ইতিহাসে গ্রহণ
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
গ্রহণ কেন হয় এখন সকলেই জানেন। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের তারিখ, সময় ও কোথা থেকে তা দেখা গিয়েছিল তা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে জানা সম্ভব হয়েছে। এই লেখাতে আমরা দেখব গ্রহণের সম্পর্কে আধুনিক হিসাব থেকে আমরা কেমন করে ইতিহাসের সাল তারিখ নির্ণয় করতে পারি। প্রাচীন যুগের ইতিহাস কাব্য ইত্যাদিতে যে সমস্ত সন তারিখ ব্যবহার করা হত, তাদের সঙ্গে প্রায়শই আমাদের আধুনিক হিসাবের কোন মিল থাকে না; অনেক সময় রাজা পরিবর্তন হলে নতুন ক্যালেন্ডার শুরু হত, বা পাশাপাশি দুই জায়গায় সম্পূর্ণ আলাদা পদ্ধতি অনুসরণ করা হত। এই সমস্ত কারণে নানা ঘটনা ঠিক কবে ঘটেছিল তা জানা বেশ দুরূহ। প্রায় সব প্রাচীন সমাজই গ্রহণকে অমঙ্গলের চিহ্ন হিসাবে দেখত বা ভয় পেত। তাই সেযুগের মানুষ অনেক নথিপত্র সাহিত্য ইত্যাদিতে এই 'ভয়ঙ্কর' ঘটনার বিবরণ লিখে রাখত। সেই সমস্ত বিবরণ থেকে আধুনিক বিজ্ঞান সেগুলি কবে হয়েছিল তা বার করার চেষ্টা করেছে। তার সঙ্গে পুরানো যুগের তারিখের হিসাব মিলিয়ে আমরা প্রাচীন আর আধুনিক ক্যালেন্ডারকে এক জায়গায় আনতে পারি। ইতিহাসের গ্রহণ বিজ্ঞানেরও কাজে লাগে; সে কথাও আমরা সংক্ষেপে শুনব।
মূল
বিষয়ে যাওয়ার আগে খুব সংক্ষেপে
গ্রহণ সম্পর্কে কয়েকটা কথা
বলে নিই। আমরা জানি যে প্রতি
অমাবস্যাতে সূর্যগ্রহণ বা
প্রতি পূর্ণিমাতে চন্দ্রগ্রহণ
হয় না,
কারণ
চাঁদের পৃথিবীকে পরিক্রমণের
কক্ষতল ও পৃথিবীর সূর্যকে
পরিক্রমণের কক্ষতল পরস্পরের
মধ্যে ৫.১৪
ডিগ্রি কোণ
করে থাকে। চাঁদের পথ যে দুই
বিন্দুতে পৃথিবীর পরিক্রমণ
তলকে ছেদ করে সেই দুটিকে বলা
হয় নোড বা চন্দ্রপাত। আমাদের
দেশে আর্যভাট যখন গ্রহণের
সঠিক কারণ নির্ণয় করেন তখন
তিনি প্রাচীন পুরাণ অনুসরণ
করে এই দুই বিন্দুর নাম দিয়েছিলেন
রাহু ও কেতু। চাঁদ যখন এই দুটি
নোডের কাছাকাছি থাকে,
তখন
গ্রহণ হওয়া সম্ভব।
বিশেষ করে সূর্যগ্রহণ ইতিহাসের কাল নির্ণয়ে অনেক কাজে লাগে কারণ চাঁদের ছায়া খুব ছোট বলে সূর্যগ্রহণ, বিশেষ করে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ খুব কম পরিসর স্থানের মধ্যে হয়। তাই কোনো স্থানে পরপর দুটি সূর্যগ্রহণের মধ্যে ৩৭০ বছরের কাছাকাছি পার্থক্য থাকে। সেই জন্য কোনো জায়গায় সূর্যগ্রহণের বর্ণনা পেলে সেই গ্রহণের তারিখ সম্পর্কে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায়। চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়ে, ফলে পৃথিবীর যে অংশে রাত সেখান থেকেই চন্দ্রগ্রহণ দৃশ্যমান হয়। তাই যে কোনো জায়গায় থেকে পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ অনেক ঘনঘন হয়। কোনো ঘটনা বারবার ঘটলে তার থেকে বিশেষ একটাকে আলাদা করা শক্ত; তা সত্ত্বেও চন্দ্রগ্রহণকে ইতিহাসের কালনির্ণয়ে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে, তা হল পৃথিবী ও চাঁদের কক্ষপথ বৃত্তাকার নয়, উপবৃত্তাকার। ফলে চাঁদ সূর্য ও পৃথিবীর আপেক্ষিক অবস্থান পাল্টে গেলে পৃথিবী বা চাঁদের ছায়ার আকার ছোট বড় হয়। তার উপর গ্রহণের স্থায়িত্বকাল