Friday, 19 May 2017

সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরঃ শতবর্ষ


নক্ষত্রের মৃত্যু ও দুই বিজ্ঞানী

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


(জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী চন্দ্রশেখরের জন্মশতবর্ষে ছোটোদের পরিচালিত একটি পত্রিকায় এই লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিল। কিছুটা পরিবর্তনের পর লেখাটি এখানে তুলে দিলাম।)

তোমরা সবাই নিশ্চয় জেনে গেছে যে ২০০৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক বিজ্ঞানী, ভেঙ্কটরমন রামকৃষ্ণণ। এও নিশ্চয় জানো যে কোষের মধ্যে যে রাইবোজোম থাকে, তার গঠন আবিষ্কারের জন্য তাঁকে এই সম্মান দেওয়া হয়েছে। আমি আজ অন্য এক বিজ্ঞানীর আবিষ্কার নিয়ে একটা গল্প তোমাদের শোনাতে বসেছি। তিনিও জন্মসূত্রে ভারতীয়, তিনিও নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এবছর তার জন্মের একশো বছর পূর্ণ হল। অনেকেই নিশ্চয় নামটা ধরে ফেলেছ। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, আমি সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরের নোবেল জয়ের কথাই তোমাদের আজ বলব। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীমহল তাঁকে চন্দ্র নামে চেনে।

চন্দ্রশেখরের জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত ভারতের লাহোরে ১৯১০ সালের ১৯শে অক্টোবর। তাঁর বাবা চন্দ্রশেখর সুব্রহ্মনিয়া আয়ার তখন সেখানে রেল দপ্তরে চাকরি করতেন। মা সীতালক্ষ্মী বালাকৃষ্ণ পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন যদিও স্কুলে প্রথাগত পড়াশোনার সুযোগ তাঁর বিশেষ হয়নি। নিজের চেষ্টাতে সারাজীবন তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যান। কিন্তু তাঁদের পরিবারের যে সদস্যের কথা আমরা সকলেই জানি, তিনি হলেন বাবার ছোটো ভাই। তার নাম চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন, আজ পর্যন্ত এক মাত্র ভারতীয় নাগরিক যিনি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

চন্দ্রশেখরের পড়াশোনা মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে। তাঁর শিক্ষকেরা সবাই বুঝতে পেরেছিলেন যে এক বিরল প্রতিভার তাঁরা সম্মুখীন। কাকা রমন তার কলকাতার গবেষণাগারে কাজ করার সুযোগ তাঁকে দিয়েছিলেন। চন্দ্রশেখরের বয়স তখন মাত্র আঠারো । তবে অচিরেই বহু যন্ত্রপাতি ভাঙার পরে সবাই বুঝলেন যে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান তাঁর বিষয় হতে পারে না। কিন্তু এই সময়ের এক যোগাযোগে চন্দ্রশেখরের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। রমনের ঘরে তাঁর হাতে এসেছিল জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান অর্থাৎ Astrophysics সংক্রান্ত একটি বই The Internal Constitution of the Stars। নক্ষত্রদের অভ্যন্তরীণ গঠন নিয়ে বইটি লেখেন আর্থার স্ট্যানলি এডিংটন। বইটি রুদ্ধশ্বাসে শেষ করেন চন্দ্রশেখর। তখন থেকেই এডিংটন তাঁর কাছে আদর্শস্বরূপ। তোমরা দেখবে যে শেষ পর্যন্ত কিন্তু এডিংটনকে এত শ্রদ্ধার ফল চন্দ্রের পক্ষে ভালো হয়নি।

সে বছরই মাদ্রাজে এসেছিলেন এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রেই তাঁর নাম জানে, আর্নল্ড সমারফেল্ড। তিনিও আঠারো বছরের এই ছাত্রের বিজ্ঞানে দখল দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন এবং তাঁকে ভবিষ্যৎ গবেষণার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন। ফলত সেই বছরই; অর্থাৎ ১৯২৮ সালে চন্দ্রের প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। এডিংটনের তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে তারাদের ভিতরে পরমাণু, ইলেকট্রন ও আলো নিজেদের মধ্যে কেমনভাবে ক্রিয়া করে সে বিষয়ে তিনি গবেষণাটি করেছিলেন।

