গ্রহান্তরের বার্তা, ভয়নিচের পুঁথি ও ডলফিনের ভাষা
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে নামটা শুনে সুররিয়াল কবিতা সম্পর্কে আলোচনা মনে হলেও এটা আদতে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা। মানুষ বহু কাল আগে থেকেই জানতে চেয়েছে সে কি এই মহাবিশ্বে একা? নাকি কোথাও আছে তার কথা বলার সঙ্গী? সৌরজগতে অন্য কোথাও এককোশী প্রাণ থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু উন্নত প্রাণী নেই। তাই খুঁজতে হবে অন্য নক্ষত্রের জগতে। কিন্তু সশরীরে সেখানে যাওয়া, এমনকি রোবট মহাকাশযান পাঠানোও আমাদের ক্ষমতার বাইরে। হয়তো উন্নত সভ্যতার পক্ষে তা সম্ভব, তবে তাদেরও যে অনেক সময় লাগবে সন্দেহ নেই। আইনস্টাইন দেখিয়েছেন আলোর থেকে বেশি দ্রুত যাওয়ার বা সঙ্কেত পাঠানোর সুযোগ নেই। তাই বার্তা বিনিময়ই আমাদের কাছে একমাত্র উপায়। সেই সম্ভাব্য বার্তার কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়েই এই লেখা।
অন্য নক্ষত্রের প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বিশেষ করে রেডিওতরঙ্গের উপর জোর দেওয়া হয়। রেডিও বার্তা আমরা অন্য নক্ষত্রের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছি, কিন্তু তা কারো কাছে পৌঁছানোর আশা আমরা করি না, কারণ আমাদের ক্ষমতা সীমিত। সত্যিই যদি ভিন গ্রহের সভ্যতা থাকে, তাহলে তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে সেই সম্ভাবনাই বেশি। আমরা সবে অন্য নক্ষত্রে খবর পাঠানোর ক্ষমতা আয়ত্ত করেছি। প্রযুক্তির বিবর্তন হয় অত্যন্ত দ্রুত হারে; দু'শো বছরেরও কম সময়ে আমরা ঘোড়ার গাড়ি থেকে মহাকাশযানে পৌঁছেছি। যদি বিশ্ব উষ্ণায়ন, পরিবেশ দূষণ, জাতিবৈরিতা ইত্যাদি সমস্যার সমাধান করে মানব সভ্যতা আরো হাজার বছর টিকে থাকতে পারে, তাহলে সে যে প্রযুক্তির কোন স্তরে গিয়ে পৌঁছোবে আমরা অনুমানও করতে পারি না। আমাদের মহাবিশ্বের বয়স তেরোশো আশি কোটি বছর, অধিকাংশ নক্ষত্রই বহু কোটি বছর ধরে আলো দিচ্ছে। তাই ভিনগ্রহে রেডিওবার্তা প্রেরণকারী সভ্যতা থাকলে তাদের আমাদের থেকে এগিয়ে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। সেই কারণে শোনার উপর বিজ্ঞানীরা বেশি জোর দিচ্ছেন। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে মহাকাশ থেকে আসা রেডিও সঙ্কেত বিশ্লেষণ করে চলেছে সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইন্টালিজেন্স বা সেটির বিভিন্ন প্রকল্প। ২০১৬ সালে শুরু হয়েছে ব্রেকথ্রু লিসন (Breakthrough Listen); স্টিফেন হকিং-এর মতো বিজ্ঞানীরা একে সমর্থন করেছিলেন।
