মৌলিক পদার্থের জন্মকথা
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
ছোটোবেলা
থেকেই আমরা পড়ে এসেছি,
আমাদের চারদিকে যত রকম বস্তু দেখতে পাই, তা মূলত কতগুলো মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। ইট, কাঠ, পাথর থেকে শুরু করে, আমাদের দেহ – কোনোটাই তার ব্যতিক্রম নয়। কত রকম মৌলিক পদার্থ আছে? আমাদের এই মহাবিশ্বে প্রাকৃতিক ভাবে মোটামুটি বিরানব্বইটা মৌল পাওয়া যায়
(যদিও তাদের কয়েকটা খুব ক্ষণস্থায়ী) – তাদের দিয়েই এই লক্ষকোটি রকম বস্তু তৈরি। আমাদের মনে হয়তো কখনো কখনো প্রশ্ন জাগে
– এতগুলো মৌলিক পদার্থ এলো কোথা থেকে?
সৃষ্টির শুরু থেকেই কি তাদের অস্তিত্ব ছিলো
? নাকি তারা পরে তৈরি হয়েছে
? যদি পরে তৈরি হয়ে থাকে,
তাহলে কেমন করে তৈরি হলো? সেই প্রক্রিয়া কী বন্ধ হয়ে গেছে
? নাকি আজও মৌলিক পদার্থ নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে?
এই লেখাতে আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব ।
মৌলিক
পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা হলো পরমাণু। জীবকোষের ভিতরের ডি এন এর মতো বড়ো অণুই হোক, কিংবা জলের মতো ক্ষুদ্র অণু, সমস্ত কিছুকেই ভাঙতে শুরু করলে শেষ পর্যন্ত পড়ে থাকে এক বা একাধিক মৌলিক পদার্থের পরমাণু। পরমাণুর কেন্দ্ৰে আছে নিউক্লিয়াস আর চারদিকে আছে ঋণাত্মক আধানযুক্ত ইলেকট্রন। নিউক্লিয়াসের মধ্যে আছে প্রোটন ও নিউট্রন। নিউট্রনের তড়িৎ আধান নেই। প্রোটন ধনাত্মক আধানসম্পন্ন -- তার আধান ইলেকট্রনের আধানের সমান, কিন্তু বিপরীত। পরমাণু নিস্তড়িৎ,
তার কেন্দ্রে যতগুলো প্রোটন আছে, বাইরেও আছে ঠিক ততগুলোই ইলেকট্রন ।
এই ইলেকট্রন সংখ্যার উপরেই মৌলিক পদার্থের সমস্ত রাসায়নিক ও
ভৌত ধর্ম নির্ভর করে। তাই এক কথায় বলতে গেলে পরমাণুর কেন্দ্রে প্রোটনের সংখ্যাই শেষ পর্যন্ত তার সমস্ত ধর্মকে ঠিক করে দেয়। একটা সহজ উদাহরণ নেওয়া যাক। কার্বন হলো জীবনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু। কার্বন পরমাণুরা একটা আরেকটার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিরাট বিরাট কার্বন-শৃঙ্খল তৈরি করতে পারে
– কার্বনের এই বৈশিষ্ট্য ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব আমরা ভাবতেও পারি না। একটা কার্বন পরমাণুতে ছটা ইলেকট্রন আছে – সে জন্যই তারা এই রকম শৃঙ্খল বানাতে পারে। ছটা ইলেকট্রন কেন ? তার কারণ কার্বন নিউক্লিয়াসে আছে। ছটা প্রোটন। তাই নিস্তড়িৎ কার্বন পরমাণুতে ছটা ইলেকট্রন থাকতেই হবে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে জীবনের অস্তিত্বের পিছনে আছে কার্বনের নিউক্লিয়াসের ছটা প্রোটন। আমরা চারদিকের বস্তুজগতে যে বৈচিত্র দেখতে পাই, বিভিন্ন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন সংখ্যার পার্থক্যই তার জন্য দায়ী। তার মানে মৌলিক পদার্থ সৃষ্টির রহস্য খুঁজতে গেলে তার নিউক্লিয়াস কেমনভাবে তৈরি হলো, তা জানতে হবে।
মহাবিশ্বে সবচেয়ে সরল পরমাণু হলো সাধারণ হাইড্রোজেন। তার কেন্দ্ৰে আছে একটা প্রোটন। সবচেয়ে ভারি চিরস্থায়ী পরমাণু হলো সিসা। সিসার পরমাণুর নিউক্লিয়াসে আছে বিরাশিটা প্রোটন। এছাড়াও আছে মোটামুটি একশো ছাব্বিশটা নিউট্রন। মোটামুটি বললাম কেন? কারণ নিউট্রনের সংখ্যার সামান্য হেরফের হতে পারে, তাতে পরমাণুর রাসায়নিক ধর্মের পরিবর্তন হয় না। একটা মৌলের সমস্ত নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা সমান। যে সমস্ত পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা সমান কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা আলাদা আলাদা হয়, তাদের বলে মৌলের আইসোটোপ।
প্রথম সারণীঃ ছায়াপথে কয়েকটি মৌলিক পদার্থের পরিমাণ
মৌলিক
পদার্থ
|
প্রোটন
সংখ্যা
|
শতাংশে
পরিমাণ
|
মৌলিক পদার্থ
|
প্রোটন
সংখ্যা
|
শতাংশে
পরিমাণ
|
হাইড্রোজেন
|
1
|
73.9
|
লোহা
|
26
|
0.11
|
হিলিয়াম
|
2
|
24.0
|
নিকেল
|
28
|
0.006
|
কার্বন
|
6
|
0.46
|
জার্মেনিয়াম
|
32
|
2X10-5
|
অক্সিজেন
|
8
|
1.04
|
ক্রিপ্টন
|
36
|
4X10-6
|
নিয়ন
|
10
|
0.13
|
টিন
|
50
|
4X10-7
|
সিলিকন
|
14
|
0.06
|
সিসা
|
82
|
10-6
|
গন্ধক
|
16
|
0.04
|
ইউরেনিয়াম
|
92
|
2X10-8
|
