বার বার আক্রান্ত বিবর্তনবাদ
শুরু করা যাক একটা পুরানো গল্প দিয়ে। গল্পটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, তবে যে কোনো দেশের হতেই পারত, এখনো হয়তো পারে। ১৯২৫ সালে টেনেসি প্রদেশের ডেইটন শহরের এক স্কুলশিক্ষক জন স্কোপ্সকে আইনভঙ্গের দায়ে আদালতে হাজির হতে হয়। কোন আইন তিনি ভেঙেছিলেন? অল্পদিন আগেই টেনেসির আইনসভা বিপুল গরিষ্ঠতাতে এক আইন পাস করেছিল; বাইবেলে লেখা আছে ইশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তার বিরোধী কোনো তত্ত্ব স্কুলে পড়ানোকে অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। স্পষ্টতই লক্ষ্য ছিল ডারউইনের বিবর্তনবাদ। তবে সকলেই যে মুখ বুজে এই আইন মানতে তৈরি ছিলেন তা নয়, কারণ তাঁরা বুঝেছিলেন যে শুধু বিবর্তনবাদ নয়, এ হল আধুনিক বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপরে আক্রমণ। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন শিক্ষকদের কাছে আহ্বান জানায় আইন ভাঙার জন্য, তার জন্য আদালতে প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা তারা দেবে। স্কোপ্স রাজি হন, তিনি স্কুলে বিবর্তনের ক্লাস নেন। আইন ভাঙার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়।
স্কোপ্সের পক্ষে দাঁড়ান আমেরিকার সব থেকে বিখ্যাত উকিলদের একজন, ক্ল্যারেন্স ড্যারো। ড্যারো ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন প্রগতিশীল, তিনি সানন্দে এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন। টেনেসির আইনের পিছনে ছিলেন রাজনীতিবিদ উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান। তিনি সরকারপক্ষের উকিলদের সঙ্গে যোগ দেন। স্কোপ্স যে আইন ভেঙেছিলেন তা তিনি অস্বীকার করেননি, কাজেই সেদিক দিয়ে বিচারের বিশেষ কিছু ছিল না। আসলে ড্যারোরা আদালত নয়, মানুষের কাছে নিজেদের যুক্তি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার পক্ষ ড্যারোকে সেই সুযোগ দিচ্ছিলেন না। ড্যারো তখন এক অভাবনীয় কাজ করেছিলেন, তিনি বিপক্ষের উকিল ব্রায়ানকে বাইবেল বিশেষজ্ঞ হিসাবে সাক্ষ্য দিতে ডেকেছিলেন, এবং বাইবেল থেকে নানা উদাহরণ দেখিয়ে বলতে বাধ্য করেছিলেন যে বাইবেলে যা লেখা আছে তার সবটাই আক্ষরিক সত্যি নয়, কিছু কথা রূপক বলে ধরতে হবে। ড্যারোর এক বিখ্যাত প্রশ্ন ছিল, বাইবেলে লেখা আছে সৃষ্টির চতুর্থ দিনে ঈশ্বর সূর্য চন্দ্র সৃষ্টি করেছিলেন, তাহলে তার আগের তিন দিন রাত কেমন করে হয়েছিল? বিচারে স্কোপ্সের অবশ্যই শাস্তি হয়েছিল, তবে পরে টেনেসি সুপ্রিম কোর্ট একটা নিয়মগত ভুল দেখিয়ে তা বাতিল করে দেয়।
উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ানকে (বাঁদিকে বসে) জেরা করছেন ক্ল্যারেন্স ড্যারো, (দাঁড়িয়ে)। বিচারের সপ্তম দিনে প্রচণ্ড গরমের জন্য কোর্টের বাইরে বিচার চলেছিল। |
আমেরিকাতে বিবর্তনবাদ প্রচারের কাজ করেছিল এই বিচার যা ইতিহাসে স্কোপ্স মাঙ্কি ট্রায়াল নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। ডারউইনের মতবাদের বিরোধিতাতে বাঁদরের কথা আসা নতুন কিছু নয়। বিজ্ঞানের ইতিহাসে সব থেকে বিখ্যাত বিতর্ক হয়েছিল ১৮৬০ সালে অক্সফোর্ডে। তার একদিকে ছিলেন এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী, অন্যদিকে এক ধর্মযাজক। বিষয় ছিল ডারউইনের বিবর্তনবাদ। ঠিক আগের বছর ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে চার্লস ডারউইনের সেই কালজয়ী গ্রন্থ যাকে 'অরিজিন অফ স্পিসিস' (পুরো নাম হল On the Origin of Species by Means of Natural Selection, or the Preservation of Favoured Races in the Struggle for Life) এই সংক্ষিপ্ত নামে আমরা সবাই চিনি। আলোচনাতে অনেকে অংশ নিলেও মূল তর্ক হয়েছিল দুজনের মধ্যে। একদিকে ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত বক্তা বিবর্তনবাদের তীব্র বিরোধী বিশপ স্যামুয়েল উইলবারফোর্স; অন্যদিকে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী টমাস হাক্সলি যিনি নিজেকে বলতেন ডারউইনের বুলডগ। তর্কটা বেঁধেছিল বিবর্তনবাদের পক্ষে যুক্তি ও প্রমাণ নিয়ে, কিন্তু উইলবারফোর্স যুক্তির পরিবর্তে কথার কারিকুরিতে হাক্সলিকে পরাজিত করার চেষ্টা করছিলেন। একসময় হাক্সলিকে ব্যাঙ্গ করে জিজ্ঞাসা করেন তাঁর ঠাকুর্দা না ঠাকুমা, কে বাঁদর ছিলেন। হাক্সলি উত্তরে বলেন যে পূর্বপুরুষ বাঁদর বলে তাঁর কোনো লজ্জা নেই, তিনি লজ্জিত হতেন যদি তিনি জানতেন যে তাঁর পূর্বপুরুষ সত্যকে সুবিধামতো বিকৃত করেছিলেন। স্পষ্টতই ইঙ্গিতের লক্ষ্য ছিলেন উইলবারফোর্স। কয়েকবছর আগে আমাদের দেশের সেই সময়ের কেন্দ্রীয় উচ্চশিক্ষামন্ত্রী সত্যপাল সিং মশাইও বলেছিলেন যে কেউ তো বাঁদর থেকে মানুষ হতে দেখেনি, সুতরাং বিবর্তন তত্ত্বটাই ভুল; জানি না হাক্সলির যুক্তির কী উত্তর তিনি দেবেন।
এখানে বলে রাখি যে ডারউইন ও আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস আলাদা আলাদা ভাবে একই সময়ে বলেছিলেন যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন হয়, সঠিক অর্থে তাই এটি দুজনেরই তত্ত্ব। এমন নয় যে বিবর্তনের কথা আগে কেউ বলেন নি, লামার্কের বিবর্তন তত্ত্বের কথা আমরা সবাই জানি। ডারউইনের ঠাকুর্দা ইরাসমাস ডারউইনও ছিলেন বিজ্ঞানী, তিনিও বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু বিবর্তন কেন হবে সে কথা ডারউইন ও ওয়ালেসের আগে কেউ বুঝতে পারেননি। তবে ডারউইন বিবর্তনবাদের সমর্থনে বিপুল পরিমাণ তথ্য জোগাড় করেছিলেন, এবং ওয়ালেস কখনো কখনো তাঁর নিজের তত্ত্বের বৈপ্লবিক তাৎপর্য থেকে পিছিয়ে এসেছিলেন। তাই অনেক সময়েই বিবর্তনতত্ত্বকে ডারউইনবাদও বলা হয়। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মতো পরিচিত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার প্রয়োজন এই লেখাতে নেই। সংক্ষেপে বলা যায় যে যে কোনো প্রজাতির জীবদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে নতুন চরিত্রের প্রকাশ ঘটে। জীবজগতে যে নতুন চরিত্রগুলি পরিবেশে ঐ জীবের বংশবৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে কোনো সুবিধা দেয়, সেগুলি স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে যেগুলি বংশবৃদ্ধিতে জীবকে অসুবিধাজনক অবস্থানে ফেলে, সেই পরিব্যক্তিগুলি লুপ্ত হয়ে যায়। এই পদ্ধতিকে বলে অভিযোজন; এর মাধ্যমে নতুন চরিত্র পুঞ্জীভূত হতে হতে শেষ পর্যন্ত নতুন প্রজাতির জন্ম হয়। একেই বলে প্রাকৃতিক নির্বাচন। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভব আমাদের পৃথিবীর এই বৈচিত্রময় জীবজগৎ কেমনভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা বুঝতে সাহায্য করেছে।