এই কান পাতার ফল কিছু পাওয়া গেছে কি? ১৯৬৭ সালে এক গবেষক ছাত্রী জোসেলিন বেল রেডিও টেলিস্কোপে এক অদ্ভুত সঙ্কেত খুঁজে পেয়েছিলেন; তার পর্যায়কাল আমাদের পারমাণবিক ঘড়ির মতো নিখুঁত। বেল ও তাঁর মাস্টারমশাই অ্যান্টনি হিউইশ অবশ্য ভিনগ্রহের সঙ্কেত খুঁজছিলেন না, তবু মজা করে তার নাম দিয়েছিলেন এলজিএম অর্থাৎ লিটল গ্রীন মেন। পরে অবশ্য সবুজ মানুষদের কথা আর আসেনি, কারণ বোঝা যায় সেই সঙ্কেতের উৎস হল নিউট্রন নক্ষত্র। এই আবিষ্কারের জন্য হিউয়িশ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন; অনেকেরই মতে বেলকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তবে সে অন্য প্রসঙ্গ।
কেমন করে আমরা এই ধরনের প্রাকৃতিক সঙ্কেত থেকে বার্তাকে আলাদা করব? এখানে একটা পুরানো বইয়ের গল্প বলি, তার নাম ভয়নিচ পুঁথি। এক পুরানো জিনিসপত্রের ডিলার উইলফ্রিড ভয়নিচ ১৯১২ সালে এটি আবিষ্কার করেন। লেখার কায়দা ও ছবি থেকে অনুমান করা হয় এটি ইতালির রেনেসাঁসের সময় লেখা। তার পক্ষে সমর্থনও মিলেছে, রেডিওকার্বন ডেটিং থেকে জানা গেছে এই পুঁথিটি ১৪০৪ থেকে ১৪৩৮ সালের মধ্যে লেখা হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে বোহেমিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় ২৪৬ পৃষ্ঠার হাতে লেখা এই পুঁথিটি ছ'শো স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে কিনেছিলেন বলে অনুমান করা হয়। সঙ্গের ছবিতে সেই পুঁথির একটি পৃষ্ঠার কিছুটা দেওয়া হল। লেখার পাশাপাশি পুঁথিতে আছে মানুষ, অচেনা গাছপালা, দুর্গ, ড্রাগন ইত্যাদির ছবি।
![]() |
ভয়নিচ পুঁথির এক অংশ (সূত্র উইকিপেডিয়া) |
গণিতের এক সূত্র থেকে আমরা ভয়নিচ পুঁথিকে পরীক্ষা করতে পারি, তার নাম জিফের সূত্র (Zipf's law)। ১৯৩২ সালে ভাষাবিজ্ঞানী জর্জ জিফ এটির কথা বলেন যদিও তাঁর আগে আরো অনেকেই এই ধরনের সূত্রের দিকে নির্দেশ করেছিলেন। ধরা যাক কোনো একটি বইতে কোন শব্দ কতবার এসেছে ক্রমানুসারে সাজানো হল। দেখা যাবে প্রথম শব্দটি দ্বিতীয় শব্দের থেকে দুগুণ বেশি ব্যবহার হয়েছে, তৃতীয়টির থেকে তিনগুণ বেশি। কিছুটা এদিক ওদিক হলেও আমাদের জানা সব স্বাভাবিক ভাষাই এই নিয়ম মেনে চলে। পরে বিখ্যাত গণিতজ্ঞ বেনোয়া ম্যান্ডেলব্রট এটির কিছুটা পরিবর্তন করেন। জিফ-মেন্ডেলব্রট সূত্র অনুসারে f(r) অর্থাৎ কোন শব্দ কতবার আসবে, তা তার ক্রম বা rank (r)- এর নির্দিষ্ট রাশিমালা (r+b)-র a-ঘাতের সমানুপাতী। সুত্রটিকে সঙ্কেতের আকারে লিখলে হবে
f(r) ~ (r+b)a
এখানে b ও a হল ধ্রুবরাশি। জিফের সূত্র অনুসারে সূচক a-র মান -১।
![]() |
শেক্সপিয়ারের রচনার জিফ বিশ্লেষণ |
যে কোনো স্বাভাবিক ভাষা এই সূত্র মেনে চলে, তার কারণও বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন। দীর্ঘদিন কোনো ভাষা ব্যবহার হলে স্বাভাবিকভাবেই তা বিবর্তিত হতে হতে এমন হয়ে দাঁড়ায় যেন সব থেকে কম পরিশ্রমে সব থেকে বেশি অর্থ বোঝানো যায়। এখানে সূচক a-ই এখানে সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার মান যত কম হবে, বড় শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা তত বাড়বে। দু' বছরের কম শিশুদের জন্য সূচকের মান হয় -০.৮, কারণ তখন তারা বড় শব্দ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে যায়। কিন্তু ঠিকঠাক কথা বলতে শেখার পর সুচক -১-এ পৌঁছে যায়।
