Wednesday, 23 October 2024

আইনস্টাইনের প্রাগ, প্রাগের আইনস্টাইন

 


আইনস্টাইনের প্রাগ
, প্রাগের আইনস্টাইন


গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

সম্প্রতি ইউরোপে এমন এক শহরে আমার স্ত্রী শম্পা ও আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল যেখানে আলবার্ট আইনস্টাইন জীবনের কিছু দিন কাটিয়েছিলেন। শহরটি হল প্রাগ, বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী, চেকভাষায় বলে প্রাহা। সেখানে আইনস্টাইন অল্প দিনই ছিলেন, এক বছরের সামান্য বেশী। কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাসে সেই অল্প সময়ের অভিঘাত খুব কম নয়। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রের পক্ষে সেই শহর দর্শনকে তীর্থযাত্রা বললে নিশ্চয় বাড়িয়ে বলা হবে না। ।

আইনস্টাইনের জন্ম ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ জার্মানির উল্ম শহরে। তিনি উচ্চতর পড়াশোনা করেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ফেডারেল পলিটেকনিকে। পাস করার কয়েকবছর পরে তিনি সুইজারল্যান্ডের বার্নে পেটেন্ট অফিসে কেরানির চাকরি পেয়েছিলেন। সেখানে কাজ করার সময়েই তিনি পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট করেন ও ১৯০৫ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গবেষণাগুলি সম্পূর্ণ করেন। সেগুলি প্রকাশিত হওয়ার পরেই বিজ্ঞানীমহলে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। আইনস্টাইন ১৮৯৬ সালেই জার্মানির নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন, কয়েক বছর পরে ১৯০১ সালে তিনি হয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। সেভাবেই কাটান ১৯৪০ সাল পর্যন্ত, তারপর মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।

পেটেন্ট অফিসের কেরানি আইনস্টাইন প্রথম অ্যাকাডেমিক চাকরি পান বার্ন বিশ্ববিদ্যাল। বার্নের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, সেখান থেকে সুইজারল্যান্ডেরই জুরিখে, এবার অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। পরের গন্তব্য প্রাগের চার্লস (জার্মান উচ্চারণে কার্ল)-ফার্ডিনান্ড জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়। যখন জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় জানতে পেরেছিল আইনস্টাইন ছাড়ার কথা ভাবছেন, একধাপে মাইনে অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রাগে তাঁর আলোচনার কেউ ছিলেন না। জুরিখে তিনি সুখী ছিলেন বলেই সকলের মত। কেন জুরিখ ছেড়েছিলেন আইনস্টাইন আমরা জানি না, কেবল আইনস্টাইনের সহযোগী ও জীবনীকার বিজ্ঞানী আব্রাহাম পাইস তাঁর গ্রন্থ 'সাটল ইজ দ্য লর্ড'-এ একটি চিঠি উদ্ধৃত করেছিলেন যার থেকে মনে হয় অন্য অধ্যাপকদের সঙ্গে আইনস্টাইনের কিছু বিরোধ হয়েছিল। তা যদি সত্যি হয়, তা নিশ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, প্রাগে আসার এক বছরের মধ্যেই তিনি আবার জুরিখ ফিরে যেতে মনস্থ করেন।

আইনস্টাইনের নাম বিবেচনার সময় তাঁর বিষয়ে বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক মাক্স প্লাঙ্ককে তাঁর মতামত জিজ্ঞাসা করা হয়। প্লাঙ্ক লিখেছিলেন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা স্পর্ধাতে ও সম্ভাব্য সুদূরkকিকপ্রসারী প্রভাবে এযাবৎ তাত্ত্বিক বিজ্ঞান এবং জ্ঞানতত্ত্বের সমস্ত প্রগতিকে ছাড়িয়ে যায়। যদি আইনস্টাইনের গবেষণা সঠিক প্রমাণিত হয়, এবং তাঁর ধারণা তা হবে, তাহলে তিনি বিংশ শতাব্দির কোপার্নিকাসরূপে বন্দিত হবেন।প্লাঙ্ক আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে সঠিকভাবেই অনুধাবন করেছিলেন। কোপার্নিকাসের তত্ত্ব যেমন পৃথিবীকে ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রীয় স্থান থেকে বিচ্যুত করে আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা করেছিল, আপেক্ষিকতা তত্ত্ব্ও তেমনি স্থান-কাল সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনাকেই পরিবর্তন করে দিয়েছিল। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বিজ্ঞানের বাইরেও শিল্পকলা বা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিল।

