Friday, 29 December 2017
Sunday, 24 December 2017
মৌলিক কণা আবিষ্কারের গল্প
মৌলিক কণা আবিষ্কারের গল্প
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
হিগস
বোসন আবিষ্কারের কথা আমরা সবাই শুনেছি। হিগস বোসনকে আমরা বলছি মৌলিক কণা। এরকম আরো
অনেক কণার কথা আমরা শুনে থাকি। মৌলিক কণা বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি? ছোটবেলায় পড়েছি,
যে সব পূর্ণ সংখ্যাকে এক এবং সেই সংখ্যা ছাড়া অন্য কোনো সংখ্যা দিয়ে ভাগ দিলে ভাগশেষ
পড়ে থাকে, তাদের বলে মৌলিক সংখ্যা। ঠিক তেমনই, সাধারণ ভাবে যে কণাকে আর ভাগ করা যায়
না, তাকেই আমরা মৌলিক বলে থাকি। মনে রাখতে হবে বিজ্ঞান এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে আসাদের জানার
পরিধিও বেড়েছে। তাই একদিন যাকে মৌলিক মনে হয়েছিলো, পরে হয়তো দেখেছি তাকেও আরো ভাগ
করা যায়। সমস্ত পদার্থই মৌলিক কণা দিয়ে তেরি। শুধু তাই নয়, পরে আমরা দেখব এই সমস্ত
মৌলিক কণাদের নিজেদের মধ্যে আকর্ষণ বিকর্ষণের জন্যও দায়ী আরো এক ধরনের মৌলিক কণা।
মৌলিক
কণা আবিষ্কারের গল্প কিন্তু বেশ মজার। কখনো কখনো হয়তো কোনো কণা হঠাৎই আবিষ্কার হয়ে
গেছে। কখনো বা ঠিক যেমন হিগস কণার কথা বিজ্ঞানীরা আগে থেকে বলেছিলেন, পরে তাকে পাওয়া
গেছে, তেমনও ঘটেছে। অনেক সময় কণাকে দেখা গেলেও প্রথমে বিজ্ঞানীরা তাকে চিনতে পারেননি।
পরে অন্য কোনো বিজ্ঞানী হয়তো সেই কণাটাকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। আবার কখনো বা
এমনও হয়েছে যে মানুষ ভেবেছে কণাটার পরিচয় এক, পরে দেখা গেছে যে আসলে তা অন্য এক কণা।
মানবসভ্যতার
সূচনা থেকেই মানুষ প্রশ্ন করেছিলো, তার চারদিকে যত কিছু দেখা যায় কিছু কী দিয়ে তৈরি।
যেমন প্রাচীন ভারতীয়রা কল্পনা করেছিলো, বিশ্ব জগতের মূলে আছে পঞ্চভূত অর্থাৎ পাঁচটি
মৌলিক পদার্থ। প্রাচীন গ্রীসে ডেমোক্রিটাস আর আমাদের দেশে কণাদ কল্পনা করেছিলেন যে
সমস্ত কিছুর মূলে আছে মৌলিক পদার্থের পরমাণু। তবে পরবর্তীকালে গ্রীসে সক্রেটিস এবং
প্লেটো আর ভারতে শঙ্করাচার্যের মতো দার্শনিকদের তীর আক্রমণের সুখে পরমাণুবাদের প্রায়
অবলুপ্তি ঘটে। পরমাণুবাদ হল বস্তুবাদের মূল ভিত্তি, ভাববাদী দার্শনিকদের আক্রমণের মুখোমুখি
যে তাকে হতে হয়েছিলো, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডে
জন ডালটন রসায়ন বিজ্ঞানের নানা সূত্র ব্যাখ্যা করতে আবার পরমাণুবাদকে ফিরিয়ে আনেন।
তিনি দেখান যে রা্সায়নিক বিক্রিয়ার সময় বিভিন্ন পদার্থ নিজেদের মধ্যে যে অনুপাতে
বিক্রিয়া করে, সমস্ত কিছু পরমাণু দিয়ে তৈরি ধরলে তার একটা সুন্দর ও সহজ ব্যাখ্যা
পাওয়া যায়। পরবর্তী কালে অ্যাভোগাড্রোর কাজ থেকে এই ধারণাটা আরো পরিষ্কার হয়। সারা
ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়েই চলেছিল পরমাণুবাদকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা এবং তার বিরোধিতা।
রসায়নের
অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝলাম সমস্ত বস্তুই কতগুলো মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। এই
মৌলিক পদার্থদের কেমন ভাবে সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে এই ব্লগেরই অন্য লেখায় আলোচনা
আছে। মৌলিক পদার্থের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে নব্বই ছাড়িয়ে গেলো। স্বাভাবিকভাবেই পরমাণুবাদের
সমর্থক অনেক বিজ্ঞানীর মনে প্রশ্ন জাগল, এতগুলো মৌলিক পদার্থের পরমাণু, এদের সবার গঠনে
কি কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে? অন্য ভাবে বললে, আমরা যে লক্ষ কোটি রকম পদার্থকে চিনি,
তারা একশোরও কম পরমাণু দিয়ে তৈরি। এই সব পরমাণুগুলোকে ভাঙলে কি আরো মৌলিক কোনো কিছু
পাওয়া যেতে পারে?
আমাদের
কাহিনি শুরু হচ্ছে উনিশ শতকের একদম শেষে। বিজ্ঞানীরা সে সময় একটা নতুন পরীক্ষা করছিলেন।
একটা দুমুখ খোলা নলের দুপাশে দুটো তড়িদদ্বার বা ইলেকট্রোড আছে। নলের দুই প্রান্তের
দেয়ালে জিঙ্ক সালফাইডের মতো কোনো প্রতিপ্রভ বা ফ্লুরোসেন্ট পদার্থ লাগানো থাকে। এবার
নলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যদি বিদ্যুৎ পাঠানো যায়, নলের দেয়ালে একটা উজ্জ্বল
বিন্দু দেখা যায়। বোঝা যাচ্ছে যে প্রতিপ্রভ পদার্থের উপর কোনো একটা অদৃশ্য রশ্মি গিয়ে
পড়ছে। অনেক বিজ্ঞানী এই আলোর উপর পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। তাদের মনে হল যে নল
থেকে যখন গ্যাস বার করে নেয়া হচ্ছে, তখন এই রশ্মির সঙ্গে নিশ্চয় গ্যাসের কোনো সম্পর্ক
নেই। তাহলে কি এটা তড়িতের কোনো মৌলিক রূপ? তবে সবাই এবিষয়ে একমত ছিলেন না। সবে তখন
এক্স- রশ্মি আবিষ্কার হয়েছে, তাকেও তো চোখে দেখা যায় না। আমরা জানি এক্স-রশ্মি একরকম
আলো, বা বিজ্ঞানের ভাষায় তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ।
অনেক
বিজ্ঞানী মনে করছিলেন, এই নতুন রশ্মিটাও আলোরই আর এক রূপ। ঋণাত্মক ইলেকট্রোড বা ক্যাথোড
থেকে এই রশ্মিটা বার হয়ে ধনাত্মক ইলেকট্রোড বা আনোডের দিকে যায় বলে রশ্মিটার নাম
দেয়া হল ক্যাথোড রশ্মি। ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে
জোসেফ জন টমসন এই নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন যে অদৃশ্য রশ্মির উপর যদি
তড়িৎ বা চুম্বক বল প্রয়োগ করা হয়: তাহলে রশ্মির পথ বেঁকে যায়। তার মানে হল যে ক্যাথোড
রশ্মির আধান বা বৈদ্যুতিক চার্জ আছে। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের বৈদ্যুতিক আধান থাকা সম্ভব
নয়, আধান থাকে এক মাত্র কোনো কণার। টমসন এই কণার আধান বা তার ভর কোনোটাই মাপতে পারলেন
না। আসলে সেগুলোর মান এতই ছোটো যে সে সময় তাদের মাপার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু তিনি
কণার অন্য একটা গুণ বা ধর্ম মাপতে সক্ষম হলেন। তড়িৎ বা চুম্বক ক্ষেত্রে রশ্মিটা কতটা
বেঁকে যায় বা বিক্ষিপ্ত হয়; সেটা মেপে তিনি কণাটা আধানকে তার ভর দিয়ে ভাগ করলে যে
সংখ্যাটা পাওয়া যায়, সেটা বার করলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন যে তাঁর ক্যাথোড বা অ্যানোড
