Sunday, 4 February 2024

কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু

 

কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন দশককে বলা হয় বিপ্লবের যুগ। এই সময়ের নানা অগ্রগতি আমাদের বহুদিনের ধ্যানধারণাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। আইজ্যাক নিউটন পদার্থবিদ্যার যে নবযুগের সূচনা করেছিলেন, ঊনবিংশ শতাব্দীতে মাইকেল ফ্যারাডে, জেমস ম্যাক্সওয়েল, লর্ড কেলভিন, কার্ল ফ্রিয়েডরিখ গাউস, হাইনরিখ হার্জ প্রমুখের গবেষণার ফলে তা এক সুউচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছিল। পরিস্থিতি এমনই হয়েছিল যে তরুণ মাক্স প্লাঙ্ককে তাঁর শিক্ষক ফিলিপ ফন জলি বলেছিলেন পদার্থবিদ্যা পড়ে আর কোনো লাভ নেই, সেখানে মৌলিক আর কিছু করার সুযোগ নেই। মাক্স প্লাঙ্ক সেই কথাতে উদ্যম হারাননি, তাঁর হাত ধরেই ১৯০০ সালে কোয়ান্টাম বিপ্লবের সূচনা হয়। কয়েক বছরের মধ্যে আলবার্ট আইনস্টাইনের গবেষণা থেকেই জন্ম হয় বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতার। পদার্থবিজ্ঞানে নবযুগের সূচনা করেছিল কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও আপেক্ষিকতা। আইনস্টাইন কোয়ান্টাম বিজ্ঞানেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন এবং তাঁর নোবেল পুরস্কারে সেই কথারই উল্লেখ ছিল। আপেক্ষিকতার নীতি ও তার থেকে পাওয়া ফলাফল আমাদের কাছে যতই চমকপ্রদ হোক না কেন, নিউটনিয় বিজ্ঞানের কাঠামোর মধ্যে তাকে জায়গা করে দেওয়া সম্ভব। কোয়ান্টাম তত্ত্বকে কিন্তু কোনোভাবেই সেখানে স্থান করে দেওয়া সম্ভব নয়। সেই কারণেই স্বয়ং আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্ত্ব সংক্রান্ত গবেষণাকেই তাঁর একমাত্র বৈপ্লবিক আবিষ্কার মনে করতেন।


 

খুব সংক্ষেপে আমরা কেন কোয়ান্টাম তত্ত্বকে বৈপ্লবিক আখ্যা দিচ্ছি এবং কেন নিউটনিয় বলবিদ্যার কাঠামোর অধ্যে তাকে স্থান দেওয়া সম্ভব নয় দেখে নিই। নিউটনিয় বিজ্ঞানকে আমরা যান্ত্রিক বিশ্বদর্শন বা mechanistic interpretation of nature বলতে পারি। এ বিষয়ে নিউটন স্বয়ং কী ভেবেছিলেন? তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকার মুখবন্ধে তিনি লিখছেন, I wish we could derive the rest of the phenomena of nature by the same kind of reasoning from mechanical principles...” অর্থাৎ, “আমরা যান্ত্রিক বলবিদ্যার নীতি থেকেই সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হব, এই আমার ইচ্ছা।” তার আগে লিখেছেন, “আমি প্রকৃতির দর্শনের মধ্যে দৈহিক নয়, বরং প্রাকৃতিক শক্তির কথা বিবেচনা করব ... আমি এই প্রয়াসকে প্রকৃতির দর্শনের গাণিতিক নীতি হিসাবে উপস্থাপিত করছি, কারণ গতি সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাকৃতিক বল বিষয়ে অনুসন্ধান, সেই বল থেকে অন্যান্য ঘটনার ব্যাখ্যা -- এই হল এই দর্শনের উদ্দেশ্য।” এই তূর্যধ্বনিই হল যান্ত্রিক বিশ্বদর্শনের সূচনা। তার পরের তিনশো বছরের বলবিদ্যার ইতিহাস শুধু নিউটনের দর্শনের জয়যাত্রার ইতিহাস। যান্ত্রিক বিশ্বদর্শন থেকেই আসে নিয়তিবাদ (Determinism)। বিজ্ঞানের একটা মূল স্তম্ভ হল কার্য-কারণ সম্পর্ক। অর্থাৎ প্রত্যেক ঘটনার পিছনে কোনো না কোন কারণ আছে। নিয়তিবাদ আরো এক ধাপ এগিয়ে বলে ভবিষ্যতের সমস্ত ঘটনা অতীত থেকে পূর্বনির্ধারিত। বিজ্ঞানী পিয়ের-সিমোঁ লাপ্লাস নিউটনের বলবিদ্যার অনেক এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন যে যদি কোনো মুহূর্তে মহাবিশ্বের সমস্ত পরমাণুর অবস্থান ও ভরবেগ জানা সম্ভব হয়, তাহলে নিউটনের সূত্র প্রয়োগ করে অতীত ও ভবিষ্যতের যে কোনো সময়ে তাদের গতির অবস্থা জানা সম্ভব। অর্থাৎ মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি পূর্বনির্দিষ্ট।

কোয়ান্টাম তত্ত্ব এই নিয়তিবাদের সম্পূর্ণ বিপরীতে যায়। কার্য-কারণ সম্পর্ককে সে অস্বীকার করে না, কিন্তু যে কোনো ঘটনার একটাই ফল হতে পারে, সেই কথাকে ভুল প্রমাণ করে সে নিয়তিবাদের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়েছে। লাপ্লাসের যুক্তি সম্পর্কে বলতে পারি যে মহাবিশ্বের সমস্ত পরমাণুর অবস্থান ও ভরবেগ জানা সম্ভব নয়; কিন্তু তার কারণ এই নয় যে তা আমাদের ক্ষমতাতীত। বস্তুতপক্ষে কোনো কণার অবস্থান বা ভরবেগ পর্যবেক্ষক-নিরপেক্ষভাবে নির্দিষ্ট নয়। ধরা যাক আমি কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে কোনো কণার অবস্থান মাপলাম, তাহলে তা নির্দিষ্ট। কিন্তু না মাপলে তা যে শুধু আমরা জানি না তা নয়; আসলে কণাটার কোনো নির্দিষ্ট অবস্থানই নেই। কণাটার একই সঙ্গে নানা অবস্থান থাকতে পারে, এবং সেই প্রতিটি অবস্থানের একটি সম্ভাবনা (Probability) আছে। শুনলে আশ্চর্য মনে হতে পারে, কিন্তু বহুবার নানা পরীক্ষা দেখিয়েছে যে এটাই সত্য। বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে অণু-পরমাণুর জগতে প্রয়োগ করতে গেলে সাবধান থাকতে হয়। এই লেখার শেষে বোস সংখ্যায়ন আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা আবার ফিরে আসব।