অবশ্য নিয়োগের পথে কিছু বাধা ছিল। আইনস্টাইন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস কিশোর বয়সেই ত্যাগ করেছিলেন। নিজের সম্পর্কে লেখার সময় ধর্মপরিচয়ের জায়গায় তিনি লিখেছিলন, undenominational অর্থাৎ কোনো বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত নন। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির অন্যতম শর্ত ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরির সম্রাটের প্রতি বিশ্বস্ততার প্রতিজ্ঞাপাঠ, কর্তৃপক্ষের মনে হয় সম্প্রদায়ভুক্ত না হলে তার প্রতিজ্ঞার কোনো দাম নেই। অবশেষে আইনস্টাইন পরিচয়ে লিখেছিলেন মোসাইক, অর্থাৎ স্বেচ্ছায় যে কোনো সম্প্রদায়ে অংশ নিতে তিনি ইচ্ছুক। এটা যথেষ্ট হয়েছিল।

সেই যুগে অধ্যাপকদের ধর্মবিশ্বাস ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাগে আইনস্টাইনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল পল এহ্‌রেনফেস্টের, এহ্‌রেনফেস্টের মৃত্যু পর্যন্ত সেই বন্ধুত্ব বজায় ছিল। তিনি প্রাগ ত্যাগ করার সময় নিজের পদে এহরেনফেস্টের নিয়োগের সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু এহ্‌রেনফেস্ট নিজেকে ধর্মত্যাগী বলে ঘোষণা করেছিলেন বলে প্রাগে তাঁর চাকরি হয়নি। এহ্‌রেনফেস্ট বিয়ে করেছিলেন রাশিয়ান বিজ্ঞানী তাতিয়ানা আফানাসিয়েভাকে। তাতিয়ানা ছিলেন রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ অনুসারী, তার নিয়মে ভিন্ন ধর্মে বিবাহ নিষিদ্ধ। এহ্‌রেনফেস্ট ইহুদি; দু’জনেই তখন নিজেদের ধর্মত্যাগী বলে ঘোষণা করেছিলেন।

প্রাগের আরো অনেক কিছুরই মতো চার্লস বিশ্ববিদ্যালয় সম্রাট চার্লসের নামাঙ্কিত। আইনস্টাইন যখন প্রাগে এসেছিলেন, সেখানে ছিল দুটি বিশ্ববিদ্যালয় -- চার্লস ফার্ডিনান্ড চেক ও চার্লস ফার্ডিনান্ড জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়। আদিতে এরা আদিতে ছিল একটিই প্রতিষ্ঠান, সেই সময় প্রাগ ছিল বোহেমিয়ার রাজধানী, প্রধান ভাষা ছিল জার্মান। ১৮৪৮ সালে চেক ভাষাতে পড়ানো শুরু হয়, তারপর নানা বিরোধের পরে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাগ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠান। তার অনেক আগেই প্রাগে চেক ভাষাভাষীরা সংখ্যাগুরু হয়ে গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আবার একটিই বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা মিলে যায়, চার্লস ইউনিভার্সিটি। চতুর্থ চার্লস ছিলেন চতুর্দশ শতকে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট। অবশ্য ঐতিহাসিক দিক থেকে বিচার করলে এই রকম ভুল নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। চার্লস রোম শহরে কাটিয়েছিলেন কয়েক ঘণ্টা, তাঁর শাসনাধীন এলাকাকে সাম্রাজ্য বলতে গেলে কল্পনাকে বহুদূর বাড়াতে হবে, আর তার পবিত্রতা অন্য সব সাম্রাজ্যের থেকে বেশি ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এটা ঠিক যে চার্লস প্রাগকে ইউরোপে এক মর্যাদার আসনে বসিয়েছিলেন। প্রাগের বহু প্রাচীন ও নবীন কাঠামোই তাঁর স্মৃতি বহন করে। কিন্তু আমার মতো বিজ্ঞানের ইতিহাসে উৎসুকদের কাছে চার্লস অন্য কারণে পরিচিত। তিনিই পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের রাজদরবার প্রাগে স্থানান্তরিত করেছেন। তাঁর মৃত্যুর দুই শতাব্দীরও বেশি পরে সেখানে দেখা হবে দুই মহান জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহে ও জোহানেস কেপলারের, ইতিহাস বইবে অন্য খাতে।