আমাদের ছায়াপথে সবচেয়ে বেশী পরিমাণে আছে হাইড্রোজেন, তারপরেই আছে হিলিয়াম। বাকি মৌলিক পদার্থের পরিমান অত্যন্ত কম। প্রথম সারণীতে কয়েকটা মৌলিক পদার্থ কি পরিমাণে পাওয়া যায় তার শতাংশে হিসেব দেওয়া হলো। বিরানব্বইটা মৌলিক পদার্থের হিসেব দিতে গেলে তালিকাটা খুব লম্বা হয়ে যেতো। কিন্তু এই ছোটো তালিকা থেকেই দেখা যাচ্ছে যে ছায়াপথের চারভাগের প্রায় তিন ভাগই হাইড্রোজেন আর এক ভাগ হলো হিলিয়াম। আমাদের ছায়াপথের হিসাবকে আমরা মোটামুটি মহাবিশ্বের হিসাব
ধরে নিতে পারি। ভালো
করে দেখলে বোঝা যাবে তিন ধরনের সংখ্যা আছে সারণীতে। হাইড্রোজেনকে আমরা হিসাব থেকে বাদ দিতে পারি,
কারণ সেই হলো অন্য সমস্ত মৌল তৈরির জন্য দরকারি কাঁচামাল। হাইড্রোজেন ও
হিলিয়াম মিলিয়েই আমাদের জানা পদার্থের প্রায়
98 শতাংশ। এর পর লোহা পর্যন্ত মৌলগুলো পাওয়া যায় হিলিয়ামের থেকে অনেক কম। লোহার চেয়েও ভারি যে মৌলগুলো,
তাদের পরিমাণ আরো অনেক কম। যেমন ইউরেনিয়ামের পরিমাণ মোট পদার্থের
2 × 10-8 শতাংশ,
অর্থাৎ এক শতাংশের দশ কোটি ভাগের দু ভাগ। আসলে তিন ধরনের পদ্ধতিতে এই মৌলগুলো তৈরি হয়েছে
– তাই এই তিন ধরনের পরিমাণ পাওয়া যায়। এই লেখাতে আমরা দেখার চেষ্টা করব এই যে নানা রকমের পরমাণু
– তারা কেমনভাবে তৈরি হলো?
অনেকেই জানো যে আজ থেকে মোটামুটি তেরোশো আশি কোটি বছর আগে এক মহা বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের জন্ম হয়। এই বিস্ফোরণের নাম আমার দিয়েছি বিগ ব্যাং
(Big Bang)।
সৃষ্টির সেই আদি মুহুর্তের পরে মহাবিশ্ব ছিলো অত্যন্ত ক্ষুদ্র। তার তাপমাত্রাও ছিলো খুব বেশি। এই অবস্থায় প্রোটন বা নিউট্রনের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। আবার একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। কিছুটা পরিমাণ জলকে গরম করছি। তাপমাত্রা আসলে হলো গতিশক্তির পরিমাপ। তাই তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জলের অণুদের ছোটাছুটি বেড়ে যায়। জলের অণুরা একে অপরকে আকর্ষণ করে, তাই অণুগুলো সাধারণ তাপমাত্রায় একটা আরেকটার থেকে দূরে চলে যেতে পারে না। কিন্তু তাপমাত্রা বেড়ে গেলে অণুদের গতি শক্তি বাড়তে থাকে,
তখন তারা তাদের মধ্যের আকর্ষণ বলকে অতিক্রম করতে পারে। অণুগুলো যখন একটা আরেকটাকে ছেড়ে চলে যায় তখন জল বাষ্পীভূত হয়ে যায়।
প্রোটন বা নিউট্রন কোয়ার্ক কণা দিয়ে তৈরি। সৃষ্টির আদিতে তাপমাত্রা এতো বেশি ছিলো যে কোয়ার্ক কণাগুলো প্রোটন বা নিউট্রনের মধ্যে আবদ্ধ ছিলো না – ঠিক যেমন জলের অণুগুলো উচ্চ তাপমাত্রায় পাত্রের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না ।
কিন্তু মহাবিশ্ব যত প্রসারিত হয়, তত ঠাণ্ডা হতে থাকে। আমাদের কাহিনি শুরু হচ্ছে বিস্ফোরণের সামান্য সময় পরে। কতটা পরে? মোটামুটি বলতে গেলে এক সেকেণ্ডের এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ
10-5 সেকেণ্ড পরে। এর ঠিক আগে হিগস ক্ষেত্র থেকে মৌলিক কণাগুলো ভর পেয়েছে। এই মুহুর্তে বিশ্বের তাপমাত্রা কমে হয়েছে এক লক্ষ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এই তাপমাত্রায় আলাদা করে প্রোটন ও
নিউট্রনের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব।
মনে রাখতে হবে যে সাধারণ অবস্থায় নিউট্রন চিরস্থায়ী কণা নয়। আমরা যদি কিছু সংখ্যায় নিউট্রন নিয়ে শুরু করি, তাহলে মোটামুটি দশ মিনিটের মধ্যে তার মধ্যে অর্ধেক ভেঙে যাবে। এই পদ্ধতিকে আমরা সমীকরণের সাহায্যে লিখতে পারি
মনে রাখতে হবে যে সাধারণ অবস্থায় নিউট্রন চিরস্থায়ী কণা নয়। আমরা যদি কিছু সংখ্যায় নিউট্রন নিয়ে শুরু করি, তাহলে মোটামুটি দশ মিনিটের মধ্যে তার মধ্যে অর্ধেক ভেঙে যাবে। এই পদ্ধতিকে আমরা সমীকরণের সাহায্যে লিখতে পারি
n→p+e-+ν
অর্থাৎ নিউট্রন ভেঙে তৈরি হয় প্রোটন,
ইলেকট্রন ও প্রতিনিউট্রিনো (ν)। নিউট্রিনো বা তার প্রতিকণা প্ৰতিনিউট্রিনো বিষয়ে আলোচনা অন্য সময় করা যাবে। আমরা শুধু মনে রাখবো যে এই কণাগুলোর ভর প্রায় শূন্য। কিন্তু সৃষ্টির আদিতে নিউট্রন ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা বিক্রিয়া ঘটতো,
তা হলো
p+ν→e++n
দেখা
যাক ব্যাপারটা কি হলো। নিউট্রনের ভর প্রোটনের চেয়ে বেশি। আমরা জানি যে ভর ও
শক্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাই উপরের দ্বিতীয় বিক্রিয়াতে প্রোটন থেকে নিউট্রন বানাতে গেলে অনেকটা শক্তি লাগে। কোথা থেকে এই অতিরিক্ত শক্তি আসবে?