কৃত্রিম ভাষার ক্ষেত্রে কী হয়? দীর্ঘ কম্পিউটার প্রোগ্রামও জিফের সূত্র অনেকটা মেনে চলে বলে দেখা যায়, কারণ সেগুলি যে সমস্ত ভাষাতে লেখা সেগুলি বহু লোক বহুদিন ধরে ব্যবহার করছে। কিন্তু বিখ্যাত ফ্যান্টাসি লর্ড অফ দি রিংস-এর রচয়িতা তাঁর উপন্যাসের চরিত্র এলফ্দের জন্য যে ভাষা লিখেছিলেন, তার উপরে জিফ-এর সুত্র কাজ করে না, কারণ তার কোনো বিবর্তন হয়নি। আশ্চর্য হল যে ভয়নিচের পুঁথিও জিফের সুত্র মেনে চলে। অর্থাৎ এটি সম্ভবত টলকিয়েনের এলভিশের মতো কোনো নতুন ভাষা নয়, ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে বিবর্তিত এক ভাষা। সম্ভবত বলছি তার কারণ জিফের সূত্র আমাদের জানা সমস্ত ভাষার ক্ষেত্রে খাটলেও তাকে প্রমাণ করা যায়নি, তাই অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন ভাষা জিফের সূত্র মেনে চলে, তা বলে জিফের সূত্র মানলেই যে অর্থ থাকবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
প্রাকৃতিক ও অর্থবহ সঙ্কেতকে আলাদা করার দ্বিতীয় এক উপায় হল তার এনট্রপি বিশ্লেষণ। এনট্রপি শব্দের অর্থ বিশৃঙ্খলা। আপনার কিবোর্ডে অনেকক্ষণ ধরে চোখ বুজে যথেচ্ছ টাইপ করুন, তারপর দেখুন কোন অক্ষর কতবার এসেছে। দেখা যাবে মোটামুটি সব অক্ষরই প্রায় সমান সংখ্যায় আসবে। এই হল বিশৃঙ্খল অবস্থা, এর এনট্রপি খুব বেশি। একে পরিভাষাতে বলে নয়েজ, অধিকাংশ প্রাকৃতিক সঙ্কেতের চরিত্র এই রকম। আবার ধরুন একটাই কি বহুবার টাইপ করলেন, এটি সম্পূর্ণ সুশৃঙ্খল। পালসারের সঙ্কেত এই চরিত্রের। অর্থবহ বাক্যে এনট্রপি হবে মাঝামাঝি। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল সঙ্কেত যেমন কোনো তথ্য বহন করতে পারে না, সম্পূর্ণ শৃঙ্খলাবদ্ধ সঙ্কেতের পক্ষেও তা সম্ভব নয়।
তথ্য তত্ত্ব (Information theory)-র জনক ক্লড শ্যানন পদার্থবিদ্যার অনুসরণ করে লেখার এনট্রপির পরিমাপ করার এক ফর্মুলা দিয়েছিলেন। ধরা যাক ইংরাজি শুধুমাত্র অক্ষরের কথা, বড় বা ছোট হাতের আলাদা করব না বা দাঁড়ি কমা সেমিকোলন ইত্যাদি যতি চিহ্ন বা শূন্যস্থানকে হিসাবে ধরব না। সেক্ষেত্রে উপরে বর্ণিত সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল অবস্থার শ্যানন এনট্রপির মান হয় ৪.৭। আবার একটিই অক্ষর বারবার এলে অর্থাৎ সম্পূর্ণ শৃঙ্খলাবদ্ধ হলে এনট্রপির মান হয় শূন্য। আমি একটি ইংরাজি গল্পের লেখার শ্যানন এনট্রপির মান মেপে পেয়েছি ৪.১, অর্থাৎ গল্পটির অর্থ আছে। তবে এই উদাহরণটি অত্যন্ত সরল; তথ্যতত্ত্ব অনেক জটিল ও সমৃদ্ধ। একই পদ্ধতিতে ভয়নিচের পুঁথির শ্যানন এনট্রপি মেপে পাওয়া গেছে ৩.৭। তুলনাতে টমাস হার্ডির উপন্যাসের ও দান্তের ডিভাইন কমেডির এনট্রপি হল ৪.২। এই ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল বিন্যাসের এনট্রপি হয় ৬।