ও কোন জায়গা থেকে সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে নির্ভর করে। তেমনি গ্রহণের প্রকৃতিও এই আপেক্ষিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে; যেমন সূর্যগ্রহণের সময় চাঁদ যদি পৃথিবী থেকে অনেকটা দূরে থাকে, তাহলে তার পক্ষে পুরো সূর্যকে ঢাকা সম্ভব হয় না, তখন বলয়গ্রাস হয়। তাই প্রাচীন ইতিহাস, কাব্য, পুরাণ বা অন্য কোনো সূত্রে যদি গ্রহণের বর্ণনা থাকে, তাহলে তার সঙ্গে মিলিয়ে সেই ঘটনা ঠিক কবে ঘটেছিল তা নির্ণয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিজ্ঞানের যে শাখা এভাবে জ্যোতির্বিদ্যা ও ইতিহাসের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করে তাকে বলে প্রত্নজ্যোতির্বিদ্যা।
এখানে আরো একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, তা হল পৃথিবীর ঘূর্ণনকাল চিরকাল একই রকম নয়। পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য আস্তে আস্তে বাড়ছে, তার জন্য দায়ী চাঁদের টান। পৃথিবী নিজের চারদিকে তেইশ ঘণ্টা ছাপ্পান্ন মিনিটে একবার পাক খায়, একে বলে নাক্ষত্র দিন। চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে একবার ঘুরে আসতে সময় নেয় সাতাশ দিন সাত ঘণ্টার মতো। এটা কিন্তু দুটো পূর্ণিমা বা দুটো অমাবস্যার মধ্যের পার্থক্য নয়, সেটা সাড়ে উনত্রিশ দিন। এ হল চাঁদের নাক্ষত্র মাস। দেখা যাচ্ছে চাঁদ অনেক আস্তে ঘোরে; ফলে পৃথিবীর মহাসমুদ্রের যে জলরাশি পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে এগিয়ে যেতে চায়, চাঁদ তাকে পিছন থেকে টেনে ধরে। এর জন্য জলরাশি ও সমুদ্রতলের মধ্যে ঘর্ষণ হয় ও পৃথিবীর নিজের অক্ষের চারপাশে ঘূর্ণন বেগ কমে যায়। একশো কোটি বছর আগে পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য ছিল আঠারো ঘণ্টার মতো। কুড়ি কোটি বছরে পরে তা বেড়ে হবে পঁচিশ ঘণ্টা। গত কয়েক হাজার বছরে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির এই পরিবর্তনকেও হিসাবে না আনলে কোনোভাবেই গ্রহণের সময় মেলানো যায় না। পৃথিবীর আবর্তন ও পরিক্রমণ এবং চাঁদের পথ মিলে এমন হয় যে কোনো জায়গায় সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ ঘটলে তার মোটামুটি ৫৪ বছর (বিয়াল্লিশটি সাধারণ বছর ও বারোটি অধিবর্ষ) ৩৪ দিন পরে আবার একই রকম গ্রহণ হয়। প্রাচীন সুমের সভ্যতা এই সময়কাল আবিষ্কার করেছিল। প্রাচীন যুগে অবশ্য গ্রহণের কারণ প্রথমে জানা ছিল না। তবে দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণের পরে সুমের সভ্যতার পুরোহিত বা জ্যোতির্বিদরা এই সময়ের অন্তরের বিষয়টা জানতে পেরেছিলেন।
গ্রহণের সব থেকে প্রাচীন সম্ভাব্য রেকর্ড আবিষ্কার হয়েছে আয়ারল্যান্ডের লখ ক্রিউ নামের এক জায়গায়। সেখানে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের কথা পাথরের খোদাই করে ছবির আকারে লিখে রাখা হত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তা থেকে ৩৩৪০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর হওয়া এক সূর্যগ্রহণের কথা জানা যাচ্ছে। কাছেই পাওয়া গেছে প্রায় পঞ্চাশটি পুড়িয়ে মারা মানুষের