জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
গত বছর আকাশে উড়েছিল জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ, বা সংক্ষেপে ওয়েব। এর মূল নির্মাতা মার্কিন মহাকাশ সংস্থা ন্যাশনাল এরোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সংক্ষেপে নাসা; তবে অন্য কিছু দেশও প্রকল্পের অংশীদার। অ্যাপোলো অভিযানের সময় নাসার অধিকর্তা জেমস ওয়েবের নামে এই দূরবিনটির নাম দেওয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে প্রায় চোদ্দ বছর পরিশ্রম করে আটশো আশি কোটি ডলার (বা সত্তর হাজার কোটি টাকা) খরচ করে বানানো এই টেলিস্কোপ আমাদের সৃষ্টির আরো গোড়ার দিকের খবর এনে দেবে। সবে সে কাজ শুরু করেছে, ইতিমধ্যেই কিন্তু তার পাঠানো বেশ কিছু ছবি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই লেখাতে আমরা খুব সংক্ষেপে ওয়েবের গঠন ও তার কাছ থেকে আমরা কী আশা করছি সেই কথা জানব।
ওয়েব হল মূলত অবলোহিত আলোর টেলিস্কোপ, যদিও দৃশ্য আলোর লাল ও কমলা আলোতেও সে কাজ করে। আলো হল তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিভিন্ন রকম হতে পারে। খুব ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্য হলে আমরা তাকে বলি গামা রশ্মি, তারপর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা এক্স রশ্মি, অতিবেগুনি পেরিয়ে আসে দৃশ্য আলোতে। দৃশ্য আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য হল চারশো থেকে সাতশো ন্যানোমিটার, তার মধ্যে বেশির দিকটা হল কমলা ও লাল রঙের আলো। সাতশো ন্যানোমিটারের থেকে বেশি কিন্তু এক মিলিমিটারের কম তরঙ্গদৈর্ঘ্য হলে তাকে আমরা বলি অবলোহিত বা ইনফ্রারেড আলো; এরপর আসবে মাইক্রোওয়েভ ও রেডিও তরঙ্গ। অবলোহিত আলো আমরা চোখে দেখতে পাই না বটে, কিন্তু টের পাই। উনুনের কাছে হাত বাড়ালে যে তাপ অনুভূত হয়, তা অবলোহিত আলোর জন্য; বা বিজ্ঞানের ভাষায় বলে তাপীয় বিকিরণ হল অবলোহিত তরঙ্গ। অবলোহিত আলোর অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়েছিল জ্যোতির্বিদ্যার সূত্রেই। 1800 সালে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্শেল সৌর বর্ণালীর বিভিন্ন অংশে থার্মোমিটার রেখে উষ্ণতা বৃদ্ধি মাপছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে লাল আলোর পরে বর্ণালীর যেখানটা অন্ধকার, সেখানে উষ্ণতা বৃদ্ধি সব থেকে বেশি। এখন আমরা জানি এর মূলে আছে অবলোহিত রশ্মি। জেমস ওয়েব ছ'শো ন্যানোমিটার থেকে 28.5 মাইক্রোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কাজ করে।
উপরে যে ক'ধরনের তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের কথা বললাম তার সবগুলিই জ্যোতির্বিদ্যাতে কাজে লাগে। সবগুলির আলোচনা না করে আমরা শুধু অবলোহিত আলোর গুরুত্ব সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলি। মহাকাশে আছে গ্যাস ও ধূলিকণার তৈরি বিশাল বিশাল মহাজাগতিক মেঘ; তাদের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে আলোর সময় লাগতে পারে কয়েকশো বছর। অবলোহিত আলোর জ্যোতির্বিদ্যা থেকে আমরা জানতে পারি এরা কী