এই দুই অস্ত্র প্রয়োগ করে আমরা প্রাকৃতিক সঙ্কেতকে রেডিওবার্তার থেকে আলাদ করতে পারি। দুইই দেখাচ্ছে যে ভয়নিচের পুঁথির অর্থবহন করে। অথচ আমরা এমনকি আধুনিক কম্পিউটারের সাহায্যেও তার সঙ্কেত ভেদ করতে পারিনি। কাজেই ভিনগ্রহীদের সঙ্কেত পেলে আমরা হয়তো তাকে প্রাকৃতিক সঙ্কেতের থাকা আলাদা করে চিনতে পারব, কিন্তু আমরা তার অর্থ উদ্ধার করতে পারব তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। একশো আলোকবর্ষ দূরের তারাকে ব্রহ্মাণ্ডের হিসাবে পাশের ঘর বলতে হবে, সেখানে সঙ্কেত পাঠিয়ে উত্তর পেতে দু'শো বছর লাগবে। আরো দূরের নক্ষত্রের সময়টা আরো বাড়বে। কাজেই বার্তাপ্রেরকদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার সুযোগ নেই। বিজ্ঞানীরা নানা রকম ভাবে ভেবে চলেছেন যে কেমন করে এমন বার্তা পাঠানো সম্ভব যা যে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী পড়তে সক্ষম হবে। বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছে গণিতের উপর, কারণ তার ভাষা অবশ্যই সার্বজনীন। দুই আর তিন যোগ করলে পাঁচ আসবেই, তা ভাষা বা বুদ্ধিমত্তার চরিত্রের উপর নির্ভর করে না।
তবু কিছু আশা আছে, এবং তার পিছনেও আছে বিবর্তনের সাক্ষ্য। আমি চিনা ভাষার বিন্দুবিসর্গ জানি না; আমাকে একটা সে ভাষার বই দিলে আমি তার অর্থ উদ্ধার করব কেমন করে? আমার একটা অভিধান লাগবে। প্রাচীন মিশরের ভাষা আধুনিক মানুষ পড়তে পারত না। রসেটা নামের বিখ্যাত পাথরে একই লেখা মিশরিয় চিত্রলিপি ও ডেমোটিক ভাষায় এবং প্রাচীন গ্রিক ভাষায় লেখা আছে। সেটি আবিষ্কারের পরে মিশরীয় চিত্রলিপির অর্থ উদ্ধার হয়েছিল। আমাদের সিন্ধুলিপি এখনো দুর্বোধ্য, তার একটা বড় কারণ অনুরূপ কিছু আমরা এখনো পাইনি। তাই দুই সভ্যতার মধ্যে বার্তা বিনিময়ের আগে একটা অভিধান দরকার। যাঁরা বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ কার্ল সাগান-এর লেখা কন্ট্যাক্ট উপন্যাসটি পড়েছেন, তাঁদের মনে পড়বে কেমন করে ভিনগ্রহীরা বার্তার সঙ্গে অভিধানও পাঠিয়েছিল।
কিন্তু অভিধান লেখাও মোটেই সহজ নয়। আমাদের ভাষা আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত। ছবি না দেখিয়ে মরুভূমির দেশের লোককে নদীর অর্থ বোঝানো কঠিন। জন্মান্ধ মানুষকে রামধনুর কথা বোঝাতে পারব? জিনতত্ত্ব ও ভাষাবিজ্ঞান থেকে দেখা যায় আফ্রিকাতে পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ বছর আগে এক আদি ভাষার জন্ম হয়, সেই পৃথিবীর সমস্ত ভাষার জননী। একই উৎস থেকে সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও নানা ভাষার এত পার্থক্য যে এক ভাষাভাষী লোক অন্য ভাষা বুঝতে পারে না। তাহলে আমরা ভিন গ্রহের মানুষের ভাষা বুঝব কেমন করে?