দেহাবশেষ, সম্ভবত গ্রহণের সময় দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য এদের বলি দেওয়া হয়েছিল। প্রাচীন চিনে মনে করা হত গ্রহণের সময় এক ড্রাগন সূর্য বা চন্দ্রকে গিলে খায়, তাই তাকে ভয় দেখানোর জন্য আকাশে তীর ছোঁড়া হত এবং ঢাকঢোল বাজিয়ে হৈহল্লা করে তাড়ানোর চেষ্টা করা হত। এ জন্য গ্রহণের খবর বলা ছিল জ্যোতির্বিদদের দায়িত্ব। চিনের প্রাচীন গ্রন্থ সু চিং থেকে জানা যায় একবার সম্রাটের দুই জ্যোতির্বিদ আগে থেকে এক সূর্যগ্রহণের কথা বলতে পারেনি বলে তাদের শিরশ্ছেদ করা হয়। গ্রহণের অনেকদিন পরে এই ঘটনার কথা লেখা হয়েছিল বলে তারিখ নিয়ে মতবিরোধ আছে; অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মনে করেন ২১৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ২২ অক্টোবর এই গ্রহণটি ঘটেছিল। তবে এই সমস্ত ইতিহাস নিয়ে কিছুটা সমস্যা থেকেই যায়। যেমন সিরিয়ায় পাওয়া এক মৃৎফলকে ১২২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ৫ মার্চ এক সূর্যগ্রহণের কথা আছে বলে মনে করা হত, কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণাতে তা আদৌ গ্রহণের বর্ণনা কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রাচীন চিনের জ্যোতির্বিদরা আগে থেকে সূর্যগ্রহণের তারিখ বলতে পারতেন এমন কোনো প্রমাণ নেই, তাই সু চিং-এর কাহিনিটা সত্য কিনা বলা শক্ত। সূর্যগ্রহণের কথা লিখে রাখার প্রাচীনতম নিশ্চিত উদাহরণ অবশ্য চিনের ইতিহাস থেকেই পাওয়া গেছে। সেই গ্রহণটি হয়েছিল ৭০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ১৭ জুলাই।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে গ্রিসের পণ্ডিত থালেস আগে থেকে এক সূর্যগ্রহণের বিষয় ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, সেটা মিলে যাওয়াতে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। কেউ কেউ অবশ্য থালেস গ্রহণের সময়কালের হিসাব জানতেন কিনা তাই নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে অন্যরা বলেন যে থালেস নিজে মিশরে গিয়েছিলেন, এবং সুমের সভ্যতার সঙ্গে মিশর ও গ্রিসের যোগাযোগ ছিল; তাই গল্পটার সত্যতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আধুনিক হিসাবে জানা গেছে সেই সূর্যগ্রহণ ঘটেছিল ৫৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মে মাসের ২৮ তারিখ। তবে থালেস নিসন্দেহে গ্রহণের প্রকৃত কারণ জানতেন না; খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক অ্যানাক্সাগোরাস প্রথম বলেন গ্রহণের কারণ হল চাঁদ ও পৃথিবীর ছায়া।
বিখ্যাত গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস তাঁর বই 'হিস্টরি'-তে তিনবার দিনের বেলা অন্ধকার নেমে আসার কথা লিখেছেন; মনে করা হয় সেগুলি ছিল সুর্যগ্রহণের বর্ণনা। গ্রিস ছিল অনেক নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত, তাদের আলাদা আলাদা ক্যালেন্ডার ছিল; ফলে বিভিন্ন ঘটনার সময়কাল নিয়ে কিছুটা সমস্যা থেকে গেছে। তার সমাধানের জন্য হেরোডোটাসের ব্যবহার করা তারিখের সঙ্গে আধুনিক যুগের সাল তারিখের হিসাব মেলাতে এই সূর্যগ্রহণদের ব্যবহার করার চেষ্টা