তড়িদদ্বার যে ধাতু দিয়েই তৈরি হোক বা নলের মধ্যে যে গ্যাসই থাকুক না কেন, এই সংখ্যাটার
কোনো পরিবর্তন ঘটে না। তার মানে হল যে সমস্ত পদার্থের মধ্যেই এই নতুন কণাটা আছে। তাছাড়া
আধান ও ভরের অনুপাত থেকে এটাও বোঝা গিয়েছিলো যে নতুন কণাটা খুবই হাল্কা। রসায়ন থেকে
আমাদের পরমাণুর ভর ও আধানের অনুপাত সম্পর্কে একটা ধারণা ছিল। সবচেয়ে হাল্কা যে পরমাণু
হাইড্রোজেন, নতুন কণাটার ভর তার মোটামুটি দুহাজার ভাগের এক ভাগ। টমসন বুঝতে পারলেন
যে পরমাণু ভেঙে এই কণাটা আসছে। বিদ্যুৎ বা ইলেকট্রসিটি বয়ে নিয়ে যায় বলে তিনি এর
নাম দিলেন ইলেকট্রন।
১৮৯৭
সালের ২৯শে এপ্রিল, শুক্রবার টমসন লন্ডনের রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে তিনি তাঁর আবিষ্কারের
কথা ঘোষণা করেন। প্রথমে অনেক বিজ্ঞানীরই টমসনকে মেনে নিতে আপত্তি ছিল। তাঁদের অনেকেই
পরমাণুবাদেই বিশ্বাস করতেন না -- টমসনের কথা মানতে গেলে তাঁদের ধরে নিতে হবে পরমাণুর
শুধু যে অস্তিত্ব আছে তা নয়, তাকে ভাঙাও যায়। জনৈক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী (টমসন তাঁর
নাম করেননি) টমসনকে পরে বলেছিলেন যে তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন টমসন সকলের সঙ্গে মজা করছেন।
তবে নানা পরীক্ষানিরীক্ষার পরে সবাই নিশ্চিত হলেন যে টমসনই ঠিক বলছেন। ইলেকট্রনই আমাদের
আবিষ্কৃত প্রথম মৌলিক কণা। ১৯০৬ সালে টমসন তাঁর আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেন।
১৯০৯ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট মিলিক্যান ইলেকট্রনের আধান বার করতে সক্ষম হলেন।
এর মান খুবই কম: 1.6 X 10-19 কুলম্ব, অর্থাৎ গ্রামে লিখলে, দশমিকের পরে
আঠারোটা শূন্য, তার পরে 16। একই সঙ্গে ভরটাও পাওয়া গেলো) 9.1 X 10-28 গ্রাম।
মিলিক্যান নোবেল পুরস্কার পেলেন ১৯২৩ সালে। তাঁর নোবেল পুরস্কারে দুটি বিষয়ের উল্লেখ
ছিল, তার মধ্যে একটি ইলেকট্রনের আধান নির্ণয়। অন্য যে কৃতিত্বের জন্য নোবেল কমিটি
তাঁকে মনোনীত করেছিলো, তার কথা এর পরেই আসবে।
জে জে টমসন |
রবার্ট মিলিক্যান |
প্রথমেই
বলেছি যে বস্তু যে শুধু মৌলিক কণা দিয়ে তৈরি তা নয়, তাদের পরম্পরের মধ্যে আকর্ষণ-বিকর্ষণের
জন্যও দায়ী অপর এক ধরনের মৌলিক কণা। মৌলিক কণাদের আমরা সাধারণ ভাবে দুভাগে ভাগ করতে
পারি একদল হল বস্তু কণা, অপর একদল হল বল কণা। ইলেকট্রন যেমন বস্তু কণা। সময়ের হিসেবে
বলতে গেলে এর পর যে মৌলিক কণার কথা আমরা জানতে পারি, তা হল এক বল কণা। যাঁরা কোয়ান্টাম
তত্ত্বের কথা জানেন, তাঁরা জানেন যে এদের পোশাকি নাম হল বলের ক্ষেত্রের কোয়ান্টাম।
এবার আমরা একটা বল কণার গল্প শুনবো।
আমাদের
পিছিয়ে যেতে হবে ১৮৮৭ সালে। সেই বছর জার্মানিতে হাইনরিখ হার্জ আবিষ্কার করেন যে কোনো
ধাতুর উপর আলো পড়লে তার থেকে ঋণাত্মক তড়িৎ বেরিয়ে আসে। এই ঘটনাকে বলে আলোকতড়িৎ
ক্রিয়া। টমসনের আবিষ্কারের পর বোঝা গেলো যে ধাতু থেকে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসছে। নানা
পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বিজ্ঞানীরা দেখলেন যে আলো পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রন বেরিয়ে
আসে - দুটো ঘটনার মধ্যে সময়ের কোনো ব্যবধান থাকে না। আলোর রঙের সঙ্গে আলোক তরঙ্গের
কম্পাঙ্কের সম্পর্ক আছে। রামধনুতে আমরা সবাই দেখেছি যে একদিকে থাকে লাল আর অন্যদিকে
বেগুনি আলো। বেগুনি আলোর কম্পাঙ্ক বেশী, লাল আলোর কম। দেখা গেলো আলোর কম্পাঙ্ক বাড়ালে
যে ইলেকট্রন বেরোচ্ছে, তার বেগ বা গতিশক্তি বেড়ে যায়। একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের
চেয়ে কম হলে ইলেকট্রন বেরোনো বন্ধ হয়ে যায়। একই রঙের, অর্থাৎ একই কম্পাঙ্কের আলোর
তীব্রতা বাড়ালে ইলেকট্রনের সংখ্যা বেড়ে যায়, কিন্তু তাদের বেগের কোনো পরিবর্তন হয়
না।
তার
আগে দুশো বছর জুড়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে যে আলো তরঙ্গ। ঊনবিংশ
শতাব্দীতে বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল দেখিয়েছিলেন যে আলো আসলে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ। অথচ
সমস্যাটা হল আলোর তরঙ্গধর্ম দিয়ে এই ব্যাপারগুলো ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিলো না। একটা সহজ
উদাহরণ নেয়া যাক। ধরা যাক, সমুদ্রের ধারে একটা বাচ্চাদের প্লাস্টিকের ফুটবল আছে। সমুদ্রের
কোনো উঁচু ঢেউ ফুটবলটাকে ধাক্কা মারলে সেটা
চলতে শুরু করবে। আরো উঁচু ঢেউ এসে পড়লে ফুটবলটা আরো জোরে যাবে। সমুদ্রের ঢেউ হল আলোক
তরঙ্গ আর বল হল ইলেকট্রন। আলোর ঢেউ আরো উঁচু হওয়া মানে আলোর তীব্রতা বাড়ে। তাহলে
আলোর তীব্রতা বাড়লে ইলেকট্রনের বেগ বেড়ে যাওয়া উচিত ছিল। দুটো ঢেউয়ের মধ্যে সময়ের
কতটা তফাত, সেটার সঙ্গে তরঙ্গের কম্পাঙ্ক যুক্ত। বেগুনি আলোর জন্য তফাতটা কম, লাল আলোর
জন্য বেশী। ফুটবলটা কত জোরে যাবে, তা নিশ্চয় দুটো ঢেউয়ের মধ্যে কতটা সময়ের ব্যবধান
তার উপর নির্ভর করে না। কিন্তু ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই ঘটছে। তার মানে আলোর
তরঙ্গধর্ম আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছে না।
বিজ্ঞানীরা
এক দশকেরও বেশী আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা করতে পারছিলেন না। এর পরের ঘটনা অনেকেরই
জানা। ১৯০৫ সালে সুইজারল্যান্ডের বার্নের পেটেন্ট অফিসের কেরানি আলবার্ট আইনস্টাইন
কয়েকটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সম্ভবত আপেক্ষিকতা সংক্রান্ত
দুটি গবেষণাপত্র। অন্য এক গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন দেখান যে আলোকে যদি আমরা তরঙ্গ না
ভেবে কণা বলে ধরে নিই, তাহলে সহজেই আলো তড়িৎ ক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করা যায়। কণার সংখ্যা
বেশী হলে আলোর তীব্রতা বাড়ে। আলোর কম্পাঙ্ক যদি বেশী হয়, তাহলে কণার গতিশক্তি বেড়ে
যায়। এখন ব্যাপারটা খুব সহজ। আলোর কণা ইলেকট্রনকে ধাক্কা মারে। তীব্রতা বাড়লে আলোর
কণার সংখ্যা বাড়ে, সুতরাং তারা ধাতু থেকে বেশী ইলেকট্রন বার করে। কম্পাঙ্ক বাড়লে
আলোর কণার গতিশক্তি বাড়ে, তখন তা ইলেকট্রনকে আরো জোরে ধাক্কা মারে, ফলে ইলেকট্রনের