নিশ্চয় প্রতিনিউট্রিনোর ভর থেকে নয়, কারণ তার ভর নেই বললেই চলে। তাহলে শক্তিটা আসতে হবে প্রতিনিউট্রনোর গতিশক্তি থেকে। আজকের বিশ্বে ঐরকম শক্তিসম্পন্ন প্ৰতিনিউট্রিনো পাওয়া যাবে না। তার সহজ কারণ বিশ্ব এখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কিন্তু সৃষ্টির গোড়ায় পরিস্থিতি ছিলো অন্যরকম। তখন তাপমাত্রা ছিলো। অনেক বেশি,
তাই প্রতিনিউট্রিনোর গতিশক্তিও প্রোটন থেকে নিউট্রন বানানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিলো। তাই নিউট্রন ভেঙে যেমন প্রোটন হতো, একইসঙ্গে প্রোটন থেকে নিউট্রন তৈরি হচ্ছিলো ।
আবারও মনে রাখতে হবে যে মহাবিশ্বের প্রসারণ বন্ধ হয়নি। একই সঙ্গে তার তাপমাত্ৰাও কমছে। তাপমাত্রা কমা মানে কণাদের গতিশক্তি কমে যাওয়া। মোটামুটি এক সেকেণ্ড পরে তাপমাত্রা কমে হলো এক হাজার কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। প্রতিনিউট্রিনোরা আর প্রোটন থেকে নিউট্রন তৈরি করতে পারলো না। নিউট্রনরা এবার আস্তে আস্তে প্রোটনে ভেঙে যেতে শুরু করলো। তবে সব নিউট্রন এক সঙ্গে ভাঙবে না। আগেই বলেছি,
দশ মিনিটে নিউট্রনের সংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে যাওয়ার কথা। অবশ্য দশ মিনিটের অনেক আগেই মুক্ত নিউট্রন মহাবিশ্ব থেকে নিঃশেষ হয়ে যায়। কোথায় যায় তারা?
প্রোটনের পরে যে নিউক্লিয়াস সবচেয়ে সরল, তা হলো ভারি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস। তার মধ্যে আছে একটা প্রোটন ও
একটা নিউট্রন। বোঝাই যাচ্ছে এটা হাইড্রোজেনের আইসোটোপ, এর পোশাকি নাম ডয়টেরিয়াম। প্রোটন নিউট্রন মিলে ডয়টেরিয়াম বানানোই সবচেয়ে সহজ। কিন্তু ডয়টেরিয়ামের মধ্যে আবার প্রোটন নিউট্রন একে অপরকে খুব শক্ত করে ধরে রাখে না। বিজ্ঞানের ভাষায় বললে ডয়টেরিয়ামের বন্ধন শক্তি
(Binding Energy) কম। তাই তাপমাত্ৰা যতক্ষণ না কমছে,
ততক্ষণ ডয়টেরিয়াম তৈরি হওয়া সম্ভব নয় – তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা ভেঙে পড়বে।
দু মিনিট পরে তাপ মাত্রা কমে হলো একশো কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। ডয়টেরিয়াম তৈরি হলেও এখন আর ভেঙে পড়লো না। কিন্তু ডয়টেরিয়ামেই এই বিক্রিয়া শেষ হলো না। ডয়টেরিয়াম, মুক্ত প্রোটন ও
নিউট্রনের মধ্যে নানা বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হলো হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস যার মধ্যে আছে দুটো প্রোটন এবং দুটো নিউট্রন। কুড়ি মিনিটের মধ্যে সমস্ত নিউট্রন হিলিয়ামের মধ্যে বাঁধা পড়ে গেলো। মনে রাখতে হবে মুক্ত নিউট্রন ক্ষণস্থায়ী হলেও নিউক্লিয়াসের মধ্যে নিউট্রন সহজে ভেঙে যায় না। অনেক নিউক্লিয়াসের মধ্যে তারা কখনোই ভেঙে পড়ে না – হিলিয়াম বা ডয়টেরিয়ামের ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটা খাটে। তাহলে যদি কোনো মুক্ত নিউট্রন থেকেও থাকে,
আধঘন্টার মধ্যেই তা ভেঙে প্রোটন তৈরি করবে। মহাবিশ্বের প্রায় সমস্ত নিউট্রনই এখন হিলিয়ামের মধ্যে। খুব একটা সহজ অঙ্ক কষে দেখানো যায় যে মহাবিশ্বের প্রায় ৭৫ শতাংশ হবে হাইড্রোজেন আর ২৫ শতাংশ হবে হিলিয়াম। প্ৰথম সারণীর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে এখনো পর্যন্ত আমরা ঠিক পথেই চলেছি।
আরো ভারি পরমাণুরা কেমন করে তৈরি হলো? মনে হতে পারে যে হিলিয়াম,
প্রোটন ও নিউট্রন পরষ্পরের মধ্যে বিক্রিয়া করে আরো ভারি মৌলগুলো তৈরি করবে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। কারণ এদের মধ্যে বিক্রিয়ার মাধ্যমে যে সমস্ত নিউক্লিয়াস তৈরি হয়ে,
তারা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, তৈরি হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তারা ভেঙে পড়ে। তাই মহা বিস্ফোরণের মিনিট তিনেক পরে নতুন নিউক্লিয়াস তৈরি আপাতত বন্ধ হয়ে গেলো। এই প্রথম পর্যায়ের যে ঘটনাক্রম,