আইনস্টাইনকে প্রাগ মনে রেখেছে কী? টুরিস্টদের অবশ্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে আইনস্টাইনের কোনো উল্লেখ পেলাম না। কিন্তু টাইকো ও কেপলারের মূর্তির উল্লেখ পেলাম প্রাগ ভ্রমণের এক ওয়েবসাইটে। খুব কাছে নয়, তবে প্রাগ স্টেশনে নেমেই স্থানীয় পরিবহনের তিনদিনের টিকিট কাটা ছিল, তাই অসুবিধা হল না। সেদিন গিয়েছিলাম কাফকা মিউজিয়ামে। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা, এই লেখার জন্য প্রায় অপ্রাসঙ্গিক। তবে প্রাগে কাফকাকে এড়ানোর উপায় নেই, তিনি আসবেন এই লেখায়। মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে গুগল ম্যাপকে জিজ্ঞাসা করলাম, মূর্তিদুটির হদিস ও যাওয়ার উপায় বসে বাতলে দিল। সামনেই ট্রাম স্টপ। আমাদের শহর থেকে ট্রাম উঠে গেলে কী হবে; ধোঁয়া ছাড়ার ব্যাপার নেই বলে ইউরোপের বহু শহরেই দেখেছি ট্রামের প্রতাপ অব্যাহত। তিনদিন প্রাগে ছিলাম, একবার ট্রলি বাসে উঠেছিলাম, বাকি সমস্ত সময়েই ট্রামে করে ঘুরেছি।

গুগল বলে দিয়েছিল ট্রাম আসার সময় হয়ে এসেছে, তাই শম্পা আর আমি মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে পা চালালাম ট্রাম স্টপের দিকে। যেতে না যেতেই ট্রাম হাজির। সিটে বসেও সামনের রড শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম। কলকাতার অভিজ্ঞতা থেকে প্রাগের ট্রামে প্রথম দিনই হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিয়েছিলাম, ট্রামের বেগ যে এত হতে পারে তা ধারণাতেই ছিল না। লন্ডন, বার্লিন, রোম, মেলবোর্ন, বুদাপেস্ট, ত্রিয়েস্তে -- আমার অভিজ্ঞতাতে এসব শহরের কোনোটিতেই ট্রামকে এত জোরে যেতে দেখিনি। একটু পরেই ডিসপ্লে বোর্ড দেখে নেমে পড়লাম গন্তব্যস্থানে। ডানদিকে তাকাতেই দেখলাম একটা ছোট্ট ঘাসজমির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন দুই মহাকায়। আমরা দুজন ছাড়া আশপাশে জনপ্রাণী নেই। শম্পা আমার ছবি তুলে দিয়েছিল, তবে সূর্যের অবস্থানের জন্য ছবি খুব ভালো উঠল বলতে পারি না। মূর্তির তলাতে শুধু দুজনের নাম লেখা, হয়তো যাঁরা দেখতে আসবেন তাঁদের জন্য সেটুকুই যথেষ্ট মনে করেছেন শহরের কর্তারা। টাইকোর হাতে কোণ মাপার যন্ত্র কোয়াড্রান্ট, কেপলারের হাতে গোল করা গণিতের কাগজ।