হয়েছে। এই তিনটির মধ্যে একটি হল থালেসের সূর্যগ্রহণ। সেই সময়েই দুই দেশ (বর্তমান ইরানের) লিডিয়া ও মেডিয়ার মধ্যে যুদ্ধ হচ্ছিল, গ্রহণের কারণে ভয় পেয়ে দুই পক্ষ শান্তি স্থাপন করে। এই ভাবে সেই যুদ্ধের তারিখ জানা গেছে। অবশ্য সেই নিয়েও বিতর্ক আছে, কারণ সেই গ্রহণটা হয়েছিল সূর্যাস্তের ঠিক আগে; সেই যুগে সাধারণত এরকম সময়ে যুদ্ধ হত না। দ্বিতীয় একটি গ্রহণের কথা আছে গ্রিক ও পারসিকদের যুদ্ধের প্রসঙ্গে, সেটির তারিখও নির্ণয় করা গেছে। সেটি হয়েছিল ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ২ অক্টোবর। এই তারিখটি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এর অল্পদিন আগেই অপর একটি সূর্যগ্রহণের বর্ণনা হেরোডোটাস লিখেছেন বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন, কিন্তু সে সময় ওই অঞ্চলে ওইরকম কোনো সূর্যগ্রহণ ঘটেনি। অবশ্য এই সমস্ত ঘটনা যখন ঘটেছিল, হেরোডোটাস তখন নেহাতই শিশু; অন্য সূত্র থেকে শুনে বা জেনে লিখেছিলেন বলে হয়তো তাঁর ভুল হয়েছিল।
প্রাচীন গ্রিসের আর এক বিখ্যাত ঐতিহাসিক থুকিদিদিস স্পার্টা ও এথেন্সের মধ্যে পেলেপোনোশীয় যুদ্ধের ইতিহাস লিখেছিলেন। তাঁর লেখা থেকে দুটি সূর্যগ্রহণ ও একটি চন্দ্রগ্রহণের বর্ণনা পাওয়া গেছে যেগুলির তারিখ সন্দেহাতীতভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। ঐতিহাসিকরা বলেন যে সেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ৪৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং শেষ হয়েছিল ৪০৪ খ্রিস্ট পুর্বাব্দে। গ্রহণগুলির তারিখ এই সময়কালকে সমর্থন করে। সূর্যগ্রহণদুটি ঘটেছিল ৪৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ৩ আগস্ট ও ৪২৪ খ্রিস্টপুর্বাব্দের ২১ মার্চ। চন্দ্রগ্রহণটি হয় ২৭ আগস্ট, ৪১৩ খ্রিস্টপুর্বাব্দে।
গ্রহণ থেকে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের এবং মিশরের ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের রাজত্বকাল হয়তো ঠিকমতো জানা সম্ভব। বাইবেলের একটি অনুচ্ছেদকে বলয়গ্রাসের বর্ণনা ধরে নিয়ে দুই বিজ্ঞানী সম্প্রতি জানিয়েছেন সেই বিশেষ গ্রহণটি ঘটেছিল ১২০৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ৩০ অক্টোবর। বাইবেলে যে ঘটনার বর্ণনা আছে, তাকে প্রাচীন মিশরের রেকর্ডের সঙ্গে মিলিয়ে সেই সময়ের ফারাওদের রাজত্বকাল ঠিকভাবে জানা সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা প্রস্তাব করেছেন। অন্য একটি বিশেষ সূর্যগ্রহণের বর্ণনা ৭৬৩ খ্রিস্টপুর্বাব্দের ১৫ জুনের সূর্যগ্রহণের সঙ্গে মিলে যায়। এই তারিখটা যে সঠিক তা নিয়ে ঐতিহাসিকরা নিশ্চিত, কারণ আসিরিয়ার রেকর্ড থেকে সেইদিন আসুর নগরীতে সূর্যগ্রহণ ও তার ফলে অশান্তির উল্লেখ আছে। এই তারিখকে ভিত্তি করে আসুর সাম্রাজ্যের তিন শতাব্দীর সময়কালের সম্রাটদের রাজত্বকাল সঠিকভাবে জানা সম্ভব হয়েছে।