তরুণ চন্দ্রশেখর এখন অনেক বেশী সাহসী । তিনি ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির সদস্য র‍্যালফ ফাউলারকে তাঁর পরবর্তী গবেষণাটি লিখে পাঠান। উত্তর দিয়েছিলেন ফাউলার। তাঁর মতামত অনুযায়ী সামান্য পরিবর্তন করে সেটি Proceedings of the Royal Society-তে ছাপা হয়। এসময় মাদ্রাজে এসেছিলেন আর এক দিকপাল পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। চন্দ্রশেখর জানতেন আটাশ বছর বয়সী এই বিজ্ঞানী আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে তিনি যে আবিষ্কার করেছিলেন, তার জন্য একত্রিশ বছর বয়সে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। তোমরা নিশ্চয় ভাবছ যে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে এত বড়ো কাজ করা সম্ভব? আমাদের গল্পের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করো । যা হোক, হাইজেনবার্গের সঙ্গে চন্দ্রশেখরের বন্ধুত্ব হয়েছিল। মেঘনাদ সাহাও এসময় চন্দ্রশেখরের গবেষণার প্রশংসা করেন।

চন্দ্রশেখর স্থির করলেন ইংল্যান্ডে যাবেন। পড়তে যাবেন কেমব্রিজে। সেখানে আছেন ফাউলার। আর আছেন তাঁর আদর্শ এডিংটন। ১৯৩০ সালের ৩১ শে জুলাই বোম্বাই বন্দর থেকে তাঁর জাহাজ ইংল্যান্ডে রওনা হল। চন্দ্রশেখরের বয়স কুড়ি পূর্ণ হতে তখনো কয়েক মাস বাকী। 

শান্ত আরব সাগরের বুক চিরে জাহাজ এগিয়ে চলেছে। ডেকে বসে এক তরুণ পদার্থবিজ্ঞানের বইতে নিমগ্ন। কী ভাবছেন তিনি? তাঁর মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে এডিংটনের বইতে লেখা নক্ষত্রদের মৃত্যুর বিবরণ। সূর্য কেন নিজের মাধ্যাকর্ষণের টানে আরো ছোটো হয়ে যাচ্ছেনা? এডিংটন দেখিয়েছেন যে সূর্যের বিকিরণের চাপ ও উত্তপ্ত গ্যাসের চাপ মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে কাজ করে। তারাই সূর্যকে তার বর্তমান আকারে ধরে রাখে । কিন্তু যখন কোনো তারকার জ্বালানি ফুরিয়ে যায় তখন কী হয়? তখন তো এই দুই বল আর মাধ্যাকর্ষণের সমান থাকবে না। এডিংটন বললেন তারকা নিজের মাধ্যাকর্ষণের টানে আস্তে আস্তে ছোটো হতে থাকবে । যত ছোটো হবে, স্বাভাবিক ভাবে ততই তার ঘনত্ব বাড়তে থাকবে । এডিংটনের মতে এক সময় নক্ষত্রের কেন্দ্র এতটাই ঘন হয়ে যাবে যে তাকে মাধ্যাকর্ষণ আর চাপ দিয়ে ছোটো করতে পারবে না।

  সেই রকম তারার সন্ধান জানা ছিল। শ্বেত বামন নক্ষত্র এতই কম উজ্জ্বল যে খালি চোখে দেখার প্রশ্ন ওঠে না। ১৭৮৩ সালে প্রথম শ্বেত বামন নক্ষত্রটিকে আবিষ্কার করেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেল, তবে তখন তার সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। এর পর আসে ফ্রিয়েডরিশ উইলহেল্ম বেসেলের কথা। আমরা সবাই রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা লুব্ধক বা সিরিয়াসকে চিনি।  বেসেল তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বলেন যে সেটি আসলে যুগ্ম নক্ষত্র, তার একটি অদৃশ্য সঙ্গী আছে। সেই সঙ্গীটি দূরবিনে ধরা দিল 1862 সালে, ঔজ্জ্বল্য খুব কম বলে তাকে আগে দেখা যায়নি। তাকে প্রথম দেখতে পেয়েছিলেন মার্কিন লেন্স নির্মাতা আলভিন গ্রাহাম ক্লার্ক। দূরবিনের লেন্স বানানো ছিল তাঁদের পারিবারিক ব্যাবসা, একটি লেন্স পরীক্ষা করতে গিয়ে তিনি সেটিকে আবিষ্কার করেছিলেন। এই হল নতুন দুনিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে জ্যোতিবিদ্যার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এর নাম দেওয়া হল সিরিয়াস বি।

