Thursday, 1 August 2024

অন্য এক গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য

অন্য এক গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় 


 


প্রকৃতিবিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের নাম আমরা সকলেই জানি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো রকম প্রথাগত ডিগ্রি ছাড়াই তিনি পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধিৎসাকে সম্বল করে বিজ্ঞান জগতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডিএসসি উপাধি দিয়েছিল। বিজ্ঞান লেখক ও বিজ্ঞান পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে তাঁর পরিচিতিও কম নয়। দীর্ঘদিন জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকার সম্পাদনার ভার তিনি সামলেছেন। এক সময় বিজ্ঞানের লেখা বিশেষ আসত না, ফলে স্বনামে ও বেনামে বহু লেখা তাঁকে লিখতে হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা আটশোরও বেশি, এখনো পর্যন্ত তাঁর সব লেখার সন্ধান পাওয়া যায় নি। যুগান্তর পত্রিকার ছোটদের পাততাড়ি বিভাগেও তিনি 'বিজ্ঞানী' ছদ্মনামে বহু লেখা লিখেছেন। বাংলার কীটপতঙ্গ বইটির জন্য তিনি রবীন্দ্র পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তবে এই ছোট্ট লেখাতে আমরা বিজ্ঞান বা বিজ্ঞান সাহিত্য নয়, গোপালচন্দ্রের জীবনের অন্য দুএকদিক নিয়ে আলোচনা করব।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে যথার্থ বিজ্ঞানসচেতনতার উল্টোদিক হল সমাজসচেতনতা। গোপালচন্দ্র জন্মসূত্রে ছিলেন ব্রাহ্মণ; তাঁদের পারিবারিক বৃত্তি ছিল পুরোহিতগিরি। খুব ছোটবেলাতে বাবা মারা যাওয়ার পরে দরিদ্র পরিবারকে সাহায্য করার জন্য স্কুলে পড়ার সময়েই তাঁকে সেই কাজ অবলম্বন করতে হয়েছিল। সেই যুগে সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি ছিল প্রবল। তাঁর নিজের গ্রামেও তার অন্যথা ছিল না। গোপালচন্দ্র কিন্তু মন থেকে এই ব্যবস্থাকে মেনে নিতে পারেননি। তাই সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্ণের পুরুষ ও নারীদের লেখাপড়া ও হাতেকলমে কাজ শেখানোর জন্য 'কমল কুটির' নামের একটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন। গরিব নমঃশূদ্রদের নিয়ে নিয়মিত আলোচনায় বসতেন তিনি, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস তাঁদের দিতেন। গ্রামের জমিদারবাড়ির পুজোতে তাঁদের প্রবেশাধিকার ছিল না, কিন্তু বিসর্জনের ভার পড়ত তাঁদেরই উপর। তাঁর প্রেরণাতে নমঃশূদ্ররা এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ করেছিলেন, বলেছিলেন অষ্টমীতে অঞ্জলি দিতে না দিলে তাঁরা আলাদা পুজো করবেন। এ বড় কম কথা নয়, প্রায় সমবয়সী মেঘনাদ সাহাকে একই সময়ে এমনকি কলকাতার হিন্দু হস্টেলেও সরস্বতী পুজোতে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। এ জন্য গ্রামের সমাজপতিদের রোষের মুখে পড়তে হয়েছিল গোপালচন্দ্রকে। কিন্তু তার জন্য মানুষে মানুষে এই কৃত্রিম ভেদাভেদ তিনি মেনে নিতে পারেননি। অনেক বছর পরে কলকাতার দাঙ্গার সময় মুসলমান ডিমবিক্রেতাকে অন্যদের আপত্তি উপেক্ষা করে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন।

বিজ্ঞানে তাঁর অনুসন্ধিৎসার কাছে ভয়ডর হার মানত। আমরা অনেকেই তাঁর ভৌতিক আলো প্রবন্ধ পড়েছি। মনে করিয়ে দিই, আলেয়ার আলো দেখে অন্যরা যখন তাকে ভৌতিক কাণ্ড সাব্যাস্ত করেছেন, তখন তিনি তার রাসায়নিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। উপস্থিত এক ভদ্রলোক তাঁকে রাত্রিবেলা গ্রামের 'পাঁচীর মার ভিটা'-তে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ দেন; তাহলে ভূতের অস্তিত্ব সম্পর্কে তাঁর মত পরিবর্তন হবে। সে সময় তিনি ভূতে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই করতেন না। কিন্তু সংস্কারের জন্য রাত্রে গা ছমছম করে। তা সত্ত্বেও তিনি দুই ভদ্রলোককে সঙ্গে করে রাত্রে পাঁচীর মার ভিটাতে যান। সেখানে আলো দেখে দুই সঙ্গী আগেই ভয়ে পিছিয়ে যান, কিন্তু অনুসন্ধিৎসা গোপালচন্দ্রকে সামনে টেনে নিয়ে যায় এবং তিনি দেখেন যে একটা পচে যাওয়া গাছের গুঁড়িই হল সেই আলোর উৎস।

