ক্যালেন্ডারের গল্প
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
আজকে তোমাদের ক্যালেন্ডারের গল্প শোনাব। ভাবছ ক্যালেন্ডারের মধ্যে আবার নতুন কী আছে? ওই প্রতিবছর হয় পয়লা জানুয়ারি নয়তো পয়লা বৈশাখ নতুন ক্যালেন্ডার আসে, কোনোটা দেয়ালে টাঙানো হয়, কোনোটা টেবিলে বা পকেটে রাখি। সেগুলোও নিশ্চয় ক্যালেন্ডার, কিন্তু আমাদের গল্পগুলো তার থেকে পুরোনো। এতই পুরোনো যে অনেক গল্পের শুরু কবে সবাই ভুলে গেছে। প্রাচীন রোমানরা মাসের প্রথম দিনটাকে বলত ক্যালেন্ডস, সেই থেকে ক্যালেন্ডার শব্দটা এসেছে। আমাদের দেশে আমরা বলি পঞ্জিকা বা পাঁজি। আয়ারল্যান্ডে এমন কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে যার ভিতরে একটি সমাধি আছে। একমাত্র একুশে ডিসেম্বর, অর্থাৎ মকর সংক্রান্তির দিনে সূর্যোদয়ের সময় সেই সমাধি সূর্যের আলোতে কয়েক মিনিটের জন্য সরাসরি আলোকিত হয়। এইরকম স্থাপত্য আমাদের দেশেও আছে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে কেরালাতে তৈরি শ্রীপদ্মনাভস্বামীর মন্দিরে গোপুরমের পাঁচটি স্তরের জানালা ভেদ করে সূর্যাস্তের সময় সূর্যের আলো ঢুকতে পারে মহাবিষুব ও জলবিষুবের দিনে, ঐ দু’দিন সূর্য বিষুবরেখার উপর লম্বভাবে কিরণ দেয় ইংল্যান্ডের বিখ্যাত স্টোনহেঞ্জও বছরের হিসাব রাখার জন্য তৈরি হয়েছিল। এদের ক্যালেন্ডার বলবে কিনা তা তোমরাই ঠিক করো।
পয়লা জানুয়ারি, কি পয়লা বৈশাখ, কি মহরম মাসের এক তারিখ, যেদিনই বছরটা শুরু হোক না কেন, ক্যালেন্ডার বানাতে হলে দুটো জিনিস জানতে হয়। এক হল বছরটা কত লম্বা? মানে কত দিন পরে আবার নতুন বছর আসবে। আর দু’নম্বরটা হল ঠিক কোন দিনে বছর শুরু হবে। এখন এই দ্বিতীয়টা নানা কারণে আলাদা আলাদা, তার কয়েকটা উদাহরণ আমরা দেখব। কিন্তু প্রথমটাতেও যে সবাই একমত, তা কিন্তু নয়। এক বছরে কত দিন? তোমরা বলবে ৩৬৫ দিন, আর লিপ ইয়ার হলে ৩৬৬। ঠিক, কিন্তু এটাই একমাত্র উত্তর নয়। যেমন ইসলামিক ক্যালেন্ডারে এক বছরে ৩৫৪ কিংবা ৩৫৫ দিন। সেটার কারণ আমরা জানি, একটু পরেই সেখানে আসব। কিন্তু মধ্য আমেরিকার মায়া সভ্যতা দু’রকম ক্যালেন্ডার ব্যবহার করত, তার একটাতে ছিল ২৬০ দিন। মায়া সভ্যতা স্পেনের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে, তাই কেন তারা বছরে ২৬০ দিন রেখেছিল, তা জানার আর উপায় নেই।
আচ্ছা ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিন কোথা থেকে এলো? এখন আমরা জানি যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একপাক ঘুরতে সময় নেয় ৩৬৫ দিনের একটু বেশি, ঠিকঠাক মাপটায় আমরা পরে আসছি। তার ফলে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত সব ঠিক এক বছর পরে ঘুরে আসে। নিশ্চয় জানো যে পৃথিবী ঠিক সোজা দাঁড়িয়ে সূর্যের চারদিকে ঘোরে না, একটু হেলে আছে। কোনো এক সময় সূর্য উত্তর গোলার্ধের উপরে বেশি লম্বভাবে কিরণ দেয়, তখন সেখানে গ্রীষ্মকাল। আবার ছ’ মাস পরে সূর্য উত্তর গোলার্ধের উপর তেরচা ভাবে কিরণ দেয়, তখন সেখানে শীতকাল। কিন্তু প্রাচীন যুগের মানুষ তো এসব জানত না, তাহলে তারা বছর গুনত কেমন করে?