জীববিজ্ঞানের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ এই বিবর্তনবাদ, তাকে পাঠ্যসূচী থেকে বাদ দেওয়ার কাহিনির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে আমাদের দেশে। ভারতের ইতিহাসের উপর আক্রমণ আমাদের দেশে বহুদিনই শুরু হয়েছে। পুরাণকথা আর ইতিহাসকে সচেতনভাবে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অযোধ্যার রামমন্দির তার একটা ফলশ্রুতি। বোঝা কমানোর নামে ইতিহাসের পাঠক্রমে রদবদল করা হচ্ছে, মাধ্যমিক স্তর থেকে বিবর্তনবাদকে এই সুযোগে ছেঁটে ফেলা হল। রসায়নে পর্যায়সারণী বা পদার্থবিদ্যাতে তড়িৎচৌম্বক আবেশ বা শক্তির উৎসের মতো বিষয়ও বাদ দেওয়া হচ্ছে, তবে তারা সম্ভবত যুদ্ধক্ষেত্রের রিপোর্টের ভাষায় কোল্যাটারাল ড্যামেজ। শুধু ইতিহাস বা জীববিজ্ঞান পাঠক্রমের বোঝা হালকা করলে অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সহজেই বোঝা যাবে, তাই অন্য বিজ্ঞানেও হাত পড়েছে। পর্যায়সারণী না পড়িয়ে রসায়ন শেখানো যায় সে কথা যাঁরা ভাবতে পেরেছেন, তাঁদের চিন্তাপদ্ধতি আমার বুদ্ধির অগম্য। কিন্তু রসায়নে পর্যায় সারণীর যেখানে স্থান, জীববিজ্ঞানে বিবর্তন তত্ত্ব তার থেকে অনেক বেশি কেন্দ্রীয় অবস্থানে আছে। আমাদের চারদিকের জীবজগতের বৈচিত্রকে বোঝার অন্য কোনো উপায় নেই। মনোবিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব, এমনকি পদার্থবিজ্ঞানেও বিবর্তনবাদ নতুন পথ দেখাচ্ছে। পরিবেশ, অতিমারী, ওষুধ ও তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি মৌলিক সমস্যার সমাধানের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে বিবর্তনবাদের মধ্যে। তাই দেশের আঠারোশোর বেশি বিজ্ঞানী এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন, তবে তাতে বড়কর্তাদের মত পাল্টায়নি।
তবে একটা কথা পাঠক্রম রচয়িতাদের সমর্থনে বলতেই হবে, তাঁরা অন্তত বিবর্তনবাদকে ভুল বলেননি, উঁচু ক্লাসের পাঠক্রমে রেখে দিয়েছেন। পুরোটাই বাদ দিয়ে দিতে পারতেন; উচ্চশিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী সত্যপাল সিং তো সেই দাবীই তুলেছিলেন। তাঁর হাস্যকর যুক্তি নিয়ে আলোচনা করে পাঠকের সময় নষ্ট করতে চাই না, কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়; বিজ্ঞানে এত নানা বিষয় থাকা সত্ত্বেও কেন ডারউইনের তত্ত্বই বারবার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে?
উইলিয়াম ব্রায়ান কেন বিবর্তনবাদের বিরোধিতা করেছিলেন? বাইবেলে লেখা আছে ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশাল অংশের মানুষ বিবর্তন তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। ব্রায়ানের মনে হয়েছিল যে সেই তত্ত্ব স্কুলে পড়লে বাইবেল ও খ্রিস্টধর্ম থেকে ছাত্রছাত্রীদের বিশ্বাস চলে যাবে। বিদ্যালয়ের পাঠক্রম থেকে যাঁরা ডারউইনবাদকে বাদ দিচ্ছেন, তাঁদের আশঙ্কার কারণ বুঝতে আগের বাক্যটাতে খ্রিস্টধর্মের জায়গায় যে কোনো ধর্ম এবং বাইবেলের জায়গায় তার ধর্মগ্রন্থের কথা বসিয়ে নিতে পারেন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের এক স্কুলে ডারউইনের তত্ত্বের কথা বলাতে এক শিক্ষকের হেনস্থার খবর এখনো পুরানো হয়নি। আমাদের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার তাদের বুদ্ধিমতো ধর্মের ভিত্তিতে দেশ চালাতে চায়, তার জন্য দেশ মধ্যযুগে ফিরে গেলেও তাদের কিছু আসে যায় না। চাইলেই তো আর অতীতে ফিরে যাওয়া যায় না, একবিংশ শতাব্দীর সমস্যার সমাধান হাজার হাজার বছরের পুরানো বইতে পাওয়া যাবে না। তবে সে কথা আমাদের নীতি নির্ধারকদের কে বোঝাবে, তাঁরা তো মেঘনাদ সাহার ভাষায় 'সবই ব্যাদে আছে', সেই কথাতে বিশ্বাসী!