ধর্মগ্রন্থ, পুরাণ বা মহাকাব্যের বর্ণিত ঘটনার তারিখ নির্ণয়ের চেষ্টাও হয়েছে। এগুলি মূলত মানুষের কল্পনা, তবে তার মূলে কোনো বাস্তব ঘটনার বীজ নিহিত থাকতে পারে ধরে নিয়ে বিজ্ঞানীরা এগিয়েছেন। গ্রিক মহাকাব্য ইলিয়াড হল ট্রয়ের যুদ্ধের কাহিনি; অন্যদিকে ওডিসি হল যুদ্ধের শেষে ইথাকা-র রাজা ওডিসিউসের ঘরে ফেরার বৃত্তান্ত। মহাকাব্যের কাহিনি অনুযায়ী ওডিসিউস পথে অনেক বিপদে পড়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত দশ বছর ধরে যাত্রার পরে তিনি যেদিন রাজ্যে ফিরে আসেন সেদিন সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। গ্রহণের সময় অন্য গ্রহদের অবস্থানের বর্ণনা থেকে দুই বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন যে ওডিসির এক বিশেষ অংশে বুধগ্রহের অবস্থানের কথা বলা হয়েছে বলে ধরে নিলে ১১৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ১৬ এপ্রিলের সূর্যগ্রহণের সঙ্গে ওডিসির সেই গ্রহণের বর্ণনা মিলে যায়। অবশ্য তাঁরা সাবধান করেছেন যে এর থেকে ওডিসির সত্যতা প্রমাণ হয় না; তা নেহাতই রূপকথা। এমন হতেই পারে যে ওই সূর্যগ্রহণকে মূলভিত্তি ধরে নিয়েই কবি ওডিসিউসের অভিযানের গল্প তৈরি করেছিলেন। তাছাড়া প্রাচীন মহাকাব্যের অনেক অংশকে আধুনিক যুগে ব্যাখ্যা করার সময় ভুল থাকতেই পারে। ওডিসিউসের অভিযান স্পষ্টতই কল্পনা, সেখানে যে সমস্ত দৈত্যদানবের কথা আছে তাদের অস্তিত্ব পৃথিবীতে কোনোদিন ছিল না। কিন্তু ট্রয়ের যুদ্ধ সত্যিই ঘটেছিল; ট্রয় নগরীর চিহ্ন পাওয়া গেছে যা থেকে অনুমান করা হয় যে তা সম্ভবত ১১৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকছি কোনো সময় ধ্বংস হয়েছিল। পুরাণ ও ইতিহাস মিলে ট্রয়ের যুদ্ধের বিভিন্ন রকম তারিখ পাওয়া যায়। বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো সেই তারিখটি অনুমান করেছিলেন যে ১১৯৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, অন্যদিকে প্রাচীন গ্রিক বিজ্ঞানী এরাটোস্থেনেসের মতে ট্রয় ধ্বংস হয়েছিল ১১৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। অন্যান্য নানা প্রাচীন সূত্রে ট্রয়ের যুদ্ধের জন্য খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১৩৩৩ থেকে ১১৩৫ সালে পর্যন্ত নানা রকমের তারিখ অনুমান করা হয়েছে। যদি ওডিসির সূর্যগ্রহণের বর্ণনা সত্য হয়, ট্রয়ের যুদ্ধের একেবারে সঠিক সময় জানা যাবে।
গ্রহণকে ব্যবহার করে মহাভারতের কাল নির্ণয়েরও চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ওডিসির মতো গ্রহনক্ষত্রের অবস্থানের নিখুঁত বর্ণনা মহাভারতে পাওয়া যায় না। মহাভারতের কাহিনিতে আছে অর্জুন কর্তৃক জয়দ্রথ বধের সময় সূর্যাস্তের অল্প সময় আগে কৃষ্ণ চক্র দিয়ে সূর্য আড়াল করেছিলেন, সেই ঘটনাকে অনেকে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের বর্ণনা বলে মনে করেন। অন্যত্র আছে যে ব্যাসদেব যুদ্ধের আগে ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন যে এমনকি কার্তিক মাসের পূর্ণচন্দ্রও ম্লান হয়ে গেছে। সেটি যদি চন্দ্রগ্রহণের বর্ণনা হয়, তাহলে মহাভারতের কাহিনি থেকে গণনা করে দেখা যায় তার তেরো দিন পরেই যুদ্ধের মধ্যবর্তী সূর্যগ্রহণটি ঘটেছিল; অবশ্য এখানে দিনের ভগ্নাংশকে হিসাবে ধরা হচ্ছে না। কুরুক্ষেত্রের উপর এই দুই গ্রহণ কবে ঘটেছিল তা বিচার করে কাল নির্ণয়ের চেষ্টা হয়েছে।