বিষয়টা জটিল মনে হলে একটা উদাহরণের সাহায্যে স্পষ্ট করা যাক। একটি পর্দায় দুটি ছিদ্র আছে, আমাদের কাছে একটি ইলেকট্রনের উৎস আছে যা থেকে ওই পর্দার দিকে ইলেকট্রন পাঠাচ্ছি। সাধারণ বুদ্ধি বলবে যে ইলেকট্রন যে কোনো একটি ছিদ্র দিয়ে যাবে। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলে যে আমরা যদি ইলেকট্রন কোন ছিদ্র দিয়ে যাচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ না করি, তাহলে ধরে নিতে হবে একই ইলেকট্রন একই সঙ্গে দুটি ছিদ্র দিয়েই যাবে, এবং প্রতিটি ছিদ্র দিয়ে যাওয়ার একটি নির্দিষ্ট সম্ভাবনা আছে। পর্দার পিছনে রাখা ফটোগ্রাফিক প্লেটে ইলেকট্রন যে চিহ্ন রেখে যায়, তাকে অন্য কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

কোয়ান্টাম জগতের বাস্তবতা সম্পর্কে এই ধারণা একবারে আসেনি, ১৯০০ সাল থেকে শুরু করে সওয়া শতাব্দীব্যাপী নানা গবেষণা ধীরে ধীরে বিজ্ঞানীদের এই পথে নিয়ে গেছে। অনেক বিজ্ঞানীই প্রথমে একে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না, আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানী জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একে বিশ্বাস করেননি। কোয়ান্টাম তত্ত্বকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ১৯০০ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত সময়কে আমরা বলি প্রাচীন কোয়ান্টাম তত্ত্বের যুগ, তারপর শুরু হয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কাল। এই দ্বিতীয় যুগ নিয়ে এই লেখাতে বিশেষ আলোচনা থাকবে না। প্রথম অর্থাৎ প্রাচীন কোয়ান্টাম তত্ত্বের যুগের চারটি মূল স্তম্ভ হল প্লাঙ্কের কৃষ্ণ বস্তু বিকিরণের তত্ত্ব, আইনস্টাইন কর্তৃক আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা, বোরের হাইড্রোজেন পরমাণুর মডেল এবং বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান। এর মধ্যে চতুর্থটির শতবর্ষ আগতপ্রায়, এই লেখাতে আমরা মূলত সেটি নিয়ে আলোচনা করব; কিন্তু তার জন্য আমাদের কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ সংক্রান্ত প্লাঙ্কের তত্ত্ব সম্পর্কে জানা দরকার।

কৃষ্ণ বস্তু (Black body) কাকে বলে? খুব সহজ কথায়, যে বস্তু তার উপরে পড়া সমস্ত তড়িৎচৌম্বক রশ্মি বা বিকিরণ সম্পূর্ণ ভাবে শোষণ করে তাকে বলে কৃষ্ণ বস্তু। এই কৃষ্ণ বস্তুকে উত্তপ্ত করলে তার থেকে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ বিকিরিত হয়। এই বিকিরণকে বলে সাম্যাবস্থার বিকিরণ, অর্থাৎ বস্তু ও বিকিরণ পরস্পরের সঙ্গে সাম্যাবস্থায় আছে; এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কোন দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ কত পরিমাণ বিকিরণ হবে তাপগতিবিদ্যার সূত্র থেকে তা খুব নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।

পরীক্ষাগারে কিন্তু কৃষ্ণ বস্তু থেকে বিকিরণ মাপতে গিয়ে সমস্যা দেখা দিল। অপেক্ষাকৃত বেশি দৈর্ঘ্যের তরঙ্গের জন্য হিসাবটা মিললেও কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জন্য তাপগতিবিদ্যা একেবারেই কাজ করল না। তত্ত্ব বলছিল তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কম হবে বিকিরণের পরিমাণ তত বেশি হবে। মেপে দেখা গেল তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একটা নির্দিষ্ট মানের নিচে দৈর্ঘ্য যত কমে বিকিরণের পরিমাণ তত বাড়ে। কিন্তু ঐ নির্দিষ্ট মানের নিচে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যত কমে, বিকিরণের পরিমাণও তত কমে। এ এক অদ্ভুত সমস্যা। তাপগতিবিদ্যার কৃষ্ণ বস্তু সংক্রান্ত সূত্রটি পরিসংখ্যানগত বলবিদ্যার দৃঢ়ভিত্তির উপর নির্মিত। আবার অপর এক সূত্র কম দৈর্ঘ্যের তরঙ্গের জন্য কাজ করলেও বেশি দৈর্ঘ্যের বিকিরণোকে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারছিল না। কোনো একটা মূল জায়গায় ভুল হচ্ছে, কিন্তু কোথায়? ভুলটা ধরালেন মাক্স প্লাঙ্ক। তাঁর পরিচিতরা কল্পনাও করতে পারতেন না যে বিজ্ঞানে রক্ষণশীল এই বিজ্ঞানী এক বিপ্লবের সূচনা করতে পারেন। প্লাঙ্ক সেই সময় কিভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন তার আলোচনাতে না গিয়ে এখন আমরা প্লাঙ্কের তত্ত্বকে কেমন ভাবে দেখি সে কথাই জানব।

পরিসংখ্যানগত বলবিদ্যা থেকে কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণের রাশিমালা নির্ণয় করেছিলেন লর্ড র‍্যালে ও জেমস জিন্স। খুব সংক্ষেপে তাঁদের ফলাফলটা দেখা যাক। তাঁরা একটি ঘনকাকার গহ্বরের মধ্যে বিকিরণের ঘনত্ব নির্ণয় করছিলেন। গহ্বরের মধ্যে সেই বিকিরণগুলিই থাকবে যারা গহ্বরের দেয়াল দ্বারা শোষিত হবে না, এগুলিকে বলে স্থানু তরঙ্গ। তাঁরা দেখালেন যে n কম্পাঙ্কের সেইরকম স্থানু তরঙ্গের ঘনত্ব, অর্থাৎ প্রতি একক আয়তনে স্থানু তরঙ্গের সংখ্যা, হল 8πn2/c31 এখানে ধরে নেওয়া হয়েছে যে দুই সমবর্তনের2 জন্য দুই রকমের স্থানু তরঙ্গ আছে; পরে আবার আমরা এই কথায় ফিরে আসব। গহ্বরের তাপমাত্রা T হলে চিরায়ত পদার্থবিদ্যার নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি স্থানু তরঙ্গের গড় শক্তি kT। এখানে k হল বোলজ্‌ম্যানের ধ্রুবক, এবং T-কে চরম তাপমাত্রার স্কেলে প্রকাশ করা হয়। সুতরাং n কম্পাঙ্কের জন্য বিকিরণের শক্তির ঘনত্ব হল 8πn2kT/c3। কিন্তু এই নিয়মটি উচ্চ কম্পাঙ্কের জন্য পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মেলানো সম্ভব নয়। একটা সমস্যা সহজেই বোঝা যায় উপরের রাশিমালাটির থেকে দেখা যাচ্ছে কম্পাঙ্ক n যত বাড়ছে, শক্তির ঘনত্ব তত বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে তো শক্তির সীমাপরিসীমা থাকছে না, অসীম কম্পাঙ্কের আলো অসীম পরিমাণ শক্তি নিয়ে নির্গত হবে যা একেবারেই অবাস্তব। দৃশ্য আলোর থেকে উচ্চ কম্পাঙ্কের আলো অতিবেগুনি রশ্মির মধ্যে পড়ে, তাই এই সমস্যাকে বলা হত অতিবেগুনি বিপর্যয়।

