বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণাঃ সমস্যা ও প্রতিকার
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
একটা কথা আমরা সবাই বহুবার শুনেছি, বিজ্ঞান কোনো বিষয় নয়, তা হল বিশ্বজগৎ সম্পর্কে জানার এক পদ্ধতি। নিঃসন্দেহে আমাদের চারপাশের জগৎকে জানার আরো পদ্ধতি আছে, বিজ্ঞান তাদের সকলের থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র। তার কারণ বিজ্ঞান বাস্তবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে, প্রকৃতি থেকে তত্ত্ব নিয়ে তত্ত্ব রচনা করে, পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ না করে কোনো পূর্বানুমান চাপিয়ে দেয় না। এ সবই হল বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য। বৈজ্ঞানিক গবেষণা মাত্রেই এই পদ্ধতি অনুসরণ করে সে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু শেষ বিচারে সেই গবেষণাই সফল হয় যার এই বৈশিষ্ট্যগুলি আছে। স্বাভাবিক ভাবেই বিজ্ঞানে পরীক্ষানিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার মানে এই নয় যে বিজ্ঞানে তত্ত্বের কোনো জায়গা নেই বা তার স্থান দ্বিতীয় সারিতে। তবে যে তত্ত্ব পরীক্ষার ফলের সঙ্গে মিলবে না, তাকে হয় বাতিল করতে হবে নয়তো তার পরিবর্তন করতে হবে। আধুনিক কালে বিজ্ঞানের কোনো কোনো শাখাতে তথ্যের পরিমাণ বিপুল বৃদ্ধি পেয়েছে, উদাহরণ স্বরূপ জ্যোতির্বিদ্যা বা জিনতত্ত্বের কথা বলা যেতে পারে। এই বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণের জন্য নানা নতুন পদ্ধতি প্রকরণ উদ্ভাবন করতে হয়েছে।
বুঝতে অসুবিধা নেই যে বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে হাতে কলমে শিক্ষা বা পর্যবেক্ষণের বিষয়টা ভীষণই অবহেলিত। বিদ্যালয় স্তরে পাঠক্রমে থাকলেও বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরির পাট নেই বললেই চলে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও ল্যাবরেটরি ক্লাস গতানুগতিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। বিজ্ঞানের আধুনিকতম বিষয়গুলিকে সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে শিক্ষক শিক্ষিকাদের খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না, তাঁদের অধিকাংশই ক্লাস নেওয়া ও প্রশাসনিক কাজে এতই ভারাক্রান্ত যে ল্যাবরেটরিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রতি আলাদা করে খেয়াল রাখার সুযোগ তাঁদের থাকে না। অর্থাভাবে ল্যাবরেটরির অবস্থাও সঙ্গিন; সেখানে নতুন যন্ত্র কেনা দূরের কথা, কোনো একটি যন্ত্র খারাপ হলে সারানোর বা পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে না। ফলে একদম বাঁধা পথের বাইরে যাওয়াকে বাধ্য হয়েই নিরুৎসাহ করতে হয়। প্রয়োজন ল্যাবরেটরিগুলির আধুনিকীকরণ, হাতে কলমে বিজ্ঞান শিক্ষার উপরে জোর দেওয়া, মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে সমস্যার সমাধানের উপর জোর দেওয়া। তার জন্য শিক্ষাখাতে বরাদ্দ অনেক বাড়ানো দরকার, যেখানে আমরা শুধু উন্নত নয়, অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের থেকেও অনেক পিছিয়ে।
আমার মতে এই সমস্যার মূল আরো গভীরে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর এ হিস্ট্ররি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি বইতে আমাদের দেশে বিজ্ঞানের অধোগতির কারণকে সঠিকভাবেই নির্দেশ করেছিলেন। হাতের কাজকে অবজ্ঞা করে চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে পরীক্ষানিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণকে অবহেলা করা হয়েছে যা স্পষ্টতই বিজ্ঞানের পরিপন্থী। শঙ্করাচার্যের মায়াবাদ শিক্ষা দেয় এই জগৎ মিথ্যা, তাই সেই মিথ্যা সম্পর্কে কষ্ট করে জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন কী? পাশ্চাত্য সমাজও এই দুই আবর্তের মধ্যে পড়েছিল, রেনেশাঁস ও সপ্তদশ শতকের বিজ্ঞানের বিপ্লব সেখান থেকে বিজ্ঞান চর্চাকে বার করে এনেছিল। আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য যে এখানে সেই রকম কোনো বিপ্লব হয়নি, ফলে আমাদের বিজ্ঞান অবিজ্ঞানের সঙ্গে আপোস করেই চলছে। আলাদা করে উদাহরণ দেয়ার দরকার নেই, প্রতিদিন আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই তা দেখতে পাচ্ছি। তাই কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারদের কাছে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব বিশেষ নেই; পক্ষান্তরে বেসরকারি পুঁজির কাছে তা একমাত্র মুনাফার ক্ষেত্র। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির মতো শিক্ষাবিরোধী বিজ্ঞানবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে সেইরকম প্রতিবাদ আমরা করতে পারিনি। বিজ্ঞান যদি বইয়ের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে, সমাজ যদি তাকে প্রয়োজনীয় না মনে করে, তাহলে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়।
এই সমস্যা থেকে বেরোবার উপায় কী? বৃহত্তর সমাজ বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি না করলে এর সমাধান সম্ভব নয়। আমাদের বুঝতে হবে একবিংশ শতাব্দীর সমস্যার সমাধান পাঁচশো হাজার বা দুহাজার বছরের পুরানো দর্শনে, বইতে বা সংস্কারে খুঁজে পাওয়া যাবে না, তার জন্য প্রয়োজন আধুনিক পদ্ধতি যা একমাত্র বিজ্ঞান প্রযুক্তি দিতে পারে। নানা বিজ্ঞান সংগঠন এই উদ্দেশ্যে কাজ করছে, কিন্তু প্রয়োজনের পক্ষে তা নিতান্ত অপ্রতুল। এখানে শুধু শিক্ষক নয়, সমাজের সমস্ত অংশকে ভূমিকা নিতে হবে।
সমাজের মানসিকতা পরিবর্তন নিঃসন্দেহে সময়সাপেক্ষ, কিন্তু তাছাড়াও অনেক কিছু করার আছে। বর্তমানে আমাদের দেশে একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে পরীক্ষাতে সাফল্য। তার উপরে জয়েন্ট, নিট, ইত্যাদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা শিক্ষার কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁততে উদ্যত। প্রথমত সেখানে হাতে কলমে কাজের উপরে কোনো গুরুত্বই নেই। বিজ্ঞানের প্রধান হাতিয়ারই সেখানে অবহেলিত। দ্বিতীয়ত, প্রতিযোগিতার বাজারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জায়গা নিচ্ছে কোচিং ক্লাস ও গৃহশিক্ষকতা। এগুলি যে আগে ছিল না, তা নয়, এবং তখনো তারা প্রকৃত শিক্ষার পরিপন্থী ছিল। তার কারণ দু'একটি ব্যতিক্রম থাকলেও সাধারণভাবে এই ধরনের শিক্ষণের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় পরীক্ষাতে নাম্বার পাওয়া, শিক্ষা সেখানে গৌণ। কিন্তু বিজ্ঞান শিক্ষাতে এগুলি বর্তমানে প্রায় সর্বব্যাপী হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাল্টিপল চয়েস প্রশ্নের ক্ষেত্রে সমাধানের পরিবর্তে কেমন করে মুখস্থবিদ্যা বা নানা শর্টকাটের সাহায্যে সমস্যার গভীরে না ঢুকে উত্তর খুঁজে বার করা যায় সেটাই শেখানো হচ্ছে। এই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তাই প্রায়শই সৃজনশীলতা দেখতে পাওয়া যায় না, বিজ্ঞানমনস্কতাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
এই সমস্যা অবশ্য নতুন নয়, তবে বর্তমানে তার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলগতভাবে এটিও সামাজিক সমস্যা; শিক্ষান্তে চাকরির সংখ্যা ক্রমশ কমছে, এবং চাকরি পেলেও প্রায়শই তার বেতন খুবই কম। এই ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাতে সাফল্য জীবনে প্রতিষ্ঠা সুনিশ্চিত করতে পারে। তাই বিপুল সংখ্যায় ছাত্রছাত্রী এই সমস্ত পরীক্ষাতে বসছে। ফলে পরীক্ষার অন্য কোনো পদ্ধতির কথা চিন্তা করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বিজ্ঞানের ক্লাসে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ক্রমশই কমছে। অবিলম্বে আমাদের শিক্ষা ও পরীক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন প্রয়োজন যাতে করে ছাত্রছাত্রীরা আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে আসে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিশাল সংখ্যক শূন্য পদ পূরণ না করে তা সম্ভব নয়। কিন্তু তার জন্যেও প্রয়োজন সরকারি সাহায্য, যা বাড়ার বদলে ক্রমশ কমছে।