দিয়ে তৈরি। দূরের নক্ষত্র থেকে যখন আলো এই সব মেঘের মধ্যে দিয়ে আসে, তখন সেই মেঘের অণুগুলি তার থেকে অবলোহিত আলোর বা রেডিওতরঙ্গের কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে নেয়, ফলে সেই নক্ষত্রের আলোর বর্ণালীতে সেই জায়গাগুলি কালো দেখায়। কোন অণু কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে শোষণ করবে তা নির্দিষ্ট, তাই বর্ণালীর কোন জায়গাগুলো অন্ধকার তা দেখে আমরা মেঘ কী দিয়ে তৈরি জানতে পারি। আবার কোনো গ্রহের বায়ুমণ্ডল কী দিয়ে তৈরি, তাও এভাবে জানা সম্ভব।
অবলোহিত জ্যোতির্বিদ্যার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ এই মহাজাগতিক মেঘের সঙ্গে যুক্ত। এই মেঘগুলি নিজের মাধ্যাকর্ষণে সংকুচিত হয়ে নক্ষত্রের জন্ম দেয়। একটা পাথরকে হাত থেকে ছেড়ে দিলাম, সে পৃথিবীর দিকে পড়বে। শুধু তাই নয়, পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বেগও বাড়বে। স্কুলে পড়েছি যে এই বেগ পরিবর্তনের হারকে বলে অভিকর্ষজ ত্বরণ। পাথরটা পৃথিবীর দিকে পড়ছে, কারণ পৃথিবীর আকর্ষণ। নিউটনের সূত্র অনুযায়ী সমস্ত বস্তুকণা এক অন্যকে আকর্ষণ করে। মহাজাগতিক কোনো মেঘের প্রতিটি অংশ এক অপরকে আকর্ষণ করছে, সুতরাং সে ক্রমশ ছোট হয়ে আসবে, অবশ্য যদি না তার বিপরীতে কোনো বল কাজ করে। পাথরটা যেমন পৃথিবীর যত কাছে যাচ্ছিল, তত তার বেগ বাড়ছিল, ঠিক তেমনি এই বিভিন্ন অংশগুলি যখন একে অপরের কাছে আসে, তাদের বেগ ক্রমশই বাড়তে থাকে। আমরা জানি যে তাপ হল গতিশক্তির রূপ, সুতরাং অংশগুলির বেগ বাড়ার অর্থ হল মেঘের মধ্যে তাপ উৎপন্ন হচ্ছে। এভাবে এক সময় সে এই উত্তপ্ত হয় যে তার মধ্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া শুরু হয়। বিক্রিয়া শুরুর আগের অবস্থাকে বলে প্রোটোস্টার বা আদ্যনক্ষত্র। আবার বাদামি বামন (Brown Dwarf) নামে এক শ্রেণির নক্ষত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, যাদের শক্তির মুখ্য উৎস হল মাধ্যাকর্ষণজনিত সংকোচন। আদ্যনক্ষত্র, বাদামি বামন বা গ্রহদের তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম, তারা দৃশ্য আলোতে বিশেষ বিকিরণ করে না, কিন্তু অবলোহিত আলোতে উজ্জ্বল দেখায়। তাই এদের সম্পর্কে জানার সব থেকে বড় হাতিয়ার হল অবলোহিত আলো। বিশেষ করে আমরা আশাতে আছি যে ধূলিকণার মেঘ ভেদ করে আসা অবলোহিত আলো বিশ্লেষণ করে আদি নক্ষত্রদের জন্মের খবর দেবে ওয়েব।
বিশেষ করে প্রথম যুগের নক্ষত্রদের জন্মের সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল আছে। আমাদের মহাবিশ্বের বয়স হল মোটামুটি 1380 কোটি বছর, আমাদের অনুমান যে ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের দশ কোটি বছরের মধ্যে প্রথম নক্ষত্রদের জন্ম হয়েছিল। সেই নক্ষত্ররা সম্ভবত ছিল অনেক বড়, এবং হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে তৈরি, কারণ তখনো পর্যন্ত সামান্য লিথিয়াম ছাড়া অন্য এই দুটি মৌলই মহাবিশ্বে ছিল। তারা খুব তাড়াতাড়ি তাদের জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে, এবং মৃত্যুর সময় বাকি ভারি মৌল তৈরি