তাকে আমরা বলি Big Bang Nucleosynthesis অর্থাৎ মহা বিস্ফোরণের সময় নিউক্লিয়াসের সৃষ্টি। সৃষ্টির আদিতে মহাবিস্ফোরণে নিউক্লিয়াস সৃষ্টির কথা প্রথম বলেছিলনে র্যালফ আলফার ও জর্জ গ্যামো। তারকাদের অভ্যন্তরে মৌলিক পদার্থ সৃষ্টির বিষয়ে এর পরে যা আলোচনা করব, তার কাঠামো নির্মাণের কৃতিত্ব চারজন বিজ্ঞানীর -- ফ্রেড হয়েল, উইলিয়াম ফাউলার, মার্গারেট বারবিজ ও জিওফ্রে বারবিজ।
এই পর্যায়ের শেষে মহা বিশ্বের মোট বস্তুর চারভাগের তিনভাগ এখন তাহলে হাইড্রোজেন আর এক ভাগ হিলিয়াম। এর সঙ্গে খুব সামান্য লিথিয়ামও তৈরি হয়েছিল। মনে রাখতে হবে যে পরমাণুরা কিন্তু এখনো তৈরি হয় নি। আগেই দেখেছি নিউক্লিয়াস ও
ইলেকট্রন মিলেই পরমাণু তৈরি হয়। কিন্তু পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনরা যে খুব শক্ত করে নিউক্লিয়াসের সঙ্গে বাঁধা থাকে তা নয়। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত না তাপমাত্রা অনেকটা কমছে,
ততক্ষণ পরমাণু তৈরি সম্ভব নয় – তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা নিউক্লিয়াস ও
ইলেকট্রনে ভেঙে যাবে। প্রায় চার লক্ষ বছর পরে তাপমাত্রা এতটা কমে গেলো যে স্থায়ীভাবে পরমাণু তৈরি হওয়া সম্ভব হলো। আরো পরে দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে তৈরি করলো হাইড্রোজেনের অণু।
এর পর কেটে গেলো আরো কয়েক কোটি বছর। ইতিমধ্যে হাইড্রোজেন ও
হিলিয়াম অণু-পরমাণুরা তাদের নিজেদের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণের মাধ্যমে বিরাট বিরাট মহাজাগতিক মেঘ তৈরি করেছে। কত বড়ো হতে পারে এই মেঘ? আমরা জানি আলো এক সেকেণ্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার পথ যেতে পারে। একটা সাধারণ আয়তনের মহাজাগতিক মেঘের একপাশ থেকে অন্য পাশ পর্যন্ত যেতে আলোর একশো বছর সময়ও লাগতে পারে। তার ভরও আমাদের সূর্যের চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে,
হয়তো এক থেকে দশ লক্ষ গুণ। এই মেঘ এবার নিজের মাধ্যাকর্ষণের টানে ছোটো হতে থাকে। একটা বল যদি উপর থেকে নিচে ফেলি,
তাহলে তার গতিশক্তি বাড়তে থাকে। ঠিক তেমনি মেঘের অণুগুলো যত ভিতরের দিকে আসে, তাদের গতিশক্তি বাড়ে। আমরা জানি তাপ হলো গতিশক্তির প্রকাশ। অর্থাৎ মেঘের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে
– পৌঁছে যায় কয়েক লক্ষ ডিগ্রি সেন্টিগ্ৰেডে ।
এই মেঘ থেকেই নক্ষত্রদের জন্ম হয়। সাধারণত একটা বিশাল মেঘ থেকে অনেক নক্ষত্র এক সঙ্গে সৃষ্টি হয়। নক্ষত্রের মধ্যে কী ঘটনা ঘটে ? সাধারণভাবে দুটো প্রোটন পরস্পরের কাছে আসতে পারে না – তাদের ধনাত্মক আধানের জন্য তারা পরষ্পরকে বিকর্ষণ করে। কিন্তু যদি তাদের গতিশক্তি খুব বেড়ে যায়,
তাহলে তারা হয়তো বিকর্ষণ বল সত্ত্বেও পরস্পরের সঙ্গে মিলতে পারে। আমরা চার রকম বলের কথা পড়েছি। নিউট্রন বা প্রোটনরা যখন খুব কাছাকাছি আসে, তখন দু রকম বল, পীন (Strong) বল ও
ও ক্ষীণ (Weak) বল তাদের মধ্যে কাজ করে। তাই একমাত্র উচ্চ তাপ মাত্রায় প্রোটন থেকে কয়েক ধাপে নতুন ভারি নিউক্লিয়াস তৈরি হওয়া সম্ভব। তাই আমাদের ঘরে কিছুটা হাইড্রোজেন গ্যাস রেখে দিলে তারা চিরকালই হাইড্রোজেনই থেকে যাবে। কিন্তু হাইড্রোজেনের মেঘের তাপমাত্রা যখন কয়েক লক্ষ ডিগ্রি হয়ে যায়,
তখন প্রোটনগুলো পরষ্পরের কাছে আসতে পারে। কয়েকটা বিক্রিয়ার মাধ্যমে তারা হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি করে।
হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর চারটে প্রোটনের ভরের থেকে কিছুটা কম। এই ভরটা শক্তি হিসেবে বেরিয়ে আসে এবং মেঘটাকে গরম রেখে দেয় যাতে করে বিক্রিয়াটা চলতেই থাকে। এই ভাবেই নক্ষত্রের জন্ম হয়। আমাদের সূর্যে ঠিক এই বিক্রিয়াই চলছে। এক লাইনে লিখলে বিক্রিয়াটা হবে
4p→24He+2e++2ν
এই বিক্রিয়া চলে নক্ষত্রের অভ্যন্তরে। ডানদিকে যে সমস্ত কণা
বা নিউক্লিয়াস আছে, তার ভর চারটে প্রোটনের ভরের থেকে কম, সেই অতিরিক্ত ভরটা
