Saturday 24 July 2021

আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, নোবেল পুরস্কার ও রাজনীতি

 

আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, নোবেল পুরস্কার ও রাজনীতি

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

এক হিসাবে ২০২১ সালে আলবার্ট আইনস্টাইনের নোবেল পুরস্কার লাভের শতবর্ষ পূর্ণ হল; আবার অন্য হিসাবে তার এখনো এক বছর বাকি আছে। তার কারণ ১৯২১ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারটা ঘোষণা করা হয়েছিল ১৯২২ সালের ৯ নভেম্বর। ১৯২২ সালে পদার্থবিজ্ঞানের পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ডেনমার্কের বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিলস বোরকে; একই সঙ্গে ১৯২১ সালের পুরস্কার দেওয়া হল আলবার্ট আইনস্টাইনকে। তাঁর বিখ্যাত আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নয়, নোবেল কমিটি পুরস্কারের কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছিল, ‘for his services to Theoretical Physics, and especially for his discovery of the law of the photoelectric effect’; অর্থাৎ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অবদান ও বিশেষ করে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া সংক্রান্ত তাঁর গবেষণার জন্য তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

সাধারণ, অর্থাৎ নন-টেকনিকাল পত্রপত্রিকাতে কখনো কখনো পড়েছি আলোকতড়িৎ ক্রিয়া ঠিক আইনস্টাইনের সব সেরা আবিষ্কারগুলির মধ্যে পড়ে না।  লেখকরা যেন বলতে চেয়েছেন সেই গবেষণাকে নোবেল দেওয়া সেই চাঁদ সদাগরের বাঁ হাতে মনসাকে পুজো দেওয়ার মতো; অর্থাৎ নেহাৎ আইনস্টাইনকে নোবেল দিতেই হবে, তাই তাঁর গবেষণার তালিকা থেকে যা হোক একটা বেছে নেওয়া। এই সব লেখকরা বিজ্ঞানের গভীরে না ঢুকে চমকের রাস্তা বেছে নিয়েছেন। আপেক্ষিকতা বা আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার তাৎপর্য আলোচনা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, তবে এটা বলাই যায় যে দ্বিতীয় কাজটি কোনোভাবেই প্রথমটার থেকে পিছিয়ে থাকবে না। স্বয়ং আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন যে তাঁর একমাত্র বৈপ্লবিক কাজ হল আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা যা তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে করেছিলেন। কিন্তু এটা ঠিক যে আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে পুরস্কার না দেওয়ার পিছনে বিজ্ঞানের বাইরে অনেকগুলো কারণ কাজ করেছিল; আগে যে লেখকদের কথা বলেছি তাঁরা সেই কারণগুলোর উপরে জোর দেন। শুধু নোবেল পুরস্কার নয়, আপেক্ষিকতাবাদ বারবার রাজনীতির সঙ্গেও জড়িয়ে গেছে। এই লেখাতে আমরা সংক্ষেপে সেই ইতিহাসের দিকে চোখ রাখব।

প্রথমেই আমরা আইনস্টাইনের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ইতিহাসের কথা শুনি। কেমনভাবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো গবেষণাকে নোবেলের জন্য মনোনীত করা হয়? প্রতি বছর  রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স বিভিন্ন বিশেষ ব্যক্তি বা সংগঠনের কাছে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন চেয়ে পাঠায়। প্রতি পুরস্কারের জন্য একটি করে পাঁচ সদস্যের নোবেল কমিটি আছে। পদার্থবিজ্ঞানে যে সমস্ত মনোনয়নপত্র জমা পড়ে, ঐ বিষয়ের কমিটি তাদের মধ্যে থেকেই পুরস্কার প্রাপকের নাম বেছে নিয়ে অ্যাকাডেমির পদার্থবিজ্ঞান সেকশনের কাছে পাঠায়। সেকশনের সদস্যদের ভোটে অনুমোদিত হলে তা যায় অ্যাকাডেমির কাছে।  অ্যাকাডেমির সদস্যরা তারপর সেই সুপারিশ  নিয়ে বিচার বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন; নোবেল কমিটির সুপারিশ বাতিল হয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে।