বেগ বেড়ে যায়। আইনস্টাইন দেখান যে আলোর কম্পাঙ্ককে প্ল্যাঙ্ক আবিষ্কৃত ধ্রুবক দিয়ে
গুণ করলে আলোর কণার শক্তির পরিমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তী কালে আলোর কণার নাম দেয়া হয়
ফোটন। এই কাজের জন্যই ১৯২১ সালে আইনস্টাইন নোবেল পুরস্কার পয়ান। মিলিক্যান পরে প্রমাণ
করেন আইনস্টাইনের তত্ত্ব পুরোপুরি ঠিক; তাঁর নোবেল পুরস্কারে অন্য যে বিষয়ের উল্লেখ
ছিল, তা হল আলোকতড়িৎ ক্রিয়া। ভাবলে মজা লাগে, মিলিক্যান আইনস্টাইনের তত্ত্বে বিশ্বাস
করতে পারেননি বলে তাঁকে ভুল প্রমাণ করার জন্যই কাজ শুরু করেছিলেন।
আলবার্ট আইনস্টাইন |
আলো
তাহলে আসলে কী? আধুনিক বিজ্ঞান বলছে আলো একই সঙ্গে তরঙ্গ, আবার কণাও বটে। এই নিয়ে
আলোচনা করার মতো সুযোগ এই লেখাতে নেই -- এই ব্লগের অন্য লেখাতে তা পাওয়া যাবে। শুধু
একটা কথা বলা দরকার। আমরা জানি যে বিভিন্ন বস্তু কণা নিজেদের মধ্যে চারটে বলের মাধ্যমে
ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া করে। তারা হল মাধ্যাকর্ষণ, তড়িৎচৌম্বক বল, দুর্বল বল ও সবল বল।
আমরা জানি গ্রহ উপগ্রহ তারা পরস্পরকে যে বলে
আকর্ষণ করে; তা হল মাধ্যাকর্ষণ। নিউটন এই বলকে আবিষ্কার করেন। সবল ও দুর্বল বলের কথা
পরে আসবে, তারা নিউক্লিয়াসের মধ্যে কাজ করে। এছাড়া আমরা যে সমস্ত বলের মুখোমুখি হই,
তারা আসলে তড়িৎচৌম্বক বল। তড়িৎ আধান, চুম্বক
বা তড়িৎপ্রবাহের জন্য যে বল পাওয়া যায়: তাকে আমরা সহজেই তড়িৎচৌম্বক বল বলে সহজেই
চিনতে পারি। দুটি কণা এই বলের মাধ্যমে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া করে অর্থাৎ তাদের মধ্যে
ফোটন কণার বিনিময় হয়। তাই ফোটন হল তড়িৎচৌম্বক বলের কণা। এটাই প্রথম আবিষ্কৃত বল কণা।
এর
পর আমরা আবার বস্তু কণায় ফিরে যাব। এবার যে কণার কথা বলতে হয়, তা হল প্রোটন। মনে
রাখতে পরমাণু সব মিলিয়ে আধান শূন্য, কাজেই ইলেকট্রন যদি ধনাত্মক আধান থাকে, তাহলে
নিশ্চয় ধনাত্মক আধান পরমাণুর মধ্যে কোনো এক জায়গায় আছে। ইতিমধ্যে ১৯১১ সালে ইংল্যান্ডের
ম্যানচেস্টারে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড দেখিয়েছেন যে পরমাণুর কেন্দ্রে
আছে ছোট্ট নিউক্লিয়াস -- তার মধ্যে আছে পরমাণুর প্রায় সমস্ত ভর এবং সমস্ত ধনাত্মক
আধান। ইলেকট্রনেরা আছে বাইরে। কত ছোটো এই নিউক্লিয়াস? পরমাণুর ব্যাস মোটামুটি এক সেন্টিমিটারের
দশ কোটি ভাগের এক ভাগ। নিউক্লিয়াসের ব্যাস হল তার দশ হাজার ভাগের এক ভাগ। পরমাণুকে
বাড়িয়ে যদি কলকাতার নেতাজি ইনডোর মাঝে একটা ছোটো মাছির মতো বড়ো। বোঝাই যাচ্ছে: পরমাণুর
ভিতরে অধিকাংশ জায়গাই ফাঁকা।
আাঁরি
বেকারেল দেখিয়েছিলেন যে নিউক্লিয়াস থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি বেরোয়। তিন ধরনের তেজস্ক্রিয়
রশ্মি আছে; তাদের নাম দেয়া হয়েছিলো আলফা, বিটা ও গামা বিকিরণ। বিটা বিকিরণ হল আসলে
ইলেকট্রন কণার স্রোত। গামা রশ্মি হল উচ্চ কম্পাঙ্কের আলো। রাদারফোর্ড দেখালেন যে আলফা
কণা হল হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। তিনি আলফা কণা
দিয়েই পরমাণুকে ধাক্কা মেরেছিলেন। ১৯১৭ সাল নাগাদ অন্য এক পরীক্ষায় রাদারফোর্ডের
পরামর্শে তাঁর ছাত্র মার্সডেন নাইট্রোজেন গ্যাসকে আলফা কণা দিয়ে ধাক্কা মারলেন। তিনি
নতুন এক কণা পেলেন যাচ্ছে যার আধান ইলেকট্রনের আধানের মানের সমান কিন্তু ধনাত্মক। নতুন
কণাটার ভর হল হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরের প্রায় সমান। আগেই জানা ছিল যে হাইড্রোজেন হল
সবচেয়ে হালকা পরমাণু আর তাতে ইলেকট্রন আছে একটা। সহজেই বোঝা গেলো যে নতুন কণাটা হল
হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস।
হাইড্রোজেনের
নিউক্লিয়াস এলো কোথা থেকে? আলফা কণা নাইট্রোজেনের নিউক্লিয়াসকে ধাক্কা মারার ফলে
তার থেকে হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস বেরোচ্ছে। অর্থাৎ হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস নাইট্রোজেনের
নিউক্লিয়াসের মধ্যে আছে। রাদারফোর্ডরা একই সঙ্গে দুটো আবিষ্কার করেছেন। প্রথমত তাঁরা
পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভাঙতে সক্ষম হয়েছেন। একই সঙ্গে তারা দেখালেন যে হাইড্রোজেনের
নিউক্লিয়াস অন্য সব পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকে। তার নাম তাঁরা দিলেন প্রোটন।
আর্নেস্ট রাদারফোর্ড |
আর্নেস্ট মার্সডেন |
ইলেকট্রন
এবং প্রোটনকে কে পরীক্ষাগারেই প্রথম পাওয়া গিয়েছিলো আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার পরীক্ষার
ফলকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফোটনের কথা আইনস্টাইন প্রথম বলেন। মানে আগে পরীক্ষা, তার
অনেক পরে তত্ত্বগত ভাবে কণাটার কথা বিজ্ঞানীরা বললেন। নিউট্রিনো, নিউট্রন বা পজিট্রনের
মতো কণাদের বেলায় ব্যাপারটা উল্টো। বিজ্ঞানীরা আগে এই কণাদের অস্তিত্বের কথা বলেছিলেন,
তার পরে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে প্রথমে আমরা পজিট্রনের কথা বলবো।
১৯২৯
সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী পল ডিরাক ইলেকট্রনের গতিবিধি ব্যাখ্যা করার জন্য একটি তত্ত্ব তৈরি
করেন। তা থেকে দেখা যায় ইলেকট্রনের সমান ভরের একটা কণা থাকা উচিত, যার তড়িৎ আধানের
মান ইলেকট্রনের সমান, কিন্তু ধনাত্মক। আমাদের অনেকে হয়তো প্রতিকণা বা আ্যান্টিপার্টিকলের
নাম শুনেছি। এই নতুন কণাটা হল ইলেকট্রনের প্রতিকণা। প্রথমে অবশ্য ডিরাক নতুন কণাটাকে
প্রোটন বলে ভেবেছিলেন, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারেন।
কণাটাকে
পাওয়া যাবে কোথায়? সাধারণ বস্তুর মধ্যে তাকে আমরা খুঁজে পাব না, কারণ তার মধ্যে প্রচুর
ইলেকট্রন আছে। এই ধনাত্মক ইলেকট্রন কোনো একটা সাধারণ ইলেকট্রনের কাছাকাছি এলে দুজনে
ধ্বংস হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক রশ্মিতে তাকে খুঁজতে শুরু করেন, কারণ সেখানে
অনেকসময় নতুন কণা তৈরি হয়। মহাকাশ থেকে সব সময় আমাদের পৃথিবীতে এসে মহাজাগতিক রশ্মি
পড়ছে - তার মধ্যে আছে নানা ধরনের মৌলিক কণা। মৌলিক কণা খোঁজার জন্য ব্যবহার করা হত