করে যা মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী কালের নক্ষত্রদের মধ্যের ভারি মৌলদের উৎস এই নক্ষত্রগুলি। কিন্তু এখনো আমরা এই সমস্ত নক্ষত্রদের সন্ধান পাইনি, আমাদের কাছের এই প্রাচীন নক্ষত্ররা অনেকদিন মৃত। তাদের সন্ধান করতে হবে অনেক দূরের মহাকাশে, কারণ সেখান থেকে আলো এসে আমাদের টেলিস্কোপে ধরা দিতে অনেক সময় নেবে। আমরা আশাতে আছি যে ওয়েব আমাদের প্রথম যুগের নক্ষত্রদের সন্ধান দেবে, এবং তার থেকে আমরা গ্যালাক্সিদের সৃষ্টি সম্পর্কেও জানতে পারব। অপর এক কারণে দূরের খবর পেতে গেলে অবলোহিত আলোর টেলিস্কোপ বেশি কাজে দেয়। আমরা জানি যে আমাদের মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, গ্যালাক্সিরা একে অন্যের থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। স্কুলে ডপলার ক্রিয়ার কথা পড়েছি; কোনো তরঙ্গ উৎস যখন আমাদের থেকে দূরে সরে যায়, তখন আমাদের কাছে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। দূরের গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোর ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে, ফলে যে আলো দৃশ্য আলো হিসাবে যাত্রা শুরু করেছিল, সে আমাদের কাছে অবলোহিত আলো হিসাবে এসে পৌঁছোচ্ছে।
কিন্তু অবলোহিত আলোর জ্যোতির্বিদ্যার কিছু সমস্যা আছে। আমাদের পৃথিবীর মাটিতে সবরকমের অবলোহিত আলো এসে পৌঁছোয় না, কারণ বায়ুমণ্ডল তাকে শোষণ করে নেয়। নিচের ছবিটাতে আমাদের বায়ুমণ্ডল অবলোহিত আলোর বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে কতটা মাটি পর্যন্ত পৌঁছোতে দেয় সেটা দেখানো হয়েছে। যেমন দেখা যাচ্ছে চোদ্দ থেকে ষোল মাইক্রনের মধ্যে কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যই এসে পৌঁছায় না, কার্বন ডাই অক্সাইড তার সবটাই শোষণ করে নেয়। মূলত জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই অক্সাইড, ওজোন এই গ্যাসগুলি অবলোহিত আলোকে শোষণ করে।
জ্যোতির্বিদ্যার পক্ষে এই শোষণ বিশেষ অসুবিধাজনক। বিশেষ করে বায়ুমণ্ডলে যে সমস্ত অণু আছে, তাদের কথা ধরা যাক। আমরা কোনো দূরের গ্রহের বায়ুমণ্ডলে জল আছে কিনা জানতে চাই, কারণ তা প্রাণ সৃষ্টির সঙ্গে সংযুক্ত। কিন্তু আমাদের বায়ুমণ্ডলের জলের অণুরা তাদের নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে শোষণ করবেই। ফলে বায়ুমণ্ডলের নিচে বসে ওই সমস্ত অণু দেখা সম্ভব নয়, তার জন্য আমাদের বায়ুমণ্ডলকে যতটা সম্ভব পেরিয়ে যেতে হবে। সে জন্য আগে পাহাড়ের উপরে শুষ্ক জায়গাকে অবলোহিত আলোর পর্যবেক্ষণের জন্য পছন্দ করা হত। স্বাভাবিকভাবেই মহাকাশে টেলিস্কোপ বসাতে পারলে সব থেকে ভালো হয়। এই সমস্ত কারণেই ওয়েব নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
টেলিস্কোপ যত বড় করা যায় তত ভালো। দূরবিনে যে প্রতিসারক বা প্রতিফলক, অর্থাৎ লেন্স বা আয়না ব্যবহার করা হয়, তার মুখের খোলা অংশকে বলে উন্মেষ (Aperture)। দূরবিন ব্যবহারের একটা বড় কারণ হল তার আলো সংগ্রহ করার ক্ষমতা। উন্মেষের ক্ষেত্রফল তার ব্যাসের বর্গের সমানুপাতে বাড়ে। ক্ষেত্রফল যত বেশি হয়, তত বেশি জায়গা থেকে আলো নিয়ে এসে ফোকাস করা হয়। ফলে তত অনুজ্জ্বল জ্যোতিষ্ককে টেলিস্কোপে দেখা যায়। সেই কারণে খুব সাধারণ টেলিস্কোপ বা বাইনোকুলারেই খালি চোখে অদৃশ্য নক্ষত্রদের দেখতে পাওয়া যায়।