 টাইকো ব্রাহে ও জোহানেস কেপলার

টাইকো ছিলেন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের রাজকীয় জ্যোতির্বিদ। তারও আগে ডেনমার্কের রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডরিকের পৃষ্ঠপোষণাতে তিনি তৈরি করেছিলেন ইউরানিবর্গ মানমন্দির। কেপলার কিছুদিন ছিলেন টাইকোর সহকারী, দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল প্রাগে। দুজনের সম্পর্ক কোনোদিনই খুব ভালো হয়নি। কেপলার ছিলেন কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বে বিশ্বাসী, টাইকো বিশ্বাস করতেন সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু দূরবিন আবিষ্কারের আগে আকাশে গ্রহনক্ষত্রদের গতিবিধি সম্পর্কে টাইকোর থেকে ভালো পর্যবেক্ষণ কেউ করেননি, টাইকো মারা যাওয়ার পরে কেপলার সেই সমস্ত তথ্য হাতে পান। হঠাৎই মৃত্যু হয়েছিল টাইকোর, মৃত্যুশয্যাতে তিনি কেপলারকে অনুরোধ করেছিলেন, 'দেখো আমার জীবন যেন বৃথা না যায়।’ কেপলার তাঁর কথা রেখেছিলেন। কেপলারের দৃষ্টিশক্তি ছিল খুব খারাপ, তাই পর্যবেক্ষণ তাঁর ক্ষমতার বাইরে ছিল। কিন্তু গণিতে সে যুগে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না। টাইকোর সংগৃহীত তথ্যের উপর ভিত্তি করে তিনি গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত তিনটি সুত্র দিয়েছিলেন যেগুলো আমরা সবাই স্কুলে পড়েছি। সেই সূত্রগুলি ব্যবহার করে নিউটন মাধ্যাকর্ষণের সূত্রেও পোঁছেছিলেন। সেটা ছিল সপ্তদশ শতাব্দী। কেপলার প্রাগে যে বাড়িতে থাকতেন, সেটা এখন এক মিউজিয়াম। কিন্তু এবারে সেখানে যাওয়ার সময় হল না।

টাইকো ও কেপলারকে ছেড়ে আবার ট্রাম, এবার লক্ষ্য প্রাগের প্রাচীনতম ব্রিজ। প্রাগের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে ভ্লাটভা নদী। প্রাচীন শহর তার পূর্ব পাশে, অন্যদিকে প্রাগ দূর্গ। দ্বাদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই দুই প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল একটিই ব্রিজ। ঠিক ধরেছেন, তার নাম চার্লস ব্রিজ। এখানে হাঁটতে ভালবাসতেন আইনস্টাইন। এখন অবশ্য আঠারোটি ব্রিজ নদীর উপর দিয়ে শহরকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধেছে। এ ব্রিজ শুধুই পদাতিকদের জন্য, টুরিস্টদের অন্যতম দ্রষ্টব্য। ছবি তোলার বাধ্যতামূলক কর্তব্য সমাধা করে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম কাফে লুভর।

রাস্তার দুপাশে দুই কাফে, কাফে (বা চেক ভাষায় কাভার্না) লুভর ও কাভার্না স্লাভিয়ান। প্রথমটি ছিল জার্মান, দ্বিতীয়টি চেক বুদ্ধিজীবীদের মিলনস্থল, হয়তো আমাদের কলেজস্ট্রিটের ইন্ডিয়ান কফি হাউসের মতোই। আমাদের লক্ষ্য প্রথমটি, অর্থাৎ ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত কাফে লুভর। শতাব্দীপ্রাচীন কাফের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কমিউনিস্ট শাসনে একসময় সরকারের রোষদৃষ্টিতেও পড়েছিল কাফে। ভেলভেট বিপ্লবের পরে আবার নতুন করে খুলেছে।

ঢুকেই একটা বোর্ড, সেখানে লেখা আছে কারা এক সময় এই কাফেতে আসতেন। সেই তালিকাতে আছেন নাট্যকার কারেল চাপেক। আমি নিজেকে সাহিত্যবোদ্ধা বলে দাবি করতে পারি না, চাপেকের একটির বেশি লেখা আমি পড়িনি। কিন্তু যে কোনো কল্পবিজ্ঞানপ্রেমীকেই পড়তে হয় চাপেকের নাটক আর ইউ আর (ইংরাজি অনুবাদে আর ইউ আর - রসাম'স ইউনিভার্সাল রোবটস)। যে কাহিনি মানুষকে একটা নতুন শব্দ দান করেছিল, রোবট।


 বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কাফে লুভর

বোর্ডে চাপেকের আগেই তাঁর থেকে অনেক বেশি বিখ্যাত একটি নাম লেখা আছে, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী সাহিত্যিক ফ্রাঞ্জ কাফকা। কাফকার সঙ্গে আসতেন তাঁর বন্ধু ম্যাক্স ব্রড। কাফকার মৃত্যুর সময় ব্রডকে তাঁর সমস্ত সাহিত্য পুড়িয়ে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, বন্ধু সে কথা শোনেননি। তাঁর সম্পাদনাতেই প্রকাশিত হয়েছিল কাফকার সাহিত্যকীর্তি। আধুনিক প্রাগে বিখ্যাততম নামটি হল ফ্রাঞ্জ কাফকা।



