Saturday, 22 June 2024

বোসন, নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু

 

বোসন, নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় 


 


আজ থেকে একশো বছর আগে সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর বিখ্যাত গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেছিলেন। আইনস্টাইনকে তিনি সেটি পাঠিয়েছিলেন, আইনস্টাইন তার গুরুত্ব বুঝতে পেরে সেটি নিজেই জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। এর পরে আইনস্টাইন সেই কাজটিকে আরো বিকশিত করেন, এই ভাবেই বোস আইনস্টাইন সংখ্যায়নের সৃষ্টি। যে সমস্ত কণারা এই সংখ্যায়ন মেনে চলে অনেক পরে বিজ্ঞানী পল ডিরাক তাদের নাম দেন বোসন। এই ইতিহাস জ্ঞান ও বিজ্ঞান-এর পাঠকদের সকলেরই জানা। সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণার দু' বছরের মধ্যে এনরিকো ফের্মি দেখান যে আর এক ধরনের কণা আছে যারা অন্য এক ধরনের সংখ্যায়ন মেনে চলে, পরে ডিরাকও সেই সংখ্যায়ন স্বাধীনভাবে আবিষ্কার করেন। সেই সংখ্যায়নের নাম ফের্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন, যে সমস্ত কণা তাকে অনুসরণ করে, তাদের নাম ফের্মিয়ন।

বোসনের উদাহরণ হল ফোটন, আবার ইলেকট্রন প্রোটন নিউট্রন কোয়ার্ক ইত্যাদি কণা হল ফের্মিয়নের উদাহরণ। আমরা জানি নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন, তাই সচরাচর নিউক্লিয়াসের আলোচনার সময় বোসনের কথা মনে না আসতেই পারে। কিন্তু নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানেও বোসনের ভূমিকা আছে, এই লেখাতে আমরা খুব সংক্ষেপে সেই দিকে চোখ রাখব।

ফোটন ছাড়া প্রথম যে বোসন কণা আবিষ্কার হয়েছিল, তা হল পাই মেসন, বা সংক্ষেপে পায়ন। ১৯৩৫ সালে জাপানি বিজ্ঞানী হিদেকি ইউকাওয়া নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন নিউট্রনদের মধ্যে বলকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক নতুন কণার প্রস্তাব করেন, পরে তার নাম দেওয়া হয় পাই মেসন। মেসন কথাটা এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে, শব্দটার অর্থ হল মধ্যবর্তী। প্রোটনের ভর হল ইলেকট্রনের ১৮৩৬ গুণের কাছাকাছি, এই দুই কণার মধ্যবর্তী ভরের কোনো কণার কথা তখন জানা ছিল না। ইউকাওয়া অঙ্ক কষে দেখিয়েছিলেন এই নতুন কণাটির ভর হওয়া উচিত ইলেকট্রনের দু'শো থেকে তিনশো গুণ। অবশ্য এই ধরণের কণার নামকরণ নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছিল, মেসোট্রন ও মেসোটন এই দুটো নামও ব্যবহার হত। মেসন নামের প্রস্তাব করেছিলেন হোমি জেহাঙ্গির ভাভা।

পরীক্ষাগারে পায়নের আবিষ্কারের ঘটনা বেশ চিত্তাকর্ষক। ইউকাওয়ার তত্ত্ব প্রকাশের দু' বছরের মধ্যেই মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে বিজ্ঞানীরা অনুরূপ ভরের একটি কণা খুঁজে পান, কিন্তু পরে দেখা যায় সেটি আলে ইউকাওয়ার প্রস্তাবিত পায়ন নয়। সেটি একটি ফের্মিয়ন, তখন তাকে বলা হত মিউ মেসন, এখন আমরা বলি মিউয়ন। আমাদের দেশে দেবেন্দ্রমোহন বোস ও তাঁর ছাত্রী বিভা চৌধুরি পায়ন কণা আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হননি। ব্রিটেনে সিসিল পাওয়েল নিশ্চিতভাবে কণাটির চিহ্ন খুঁজে পান। তার পরেই ১৯৪৯ সালে ইউকাওয়া ও ১৯৫০ সালে পাওয়েলকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।

