বিজ্ঞান অতিমারী
ও কুসংস্কার
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
গত
কয়েক মাস সারা পৃথিবী এক অতিমারীর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। মহামারী শব্দটার সঙ্গে সবাই পরিচিত
ছিলাম, অতিমারী শব্দটা অনেকের কাছেই নতুন। মহামারী যখন অনেক দেশে বা মহাদেশে ছড়িয়ে
পড়ে, তখন তার নাম হয় অতিমারী। খুব সাম্প্রতিক কালে ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লুকেও অতিমারী
বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। এর আগে ১৯৫৭-৫৮ সালের এশিয়ান ফ্লু এবং ১৯৬৮ সালের হংকং ফ্লুকেও
অতিমারী বলা হয়। কিন্তু বর্তমান অতিমারীর মতো অভিজ্ঞতা পৃথিবীর প্রায় কোনো মানুষের
নেই। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লুর জন্য মৃতের সংখ্যা ছিল এক থেকে চার লক্ষের মধ্যে। হংকং
ফ্লু বা এশিয়ান ফ্লু, এই দুয়েরই শিকারের সংখ্যা দশ লক্ষের কাছাকাছি ছিল। তুলনায় আজ
৩১ আগস্ট কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে আট লাখের বেশি, এবং শেষ পর্যন্ত কত মানুষ
এই রোগের শিকার হবেন তা আমরা জানি না।
একই
মাত্রার অতিমারীর কথা জানতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে এক শতাব্দী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের
শেষ পর্বে ১৯১৮-১৯ সালে স্প্যানিশ ফ্লু অতিমারীর চেহারা নিয়েছিল। কমপক্ষে দেড় কোটি
লোকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু, আসল সংখ্যাটা এর কয়েকগুণও হতে পারে। পৃথিবীর
প্রতি তিন জন মানুষের এক জন সম্ভবত এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের জনসংখ্যা
১৯১০ সালে যা ছিল, স্প্যানিশ ফ্লুয়ের জন্য ১৯২০ সালের জনগণনাতে তার থেকে কমে গিয়েছিল।
আগেই
বলেছি মহামারী যখন একই সঙ্গে অনেক দেশে দেখা দেয়, তখন তাকে আমরা অতিমারী বলি। আমরা
সবাই জানি যে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আধুনিক উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্যই করোনা বা কোভিড-১৯
এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে। স্প্যানিশ ফ্লু যে সারা পৃথিবীতে থাবা বসিয়েছিল, তার কারণ
হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশের মধ্যে সৈন্য চলাচল। প্রাচীনকালে মৃত্যুর হিসাব
সঠিক জানা যায় না, অনুমান করা হয় যে ব্ল্যাক ডেথ প্লেগের জন্য মধ্যযুগে মৃত্যুর সংখ্যা
সাড়ে সাত কোটি থেকে কুড়ি কোটি পর্যন্ত হতে পারে। সংখ্যাটাকে সেই সময়ের সারা পৃথিবীর
জনসংখ্যার অনুপাতে ভাবতে হবে, এই রোগে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ ভারত থেকে বাণিজ্য ও সৈন্য চলাচলের পথ ধরে কলেরা ইন্দোনেশিয়া থেকে রাশিয়া পর্যন্ত
ছড়িয়ে পড়েছিল।
মহামারী
বা অতিমারীতে মৃত্যু সংখ্যা সব সময়েই খুব বেশি। বিউবোনিক প্লেগ, বসন্ত বা কলেরার কথাও
সকলেরই জানা। ১৯০০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে শুধু ভারতবর্ষেই অন্তত আশি লক্ষ মানুষ কলেরার
জন্য মারা যান। ১৯৭৯ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা হু বসন্ত রোগের ভাইরাসকে নির্মূল
ঘোষণা করেছিল, তার আগে শুধু বিংশ শতাব্দীতেই বসন্ত রোগের জন্য তিরিশ থেকে পঞ্চাশ কোটি
লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। অথচ গত চল্লিশ বছরে বার্ড ফ্লু, এইচআইভি, সিভিয়ার অ্যাকিউট
রেস্পিরেটরি সিন্ড্রোম বা সার্স, ইবোলা, ম্যাড কাউ ডিজিজ ইত্যাদি রোগ অতিমারী হয়ে ওঠার
আশঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। কোভিড-১৯-এর বিপদকে ছোটো ভাবার কোনো কারণ নেই, কিন্তু
দেখা যাচ্ছে এতে মৃত্যুর হার কালাজ্বর, কলেরা, বসন্ত বা স্প্যানিশ ফ্লু-এর থেকে অনেক
কম। তার কারণ কী?