অনেক রকম পদ্ধতি তারা নিয়েছিল। প্রথম ক্যালেন্ডার তৈরি হয়েছিল মিশরে। ভূগোল বইতে পড়েছ মিশরের সভ্যতা হল নীলনদের দান। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে নদী বয়ে চলেছে, বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় সেখানে বন্যা আসত। কূল ছাপিয়ে নদী তীরকে প্লাবিত করত, রেখে যেত জল আর উর্বর পলিমাটি। সেইখানে সারা বছরের জন্য ফসল চাষ হত। কবে নাগাদ বন্যা আসবে আগে জানা গেলে তৈরি থাকা যায়, জল নামার সঙ্গে সঙ্গে বীজ বোনা যায়। মিশরিয়রা দেখল যখন সূর্য ওঠার ঠিক আগে পূর্ব আকাশে আকাশের সব থেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র লুব্ধকের উদয় হয়, তার কয়েকদিনের মধ্যেই নীলনদে বন্যা আসে। তারা গুনে দেখল দু’বার এই ঘটনার মধ্যে মোটামুটি ৩৬৫ দিনের তফাত। তার থেকেই তারা বছর মেপে ফেলল। আসলে হিসেবটা ৩৬৫ দিনের থেকে একটু বেশি, মোটামুটি এক দিনের চার ভাগের এক ভাগ। তাহলে প্রতি চারবছরে এক দিন বেশি হয়। মিশরিয়রা সেটা বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু সেটাকে হিসেবে আনার প্রয়োজন মনে করেনি। সেজন্য প্রতি চার বছরে এক দিনের গোলমাল হত। কবে থেকে তারা বছর গুনতে শুরু করেছিলে, তাই নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে তর্ক আছে, তার মধ্যে আমরা যাব না। কিন্তু খ্রিস্ট জন্মের তিন হাজার বছর আগে যে তারা এভাবে বছর গুনতে শুরু করেছিল তাই নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রতি চার বছরে একদিনের গণ্ডগোল মানে ১৪৬০ বছরে এক বছরের গণ্ডগোল। বুঝতেই পারছ গোনা শুরুর কয়েকশো বছর পরেই লুব্ধকের উদয়ের সঙ্গে বন্যার আর কোনো সম্পর্ক রইল না। তৃতীয় টলেমি যখন ২৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরের সম্রাট হলেন, তখন তিনি বলেছিলেন যে প্রতি চার বছরে এক দিন যোগ করা হোক, এখন আমরা যাকে লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ বলি। কিন্তু টলেমি ছিলেন গ্রিক, আলেকজান্ডার মিশর দখল করে নিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরে সেখানে গ্রিকরাই সম্রাট বা ফারাও হয়ে শাসন করতে শুরু করেন। বছরের হিসেব রাখত পুরোহিতরা, তারা গ্রিক সম্রাটের আদেশকে গুরুত্ব দেয়নি। সে যাই হোক, মিশরিয়রাই প্রথম ৩৬৫ দিনে বছর গুনেছিল।