গবেষণার জগতের কছে আমাদের আশা ছিল বেশি, কিন্তু সেখানেও গতানুগতিকতাই মুখ্য হয়ে দঁড়িয়েছে। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের আমরা নতুন পথে যেতে উৎসাহী করি না, কারণ সেখানে বাধাবিপত্তি অনেক। পদোন্নতি, নতুন প্রকল্পের জন্য অর্থ অনুমোদন ইত্যাদির বিচারে গবেষণার মানের জায়গা নিয়েছে গবেষণাপত্রের সংখ্যা। বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বেড়েছে, আমাদের বিজ্ঞানীরা অনেক বেশি সংখ্যক আন্তর্জাতিক প্রকল্পে অংশ নিতে পারছেন। এটা নিঃসন্দেহে সদর্থক দিক। কিন্তু দেশে গবেষণা খাতে সরকারি বরাদ্দ ক্রমশই কমছে, বেসরকারি পুঁজিও কয়েকটি সীমিত ক্ষেত্র ছাড়া অর্থলগ্নিতে উৎসাহী নয়। ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা দেশে কাজ লাগানো যাচ্ছে না। বেসরকারি ক্ষেত্রের কছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হয়তো দুরাশা, কিন্তু সরকারও যে সমস্ত গবেষণাতে আশু লাভ তার বাইরে কিছুতে উৎসাহী নয়। এর ফলে বিজ্ঞান গবেষণা তো পিছিয়ে পড়ছেই। নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনও সম্ভব হচ্ছে না, সেখানেও বাঁধা পথের বাইরে চলাকে উৎসাহ দেওয়া হয় না। উচ্চশিক্ষা বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরির সংখ্যাও ক্রমশ কমছে, ফলে প্রথম থেকেই মৌল বিজ্ঞান পাঠেই ছাত্রছাত্রীদের অনীহা দেখা যায়; তাদের মধ্যেও যে ক'জন গবেষণাতে আসে, তারা প্রায়ই হতাশাতে ডুবে যায়। সবসেরা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও তাই আত্মহত্যার কথা প্রায়ই শোনা যায়। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলি মনোবিদদের সাহায্য নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু তা মূল রোগ নয়, শুধুমাত্র উপসর্গের চিকিৎসা করতে পারে।
প্রতিবেশী দেশ চিনের দিকে তাকালে আমরা হয়তো এই সমস্যা সমাধানের কিছু দিশা পেতে পারি। তিরিশ বছর আগেও চিন নিঃসন্দেহে বিজ্ঞান গবেষণাতে ভারতের থেকে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু সে দেশের সরকার বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে। এর ফলে দেশের ছাত্রছাত্রীরা বিজ্ঞান শিক্ষা-গবেষণাতে উৎসাহিত হয়েছে, এবং সরকারি ক্ষেত্রও তাদের কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। তৃতীয় বিশ্ব তো বটেই, এমনকি পশ্চিমী উন্নত দেশ থেকেও এখন গবেষকরা চিনের গবেষণাগারগুলিতে জায়গা পাচ্ছেন। ফলে এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিন আমাদের থেকে অনেকদূর এগিয়ে গেছে এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাতে একদম প্রথম সারিতে জায়গা করে নিচ্ছে।
শেষে একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা বলি। আমাদের সেরা প্রতিভাগুলি রয়েছে কেন্দ্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যেখানে বেতন ও গবেষণার সুযোগসুবিধা অপেক্ষাকৃত বেশি; কিন্তু সেখানে মুষ্টিমেয় ছাত্রছাত্রীর প্রবেশাধিকার আছে। পৃথিবীর সমস্ত উন্নত দেশে গবেষণাতে নেতৃত্ব দেয় বিশ্ববিদ্যালয়, ভুললে চলবে না আমাদের দেশেও জগদীশচন্দ্র, রামন, মেঘনাদ, সত্যেন্দ্রনাথ সকলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় তাঁদের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজগুলি করেছিলেন, এবং সমতুল্য কোনো কাজ আজ পর্যন্ত দেশের কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানে হয়নি। স্বাধীনতার পরে নেহরু-ভাভা মডেলে আমাদের দেশে বিজ্ঞান গবেষণা কয়েকটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। হয়তো সদ্য স্বাধীন দেশের পক্ষে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে সাহায্য করা সম্ভব ছিল না, কিন্তু সেই আপতকালীন ব্যবস্থাই স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরে নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা প্রায়শই গর্ব করি যে ভবিষ্যৎ আমাদের, কারণ আমাদের দেশ তরুণদের দেশ। কিন্তু সেই তরুণদের বৃহত্তর অংশকে আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে দূরে রেখে আমরা কিছুতেই উন্নত দেশের সারিতে পৌঁছাতে পারব না।
প্রকাশঃ স্মরণিকা, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় স্মারক বিজ্ঞান মেলা ও প্রদর্শনী, ২০২৩
No comments:
Post a Comment