শ্বেত বামনরা অন্য সব নক্ষত্রদের থেকে আলাদা। তাদের অদ্ভুত চরিত্র সম্পর্কে কেমন করে জানা গেল তার বিবরণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি নরিস রাসেল লিখে গেছেন। ১৯১০ সালে তিনি হার্ভার্ড মানমন্দিরের অধিকর্তা এডওয়ার্ড পিকেরিং-এর থেকে বামন নক্ষত্রদের শ্রেণি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছিলেন। সব বামন নক্ষত্রই M শ্রেণিতে পড়ছিল, কিন্তু হার্ভার্ডের মহিলা জ্যোতির্বিদ উইলিয়ামিনা ফ্লেমিং দেখান যে হার্শেলের দেখা নক্ষত্রটি হল A-শ্রেণিতে পড়ে। এই শ্রেণির অন্য নক্ষত্ররা সবাই অনেক বেশি উজ্জ্বল, অর্থাৎ এদের তাপমাত্রা খুব বেশি। তাপমাত্রা জানা থাকলে তার প্রতি একক ক্ষেত্রফল থেকে কত শক্তি বেরোয় তা তাপগতিবিদ্যা থেকে নির্দিষ্ট।1 কোনো নক্ষত্রের মোট শক্তি বিকিরণের পরিমাণকে লিখতে পারি তার প্রতি একক ক্ষেত্রফল থেকে বিকিরিত শক্তি ও তার উপরিতলের ক্ষেত্রফলের মোট গুণফল। কোনো তলের তাপমাত্রা কেলভিন স্কেলে T হলে তার প্রতি একক ক্ষেত্রফল থেকে নির্গত শক্তির পরিমাণ হল E=sT4। একে বলে ভীনের সূত্র, s হল ভীন-বোলজ্‌মান ধ্রুবক। সব A শ্রেণির তারাদের ক্ষেত্রেই একক ক্ষেত্রফল থেকে বিকিরিত শক্তির পরিমাণ কাছাকাছি, কারণ তাদের তাপমাত্রার খুব একটা পার্থক্য হয় না। সুতরাং এই তারাদের এত কম উজ্জ্বলতার একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে, এরা নিশ্চয় আয়তনে খুব ছোট বা বামন। হিসাব করে দেখা গেল এই দ্বিতীয় তারাটির ভর সূর্যের প্রায় সমান, কিন্তু তা আয়তনে পৃথিবীর থেকে সামান্য বড়ো। এরকম আরো তারকার খাঁজ মিলল। সহজ অঙ্ক কষে দেখা গেল এদের এক ঘন সেন্টিমিটার, মানে বড়ো চামচের এক চামচ, পদার্থের ভর হবে একশো কিলোগ্রাম। তারার কেন্দ্রের এই বিশাল ঘনত্বই মাধ্যাকর্ষণকে  প্রতিহত করে। আয়তনে ছোটো ও সাদা রঙের বলে এধরনের নক্ষত্রদের নাম দেয়া হল শ্বেত বামন। এডিংটনের সহকর্মী ফাউলার দেখালেন যে নতুন আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম তন্ত্র প্রয়োগ করলে দেখা যায় তারাদের ঘনত্ব একটা নির্দিষ্ট মানের চেয়ে বেশী হতে পারে না। পদার্থের অতি ঘন অবস্থায় ইলেকট্রনেরা যে চাপ তৈরি হয়, তা মাধ্যাকর্ষণকে প্রতিহত করে।