 আইনস্টাইন যে নোবেল পাবেন, সে নিয়ে কারোর কোনো সন্দেহ ছিল না, আইনস্টাইনের নিজেরও নয়। ১৯১৯ সালে বিবাহবিচ্ছেদের সময় তিনি প্রথমা স্ত্রী মিলেভাকে বলেছিলেন যে নোবেল পুরস্কার যখন পাবেন, সেই টাকা তাঁকে দেবেন; সেই কথা তিনি রেখেছিলেন। ১৯২১ ও ১৯২২ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং আলোকতড়িৎ ক্রিয়া সংক্রান্ত গবেষণার বিচার করতে জন্য নোবেল কমিটি তার দুই সদস্যকে আলাদা আলাদা রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিল। কোনো রিপোর্টই প্রথম বছর আইনস্টাইনের পক্ষে যায় নি। নোবেল কমিটির আলোচনা লিপিবদ্ধ হয় না, তবে যতদূর জানা গেছে যে আইনস্টাইনকে নোবেল পুরস্কার দেয়া নিয়ে এত বিতর্ক হয়েছিল যে সে বছর শেষ পর্যন্ত কমিটি কোনো নামই ঠিক করে উঠতে পারে নি। পরের বছর  আবার ওই দুই বিষয়েই রিপোর্ট তৈরি হয়েছিল। এই বছর আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার বিষয়ে রিপোর্ট জোরালোভাবে আইনস্টাইনের পক্ষে যায়। কমিটি তখন আগের বছরের নোবেলের জন্য আইনস্টাইনের নাম সুপারিশ করে, পুরস্কারের নিয়মে সেই সুযোগ আছে। আইনস্টাইনের কাছে যখন সেই খবর যায়, তখন তিনি জাহাজে জাপানের পথে। পুরস্কারের সময়েও তিনি জাপানে ছিলেন, তাঁর হয়ে পুরস্কারটি নেন সুইডেনে জার্মানির রাষ্ট্রদূত। 

জাপান যাত্রার পথে জাহাজে সস্ত্রীক আইনস্টাইন

ফিরে আসি আপেক্ষিকতা তত্ত্বের কথায়। ১৯০৫ সালে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যাতে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগ বিষয়ে আইনস্টাইনের গবেষণা প্রকাশ হওয়া মাত্র তাঁর নাম বিজ্ঞানী মহলে পরিচিত হয়েছিল। বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বেই প্রথম চতুর্মাত্রিক স্থানকালের কথা আসে; ভর ও শক্তির সমতুল্যতা সংক্রান্ত আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্রটিও এই তত্ত্বের ফলশ্রুতি। ওই একই বছর আলোকতড়িৎ ক্রিয়া ও ব্রাউনিয় গতি সংক্রান্ত গবেষণাও তিনি প্রকাশ করেন। ১৯১০ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত তের বছরে তাঁর পক্ষে মনোনয়ন জমা পড়েছিল মোট বাষট্টিটি, ১৯১১ ও ১৯১৫ এই দুই বছর ছাড়া প্রতি বছরই তাঁর নাম বিবেচনাতে এসেছিল। মূলত আপেক্ষিকতা ও আলোকতড়িৎ বিক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও ব্রাউনিয়ান গতি সংক্রান্ত কাজও একাধিকবার উল্লেখিত হয়েছিল।

কোনো আবিষ্কারকে নোবেল পুরস্কার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়েই বেশ কয়েক বছরের ব্যবধান থেকে যায়, তাই সঙ্গে সঙ্গেই যে আইনস্টাইনের নাম নোবেল কমিটি বিবেচনাতে আনেনি সেটা আশ্চর্য নয়। প্রথমবার নোবেল কমিটির কাছে তাঁর সমর্থনে মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল ১৯১০ সালের পুরস্কারের জন্য; ১৯০৯ সালে রসায়নে নোবেলজয়ী উইলহেল্ম অসওয়াল্ড বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্য তাঁর নাম সুপারিশ করেন। প্রথম কয়েক বছর বিশেষ আপেক্ষিকতার গুরুত্বের কথা স্বীকার করেও নোবেল কমিটি বলে যে সেই তত্ত্বের পক্ষে সঠিক প্রমাণ তখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। মনে রাখতে হবে নোবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক প্রমাণের উপরে জোর দেওয়া হয়, যে কারণে স্টিফেন হকিঙের নাম শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর তালিকায় পাওয়া যায় না। 