এবার দেখা যাক প্লাঙ্ক কী করলেন। তরঙ্গের গড় শক্তি নির্ণয়ের সময় আমরা ধরে নিয়েছি যে আলোর তরঙ্গ যে কোনো পরিমাণ শক্তি নিয়ে আসতে পারে। সেই ধারণাই স্বাভাবিক। ধরুন শব্দ তরঙ্গের কথা। কেউ যখন কথা বলছেন, তিনি গলার জোর ইচ্ছামত বাড়াতে কমাতে পারেন। প্লাঙ্ক বললেন আলোর ক্ষেত্রে এই নিয়ম খাটবে না। তিনি দেখালেন আমরা যদি ধরে নিই যে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের শক্তি একটা নির্দিষ্ট মানের পূর্ণসংখ্যার গুণিতকে আসে তাহলে কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণের ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। যদি তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গের কম্পাঙ্ক n হয় তাহলে তার জন্য শক্তির ঐ ন্যুনতম মানের পরিমাণ হল hnএখানে h একটি ধ্রুবক; এখন আমরা বলি প্লাঙ্কের ধ্রুবক। শক্তির পরিমাণ এই ল্যূনতম মানের কেবল পূর্ণসংখ্যার গুণিতক হতে পারে, অর্থাৎ hn, 2hn, 5hn এমন হতে পারে, কিন্তু 1.7hn বা 3.59hn এমন হওয়া সম্ভব নয়।

প্লাঙ্ক স্থানু তরঙ্গের সংখ্যা বিষয়ে কোনো পরিবর্তন করলেন না, তিনি শুধু স্থানু তরঙ্গে গড় শক্তির বিষয়টিকে পাল্টালেন। আগে বলেছি গড় শক্তি হল kT, সেই গড়টা করার সময় ধরে নেওয়া হয়েছিল যে তরঙ্গ যে কোনো পরিমাণ শক্তি নিতে পারে। প্লাঙ্ক বললেন তা নয়, এরা একমাত্র nhnএই পরিমাণ শক্তি নিতে পারে। এখানে n-কে পূর্ণ সংখ্যা হতেই হবে। পরিসংখ্যানগত বলবিদ্যা থেকে বলা যায় যে nhn শক্তি থাকার সম্ভাবনা হল e-nhn/kT। তার থেকে প্লাঙ্ক দেখালেন যে স্থানু তরঙ্গের গড় শক্তি হল hn/(ehn/kT-1); অর্থাৎ বিকিরণের ঘনত্ব হল 8πn2´hn/(ehn/kT-1)/c3। এই রাশিমালাটি পরীক্ষার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গেল। বোঝা গেল যে শক্তি একটা নিদিষ্ট প্যাকেটের মাপে আসে। শক্তির পরিমাণ পূর্ণ সংখ্যায় প্যাকেটে পাওয়া যাবে, কিন্তু প্যাকেটকে ভাঙা যাবে না। প্লাঙ্ক এই প্যাকেটের নাম দিয়েছিলেন কোয়ান্টাম। আলোর কোয়ান্টামকে আধুনিক যুগে আমরা ফোটন বলে চিনি; সুবিধার জন্য আমরাও এখন থেকে তাই বলব, যদিও কথাটা চালু হয়েছে অনেক পরে। আলোকশক্তি যে ঐ রকম নির্দিষ্ট মাপের গুণিতকে আসে তা আগে বোঝা যায়নি কারণ ঐ নির্দিষ্ট মানটা খুবই ছোটো। একটা ১ ওয়াটের লাল এলইডি আলো থেকে প্রতি সেকেন্ডে মোটামুটি দু’লক্ষ কোটি ঐ রকম ফোটন বেরিয়ে আসে। তাই তার মধ্যে একটা বা দুটো কম বেশি হলে তা বুঝতে পারাই সহজ নয় তার পরে তো আসে ভগ্নাংশের কথা! তাই আমাদের মনে হতো যে শক্তির পরিমাণ যেমন খুশি হতে পারে - একটা নির্দিষ্ট মানের গুণিতক যে হতেই হবে, তা খেয়াল করা সহজ ছিল না।

আমরা প্লাঙ্কের তত্ত্বের আধুনিক রূপটি লিখেছি, কিন্তু প্লাঙ্ক নিজে কিছুটা অন্য ভাবে ব্যাখ্যাটা দিয়েছিলেন। তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে আলোকতরঙ্গের শক্তি প্রকৃতপক্ষে কিছু রেজোনেটর বা অনুনাদকের শক্তির সঙ্গে সমান। কৃষ্ণ বস্তুর দেওয়াল অনুনাদক হিসাবে কাজ করছে। এই প্রসঙ্গে আমরা ফিরে আসব।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের পরের দুটি স্তম্ভের পরিচয় দু-এক কথায় সীমাবদ্ধ রাখি। ধাতুর উপরে আলো ফেললে তার থেকে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে, একে বলে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন দেখালেন যে আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব এই ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে। ১৯১৩ সালে নিল্‌স বোর তাঁর পরমাণুর মডেল প্রকাশ করেছিলেন। তিনি দেখালেন যে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনেরা যে কোনো কক্ষপথে ঘুরছে না, তাদের নির্দিষ্ট কতকগুলি কক্ষপথ আছে, এই ধরে নিলে পরমাণু থেকে নির্গত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। সেই নির্দিষ্ট কক্ষপথগুলির কৌণিক ভরবেগের মান প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাঁদের গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ প্লাঙ্ক, আইনস্টাইন ও বোর যথাক্রমে ১৯১৮, ১৯২১ ও ১৯২২ সালের নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন।