অন্যভাবেও কিন্তু এই হিসেবটা করা যায়। প্রতিদিন যদি সূর্য একই জায়গায় উদয় হয় বা অস্ত যায় না। একুশে জুন কর্কটসংক্রান্তির দিনে সূর্য সব থেকে উত্তর দিকে উদয় হয়, তারপর সে দক্ষিণদিকে চলতে শুরু করে। বাইশে ডিসেম্বর দক্ষিণতম বিন্দুতে যায়, আবার তারপর উত্তর দিকে রওনা দেয়। সেই দেখেই বছরের হিসাব করা যায়। ঠিক তেমনি ঠিক দুপুর বেলা একটা খাড়া ভাবে রাখা লাঠির ছায়া কোনদিকে পড়ে আর কত বড় হয়, তাই দেখেও বছর মাপা যায়। ধরো, বেশ কয়েকবছর ধরে কর্কটক্রান্তি রেখার উপরে কোনদিন দুপুরবেলা লাঠির ছায়া থাকে না, তার থেকে হিসেব করলে দেখা যাবে বছর ৩৬৫ দিনের থেকে ছ’ ঘণ্টা বেশি। ভারত, মেসোপটেমিয়া, চিন, এই সমস্ত দেশে এভাবেই হয়তো বছরের হিসেব করা হয়েছিল। কিন্তু নীল নদের বন্যার সঙ্গে যোগ রেখে লুব্ধক উদয়ের সঙ্গে নতুন বছর শুরু করার হিসাব মিশরিয়রা করেছিল, অন্যদের বছরের শুরুটা সেই দিনে পড়ার কোনো কারণ নেই। যেমন আমাদের যে বঙ্গাব্দ, তার পয়লা বৈশাখ ছিল মার্চ মাসের একুশ তারিখ অর্থাৎ মহাবিষুব, সেই দিন সূর্য বিষুবরেখার উপর লম্বভাবে কিরণ দেয়।
আমি জানি তোমরা এক্ষুনি বলবে যে পয়লা বৈশাখের ছুটি তো ১৫ এপ্রিল পাই। আসলে সূর্য দেখে আর নক্ষত্র দেখে বছরের হিসেব করলে একটু তফাত হয়, তার কারণ পৃথিবীর অয়নচলন। এটা একটু জটিল, আসলে পৃথিবীর অক্ষ মোটামুটি ছাব্বিশ হাজার বছরে কক্ষতলের সঙ্গে লম্বের সাপেক্ষে একপাক ঘুরে আসে। কিন্তু আমাদের বঙ্গাব্দের পঞ্জিকায় সেটাকে হিসাবে রাখা হয়নি। ফলে ২০২৩ সালে মে মাসের গরমে রবীন্দ্রজয়ন্তী হল, আর ১৫০২৩ সালে সোয়েটার গায়ে দিয়ে পঁচিশে বৈশাখ পালন হবে। বঙ্গাব্দ কে কবে শুরু করেছিলেন তাই নিয়ে তর্ক আছে, তার মধ্যে না ঢুকে একটা কথা বলতেই পারি। বঙ্গাব্দ শুরুর হিসাবের পরে চোদ্দশো তিরিশ বছরে পয়লা বৈশাখ পিছিয়ে পিছিয়ে পনেরই এপ্রিলে চলে গেছে। এই অয়নচলন বিষয়টা আবিষ্কার করেছিলেন গ্রিক বিজ্ঞানী হিপ্পারকস খ্রিস্ট জন্মের একশো বছর আগে। কিন্তু আমাদের পঞ্জিকায় সেটা আর কেউ ঢোকায় নি। জ্যোতিষীরা জন্মের সময় কোন রাশি ছিল জানতে চায়। রাশি আর কিছু নয়, আকাশে সূর্যের গতিপথে বারোটা নক্ষত্রমণ্ডলের কল্পনা করা হয়েছে, তাদের বলে রাশি। কিন্তু বছর পিছিয়ে যাওয়ার ফলে রাশির হিসেবেও গণ্ডগোল হয়ে গেছে। অবশ্য রাশি ঠিক থাকলেও জ্যোতিষীদের ভবিষ্যৎবাণী মেলার কোনো কারণ নেই, সূর্য আকাশে কোথায় আছে তার সঙ্গে মানুষের ভবিষ্যতের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। জ্যোতিষীরা যা বলে সবই ভুলভাল, কিন্তু তাদের হিসেবের গোড়াতেও ভুল আছে।
সূর্যকে ধরে বছর হিসেব করার কারণ আছে। কবে ফসল রোপণ করতে হবে, শীত শুরুর আগে কবে পশুপালকরা পাহাড় থেকে তাদের ভেড়ার পাল নিয়ে নেমে আসবেন, বর্ষার শেষে রাজা কবে যুদ্ধযাত্রা করবেন বা শিকার করতে বেরোবেন, এ সমস্তই ঋতুর উপর নির্ভর করত। আগেই বলেছি পৃথিবী ও সূর্যের আপেক্ষিক অবস্থানের জন্যই ঋতু পরিবর্তন হয়। মানুষের জীবনের জন্য এই বছরটাই হল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, একে বলে ক্রান্তীয় বা সৌর বছর। কিন্তু অন্য এক ধরনের বছরও আছে।