ইতিমধ্যে ১৯১ সালে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সম্পূর্ণ রূপ প্রকাশ করেছিলেন আইনস্টাইন; নিউটনের পরের তিনশ বছরে মাধ্যাকর্ষণ বিষয়ে এ হল প্রথম মৌলিক অগ্রগতি। ১৯১৯ সালে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের পক্ষে সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায়। সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের পাশ দিয়ে আসা দূরের নক্ষত্রের আলো সূর্যের মাধ্যাকর্ষণের জন্য কতটা বাঁকে তা মাপা সম্ভব হয়; দেখা গেল তা নিউটন নয়, আইনস্টাইনের হিসাবের সঙ্গে মেলেসেই খবর প্রকাশ হওয়া মাত্র বিজ্ঞানী মহলের বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও আইনস্টাইনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়। ১৯১৯ সালের পরে তাঁকে অবিলম্বে পুরস্কার দেওয়ার কথা বলেছিলেন অনেক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। এবং অধিকাংশ বিজ্ঞানীই মনোনয়নের সময় আপেক্ষিকতা তত্ত্বের উল্লেখ করেছিলেন।

(এই লেখাতে বিজ্ঞান নিয়ে বিশেষ আলোচনা করা হয়নি, এই ব্লগেই অন্যত্র বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদসাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে অল্প কথা পাওয়া যাবে।)

১৯২২ সালে রয়াল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের সম্পাদক আইনস্টাইনকে নোবেল পুরস্কারের কথা জানাতে গিয়ে লিখেছিলেন পুরস্কারের কথা বিবেচনাতে আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে ধরা হয়নি। রেকর্ড থেকে দেখা যায় দু’বছরই আপেক্ষিকতা তত্ত্বের রিপোর্টের দায়িত্বে ছিলেন একই ব্যক্তি, দুবছরই তিনি আইনস্টাইনকে নোবেল দেওয়ার বিপক্ষেই মত দিয়েছিলেন। তাঁর নাম আলভার গালস্ট্রান্ড, তিনি ছিলেন চক্ষু এবং আলোকবিদ্যা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনিও নোবেলজয়ী, এবং এখনো পর্যন্ত একমাত্র ব্যক্তি যিনি একই সঙ্গে নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান ও গ্রহণ করেছেন। ১৯১১ সালে পদার্থবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যা উভয় বিষয়েই তাঁর নাম এসেছিল। পদার্থবিজ্ঞান কমিটির সদস্য গালস্ট্র্যান্ড পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল নেবেন না বলে কমিটিকে জানিয়েছিলেন এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের নোবেলটিকে স্বীকার করেন। রিপোর্ট দুটি পড়ে বোঝা যায় যে তিনি আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বুঝতেই পারেন নি। ওই রিপোর্টের জন্যই  অ্যাকাডেমির চিঠিতে লেখা ছিল যে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব পুরস্কারের বিবেচনার সময় হিসাবে নেওয়া হয়নি। 

আলভার গালস্ট্রান্

গালস্ট্র্যান্ডের রিপোর্টের পিছনে সরাসরি কোনো রাজনীতি ছিল বলে মনে হয় না, তবে আইনস্টাইনের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সংখ্যা কম ছিল না, এবং তাদের যথেষ্ট প্রভাব সেই সময়ে ছিল; পরে তা আরো বেড়েছিল। সে কথায় আমরা পরে আসছি, তবে এ কথা বলাই যায় যে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বিরুদ্ধে যে রকম প্রচার শুরু হয়েছিল, তার কিছুটা প্রভাব নোবেল কমিটির উপরেও পড়েছিল। কিন্তু রাজনীতি, জাতিবিদ্বেষ ইত্যাদি কারণ ছাড়াও আইনস্টাইনের গবেষণা অনেকেরই চক্ষুশূল হয়েছিল। তার একটা বড় কারণ হল তত্ত্বের জটিলতা ও আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার দুস্তর ফারাক।