দূরবিনের আর একটা বড় ধর্ম হল বিভেদন। আলো ব্যবহার করে যে কোনো যন্ত্রে কত ছোট কোণ মাপা যায়, তার একটা সীমা আছে, তাকেই বলে বিভেদন। আলোর তরঙ্গধর্ম থেকে প্রমাণ করা যায় যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি l এবং যে যন্ত্র দিয়ে আলো দেখছি তার উন্মেষের ব্যাস d হলে
যন্ত্রের বিভেদন = 252000 X l/d
বিভেদনের মাপটা এখানে সেকেন্ডে দেওয়া আছে। এই সেকেন্ড হল কোণের মাপ। দেখা যাচ্ছে দূরবিন যত বড় হয়, বিভেদন তত কমে, অর্থাৎ তত নিখুঁত কোণ মাপা যায়। এটা খুব জরুরি বিষয় কারণ এর ফলে আমরা আকাশে কোনো জ্যোতিষ্কের অবস্থান নিখুঁতভাবে মাপতে পারি বা দুটো কাছাকাছি জ্যোতিষ্ককে আলাদা আলাদা ভাবে দেখতে পারি। যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বেশি, তার বিভেদন তত খারাপ। রেডিও তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক বড় বলে রেডিও টেলিস্কোপে বিশাল বিশাল ডিশ ব্যবহার করা হয়। বিভেদন কমানোর অন্য অনেক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়, কিন্তু সেই আলোচনাতে আমরা এই লেখাতে যাব না। কিন্তু একটা বিষয় সহজেই বোঝা যায়, অবলোহিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সাধারণ দৃশ্য আলোর থেকে অনেক বড়, তাই তার জন্য বড় উন্মেষ দরকার। এমন নয় যে ওয়েব মহাকাশে পাঠানো প্রথম অবলোহিত টেলিস্কোপ, কিন্তু তা নিঃসন্দেহে সব থেকে বড়। আগে এই রেকর্ড ছিল হার্শেল টেলিস্কোপের দখলে, ওয়েবের আয়নার 6.5 মিটার ব্যাস হার্শেলের তুলনায় প্রায় দুগুণ।
ওয়েবের বর্ণনাতে যাওয়ার আগে খুব সংক্ষেপে টেলিস্কোপ সম্পর্কে আরো দু'একটা সাধারণ কথা বলে নিই। দুরবিন দু'ধরনের হয়। প্রতিসারক দূরবিনে লেন্স ব্যবহার করা হয়, আর প্রতিফলক দূরবিনে তার জায়গায় থাকে বক্রতল আয়না। বিভিন্ন কারণে দ্বিতীয়টা বানানো অনেক সহজ, তার সুবিধাও অনেক বেশি। একটা সুবিধা খুব সহজেই বোঝা যায়। আমরা সবাই জানি যে প্রিজমের মধ্যে দিয়ে আলো গেলে সে নানা রঙে (অর্থাৎ নানা তরঙ্গদৈর্ঘ্যে) ভেঙে যায়। তার কারণ হল বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর প্রতিসরাঙ্ক এক নয়। তাই লেন্সে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর ফোকাস দৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা। একে বলে বর্ণাপেরণ (Chromatic aberration)। বিভিন্ন রঙের আলো বিভিন্ন বিন্দুতে ফোকাস হয় বলে প্রতিবিম্ব ঝাপসা দেখায়। আয়নাতে এই সমস্যা নেই, তাই সমস্ত আধুনিক বড় দূরবিনে আয়না ব্যবহার করা হয়। এই বক্রতল আয়নার আকার হল অধিবৃত্তাকার (Paraboloid), তার ফলে ফোকাস আরো ভালো হয়।