গ্রহান্তরের মানুষের সঙ্গে বার্তা বিনিময়ের সমস্যাটা হয়তো আরো জটিল। মুখের ভাষাকেই সঙ্কেতের সাহায্যে লেখা হয়, সেটাই আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম। কিন্তু সেটাই কি একমাত্র উপায়? বধিরদের জন্য আছে ইশারার ভাষা। পৃথিবীতে অনেক প্রাণী আছে যারা শব্দের মাধ্যমে নয়; রঙ, গন্ধ বা অঙ্গভঙ্গীর সাহায্যে বার্তা বিনিময় করে। অক্টোপাস গায়ের রঙ পরিবর্তন করে তার মুড বোঝায়। মৌমাছিদের নাচ অন্য মৌমাছিদের মধুর সন্ধান দেয়। সেই সব ভাষার ব্যাকরণ কি আমাদের ভাষার সঙ্গে মিলবে?
তবু সব ভাষার মধ্যে একটা সাধারণ চরিত্র থাকতেও পারে, তা হল ব্যাকরণ। মধ্য আমেরিকার দেশ নিকারাগুয়ার এক মূকবধিরদের স্কুলের গল্প শোনাই। ১৯৭৭ সালে নিকারাগুয়াতে প্রথম এমন স্কুল তৈরি হয়। সেই স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের স্পেনিয় ভাষা শেখানো শুরু হল। ঠোঁটের নড়াচড়া থেকে কথা বুঝতে বধিরদের শেখানো হচ্ছিল এবং আঙুলের সাহায্যে ইঙ্গিত করে অক্ষরগুলি চেনানো হচ্ছিল। এই পদ্ধতিতে শব্দকে পরপর অক্ষর সাজিয়ে বোঝানো হয়, কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা শব্দ কাকে বলে তাই জানত না; তারা পড়তেও জানত না। শিক্ষকশিক্ষিকারাও এই পদ্ধতিতে খুব একটা সড়গড় ছিলেন না। কিছু দিন পরে তাঁরা খেয়াল করলেন তাঁদের ছাত্রছাত্রীরা খুব সহজেই নিজেদের মধ্যে আভাসে ইঙ্গিতে অনর্গল কথা বলছে, কিন্তু সেই পদ্ধতি তাঁরা শেখাননি এবং ভাষাটাও স্পেনিয় নয়। বিশেষজ্ঞরা এসে দেখলেন শিক্ষার্থীরাই নিজেদের প্রয়োজনে সম্পূর্ণ নতুন এক ভাষার জন্ম দিয়েছে। সেটিকে এখন বলা হয় নিকারাগুয়ান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ।প্রশ্ন হল এই ভাষার ব্যাকরণ কোথা থেকে এলো? আমরা দেখেছি শিশুরা খুব সহজে কথা বলতে শেখে। বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ নোয়াম চমস্কি দেখিয়েছেন এমন কি যখন সেরকম কোনো তাগিদ থাকে না, (চমস্কির ভাষায় Poverty of Stimulus) সেক্ষেত্রেও শিশুরা কথা বলতে শুরু করে দেয়, এবং তাদের ভাষা অনেকটাই ব্যাকরণ মেনে চলে। চমস্কি অনুমান করেছেন জন্মসূত্রেই আমাদের মস্তিষ্কের একটা অংশ ব্যাকরণ বুঝতে পারে। কম্পিউটারের ভাষায় হার্ডওয়্যার হল কম্পিউটারের যন্ত্রপাতি, যাকে পরিবর্তন করতে গেলে যন্ত্রটারই পরিবর্তন করতে হবে, সফটওয়ার হল কম্পিউটারের ভাষায় লেখা প্রোগ্রাম। আমরা বলতে পারি ব্যাকরণ মস্তিষ্কের হার্ডওয়্যারের উপর নির্ভর করে, আর ভাষা হল সফটওওয়ার। মস্তিষ্কে ব্যাকরণের জন্য হার্ডওয়্যারের জন্ম এলো কোথা থেকে? আমাদের মস্তিষ্কের হার্ডওয়ার