সাধারণ আপেক্ষিকতার গণিত আজ এক শতাব্দী পরেও ওই বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের বাইরের পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে খুব সহজবোধ্য নয়, সেই সময় তা ছিল প্রায় অবোধ্য। বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন ছিলেন সাধারণ আপেক্ষিকতার উৎসাহী সমর্থক, ১৯১৯ সালের সুর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ অভিযানে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যে মিটিঙে তিনি সেই কথা ঘোষণা করেছিলেন, সেখানে আর এক বিজ্ঞানী লুডউইগ সিলবারস্টাইন তাঁকে বলেছিলেন, ‘প্রফেসর এডিংটন, আইনস্টাইনের তত্ত্ব এতই জটিল যে পৃথিবীতে মাত্র তিনজন সেটা বোঝেন, আপনি তাঁদের একজন।’ এডিংটন কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। সিলবারস্টাইন বললেন, ‘লজ্জা পাবেন না, বলুন কথাটা ঠিক কিনা।’ এডিংটন উত্তর দিলেন, ‘না না, আমি ভাবছি তৃতীয় ব্যক্তিটি কে।‘ তিনজন নিশ্চয় অতিকথন, কিন্তু সত্যিই সেই সময় সাধারণ আপেক্ষিকতার মর্মভেদ করতে সক্ষম বৈজ্ঞানিকের সংখ্যা হাতে গুণে বলা যেত।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ বা বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও শখের গবেষকরা বিজ্ঞানে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারতেন। কিন্তু একদিকে উচ্চ গণিত, অন্যদিকে জটিল ও দামী যন্ত্রের উপর নির্ভরতা বাড়তে থাকার ফলে আধুনিক বিজ্ঞান তাঁদের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল। আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব দুইই আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বিপক্ষে যায়, তাই গভীর চর্চা ছাড়া তাদের হৃদয়ঙ্গম করা মোটেই সহজ নয়। শৌখিন বিজ্ঞানীরা এই নতুন অগ্রগতিকে মেনে নিতে পারছিলেন না। বেশ কিছু বিজ্ঞানী যাঁরা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের তল পাচ্ছিলেন না তাঁরাও এই দলে  যোগ দিয়েছিলেন। জার্মানিতে যে দু’জন বিজ্ঞানী আপেক্ষিকতা তত্ত্বের উপর আক্রমণের নেতৃত্ব দেন, সেই ফিলিপ লেনার্ড ও জোহানেস স্টার্ক যথাক্রমে ১৯০৫ এবং ১৯১৯ সালে পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। দু’জনেরই প্রধান সমস্যা ছিল যে জটিল গণিত নির্ভর বিজ্ঞানের অগ্রগতি তাঁদের বোধগম্য হচ্ছিল না, তাই তাঁরা সেগুলোকে বাতিল করতে চেয়েছিলেন। গালস্ট্রান্ডের রিপোর্ট পড়ে দেখা যায় তিনিও আপেক্ষিকতার গণিতকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি।

যে কোনো নতুন আবিষ্কারের কিছু বিরোধী থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপেক্ষিকতার বিরোধিতার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল আইনস্টাইনের রাজনীতি এবং ইউরোপিয় সমাজের জাতিবিদ্বেষ। আইনস্টাইনকে অনেকে যেমন সমাজবিচ্ছিন্ন বিজ্ঞানী মনে করেন, তিনি মোটেও সেই রকম ছিলেন না। তিনি ১৮৯৬ সালে জার্মানির নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন; কয়েক বছর পরে ১৯০১ সালে হয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। ১৯১৪ সালে বার্লিনে প্রুশিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের অধীনে আইনস্টাইনকে অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা হয়। অ্যাকাডেমির কর্মচারীরা জার্মান সরকারের কর্মচারী, তাই তাঁদের জার্মানির নাগরিক হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। আইনস্টাইনের জন্য নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই জার্মানিতে যে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছিল তা আইনস্টাইনের পছন্দ ছিল না। তিনি সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেননি, জাপানে তিনি সুইস পাসপোর্টই ব্যবহার করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি স্পষ্টতই ছিল আক্রমণকারী, অথচ ১৯১ সালে সাড়ে চারশো জন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জার্মানির সামরিক অভিযানকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। বিরোধিতা করেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইনসহ মাত্র তিনজন। যুদ্ধে পরাজয়ের পরে জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত ভাইমার প্রজাতন্ত্র অনেক অধ্যাপকেরই অপছন্দ ছিল। আবারও আইনস্টাইন ছিলেন ব্যতিক্রম, তিনি প্রজাতান্ত্রিক সরকারের অঘোষিত মুখপাত্রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