আমরা এখন জানি পায়ন হল তিন রকম, π+, π0, π- এর পরে আরো অনেক মেসন আবিষ্কার হয়েছে, তাদের অনেকের ভর প্রোটনের থেকে অনেক বেশি, তবে মেসন কথাটাই চালু হয়ে গেছে। আধুনিক যুগের ভাষায় বললে আমরা বলি যে সমস্ত কণা একটা কোয়ার্ক ও একটা অ্যান্টিকোয়ার্ক বা প্রতিকোয়ার্ক দিয়ে তৈরি, তাদের বলে মেসন। এখনো পর্যন্ত প্রায় দু'শো মেসনের সন্ধান পাওয়া গেছে, তাদের অনেকেরই ভর এত বেশি যে নিউক্লিয়াসের মধ্যের বলে তাদের বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই। তবে তারা সবাই বোসন।

বোস ঘনীভবন বা বোস কন্ডেনসেশন কথাটা অনেকে শুনেছেন, জ্ঞান ও বিজ্ঞান-এর এই সংখ্যাতেই অন্য লেখাতে সেই নিয়ে আলোচনা আছে। আমাদের অভিজ্ঞতায় পদার্থ সাধারণভাবে কঠিন তরল ও গ্যাসীয়, এই তিন দশাতে অবস্থান করে। বোস ঘনীভূত অবস্থাকে বলা হয় সম্পূর্ণ নতুন এক দশা, তার সঙ্গে সাধারণ পদার্থের কোনো মিল নেই। বোসনের বৈশিষ্ট্য হল যে একই শক্তিস্তরে যত খুশি বোসন থাকতে পারে। ফলে অতি শীতল তাপমাত্রায় সমস্ত কণা নিচের শক্তিস্তরে চলে গিয়ে এই ঘনীভূত অবস্থার সৃষ্টি করে। তাত্ত্বিকভাবে দেখানো হয়েছে যে বিশেষ পরিস্থিতিতে পায়নের ক্ষেত্রেও এই ঘনীভূত অবস্থা বা পায়ন কন্ডেনসেশনের সৃষ্টি করতে পারে। তবে পরীক্ষাগারে পায়ন কন্ডেনসেট সৃষ্টি এখনো আমাদের ক্ষমতার অতীত। নিউট্রন তারা হলো ভারি তারকার জীবনের শেষ অবস্থা, তা প্রায় সম্পূর্ণ নিউট্রন দিয়ে তৈরি। এই তারার ঘনত্ব খুব বেশি, এক চামচ পদার্থেভর হবে দশ কোটি টন। এই অতি ঘন অবস্থায় পায়ন ঘনীভবন হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।

মৌলিক কণা বা কণাসমষ্টির এক ধর্ম হল স্পিন। এই স্পিনকে প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সঙ্গে যুক্ত করে লেখা যেতে পারে s= nh /2π. বোসনের ক্ষেত্রে n-এর মন পূর্ণসংখ্যা অর্থাৎ 0, 1,,2,.. হতে পারে। ফের্মিয়নের ক্ষেত্রে মান হয় অর্ধপূর্ণ সংখ্যা অর্থাৎ 1/2, 3/2, 5/2,... এমন। পায়নের জন্য n-এর মান 0। পায়নের থেকে ভারি দুটি মেসন হল ওমেগা ও রো (ρ)। এই দুটির জন্যই n=1। নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যাতে আধুনিক এক তত্ত্বে নিউক্লিয় কণাদের মধ্যে বলকে ফোটন ও এই তিনটি মেসন বয়ে নিয়ে যায় ধরে নিয়ে নিউক্লিয়াসের গঠন ও অন্যান্য ধর্ম খুব সফলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।