তাপশক্তি হিসাবে বেরিয়ে আসে এবং নক্ষত্রকে গরম করে রেখে দেয়। এধরনের আরো কিছু বিক্রিয়া আছে যেগুলো সূর্যের চেয়ে ভারি নক্ষত্রে ঘটে। সেই বিষয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আমাদের নেই, কিন্তু শুধু একটা কথা মনে রাখা দরকার। সূর্য বা তার মতো ভারি নক্ষত্রে এই বিক্রিয়াটা চলে খুব ধীর গতিতে। তাই সূর্য অন্তত সাড়ে চারশো কোটি বছর ধরে আলো দিচ্ছে এবং আরো সাড়ে চারশো কোটি বছর পরে তার কেন্দ্রের হাইড্রোজেন শেষ হবে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ভারি নক্ষত্রে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরিটা হয় অনেক তাড়াতাড়ি। তাই কোনো কোনো নক্ষত্র এমনকি এক কোটি বছরেরও কম সময়ে তার কেন্দ্রের জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে। খুব সহজে বলা যায়,
যে নক্ষত্র যত ভারি,
তার আয়ু তত কম।
হাইড্রোজেন তো শেষ হয়ে গেলো,
এবার তাহলে নক্ষত্র কি নিভে যাব? এখানে ব্যাপারটা একটু জটিল,
সহজে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করা যাক। আগেই বলেছিলাম যে মহাজাগতিক মেঘ নিজের আকর্ষণে ছোটো হয়ে নক্ষত্রের জন্ম দেয়। কিন্তু নক্ষত্রের ভর তো আর বিশেষ পাল্টায় না, তাহলে নক্ষত্রের সংকোচন বন্ধ হয়ে যায় কেন? তার কারণ হলো নক্ষত্রের তাপমাত্রা বেশী বলে যে গ্যাস দিয়ে সে তৈরি তার চাপও বেশি। গ্যাসের তাপমাত্রা বাড়ালে তার চাপ বাড়ে। গ্যাসের এই চাপ এবং নক্ষত্র যে আলো বিকিরণ করে তার চাপ, এই দুই চাপ মাধ্যকর্ষণের বিপক্ষে কাজ করে বলে নক্ষত্র আর ছোটো হতে পারে না। কিন্তু যেই নক্ষত্রের কেন্দ্রের আশেপাশের অঞ্চলে হাইড্রোজেন পুরোপুরি হিলিয়ামে পরিবর্তিত হয়ে যায়,
তখন জ্বালানি শেষ হয় বলে নিউক্লিয় বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। তার ফলে চাপ যায় কমে। তখন নক্ষত্র নিজের মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে আবার সংকুচিত হতে শুরু করে। ঠিক আগের মতোই,
সংকোচনের ফলে তাপমাত্রা আরো বেড়ে যায়
| কেন্দ্রের তাপমাত্রা তখন এত বেড়ে যায় তৈরি হয় একটা কার্বন নিউক্লিয়াস। কার্বনের নিউক্লিয়াসের মধ্যে আছে ছটা করে প্রোটন ও
নিউট্রন।
এর আগে কেন নক্ষত্রের কেন্দ্রে হিলিয়াম বিক্রিয়া হচ্ছিলো না? তার কারণ দুটো। প্রথমত হিলিয়ামের আধান হাইড্রোজেনের দ্বিগুণ
– তাই একটা প্রোটন অর্থাৎ হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসকে একটা হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের কাছে আনতে যতটা বল লাগে,
দুটো হিলিয়াম নিউক্লিয়াসকে কাছাকাছি আনতে বল লাগে তার প্ৰায় দ্বিগুণ। সেকারণে তাপমাত্রা অনেকটা বেশি না হলে হিলিয়াম বিক্রিয়া সম্ভব নয়। যতক্ষণ হাইড্রোজেন বিক্রিয়া চলে ততক্ষণ তাপমাত্রা থাকে অনেক কম। দ্বিতীয়ত,
দুটো হিলিয়াম
নিউক্লিয়াস মিলে যে নতুন নিউক্লিয়াস তৈরি হরে, বেরিলিয়ামের সেই আইসোটোপ একেবারেই
সুস্থিত নত, তৈরির সঙ্গে সঙ্গে তা ভেঙে পড়ে। তাই হিলিয়ামের বিক্রিয়াটা ঘটতে গেলে একই সঙ্গে তিনটে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসকে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে হবে। সাধারণ নক্ষত্রের কেন্দ্রে এ
ঘটনাটা ঘটে না। এমনকি মহা বিস্ফোরণের সময়ও হিলিয়াম তৈরি হওয়ার পরে এক জায়গায় তিনটে হিলিয়াম পরমাণু আসার সম্ভাবনা ছিলো না বললেই চলে। কিন্তু হাইড্রোজেন শেষ হওয়ার পরে নক্ষত্র যখন সংকুচিত হয়, তখন তার কেন্দ্রের ঘনত্ব বেড়ে যায় অনেক
– অর্থাৎ নিউক্লিয়াসগুলো অনেক ঘেঁষাঘেষি করে থাকে। ফলে তিনটে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস অনেক সময়ই খুব কাছাকাছি চলে আসে। সেই পরিস্থিতিতে তারা এক সঙ্গে মিলে কার্বন তৈরি করতে পারে। কার্বন নিউক্লিয়াসের ভর তিনটে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর অপেক্ষা কম। এই অতিরিক্ত ভরটা শক্তি হিসেবে বেড়িয়ে আসে। নক্ষত্র আবার নতুন করে জ্বলতে শুরু করে। ফ্রেড
হয়েল দেখিয়েছিলেন এই বিক্রিয়ার জন্য কারবন নিউক্লিয়াসের একটি বিশেষ শক্তিস্তর
দায়ী, তাঁর নামানুসারে আমরা তাকে বলি হয়েল শক্তিস্তর। কার্বন যেহেতু প্রাণের মূল