যুদ্ধে জার্মানির পরাজয় ও রাশিয়াতে বিপ্লবের পরে উগ্র জাতীয়তাবাদী অতিদক্ষিণপন্থীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছিল, যা শেষ পর্যন্ত হিটলারের নাৎসি পার্টিকে ক্ষমতায় আনে। নাৎসিরা ইহুদিদের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের দায় চাপিয়ে দিয়েছিল এবং লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে ইউরোপিয় সমাজে ইহুদিবিদ্বেষের ক্ষেত্র আগে থেকেই তৈরিই ছিল, সে কারণেই হিটলার তাকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। আইনস্টাইন ইহুদি, শান্তিবাদী, প্রজাতন্ত্রের সমর্থক ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধী -- তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি অতিদক্ষিণপন্থীদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। ১৯২২ সালে জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে বিজ্ঞানী ফন লউ আইনস্টাইনকে বলেছিলেন নভেম্বর মাসে এমন খবর আসতে পারে যাতে ডিসেম্বরে তাঁ  ইউরোপে থাকার প্রয়োজন হবে আইনস্টাইন সে কথা শোনেননি; তাঁর সেই সময় সস্ত্রীক দেশের বাইরে কিছুদিন থাকার প্রয়োজন ছিল। আইনস্টাইনের বন্ধু জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াল্টার রাঠেনাউ সেই বছর জুন মাসে অতি দক্ষিণপন্থীদের হাতে খুন হন, খবর ছিল আইনস্টাইনেরও প্রাণসংশয় হতে পারে।

অতিদক্ষিণপন্থীরা এবং আপেক্ষিকতার তল না পাওয়া পেশাদার বা শখের বিজ্ঞানীরা আইনস্টাইনের বিরোধিতায় এক জায়গায় এসে মেলেন। ১৯২০ সালের ২৪ আগস্ট মাস বার্লিনের এক সভাতে তাঁকে তীব্র আক্রমণ করা হয়, আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে বলা হয় চুরি এবং ধাপ্পাবাজি। এই সভার আয়োজন করেছিলেন পল ওয়েল্যান্ড নামের এক অতিদক্ষিণপন্থী ইহুদি-বিদ্বেষী রাজনীতিক। সভাতে আর্ন্সট গের্কে বলে এক সুপরিচিত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের তত্ত্বের দীর্ঘ সমালোচনা করেছিলেন। আইনস্টাইন নিজে সেই সভাতে গিয়েছিলেন, এবং পরে এক দীর্ঘ বিবৃতিতে তাঁর সমালোচনার উত্তর দিয়েছিলেন। এর পর তিনি তাঁর সমালোচকদের প্রকাশ্যে আলোচনার জন্য আহ্বান করেছিলেন। সেই সভা হয় পরের মাসের ২০ সেপ্টেম্বর, বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। গের্কে সভাতে তাঁর মত পেশ করেছিলেন। গের্কের যুক্তি পড়লে বোঝা যায় যে তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানেই আটকে ছিলেন। লেনার্ড বা স্টার্ক সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে।