যদিও ফাউলারের তত্ত্ব মাত্র দু বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল, তরুণ চন্দ্রশেখর এই সমস্ত বিষয়ে পরিচিত ছিলেন। জাহাজে যেতে যেতে তিনি ভাবলেন যে ফাউলার তো ধরে নিয়েছেন  ইলেকট্রনরা নিউটনের গতিসূত্র মেনে চলে । কিন্তু আমরা জানি যে যদি কোনো কণা আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে চলে, তাহলে তাদের জন্য নিউটনের বলবিদ্যা কাজ করে না।  আইনস্টাইন আবিষ্কৃত বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ বা Special Theory of Relativity-ই একমাত্র তার গতিবিধি ব্যাখ্যা করতে পারে। চন্দ্রশেখর বুঝতে পারলেন যে নক্ষত্র যখন মাধ্যাকর্ষণের টানে ছোটো হয়ে আসে, তখন তার ভিতরের ইলেকট্রনের বেগ খুব বেড়ে যায়। তার ফলে ফাউলারের তত্ত্বের পরিবর্তন হতে বাধ্য । জাহাজেই তিনি প্রাথমিক অঙ্কটা কষে ফেললেন। দেখলেন যে শ্বেত বামনের ভর সূর্যের থেকে ১.৪ গুণের বেশী হওয়া সম্ভব নয়। তার থেকে বেশী ভরের তারাদের মাধ্যাকর্ষণ আরো বেশী, তাই ইলেকট্রনের চাপ মাধ্যাকর্ষণকে প্রতিহত করতে পারবে না। তারাটা ছোটো হতে হতে একটা বিন্দুতে পর্যবসিত হবে যার ঘনত্ব অসীম । আমরা যাকে আজ কৃষ্ণ গহ্বর বা Black Hole বলি, তাই হল ভারী তারাদের অন্তিম পরিণতি । এই কাজের সময় চন্দ্রশেখরের বয়স কুড়িও পূর্ণ হয়নি।


সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর (অক্টোবর ১৯, ১৯১০ - আগস্ট ২১, ১৯৯৫)

কেমব্রিজে পৌঁছে চন্দ্রশেখর তাঁর তত্ত্ব ফাউলার, এডিংটন প্রমুখদের কাছে ব্যাখ্যা করেন। পরের দু বছরে তিনি তাকে আরো বিকশিত করেন। ফাউলারের অধীনে তিনি গবেষণা করেছিলেন। এডিংটনও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, তার এ বিষয়ে গবেষণার খবর নিতেন। এডিংটনকেই তখন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী বলে সবাই মেনে নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পেয়ে চন্দ্রশেখর নিজেও খুব খুশী ছিলেন। হঠাৎই হল বিনা মেঘে বজ্রপাত।

১৯৩৫ সালের ১১ই জানুয়ারি রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনেমিকাল সোসাইটির এক সভায় চন্দ্রশেখর তাঁর তন্ত্র ব্যাখ্যা করেন। তাঁর ঠিক পরে বলতে ওঠেন এডিংটন। তিনি কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি ছাড়াই চন্দ্রশেখরের গবেষণাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। চন্দ্রশেখর হতচকিত হয়ে যান। তিনি অনেকবার এডিংটনের সঙ্গে তার গবেষণা নিয়ে আলোচনা করেছেন, কখনো তো এডিংটন তাঁর কাজকে ভুল বলেন নি। হঠাৎ করে প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের এক সভায় এরকম ব্যক্তিগত আক্রমণ তাঁকে স্তম্ভিত করে দেয়। চন্দ্রশেখর উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে যান, কিন্তু সভাপতি তাঁকে সেই সুযোগ দেন নি।