আগেই বলেছি বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান হল কোয়ান্টাম তত্ত্বের চতুর্থ প্রধান স্তম্ভ। এটি প্রকাশের ঘটনা বেশ অভিনব। আইনস্টাইন ১৯২৪ সালে তিনি একটা চিঠি পেলেন। অবিভক্ত ভারতের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তরুণ বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস অবিভক্ত ভারতের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে ইংরাজিতে লেখা একটি প্রবন্ধ পাঠিয়েছেন। প্লাঙ্কের সূত্রের সীমাবদ্ধতা নিয়ে অনেকেই সচেতন ছিলেন, সেই কথায় আমরা পরে আসছি। সত্যেন্দ্রনাথ সেই সীমাবদ্ধতা দূর করে পরিসংখ্যানগত বলবিদ্যা থেকে প্লাঙ্কের সূত্র নির্ণয় করেছেন আইনস্টাইন যদি তা ছাপার ব্যবস্থা করেন। প্রবন্ধটির সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য বুঝতে পেরে আইনস্টাইন নিজে সেটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ছাপানোর ব্যবস্থা করেন।

এই বিখ্যাত প্রবন্ধটির জন্মের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের আরো একটু পিছিয়ে যেতে হবে। ১৯২৪ সালের মার্চ মাস নাগাদ সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু ও সহপাঠী মেঘনাদ সাহা ঢাকাতে পৈতৃক বাড়িতে এসেছিলেন; তিনি বন্ধুর বাড়িতে কয়েকদিন ছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে প্লাঙ্কের তত্ত্ব পড়ানোর সময় তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে চিন্তা করতেন, দুই বন্ধুর মধ্যে সেই বিষয়ে কথা হয়। এ বিষয়ে আইনস্টাইন, পল এহ্‌রেনফেস্ট, উলফগ্যাং পাউলির মতো বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্রগুলোর প্রতি সত্যেন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মেঘনাদ। এরপর সত্যেন্দ্রনাথ এ বিষয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করে একটি গবেষণাপত্র লিখেছিলেন। তিনি সেটিকে ব্রিটেনে ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তার ঠিক কী পরিণতি হয়েছিল জানা নেই। সম্ভবত নিজের কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন সত্যেন্দ্রনাথ সেটিকে অল্প দিন পরেই আইনস্টাইনের কাছে পাঠান।3

প্লাঙ্কের সূত্রের সীমাবদ্ধতা কী ছিল? তিনি স্থানু তরঙ্গের সংখ্যা গুনেছেন, তারপরে ধরে নিয়েছেন যে সেই স্থানু তরঙ্গের সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তির কোয়ান্টাম যুক্ত আছে। সমস্যা হল যে প্রথম ভাগের সঙ্গে দ্বিতীয় ভাগ সুসমঞ্জস নয়। আইনস্টাইনের ভাষায়, “If the energy of a resonator can alter only in jumps, then for the evaluation of the average energy of a resonator in a radiation cavity, the usual theory cannot be used, for the latter does not admit any distinctive energy values for a resonator.” সহজ কথায় বললে রেজোনেটর বা কোয়ান্টাম বা কণার সংখ্যা কেন স্থানু তরঙ্গের নিয়ম মেনে গোনা হবে? প্লাঙ্ক নিজেও এই সমস্যার কথা বুঝেছিলেন। পিটার ডিবাই, আইনস্টাইন, এহ্‌রেনফেস্ট, পাউলি অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সম্পূর্ণ সফলতা কেউই পাননি।

আইনস্টাইন অণুপরমাণু ও বিকিরণের আন্তঃপ্রতিক্রিয়া থেকে প্লাঙ্কের সূত্র নির্ণয় করার চেষ্টা করছিলেন। ই বিশেষ প্রবন্ধটি অন্য কারণে উল্লেখযোগ্য। আমরা সবাই লেজারের নাম শুনেছি। লেজার উদ্ভাবন হয়েছে গত শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধে, কিন্তু তার মূলে আছে ১৯১৭ সালে প্রকাশিত আলবার্ট আইনস্টাইনের এই গবেষণাপত্র। এর একটি ধারণার সঙ্গে সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথের কাজের সম্পর্ক আছে, তাই এখানে সামান্য আলোচনা করে নেয়া যাক। ধরা যাক একটা অণুতে দুটি শক্তি স্তর আছে। কোনো অণু যদি উপরের শক্তিস্তরে থাকে, তাহলে সে স্বাভাবিক ভাবেই নিচের শক্তিস্তরে আসতে চাইবে। অণুটি তখন একটি ফোটন ছাড়বে, একে বলে স্বতঃস্ফুর্ত নিঃসরণ (Spontaneous Emission)। আবার অণুটির উপর যদি এমন আলো ফেলা হয় যার ফোটনের শক্তি ঠিক দুই স্তরের শক্তির পার্থক্যের সমান, তাহলেও অণুটি উপরের শক্তিস্তর থেকে নিচের শক্তিস্তরে নেমে আসবে। এক বলে উদ্দীপিত নিঃসরণ (Stimulated emission)। তেমনি অন্য এক ঘটনা ঘটতে পারে। অণুটি যদি নিচের স্তরে থাকে, সে ওই আলোকে শোষণ করে উপরের স্তরে চলে যেতে পারে। এই ঘটনাকে বলে উদ্দীপিত শোষণ (Stimulated absorption)। উদ্দীপিত নিঃসরণ ও শোষণের সম্ভাবনা বাইরে থেকে যে আলো ফেলা হচ্ছে তার তীব্রতা (অন্যভাবে বললে ফোটনের ঘনত্বের) উপর নির্ভর করে। আইনস্টাইনের মতে স্বতঃস্ফুর্ত নিঃসরণের সম্ভাবনা কিন্তু বাইরের কোনো কিছুর উপর নির্ভর করে না, এ হল অণুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সাম্যাবস্থায় মোট শোষণের পরিমাণ দুইরকম নিঃসরণের পরিমাণের যোগফলের সমান, সেই থেকে আইনস্টাইন প্লাঙ্কের সূত্র নির্ণয় করেছিলেন, কিন্তু সেখানেও তাঁকে তরঙ্গ সংক্রান্ত একটি সূত্র ব্যবহার করতে হয়েছিল।