কিন্তু অন্য কোনো তথ্য হিসাবে না ধরে এই কাজ প্রায় অসম্ভব, কারণ এই ধরনের ঘটনা মোটেই বিরল নয়। এখানেই সমস্যা শুরু হয়েছে। আর্যভাট লিখেছিলেন কলিযুগের শুরুতে সূর্য, চন্দ্র ও সমস্ত গ্রহ মেষ রাশিতে অবস্থান করেছিল। এখানে অবশ্য খালি চোখে যে সমস্ত গ্রহ দেখা যায় তাদের কথাই ধরতে হবে। তাঁর হিসাব মতো কলিযুগের শুরুর তারিখ হবে ৩১০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। মহাভারতে লেখা আছে কলি যুগ আগতপ্রায়, তাই তেরো দিনের ফারাকে দুই গ্রহণের সাক্ষ্য মিলিয়ে অনেকে সিদ্ধান্ত করেছেন যে মহাভারতের যুদ্ধ ঘটেছিল ৩১৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। অবশ্য আর্যভাটের পক্ষে গ্রহদের গতিবিধির নিখুঁত হিসাব জানা সম্ভব ছিল না, প্রকৃতপক্ষে সেই রকম কোনো ঘটনা সে সময় ঘটেনি। অনেক উৎসাহী তো এমনকি মহাভারতের যুদ্ধকে ৫৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন মহাভারতকে অতি প্রাচীন প্রমাণ করার পিছনে শুধুমাত্র ঐতিহাসিক প্রেরণা কাজ করছে না। তা করতে গিয়ে যে শুধুমাত্র প্রত্নতত্ত্ব বা ইতিহাসের সাক্ষ্যকে অবহেলা করা হয়েছে তা নয়, মহাভারত থেকেও সুবিধামতো তথ্য নেওয়া বা বাদ দেওয়া হয়েছে। যেগুলি এই প্রাচীনত্বের দাবীর সঙ্গে মেলে না, তাদের উল্লেখও করা হয় না। এমনিই উপরের দুটি ঘটনা সত্যিই গ্রহণ কিনা মহাভারতে লেখা নেই। এই ধরনের প্রাচীন সাহিত্যে কোন মহাজাগতিক ঘটনার কথা লেখা হয়েছে তা অনেক সময়েই স্পষ্ট নয়, গবেষক নিজের মতো করে তার ব্যাখ্যা করেন। মনে রাখতে হবে যে আর্যভাট ৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম চন্দ্রসূর্য গ্রহণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, কিন্তু ব্রহ্মগুপ্ত, বরাহমিহির বা লল্লের মতো পরবর্তী জ্যোতির্বিদরা সেই ব্যাখ্যা স্বীকার না করে রাহু কেতুর গল্পে ফিরে যান। মহাভারত আর্যভাটের বহু যুগ আগে লিখিত। প্রত্নতত্ত্বও এত প্রাচীনত্বের পক্ষে সাক্ষ্য দেয় না, যেমন ভারতে অত প্রাচীন যুগে কোনো ঘোড়ার কঙ্কাল পাওয়া যায়নি, কিন্তু মহাভারতের যুগে ঘোড়া ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরাণের হিসাব থেকে মহাভারতের কালকে খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীর থেকে পুরানো বলা সম্ভব নয়। আধুনিক জিনতত্ত্ব প্রমাণ করে দিয়েছে যে মহাভারত যাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, খ্রিস্টজন্মের দুহাজার বছর আগে সেই ইন্দোইরানিয় জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ভারতে ছিল না। ওডিসি ও মহাভারতের কালনির্ণয়ের প্রচেষ্টা থেকে একটা পুরানো কথা আবার বলা যায়, মহাকাব্য ইতিহাস নয়, তাকে কাব্য হিসাবে পড়াই শ্রেয়। দ্বিতীয় আর একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন; শুধুমাত্র জ্যোতির্বৈজ্ঞনিক সাক্ষ্য যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