চন্দ্রশেখর জানতেন এডিংটন যা বলছেন তা পুরোপুরি ভুল। তিনি আরো অবাক হয়ে যান এই ভেবে যে এডিংটন নিজে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ বিষয়ে প্রথম সারির বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম। অন্য কেউ না বুঝুক, তিনি তো চন্দ্রশেখরের গবেষণার প্রকৃত অর্থ বুঝবেন! এডিংটনের নামডাক তখন এতই বেশী যে কোনো বিজ্ঞানীই প্রকাশ্যে সে সময় চন্দ্রশেখরকে সমর্থন করলেন না। এর পরেও এডিংটন আরো প্রায় দশ বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু কখনোই তিনি নিজের ভুল স্বীকার করেন নি। পরেও বারবার তিনি চন্দ্রশেখরের তত্ত্বকে আক্রমণ করেছেন। চন্দ্রশেখর অবশ্য তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় এই যে ১৯৪৪ সালে যখন চন্দ্রশেখর রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন, তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন এডিংটন। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেল। চন্দ্রশেখরের আবিষ্কারের তাৎপর্য বুঝতে বুঝতে আরোপ্রায় তিরিশ বছর গড়িয়ে যায়। অনেক বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক মনে করেন যে এর ফলে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান অন্তত দুই দশক পিছিয়ে গেছে।

১৯৩৫ সালের পরে চন্দ্রশেখর আরো বিভিন্ন 'বিষয়ে গবেষণা করেন। তিনি অবশেষে আমেরিকা চলে যান ও সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। শ্বেত বামনের সর্বোচ্চ ভরকে আমরা আজ চন্দ্রশেখর সীমা বলে নাম দিয়েছি। আমরা এও জানি যে শ্বেত বামন ও কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে আরো একটা স্তর আছে। যে সমস্ত তারাদের মোটামুটি তিন গুণের কম, সেগুলো জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে নিউট্রন তারাতে রূপান্তরিত হয়। চন্দ্রশেখর যখন গবেষণা করেছিলেন, তখন নিউট্রন আবিষ্কার হয়নি, তাই তীর পক্ষে সে সময় তাকে হিসাবে ধরা সম্ভব ছিল না। অবশেষে ১৯৮৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। উনিশ বছরের এক তরুণ জাহাজের ডেকে বসে যা ভেবেছিলেন, সেটাকেই নোবেল করিটি সেই তরুণের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব মনে করেছিলেন। হবেই তো, নক্ষত্রের শেষ পরিণতি কী হবে, তা আমাদের বুঝিয়েছিলেন চন্দ্র। তার চেয়ে বড়ো কাজ আর কী খুব বেশী হবে?

১৯৯৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। জীবনের প্রায় শেষ দিন পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের একজন বলে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯৯ সালে মহাকাশে উৎক্ষিপ্ত তাঁর নামাঙ্কিত চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি আজও মহাকাশ থেকে নানা খবর আমাদের কাছে পাঠাচ্ছে।

আর্থার এডিংটন
কেন এডিংটন এভাবে চন্দ্রশেখরকে আক্রমণ করেছিলেন তা আজও আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারিনি। নানা লোকে নানা মত দিয়েছেন। পরাধীন ভারতবাসীর কৃতিত্ব কি তাঁর সহ্য হচ্ছিল না? কেমব্রিজের আর এক অধ্যাপক হার্ডি অঙ্কের প্রতিভা শ্রীনিবাসন রামানুজনকে কেমন করে সাহায্য করেছিলেন তা আমাদের সকলের জানা। এডিংটন কিন্তু সেই উদাহরণ দেখাতে পারেন নি। বিজ্ঞানীরাও মানুষ, তাঁদেরও ভুলভ্রান্তি হয়, ব্যক্তিগত বিশ্বাস অনেক সময় বৈজ্ঞানিক যুক্তিকে ছাড়িয়ে ওঠে। এডিংটন জ্যোতির্পদার্থবিদ্যাকে পরিণত বিজ্ঞানে রূপান্তরিত করেন। তাঁর এই ব্যবহার বিজ্ঞানের ইতিহাসে কলঙ্কময় ঘটনাদের অন্যতম। বিজ্ঞানের সৌভাগ্য যে চন্দ্রশেখর নিজের জোরে এ মানসিক অবস্থা কাটিয়ে ওঠেন এবং আরো দীর্ঘ ষাট বছর বিজ্ঞানকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেন। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্পর্দার্থবিজ্ঞানীদের নাম করলে তার নাম কারোর পরে থাকবে না, এমনকি এডিংটনের পরেও নয়।