হল জিনগত, বিবর্তনের ফসল। অর্থাৎ ব্যাকরণ জ্ঞান হয়তো প্রাণীকে অস্তিত্বের সংগ্রামে কিছু সুবিধা দেয়। সেক্ষেত্রে উন্নত যে কোনো প্রাণী, সে যে গ্রহেই জন্মাক না কেন, তার মস্তিষ্ক সমতুল্য অঙ্গে একই ধরনের কিছু আছে। তাই যদি হয়, তাহলে ভাষার ব্যাকরণ হয়তো আদৌ ভাষার উপর নির্ভর করে না, সেক্ষেত্রে কোনোদিন ভিনগ্রহীদের সঙ্কেত পেলে আমরা হয়তো তার অর্থ বুঝতে পারব।
কত পুরানো এই হার্ডওয়্যার? এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ভাষার সৃষ্টি মানুষকে বুদ্ধিমত্তার বিকাশের পথে এগিয়ে দিয়েছিল। মানুষ ভাষার আবিষ্কার করেছে কত বছর আগে? বিবর্তন শিক্ষা দেয় আধুনিক মানুষ ও নিয়ান্ডারথাল প্রজাতি হিসাবে আলাদা হয় মোটামুটি পাঁচ থেকে আট লক্ষ বছর আগে, যদিও আধুনিক বিজ্ঞান দেখায় তার পরেও এই দুয়ের মধ্যে আন্তঃপ্রজনন ঘটেছিল এবং আধুনিক মানুষের দেহে নিয়ান্ডারথাল জিন আছে। নিয়ান্ডারথালদের স্বরযন্ত্র বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত করেছেন তাদের কথা বলার ক্ষমতা ছিল। দুই ভিন্ন প্রজাতি আলাদা আলাদা করে কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করেছিল, তার থেকে বেশি সম্ভাবনা দুয়ের সাধারণ পূর্বপুরুষেরই সেই ক্ষমতা ছিল।
আরো আগে? বনমানুষ বা গ্রেট এপদের থেকে মানুষ প্রজাতি হিসাবে পৃথক হয়েছিল পঞ্চাশ লক্ষ থেকে এক কোটি বছর আগে। কোনো গরিলা বা শিম্পাঞ্জি অবশ্যই ভাষার উদ্ভাবন করেনি, কিন্তু তাদের শেখানো সম্ভব। সান ফ্রানসিসকো চিড়িয়াখানার গরিলা কোকো প্রায় আমেরিকান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের প্রায় এক হাজার শব্দ বুঝতে পারত ও ব্যযহার করতে পারত। নেভাদা চিড়িয়াখানার ওয়াশো নামের শিম্পাঞ্জি ছশো এমন শব্দ চিনেছিল, এমনকি নতুন শব্দ তৈরি করতেও পারত; হাসকে বলেছিল জলপাখি। সুতরাং ভাষার সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা হয়তো পঞ্চাশ লক্ষ বছরের থেকেও বেশি পুরানো।
এর পরের প্রশ্ন হল ভাষার সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা কি মানুষ আর বনমানুষদেরই একচেটিয়া? নাকি বিবর্তন অন্য প্রাণীদেরও সেই ক্ষমতা দিয়েছে। ধরা যাক ভেরভেট বাঁদরের কথা। তারা দল বেঁধে যখন খাবারের সন্ধান করে, তখন একজন পাহারা দেয়। সাবধান করার জন্য পাহারাদার তিন রকমের আওয়াজ করে, যাকে আমরা বলব লেপার্ড, সাপ ও ঈগল। লেপার্ড শুনলে ভেরভেটরা গাছে উঠে পড়ে, সাপ শুনলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘাসের দিকে দৃষ্টি দেয়, আর ঈগল শুনলে কাছের শিকড়বাকড়ের মধ্যে আশ্রয় নেয়। একে কি ভাষা বলব?