দুটি বোসনের স্পিন যোগ করলে তা আবার পূর্ণসংখ্যা দিয়েই প্রকাশিত হবে, দুটি ফের্মিয়নের ক্ষেত্রেও তাই। যেমন কোয়ার্ক বা অ্যান্টিকোয়ার্কের স্পিনের জন্য n-এর মান 1/2। আগে দেখেছি একটি কোয়ার্ক ও একটি অ্যান্টিকোয়ার্কের সাহায্যে মেসন কণা গঠিত হয়। দুটি কণার স্পিনকে যোগ করলে মোট স্পিনের জন্য n-এর মান 0 বা 1 হতে পারে; অর্থাৎ তারা বোসন।

আমরা সবাই অতিপরিবাহিতা বা সুপারকন্ডাক্টিভিটির নাম শুনেছি। সুপারকন্ডাক্টিভিটির প্রথম ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তিন বিজ্ঞানী, জন বার্ডিন, লিওন কুপার এবং জন শ্রিফার; সেই কৃতিত্বের জন্য তাঁরা ১৯৭২ সালে নোবেপ পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনজনের নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে এই তত্ত্বকে বলা হয় বিসিএস তত্ত্ব। তাঁরা দেখান অতি নিম্ন তাপমাত্রায় ধাতুর দুটি ইলেকট্রন মিলে একটি ইলেকট্রন যুগ্ম তৈরি করে, একে বলে কুপার যুগ্ম। ইলেকট্রনের স্পিনও কোয়ার্কের মতন, অর্থাৎ কুপার যুগ্ম হল বোসন, তার জন্য n=0। বিজ্ঞানীরা দেখেন যে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে যে দুই ধরনের ফের্মিয়ন কণা প্রোটন ও নিউট্রন আছে, তাদের মধ্যেও এই ধরনের যুগ্মন বল খুব শক্তিশালী হয়। ফলে নিউক্লিয়াসের মধ্যেও দুটি প্রোটন বা দুটি নিউট্রন মিলে কুপার যুগ্ম তৈরি করতে পারে। এইভাবে বিসিএস তত্ত্বকে নিউক্লিয়াসের নানা ধর্মের ব্যাখ্যাতে খুব সফলভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে। এই কুপার যুগ্ম কোনো মৌলিক কণা নয়, মেসনের সঙ্গে তাদের এই দিক দিয়ে অনেক পার্থক্য আছে। এমন নয় যে কোনো যুগ্মে দুটি বিশেষ কণাই আছে। এই লেখাতে আমরা সেই আলোচনাতে যাচ্ছি না।

এর পরে ১৯৭০-এর দশকে নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানে বোসনকে ব্যবহারের এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন আকিতো আরিমা ও ফ্রান্সিস্কো ইয়াকেলো। তাঁদের মডেলে দু'টি প্রোটন বা দু'টি নিউট্রন মিলে যে বোসন তৈরি করতে পারে, তাদের ক্ষেত্রে n-এর মান হতে পারে 0, 2, 3 বা 4; এদের বলা হয় যথাক্রমে s, d, f g বোসন। (পরমাণুর গঠনের ক্ষেত্রে কৌণিক ভরবেগের অনুরূপ নামকরন থেকে বোসনের নামগুলি নেওয়া হয়েছে।) সব থেকে সরল মডেলে থাকে কেবল s d বোসন। এর পরে গ্রুপ থিওরি ও প্রতিসাম্যের ধারণার য়োগ করে তাঁরা নিউক্লিয়াসের আকার ও তার মধ্যের শক্তিস্তর সম্পর্ক নির্ণয় করেন। সেই জটিল আলোচনা এই প্রবন্ধের সীমার বাইরে। তবে একটা কথা বলাই যায় যে তাঁদের গবেষণা থেকে দেখা যায় কিছু কিছু নিউক্লিয়াস এক বিশেষ আকার নেয় যা আগে জানা ছিল না। পরীক্ষাগারে তা প্রমাণিত হয়েছে।