আকাশে সব থেকে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক নিশ্চয় সূর্য, কিন্তু রাতের আকাশের চাঁদও মানুষের মন কেড়ে নিয়েছিল। চান্দ্র বছরের হিসাব সৌর বছরের থেকে বেশি পুরানো, চাঁদকে দেখে ক্যালেন্ডার বানানোর সব থেকে বড় সুবিধা হল চাঁদের কলা। পূর্ণিমার দিনের থালার মতো চাঁদ ক্ষয় পেতে পেতে অমাবস্যাতে অদৃশ্য হয়ে যায়, তারপর আবার বাড়তে বাড়তে পূর্ণিমাতে ফিরে আসে। এই বিষয়টা বোঝা খুব সোজা। এক অমাবস্যা থেকে আরেক অমাবস্যা বা এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমার মধ্যে মোটামুটি সাড়ে ঊনত্রিশ দিনের তফাত থাকে। একে বলে এক চান্দ্র মাস। যদি বারোটা চান্দ্র মাসের হিসেব করি, তাহলে হয় ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনের মাঝামাঝি। এই সংখ্যাটা ৩৬৫ দিনের সৌর বছরের কাছাকাছি, তাই বারো চান্দ্র মাসে এক বছর গোনা শুরু হয়েছিল। ইসলামিক হিজরি ক্যালেন্ডার চান্দ্র মাস মেনে চলে, তাই প্রতিবছর ইদ মহরম ইত্যাদি সৌর বছর বা বঙ্গাব্দের হিসাবে দশ থেকে এগারো দিনে আগে পড়ে। একে বলে চান্দ্র ক্যালেন্ডার। হজরত মহম্মদ যে বছর তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে মক্কা থেকে মদিনা গিয়েছিলেন, সেই বছর থেকে হিজরি সাল গোনা শুরু হয়।
বছরকে বারো মাসে ভাগ করার ধারণাটা এসেছিল চান্দ্র মাস থেকে, কিন্তু পরে অনেক সময় তাকে চাঁদের কলার থেকে আলাদা করা হয়। মিশরিয়রা ধরেছিল তিরিশ দিনে এক মাস, তার সঙ্গে চাঁদের কলার কোনো সম্পর্ক নেই। বারো মাসে ৩৬০ দিন, শেষ পাঁচ দিনকে তারা কোনো মাসের মধ্যে ফেলে নি। চাঁদের সঙ্গে বঙ্গাব্দের মাসেরও কোনো সম্পর্ক নেই। তাই বঙ্গাব্দ হল বিশুদ্ধ সৌর ক্যালেন্ডার। বুঝতেই পারো চাঁদের কলার সম্পর্ক আছে তিথির সঙ্গে। ইদের মতোই দুর্গাপুজোও এগোতে থাকে, কিন্তু তার একটা সীমা আছে। মহালয়া হল এমন অমাবস্যা তিথি যাকে আশ্বিন মাসে পড়তেই হবে। তার পরের পক্ষকে বলা হয় দেবীপক্ষ, দুর্গাপুজো সেই সময় হয়। এক মহালয়ার পরে আবার তেরো নম্বর অমাবস্যাই মহালয়া, কিন্তু এগোতে এগোতে যখন সেই অমাবস্যাটা ভাদ্র মাসে চলে যায়, তখন তার পরের অমাবস্যাতে মহালয়া পালন করা হয়। এভাবে চান্দ্র ক্যালেন্ডারকে যদি সৌর ক্যালেন্ডারের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়, তখন তাকে বলে চান্দ্রসৌর ক্যালেন্ডার। দুই ক্যালেন্ডারের মধ্যে বছরে দশ বা এগারো দিনের তফাত হয়, সেই কারণে ভারতীয় পাঁজিতে তিন বছর অন্তর একটি অতিরিক্ত মাস যোগ করা হয় যাকে বলে মলমাস। অনেক ক্যলেন্ডারেই এই রকম ব্যবস্থা আছে।