জিনগত দিকে থেকে ভেরভেট বাঁদর ও মানুষের দূরত্ব হয়তো খুব বেশি নয়, দুইই প্রাইমেট বর্গের মধ্যে পড়ে। সেই তুলনায় ডলফিনরা মানুষের অনেক দূরের আত্মীয়। ডলফিনের মস্তিষ্ক মানুষের থেকে বড়, অবশ্য তার মূল কারণ তাদের দেহও অনেক বড়। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে তাদের ভাষা খুবই জটিল, তাতে বিভিন্ন জিনিস বোঝাতে বিভিন্ন শব্দ আছে, এবং সেই শব্দ সাজিয়ে ডলফিনরা বাক্য গঠন করে, বাক্যের শেষে যতি দেয়; অবশ্য সেই বাক্যের অর্থ এখনো আমরা উদ্ধার করতে পারিনি। পূর্ণবয়স্ক বটলনোস ডলফিনের হুইসলের দৈর্ঘ্যের জিফ সূচক হল -০.৯৫, অর্থাৎ আমরা না বুঝতে পারলেও সম্ভবত তার অর্থ আছে। (এই লেখার জিফ-মেন্ডেলব্রট বিশ্লেষণ করে সূচক পেয়েছি -০.৬২, তার মানে কি আমার ভাষার থেকে ডলফিনদের ভাষা উন্নত? অনুমান করি তা নয়; বাংলা ভাষাতে যুক্তাক্ষরের ব্যবহার খুব বেশি, তাকে আমি হিসাবে নিইনি। আমাদের ভাষার জিফ সূচক বিষয়ে কোনো গবেষণার সন্ধান আমি পাইনি। তবু সূচকের মান থেকে মনে হয় একটু বড় শব্দ ব্যবহারের দিকে আমার ঝোঁক আছে, এবং বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেখাতে একটু বড় শব্দ বেশি ব্যবহারই স্বাভাবিক।) ডলফিনের ভাষার এনট্রপি বিশ্লেষণও তার অর্থবহতার দিকে ইঙ্গিত করছে। প্রত্যেক ডলফিনদের আলাদা আলাদা নাম আছে; বাচ্চা জন্মানোর পরে মা ডলফিন তাকে একটা বিশেষ আওয়াজ করে ডাকতে থাকে, সে ঐ শব্দের সাহায্যে নিজেকে চিহ্নিত করে, পরে দলের অন্যরাও সেই শব্দের সাহায্যে তাকে চেনে। আমাদের মস্তিষ্ক ও হাতের দক্ষতার বিবর্তন একই সঙ্গে হয়েছিল, অথচ ডলফিনের হাতের সমতুল্য কোনো অঙ্গই নেই। আরো দূরে যাই; অমেরুদণ্ডী প্রাণী অক্টোপাস নিজের গায়ের রঙ পাল্টে এবং নানা অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ করে। কোনো কোনো প্রজাতির অক্টোপাস একশোর মতো এমন 'শব্দ'-কে ব্যবহার করে বেশ জটিল বার্তা দেয় বলে অনুমান করা হয়। মানুষ, ডলফিন ও অক্টোপাসের সাধারণ পূর্বপুরুষ ভাষার সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারত না। তার অর্থ বিবর্তনে ভাষা একাধিকবার উদ্ভাবিত হয়েছে। তাই অনুমান করি ভাষা হয়তো যে কোনো উন্নত জীবেরই বৈশিষ্ট্য, ব্যাকরণ হয়তো প্রজাতি নিরপেক্ষ।
তবে সব ভাষা আমরা কি পড়তে পারব? জগতের চেহারা হয়তো কেমনভাবে তার খবর নিচ্ছি তার উপরেও নির্ভর করে। ডলফিন জলের তলা পর্যবেক্ষণের জন্য শব্দতরঙ্গকে ব্যবহার করে; শব্দতরঙ্গে তাকে বাধার পিছনেও দেখতে দেয় আলো যেখানে অচল। আমাদের আলোর জগৎ তার সঙ্গে মিলবে কি?