ক্লাউড চেম্বার। তার মধ্যে দিয়ে কোনো তড়িৎ আধান যুক্ত কণা গেলে তার পথের ফটো তোলা
যায়। সেই ফটোগ্রাফ বিশ্লেষণ করে কণাটার আধানের পরিমাণ ও ভর পাওয়া যায়। ক্লাউড চেম্বার
আবিষ্কারের জন্য উইলসন ১৯২৭ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। মার্কিন বিজ্ঞানী কার্ল
অ্যান্ডারসন ১৯৩২ সালে তাঁর ক্লাউড চেম্বারে এই নতুন কণাটিকে খুঁজে পান। তিনি এর নাম
দেন পজিট্রন। ১৯৩৬ সালে নোবেল কমিটি তার নাম নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করে। ডিরাককে
তাঁরা আগেই ১৯৩৩ সালে সম্মানিত করেছিলেন।
চার্লস উইলসন |
কার্ল অ্যান্ডারসন |
পল ডিরাক |
পজিট্রনকে
কিন্তু আরো আগে বিজ্ঞানীরা দেখেছিলেন। ১৯২৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে স্কোবেল্টসিন এবং
১৯২৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চুং ইয়াও চাও ক্লাউড চেম্বারে পজিট্রনের ফটো তুলেছিলেন,
কিন্তু তাঁরা ব্যাপারটা বুঝতে পারেন নি। কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৫
সালে নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী দম্পতি আইরিন ও ফ্রেডরিক জোলিও কুরিরাও পজিট্রনের ছবি তুলেছিলেন,
কিন্তু তারা সেটাকে প্রোটন মনে করে কোনো গুরুত্ব দেন নি।
প্রোটনের
সঙ্গে সঙ্গে নিউক্লিয়াসে আর একটি কণা থাকে যার নাম নিউট্রন। ১৯২০ সালে রাদারফোর্ড
প্রথম নিউট্রনের কথা বলেন। নিউক্লিয়াসের মধ্যে কতগুলো কণা থাকে? একটা উদাহরণ নেয়া
যাক। সাধারণ কার্বনের নিউক্লিয়াসের ভর বারোটা প্রোটনের কাছাকাছি, কিন্তু আধান হল ছটা
প্রোটনের সমান। সেই সময় মনে করা হতো যে নিউক্লিয়াসে আছে বারোটা প্রোটন আছে ছটা ইলেকট্রন।
ইলেকট্রনের ভর প্রোটনের প্রায় দু হাজার ভাগের একভাগ, তাই তাদের মোট ভর নিউক্লিয়াসের
এক খুব ক্ষুদ্র অংশ। তাই অন্তত নিউক্লিয়াসের ভর মেপে এই ধারণাটাকে ভুল বলার কোনো উপায়
সেই সময় ছিলনা। রাদারফোর্ড বলেছিলেন যে প্রোটন ও ইলেকট্রন মিলে একটা নিউট্রন গঠন করবে।
কিন্তু শীগগিরই বোঝা গেলো যে নিউক্লিয়াসের মধ্যে ইলেকট্রন থাকা সম্ভব নয়।
নিউট্রনের
খোঁজ শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। রাদারফোর্ডের ছাত্রদের মধ্যে জেমস চ্যাউউইক শেষপর্যন্ত নিউট্রন
আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। এখানেও একটা গল্প আছে। চ্যাডউইককে তাঁর আবিষ্কারটা করতে বিশেষ
বেগ পেতে হয়নি -- অন্যদের করা একটা পরীক্ষা থেকে তিনি তাঁর পরিকল্পনাটা সহজেই পেয়ে
যান। জোলিও কুরি দম্পতি, যাঁদের কথা আগেই বলেছি, দেখেছিলেন বেরিলিয়ামকে আলফা কণা দিয়ে
ধাক্কা মারলে এক আধানহীন রশ্মি বেরোয়। এই রশ্মি প্রোটনকে আঘাত করলে প্রোটনের বেগ হয়ে
দাঁড়ায় প্রতি সেকেন্ড পনের হাজার কিলোমিটারেরও বেশী। জোলিও কুরিরা মনে করেছিলেন এ
অদৃশ্য রশ্মি হল গামা রশ্মি, যার কথা আমরা আগেই বলেছি। গামা রশ্মির কণা হল ফোটন। তার
কোনো আধান নেই।
রাদারফোর্ড
যখন এই পরীক্ষার কথা শুনলেন, তিনি সরাসরি বললেন, “আমি এতে বিশ্বাস করি না। তার কারণও
আছে। ধরা যাক একটা ফুটবলকে একটা টেবিল টেনিস বল দিয়ে খুব জোরে ধাক্কা মারলাম। তাহলে
ফুটবলটা যত জোরে সরে যাবে, তার চেয়ে অনেক জোরে সরবে অন্য একটা ফুটবল দিয়ে আস্তে ধাক্কা
মারলে। আলোর কণা ফোটনের স্থির ভর শূন্য- তা দিয়ে প্রোটনকে অত জোরে ধাক্কা মারতে গেলে
তার শক্তি খুব বেশী হতে হবে। বিজ্ঞানীরা জানতেন নিউট্রনের ভর প্রোটনের ভরের প্রায়
সমান। চ্যাডউইক সন্দেহ করলেন যে সম্ভবত বেরিলিয়াম নিউক্লিয়াস থেকে নিউট্রন কণা বেরিয়ে
প্রোটনকে ধাক্কা মারছে। নিউট্রনেরও আধান নেই, তাই তাকে গামা রশ্মির সঙ্গে জোলিও কুরিরা
গুলিয়ে ফেলেছেন। বাস্তবে তাই ঘটেছিলো। চ্যাডউইক পরীক্ষা করে সেটা প্রমাণ করলেন। এজন্য
১৯৩৫ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। তবে মনে রাখা দরকার, নিউট্রন কিন্তু, রাদারফোর্ড
যেমন ভেবেছিলেন, সেরকম প্রোটন ইলেকট্রনের মিলিত রূপ নয়। সে কথায় আমরা পরে আসব।
এর
পরের গল্পটা একটু জটিল। গল্পের শুরুটা হয়েছিলো জাপানে। এতদিনে আমরা জানতে পেরেছি যে
তড়িৎচৌম্বক বলের জন্য দায়ী হল ফোটন। নিউক্লিয়াসের কথা যদি ভাবি, সেখানে আছে প্রোটন
ও নিউট্রন। প্রোটনদের তড়িৎ আধান ধনাত্মক, নিউট্রনদের আধান নেই। আমরা জানি যে দু'টি
সম তড়িতের কণা একে অন্যকে বিকর্ষণ করে। তাহলে নিউক্লিয়াসের মতো ছোটো জায়গায় ওদের
ধরে রেখেছে কে? সহজেই বোঝা যায় যে তড়িৎ বিকর্ষণ বলের থেকে আরো শক্তিশালী বলের দরকার
হবে। সেই বলটাই হল সবল বল। ১৯৩০-এর দশকে এটা বোঝা গিয়েছিলো। কিন্তু সবল বলের সম্পর্কে
আর বিশেষ কিছুই জানা যাচ্ছিলো না। ১৯৩৫ সালে জাপানে হিদেকি ইউকাওয়া কল্পনা করলেন অনেকটা
ফোটনের মতো কোনো এক কণার। তিনি বললেন যে দুটি প্রোটন, দুটি নিউট্রন বা একটি প্রোটন
ও একটি নিউট্রনের মধ্যে এই কণার বিনিময় হল সবল বলের জন্য দায়ী। তবে এটা ফোটনের মতো
ভরশূন্য নয়। তিনি হিসেব করে দেখালেন যে এর ভর হবে ইলেকট্রনের ভরের মোটামুটি দুশো গুণ।
ইলেকট্রন ও প্রোটনের ভরের মাঝামাঝি পড়বে এই কণার ভর। গ্রিক “মেসো, শব্দের মানে মধ্যবর্তী,
তাই থেকে শেষ পর্যন্ত এই কণাটার নাম হয় পাই () মেসন বা পায়ন। এখন অবশ্য মেসন বলতে আমরা
এক বিশেষ ধরনের কণার কথা বুঝি, সে কথায় পরে
আসবো।
বললেন
তো বটে, কিন্তু এরকম ভরের কোনো কণা তো তখনো পর্যন্ত কারো চোখে পড়েনি। কোথায় তাকে
খুঁজে পাওয়া যাবে? ইউকাওয়ার ধারণা যদি ঠিক হয়, তাহলে কণাটির জীবন কালও খুবই কম হওয়া
উচিত, এক সেকেন্ডের একশো কোটি ভাগের একভাগেরও কম। তাই সাধারণ বস্তুর মধ্যে একে খুঁজতে
যাওয়ার কোনো অর্থ নেই। আবার বিজ্ঞানীরা খুঁজতে শুরু করলেন মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে।
আগেই বলেছি তার মধ্যে নতুন কণা তৈরি হয়। একবছরের মধ্যেই পজিট্রনের আবিষ্কর্তা অ্যান্ডারসন
পেলেন ইলেকট্রনের ভরের দুশো গুণ ভরের এক কণা। মনে হল তাহলে ইউকাওয়ার তত্ত্ব যে ঠিক,
তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিজ্ঞানে শেষ কথা বলা
যে খুব সহজ নয়, এর পরই তা বোঝা গেলো আরেকবার। নতুন পাওয়া কণাটার জীবনকাল দেখা গেলো