এখানে একটা কথা বলে রাখি, সাধারণভাবে দিন কত লম্বা তা মাপা হয় এক মধ্যাহ্ন থেকে পরের মধ্যাহ্নের মধ্যের সময় দিয়ে। রাত বারোটা থেকে দিনের শুরু হয়েছে অনেক পরে। বঙ্গাব্দে দিন শুরু হয় সূর্যোদয় থেকে। হিজরি ক্যালেন্ডার চাঁদ মেনে চলে, তার দিনের শুরু সূর্যাস্ত থেকে। হিন্দুরা যে তিথি গণনা করেন, তা কিন্তু সৌর দিনের মাপের থেকে আলাদা; সেটা চান্দ্রমাসের হিসাবেই হয়। দিনেরও অনেক গল্প আছে, সে সব পরে কখনো বলা যাবে।
প্রতি চারবছরে একটা অধিবর্ষের নিয়ম চালু করেছিলেন রোমের শাসক জুলিয়াস সিজার। তাঁর পরে রোমের সম্রাট হন অগাস্টাস। জুলিয়াস মিশর দখল করেছিলেন, অগাস্টাস সেখানে অধিবর্ষ চালু করেন। জুলিয়াসের আগে রোমে বছর গোনা হত ৩৫৫ দিনে অর্থাৎ মোটামুটি বারোটি চান্দ্র মাস। দু’বছর অন্তর তার সঙ্গে বাইশ বা তেইশ দিন যোগ করা হত, কিন্তু তার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। ফলে জুলিয়াস সিজারের সময় দু’মাসের বেশি ফারাক হয়ে যাচ্ছিল। সিজার মিশরের থেকে ৩৬৫ দিনের সৌর বছরটিকে নিলেন, আর খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালকে বাড়িয়ে করলেন ৪৪৫ দিনের। তিনি মাসের সঙ্গে চাঁদের কোনো সম্পর্ক রাখলেন না, এবং অধিবর্ষের নিয়ম চালু করলেন। একে বলা হয় জুলিয়াসের ক্যালেন্ডার।
কিন্তু বছরের আসল দৈর্ঘ্য হল ৩৬৫.২৪২২ দিন, অধিবর্ষের নিয়মে প্রতি চার বছরে ০.০৩১২ দিন বেশি যোগ হয়ে যাচ্ছিল। ১৫৮২ সালে পোপ দ্বাদশ গ্রেগরির আগ্রহে আবার ক্যালেন্ডার সংশোধন করা হয়। সমস্যাটা ছিল মূলত ধর্মীয়, যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ও পুনরুত্থানের যে উৎসব সেই ইস্টারের তারিখ নিয়ে গণ্ডগোল দেখা দিয়েছিল। তাই গ্রেগরি নিয়ম করলেন শতাব্দীর ক্ষেত্রে অধিবর্ষ তখনই প্রযোজ্য হবে যদি তা চারশো দ্বারা বিভাজ্য হয়। অর্থাৎ ১৯০০ সাল অধিবর্ষ ছিল না, ২১০০ সালও অধিবর্ষ হবে না, কিন্তু ২০০০ সাল ছিল অধিবর্ষ। এর ফলে সমস্যাটা পুরোপুরি চলে যায় নি, তবে তিন হাজার বছর না পেরোলে একদিনের নড়চড় হবে না। জুলিয়াস সিজার ও দ্বাদশ গ্রেগরির যুগের মধ্যে এগারো দিন গণ্ডগোল হয়েছিল, তাই তিনি নির্দেশ দেন যে ১৫৮২ সালের ৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবারের পরের দিন হবে ১৫ অক্টোবর শুক্রবার। আস্তে আস্তে সব দেশই এই নিয়ম মেনে নিয়েছে, এই ক্যালেন্ডার গ্রেগরির ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। রাশিয়া ১৯১৭ সালের বিপ্লবের আগে পর্যন্ত জুলিয়াস সিজারের ক্যালেন্ডার মেনে চলত, বিপ্লবের পরে গ্রেগরির ক্যালেন্ডার অবলম্বন করে। আগের ক্যালেন্ডারে বিপ্লব হয়েছিল অক্টোবর মাসে, পরের হিসাবে সেটা ছিল নভেম্বর মাস। তাই পুরানো বইতে রুশ বিপ্লবকে অক্টোবর বিপ্লব বলা হত।
সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর, এদের মানে হল সপ্তম, অষ্টম, নবম, ও দশম মাস। কিন্তু ক্যালেন্ডারে তো তা নয়। আসলে রোমে বছর শুরু হত পয়লা মার্চ থেকে, সেই জন্যই এই নাম। খ্রিস্টজন্মের সাড়ে চারশ বছর আগে রোমে জানুয়ারি থেকে নতুন বছর গোনা শুরু হয়। তখন ছিল চান্দ্র মাস, তাতে থাকত আটাশ বা ঊনত্রিশ দিন। তার চারশো বছর পরে জুলিয়াস সিজার সব মাসগুলোকে হয় তিরিশ না হয় একতিরিশ দিনে চালু করেছিলেন। খালি ফেব্রুয়ারি মাসে আছে আটাশ দিন, অধিবর্ষে সেটা হয় ঊনত্রিশ দিন। জুলিয়াস ও অগাস্টাসের শাসনকে স্মরণীয় করে রাখতে বছরের সপ্তম ও অষ্টম মাসের নাম রাখা হয় জুলাই ও আগস্ট। কোথাও কোথাও গল্প শুনবে যে অগাস্টাস নিজের নামের মাস যাতে ছোট না হয় তার জন্য ফেব্রুয়ারি থেকে একদিন নিয়ে নিয়েছিলেন। ওটা গল্পই, অগাস্টাস সম্রাট হওয়ার আগেই অষ্টম মাসে একত্রিশ দিন ছিল।
একটা কথা বলে রাখি, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব সব সময় সমান নয়, আমাদের যখন গ্রীষ্মকাল, তখন আমরা সূর্যের থেকে একটু বেশি দূরে থাকি। গ্রীষ্মকালের সঙ্গে সূর্য পৃথিবীর দূরত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলার দেখিয়েছিলেন যে গ্রহ যখন সূর্যের থেকে বেশি দূরে থাকে তখন তার বেগ কমে যায়। সেই কারণে উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল বেশি লম্বা। এই কারণেই আমাদের বঙ্গাব্দের হিসাবে গ্রীষ্মকালের মাসগুলি অপেক্ষাকৃত বড় রাখা হয়। যেমন ১৪৩০ বঙ্গাব্দে বৈশাখ, আষাঢ়, ভাদ্র ও চৈত্র মাসে আছে একত্রিশ দিন করে, জ্যৈষ্ঠ ও শ্রাবণ মাসে বত্রিশ দিন, আবার পৌষ ও মাঘ মাসে উনতিরিশ দিন। পৃথিবীর গতির কথা জানা না থাকলেও উদয় বা অস্তের সময় সূর্যের অবস্থান পর্যবেক্ষণ থেকেই প্রাচীন পঞ্জিকাকাররাই এই ধরনের হিসাবে পৌঁছেছিলেন।
আমার কথা শেষ করার সময় এসেছে। আরো অনেক রকম ক্যালেন্ডার আছে, তাদের প্রত্যেকের অনেক গল্প আছে। ইচ্ছা করলে তোমরাও বই বা ইন্টারনেট ঘেঁটে তাদের সম্পর্কে জানতে পারো। দুটো খুব ভালো বইয়ের কথা বলি, পলাশ বরন পালের লেখা 'সাল তারিখের ইতিহাস' ও প্রদীপ্ত সেনের 'সন-তারিখের পাঁচালি'; উপরের অনেকগুলো কথাই এদের থেকে নেওয়া।
খুশির হাওয়া পত্রিকার শারদীয় ১৪৩০ সংখ্যায় প্রকাশিত
Image by Freepik
No comments:
Post a Comment