এবার আসি সত্যেন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গবেষণাপত্রটির কথায়। তার শুরুতেই প্লাঙ্কের সূত্রের অসম্পূর্ণতার কথা আছে। তিনি লিখছেন, “এই গুণকটি4 একমাত্র প্রাচীন তড়িৎচুম্বক তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায়। এই অংশটি মোটেই সন্তোষজনক নয়।”5 আমরা এখন পিছন দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি যে আইনস্টাইনসহ কেউই তখনো পর্যন্ত ফোটনকে পুরোপুরি কণা হিসাবে চিন্তা করতে পারছিলেন না, সেটাই ছিল প্লাঙ্কের সূত্র সুসমঞ্জসভাবে নির্ণয় করার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা। সত্যেন্দ্রনাথের অঙ্কে তরঙ্গের প্রায় কোন উল্লেখই নেই (একটি ক্ষেত্র ছাড়া, যার কথা পরে আসবে); তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে আলো কোয়ান্টাম কণার সমষ্টি, সেই সমস্ত কণাদের নির্দিষ্ট শক্তি ও ভরবেগ আছে। কোনো নির্দিষ্ট শক্তিসম্পন্ন কতগুলি কণা সর্বমোট কতগুলি থাকতে পারে তিনি অঙ্ক কষে বার করলেন। এর জন্য তাঁকে ধরে নিতে হয়েছিল যে ওই কণার ভরবেগও প্লাঙ্কের ধ্রুবকের পূর্ণ গুণিতক হতে হবে। তিনি লিখছেন, “নির্দিষ্ট আয়তনের মধ্যে আবদ্ধ আলোককণার দশা-নির্দেশক ছককে ছোট ছোট ঘরে ভাঙা যায়, প্রত্যেক ঘরের ঘন h3।” সত্যেন্দ্রনাথের আগেও কেউ কেউ এই রকম ঘরে ভাগ করার কথা বলেছিলেন, অবশ্য আলো নয়, বস্তুকণার জন্য; কিন্তু তার পিছনের কারণ তখন বোঝা সম্ভব ছিল না। কয়েকবছর পরে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আবিষ্কারের পরে বিষয়টি বোঝা যাবে। সত্যেন্দ্রনাথের ভাষায়, “এই বিভাগ পদ্ধতি সম্পর্কে সুনিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে ঘরগুলির মোট সংখ্যা হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট আয়তনের মধ্যে একটি কণাকে আবদ্ধ করে রাখার যত রকমের উপায় আছে তাদেরই সংখ্যা।” এভাবে তিনি মোট ঘরের সংখ্যা নির্ণয় করলেন যেখানে কণাগুলি রাখা সম্ভব।

এরপর সত্যেন্দ্রনাথ নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক কণা কতভাবে ওই ঘরগুলির মধ্যে ছড়িয়ে রাখা যায় তার সংখ্যা বার করলেন। স্পষ্টভাবে না লিখলেও এই গোণার মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল ফোটন কণার ভেদহীনতার (Indistinguishibility) কথা; দু’টি সমশক্তির ফোটনের মধ্যে পার্থক্য করা সম্ভব নয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। দু’টি খোপ আছে, আর আমার হাতে আছে দুটো অবিকল একরকম বল। একটি খোপে একটি বল, এইভাবে রাখলে মোট দু’ভাবে সাজানো সম্ভব। বলের জায়গায় যদি ফোটন বা অন্য কোনো মৌলিক কণার কথা ভাবি, সেক্ষেত্রে কোয়ান্টাম তত্ত্ব কিন্তু অন্য কথা বলছে। কণারা ভেদহীন, সুতরাং দুইরকম সজ্জার মধ্যে পার্থক্য করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য সজ্জার সংখ্যা হল এক। বিভিন্ন সজ্জার প্রবাবিলিটি বা সম্ভাবনা আলাদা আলাদা, তাহলে কোন শক্তির সম্ভাবনা কত, তাই ধরে সত্যেন্দ্রনাথ কৃষ্ণ বস্তুর শক্তির ঘনত্ব বার করলেন। দেখা গেল যে সেটি প্লাঙ্কের সূত্রের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। শুধুমাত্র পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে সত্যেন্দ্রনাথ প্লাঙ্কের সূত্র প্রমাণ করলেন। এই হল কোয়ান্টাম তত্ত্বে পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রথম প্রয়োগ। আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথের সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে প্রবন্ধটি শেষে লিখে দিয়েছিলেন, “আমার মতে বসুর প্রমাণটি গুরুত্বপূর্ণ প্রগতির সূচনা করছে।”

ভেদহীনতা আবার এক কোয়ান্টাম ধর্ম, আমাদের সাধারণ জীবনে তার তুলনীয় কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। এর তাৎপর্যটা আরো গভীর। আমি যদি বলগুলিকে আলাদা করে চিনতে নাও পারি, এক নম্বর বলটা কোনো এক নির্দিষ্ট মুহূর্তে একটি খোপেই থাকবে, দু’নম্বর বলটাও তাই। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুযায়ী আমি যদি খোপে কী আছে তা পর্যবেক্ষণ না করি, তাহলে ধরে নিতে হবে একটি ফোটন একই সঙ্গে দু’টি খোপেই আছে, তবেই একমাত্র পরীক্ষার ফল ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ক্রিকেট বলের ক্ষেত্রে অবশ্যই তা সত্য নয়, কিন্তু বহু পরীক্ষা দেখায় যে শুধু ফোটন নয়, যে কোনো মৌলিক কণার ক্ষেত্রে তা অবশ্যই সত্য।

সত্যেন্দ্রনাথ কেন কণাদের ভেদহীনতার তাঁর সেই গবেষণাপত্রে স্পষ্টভাবে লেখেননি তাই নিয়ে অনেকেই আলোচনা করেছেন। চঞ্চলকুমার মজুমদার লিখেছেন, “প্রকৃত প্রস্তাবে সমধর্মী এককের সমষ্টির উপরেই পরিসংখ্যান প্রয়োগ করা সম্ভব একথা প্রাচীন তত্ত্বের জানা ছিল।” সত্যেন্দ্রনাথের ছাত্র বিজ্ঞানী পার্থ ঘোষ লিখেছেন, “Contrary to popular belief, therefore, the indistinguishability of the quanta had already been tacitly assumed by Planck and Debye and this was first noticed by Natanson already in 1911.” ১৯১১ সালে লাদিস্লাস নাটানসন দেখিয়েছিলেন প্লাঙ্কের সূত্রের সঙ্গে কণার ভেদহীনতার সম্পর্ক আছে। তবে সেটি অবশ্যই সুপরিচিত ছিল না, কারণ কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম আবিষ্কারক এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার বোস সংখ্যায়ন বিষয়ে আইনস্টাইনের গবেষণাপত্র পড়ে তাঁকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন যে তাঁর অঙ্কে একটা প্রাথমিক ভুল আছে। আইনস্টাইন তাঁকে চিঠিতে যত্ন করে বিষয়টির গুরুত্ব বোঝান। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তরঙ্গ সমীকরণ আবিষ্কারের পিছনে আইনস্টাইন ও শ্রয়ডিঙ্গারের সেই আলোচনার একটা বড় ভূমিকা আছে।