অনেক বড়ো, এক সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগেরও বেশী। অন্য অনেক দিক থেকেও বোঝা গেলো
যে, ইউকাওয়ার কণা এটা হতে পারে না। যেন এই কণার উপর সবল বল কোনো কাজই করে না; অথচ
ইউকাওয়ার কণার তো সবল বলকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা। শেষ পর্যন্ত বোঝা গেলো যে এটা একটা
নতুন কণা, যার নাম দেওয়া হল মিউয়ন (m)। এটার সঙ্গে ইলেকট্রনের
ধর্মের অনেক মিল আছে। দু’রকমের মিউয়ন হয়: যাদের আধান যথাক্রমে ইলেকট্রনের ও পজিট্রনের
সমান। আজও এই কণাটার পদার্থবিজ্ঞানে কী ভূমিকা, তা আমরা বিশেষ জানিনা।
তাহলে
কি ইউকাওয়ার তত্ত্ব ভুল? ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে: যার সমাপ্তিতে
ঘটল হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিউক্লিয় বোমা বিস্ফোরণে। এসময় গবেষণার কাজ স্বাভাবিক ভাবেই
প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত পাই মেসনকে পাওয়া গেলো ১৯৪৭ সালে। এজন্য
ইউকাওয়া ১৯৪৯ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। পাই ও অন্যান্য মেসন আবিষ্কারের জন্য
পরের বছর 'সিসিল পাওয়েল নোবেল পুরস্কার পান। আমাদের দেশে বিভা চৌধুরি ও দেবেন্দ্রমোহন
বোস পাই মেসন আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন, সেই গল্প এই লেখাতে
আছে।
এর
পরে যে কণার কথা বলব, তার কথা বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই কল্পনা করেছিলেন। ১৯১০ ও ১৯২০-র
দশকে যখন বিটা তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে ভালো ভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়, তখন একটা বিশেষ সমস্যা সামনে আসে। আগেই
বলেছি বিটা তেজস্ক্রিয়াতে ইলেকট্রন (বা পজিট্রন) বেরিয়ে আসে। কিন্তু ইলেকট্রনদের
শক্তি মাপতে গিয়ে দেখা গেলো একই নিউক্লিয়াস থেকে বেরোনো ইলেকট্রনদের মোট শক্তি বিভিন্ন
সময়ে বিভিন্ন হচ্ছে। তার মানে কি শক্তির সংরক্ষণ সূত্র (আরো সঠিকভাবে বললে ভর ও শক্তির
সংরক্ষণ সূত্র) এখানে মানা হচ্ছেনা? কিন্তু এই সূত্রটা পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
সূত্রদের মধ্যে একটা। এটা যদি কখনো ভেঙে পড়ে, তাহলে তো পদার্থবিজ্ঞানের আরো অনেক জায়গায়
সমস্যা দেখা দেবে।
জার্মান
বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি ১৯৩০ সালে লেখা এক বিখ্যাত চিঠিতে প্রস্তাব করেন যে বিটা তেজস্ক্রিয়াতে
আরো একটা কণা বেরোয় যা বাকি শক্তিটা নিয়ে
যায়। পরে এই কণাটার নাম হয় নিউট্রিনো। নিউট্রিনোর কোনো তড়িতাধান নেই; তাই তড়িৎচুম্বক
বল তার উপর কাজ করে না। নিউট্রিনো সবল বলেও প্রভাবিত হয়না। বিটা তেজস্ক্রিয়া হল দুর্বল
বলের উদাহরণ, নিউট্রিনোর ওপর তা কাজ করে। নামেই বোঝা যাচ্ছে দুর্বল বল, অন্য যে দুটো
বলের নাম করলাম: তাদের থেকে অনেক বেশি দুর্বল, তাই তা বস্তুর সঙ্গে প্রায় ক্রিয়া
করেনা বললেই চলে। যেমন এখন আমরা জানি যে আমাদের দেহের মধ্যে দিয়ে প্রতি মুহূর্তে কোটি
কোটি নিউট্রিনো চলে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা তা টের পাই না। তেমনি বিটা তেজস্ক্রিয়াতে
কিছুটা শক্তি এই নিউট্রিনো নিয়ে চলে যায়, তা আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়ে না। ইলেকট্রন
ও নিউট্রিনোর মোট শক্তির হিসেব ধরলে শক্তির সংরক্ষণ সূত্র অক্ষুণ্ণ থাকে। আরো অনেক
বিষয় নিউট্রিনো দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, যেগুলো আর বিশদে আলোচনা করছি না।
কিন্তু
এই কণা, যা বস্তুর সঙ্গে ক্রিয়া করে না বললেই চলে, তার অস্তিত্ব প্রমাণ হবে কেমন করে?
যদি অনেক নিউট্রিনো একসঙ্গে আসে, তার মধ্যে একটা হয়তো আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়তেও পারে।
কিন্তু সেরকম শক্তিশালী নিউট্রিনোর উৎস সে সময় জানা ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
পরে আমরা সেরকম উৎস পেলাম, তা হল নিউক্লিয়ার রিআ্যাক্টর। ১৯৫৬ সালে ক্লাইড কাওয়ান
এবং ফ্রেডেরিক রাইনেস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষাগারে নিউট্রিনোর অস্তিত্ব প্রমাণে
সক্ষম হন। তাঁরা দেখান যে রিআ্যাক্টর থেকে আসা নিউট্রিনোর স্রোত কখনো কখনো প্রোটনের
সঙ্গে ক্রিয়া করে নিউট্রন ও পজিট্রন তৈরি করছে। প্রচণ্ড দুরূহ এই পরীক্ষার জন্য রাইনেস
১৯৯৫ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কাওয়ান অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন, মৃত ব্যক্তির
নাম নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয় না।
উলফগ্যাং পাউলি |
ফ্রেডেরিক রাইনেস |
বিশ্বযুদ্ধের
আগে থেকেই পার্টিকল এক্সিলারেটর বা কণা ত্বরক যন্ত্র তৈরি শুরু হয়েছিলো, বিশ্বযুদ্ধের
পরে তা আরো গতি পায়। এই যন্ত্রে ইলেকট্রন, প্রোটন জাতীয় কণার বা ভারী নিউক্লিয়াসের
বেগকে অনেক বাড়ানো যায়। সেই কণা যখন অন্য কোনো কণার সঙ্গে সংঘর্ষ করে, তখন নতুন কণা
তৈরি হতে পারে। আমরা জানি যে ভর ও শক্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আইনস্টাইনের সেই
বিখ্যাত সূত্রটি
আমাদের সবার জানা। কাজেই নতুন যে কণা তৈরি হয়, তার ভর এ সংঘর্ষে লিপ্ত কণাদের গতিশক্তি
থেকে পাওয়া যায়। এখন আর বিজ্ঞানীদের আকাশের দিকে তাকিয়ে মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে
নতুন কণার অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে না। পরীক্ষাগারেই
তাদের তৈরি করা সম্ভব।
বিজ্ঞানীরা
কণা ত্বরক ব্যবহার করে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক নতুন কণা খুঁজে
পেলেন। তারা সবাই খুব ক্ষণস্থায়ী, সে জন্য তাদের আগে আমরা দেখিনি। কিন্তু অতি উচ্চ
বেগে সংঘর্ষে তাদের তৈরি করা সম্ভব হল। পরিস্থিতিটা অনেকটা ঠিক উনিশ শতকের শেষ দিকের
মতো, যখন বহু পরমাণু পাওয়া গিয়েছিলো। তখন যেমন মনে হয়েছিলো যে পরমাণু মৌলিক নয়,
বিজ্ঞানীদের এখনও মনে হল যে এই সমস্ত কণাই কি মৌলিক? নাকি তাদের ভেঙে আরো অন্য কণা
পাওয়া যাবে।
মারে
গেলম্যান বলে এক মার্কিন বিজ্ঞানী বললেন প্রোটন নিউট্রন বা মেসনরা আসলে মৌলিক কণা নয়।
