পিটার হিগস (১৯২৯-২০২৪)
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
দিনটা ছিল ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর। চুরাশি বছরের পিটার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন ঘোষণা হতে আধ ঘণ্টা বাকি আছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। এডিনবার বন্দর তাঁর বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়, কিছুক্ষণ সেখানে হাঁটাহাঁটি করার পরে সমুদ্রের ধারে এক পাবে বসেই দুপুরের খাবার সারলেন। তারপরে ঢুকলেন এক শিল্প প্রদর্শনীতে। ঘণ্টা চারেক পরে যখন বাড়ি ফিরছেন, এক প্রতিবেশী তাঁকে দেখতে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে নেমে এলেন। 'প্রফেসর হিগস, অভিনন্দন। আমার মেয়ে লন্ডন থেকে ফোন করে আপনার পুরস্কারের খবরটা দিয়েছে।'
'কী পুরস্কার?’ পিটার অবশ্য জানতেন কোন পুরস্কার সেদিন ঘোষণা হবে। এও জানতেন যে সেই বছর তাঁর নামই পুরস্কারের তালিকায় থাকার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি। তাই সহকর্মী, সংবাদমাধ্যম, বন্ধু, আত্মীয় সকলের ফোন এড়ানোর জন্যই তিনি বাড়ি ছেড়েছিলেন। মোবাইল ফোন তিনি ব্যবহার করেন না, তাই সুইডিশ অ্যাকাডেমি পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করার পরে অন্যতম প্রাপক পিটার হিগসের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারেনি। বাড়ি ফিরে গিয়ে তিনি ফোনের রেকর্ড করা মেসেজগুলো শুনে নিলেন।
এই ছিলেন পিটার হিগস; কখনোই নিজেকে সামনে আনতে চাইতেন না। তার আগের বছর যখন সার্নে সাংবাদিক সম্মেলন করে হিগস বোসন কণার আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করা হয়, হিগস সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকরা তাঁকে ঘিরে ধরতে তিনি শুধু বলেছিলেন সেই দিনটা এই সমস্ত বিজ্ঞানীর যাঁরা কয়েক বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে কণাটির সন্ধান পেয়েছেন। সেদিন তিনি কিছু বলবেন না।
নিজেকে আড়াল করার এই অভ্যাস কিন্তু কোনোভাবেই দুর্বলতা নয়। এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ষাট ও সত্তরের দশকে উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের সংগঠকদের উপরে শাস্তি নামিয়ে আনতে চেয়েছে, বিরোধিতা করেছেন পিটার হিগস। বিশ্ববিদ্যালয় বর্ণবিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকার কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে, প্রতিবাদ করেছেন পিটার হিগস। বিজ্ঞানের বিষয়েও কোনো আপোস করেন নি। পরমাণু অস্ত্র বিরোধী সংগঠনের সদস্য হয়েছেন, আবার সেই সংগঠন যখন পরমাণু শক্তির বিরোধিতা করেছে, তার সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। পরিবেশবাদী সংস্থা গ্রিনপিসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, কিন্তু যখন তিনি মনে করলেন যে জিন প্রযুক্তির বিরোধিতা করে গ্রিনপিস বিজ্ঞানবিরোধী কাজ করছে, তার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।