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণাপত্রের মধ্যে নিহিত। প্লাঙ্কের সূত্র আবিষ্কারের পরেই প্রশ্ন ওঠে এটা কি বিকিরণের নিজস্ব চরিত্র, না কি বস্তুর সঙ্গে বিকিরণের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া এই বিশেষ ধর্মের জন্য দায়ী? আমরা দেখেছি যে প্লাঙ্ক কতকগুলি রেজোনেটর বা অনুনাদকের কথা বলেছিলেন, কিন্তু তাদের কী কোনো প্রয়োজন আছে? এই প্রশ্নের প্রথম উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন আইনস্টাইন, তারপরে পিটার ডিবাই। কিন্তু কারো উত্তরই সন্তোষজনক হয়নি। যেমন আমরা দেখেছি আইনস্টাইন প্লাঙ্কের সূত্র নির্ণয় করতে গিয়ে অণুর শক্তিস্তর ও আলোর শোষণ ও নিঃসরণের কথা বলেছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে অণু ও বিকিরণের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার ভূমিকা আছে। সত্যেন্দ্রনাথকে কৃষ্ণ বস্তু কর্তৃক আলোর শোষণ বা বিকিরণ কিছুই ধরতে হয়নি, অর্থাৎ তিনি দেখালেন এটি বিকিরণের নিজস্ব চরিত্র, বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কবিহীন ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।

পরবর্তীকালে দেখা গেছে শুধু ফোটন নয়, ইলেকট্রন প্রোটন ইত্যাদি সমস্ত সমধর্মী মৌলিক কণাই ভেদহীন। আইনস্টাইন বোসের সূত্রের ভেদহীনতাকে সামনে আনেন। ফোটনের স্থিরভর শূন্য, সত্যেন্দ্রনাথ কেবল তাদের জন্য অঙ্কটা কষেছিলেন। আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথের পদ্ধতিকে ভরযুক্ত কণাদের জন্য কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে তা দেখান। সেজন্যই সাধারণত বোস সংখ্যায়নকে বলা হয় বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন। যে সমস্ত কণা এই পরিসংখ্যান মেনে চলে তাদের নাম দেওয়া হয়েছে বোসন। সমস্ত মৌলিক কণা বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন অথবা ফের্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন এই দু রকমের কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের যে কোনো একটি মেনে চলে। দ্বিতীয়টির আবিষ্কার হয়েছিল ১৯২৬ সালে। বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়নই হল প্রথম কোয়ান্টাম পরিসংখ্যান। সত্যেন্দ্রনাথকেই তাই কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের জনক বলে মানা হয়। এই দুটি কোয়ান্টাম সংখ্যায়নের মধ্যে পার্থক্য কী? সত্যেন্দ্রনাথ যে ছোট ছোট ঘরের কথা বলেছিলেন, বোস সংখ্যায়নে তার যে কোনো ঘরে যতগুলি খুশি কণা থাকতে পারে। ফের্মি-ডিরাক সংখ্যায়নে একটি ঘরে একটির বেশি কণা থাকা সম্ভব নয়।

এখানে খুব সংক্ষেপে আরো একটি বিষয়ের উল্লেখ করা যাক, তা হল বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন। একে অনেক সময় আমরা পদার্থের পঞ্চম অবস্থা বলি, একমাত্র ভরযুক্ত কণাদের জন্যই এই ঘনীভবন সম্ভব। আগেই বলেছি যে কোনো বিশেষে শক্তিস্তরে কতগুলি বোসন থাকবে তার কোনো সীমা নেই। অতি শীতল তাপমাত্রাতে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান প্রয়োগ করলে দেখা যায় প্রায় সমস্ত বোসনই নিচের শক্তিস্তরে থাকবে। পরীক্ষাগারে বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন তৈরি করার জন্য উলগ্যাং কেটার্লে, এরিক কর্নেল ও কার্ল ওয়াইম্যানকে পদার্থবিদ্যাতে ২০০১ সালের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। আমরা তাঁদের পরীক্ষাগুলির বিশদ আলোচনাতে যাচ্ছি না। তাঁরা গ্যাসের অণুগুলিকে এত ঠাণ্ডা করেন যে সবগুলিই নিচের শক্তিস্তরে চলে যায়। এই বিষয়টি কিন্তু চিরায়ত পদার্থবিদ্যার থেকে আলাদা; ওই নির্দিষ্ট তাপমাত্রাতে চিরায়ত পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী যতগুলি গ্যাসের অণু একেবারে নিচের শক্তিস্তরে থাকবে, বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেই সংখ্যাটা অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, সবগুলি অণু মিলে একটি কোয়ান্টাম তন্ত্র গঠন করে।

একটু আগে মন্তব্য করেছি যে সত্যেন্দ্রনাথ তরঙ্গের কথা প্রায় ধরেননি। সত্যেন্দ্রনাথের প্রকাশিত প্রবন্ধের এক জায়গায় লেখা আছে যে আলোকতরঙ্গের দুইরকম সমবর্তনের জন্য স্থানুতরঙ্গের সংখ্যাকে দুই দিয়ে গুণ করা হল। সত্যেন্দ্রনাথ কিন্তু আসলে সে কথা লেখেননি। আগেই বলেছি যে আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথের প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ পরে বলেছিলেন যে তিনি লিখেছিলেন ফোটন কণার ঘূর্ণন বা স্পিন আছে, তা উপর বা নিচ দুই দিকে মুখ করে ঘুরতে পারে, সে জন্য দুই দিয়ে গুণ করেছিলেন। স্পিনের কথা তখন কারো জানা ছিল না, আইনস্টাইন সে জন্য অনুবাদের সময় লেখাটা পাল্টে দিয়েছিলেন। তার অল্পদিন পরে মৌলিক কণার ঘূর্ণন প্রস্তাবিত হয়েছিল। এখন আমরা জানি যে এই ঘূর্ণনও মৌলিক কণাদের এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম, তবে সেটিকে চিরায়ত পদার্থবিদ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, অর্থাৎ কণারা তার অক্ষের চারপাশে পাক খাচ্ছে এমন কথা বলার কোনো অর্থ নেই। কোন কণা বোস-আইনস্টাইন আর কোন কণা ফের্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান মেনে চলবে, তা ওই কণার স্পিনের উপর নির্ভর করে।

সব মিলিয়ে সত্যেন্দ্রনাথের এই গবেষণাটি একটি অসাধারণ কাজ। এর পরেই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্ম হয়; কোয়ান্টাম তত্ত্বের নানা রকম পরস্পর বিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণকে এক সূত্রে বাঁধা সম্ভব হয়। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার দুটি রূপ আছে। প্রথমটি প্রকাশ করেন ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। দ্বিতীয়টির রূপ দেন এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার, পরের বছর মার্চ মাসে তিনি তাঁর বিখ্যাত তরঙ্গ সমীকরণ্টি প্রকাশ করেন। সত্যেন্দ্রনাথের চিঠি যে ঘটনাক্রমের সূচনা করেছিল, তারই ফলে শেষ পর্যন্ত শ্রয়ডিঙ্গার সমীকরণটি আবিষ্কার করেছিলেন। সেই ইতিহাস আমরা খুব সংক্ষেপে দেখে নেব।

