Sunday, 13 October 2024

কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা ও রসায়নবিদ এলিস বল

 

কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা ও রসায়নবিদ এলিস বল

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়




আজ তোমাদের এমন একজনের গল্প শোনাব, যিনি মারা গিয়েছিলেন মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে। তার অল্পদিন আগে তিনি কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসাতে এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অকালমৃত্যুর পরে অন্যরা তাঁর কাজকে নিজেদের বলে প্রকাশ করেন। কিন্তু সত্য চিরকাল চাপা থাকে না, তাই মৃত্যুর আশি বছরের বেশি পরে হলেও শেষ পর্যন্ত সঠিক মানুষই স্বীকৃতি পেয়েছেন।

যাঁর গল্প বলছি, তাঁর নাম এলিস অগুস্টা বল। এলিস ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ, তাঁর বাবা জেমস প্রেসলি বল ছিলেন উকিল, সম্পাদক এবং আলোকচিত্রগ্রাহক বা ফটোগ্রাফার। মা লরাও আলোকচিত্রীর কাজ করতেন। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে এলিস ছিলেন তৃতীয়, বড় দুই দাদার নাম উইলিয়াম ও রবার্ট, ছোট বোন অ্যাডি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন প্রদেশের সব থেকে বড় শহর সিয়াটলে ১৮৯২ সালের ২৪ জুলাই এলিসের জন্ম হয়েছিল।

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১২ সালে ফার্মাসিউটিকাল কেমিস্ট্রি বা ভেষজ রসায়ন নিয়ে স্নাতক হলেন এলিস। তার দু' বছর পরে হলেন ফার্মাসি বা ভেষজবিদ্যাতে স্নাতক। এই সময় জার্নাল অফ দি আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটিতে তিনি ও তাঁর শিক্ষক দশ পাতার এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেই সময় কোনো মহিলার পক্ষে গবেষণাপত্র ছাপানোই ছিল বিরল ঘটনা, এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার জন্য তা ছিল আরো অসাধারণ।

স্নাতক হওয়ার পরে মাস্টার্স করবেন ঠিক করলেন এলিস। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই তাঁকে ছাত্রী হিসাবে পেতে চেয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তিনি হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের হনলুলুতে কলেজ অফ হাওয়াই-এ ভর্তি হলেন। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ হল প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রদেশ। ছোটবেলাতে তাঁর পরিবার এক বছর হাওয়াইতে কাটিয়েছিলেন, সেই স্মৃতি থেকেই তিনি সেই কলেজকে বেছে নিয়েছিলেন। সেই কলেজ এখন হয়েছে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে মাস্টার্স করার সময় কাভা নামের একটি ভেষজ উদ্ভিদের শিকড়ে কী কী রাসায়নিক দ্রব্য থাকে তা গবেষণা করে আবিষ্কার করেন। কাভা মাথা যন্ত্রণা, উৎকণ্ঠা, বৃক্কের রোগ ইত্যাদির চিকিৎসাতে ব্যবহার হয়। এলিস হলেন হাওয়াই কলেজের প্রথম নারী ও প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মাস্টার্স। এর পরে তিনি সেখানেই পড়ানো শুরু করেন, এক্ষেত্রেও কৃষ্ণাঙ্গ ও নারী দুই ক্ষেত্রেই তিনি প্রথম।