এখানে
আর একটা কথা মনে রাখতে হবে। মধ্য যুগে খুব মানুষ সাধারণভাবে জমি বা বাসস্থানের সঙ্গে
বাঁধা পড়ে থাকত। খুব কম মানুষই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেত, ফলে মহামারীতে এক লোকালয়
উজাড় হয়ে গেলেও অন্যত্র তার সংক্রমণ ঘটত অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে। ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের
যাওয়ার আগে অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার মানুষ বসন্ত রোগের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। ইউরোপ,
এশিয়ার পশ্চিম ভাগ ও উত্তর আফ্রিকাতে ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ ছড়াতে সময় নিয়েছিল পাঁচ বছর।সেখানে
এত মৃত্যু ঘটালেও তা ভারতে আসেনি, তার কারণ মধ্য যুগে ভারত ও ইউরোপের মধ্যে যোগাযোগ
ছিল খুবই কম। ধীর সংক্রমণ সত্ত্বেও ব্ল্যাক ডেথ বা কলেরা প্রাচীনকালে যে এত মানুষের
মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার কারণ হল রোগ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অভাব। চিকিৎসা
ব্যবস্থা তখন অত্যন্ত পিছিয়েছিল, ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুই ছিল স্বাভাবিক
ঘটনা।কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কারের আগে গত শতাব্দীর গোড়ার দুই দশকে এই রোগে মৃত্যুর হার
ছিল ৯০-৯৫ শতাংশ,
আরও
একটা তথ্যের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। জনগণনা শুরু হয়েছে এই সেদিন, তাই প্রাচীন
যুগের জনসংখ্যা আমাদের কিছুটা অনুমান করতেই হয়। সেটা মেনে নিয়ে দেখা যায় যে পৃথিবীতে
মানুষের সংখ্যা দশ কোটি থেকে কুড়ি কোটি হতে সময় নিয়েছিল মোটামুটি এগারোশো বছর, সেখান
থেকে চল্লিশ কোটি হতে লেগেছিল সাড়ে আটশো বছর। এর মধ্যে ব্ল্যাক ডেথের জন্য জনসংখ্যা
কমে গিয়েছিল।অথচ পঞ্চাশ কোটি থেকে দ্বিগুণ হতে সময় নিয়েছিল দু’শো বছর, আর গত একশো বছরে
পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়েছে চারগুণ। মানুষের গড় আয়ু গত একশো বছরে বেড়েছে দু’গুণেরও বেশি।
এর একটা কারণ নিশ্চয় কৃষিতে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির ব্যবহার যার ফলে ফলন বেড়েছে অনেক গুণ,
এবং দুর্ভিক্ষকে অনেকটা প্রতিহত করা গেছে। আর কোনো কারণ আছে কী?
গত
একশো বছরে চিকিৎসা বিজ্ঞান দ্রুত এগিয়েছে। মহামারী সবসময়েই জীবাণুঘটিত রোগ, তার জন্য
দায়ী জীবাণুটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, সংক্রমণ কোন পথে ঘটে তা খুঁজে বার করা হয়েছে, এবং
রোগের ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কার করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কার,
বা কালাজ্বরের ওষুধ উদ্ভাবনের জন্য শুধু আমাদের দেশেই কোটি কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচানো
সম্ভব হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতের জনসংখ্যা যখন প্রতি দশকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে,
তখন আসাম, যেখানে কালাজ্বর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল, সেখানে জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছিল।
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে যুগান্তর এনেছে পেনিসিলিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক, যদিও তার