প্রকাশ : ফিনিক্স বৈশাখ ১৪১৭ (২০১১), পরিমার্জিত









Tuesday, 9 May 2017

রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান ভাবনা




রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানভাবনা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

(প্রথমেই একটা স্বীকারোক্তি করে নেয়া ভালো । আমি সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ নই, বিজ্ঞানের ছাত্র। রবীন্দ্রনাথ শেষ বিচারে লেখক। তাঁর অনুরাগী পাঠক হলেও লেখার সাহিত্য বিচার আমার পক্ষে ধৃষ্টতা। তাই তাঁর যে সমস্ত গল্পের পটভূমি বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেমন “তিনসঙ্গী” বা  “ল্যাবরেটরি”, তাদের বিশ্লেষণ এই লেখাতে নেই। অন্যদিকে আমি সমাজবিজ্ঞানীও নই, তাই রবীন্দ্রনাথের লেখার সমাজবিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণও আমার পক্ষে অনধিকারচর্চা। কিন্তু সমাজ-বিচ্ছিন্ন ভাবে বিশেষত প্রযুক্তি বিষয়ে আলোচনার চিন্তাও করা যায় না। তাই এই প্রবন্ধকে বিজ্ঞানের এক ছাত্রের ব্যক্তিগত মত হিসেবেই ধরে নিতে পাঠককে অনুরোধ জানাই )

(১)