আজ থেকে ষাট বছর আগে ১৯৬৪ সালে পিটার হিগস কণা পদার্থবিদ্যার এক প্রধান সমস্যার সমাধানের পথ দেখিয়েছিলেন। শুধু তিনি নন, প্রায় একই সময়ে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রাঁসোয়া আংলেয়ার ও রবার্ট ব্রাউট, এবং লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের জেরাল্ড গুরালনিক, রিচার্ড হ্যাগেন, ও টমাস কিবল প্রায় একই ধরনের প্রস্তাব করেন। সমস্যাটা ছিল এই যে কনা পদার্থবিদ্যার প্রধান ভরসা যে স্ট্যান্ডার্ড মডেল, যা সুন্দভাবে সেই বিজ্ঞানের সমস্ত কিছুকে ব্যাখ্যা করতে পারে, সেখানে ভরযুক্ত কণাকে স্থান দেওয়া যাচ্ছে না। অদ্ভুত এক পরিস্থিতি, যেখানে ইলেকট্রনের মতো কণার ভর আছে আমরা জানি, কিন্তু অঙ্কের উত্তর মেলাতে গেলে তাকে শূন্য ধরতে হবে। তিন দল বিজ্ঞানীই একই কথা বললেন, বললেন কণাগুলি আসলে ভরশূন্যই, মহাবিশ্বব্যাপী এক বিশেষ ক্ষেত্রের সঙ্গে ক্রিয়া করেই তারা ভর পায়। কিন্তু প্রমাণ কী? এমন তো কোনো জায়গা নেই সেখানে ঐ বিশেষ ক্ষেত্রটি নেই, কাজেই কণাকে ভরশূন্য করা যাবে না। হিগস বলেছিলেন, এই ক্ষেত্রকে কখনো কখনো একটা কণার আকারে দেখা যাবে। ওই বিশেষ ক্ষেত্রটির নাম দেওয়া হয়েছিল হিগস ক্ষেত্র, আর কণাটির নাম হিগস বোসন। বোসন, কারণ তা সত্যেন্দ্রনাথ বসু আবিষ্কৃত বোস সংখ্যায়ন মেনে চলে। প্রসঙ্গত, এই বছর বোস সংখ্যায়ন আবিষ্কারের শতবর্ষ।
পরের প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা হিগস কণার সন্ধান চালিয়েছিলেন। কণাটার ভর নিশ্চয় খুব বেশি, তাই আইনস্টাইনের সূত্র অনুযায়ী তাকে দেখতে অনেকটা শক্তিকে একজায়গায় আনতে হবে। অবশেষে সার্নের সাতাশ কিলোমিটার পরিধির কণাত্বরক লার্জ হ্যাড্রনিক কলাইডারে ধরা পরেছিল সেই কণা। প্রায় ছ'হাজার বিজ্ঞানীর সেই দলে অনেক ভারতীয়ও ছিলেন, ছিলেন আমাদের কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর গবেষকরা। তার পরের বছর হিগস ও আংলেয়ারকে মৌলিক কণার ভরের উদ্ভব সংক্রান্ত আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। আগে থেকেই অনুমান করে পুরস্কার ঘোষণার দিন শহর ছেড়ে পাহাড়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন হিগস, কিন্তু সেই পরিকল্পনা শেষ মুহূর্তে বাতিল করতে হয়। অগত্যা বাড়ি ছেড়ে সমুদ্রতীরের পাবে অবস্থান।
অন্তর্মুখী হিগস নিজের নামে কণার নামকরণে খুশি হননি, তিনি অন্য নাম প্রস্তাব করেছিলেন। নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী লিওন লেডারম্যান তাঁর বেস্ট সেলার বইতে হিগস কণার নাম দিয়েছিলেন গড পার্টিকল অর্থাৎ ঈশ্বরকণা। নাস্তিক হিগসের সেই নামও বিশেষ অপছন্দের ছিল। আত্মপ্রচারবিমুখ হিগস ছিলেন আজকের বিজ্ঞান দুনিয়াতে ব্যতিক্রম। যখন প্রতিমুহূর্তেই বিজ্ঞানীরা প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য ব্যাস্ত, গুণমানের পরিবর্তে সংখ্যাই যখন মূল কথা, তখন সেই বিখ্যাত কাজটির পরে সারা জীবনে তিনি দশটি প্রবন্ধও লেখেননি। তিনি নিজেই বলেছিলেন যে এই যুগে তিনি চাকরিই পেতেন না; এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ছাঁটাই করেনি তার একমাত্র কারণ ১৯৮০ সালেই তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রস্তাবিত হয়েছিল।
হিগসের জন্ম হয় ইংল্যান্ডে ১৯২৯ সালের ২৯ মে। তাঁর স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন কিংবদন্তী পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক। ডিরাকের বিভিন্ন কৃতিত্বের কথা শুনে হিগসের পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহ জন্মায়। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে তিনি পদার্থবিদ্যাতে বিএসসি, এমএসসি ও ডক্টরেট করেন। ১৯৬০ সালে তিনি এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন, ১৯৯৬ সালে অবসর নেওয়ার পরে তিনি হয়েছিলেন সেই প্রতিষ্ঠানের এমিরিটাস অধ্যাপক। অবশেষে ৯৪ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে তাঁর প্রয়াণ ঘটল।
সৃষ্টির একুশশতক-এ পাঠিয়েছি
No comments:
Post a Comment