উপাদান, তাই প্রাণের অস্তিত্বের পিছনে হয়েল স্তরের বিশেষ ভূমিকা আছে।
কেন্দ্রের হিলিয়ামও এক দিন শেষ হয়ে যায়। আবার সেই চক্রের পুনরাবৃত্তি ঘটে। আবার নক্ষত্রের কেন্দ্র সংকুচিত হয়, আবার তার তাপমাত্রা বাড়ে। তাপমাত্রা এতই বেড়ে যায় যে এবার দুটো কার্বন নিউক্লিয়াস পরস্পরের কাছে এসে বিক্রিয়া করে তৈরি করে নিয়ন বা তার চেয়েও ভারি নিউক্লিয়াস। এভাবে পর পর কার্বন,
নিয়ন, অক্সিজেন ও
সিলিকন জ্বালানির কাজ করে। শেষ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া শেষ হয় গিয়ে লোহাতে ।
এখানে কয়েকটা কথা বলে রাখা দরকার। সব নক্ষত্ৰ যে এই ধাপগুলোর মধ্যে দিয়ে যেতে পারে তা নয় – একমাত্র খুব ভারি নক্ষত্রেরাই লোহা তৈরি করতে সক্ষম হয়। সূর্য যেমন কখনোই কার্বন জ্বালানোর স্তরে পৌছোবে না। দ্বিতীয়ত,
পরের স্তরগুলো অনেক কম সময় স্থায়ী। যেমন সূর্যের চেয়ে পঁচিশ গুণ ভরের কোনো নক্ষত্র হাইড্রোজেন জ্বালানোর স্তরে থাকে। পঞ্চাশ লক্ষ বছর, কিন্তু সিলিকন শেষ করতে সময় নেয় এক দিনেরও কম।
নক্ষত্রের কেন্দ্রের বিক্রিয়া কেন শেষ পর্যন্ত লোহাতে শেষ হয়? তার কারণ হল যে লোহা বা তার চেয়ে ভারি কোনো নিউক্লিয়াসের সঙ্গে অন্য কোনো নিউক্লিয়াস বিক্রিয়া করে লোহার থেকে ভারি নিউক্লিয়াস তৈরি করলে তাতে কোনো শক্তি পাওয়া যায় না। আমরা এর আগে দেখছিলাম যে দুটো নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে যখন কোনো ভারি নতুন নিউক্লিয়াস তৈরি করছে,
তখন কিছুটা অতিরিক্ত ভর শক্তি হিসেবে বেরিয়ে আসছে। এই শক্তিটাই নক্ষত্র কে গরম রাখে যাতে করে বিক্রিয়াটা বন্ধ হয়ে যায় না, চলতেই থাকে। লোহার ক্ষেত্রে এই শক্তিটা পাওয়া তো যায় না, উল্টে আরো কিছু শক্তি দিতে হয়। তার মানে নক্ষত্র ঠাণ্ডা হতে শুরু করে। তাই বিক্রিয়াটা বন্ধ হয়ে যায়।
তাহলে লোহার চেয়ে ভারি মৌলগুলো এলো কোথা থেকে
? আগেই বলেছি,
প্রথম সারণীর দিকে চোখ রাখলে বোঝা যায় যে লোহার চেয়ে ভারি মৌলরা অন্য কোনো পদ্ধতিতে তৈরি হয়। কী সেই পদ্ধতি?
যদিও মুক্ত নিউট্রন আমাদের চারপাশে পাওয়া যায় না, কিন্তু যেমন কার্বন, নিয়ন,
অক্সিজেন ইত্যাদি জ্বালানোর সময় নিউট্রন তৈরি হয়। মনে রাখতে হবে যে নিউট্রনের কোনো তড়িৎ আধান নেই, তাই নিউক্লিয়াস তাকে বিকর্ষণ করে না। তাই তা সহজেই নিউক্লিয়াসের ভিতরে ঢুকতে পারে। ধরা যাক এরকমই কয়েকটা নিউট্রন একটা লোহার নিউক্লিয়াসে ঢুকলো। তাহলে লোহার যে আইসোটোপ তৈরি হলো, তা সাধারণ লোহার চেয়ে অনেক ভারি। কিন্তু এই আইসোটোপটা চিরস্থায়ী নয় – বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে লোহার নিউক্লিয়াসের একটা নিউট্রন প্রোটনে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ প্রোটনের সংখ্যা এক বেড়ে গেলো,
তৈরি হলো নতুন মৌল কোবাল্ট। আবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, আরো নতুন নতুন মৌল সৃষ্টি হয়। এভাবে সিসা পর্যন্ত সমস্ত মৌল তৈরি হয়েছে। তার পর নক্ষত্রের মৃত্যুর সময় এক বিস্ফোরণ ঘটে যাকে বলে নোভা বা সুপারনোভা। নতুন তৈরি সমস্ত মৌল তখন মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে।
নক্ষত্রের জ্বলার সময় এক সঙ্গে বেশি নিউট্রন পাওয়া যায় না। সিসার চেয়ে ভারি মৌল। এভাবে তৈরি সম্ভব নয়। মহাবিশ্বে যে দু’ভাবে এক সঙ্গে অনেক নিউট্রন পাওয়া যেতে পারে,
তারা হলো নিউট্রন তারার সংযুক্তি এবং সুপারনোভা বিস্ফোরণ। এ
নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। এই লেখাটায় এ বিষয়ে আরো আলোচনা আছে। এই দুই ঘটনার সময় বিপুল সংখ্যায় নিউট্রন তৈরি হয়, তারা লোহা জাতীয় ভারি মৌলের নিউক্লিয়াসে ঢুকে,
এবং তারপর বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে আরো ভারি মৌল তৈরি করতে পারে। এই পদ্ধতিতেও লোহা থেকে সিসা পর্যন্ত মৌল তৈরি হয়। সিসার চেয়ে ভারি মৌলগুলো এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে।
দ্বিতীয় সারণীঃ ভূত্বকে ও মানবদেহে মৌলিক পদার্থের