বর্তমানে কাফে লুভরের প্রবেশপথ



 
কাফে লুভরের বোর্ডে পাশাপাশি আইনস্টাইন ও কাফকা

আর আসতেন আইনস্টাইন। নিউটনের আড়াইশো বছর পরে তাঁর মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের সত্যতা নিয়ে প্রথম যিনি প্রশ্ন যিনি তুলেছিলেন। আব্রাহাম পাইসের মতে সঠিকভাবে বললে প্রাগেই প্রথম তিনি পথের দিশা পেয়েছিলেন। সেই নিয়ে খুব সামান্য কিছু কথা আমাদের লেখাতে আসবে, তার আগে বিংশ শতাব্দীর দুই বিখ্যাততম ইহুদি কাফকা ও আইনস্টাইনের সম্পর্কের কথা শেষ করে নিই। তাঁরা দুজনে যে শুধু কাফে লুভরেই যেতেন এমন নয়। আইনস্টাইনের সহকর্মী হুগো বার্গমান আইনস্টাইনকে ওল্ড টাউন স্কোয়ারে তাঁর শাশুড়ি বার্থা ফান্টার বৈঠকখানায় নিয়ে যেতেন, সেখানে ভিড় জমাতেন প্রাগের সেরা মস্তিষ্করা। বেহালা বাজাতে ভালোবাসতেন আইনস্টাইন, আরো তিনজন সহযোগীর সঙ্গে বৈঠকখানাতে প্রায়ই তাঁর দুই প্রিয় সঙ্গীতস্রষ্টা বাখ বা মোৎজার্টের সুরঝঙ্কার তুলতেন বেহালাতে। বৈঠকখানাতে যেতেন ম্যাক্স ব্রড, এবং ফ্রাঞ্জ কাফকা। ম্যাক্স ব্রডের লেখা কেপলারের জীবনীভিত্তিক উপন্যাসে আইন্সটাইনের ছায়া পড়েছে বলে অনেকে মনে করতেন, স্বয়ং ব্রড অবশ্য সে কথা উড়িয়ে দেন। অন্তত একবার আইনস্টাইন সেই বৈঠকখানাতে আপেক্ষিকতা নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, কাফকা সেখানে কখনো কখনো অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি পাঠ করতেন। জানতে ইচ্ছা করে শ্রোতাদের কাছে কোনটি বেশি দুরূহ ঠেকেছিল।

পাইস তাঁর বইতে কাফকার নাম উল্লেখ করেন নি। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘আইনস্টাইন ইন বোহেমিয়া’ বইতে মাইকেল গর্ডিন অনুমান করেছেন যে অন্তত একবার দুজনের দেখা হয়েছিল। কিন্তু দুজনের কেউই সেই কথা মনে রাখেননি। তিরিশের দশকে কাফকার উপন্যাস পড়েছিলেন আইনস্টাইন, তাঁর ভালো লাগেনি। এক প্রেমিকাকে ১৯২০ সালের চিঠিতে আপেক্ষিকতার কথা লিখেছিলেন কাফকা। কিন্তু কেউই কখনো জানানি যে তাঁরা একে অপরকে চিনতেন।