আমরা দেখেছি যে আইনস্টাইন ও প্লাঙ্ক, এবং পরবর্তীকালে সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণা থেকে সেখা গেল আলোতরঙ্গের কণিকা ধর্ম আছে। তরুণ ফরাসি বিজ্ঞানী লুই দ্য ব্রয়লি ১৯২৩ সালে একটা আরো অদ্ভুত কথা বললেন। তাঁর মতে আলোর যেমন কণিকা ধর্ম আছে, ঠিক তেমনি সমস্ত কণিকারও তরঙ্গ ধর্ম আছে। শুধু কণা নয়, সমস্ত বস্তুরই তরঙ্গ ধর্ম আছে, কিন্তু আমরা সেটা দেখতে বা মাপতে পারি না। একমাত্র খুব কম ভরের বস্তুর জন্য সেটা দেখা যাবে। ১৯২৪ সালে তিনি ডক্টরেটের জন্য থিসিস জমা দেন। দ্য ব্রয়লির স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় যে একজন পরীক্ষক পিয়ের লাঁজেভা তাঁর থিসিসটির বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন, তাঁর পরামর্শে দ্য ব্রয়লি থিসিসের একটি কপি আইনস্টাইনকে পাঠিয়ে দেন। আইনস্টাইন সেটি পড়ে লাজেভাঁকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯২৪ লেখা এক চিঠিতে কাজটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।

আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথের সূত্রকে ভরযুক্ত কণিকার জন্য ব্যবহারের উপযোগী করেছিলেন, সেই নিয়ে তিনি পরপর তিনটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত চিঠিটি পাঠান ১৯২৪ সালের ২ জুন, আইনস্টাইন তাঁকে উত্তর দেন ২ জুলাই, সেদিনই তিনি প্রবন্ধটি প্রকাশের জন্য জমা দেন। এরপর ১০ জুলাই প্রুশিয়ান আকাডেমি তিনি এ বিষয়ে তাঁর প্রথম গবেষণাপত্রটি পাঠ করেন। খুব সম্ভবত এর পরে তিনি দি ব্রয়লির থিসিসটি হাতে পান। পরের জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখে তিনি দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটি পাঠ করেন এবং সেখানে নতুন সংখ্যায়ন এবং দ্য ব্রয়লির কণাতরঙ্গ, এই দুইকেই ব্যবহার করেন। এই লেখাটি পড়েই দ্য ব্রয়লির কাজের প্রতি শ্রয়ডিঙ্গারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল, এবং শেষ পর্যন্ত তার থেকেই তিনি কণাতরঙ্গের জন্য একটি সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করেন, যাকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার দ্বিতীয় জন্ম বলা যায়। যদিও হাইজেনবার্গ আগে তাঁর ম্যাট্রিক্স বলবিদ্যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু শ্রয়ডিঙ্গারের সমীকরণের পরই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিষয়টি কিছুটা বোধগম্য হয়। দ্য ব্রয়লির থিসিস শ্রয়ডিঙ্গার কবে প্রথম দেখেছিলেন তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী মতামত আছে। তবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্মে আইনস্টাইনের এই দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটির ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ নেই, কারণ শ্রয়ডিঙ্গার আইনস্টাইনকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন সেটি তাঁর চোখে না পড়লে তিনি এ বিষয়ে চিন্তাভাবনাই শুরু করতেন না।

সত্যেন্দ্রনাথ কিন্তু তিনি যে এক সম্পূর্ণ নতুন সংখ্যায়ন সৃষ্টি করেছেন সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন না, পরে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা তিনি নিজেই বলেছিলেন। আইনস্টাইনও প্রথমে সে কথা বোঝেন নি, তাঁর ১০ জুলাইয়ের বক্তৃতাতে তার কোনো উল্লেখ নেই। এটা যে এক সম্পূর্ণ নতুন গণনা পদ্ধতি, সে কথা জানুয়ারি মাসের বক্তৃতাতে তিনি প্রথম বলেছিলেন। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, নতুন অনেক আবিষ্কারের ক্ষেত্রেই এই ধরনের ঘটনা ঘটে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের ক্ষেত্রে তা আরো সত্যি।

প্রথম প্রবন্ধ পাঠানোর এগারো দিন পরেই সত্যেন্দ্রনাথ আইনস্টাইনকে ফোটন ও পরমাণুর পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া নিয়ে আরো একটি প্রবন্ধ পাঠান। সেখানে তিনি ফোটনদের ক্ষেত্রে নতুন সংখ্যায়নটির প্রয়োগ করেছিলেন, তবে পরমাণুরা সাধারন পদার্থবিদ্যার নিয়ম মেনে চলে। তার থেকে তিনি আইনস্টাইনের স্বতঃস্ফুর্ত ও উদ্দীপিত বিকিরণ ও উদ্দীপিত শোষণের সম্পর্কটি নির্ণয় করেছিলেন। আইনস্টাইনের মূল গবেষণাপত্রে তরংপ সংক্রান্ত যে সমস্ত অনুমান করার প্রয়োজন হয়েছিল, সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর আগের গবেষণাপত্র থেকে দেখিয়েছিলেন সেগুলির প্রয়োজন নেই। এর পরে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেন যে উদ্দীপিত বিকিরণের কোনো প্রয়োজন নেই। সেটিও আইনস্টাইন অনুবাদ করে ছাপিয়েছিলেন, যদিও গবেষণাপত্রের শেষে সংযোজিত এক মন্তব্যে এই শেষ বিষয়টি সম্পর্কে সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। পরে তাঁকে এক চিঠিতেও তিনি আপত্তির কারণগুলি জানিয়েছিলেন।