শতাংশে পরিমাণ
ভূত্বক
|
মানবদেহ
|
||
মৌল
|
পরিমাণ
|
মৌল
|
পরিমাণ
|
অক্সিজেন
|
47
|
অক্সিজেন
|
65
|
সিলিকন
|
28
|
কার্বন
|
18
|
অ্যালুমিনিয়াম
|
8
|
হাইড্রোজেন
|
10
|
লোহা
|
5
|
নাইট্রোজেন
|
3
|
ক্যালসিয়াম
|
3.6
|
ক্যালসিয়াম
|
1.5
|
সোডিয়াম
|
2.8
|
ফসফরাস
|
1.2
|
এতক্ষণ যে সমস্ত প্রক্রিয়ার কথা বললাম, সেগুলোতে সৃষ্ট মৌল দিয়েই তৈরি আমাদের পৃথিবী, আমাদের দেহ। বহু সংখ্যায় নক্ষত্রের মৃত্যু না ঘটলে সৌরজগতের সৃষ্টি সম্ভব ছিলো না। দ্বিতীয় সারণীর দিকে তাকালে দেখা যায় আমাদের দেহ, কিংবা যে পৃথিবীর উপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তার বাইরের স্তর নির্মিত হয়েছে মূলত হাইড্রোজেন বা হিলিয়ামের চেয়ে ভারি মৌল দিয়ে। এরা সবাই নক্ষত্রের অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছে। ভাবতে কেমন লাগে, আমাদের শরীরের নব্বই শতাংশ পদার্থই এক সময় কোনো না কোনো নক্ষত্রের ভিতরে ছিলো – সেই নক্ষত্রদের মৃত্যু না ঘটলে আমাদের জন্ম হতো না।
হিলিয়ামের থেকে ভারি সমস্ত মৌল যে পদ্ধতিতে নক্ষত্রের ভিতরে তৈরি হয়, তা মূলত দেখিয়েছিলেন চারজন বিজ্ঞানী। এই কাজের জন্য তাঁদের মধ্যে একজন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন,
তা নিয়ে সমালোচনাও হয়েছিল। আগে এই কাজের জন্য তাঁদের চারজনই একসঙ্গে একবার নোবেল পুরস্কারের
জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন। 1957 সালে রিভিউজ অফ
মডার্ন ফিজিক্সে প্রকাশিত তাঁদের সেই গবেষণাপত্রের লেখকতালিকাতে আছেন মার্গারেট ও জিওফ্রে
বারবিজ, উইলিয়াম ফাউলার ও ফ্রেড হয়েল। তাঁদের নামানুসারে এই গবেষণাপত্রটি B2FH
বলে বিজ্ঞানীমহলে পরিচিত। চারজনের মধ্যে উইলিয়াম ফাউলারই শেষ পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার
জিতেছিলেন।
এতক্ষণ পর্যন্ত যে সমস্ত পদার্থের গল্প বললাম,
তারা আমাদের চেনা। মহাবিশ্ব কি শুধু এই প্রোটন নিউট্রন ইলেকট্রন দিয়ে তৈরি পরমাণু দিয়েই গঠিত
? নাকি ভালো করে খুঁজলে আরো কিছু পাওয়া যাবে
?
আমরা জানি যে নক্ষত্রেরা দল বেঁধে থাকে। এরকম কোটি কোটি নক্ষত্র নিয়ে তৈরি দলকে বলে গ্যালাক্সি। আমাদের সূর্য যে গ্যালাক্সির সদস্য,
তার নাম আকাশগঙ্গা বা
Milky Way।
কেউ কেউ বলেন
ছায়াপথ। মহাবিশ্বে এরকম কোটি কোটি গ্যালাক্সি আছে। গ্যালাক্সিরা একে অন্যকে মাধ্যাকর্ষণ বলের মাধ্যমে আকর্ষণ করে। দুটি বস্তুর মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ বল তাদের ভরের উপর নির্ভর করে। তাই গ্যালাক্সিদের চলাফেরা থেকে তাদের ভর বের করা সম্ভব ।
ভর নির্ণয় করতে গিয়ে দেখা গেলো যে আমরা নক্ষত্ৰ, মহাজাগতিক মেঘ ইত্যাদি চোখে দেখে গ্যালাক্সির ভর যতটা আন্দাজ করছিলাম,
তার থেকে আসলে গ্যালাক্সির ভর কয়েকগুণ বেশি। এই বাড়তি ভরটা আসছে কোথা থেকে?
অধিকাংশ বিজ্ঞানী মনে করছেন যে এটা আমাদের জানা সাধারণ পদার্থ হতে পারে না। কারণ মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় যে Big Bang
Nucleosynthesis-এর কথা আগে বলেছি,
সে সময় সাধারণ পদার্থের কতটা ঘনত্ব ছিলো সেটা তামরা জানি। যদি সাধারণ পদার্থের পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি। থাকতো,
তাহলে সেই বিক্রিয়াতে তৈরি বিভিন্ন পদার্থের পরিমাণ একেবারেই অন্যরকম হতো – এখন আমরা যা দেখতে পাই তার সঙ্গে একেবারেই মিলতো না। তাই সাধারণ পদার্থের পরিমাণ বাড়ালে চলবে না – দরকার একদম নতুন ধরনের এক পদার্থ যা প্রোটন নিউট্রন ইলেকট্রন দিয়ে তৈরি নয়। এদের চোখে দেখা যায় না, অর্থাৎ এরা আলোর সঙ্গে ক্রিয়া করে না। তাই এদের নাম দেওয়া হয়েছে কৃষ্ণ বস্তু বা Dark
Matter।
আমাদের মহাবিশ্বের এই নতুন পদার্থের পরিমাণ সাধারণ পদার্থের পাঁচ গুণেরও বেশি। তার মানে মহাবিশ্ব যে সমস্ত পদার্থ দিয়ে তৈরি,
তার অধিকাংশটা সম্পর্কে আমরা প্ৰায় কিছুই জানি না। বিজ্ঞানীরা অনেকরকম চেষ্টা করছেন,
কিন্তু কৃষ্ণ বস্তু আজও আমাদের পরীক্ষাগারে ধরা পড়েনি।
এই কি শেষ?