 
ওল্ড টাউন স্কোয়ারের দেওয়ালে আইনস্টাইন

আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট ছিল শহরের পশ্চিম পাশে, আঠারোটা ব্রিজের মধ্যে একটার ধারে। সেখান থেকে আইনস্টাইনের বাসস্থান হেঁটে তিন মিনিট। মাঝে একটা ছোট্ট পার্ক। পরপর দুটো ব্রিজ আছে, তার কোনোটা দিয়েই হয়তো আইনস্টাইন রোজ হেঁটে নদী পেরোতেন, গন্তব্য ছিল হয়তো কাফে লুভর, হয়তো বা ইউনিভার্সিটি, বা হয়তো শহরের প্রাণকেন্দ্র ওল্ড সিটি স্কোয়ারে, যেখানে রয়েছে ইউরোপের প্রাচীনতম অ্যাস্ট্রোনমিকাল ক্লক। গুগল দেখাচ্ছিল যে বাড়িটি চব্বিশ ঘণ্টা খোলা। তাই ভোরবেলা পা চালালাম লেসনিকা ৭-এর দিকে। গিয়ে দেখলাম, আমার বুঝতে ভুল হয়েছিল, ওই ঠিকানাতে কোনো মিউজিয়াম নেই। লেসনিকা ৭ হল একটা অ্যাপার্টমেন্ট, সেখানে অনেক মানুষ বাস করেন। আইনস্টাইনের স্মৃতিতে বাড়ির সামনে দেওয়ালে তাঁর মাথার এক ভাস্কর্য রাখা আছে, এইটুকু স্মৃতি সে বহন করে। এই লেখার শুরুতেই সেই ছবি আছে।

আইনস্টাইন তাঁর পরিবার নিয়ে ১৯১১ সালের মার্চ মাসের শেষে বা এপ্রিল মাসের শুরুতে এই বাড়ির তিন বেডরুমের এক ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিলেন। বাড়িটি তখন নতুন। আর বিশেষ আকর্ষণ ছিল ইলেকট্রিসিটি, যা সবে প্রাগে এসেছে। এখন প্রাগ, বিশেষ করে তার সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্ট ছবির মতন সাজানো। প্রতি বছর সত্তর লক্ষেরও বেশি পর্যটককে সে আকর্ষণ করে। আইনস্টাইনের সময়ে তা ছিল না। লেসনিকা তখন ছিল শিল্পাঞ্চল, ধোঁয়া ও ধুলোতে ঢাকা। সুইজারল্যান্ডের খোলামেলা পরিবেশ থেকে এসে মানিয়ে নিতে আইনস্টাইনের কোনো অসুবিধা হয় নি। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন প্রথমা স্ত্রী মিলেভা, দুই শিশু পুত্র হান্স আলবার্ট ও এডওয়ার্ড। আর ছিলেন এক গৃহ-পরিচারিকা। মিলেভার অবশ্য প্রাগের পরিবেশ পছন্দ হয়নি, সেই কারণেই প্রাগে আইনস্টাইনের বেশিদিন থাকা হয়নি। মিলেভার সঙ্গে আইনস্টাইনের সম্পর্ক তখন ক্রমান্বয়ে খারাপ হওয়ার পথে।

এহ্‌রেনফেস্ট ছাড়াও আর একজন তরুণ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে খুঁজে বার করে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে এসেছিলেন। তিনি আবার আইনস্টাইনের সঙ্গেই জুরিখ গিয়েছিলেন। তাঁর নাম অটো স্টার্ন। ১৯৪৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পাবেন। তাঁর দখলে এক রেকর্ড আছে, যা ভাঙা শক্ত। বিভিন্ন সময়ে তাঁর নামে মোট বিরাশিটি নোবেল মনোনয়ন জমা পড়েছিল, অন্য যে কোনো নোবেল পুরস্কারজয়ীর থেকে অনেক বেশি। কিন্তু জীবনের এই পর্বে আইনস্টাইন যা নিয়ে ভাবছিলেন, স্টার্নের কাজের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।

এই সময়েই তাঁর কাছে এসে পোঁছেছিল এক আমন্ত্রণপত্র। শিল্পপতি আর্ন্সট সলভের পৃষ্ঠপোষণাতে পৃথিবীর সেরা পদার্থবিজ্ঞানী ও রসায়নবিদদের নিয়ে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে আয়োজিত হবে সলভে কনফারেন্স, সেখান আইনস্টাইনও আমন্ত্রিত। এর পর থেকে সলভে কনফারেন্স নিয়মিত অনুষ্ঠিত হত। আইনস্টাইন গিয়েছিলেন ব্রাসেলস, সেখানে অনেক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীর সংগে তাঁর প্রথম আলাপ হয়েছিল। প্রথম সলভে কনফারেন্সে তাঁর থেকে বয়সে কম আমন্ত্রিত একজনই ছিলেন। প্রাগে থাকাকালীন আইনসস্টাইনের নাম প্রথমবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়, করেছিলেন উইলিয়াম ভীন।