তিনি কোয়ার্ক বলে এক কণার প্রস্তাব করলেন। আর একজন আমেরকান বিজ্ঞানী জর্জ জুইগও একইরকম
কথা বলেছিলেন। প্রোটন বা নিউট্রনের মধ্যে আছে তিনটি কোয়ার্ক। মেসনদের মধ্যে আছে একটি
কোয়ার্ক ও একটি প্রতিকোয়ার্ক বা আ্যান্টিকোয়ার্ক। গেলম্যান কিছু নতুন কণার কথাও
বললেন, যেগুলোকে পরীক্ষাগারে পাওয়াও গেলো। গেলম্যানের ধারণা যদি ঠিক হয়: তাহলে এত
দিন আমরা যাদের মৌলিক কণা বলছি, তাদের অনেকেই আসলে মৌলিক নয়। কিন্তু কেমন করে বুঝব
যে প্রোটনের মধ্যে অন্য কণা আছে? ১৯৬৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ডে এক
পরীক্ষায় উচ্চগতি শক্তিসম্পন্ন ইলেকট্রনের সঙ্গে প্রোটনের সংঘর্ষ ঘটানো হল। দেখা গেলো
সত্যিই প্রোটনের মধ্যে তিনটি বিন্দুর মতো আয়তনের কণা আছে। কোয়ার্ক তত্ত্বের জন্য
১৯৬৯ সালে গেলম্যান নোবেল পুরস্কার পেলেন। পরীক্ষা করে কোয়ার্কের অস্তিত্ব দেখানোর
জন্য ১৯৯০ সালে জেরোম ফ্রিয়েডম্যান, হেনরি কেন্ডাল ও রিচার্ড টেলর নোবেল পুরস্কার
লাভ করেন।
রিচার্ড টেলর |
আগে
যে বস্তু কণাগুলোর কথা বলেছিলাম, তার মধ্যে ইলেকট্রন পজিট্রন, মিউয়ন ও নিউট্রিনো হল
মৌলিক। বস্তু কণা কে আমরা এখন দু ভাগে ভাগ করতে পারি। যে সমস্ত কণা কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি,
তাদের বলে হ্যাড্রন। এদের মধ্যে যারা তিনটি কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি, তাদের বলে ব্যারিয়ন।
একটি কোয়ার্ক ও একটি প্রতিকোয়ার্ক দিয়ে
তৈরি কণাকে বলে মেসন। এরা সবাই সবল বলের সঙ্গে ক্রিয়া করে। ইলেকট্রন, মিউয়ন, নিউট্রিনো,
এই কণাদের উপর সবল বলের প্রভাব খাটে না, এদের আমরা বলি লেপ্টন। মোট ছটা লেপ্টন আছে,
ইলেকট্রন, মিউয়ন, টাউয়ন ও তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আছে আলাদা আলাদা নিউট্রিনো। যে
নিউট্রিনো আবিষ্কারের কথা আমরা একটু আগে পড়লাম, সেটা হল ইলেকট্রন নিউট্রিনো। আমরা
এখন এটাও জানি মোট ছয় রকমের কোয়ার্ক আছে। এই ছটা কোয়ার্কের নাম হল আপ, ডাউন, চার্ম,
স্টেজ, টপ ও বটম। এছাড়াও মনে রাখতে হবে যে এদের প্রত্যেকের প্রতিকণা আছে, যেমন ইলেকট্রনের
প্রতিকণা পজিট্রন। প্রোটন বা নিউট্রনের মতো সাধারণ কণার মধ্যে শুধু মাত্র এই তালিকার
প্রথম দু রকমের কোয়ার্ক আছে। প্রথম সারণীতে আমাদের জানা মৌলিক বস্তুকণাদের তালিকা
দেয়া আছে।
সারণী নং ১ঃ বিভিন্ন
মৌলিক বস্তুকণা
কোয়ার্ক
|
আপ
|
চার্ম
|
টপ
|
ডাউন
|
স্ট্রেঞ্জ
|
বটম
|
|
লেপ্টন
|
ইলেকট্রন
|
মিউয়ন
|
টাউয়ন
|
ইলেকট্রন নিউট্রিনো
|
মিউয়ন নিউট্রিনো
|
টাউয়ন নিউট্রিনো
|
মনে
রাখতে হবে এরা সবাই ফের্মিয়ন। ফের্মিয়ন জিনিসটা কী? মৌলিক কণাদের নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের
যে তত্ত্ব তাকে বলে স্ট্যান্ডার্ড মডেল। তাতে দু ধরনের কণার অস্তিত্ব আছে, ফের্মিয়ন
ও বোসন। প্রথম ভাগের কণারা ফের্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান আর দ্বিতীয় ভাগের কণারা বোস-আইনস্টাইন
পরিসংখ্যান মেনে চলে। এখানে এ নিয়ে আর আলোচনায় যাচ্ছি না। সারণীতে যে টপ কোয়ার্কের
কথা আছে; এই লেখার একে বারে শেষে আমরা তার আবিষ্কারের কথা শুনব। কিন্তু তার আগে অন্য
এক ধরনের কণার গল্প খুব সংক্ষেপে শোনা যাক।
আমরা
আগে বলেছি যে মোট চার রকমের বল আছে। বিজ্ঞানীরা অনেকেই মনে করেন যে এগুলো আসলে একটা
বলেরই রকম ফের। আইনস্টাইন তাঁর জীবনের শেষ প্রায় চল্লিশ বছর এই চেষ্টা করে গেছেন।
আমরা সেই লক্ষ্যে কিছুটা এগিয়েছি। এবিষয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হল দুর্বল
এবং তড়িৎচুম্বক বলকে এক জায়গায় নিয়ে আসা। এই কাজটা মূলত করেছেন দুই মার্কিন বিজ্ঞানী
স্টিভেন ভাইনবার্গ ও শেলডন গ্লাসো এবং পাকিস্তানজাত বিজ্ঞানী আবদুস সালাম। তত্ত্বটা
যদি ঠিক হয় তাহলে তিনটে বলকণা পাওয়া যাওয়া উচিত। এরা দুর্বল বলের কণা। এদের মধ্যে
দুটোকে আমরা বলি W- ও W+; এদের আধান যথাক্রমে ইলেকট্রন ও পজিট্রনের
সমান। তৃতীয় কণাটার নাম Z, এর তড়িতাধান নেই। ১৯৭৯ সালে এই তিন বিজ্ঞানী তাদের কাজের
জন্য নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন।
শেলডন গ্লাসো |
দ্বিতীয়
সারণীতে বিভিন্ন বল ও তাদের কণার নাম দেয়া আছে। এদের মধ্যে গ্রাভিটন একেবারেই তাত্ত্বিক
কল্পনা। এখনো আমরা গ্র্যাভিটন আছে কিনা, তা বলার মতো জায়গায় পৌঁছোতে পারিনি। গ্লুয়নের
বিষয়টা আর একটু জটিল - এই লেখাতে সেই আলোচনা আমরা করছিনা। এরা সবাই বোসন।
সারণী নং ২ : বিভিন্ন
বল ও তাদের কণা
বল
|
তড়িৎচৌম্বক
|
সবল
|
দুর্বল
|
মাধ্যাকর্ষণ
|
বল কণা
|
ফোটন
|
গ্লুয়ন
|
W-, W+, Z
|
গ্র্যাভিটন
|
একথা
জানা ছিল যে এই তিনটে কণাই খুব ভারী, নব্বইটা প্রোটনের মোট ভরের কাছাকাছি এদের ভর।
এদের মধ্যে Z-এর ভর বেশী। পরীক্ষাগারে এত ভারী কণা বানাতে হলে চাই বিশাল কণাত্বরক।
অবশেষে সার্নে সুপার প্রোটন সাইক্লোট্রনে ১৯৮৩ সালে প্রোটন প্রোটন সংঘর্ষে এই দুই কণার
সন্ধান পাওয়া গেলো। বিরাট এক বিজ্ঞানীদল এই কাজটা করেছিলেন যার নেতৃত্বে ছিলেন কার্লো
রুবিয়া এবং সাইমন ভ্যান ভার মির। পরের বছরই এঁরা দুজন তাঁদের কৃতিত্বের জন্য নোবেল
পুরস্কার পান।
আমাদের
গল্প প্রায় শেষের পথে। হিগস বোসন আবিষ্কারের গল্প অন্য লেখায় পাওয়া যাবে। কিন্তু
হিগসের চেয়েও বেশী ভরের কণা আমরা আগেই দেখেছি। তা হল টপ কোয়ার্ক। টপের ভর প্রোটনের
দুশো গুণের কাছাকাছি। যে কোনো কণা যত ভারী হয়: তাকে দুটি সাধারণ কণার সংঘর্ষে তৈরি
করতে তত বেশী শক্তি লাগে। কণাত্বরকের মাধ্যমে সাধারণ কণাদের গতিশক্তি বাড়াতে হয় সে
কথা আগেই বলেছি। আবার কণা ত্বরক যত বড়ো হয়, তার পক্ষে তত বেশী গতিশক্তি বাড়ানো সম্ভব।
সেই কারণেই এল এইচ সি এত বড়ো। এল এইচ সি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত সবচেয়ে বড়ো যে কণাত্বরক,
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই টেভাট্রন অবশেষে ১৯৯৪ সালে টপ কোয়ার্ক তৈরি করতে সক্ষম
হয়। এই কোয়ার্কের ভর প্রোটনের থেকে প্রায় একশো পঁচাশি গুণ বেশী। টপ কোয়ার্কের কথা
যাঁরা প্রথম বলেছিলেন, সেই মাকোরতা কোবায়াশি ও তোশিহিদে মাসকাওয়াকে ১৯০৮ সালে নোবেল
পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।
এই
লেখাতে আরো অনেক কণার আবিষ্কারের কথা বলার জায়গা হল না। আরো বেশ কিছু নোবেল পুরস্কার
মৌলিক্ম কণা সংক্রান্ত গবেষণার জন্য দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে দুটির নাম উল্লেখ করি
- মিউয়ন নিউট্রিনোর জন্য লিয়ন লেডারম্যান, মেলভিন সোয়ার্জ ও জ্যাক স্টেইনবার্গার
(১৯৮৮) এবং টাউয়নের জন্য মার্টিন পার্ল(১৯৯৫)। মৌলিক কণা আবিষ্কারের গল্পের একটা খুব
সংক্ষিপ্ত অংশই এখানে জানলাম। আমরা যত আরো শক্তিশালী কণা ত্বরক বানাতে সক্ষম হয়েছি,
ততই আমরা বস্তুর ভিতরে আরো ক্ষুদ্র অংশকে দেখতে সক্ষম হয়েছি। তবে মনে রাখতে হবে যে
শুধু কণাত্বরক নয়: প্রয়োজন হয়েছে এমন ডিটেক্টর যন্ত্র বানানোর যা আমাদের নতুন কণাটা
যে সত্যি সত্যিই তৈরি হয়েছে তা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারব এবং তার নানা ধর্ম মাপতে সক্ষম
হবে। অনেক সময় নতুন তৈরি কণাটা এতই ক্ষণস্থায়ী যে সে ডিটেক্টরে এসে পৌঁছোয় না, তার
আগেই সে ধ্বংস হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে বুঝতে পারেন যে কণাটা সত্যিই
তৈরি হয়েছিলো। এই সব মিলিয়ে মৌলিক কণা সংক্রান্ত পরীক্ষা এখন বেশ জটিল। অনেক সময়
হাজারেরও বেশী বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ একসঙ্গে কাজ করে তবেই একটা পরীক্ষা ঠিকঠাক ভাবে
করা সম্ভব হয় এবং তার ফলাফল সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। টমসন বা মিলিক্যানের সময়,
যখন একজন বিজ্ঞানী একা বা তাঁর কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে মিলে প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন
করছিলেন, সেই সময়টা আমরা অনেকদিন পেরিয়ে এসেছি। সেটা স্বাভাবিক, কারণ সেই সময়ের
গবেষণার উপর ভিত্তি করে আমরা এখন বিজ্ঞানের আরো মৌলিক স্তরে পৌঁছোতে সক্ষম হয়েছি।
এ বিষয়ে গবেষণা ভবিষ্যতে যে আরো নানা নতুন দিকের সন্ধান দেবে, তাতে সন্দেহ নেই। তাই
এই লেখা শেষ হলেও আমাদের গল্পের শেষ হয়নি।
Saturday, 9 December 2017
নারীজাগরণে রোকেয়া
নারীজাগরণে রোকেয়া
শম্পা গাঙ্গুলী
আজকের নিবন্ধে আমি ছাত্রীদের কাছে এমন একজন স্বতন্ত্র সাহসী
মনের পরিচয় তুলে ধরতে চাই যিনি তাঁর একক প্রয়াসে বাঙালী মুসলমানের অন্তঃপুরে আধুনিক শিক্ষার আলো যতখানি
পৌঁছে দিয়েছেন, আঘাত দিয়ে জড়তা কাটিয়ে দিতে চেয়েছেন সমাজের বিবেকের কর্মচেতনাকে জাগাবার
চেষ্টায় - তেমনটা এই একশো বছরে বাঙালী মুসলমান নারীদের জন্য আর কেউ করেননি।
রোকেয়া
সাখাওয়াত হোসেনের কথা আজ তোমাদের বলব। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর বর্তমান
বাংলাদেশের রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। বাবা জাহিরুদ্দিন মহম্মদ আবু আলি হায়দার সাবের ছিলেন
একজন উচ্চশিক্ষিত সম্ভ্রান্ত জমিদার। রোকেয়ার মায়ের নাম রাহাতুন্নেসা সাবেরা
চৌধুরাণী। রোকেয়ার জীবনে তাঁর বড় ভাই ইব্রাহিম আর বড় বোন করিমুন্নিসার প্রভাব ছিল
অনেকখানি। তখনকার উচ্চবংশের মুসলমানদের মধ্যে আরবি ও পারসির বাইরে অন্য কোনো ভাষা
শিক্ষা একটা দুরূহ ব্যাপার ছিল। সে সময়ের নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আধুনিকমনস্ক বড়
ভাই ইব্রাহিম তাঁর দুই বোন রোকেয়া আর করিমুন্নিসাকে গোপনে বাংলা ও ইংরাজি ভাষা
শেখান। করিমুন্নিসা পরে বাংলাতে কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করেন।
১৮৯৬ সালে ষোলো
বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় একজন চল্লিশ বছর বয়সী উচ্চশিক্ষিত উর্দুভাষী মুসলমান খান
বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি তখন পরাধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের ভাগলপুর
জেলার (বর্তমান বিহারের অন্তর্গত) ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই
উদার মনোভাবাপন্ন এবং নারী শিক্ষা প্রসারে উৎসাহী। তখনকার কট্টর মুসলমান সমাজ ব্যবস্থার
মধ্যে দাঁড়িয়েও তিনি তাঁর স্ত্রীকে বাংলা ও ইংরাজি ভাষা শিখতে এবং বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ লিখতে
অনুপ্রাণিত করেছিলেন। রোকেয়ার ভেতর যে সুপ্ত প্রতিভা ছিল তার আবিষ্কার ও প্রকাশে
স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।
রোকেয়া শুরু করলেন সাহিত্য চর্চা। ১৯০২ সালে লিখলেন তাঁর
প্রথম উপন্যাস ‘পিপাসা’। এরপর ১৯০৫ সালে ‘মতিচুর’। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য
রচনা হল ‘Sultana’s
Dream’ যার অনুদিত রূপ ১৯০৮ সালে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে বই প্রকাশিত
হয়। এই বইটিকে বাংলার তথা বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যের একটি মাইলফলক ধরা হয়। ১৯২৪
সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাস। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় ‘অবরোধ-বাসিনী’।
বাংলায়
নারী
শিক্ষা
বিস্তারে
শিক্ষাবিদ
বেগম
রোকেয়ার
অবদান
অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন একাধারে বঙ্গ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান নারীবাদী লেখক ও সমাজ-সংস্কারক। নারী শিক্ষার প্রসার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তিনি লিখে গেছেন শক্ত হাতে। মেয়েদের
জন্য
বেশকিছু
স্কুল
স্থাপন
করেছেন। অনেক দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে এসব স্কুলে মেয়েদের নিয়ে আসার জন্য। দ্বারে
দ্বারে
ঘুরে
অভিভাবকদের
অনুরোধ
করেছেন
যাতে
তারা
মেয়েদের
স্কুলে
পাঠান। এমনকি মেয়েদের নিরাপত্তা ও পর্দার নিশ্চয়তা দিতে বেগম রোকেয়া ফিটন গাড়ি (ঘোড়ার গাড়ি) ও মোটর বাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। এ গাড়িগুলো সম্পূর্ণভাবে পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকত। তার
পরও
রক্ষণশীলরা
যখনই
সুযোগ
পেয়েছে, বেগম
রোকেয়াকে
আক্রমণ
করতে
ছাড়েনি।
তাঁর কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৯১১ সালে কলকাতায় মাত্র আটজন