কৃষ্ণ বস্তু কী জানতে পারলেই কী আমরা মহাবিশ্ব শেষ পর্যন্ত কী দিয়ে তৈরি জানতে পারব?
না। জানার এখনো আরো অনেক বাকি। দেখা যাক আরো কোন বিস্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
একটা পাথরের টুকরো নিয়ে মাটি থেকে উপরে ছুড়ে দিলাম। সেটা যত উপরে উঠবে,
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের জন্য তার বেগ তত কমবে। এক সময় সেটা থেমে গিয়ে তারপর আবার মাটিতে এসে পড়বে। যদি খুব জোরে ছুড়তে পারতাম। তাহলে হয়তো সেটা পৃথিবীর চারদিকে কক্ষপথে পৌঁছে যেতো। যদি আরো জোরে ছুড়তাম,
তাহলে হয়তো সেটা পৃথিবীর আকর্ষণকে উপেক্ষা করে চলে যেত। কিন্তু,
সেটার যে বেগ ক্রমশ কমতো,
তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মহা বিস্ফোরণের সময় মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে শুরু করেছে। মনে রাখতে হবে যে মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু একে অন্যকে মাধ্যাকর্ষণ বলের মাধ্যমে আকর্ষণ করে। তাই আমরা ভেবেছিলাম যে প্রসারণের বেগ নিশ্চয় কমছে। বিশ্বের অন্তিম পরিণতি কী? যদি শুরুর সময়ের বেগ যথেষ্ট বেশি না হয়, তাহলে প্রসারণ এক সময় বন্ধ হয়ে যাবে। তার পর শুরু হবে সংকোচন। যদি শুরুর বেগ যথেষ্ট বেশি হয়, তাহলে এই প্রসারণ কখনোই বন্ধ হবে না।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মহা বিস্ফোরণের পর থেকে বিভিন্ন যুগে বিশ্বের প্রসারণের বেগ মাপা সম্ভব হলো। কেমন ভাবে,
সেই আলোচনার সুযোগ এই প্রবন্ধে নেই। কিন্তু একটা কথা সহজেই বোঝা গেলো। মহাবিশ্বের প্রসারণ বেগ এক সময় কমছিলো বটে, কিন্তু এখন তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। এ যেন আমি পাথরের টুকরোটা আকাশে ছুড়লাম,
আর তার বেগ প্রথমে কিছুক্ষণ কমে তারপর হঠাৎ আবার বাড়তে শুরু করলো
! মহাবিশ্বের এই অদ্ভুত আচরণের কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। তবে যে শক্তির জন্য এই প্রসারণ,
তাকে আমরা নাম দিয়েছি কৃষ্ণ শক্তি বা Dark
Energy ।
মহাবিশ্বে সাধারণ পদার্থ কৃষ্ণ বস্তু এবং কৃষ্ণ শক্তির পরিমাণ মাপা সম্ভব হয়েছে। দেখা গেছে সাধারণ বস্তু আছে 5 শতাংশ, কৃষ্ণ বস্তু আছে 27 শতাংশ এবং কৃষ্ণ শক্তির পরিমাণ
68 শতাংশ। আমাদের সমস্ত জ্ঞান কিন্তু ঐ
প্রথম 5 শতাংশেই সীমাবদ্ধ। তাই এই বিপুল বিশ্ব সম্পর্কে এখনো আমাদের অনেক কিছু জানার আছে সন্দেহ নেই। এই নিবন্ধে আমরা সাধারণ পদার্থ কেমনভাবে তৈরি হলো সেই আলোচনা খুব সংক্ষেপে করলাম। তবে এই বিষয়টাও য়ে আমরা পুরোপুরি বুঝতে পেরেছি তা নয়। সহজ ভাবে লিখতে গিয়ে অনেক জায়গায় মাঝের বহু ধাপ আমরা আলোচনার বাইরে রেখেছি। অনেকগুলো বিক্রিয়া আমাদের পরীক্ষাগারে এখনো করা সম্ভব হয়নি
– বিজ্ঞানীরা এখনো সেই সমস্ত বিষয়ে গবেষণা করছেন।
প্রকাশঃ জ্ঞান
ও বিজ্ঞান শারদীয় ২০১৭ (পরিমার্জিত)
ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি বিষয়ে আরো একটু বেশি খবর ব্লগের
পরমাণু থেকে কৃষ্ণশক্তি লেখাটায় পাওয়া যাবে
"......আমারা একই উৎস থেকে উৎসারিত। আমাদের জীবনের শিকড় শেষ পর্যন্ত চলে গেছে ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে।......
ReplyDeleteআমাদের রং কালোই হোক আর সাদায় হোক, আমরা হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান বৌদ্ধ, যে সম্প্রদায়েরই হই না কেন, আমরা একই পরিবারের সদস্য,...।...শুধু যদি মনে রাখি, আমরা একই উৎস থেকে এসেছি, তাহলেই আমরা ভুলতে পারবো আমাদের প্রভেদ।...............
.........আমাদের প্রত্যেকের শরীরে রয়েছে তারার ধুলো। মহাবিশ্বের কাছে আমরা নিতে পারি সমতার দীক্ষা,...।.........": ড: মণি ভৌমিক
(বিশ্বজীবনী)
Great....
ReplyDeleteWell written Sir
ReplyDeleteএই বিষয়ে কাজ করছি বিগত কয়েক বছর, কিন্তু এতো সহজ প্রাঞ্জল ভাবে যে প্রকাশ করা যাবে, কখনো ভাবিনি। বিশেষত মাতৃ ভাষায়। ধন্যবাদ স্যার এক লাহোমায় পুরোটা পড়ে ফেললাম।
ReplyDeleteএমন কঠিন, এমন বহুবিস্তৃত বিষয় এতো সহজভাবে মাতৃভাষা বাংলায় লেখার জন্য লেখককে অশেষ ধন্যবাদ। এটি খুব আগ্রহের বিষয় ছিল আমার। সমৃদ্ধ হলাম।
ReplyDelete