সত্যেন্দ্রনাথের জীবনী যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন তিনি ফ্রান্স থেকে আইনস্টাইনকে তৃতীয় একটি প্রবন্ধ পাঠিয়েছিলেন। আইনস্টাইনের পূর্বোল্লিখিত চিঠি পাওয়ার পরে তাঁর চিন্তার ফসল ছিল এই প্রবন্ধটি। অল্প দিন পরে যখন তিনি বার্লিনে আইনস্টাইনের কাছে যান, তাঁদের দুজনের এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু আইনস্টাইন তার সিদ্ধান্তগুলি মেনে নেননি। ফলে সত্যেন্দ্রনাথ সেটি ছাপাননি, তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাঁদের মধ্যের চিঠিপত্র ও পরে সত্যেন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণ থেকে এই বিষয়ে কিছু অনুমান করা যায়। গবেষণাপত্রটির সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ যে চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন সেখানে তিনি লিখেছিলেন, “But the additional hypothesis of a spontaneous change, independent of the state of the field, seems to me not necessary...”, অর্থাৎ স্বতঃস্ফুর্ত নিঃসরণকে আলাদা করে বিবেচনা করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা দেখেছি আইনস্টাইন ধরেছিলেন স্বতঃস্ফুর্ত নিঃসরণের বাইরের বিকিরণের কোনো সম্পর্ক নেই, এটি পুরোপুরি ঐ শক্তিস্তরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বার্লিনে আলোচনার সময় তিনি সত্যেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন যদি ব্রহ্মাণ্ডে আর কিছু না থাকে, শুধুমাত্র একটি হাইড্রোজেন পরমাণু থাকে, তাহলে তা যদি উপরের শক্তিস্তরে থাকে, বাইরে থেকে বিকিরণ না থাকলেও তা নিশ্চয় স্বতঃস্ফুর্ত বিকিরণের মাধ্যমে নিচের স্তরে নেমে আসবে। সত্যেন্দ্রনাথ তা মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি মনে করেছিলেন যে এইরকম অবাস্তব পরিস্থিতির কল্পনা করা অর্থহীন। সেই মুহূর্তে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত করা সম্ভব ছিল না; কিন্তু পরবর্তীকালে কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডায়নামিক্স দেখিয়েছে যে শূন্যস্থান বা ভ্যাকুয়াম আসলে শূন্য নয়, সেখানে প্রতিমুহূর্তে ফোটন সহ বহু নতুন কণা সৃষ্টি ও ধ্বংস হচ্ছে। এদের বলে ভার্চুয়াল কণা। স্বতঃস্ফুর্ত বিকিরণকে আর সঠিক অর্থে স্বতঃফুর্ত বলা যায় না, কারণ আইনস্টাইনের উদাহরণের মহাবিশ্বে একটি মাত্র পরমাণু থাকলেও সে ওই ভার্চুয়াল ফোটনের সঙ্গে ক্রিয়া করতেই পারে। বাস্তবে স্বতঃস্ফুর্ত নিঃসরণের হারও পরিবর্তন করা সম্ভব হয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ যখন সেই গবেষণাপত্রটি লিখেছিলেন, তখন এর কিছুই জানা ছিল না, কিন্তু তাঁর অনুমান সম্ভবত সঠিক পথে যাচ্ছিল।

আমরা দেখলাম কোয়ান্টাম তত্ত্ব যে বাস্তবতার কথা বলে, সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণা তার ভিত্তি স্থাপনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। এমনকি সম্ভবত কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডায়নামিক্সের কোনো কোনো ধারণার বীজ তাঁর মনে এসেছিল। তাঁর গবেষণার গুরুত্বের একটা পরিচয় দিই। রাশিয়ান বিজ্ঞানী লেভ লান্দাউ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের প্রতিভা অনুসারে সাজিয়েছিলেন। সেই তালিকার এক ও দুই নম্বরে ছিলেন আইজ্যাক নিউটন ও আইনস্টাইন। তার পরের ধাপে ছিলেন ছজন। তাঁদের মধ্যে নিল্‌স বোরের কথা আমাদের লেখাতে এসেছে। এই ধাপেই আছেন ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার এবং পল ডিরাক যাঁরা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সমীকরণগুলি আবিষ্কার করেছিলেন।আড় আছেন ইউজিন উইগনার, তিনি কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতে সিমেট্রি বা প্রতিসাম্যের গুরুত্ব দেখিয়েছিলেন। এই ধাপের ষষ্ঠ নামটি হল সত্যেন্দ্রনাথ বোস। তাঁর কৃতিত্বের বিষয়ে লান্দাউ সচেতন ছিলেন। ১৯৬২ সালে লান্দাউ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, নোবেল কমিটি বিশেষ করে তরল হিলিয়ামের ধর্ম বিষয়ে তাঁর গবেষণার কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেই ধর্ম ব্যাখ্যা করতে তাঁকে সাহায্য করেছিল সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণা।


তথ্যসূত্রঃ

  • বসু পরিসংখ্যান, চঞ্চলকুমার মজুমদার, প্রেসিডেন্সি কলেজ পত্রিকা, ১৯৭৪

  • Bose Statistics: A Historical Perspective, Partha Ghose, “S.N. Bose: The Man and His Works, Part I: Collected Scientific Papers, Editors C.K. Majumdar, Partha Ghose, Enakshi Chatterjee, Samik Bandyopadhyay and Santimoy Chaterjee, S.N. Bose National Centre for Basic Sciences, 1994

  • Satyendranath Bose, Jagadish Mehra, Biographical Memoirs of the fellows of the Royal Society, 1975

  • সত্যেন বোস, গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়, খোয়াবনামা প্রান্তজনের কথা, ২০২১।


1এখানে c হল আলোর বেগ। আলো এক প্রকার তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য (l), কম্পাঙ্ক (n) ও বেগের মধ্যে সহজ সম্পর্ক হল c=ln

2তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের গতির অভিমুখের সঙ্গে তরঙ্গের কম্পনতল লম্বভাবে থাকে। এরকম দুটি পরস্পরনিরপেক্ষ লম্ব তল পাওয়া যায়, তাই দুই রকম তরঙ্গ সম্ভব। একে বলে তরঙ্গের সমবর্তন (Polarization)

3সত্যেন্দ্রনাথ প্রবন্ধটি যে ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে পাঠিয়েছিলেন তার পক্ষে সব থেকে বড় প্রমাণ হল যে এই বিষয়ে দ্বিতীয় একটি প্রবন্ধ এগারো দিন পরেই আইনস্টাইনকে পাঠিয়েছিলেন, আইনস্টাইন সেটিরও অনুবাদ করেন। সেটিতে প্রথম প্রবন্ধটির উল্লেখের সময় লেখা আছে যে সেটি ফিলোজফিক্যাল মযাগাজিনে প্রকাশিত হবে; আইনস্টাইন সেটি পরিবর্তন করতে ভুলে গিয়ছিলেন।

4 অর্থাৎ একক আয়তনে স্থানু তরঙ্গের সংখ্যা 8πn2/c3

5সত্যেন্দ্রনাথের ইংরাজিতে লেখা মূল গবেষণাপত্রটির সন্ধান পাওয়া যায় নি। সত্যেন্দ্রনাথ কোনো কপি রাখেননি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী চঞ্চলকুমার মজুমদার প্রকাশিত গবেষণাপত্রটিকে জার্মান থেকে বাংলাতে অনুবাদ করে ১৯৭৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ পত্রিকাতে প্রকাশ করেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণাপত্র থেকে উদ্ধৃতিগুলি সেই অনুবাদ থেকে গৃহীত। বানানের ক্ষেত্রে আধুনিক রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। 

(প্রকাশঃ আলোচনাচক্র পত্রিকা জানুয়ারি, ২০২৩) 

No comments:

Post a Comment