ষোল মাস প্রাগে ছিলেন আইনস্টাইন। ১৯১২ সালের জুলাই মাসের ২৫ তারিখে তিনি জুরিখে ফিরে যান। প্রাগে থাকাকালীন এগারটি গবেষণাপত্র লিখেছিলেন আইনস্টাইন, যে কোনো বিচারেই যা বিস্ময়কর। কিন্তু যে বিষয়টি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, তা হল এই সময়েই তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে সঠিক পথে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন। সাধারণ আপেক্ষিকতা হল মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব, নিউটনের পরে এই বিষয়ে প্রথম ও এখনো পর্যন্ত একমাত্র প্রতিষ্ঠিত পদক্ষেপ। এই পর্বে তিনি সূর্যের পাশ দিয়ে আসার সময় নক্ষত্রের আলো কতখানি বাঁকবে তা হিসাব করেছিলেন। ১৯১৯ সালে এই পরিমাপই তাঁকে বিশ্বখ্যাতি এনে দেবে। কিন্তু প্রাগের হিসাবে ভুল ছিল, সেই সময় তিনি স্থানকালের বক্রতাকে হিসাবে ধরেননি, ফলে উত্তর এসেছিল সঠিক পরিমাণের অর্ধেক। এই সময়েই আইনস্টাইন আরো দেখিয়েছিলেন যে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যাব। নীল আলোর এর ফলে লাল দেখাবে বলে একে অভিকর্ষজ লোহিতাপসরণ বলা হয়। অবশ্য তার প্রমাণ পেতে সময় লেগেছিল আরো তেতাল্লিশ বছর। প্রাগ পর্বেই আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন যে মাধ্যাকর্ষণ তিনি যা অনুমান করছেন, তার থেকে অনেক বেশী জটিল। কিন্তু প্রাগে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করার মতো কোনো বিজ্ঞানী ছিলেন না। জুরিখে ফিরে তিনি পাবেন পুরানো বন্ধু গণিতবিদ মার্সেল গ্রসম্যানকে, যাঁর গণিতের জ্ঞান তাঁকে সাহায্য করেছিল। পরের চার বছর তিনি সেই গবেষণাতেই ব্যয় করবেন। ১৯১৬ সালে তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পূর্ণ রূপ দেবেন।

আমাদেরও প্রাগ ছাড়ার সময় হল। প্রাগ থেকে আইনস্টাইন গিয়েছিলেন উত্তরে, আমাদের গন্তব্য দক্ষিণে হাঙ্গারির রাজধানী বুদাপেস্ট। বার্লিনে সত্যেন্দ্রনাথ বসু আইনস্টাইনের সঙ্গে যে বাড়িতে দেখা করতেন, তার খোঁজ করতে গিয়ে হতাশ হয়েছিলাম। সেই বাড়ির আর অস্তিত্ব নেই। যেমন অস্তিত্ব নেই তাঁর অপর ফ্ল্যাটের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমা আইনস্টাইনের বাড়িকে রেয়াত করেনি। প্রাগে অন্তত তাঁর বাসস্থানটি আছে, যদিও তার ভিতরে আইনসস্টাইনের কোনো চিহ্ন আর নেই। অবশ্য বার্লিনের কাছে পটসডামে আইনস্টাইনের গ্রীষ্মাবকাশের বাড়িটি এখন মিউজিয়াম, সেটি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সুযোগ পেলে পরে সে কথা বলা যাবে। আইনস্টাইন নিজে প্রাগের স্মৃতিকে কেমনভাবে দেখতেন? আপেক্ষিকতা বিষয়ক আঁর বইটি চেক ভাষাতে অনুবাদ হয়েছিল, ভূমিকাতে আইনস্টাইন লিখেছিলেন, (ইংরাজি অনুবাদে) “I’m pleased that this little book in which the main thoughts of the theory of relativity are portrayed is now published in the national language of the country in which I found the necessary composure to give the basic thought of the general theory of relativity (1908) step by step a more definite shape so it could be realized. In the quiet rooms of the Theoretical Physical Institute of the Prague German University in the Vinicna ulice I discovered in 1911 that the equivalence principle demands a refraction of the rays of light at the sun of a sum that can be observed ... Also the still not really confirmed consequence of the red shift of the spectral lines I discovered in Prague.”

প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, ২০২৪


No comments:

Post a Comment