ছাত্রী নিয়ে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা। ১৯১৫ সালে পঞ্চম শ্রেণি
শুরু হল স্কুলে। স্কুলটি উচ্চ প্রাইমারি বিদ্যালয়ে উন্নীত হল। ছাত্রী সংখ্যাও
বাড়তে বাড়তে হল চুরাশি। ১৯২৭ সালে তাঁর স্কুলটি উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ে পরিণত হল। কিন্ডারগার্ডেন
শাখারও প্রবর্তন ঘটল। ছাত্রী সংখ্যাও বাড়ল। বেগম
রোকেয়ার
কাজ
এগিয়ে
নিয়ে
গিয়েছিলেন
অনুজপ্রতিম
শিক্ষক, সমাজকর্মী
এবং
সংসদ
সদস্য
শামসুন্নাহার
মাহমুদ। তার বাবা ফজলুল করিম সে সময় পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্নাতক।
রোকেয়ার শিক্ষার আদর্শ কিন্তু একেবারেই রক্ষণশীল ছিল না, ছিল
আধুনিক। তিনি তাঁর সমাজের থেকে বহুগুণ অগ্রসর ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাস্থ্য
রক্ষার জন্য শারীরিক ব্যায়াম চর্চার প্রয়োজন; আর প্রয়োজন বিশুদ্ধ বাতাসের।’ আজকে
আমরা যে সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার কথা বলি, রোকেয়ার কথাতে তার প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
রোকেয়া ছিলেন ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম আমূল
নারীবাদী এক মহান নারী ব্যক্তিত্ব। তাঁর সময়ে নারীদের এতই করুণ দশা ছিল যে তিনি
নারীকে নিকৃষ্ট জীবের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বলেছিলেন- “আপনারা শুনিয়া হয়ত
আশ্চর্য্য হইবেন যে, আমি আজ বাইশ বৎসর
ধরিয়া ভারতের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীবের জন্য রোদন করিতেছি। ভারতের সর্বাপেক্ষা
নিকৃষ্ট জীব কাহারা জানেন? সে জীব ভারত-নারী। এই জীবগুলির জন্য কখনো কাহারো প্রাণ
কাঁদে নাই। পশুর জন্য চিন্তা করিবারও লোক আছে। তাই যত্র-তত্র পশুক্লেশ নিবারণী
সমিতি দেখিতে পাই। কিন্তু আমাদের ন্যায় অবরোধ-বন্দিনী নারী জাতির জন্য কাঁদিবার
একটি লোকও এ ভূভারতে নাই।” তখন মুসলমান নারীর জন্য শিক্ষার্জন নিষিদ্ধ ছিল, এবং
অবরোধ-বন্দী নারীকে ঘরের মধ্যেও অপর নারীর সামনে পর্দা করতে হত। সেই বীভৎস অবরোধ
প্রথার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা তিনি এভাবে করেন- “জমিদার বাড়িতে এক জমিদার
কন্যা দুপুরবেলা আঙিনায় মুখ ধুইতেছিলেন। আলতার মা পাশে দাঁড়িয়া জল ঢালিয়া দিতেছিল।
ঠিক সেই সময় এক লম্বা চওড়া কাবুলি স্ত্রীলোক আঙিনায় আসিয়া উপস্থিত। হায় হায় সে কি
বিপদ! আলতার মা চেঁচাইয়া উঠিল- বাড়ির ভিতর পুরুষ মানুষ! স্ত্রীলোকটি হাসিয়া জানাইল--
সে পুরুষ নয়। জমিদার কন্যা প্রাণপণে ঊর্ধ্বশ্বাসে গৃহাভ্যন্তরে ছুটিয়া গিয়া
হাঁপাইতে হাঁপাইতে ও কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন-- পাজামা-পরা একটা মেয়েমানুষ আসিয়াছে।
গৃহকর্ত্রী ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন-- সে তোমাকে দেখিয়া ফেলে নাই তো? কন্যা
সরোদনে বলিল-- হ্যাঁ দেখিয়াছে। অপর মেয়েরা শশব্যস্তভাবে
দ্বারে অর্গল দিলেন। কেহ বাঘ ভাল্লুকের ভয়েও বোধ হয় এমন করিয়া কপাট বন্ধ করে না।‘
এমন অন্ধকারে ডুবে ছিল রোকেয়ার ভারতবর্ষ। সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের বুক চিরে তিনি
নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের দীপশিখাটি প্রজ্বলিত করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল নারীদের
স্বাবলম্বন। তিনি দাবি জানিয়েছিলেন যে, নারীকে দিতে হবে শিক্ষার্জনের ও
অর্থোপার্জনের অধিকার। তিনি পুরুষজাতির চোখে চোখ রেখে ঘোষণা করেছিলেন --- পুরুষের ঘর-সংসার করাই কেবল নারীর সারধর্ম নয়, নারী তার বুদ্ধি, মেধা,
প্রজ্ঞা ও শ্রম দিয়ে দেশের উন্নয়নে অংশ নিতে এবং দেশকে নেতৃত্ব প্রদান ও পরিচালনার
দায়িত্ব পালনে সক্ষম। তিনি দাবি করেছিলেন পুরুষের সমকক্ষতা এবং নারী-পুরুষের
সমানাধিকার। তিনি ‘স্বামী’ শব্দের তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, নারী পুরুষকে তার
স্বামী (প্রভু) মানবে কেন? স্বামী আর বলবে না, ‘স্বামী’র পরিবর্তে পুরুষকে
অর্ধাঙ্গ বলবে। এই ছিল রোকেয়ার নারী-স্বাধীনতা আন্দোলনের আসল রূপ, যা ছিল
পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ।
তিনি কার্যত বিদ্রোহ করেছিলেন নারীর প্রধান শত্রু
ধর্মের বিরুদ্ধেও। সকল ধর্মগ্রন্থই পুরুষ দ্বারা রচিত বলে পৃথিবীর সকল ধর্মকেই
নস্যাৎ ও অস্বীকার করেছিলেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে প্রচলিত
ধর্মই যে নারীর দাসত্ব বন্ধন দৃঢ় হতে দৃঢ়তর করেছে। তিনি সে কথা ‘মহিলা’ পত্রিকায় ‘অলঙ্কার না Badge of Slavery’ প্রবন্ধে
বলিষ্ঠ ভাষায় লিখেছিলেন। মুসলিম সমাজ ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ভূকম্পন সৃষ্টিকারী
তাঁর সেই দুঃসাহসিক
কথাটি এরূপঃ “‘ধর্ম’ই আমাদের
দাসত্ব বন্ধন দৃঢ় হতে দৃঢ়তর করিয়াছে, ‘ধর্মে’র দোহাই দিয়া
পুরুষ রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।”
রোকেয়া তাঁর
জন্মভূমিকে ভালবেসেছিলেন, ভালবেসেছিলেন তাঁর দেশের মানুষকে। তিনি মায়েদের বলতেন,সন্তানকে
আগে শেখাতে হবে সে ভারতবাসী, তারপর আসে ধর্মের পরিচিতি। দেশের উন্নতির জন্য হিন্দু
মুসলমানের মিলনের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি তুলে ধরেছিলেন। তাঁর সৌভাগ্য যে তিনি ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ
দেখে যাননি। বিশেষ করে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে নারী শিক্ষার বিস্তারে তিনি যে
জীবন উত্সর্গ করেছিলেন, তার মূলে তাঁর এই ভালবাসা। এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন,
মুসলমানদের যাবতীয় দৈন্য-দুর্দশার একমাত্র কারণ স্ত্রীশিক্ষায় ঔদাস্য। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি শুধুমাত্র শিক্ষাতেই সীমাবদ্ধ
থাকেনি। কৃষির উন্নতি, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার, শিল্পোন্নয়ন, এই সমস্ত বিষয়ে
তিনি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
তিনি
তাই প্রাতঃস্মরণীয় এক ভারতীয় মনীষী, আমাদের বাঙালী জাতির গর্ব।
Subscribe to:
Posts (Atom)