তরুণ বয়সে গোপালচন্দ্রের এক শিক্ষা হয়েছিল। তাঁর ভাইয়ের অসুখ, কিন্তু চিকিৎসাতে সারছে না। গোপালচন্দ্র বুঝলেন রোগের কারণ লুকিয়ে আছে মনে। তিনি মা শশিমুখীকে বললেন যে রাত্রে আপদ বিনাশিনী দেবী এসে তাঁকে ভাইয়ের জন্য ওষুধ দিয়ে গেছেন, মাদুলি করে সেটি পরিয়ে দিতে হবে। অব্যর্থ কাজ হল, ভাই সুস্থ হয়ে উঠল। আপদ বিনাশিনী দেবীর প্রতি মায়ের ভক্তি এমনই আকার নিল, যে গোপালচন্দ্র সত্যি কথাটা প্রকাশ করার পরেও তাতে বিন্দুমাত্র কমতি হল না। গোপালচন্দ্র বুঝেছিলেন অন্ধবিশ্বাসের ভিত নড়ানো কত কঠিন কাজ।

আমরা যারা ছোটদের মধ্যে বিজ্ঞান প্রচার করতে চাই, তাদের জন্য গোপালচন্দ্রের একটা কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলে, বিজ্ঞানের মতো জটিল বিষয়ে ছোটদেরকে কেমন করে আগ্রহী করা যাবে। গোপালচন্দ্র উত্তরে বলেছিলেন, প্রত্যেক শিশুই একটি ক্ষুদে বিজ্ঞানী; তারা সব সময়েই জানতে চায়, বুঝতে চায়। আমরা বড়রাই তাদের নিরুৎসাহিত করি, ভুল পথে চালনা করি। তাঁর ভাষায়, গ্রামে সাপুড়েদের ডুগডুগি বাজানো শুনে ছোটরা সাপ বিষধর প্রাণী জেনেও তাকে দেখতে জড়ো হয়, তেমনি আমাদের কাজ বিজ্ঞানের ডুগডুগি বাজানো; ছেলেমেয়রা নিজেরাই বিজ্ঞান শিখতে আসবে। সেই ডুগডুগি বাজানোর জন্যই তিনি জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকাতে 'করে দেখ' বিভাগ চালু করেছিলেন।

আগেই দেখেছি তিনি তরুণ বয়সে ভূতে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই করতেন না, তবে প্রমাণ চাইতেন। পরে তাঁর মত আমরা জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকাতে প্রকাশিত 'স্পিরিচুয়ালিজম বা প্রেততত্ত্ব' প্রবন্ধ থেকে দেখতে পাই। সেখানে তিনি খুব সহজ কথায় বিজ্ঞান কাকে বলে বুঝিয়েছিলেন; মানুষের অজানা কোনো রহস্য বিষয়ে অনুসন্ধান অবশ্যই বিজ্ঞান, যদি তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করা হয়। নানা রকম বুজরুকির নজির তুলে দেখিয়েছিলেন যে সমস্ত পরীক্ষাতে প্রতারণার সুযোগ আছে, একমাত্র সেই সমস্ত পরীক্ষাতেই প্রেতের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি শেষ করেছিলেন যে কথা বলে, তা তাঁর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের আদর্শের সঙ্গে মিলে যায়; “প্রাকৃতিক নিয়মের প্রতি একটু গভীরভাবে মনঃসংযোগ করলে সহজেই প্রতীত হয় - জীবন হইতে জীবনের উৎপত্তি হইতেছে, এবং এই জীবন প্রবাহ অবিচ্ছিন্ন। ... দেহাতিরিক্ত কোন অতি প্রাকৃত প্রেতযোনির জন্মান্তর পরিগ্রহের সম্ভাবনাও থাকে না। কাজেই এইরূপ বিশ্বাসের মূল ভিত্তিতেই টান পড়ে।" শেষ জীবনে রোগভোগে কষ্ট পেলেও কখনো সেই যন্ত্রণা কমানোর জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেননি গোপালচন্দ্র। ভুল করেও কোনো দেবদেবীর নাম মুখে আনতেন না। একদিন বাড়ির লোককে বলে দিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পরে যেন অশৌচ পালন না করা হয়। বিজ্ঞানে নিবেদিত প্রাণ গোপালচন্দ্র আমাদের সকলেরই আদর্শ।