ওয়েবের আলোক সংবেদন ক্ষমতা হাবল স্পেস টেলিস্কোপের একশো গুণ। আমরা আশা করছি যে মহাবিশ্বের জন্মের কুড়ি কোটি বছর পরের খবর সে দেবে। মূল আয়নাটি (primary mirror) আঠারোটি ষড়ভুজ দিয়ে তৈরি, আয়নাদের হালকা করার জন্য বেরিলিয়াম ধাতুর উপর পাতলা সোনার আস্তরণ দিয়ে তৈরি হয়েছে। ফলে হাবলের থেকে অনেক বড় হলেও ওয়েবের ভর হাবলের অর্ধেক। গতবছর 25 ডিসেম্বর ফরাসি গায়না থেকে এরিয়ে-5 রকেটে সে যাত্রা শুরু করেছিল, রকেটের মধ্যে ধরানোর জন্য আয়নাটা ভাঁজ করে রাখা ছিল, মহাকাশে যাওয়ার পরে তাকে খোলা হয়েছে। জেমস ওয়েবকে বসানো হইয়েছে পৃথিবী থেকে পনের লক্ষ কিলোমিটার দূরে, আমাদের যেদিকে সূর্য তার উল্টোদিকে। টেকনিকাল ভাষায় এই অবস্থানকে বলে L2 বা দ্বিতীয় লাগ্রাঞ্জ বিন্দু, এখানে যে কোনো বস্তু পৃথিবীর সঙ্গে সমানতালে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এত দূরে পৃথিবী বা চাঁদের ছায়া তার উপর বিশেষ পড়বে না, তার ফলে তাপমাত্রার বিশেষ হেরফের হবে না। সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাপমাত্রা পরিবর্তনের জন্য আয়নার মাপের পরিবর্তন হতে পারে। যন্ত্রপাতি সমস্ত সৌরশক্তি চালিত, কিন্তু সূর্যের আলো এবং পৃথিবী ও চাঁদের তাপীয় বিকিরণ তার অবলোহিত আলোর পর্যবেক্ষণে বাধা দেবে। তাই ওয়েবের একদিকে রয়েছে টেনিস কোর্টের মতো বড় একটা সানশিল্ড, টেলিস্কোপকে এই তিন জ্যোতিষ্ক থেকে সে ঢেকে রাখে।
অবলোহিত টেলিস্কোপের তাপমাত্রা কম রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা না হলে টেলিস্কোপ থেকে যে তাপীয় বিকিরণ বেরোয় তা মহাকাশের বিকিরণ পর্যবেক্ষণে বাধা সৃষ্টি করে। তাপমাত্রা কমালে সেই বিকিরণ কমে। অন্যন্য টেলিস্কোপে শীতলীকরণের জন্য তরল হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম ব্যবহার করা হয়, কিন্তু মহাকাশে সেই পদ্ধতি নিলে দূরবিন কিছুদিন পরে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায়। যেমন হার্শেল টেলিস্কোপের তরল হিলিয়াম শেষ হওয়ার ফলে সে চার বছরের বেশি চলেনি। ওয়েবের ক্ষেত্রে শীতলীকরণের জন্য তরল গ্যাস নয়, সানশিল্ড, রেডিয়েটর ও যান্ত্রিক কুলার ব্যবহার করা হয়েছে।
ওয়েব আছে দৃশ্য আলোর কাছাকাছি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অবলোহিত আলোর (Near infrared) জন্য একটি ক্যামেরা ও একটি বর্ণালী বিশ্লেষণ, অন্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জন্য আরো দুটি যন্ত্র। নতুন মাইক্রোশাটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে একসঙ্গে অনেকগুলি জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওয়েব সবে পূর্ণ শক্তিতে কাজ শুরু করেছে। নিচে কয়েকটা ছবি থেকে দেখানো হল, এর থেকে ওয়েবের ক্ষমতা সম্পর্কে একটু ধারণা হয়তো পাওয়া যাবে। বিজ্ঞানীরা এখন ওয়েব থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে ব্যস্ত। আশা করা যায় কিছুদিনের মধ্যেই অনেক নতুন চমকপ্রদ খবর পাওয়া যাবে, যা আমাদের মহাবিশ্বকে জানতে চিনতে সাহায্য করবে।
সৌরজগতের বাইরের গ্রহে জলের উপস্থিতি |
নেপচুনের বলয় |
(লেখাটি মুক্তমন পত্রিকার ডিসেম্বর ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। সমস্ত আলোকচিত্র নাসার ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া হয়েছে। )
No comments:
Post a Comment