিক, রিচার্ড হ্যাগেন, ও টমাস কিবল প্রায় একই ধরনের প্রস্তাব করেন। হিগস একটি অতিরিক্ত কথা বলেছিলেন। এই তত্ত্বকে প্রমাণ করব কেমন করে, বিজ্ঞান প্রমাণ ছাড়া কিছু মানে না। মহাবিশ্বের সর্বত্রই এই ক্ষেত্র অবস্থান করে, কাজেই আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয় সত্যিই ক্ষেত্রের বাইরে গেলে কণাদের ভর শূ্ন্য হয়ে যায় কিনা। হিগস বলেছিলেন যে এই ক্ষেত্রকে কখনো কখনো একটা কণার আকারে দেখা যাবে। আগের উপমাতে ফিরে যাই, ধরা যাক ঘরে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন, সেই কথা শুনতে অনেকে ভিড় করবে। আবার শ্রোতাদের মধ্যে একজন অন্য একজনকে বলতে গেলেন, আরো কয়েকজন শুনতে এলেন, তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালালেন। এভাবে একটা জটলা ঘরের এক পাশ থেকে অন্য পাশে চলে গেল। হিগস বোসন হিগস ক্ষেত্রের সেইরকম এক উত্তেজনা, একে আমাদের যন্ত্রে খুঁজে পাওয়া গেলে প্রমাণ হবে যে বিজ্ঞানীদের ধারণা ঠিক। এই কণাটি বোসন, কারণ এ সত্যেন্দ্রনাথ আবিষ্কৃত বোস পরিসংখ্যান মেনে চলে।

হিগস কণাকে যন্ত্রে তৈরি করা মোটেই সহজ নয়, কারণ এর ভর খুব বেশি। আধুনিক গবেষণাগারে কণাত্বরক দিয়ে উচ্চশক্তিতে দুটি কণার সংঘর্ষ ঘটিয়ে নতুন কণা সৃষ্টি করা হয়। আমরা আইনস্টাইনের ভর ও শক্তির সমতুল্যতা সূত্র জানি, সুতরাং বেশি ভরের কণা সৃষ্টি করতে হলে সংঘর্ষের শক্তি অবশ্য বেশি হতে হবে। যে কণাত্বরক যত বড়, তা দিয়ে তত উচ্চশক্তির সংঘর্ষ ঘটানো সম্ভব। অবশ্য হিগস কণার ভর কত তা স্ট্যান্ডার্ড মডেল থেকে জানা যায় না, তবে ভর কম হলে আমাদের ছোটখাটো কণাত্বরকে তাকে আগেই খুঁজে পাওয়া যেত। পৃথিবীর সব থেকে বড় কণাত্বরক, লার্জ হ্যাড্রনিক কোলাইডার, যার রিংটার পরিধি হল সাতাশ কিলোমিটার, তা দিয়েই শেষ পর্যন্ত হিগস বোসনকে খুঁজে পাওয়া গেল; দেখা গেল তার ভর প্রোটনের ভরের মোটামুটি একশো তেত্রিশগুণ। হিগস বোসন খুবই স্বল্পস্থায়ী, সৃষ্টির পরেপরেই তা ভেঙে অন্য অনেক কণা সৃষ্টি হয়। সেই সমস্ত কণা আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়ে, তার থেকে বোঝা গেল যে সত্যিই হিগস কণা তৈরি হয়েছিল। এই গবেষণাতে ভারত সহ অনেক দেশের বিজ্ঞানীরা যুক্ত ছিলেন। হিগস বোসনের সন্ধান পাওয়ার পরের বছরেই হিগস ও ফ্রাঁসোয়া আংলেয়ারকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল। তার আগেই অবশ্য হিগস পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় সমস্ত পরিচিত পুরস্কারই পেয়েছেন, তাদের মধ্যে আছে হিউজেস পদক, রাদারফোর্ড পদক, উল্‌ফ পুরস্কার, ডিরাক পদক, সাকুরাই পদক, অস্কার ক্লাইন সম্মান, ইত্যাদি। নোবেল পুরস্কারের পরে পাওয়া সম্মানের মধ্যে আছে পৃথিবীর প্রাচীনতম পুরস্কার, রয়্যাল সোসাইটির কপলি পদক।