কাভা বিষয়ে তাঁর চুয়াল্লিশ পাতার থিসিসটি হাওয়াই কুষ্ঠ চিকিৎসাকেন্দ্রের ডাক্তার হ্যারি হলমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তিনি এলিসের কাছে এক বিশেষ সমস্যার সমাধানের জন্য এলেন। সে কথায় যাওয়ার আগে সেই সময় কুষ্ঠ রোগীদের অবস্থা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। কুষ্ঠ রোগের বিশেষ কোনো চিকিৎসা ছিল না। ভীষণ সংক্রামক হওয়াতে সুপ্রাচীন কাল থেকেই কুষ্ঠ রোগীকে জনবসতি থেকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হত। তোমরা যদি বেন হুর সিনেমাটা দেখ তাহলে যীশু খ্রিস্টের সময় কুষ্ঠরোগীদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা হত জানতে পারবে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে আগে এই রোগ ছিল না, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমে সেই রোগ সেখানে যায়। ১৮৬৬ সাল থেকে হাওয়াইয়ের আদি অধিবাসীদের কুষ্ঠ হলে তাদের জোর করে এক দুর্গম উপদ্বীপ কালাউপাপাতে পাঠিয়ে দেওয়া হত, সেখানে শুধু কুষ্ঠরোগীরাই থাকত, কোনো কোনো সময় রোগীর আত্মীয়রাও তাদের সঙ্গে যেত। নৌকা ছাড়া কালাউপাপাতে যাওয়ার বিশেষ উপায় ছিল না, মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই থাকতে হত। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জ্যাক লন্ডন কালাউপাপা সম্পর্কে বলেছিলেন নরকের গহ্বর, পৃথিবীর সব থেকে অভিশপ্ত স্থান। ১৮৯০ সালে প্রায় ১১০০ মানুষ সেই উপদ্বীপে থাকতেন। শ্বেতাঙ্গদের ক্ষেত্রে অবশ্য অন্য ব্যবস্থা, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারত।

সেই যুগে কুষ্ঠ রোগের প্রধান ওষুধ ছিল চালমুগরার তেল। চিন বা ভারতে দীর্ঘদিন ধরে এই তেল চামড়ার রোগের চিকিৎসাতে ব্যবহার হত। ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক ফ্রেডরিক মোয়াট কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসার জন্য চালমুগরার কথা প্রথম পশ্চিমী ডাক্তারদের সামনে আনেন। মোয়াট তিরিশ বছর ভারতে ছিলেন, তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পড়িয়েছিলেন। ১৮৫৩ সালে তিনি কলকাতাতে এক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠান, যদিও সরকার সেই মুহূর্তে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

চালমুগরার তেল ব্যবহার করা ছিল প্রচণ্ড কঠিন। তা এতই বিস্বাদ ছিল যে খেলে বমি হয়ে যেত। প্রচণ্ড আঠালো বলে তা বাইরে থেকে লাগানো যেত না কারণ চামড়া তা শোষণ করে না। চালমুগরার তেল জলে দ্রাব্য নয়, ফলে ইঞ্জেকশন আকারে দিলে তা চামড়ার নিচে ফোস্কার মতো হয়ে থেকে যেত, ছড়িয়ে পড়ত না। হলমান এলিসকে এই সমস্যার সমাধানের অনুরোধ করেন।

এলিস দেখেন যে চালমুগরার তেলে আছে চালমুগরিক অ্যাসিড এবং হাইডনোকার্পিক অ্যাসিড। এবার তিনি তার থেকে জীবাণুনাশী ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো আলাদা করে তাদের এস্টার তৈরি করেন। এস্টারগুলো জলে দ্রাব্য, ফলে ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরে তা রক্তস্রোতের মাধ্যমে শরীরের অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে। দেখা গেল এস্টারে রূপান্তরের পরেও তাদের জীবাণুনাশী ক্ষমতার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

কিন্তু এই বিষয়টা প্রকাশের আগেই ১৯১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর এলিসের মৃত্যু হয়।অসুস্থতার জন্য কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে তিনি সিয়াটল ফিরে এসেছিলেন। কোন অসুখ তাঁর হয়েছিল তা নিয়ে সন্দেহ আছে। হাওয়াইয়ের এক খবরের কাগজে লেখা হয়েছিল যে গ্যাসমুখোশের কার্যকারিতা দেখানোর সময় তিনি দুর্ঘটনাবশত বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাসের কবলে পড়েন। সেই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল যেখানে অস্ত্র হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছিল, তাই গ্যাসমুখোশ কেমনভাবে ব্যবহার করা হয় সরকার থেকে সাধারণ মানুষকে তা শেখানো হচ্ছিল। হাওয়াই কলেজ অবশ্য দুর্ঘটনার কথা অস্বীকার করে। তাঁর ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসাবে যক্ষার কথা বলা হয়েছে।