ঐতিহাসিক কালে কিছু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারতের ইতিহাসের কাল নির্ণয়ে গ্রহণকে কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে। সাহিত্যে বা ইতিহাস ছাড়াও ভারতের ইতিহাসে গ্রহণ সম্পর্কে অন্যেক সাক্ষ্য পাওয়া যায়। গ্রহণকে অমঙ্গল ভেবে সেই সময় বা তার পরে অনেকে মন্দিরে দান করতেন, তাম্রপত্রে সেই সব কথা লেখা আছে। অবশ্য অনেক সময়েই গ্রহণের পরে দান করা হত, কারণ আগে থেকে গ্রহণ সম্পর্কে জানা সম্ভব ছিল না। আর্যভাটের তত্ত্বে বিশ্বাস না করলেও তাঁর নিয়ম অনুসরণ করে গ্রহণ সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করা হত, তবে তার প্রথম লিখিত নজির অনেক পরে পাওয়া যায়। তাম্রপত্র থেকে জানা যায় কালাচুরি রাজ রত্নদেবের সময় পদ্মনাভ নামের এক জ্যোতিষী এক পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে সঠিক ভবিষ্যৎবাণী করার পুরস্কার হিসাবে একটি গ্রাম পেয়েছিলেন। সেই গ্রহণটি হয়েছিল ১১২৮ সালের ৮ নভেম্বর। ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যে গ্রহণের কথা থাকলেও নবম শতাব্দীর আগে তারিখের উল্লেখ বিশেষ পাওয়া যায় না। তাম্রপত্র থেকে প্রথম যে গ্রহণের খবর জানা যায় তা ছিল এক পূর্ণ সূর্যগ্রহণ, ঘটেছিল ৪৪০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে।
পদ্মনাভকে প্রদত্ত তাম্রপত্রগুলির একটি |
অন্তত একটি ক্ষেত্রে ভারতের ইতিহাসে গ্রহণের সময় থেকে রাজার রাজত্বকালকে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করা গেছে। কনৌজরাজ যশোধর্মনের সভাকবি বাকপতিরাজ রাজার প্রশস্তি করে লেখা গৌড়বাহ কাব্য লিখেছিলেন। সেখানে তিনি রূপক অর্থে রাজার প্রশংসা করতে গিয়ে যে বর্ণনা ব্যবহার করেছেন তার সঙ্গে সূর্যের বলয়গ্রাসের অনেক মিল আছে। ভারতীয় সাহিত্যে তার আগে বলয়গ্রাসের এমন নিখুঁত বর্ণনা এর আগে পাওয়া যায় না, তাই কবি যে স্বচক্ষে তা দেখেছিলেন তা অনুমান করা অসঙ্গত হবে না। কনৌজে সেইরকম একটি গ্রহণ হয়েছিল ৭৩৩ সালের ১৪ আগস্ট। যশোধর্মন ৭২৫ থেকে ৭৪৫ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন।
লেখা শেষ করার আগে খুব সংক্ষেপে দেখা যাক গ্রহণের ইতিহাস বিজ্ঞানকে কেমন ভাবে সাহায্য করেছে। আগেই দেখেছি যে চাঁদের টানের জন্য পৃথিবীর ঘূর্ণন আস্তে আস্তে কমছে। তাছাড়াও এই হার হিমযুগের জন্য সমুদ্রতলের পরিবর্তন, ভূমিকম্প, পৃথিবীর কেন্দ্রমণ্ডল ও পৃথিবীর গুরুমণ্ডলের মধ্যেকার ঘর্ষণ ইত্যাদির উপরেও নির্ভর করে। শুধুমাত্র সমুদ্রতল ও জলরাশির ঘর্ষণকে হিসাবে আনলে দেখা যায় প্রতি শতাব্দীতে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ার কথা ২.৩ মিলিসেকেন্ড। দিনের দৈর্ঘ্য এত নিখুঁতভাবে আমরা খুব অল্প দিনই মাপতে পারছে, তাই সেই হিসাবটা কতটা ঠিক কেমন করে জানব? প্রাচীন সূর্যগ্রহণের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতক থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত দিনের দৈর্ঘ্য প্রতি শতাব্দীতে গড়ে ১.৮ মিলিসেকেন্ড করে বাড়ছে। এই পার্থক্যের মূল কারণ লুকিয়ে আছে ভূবিদ্যার মধ্যে; তাই পৃথিবীর অভ্যন্তর সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তার থেকে পাওয়া সম্ভব। এভাবেই ইতিহাস ও জ্যোতির্বিজ্ঞান পরস্পরকে সাহায্য করার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চাকে পুষ্ট করছে।
প্রকাশিতঃ বিজ্ঞানভাষ বার্ষিক সংকলন ২০২৩
No comments:
Post a Comment