তাঁর গবেষণা এত স্বীকৃতি পেলেও ব্যক্তি হিগস কিন্তু অনেক দিক থেকেই বর্তমান বিজ্ঞানীমহলের অধিকাংশের থেকে আলাদা। 'পাবলিশ অর পেরিশ'-এর যুগেও প্রবন্ধ ছাপার ইঁদুর দৌড়ে তিনি কখনোই নাম লেখান নি। ১৯৬৪ সালের পরে তাঁর মোট প্রকাশিত বিজ্ঞানপ্রবন্ধের সংখ্যা দুই অঙ্কে পোঁঁছায়নি। তিনি নিজেই বলেছিলেন আধুনিক কালে তিনি চাকরিই পেতেন না। এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর চাকরি যায়নি তার একমাত্র কারণ ছিল যে ১৯৮০ সালেই তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রস্তাবিত হয়েছিল, কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল যে হয়তো তিনি একদিন পুরস্কার পাবেন। হিগসের নিজের কথায়, 'না পেলে যে কোনো সময় ছাঁটাই করা যাবে।'

অন্য অনেক বিজ্ঞানীর মতো হিগস গজদন্তমিনারে বাস করতেন না, বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগ ছিল। নিজের মত স্পষ্ট করে জানাতে তিনি ভয় পেতেন না। উনিশশো ষাট ও সত্তরের দশকে এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ছাত্র আন্দোলন বিরোধী আচরণের এবং বর্ণবিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকার কোম্পানিদের সঙ্গে এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগের সমালোচনা করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। নিউক্লিয় অস্ত্র বিরোধী আন্দোলন সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার ডিসআর্মামেন্টের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন, কিন্তু তা যখন নিউক্লিয় বিদ্যুতেরও বিরোধিতা করে, তখন তিনি তার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তেমনি পরিবেশবাদী গ্রিনপিস সংগঠনের সদস্য হইয়েছিলেন, কিন্তু সেই সংগঠন যখন জিন প্রযুক্তির বিরোধিতা শুরু করে, তখন তিনি সদস্যপদ ত্যাগ করেন। প্যালেস্টাইনের প্রতি ইজরায়েলের মনোভাবের প্রতিবাদে তিনি জেরুজালেমে দিয়ে উলফ পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার এই সম্মান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। ২০১২ সালে অবশ্য তিনি অনুরূপ এক সম্মান গ্রহণ করেছিলেন, কারণ তাঁকে ভুল বোঝানো হয়েছিল যে ব্রিটেনের রাণীই সেই সম্মান দেন, তার সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। হিগস ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না, তাঁর প্রস্তাবিত কণাটি গড পার্টিকল বা ঈশ্বরকণা নামে পরিচিত হওয়াতে তিনি খুব বিরক্ত হয়েছিলেন।

হিগস লোকচক্ষুর অন্তরালে কাজ করাই পছন্দ করতেন, তিনি মোবাইল ফোন, ইমেল বা ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন না। ঘটনাচক্রে কণাটির সঙ্গে একমাত্র তাঁর নাম যুক্ত হওয়াটাকে তিনি পছন্দ করতেন না, তিনি নিজে তার পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। সার্নের আবিষ্কারের পরে প্রচারমাধ্যম তাঁকে নিয়ে যে মাতামাতি শুরু করেছিল, তা তাঁর নিতান্তই অপছন্দ ছিল। ২০১৩ সালের নোবেল পুরস্কারের তালিকাতে তাঁর নাম থাকবে বলে সকলেই অনুমান করেছিলেন। সংবাদমাধ্যমকে এড়াতে তিনি পুরস্কার ঘোষণার দিন আগেভাগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। কয়েকঘণ্টা এডিনবার শহরে ঘোরাঘুরির পরে তিনি যখন বাড়ি ফিরছেন, তখন পরে এক প্রতিবেশী তাঁকে খবরটা দেয়। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে তিনি আশা করেননি যে তাঁর জীবৎকালে কণাটি খুঁজে পাওয়া যাবে। তাই সার্নের আবিষ্কারের খবর পেয়ে প্রথমে তাই তাঁর ভালো লেগেছিল, কিন্তু তার পরেই মনে হয়েছিল যে তাঁর শান্তিপূর্ণ জীবন শেষ হতে চলেছে। কিছুটা মজা করেই হয়তো বলেছিলেন, ওই একটি কণা তাঁর জীবনকে ধ্বংস করে দিল। তাঁর আবিষ্কারকে ঘিরে এত উত্তেজনা তিনি নিজে অপছন্দ করতেই পারেন, কিন্তু সন্দেহ নেই যে হিগস ও অন্যান্যরা বিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছেন।


                                                                                          গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় 

প্রকাশ সংবাদ প্রতিদিন,  ২০২৪

1 comment:

  1. খুব ভালো লাগলো আপনার লেখা। হিগস কণার ধারণা এত প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় উপস্থাপন করার জন্য। লেখার অক্ষরের হরফ খুব ভালো লেগেছে।

    ReplyDelete