এলিসকে চালমুগরার তেল বিষয়ে গবেষণাতে সাহায্য করছিলেন তাঁর কলেজের রসায়নের অধ্যাপক আর্থার ডিন। এলিসের মৃত্যুর পরে তিনি আর এক রসায়নের অধ্যাপক রিচার্ড রেনশ্যালের সঙ্গে চালমুগরার তেলকে ব্যবহার করার এই কায়দাকে ডিন পদ্ধতি নাম দিয়ে প্রকাশ করেন; সেখানে এলিস বলের কোনো উল্লেখই ছিল না। ডিন তার আগে বা পরে কখনোই ওষুধ নিয়ে কোনো কাজ করেননি।

এই নতুন পদ্ধতি খুবই ভালো কাজ করছিল। ১৯২০ সালে এক ডাক্তার রিপোর্ট করেন যে হাওয়াইতেই ৭৮ জন রোগীকে এই ভাবে ইঞ্জেকশন দিয়ে সুস্থ করা সম্ভব হয়েছে। ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে নতুন কোনো রুগীকে কালাউপাপাতে পাঠানো হয়নি। বস্তুত অ্যান্টিবায়োটিকের আগে পর্যন্ত এটি ছিল কুষ্ঠ রোগ চিকিৎসার প্রধান পদ্ধতি, অবশ্য সব সময় তাতে সাফল্য আসত না। কুষ্ঠ হয় যে জীবাণুর জন্য তার নাম মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি; সালফোন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পরে তার বিরুদ্ধে সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব হয়। আর্থার ডিন পরে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নাম রাখা হয়।

এলিস নিজের কথা বলার জন্য পৃথিবীতে ছিলেন না, কিন্তু ছিলেন হলমান। তিনি ১৯২২ সালে এক গবেষণাপত্রে সরাসরি বল পদ্ধতির কথা বলেন, এবং লেখেন ডিন পদ্ধতির সঙ্গে বল পদ্ধতির মূলগত কোনো তফাত নেই। তা সত্ত্বেও এলিস বলের কথা প্রায় সবাই ভুলে গিয়েছিল। এলিসের মৃত্যুর অনেক দশক পরে স্ট্যানলি আলি ও হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্যাথরিন টাকারা প্রায় কুড়ি বছর পরিশ্রম করে পুরানো কাগজপত্র খুঁজে প্রমাণ করেন যে এলিস বলই চালমুগরার তেলকে ব্যবহারের উপযোগী করেছিলেন।

২০০০ সালে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র চালমুগরা গাছের সামনে এলিসের স্মৃতিতে একটি ফলক বসিয়েছেন। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে ২৯ ফেব্রুয়ারিকে এলিস বল দিন হিসাবে পালন করা শুরু হয়, ২০২২ থেকে সেটি পালটে ২৮ ফেব্রুয়ারি করা হয়েছে। লন্ডন স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিন এন্ড হাইজিনের মূল ভবনের দেওয়ালে তাঁর নাম খোদাই করে রাখা হয়েছে। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা দাবি তুলেছে ডিন হলের নাম পরিবর্তন করে এলিস বল হল রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞরা একমত যে এলিস বল সেই যুগে যা করেছেন, অসাধারণ প্রতিভা না থাকলে তা সম্ভব নয়। কোনো সন্দেহ নেই যে সে যুগে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীর পক্ষে এই সাফল্য অর্জন ছিল আরো কঠিন কাজ। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে প্রয়াত হলেও তাঁর গবেষণা হাজার হাজার মানুষকে নরকযন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করেছে। 

প্রকাশ: সায়ন্তনী ২০২৪ পুজো সংখ্যা

1 comment:

  1. তপন কুমার বিশ্বাস,14 October 2024 at 00:57

    এ এক অসাধারণ কাহিনি। এক গভীর বঞ্চনার কাহিনী। জানতাম না। আপনার লেখার কল্যাণে জানতে পারলাম

    ReplyDelete