অল্প দিনের মধ্যেই আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন যে এমন কোনো জায়গা নেই যেখান থেকে তিনি ও আপেক্ষিকতাবাদের বিরোধীরা আলোচনার শুরু করতে পারেন। তিনি এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘এই পৃথিবীটা একটা পাগলাগারদ। এখন প্রত্যেক গাড়োয়ান আর প্রত্যেক ওয়েটার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে তর্ক করছে। সে কোন রাজনোতিক দলের সমর্থক, তার উপরে তার বিশ্বাস-অবিশ্বাস নির্ভর করে।’ ১৯২১ সালে আপেক্ষিকতাবাদ বিরোধী এক আন্তর্জাতিক সংগঠন তৈরি হয়েছিল; জার্মানির বাইরে নানা দেশে, এমনকি আমেরিকাতেও তা প্রভাব বিস্তার করেছিল। ১৯৩১ সালে এক পুস্তিকা বেরোয়, ‘আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে একশ লেখক’। শোনা যায় আইনস্টাইন বলেছিলেন যে তিনি যদি ভুল করে থাকেন, তাহলে তা একজন বললেই যথেষ্ট। বিজ্ঞানের সত্য গণতন্ত্র দ্বারা নির্ধারিত হয় না। আপেক্ষিকতাবাদের সমর্থক বিজ্ঞানীরাও রেহাই পেতেন না, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আবিষ্কর্তা ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের মতো বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীকে বিদ্রূপ করে শ্বেত-ইহুদি বলা হত। এগারো বছর পরে হিটলারের ক্ষমতায় আসা যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন আইনস্টাইন শেষ পর্যন্ত দেশত্যাগে চলে যেতে বাধ্য হন। নাৎসিরা আপেক্ষিকতাবাদ পড়ানো নিষিদ্ধ করে।

জোহানেস স্টার্কের কথা আগে বলেছি; তিনি লিখেছিলেন অন্য কোনো সৃষ্টিশীল কাজের মতো বিজ্ঞানও চর্চাকারীর মানসিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। এ এক অদ্ভুত কথা যা বিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিক দর্শন বা সমাজনিরপেক্ষ চরিত্রের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না। নাৎসি আমলে নিন্দিত ‘ইহুদি’ বিজ্ঞানের জায়গায় বসানো হয় এক কল্পিত ‘জার্মান’ বিজ্ঞানকে। স্টার্কের মতে ‘জার্মান’ বিজ্ঞান তথ্য ও পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করে, বিপরীতে ‘ইহুদি বিজ্ঞান’ বাস্তব বিবর্জিত অঙ্কের গোলকধাঁধা সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানের এরকম জাতিগত চরিত্রের কথা আজ যতই অদ্ভুত ঠেকুক, ফ্যাসিস্ট জার্মানিতে তাই ছিল স্বাভাবিক। ইহুদিদের গবেষণা সম্পর্কে তাচ্ছিল্যের কারণ এই নয় যে পরীক্ষার বা যুক্তির মাধ্যমে তাকে ভুল প্রমাণ করা গেছে। কেবলমাত্র ইহুদিদের আবিষ্কৃত বলেই তা ভ্রান্ত। আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে বলা হয়েছিল ইহুদি ধাপ্পাবাজি।

তবে এখনো এই ধরনের অদ্ভুত কথা মাঝে মাঝে শোনা যায়। এই উত্তর-আধুনিকতা বা উত্তর-সত্যের যুগে সমাজতত্ত্ব বিষয়ক বক্তৃতাতে এ কথা শোনার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়েছে যে বিজ্ঞানের সত্য সমাজ নিরপেক্ষ নয়, আইনস্টাইন অস্ট্রেলিয়াতে গবেষণা করলে হয়তো ‘ই ইক্যুয়ালস এম সি কিউব’ পেতেন। এ কথা মানতে হলে মেনে নিতে হয় যে আইনস্টাইন অস্ট্রে্লিয়াতে বসে কাজ করলে সূর্যের বয়স পালটে যেত। নোবেলজয়ী পদার্থবিদ স্টিফেন ভাইনবার্গ নিউটনের সূত্র সম্পর্কে যে কথা বলেছিলেন, তার প্রতিধ্বনি করে আমরা বলতে পারি যে আপেক্ষিকতার সূত্রগুলি যে ঐ রূপই নিয়েছে, তার কারণ হল বাস্তবজগৎ সেই সূত্রদের খুব কাছাকাছি। তার সঙ্গে ব্যক্তি, সমাজ বা দর্শনের কোনো সম্পর্ক নেই।