অতিব্যবহার এখন বিপদ ডেকে আনছে। পেনিসিলিন আবিষ্কার হয়েছিল ১৯২৮ সালে, তার এক দশকের
মধ্যে তার ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছিল।
একই
সঙ্গে বোঝা গেছে যে জীবনযাত্রার চরিত্রও মহামারীর দ্রুত প্রসারের জন্য দায়ী। প্রথমে
শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও প্রাচীন প্রস্তরযুগে মানুষের গড় আয়ু ছিল আনুমানিক ৩৩ বছর, নব্য
প্রস্তরযুগে তা কমে দাঁড়ায় মোটামুটি পঁচিশে। গড় আয়ু প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানকে অতিক্রম
করে বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে। তার কারণ নব্য প্রস্তরযুগে কৃষিকাজ আবিষ্কারের সঙ্গে
সঙ্গে গ্রাম ও নগর পত্তন হয়েছিল। তার আগে মানুষ ছিল যাযাবর, খাদ্যের সন্ধানে তারা এক
জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াত। দুই ভিন্ন দলের মধ্যে দেখা হত খুব কম, ফলে রোগ
সংক্রমণ খুবই সীমাবদ্ধ থাকত। নব্য প্রস্তরযুগে গ্রাম ও শহরের পরিবেশ ছিল অস্বাস্থ্যকর,
সংক্রামক রোগ সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শত্রুর অস্ত্রে যত সৈন্য মারা
গিয়েছিল, তার থেকে বেশি মারা গিয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লুতে। তার কারণ ট্রেঞ্চের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর
পরিবেশে অল্প জায়গার মধ্যে অনেক সৈন্যকে থাকতে হয়েছিল – ফলে ফ্লুয়ের দ্রুত সংক্রমণ
ঘটেছিল। কলেরাকে ছড়িয়ে পড়া থেকে আটকাতে গেলে ওষুধের থেকেও বেশি প্রয়োজন পরিস্রুত জলের
ব্যবস্থা। ম্যালেরিয়ার বা ডেঙ্গুর জন্য মশাকে দূরে রাখা জরুরি। এই খুব সাধারণ জ্ঞানের
জন্যও কিন্তু বিজ্ঞান গবেষণার প্রয়োজন হয়েছিল।
করোনার
বিপদকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভাবতে হবে। তার থেকে রক্ষা পাওয়ার চাবিকাঠি বিজ্ঞানের হাতেই
আছে। সারা পৃথিবী করোনা রোগের টিকা আবিষ্কারের জন্য গবেষকদের দিকে তাকিয়ে আছে। মাস্ক
ব্যবহার, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া বা মানুষে মানুষে দূরত্ব বজায় রেখে সংক্রমণ কমানোর কথা
আমাদের বিজ্ঞানই বলেছে। বহু দেশ এই পদ্ধতি অবলম্বন করে কোভিড-১৯-কে নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
ডাক্তাররা নানারকম ওষুধ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন, করোনার ফলে মৃত্যু কেন হয় তা নিয়ে
গবেষণা করছেন। এ সমস্তের ফলে শুরুতে করোনাতে মৃত্যুর হার যা ছিল, এখন তার থেকে অনেক
কমে এসেছে।
বিজ্ঞান
প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া এই বিপদ থেকে আমরা উদ্ধার পাব কি? যাঁরা কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ
হয়ে উঠছেন, তাঁদের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে। যতদিন তা কার্যকর থাকবে ততদিন তাঁরা
আর দ্বিতীয়বার সংক্রামিত হবেন না। ‘হার্ড ইমিউনিটি’-র তত্ত্ব বলে যদি একটা বিরাট অংশের
মানুষের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, স্বাভাবিকভাবেই সংক্রমণের হার অনেক কমে যাবে। অন্যান্য
কারণেও ভাইরাসের ক্ষমতা কমে। এখনো পর্যন্ত
পৃথিবীর প্রায় আড়াই কোটি লোক সংক্রামিত বলে চিহ্নিত হয়েছেন, সেই হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা
তিন শতাংশের বেশি। সন্দেহ করা হচ্ছে আসলে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি, অধিকাংশ লোক
কোনো রোগলক্ষণ ছাড়াই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। সেক্ষেত্রে মৃত্যুর প্রকৃত হার অনেক কম। কিন্তু
‘হার্ড ইমিউনিটি’-র তত্ত্ব অনুযায়ী যত সংখ্যক মানুষকে সংক্রামিত হতে হবে, যদি তার মধ্যে
এক ক্ষুদ্র অংশও মারা যান মোট মৃত্যুর সংখ্যাটা বিপুল হতে পারে। তাছাড়া কোভিড-১৯-এর
অ্যান্টিবডি কতদিন কার্যকরী থাকবে তাও এখনো নিশ্চিত নয়। তাই স্বাভাবিক উপায়ে ভাইরাস
প্রতিরোধের পথ নয়, মৃত্যুর সংখ্যা কমানোর জন্য আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের মুখাপেক্ষী।
চিকিৎসা
বিজ্ঞান যখন খুব একটা এগোয় নি, সেই সময়টা কেমন ছিল? শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথা নয়,
বিজ্ঞানের অগ্রগতির আগে স্বাভাবিকভাবেই যে কোনো প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যার জন্য প্রথম
মানুষ দৈবের শরণাপন্ন হত। উদাহরণ স্বরূপ দেখা যায় বৃষ্টি বা বজ্রবিদ্যুতের দেবতা হিসাবে
বিভিন্ন সভ্যতা ইন্দ্র, জিউস, জুপিটার বা থরের কল্পনা করেছে। বজ্রপাত এক আকস্মিক ঘটনা,
তার চোখ ধাঁধানো আলো ও কান ফাটানো শব্দ ভয়ের উদ্রেক করে। তাই বিভিন্ন প্রাচীন পুরাণে
বজ্রবিদ্যুতের দেবতাই দেবতাদের রাজা বা, তা না হলেও, খুবই সম্মানের জায়গা অধিকার করে
আছেন। তারও আগে, মানুষ অনেক কিছুর সঙ্গেই দৈব শক্তিকে যুক্ত করত। প্রতিটি নদী, প্রতিটি
বড় গাছ, প্রতিটি পাহাড় বা টিলার সঙ্গে দেবতা না হলেও উপদেবতা বা অলৌকিক শক্তির যোগ
পাওয়া যেত। আমাদের দেশে প্রায় প্রত্যেক বড়ো নদীই অন্তত স্থানীয়ভাবে দেবতা হিসাবে পরিচিত।
দৈবশক্তির
এত প্রাধান্যের কারণ হল প্রকৃতির বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার এবং প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের
চেষ্টা। যে সময় বিজ্ঞানের শৈশব বলা যেতে পারে, তখন বন্যা, বজ্রপাত, ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ,
মহামারী ইত্যাদির থেকে রক্ষা পেতে বা চাষের সময় বৃষ্টি ইত্যাদির জন্য দৈব শক্তির কাছে
প্রার্থনা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। ভয়াবহ মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যও তাই তখন ঈশ্বর
কি দেবতা বা মর্তে তাঁদের প্রতিনিধি গুরু বাবা পির সন্ত ওঝা গুণিনদের শরণাপন্ন হওয়া
ছাড়া গতি ছিল না। কলেরা কেন হয় না জানা পর্যন্ত তাই ওলাবিবি বা ওলাইচণ্ডীর পুজো করতে
হত। বসন্তের টীকা আবিষ্কারের আগে মা শীতলার কাছে হত্যে দিতে হত, কিংবা জলপড়া তেলপড়া
ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হত। চরণামৃত বা বিশেষ পুকুরের জল খাওয়া, কোনো বিশেষ দেবালয়ে
পুজো দেওয়া ইত্যাদিকেই মানুষ রোগ থেকে ত্রাণের উপায় হিসাবে মেনে নিয়েছিল, কারণ অন্য
কোনো উপায় তার জানা ছিল না। লোক সংস্কৃতিতেও এই সমস্ত দেবতাদের অনেকেই জায়গা করে নিয়েছিলেন।স্বাভাবিক
ভাবেই তার রেশ এখনো রয়ে গেছে, তাই সেই সব দেবদেবীদের অনেকেই এখনো পুজো পান। স্বাধীনতার
এত বছর পরেও আমাদের দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থা সাধারণ গরীব মানুষের নাগালের বাইরে রয়ে
গেছে। তাই কোথাও কোথাও মানুষ দৈবের কাছে আশ্রয় খুঁজছে। সেই জন্য করোনার মন্দির বা পুজোর
খবরে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