কোনো ধর্মগ্রন্থই যুক্তিপ্রমাণের ধার ধারে না, সেখানে আপ্তবাক্যই যথেষ্ট। প্রাচীন ও মধ্যযুগে তাকে কেউ প্রশ্ন করার কথা ভাবতে পারত না। কিন্তু আধুনিক জগৎ অনেকটা এগিয়ে গেছে, বিজ্ঞান হল এই যুগের মন্ত্র। তাই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মও এখন অনেক সময়েই নিজেকে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ করতে চায়। প্রায়ই নানা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির সমর্থনে বিজ্ঞান থেকে যুক্তি খোঁজা হয়, যদিও প্রায় সব ক্ষেত্রেই তা অপযুক্তি। তাই বিজ্ঞানের অন্য শাখার উপর মৌলবাদীদের বিদ্বেষ খুব প্রবল নয়। কিন্তু বিবর্তনবাদ সম্পর্কে তারা সবাই খড়্গহস্ত, কারণ সেখানে ঈশ্বরের কোনো স্থান নেই। বিবর্তনবাদ পুরোপুরি বস্তুবাদসম্মত যুক্তিতে জীবজগতের উদ্ভবের ব্যাখ্যা দেয়। এবং সেই কারণেই বিবর্তনবাদ সকলের অবশ্যপাঠ্য। আমরা যে সায়েন্টিফিক টেম্পার বা বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির কথা বলি, এমন তো নয় যে একমাত্র বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্যই তা প্রযোজ্য; আধুনিক সমাজে সকলেরই সেই মনোবৃত্তি থাকা উচিত। বিবর্তনবাদ তা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তাই দশম শ্রেণির পরে যারা ইতিহাস বা শিক্ষাবিজ্ঞান নিয়ে পড়বে, বা পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে, তাদেরও বিবর্তনবাদ শেখাটা জরুরি।
ডারউইনের বিরোধিতার নানা রূপ আছে। একটা হল যা আমাদের মন্ত্রীমশাই বলতে চেয়েছিলেন, অর্থাৎ বিবর্তন তত্ত্বের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। আধুনিক বই পড়তে হবে না, একটু কষ্ট করে তিনি যদি 'অরিজিন অফ স্পিসিস' বইটা পড়ে নিতেন, তাহলে তাঁর হয়তো এই কথাটা বলার সাহস হতো না। ইংরাজিতে বাক্যবন্ধটা হল থিওরি অফ ইভলিউশন, তাই এমন কথা শোনার দুর্ভাগ্য হয়েছে, ও তো থিওরি, প্রমাণিত সত্য নয়। বিজ্ঞানে ব্যবহৃত শব্দগুলি প্রতিদিনের ভাষা থেকেই নেওয়া, তার ফলে এই ধরনের সমস্যার সৃষ্টি। সাধারণ ভাষাতে আমরা অনেক সময় বলেই থাকি, ‘এটা তোমার থিওরি,’ অর্থাৎ তোমার বিশ্বাস, কিন্তু তা সত্যি নাও হতে পারে। বিজ্ঞানে ব্যাপারটা অনেকটা আলাদা। প্রথম যখন ডারউইন ও ওয়ালেস বিবর্তনের কথা বলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার নাম দেয়া হয়েছিল তত্ত্ব বা থিওরি। তারপরে গত দেড় শতাব্দীতে তার পক্ষে এত প্রমাণ জড়ো হয়েছে যে কোনো বিজ্ঞানীর আর তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও তার নামটা থিওরিই রয়ে গেছে, যেমন ভৌতবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম তত্ত্ব বা আইস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পক্ষে অসংখ্য প্রমাণ সত্ত্বেও তাদের আমরা থিওরিই বলে থাকি।