সূর্যের আলোতে দেখার জন্যই আমাদের চোখ অভিযোজিত। সূর্যের আলোতে অতিবেগুনি রশ্মির পরিমাণ কম, তাই আমাদের চোখ অতিবেগুনি আলোতে সাড়া দেয় না। সূর্যের থেকে অনেক বেশি উত্তপ্ত নক্ষত্রের গ্রহের কোন প্রাণী হয়তো অতিবেগুনি আলোতে দেখতেই অভ্যস্ত; তার কাছে জগতের চেহারা সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা যে রঙ দেখি, বাস্তবে তার কোন অস্তিত্ব নেই; তা আমাদের মস্তিষ্কের সৃষ্টি। ধরা যাক, সবুজ রঙের কথা। যদি কোনো বস্তু থেকে শুধু সবুজ রঙের আলো বেরোয়, তাকে আমরা সবুজ দেখি। কিন্তু যদি সেই বস্তু থেকে লাল ছাড়া অন্য সব রঙের আলো বেরোয়, তাকেও আমরা সবুজ দেখি। তাই রঙের বিষয়টা অন্য গ্রহের প্রাণীর কাছে হয়তো আদৌ বোধগম্য হবে না।
অনেক প্রাণীই দ্বিমাত্রিক ছবি বুঝতে পারে না। বনমানুষ বা ডলফিন আয়নায় নিজেকে চিনতে পারে, কিন্তু অক্টোপাস পারে না। অক্টোপাস সম্ভবত আয়নার প্রতিবিম্বকেই বুঝতে পারে না । তার সম্ভাব্য কারণটা খুব আকর্ষণীয়। আলোর পোলারাইজেশন বা সমবর্তন বলে একটা ধর্ম আছে, যা আলোর কম্পনের সঙ্গে যংশ্লিষ্ট। ত্রিমাত্রিক সিনেমাতে এই ধর্ম ব্যবহার করা হয়, আমাদের চোখ সেটা দেখতে পারে না, তাই বিশেষ চশমা ব্যবহার করতে হয়। অক্টোপাসের চোখ সমবর্তন ধরতে পারে। আয়নাতে প্রতিফলনের সময় আলোর সমবর্তন চরিত্র পাল্টে যায়, তাই মূল বস্তু আর তার প্রতিবিম্ব অক্টোপাসের কাছে আলাদা।
তাই বিজ্ঞানীরা ডলফিন, বানর, বনমানুষ, অক্টোপাস ইত্যাদিরা কেমনভাবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখে তা বুঝতে চাইছেন। মানুষের সৃষ্ট পুঁথির রহস্য উদ্ধার করতে আমরা পারছি না, তাই ভিনগ্রহীদের বার্তার অর্থ উদ্ধার হয়তো সহজ হবে না। ভিনগ্রহীদের সঙ্গে যোগাযোগ হবে কিনা জানি না, হলেও ডলফিনের বা অক্টোপাসের ভাষা আমাদের সাহায্য করবে কিনা তাও ভবিষ্যতের কথা। কিন্তু যেদিন এই পৃথিবীরই অন্য প্রাণীদের ভাষা বুঝতে পারব, সেদিন হয়তো আমাদের একাকীত্ব ঘুচবে, মানুষ পাবে কথা বলার সঙ্গী।
(প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, উৎসব সংখ্যা ২০২৫, কার্টুন ছবিগুলি Chat GPT-র সাহায্যে আঁকা)
No comments:
Post a Comment