বিজ্ঞান
মানসিকতার প্রসার এখনো আমাদের মতো দেশে বিশেষ হয়নি। বিজ্ঞামী মেঘনাদ সাহা লিখেছিলেন
‘পঞ্জিকায় অন্ধবিশ্বাস জাতীয় জীবনের
দৌর্বল্যের দ্যোতক’, সেই বিচারে আমাদের জাতীয় জীবন
যে দুর্বল তাতে সন্দেহ নেই। কোনো গুরুদেবের লালা লাগানো প্রসাদ যদি করোনার প্রতিষেধক
হিসাবে প্রচারিত হয়, তাহলে আমাদের মতো দুর্বল
জাতিতে সেই
প্রসাদ খাওয়ার লোকের অভাব হয় না। সেই গুরুর করোনাতে মৃত্যুতে তাঁর ভক্তদের কী মনে হয়েছে
তা জানি না, কিন্তু এটা বুঝি যে আবার একই রকম দাবী কেউ করলে তার অন্তত কিছু সমর্থক
জুটে যাবে। রোগের নামের বাংলা বর্ণীকৃত রূপের সঙ্গে ধর্মের পালনীয় প্রকরণের মিল খুঁজে
পাওয়াকে আমরা তাচ্ছিল্য করতে পারি, কিন্তু বিশ্বাসীর অভাব হয় না।
এগুলো
যে কুসংস্কার তা নতুন করে বলার কোনো প্রয়োজন নেই, শিক্ষিত-অল্পশিক্ষিত=অশিক্ষিত বা
ধনী-মধ্যবিত্ত-দরিদ্র, সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই ননারকম কুসংস্কার খুঁজে পাওয়া যাবে
সন্দেহ নেই। আধুনিক যুগের সমস্যা হল যে এখন
এমনকি শিক্ষিত মানুষরাও কুসংস্কারের প্রচারে নামতে দ্বিধাবোধ করছেন না। আগে নিজে মানলেও
প্রকাশ্যে তার পক্ষ নিতে একটা কুণ্ঠাবোধ কাজ করত, এখন কিন্তু ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ,
টুইটার ইত্যাদি সামাজিক মিডিয়ার এই নতুন যুগে কুসংস্কারকে সমর্থন করার ব্যক্তিরও অভাব
নেই। ফেসবুকের এক বিজ্ঞান আলোচনার গ্রুপে সেদিন দেখলাম একজন জানতে চেয়েছেন যে শাঁখের
ধ্বনি যতদূর যায় তত দূর জীবাণু মারা যায়, এই কথা কতদূর সত্য। তিনি সরাসরি সমর্থন করেন
নি, কিন্তু পোস্টের ধরন থেকে মনে হল সমর্থনের যুক্তি খুঁজছেন। সরাসরি সমর্থন করার লোকেরও
অভাব হয় না। মেঘনাদ সাহার অভিজ্ঞতায় বেদ না পড়ে ‘সবই ব্যাদে আছে’ বলার লোকের অভাব ছিল
না, এখনো বিজ্ঞান বিন্দুমাত্র না জেনে তা নিয়ে বলার লোকের অভাব নেই। বিশ্বাসটাই যেখানে
আসল, তর্ক বা যুক্তি যেখানে নেহাত অপ্রয়োজনীয়, সেখানে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াইটা
আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। আর আধুনিক যুগে তো নতুন তত্ত্বই আছে, তাই সত্য যা অধিকাংশ লোক বিশ্বাস
করে। এই স্বতঃসিদ্ধ থেকে প্রমাণ করাই যায় যে কোপার্নিকাস-গ্যালিলিওর যুগের আগে সূর্য
পৃথিবীর চারদিকে ঘুরত, চার্লস লিয়েল বা চার্লস ডারউইনের আগে পৃথিবীর বয়স ছিল ছ’হাজার
বছর। বিজ্ঞানে শেষ সত্য বলে কিছু হয় না, বিজ্ঞানীরাও তেমন দাবি করেন না। তা বলে, বিজ্ঞানে
সত্য বলে কিছু নেই, সুতরাং ভাগ্যের উপর গ্রহের প্রভাবের কথা বিজ্ঞান আজ সমর্থন না করলেও
কাল করবে -- তার থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না।
ব্যক্তি
যখন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়, তখন তাকে সমর্থন না করলেও তার পিছনের কারণটা বুঝতে পারি।
কিন্তু আধুনিক যুগে কোনো দেশের সরকারের আচরণ যখন এই রকম কুসংস্কারের প্রতি সমর্থন জোগায়,
তখন বিষয়টা অন্য স্তরে চলে যায়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার সময়
একবার থালা বাটি বাজানোর আর একবার বিদ্যুতের আলো নেভানোর পরামর্শ দিলেন। স্বাস্থ্য
ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা করোনা নিরাময়ের সংগ্রামের প্রথম সারিতে আছেন, থালা
বাজিয়ে সম্মান দেখানোর পরিবর্তে তাঁদের দরকার ছিল পিপিই, মাস্ক ইত্যাদি সামগ্রীর। আলো
নিভিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে করোনার বিরুদ্ধে দেশের ঐক্য দেখানো হল কিনা জানি না, তবে ইলেকট্রিসিটি
গ্রিডের ইঞ্জিনিয়ারদের কয়েক রাতের ঘুম চলে গেল।
একথা
বলতেই হবে প্রধানমন্ত্রী বলেননি হাততালি দিলে বা প্রদীপ জ্বালালে করোনা ভাইরাস ধ্বংস
হয়ে যাবে, কিন্তু বক্তৃতার ফলটা সেইদিকেই গড়াল। মুহূর্তের মধ্যেই করোনা ভাইরাসের উপর
শব্দ বা আলোর প্রভাব নিয়ে ‘বৈজ্ঞানিক’ ব্যাখ্যাতে সোশাল মিডিয়া ভরে গেল; তাদের মধ্যে
কয়েকটা আবার তথাকথিত গবেষণার জার্নালেও জায়গা করে নিলো। অবশ্য সেই জার্নালের নাম কোনো
সিরিয়াস গবেষক কখনো শোনেননি, কিন্তু তাতে কী? আধুনিক যুগে কোনো ধারণাকে সত্য বলে ধরে
নিতে সাক্ষ্যপ্রমাণের আর প্রয়োজন হয় না, বিশেষজ্ঞের জ্ঞান আর আমার অজ্ঞানতার মূল্য
সমান। ফল যা হওয়ার তাই হল, অতিমারীর মধ্যে অকাল দেওয়ালির আবির্ভাব।
এই
ধরনের সিদ্ধান্তের পিছনে কী চিন্তাভাবনা কাজ করেছিল জানি না, কিন্তু আমার কোনো সন্দেহ
নেই যে এর ফলে সমস্যার গভীরতা থেকে দৃষ্টি সরে যায়। দেশের নীতিনিয়ন্তাদের সঙ্গে আধুনিক
বিজ্ঞান প্রযুক্তির সম্পর্ক খুব নিবিড় নয়, পুরাণে তার সন্ধান করাতেই বোধ করি তাঁরা
বেশি স্বচ্ছন্দ। আধুনিক যুগের সমস্যার জটিলতা বোঝাতে অক্ষমতার জন্যই হঠাৎ লকডাউনের
মতো সরল সমাধানের দিকে তাঁরা আকৃষ্ট হলেন। কোনো প্রস্তুতি ছাড়া খেয়ালখুশি মতো লকডাউন,
ইচ্ছামতো সেটাকে বাড়িয়ে দেওয়া যেমন অনেকের জীবনকে দুর্বিষহ করেছিল, তেমনি ব্যবস্থার
প্রতি বিশ্বাসকেও দুর্বল করেছিল। ভুলে গেলে চলবে না যে সমস্ত দেশ সাফল্যের সঙ্গে এই
সমস্যার মোকাবিলা করেছে, তারা কেউই শুধুমাত্র লকডাউনকেই করোনা প্রতিরোধের উপায় করেনি,
তার সঙ্গে ব্যাপক পরীক্ষা, আইসোলেশন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। রাজনৈতিক নেতাদের এই
দূরদৃষ্টির অভাব অন্যত্রও সংক্রমিত হয়েছে। নীতি আয়োগের সদস্য ইন্টারনেট থেকে পাওয়া
একটি লেখচিত্র দেখিয়ে দাবি করলেন যে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দেশ থেকে করোনা নির্মূল
হয়ে যাবে। সেই গ্রাফ থেকে ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছালে যে কোনো বিজ্ঞানের ছাত্র পরীক্ষাতে
শূন্য পেত।
করোনা
রোধে বিজ্ঞানই পথ দেখাবে, অন্য কোনো উপায় নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সেই লড়াইটা
পিছিয়ে থেকে শুরু করেছি। আমরা মোট জাতীয় উৎপাদনের মাত্র ০.৬ শতাংশ বিজ্ঞান প্রযুক্তি
গবেষণা খাতে খরচা করি। ইউরোপ আমেরিকার শিল্পোন্নত দেশ দূরে থাক, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া
বা তাইওয়ানের মতো এশীয় দেশগুলিও এর কয়েক গুণ বেশি ব্যয় করে। গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন
ক্ষেত্রে সেই বরাদ্দও হয় স্থির হয়ে আছে, নয় কমছে। এখন হঠাৎ করে বিজ্ঞানীদের দিকে তাকালেই
বা গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ করলেই তার থেকে ফলের আশা করা যায় না, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী
পরিকল্পনা। করোনার বিপদ একদিন দূর হয়ে যাবে, কিন্তু ভবিষ্যতে আরও নানা বিপদ আসবে। তার
জন্য এখন থেকে প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন।
প্রকাশ ঃ শারদীয় মাসিক বসুমতী, ১৪২৭
No comments:
Post a Comment