তার মানে এই নয় যে বিজ্ঞানের এই সব তত্ত্বে কখনো কোনো সামান্য পরিবর্তন হবে না, কিন্তু মোটের উপর কাঠামো যে এক থাকবে তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। বিজ্ঞান কি পাল্টায় না? আজ যা গল্প, কাল তা সত্যি প্রমাণিত হতেও তো পারে। একথা ঠিক বিজ্ঞানের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল যে সে শেষ কথা বলতে পারে না। প্রতিনিয়ত নতুন উদ্ভাবন নতুন পর্যবেক্ষণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হচ্ছে, বিজ্ঞান নিজেকে পরিবর্তন করছে। এই আত্মসংশোধন ও আত্মোন্নতি একান্তভাবেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অঙ্গ। তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে আজ যা জানি তা কাল একেবারে ভুল প্রমাণিত হবেই। একেবারে যে তা হয় না এমন নয়, কিন্তু সেই উদাহরণ খুবই কম; এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তা আরও দ্রুত কমে আসছে।
বিজ্ঞানের পোশাক পরা অবিজ্ঞানের থেকে দ্বিতীয় ধরনের বিরোধিতা আসে। অনেক বছর আগে কলকাতার এক বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান একটি বক্তৃতা আয়োজন করেছিল, বিষয় ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন। ঈশ্বর প্রাণ বা মানুষের সৃষ্টি করেছেন, এই ধারণার পোশাকি নাম ছিল ক্রিয়েশনিজম। এখন সেটা বিজ্ঞানী মহলে উপহাসের পাত্র, তাই তার নতুন নাম হয়েছে ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন, কিন্তু সেটা একই রকম অবিজ্ঞান। ফেসবুকের বিজ্ঞানীরা যেমন ম্যাক্রোইভোলিউশন আর মাইক্রোইভোলিউশন নিয়ে ভারি ভারি পোস্ট করেন (আজকের যুগের ভাষায় হ্যাজ নামান), ইন্টালিজেন্ট ডিজাইনের প্রবক্তাদের বক্তব্যও তার থেকে উন্নত কিছু নয়। তাঁরা ফিরে যেতে চান যেই যুগে, যখন ঈশ্বরের ইচ্ছায় জগৎ চলত। বিবর্তন তত্ত্ব প্রকাশের পরে তা আর হওয়ার নয়, তাই ডারউইনের উপরে রাগ স্বাভাবিক।
তৃতীয় এক পক্ষ আছেন যাঁরা ডারউইনের তত্ত্বকে পুরাণের মধ্যে খুঁজে পান, যেমন আজকাল সব নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনকেই ধর্মগ্রন্থে বা পুরাণে পাওয়া যায়। অবশ্য কেন জানি না বিজ্ঞানীরা আবিষ্কারটি করার আগে ধর্মগ্রন্থে তার উল্লেখ সবসময়েই তাঁদের সকলের চোখ এড়িয়ে যায়। তবে বিবর্তনবাদের উপর সাম্প্রতিকতম আক্রমণের সঙ্গে তার খুব একটা সম্পর্ক নেই, তাই সেই আলোচনাতে গেলাম না। আগ্রহীরা মেঘনাদ সাহা ও অনিলবরণ রায়ের মধ্যে যে বিতর্ক হয়েছিল, সেই প্রবন্ধগুলি পড়ে নিতে পারেন।
ইতিহাস না পড়ালে ইতিহাস পাল্টে যাবে না, তেমনি বিবর্তনতত্ত্ব না পড়ালে তা মিথ্যা হয়ে যাবে না। কিন্তু ক্ষতি হবে আমাদের সমাজের, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের। প্রকৃতিকে চেনার সব থেকে বড় হাতিয়ার হল বিবর্তন তত্ত্ব, তা না জানলে মানুষ অন্ধ থেকে যাবে। তাতে কিছু সুবিধাভোগী মানুষের লাভ নিশ্চয়, দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁরাই এখন আমাদের নীতিনিয়ন্তা। তাই প্রয়োজন আরো ব্যাপক মাত্রায় প্রতিবাদের, কারণ অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকবে না। পৃথিবী যখন এগিয়ে চলেছে, উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে 'ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে।'
পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ মহেশতলা আঞ্চলিক কমিটির পত্রিকা 'জীবনের সপক্ষে' আশ্বিন ১৪৩০ সংখ্যায় প্রকাশিত।
No comments:
Post a Comment