আমরা দেখলাম যে সত্যেন্দ্রনাথ সরাসরি নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা বিষয়ে গবেষণা না করলেও বোসন কণার ধারণা নিউক্লিয় বিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নিউক্লিয় বিজ্ঞান সম্পর্কেও তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান ছিল; সেই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করে এই লেখা শেষ করব, অবশ্য আগেও জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকাতে এই ঘটনার কথা লিখেছি। । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সূচনা করেছিলেন শ্যামাদাস চ্যাটার্জি, তিনি ছিলেন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে দেবেন্দ্রমোহন বসুর ছাত্র। ১৯৩৮ সালের একেবারে শেষে আবিষ্কার হয় যে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করলে ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস দু'টুকরো হয়ে যায়, একে বলে ফিশন বা বিভাজন। সেই বিষয়ে কাজ করার সময় শ্যামাদাস দেখলেন যে নিউট্রন উৎস সরিয়ে নিলেও ফিশনের সঙ্কেত তাঁর ডিটেক্টরে ধরা পড়ছে। দেবেন্দ্রমোহন সেই সময় দার্জিলিঙে, তাঁর সঙ্গে আলোচনার সুযোগ নেই। সত্যেন্দ্রনাথ বসু তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছুটিতে কলকাতায় এসেছেন, শ্যামাদাস তাঁর কাছে গিয়ে বিষয়টা খুলে বললেন। সত্যেন্দ্রনাথ প্রথমে বলেন মহাজাগতিক রশ্মির কথা। শ্যামাদাস ইউরেনিয়ামকে সিসের চাদর দিয়ে মুড়ে মহাজাগতিক রশ্মি কমানোর ব্যবস্থা করলেন, কিন্তু সঙ্কেত আসা কমল না। সত্যেন্দ্রনাথ তখন অনুমান করলেন যে ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস নিজে নিজেই ভেঙে যাচ্ছে। সে সময় নিউক্লিয় বিভাজন ব্যাখ্যা করার জন্য নিল্‌স বোর ও জন হুইলারের তত্ত্ব ব্যবহার করা হত, সেই অনুযায়ী এই ঘটনা অসম্ভব। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ চিরকালই পরীক্ষানিরীক্ষাকে তত্ত্বের থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন; তিনি শ্যামাদাসকে তাঁর গবেষণার কথা ছাপানোর পরামর্শ দেন। শ্যামাদাসও সেই মতো গবেষণাপত্রটি লিখে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু দেবেন্দ্রমোহন কলকাতাতে ফিরে এসে শ্যামাদাসের পরীক্ষা দেখে সন্তুষ্ট হতে পারেননি; হয়তো তাঁর মনে হয়েছিল যে নিল্‌স বোরের তত্ত্বে ভুল থাকতে পারে না। তিনি শ্যামাদাসকে গবেষণাপত্র ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেন। ঠিক দু’মাস পরে দুই সোভিয়েত বিজ্ঞানী ফ্লেরভ ও পেত্রাক ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের নিজে নিজে ভেঙে পড়ার কথা প্রকাশ করেন।

 

প্রকাশিত জ্ঞান ও বিজ্ঞান, জুলাই ২০২৪

3 comments:

  1. তপন কুমার বিশ্বাস4 October 2024 at 22:02

    খুব মনোজ্ঞ ও মূল্যবান লেখা। জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকার জুলাই ২০২৪ সংখ্যায় আগেই পড়েছি। সমৃদ্ধ হয়েছি।

    ReplyDelete
  2. How could I avail the hard copies of this magazine?

    ReplyDelete
    Replies
    1. You can be a subscriber of the magazine or a member of the Bangiya Bijnan Parishad. For more details, please consult https://bangiyabijnanparishad.org/

      Delete