নাৎসি জার্মানিতে আইনস্টাইনের তত্ত্বের বিরোধিতার এই ইতিহাস আমরা অনেকেই জানি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পরে হঠাৎ করে লেখালেখি শুরু হয় যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সঙ্গে আপেক্ষিকতাবাদকে মেলানো যায় না, তাই স্ট্যালিনের আমলে সোভিয়েত বিজ্ঞান ছিল আপেক্ষিকতাবাদের বিরোধী; নাৎসি জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মতাদর্শগত ভাবে পরস্পর বিরোধী হলেও এই বিষয়ে তারা একই বিন্দুতে অবস্থান করে। এ কথা অনস্বীকার্য যে জীববিজ্ঞানে বংশগতিতত্ত্বের প্রতি রাষ্ট্রের বিরোধিতা সোভিয়েত কৃষিতে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। আপেক্ষিকতাবাদের ক্ষেত্রে সেই রকম কোনো বিরোধিতা ছিল কিনা তা বিচার করতে হলে ইতিহাস ফিরে দেখা প্রয়োজন।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে সব দেশেই সব কালেই আপেক্ষিকতাবাদের বিরোধী লোকজন পাওয়া যাবে, এখনো খবরের কাগজে দেখতে পাওয়া যায় যে অমুক আইনস্টাইনকে ভুল প্রমাণ করেছেন। তবে তাদের আমরা crackpot বা ছিটগ্রস্ত মানুষ ভাবতেই অভ্যস্ত, তাদের সমালোচনাকে কোনো গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন সে যুগেও ছিল না বা এখনো নেই। প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী মহল থেকেও আপেক্ষিকতার বিরোধিতা সব দেশেই হয়েছিল, এবং বিজ্ঞানে সেটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের পক্ষে অনেক প্রমাণ থাকলেও সাধারণ আপেক্ষিকতার সমর্থনে পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ ছিল খুবই সীমিত। তাই বিজ্ঞানীরা অনেকেই তার পরিবর্তে অন্য কোনো তত্ত্বের খোঁজ করতেন। বাস্তবে ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে মাত্র দুজন প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত বিজ্ঞানী আপেক্ষিকতাবাদের বিরোধিতা করেছিলেন, আর্কাদি টিমিরিয়াজেভ ও নিকোলাই কাস্টেরিন। ঘটনাচক্রে প্রথমজন ছিলেন সোভিয়েত সরকারের সমর্থক, দ্বিতীয়জন তীব্র বিরোধী। তাঁরা এক বিকল্প তত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন, তবে তাঁদের মতামত সোভিয়েত বিজ্ঞানী বা দার্শনিক মহলে মধ্যে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলেনি।

সোভিয়েত দার্শনিকদের মধ্যে অবশ্য আপেক্ষিকতার তাৎপর্য নিয়ে তীব্র বিতর্ক ছিল, কিন্তু তা সোভিয়েত ইউনিয়নে সীমাবদ্ধ ছিল ভাবলে ভুল হবে। আইনস্টাইন ঊনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছেন, সে সময় বিজ্ঞানীরা দর্শন নিয়ে আজকের থেকে অনেক বেশি চিন্তাভাবনা করতেন। আইনস্টাইনও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না, এবং বহু জায়গায় তিনি তাঁর মত প্রকাশ করেছিলেন। আপেক্ষিকতাবাদের দর্শন নিয়ে আলোচনা এই প্রবন্ধের পরিধির বাইরে। শুধু বলতে পারি, আইনস্টাইন নিঃসন্দেহে ভাববাদী নন, কিন্তু অন্য অনেক বিজ্ঞানীর থেকে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তত্ত্বকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। নিলস বোরের সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত বিতর্কে তা বারবার প্রমাণ হয়েছে। আইনস্টাইনের শেষ জীবনে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন তার এক বড় কারণ তিনি কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে সম্পূর্ণভাবে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। তিনি তার অন্তর্নিহিত কোনো তত্ত্বের খোঁজ করছিলেন যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আজও পাওয়া যায়নি। ফলে আইনস্টাইনের গবেষণা নিয়ে দার্শনিকরা কখনোই একমত হতে পারেন নি।   

বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ প্রকাশের সময় আইনস্টাইন ছিলেন ঘোষিত ভাবে আর্নস্ট মাখের পজিটিভিজম বা প্রত্যক্ষবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু সঠিক বিচার করলে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদকেও প্রত্যক্ষবাদের অনুসারী বলা শক্ত। পরবর্তীকালে আইনস্টাইন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন এবং প্রত্যক্ষবাদকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছিলেন। লেনিন Materialism and Empirio-criticism-এ মাখের দর্শনের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। মার্ক্সবাদী দার্শনিকরা, যাঁরা আইনস্টাইনের মত পরিবর্তনের খবর হয়তো রাখতেন না, তাঁরা অনেকেই সেই কারণে বিশেষ আপেক্ষিকতা বিষয়ে  বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন। আপেক্ষিকতাবাদের দর্শনের অন্য সমালোচনাও ছিল। বিরোধিতা শেষ পর্যন্ত সাধারণ আপেক্ষিকতাকেও স্পর্শ করেছিল। ১৯৫২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকাশিত এক প্রবন্ধ সংকলনে এমন কথাও লেখা হয়েছিল যে আইনস্টাইনের ভ্রান্ত দর্শনের জন্য সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদও ত্রুটিপূর্ণ।

সমালোচনা হতেই পারে, প্রশ্নটা হল সরকারিভাবে তার জন্য আপেক্ষিকতাবাদ পড়ানো চর্চা ইতাদিতে কোনো বাধা এসেছিল কিনা। এক কথায় এর উত্তর হল, না।  সোভিয়েত ইউনিয়নের আপেক্ষিকতাবাদ বিশেষজ্ঞ বিখ্যাত বিজ্ঞানী ভ্লাদিমির ফক এইরকম অজ্ঞ সমালোচনার তীব্র বিরোধিতা করেন এবং সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল কমিটিকে চিঠি লেখেন। সেন্ট্রাল কমিটি ফককে জানায় যে পার্টি আপেক্ষিকতাবাদের সমালোচনাকে সমর্থন করে না। ফক এবং সোভিয়েত অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের সভাপতি সের্গেই ভাভিলভ আপেক্ষিকতাবাদের দর্শন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন এবং তার উপরে সমস্ত রকমের আক্রমণের জবাব দেন। কাজেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে এই বিষয়ে সমালোচনা নেহাতই রাজনীতি প্রসূত বললে খুব ভুল আমরা করব না। আবিষ্কারের পঁচাত্তর বছর পরেও আপেক্ষিকতাবাদ রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল।

সের্গেই ভাভিলভ

যে কোনো নতুন অগ্রগতির ক্ষেত্রে মতাদর্শগত বা দার্শনিক বিতর্ক ওঠাটাই স্বাভাবিক। আপেক্ষিকতাবাদ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিকোণের  সন্ধান দিয়েছিল, তার ক্ষেত্রে সেটা আরো বেশি সত্যি। কিন্তু সে যে সত্যের সন্ধান দিয়েছিল তা ব্যক্তিনিরপেক্ষ, তাকে ‘ইহুদি’ বা অন্য কোনো লেবেলে দাগিয়ে দেয়াটা অর্থহীন। বিজ্ঞান কখনোই শেষ কথা বলে না, আমাদের জানা অন্য সমস্ত তত্ত্বের মতোই আপেক্ষিকতাবাদও খুব সম্ভবত আরো নির্ভুল কোনো তত্ত্বের approximation অর্থাৎ  আসন্নায়ন। সেই তত্ত্বের সন্ধান চলছে। কিন্তু তা বলে আপেক্ষিকতাবাদের সত্যকে অস্বীকার করা যায় না। আবিষ্কারের একশো বছর পরেও সে সমস্ত পরীক্ষায় সগৌরবে উত্তীর্ণ হয়েছে।  

 

প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, জুলাই ২০২১  

 

 

 

No comments:

Post a Comment