সময়টা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক। সে সময় ভারত থেকে যাঁরা বিদেশে পড়তে যেতেন, তাঁরা প্রায় সবাই আইন পড়ে ব্যারিস্টার বা জজ হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। কয়েকজন হয়তো ডাক্তারি শেখার জন্য সাগর পাড়ি দিতেন। জগদীশচন্দ্র বা প্রফুল্লচন্দ্র দু দশক আগে মৌলিক বিজ্ঞানে পড়াশোনা করে দেশে ফিরে এসে গবেষণা করছেন। কিন্তু তাদের ব্যতিক্রম হিসাবেই দেখতে হবে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর বড়ো ছেলে রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর এক বন্ধুর ছেলে সন্তোষ মজুমদারকে আমেরিকাতে কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য পাঠান। তাঁরা দুজনেই ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। পরবর্তী কালে তাঁর ছোটো জামাই নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীকেও একই লক্ষ্যে সেখানেই পাঠিয়েছিলেন। কবির উদ্দেশ্য ছিল অত্যন্ত গদ্যময়: দেশে কৃষির উন্নতির মাধ্যমে খাদ্যসংকট দূর করা, বা সোজা কথায় বললে দেশের না খেতে পাওয়া মানুষের পেটে দুবেলা খাবার জোগানো। তিনি জানতেন তার জন্য প্রয়োজন আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি; সেটা করায়ত্ত করার জন্যই এঁদের বিদেশযাত্রাতে তাঁর উৎসাহ।
একথা অস্বীকার করা যায় না যে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক, অন্তত প্রথম দৃষ্টিতে, মিশ্র। তাঁর একটি বহুপঠিত কবিতা, “দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর”। অথচ এই একই রবীন্দ্রনাথ অন্য কথাও বলেছেন। বিদেশে দেওয়া “সাধনা” বক্তৃতামালাতে তিনি বলেছিলেন, “Steam andelectricity shall be our nerve and muscle”, অর্থাৎ বাষ্পশক্তি ও বিদ্যুৎ হবে আমাদের স্নায়ু ও পেশী। সভ্যতার চালিকাশক্তিটিকে চিহ্নিত করতে তিনি কোনো ভুল করেননি বা কবিসুলভ ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয়ে প্রাচীন কালে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন নি। অন্য এক সময় আইনস্টাইন সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন যে তিনি ও আইনস্টাইন দুজনেই নিশ্চিত যে আধুনিক শিল্পের উন্নতি মানুষের অগ্রগতির জন্য জরুরি। “সভ্যতার সংকট” প্রবন্ধে ইংরাজ শাসনের প্রতি তীব্র ধিক্কার বর্ষণের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সেই শাসনের স্থায়িত্ব যে প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে আছে, সে কথা ভোলেন নি। “যে যন্ত্রশক্তির সাহায্যে ইংরেজ আপনার বিশ্বকর্তৃত্ব রক্ষা করে এসেছে তার যথোচিত চর্চা থেকে এই নিঃসহায় দেশ বঞ্চিত।” ভারতের অবস্থার বিপরীতে কবি জাপান ও রাশিয়াতে যে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল, তার তুলনাও করেছেন।
তাহলে পরিণত বয়সে লেখা “মুক্তধারা” বা “রক্তকরবী'-র মতো নাটকে আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার উপর রবীন্দ্রনাথ যে আক্রমণ শানিয়েছেন, তাকে আমরা কোন চোখে দেখব? মুক্তধারা নাটকে যন্ত্ররাজ বিভূতির বিরুদ্ধে ধনঞ্জয়ের লড়াই কিন্তু স্পষ্টতই প্রযুক্তিসভ্যতার বিশু যখন বলে, “ওদের কাছে আমরা মানুষ নয়, কেবল সংখ্যা”, যখন মানুষের নাম হয় ৪৭ফ কিংবা ৬৯ঙ, তখন কি চার্লি চ্যাপলিনের “মডার্ন টাইমস” মনে পড়ে না?
আজীবন সুন্দরের পূজারী কবির এই ক্ষোভ একদিকে নগরসভ্যতার কুশ্রীতার বিরুদ্ধে। বিখ্যাত বিজ্ঞান ঐতিহাসিক জে ডি বার্নাল তাঁর ‘সায়েন্স ইন হিস্ট্রি” বইতে লিখেছেন, “Wealth had never been accumulated so easily; misery had never been so widespread and unmitigated by social defences. With all the new triumphs of engineering went a smoky dirtiness, drabness, and ugliness which no previous civilization could have produced. It was in this environment that science approached its present scale of activity and importance.” শিল্পবিপ্লবের  ফলে শহরগুলির এই ক্লেদাক্ত রূপ নিয়ে মার্কসও চিন্তা করেছিলেন। ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথও। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় মার্কসবাদী নন। কিন্তু যে আধুনিক প্রযুক্তিসভ্যতা মানুষকে শুধু উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে দেখে, তার অন্য সমস্ত পরিচয় যার কাছে গৌণ, যা প্রতিটি মানুষকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তাঁকে করতেই হয়েছে। আমার কাছে অন্তত সে প্রতিবাদ প্রযুক্তি নয়, ধনতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে। শেষ কথাটা যদি মনে হয় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, খুলুন “রক্তকরবী”-র প্রস্তাবনা । সেখানে সরাসরি রাজাকে কবি বলেছেন,“সোনার খনির মালিক”। ধনতন্ত্রকে এর চেয়ে সহজ করে আর কীই বা বলতে পারতেন? তাও পাছে আমরা ভুল করি, পরের অনুচ্ছেদে গ্রামের কৃষকদের টিটাগড়ের চটকলে মরতে আসার কথা বলেছেন। আর কতো স্পষ্ট করে কবি লিখবেন? উপরের উদ্ধৃতিটির শেষে বার্নাল আধুনিক বিজ্ঞানের বিকাশের যে পটভূমি এঁকেছেন, শিল্পবিপ্লব সৃষ্ট নগরসভ্যতার সেই ক্লেদের বিরুদ্ধে কবি সোচ্চার তিনি সংবেদনশীল, কিন্তু সমাজবিজ্ঞানী নন, তাই কখনো কখনো হয়তো তাঁর প্রতিবাদ পুঁজিবাদী শোষণের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির বিরুদ্ধেও গেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এমন একজন মানুষ যিনি সারা জীবন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। তাই প্রথম যৌবনের অরণ্যকে ফিরে পাওয়ার আকুতি পরবর্তীকালে অনুপস্থিত।
বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মত কী? এমন অনেকে আছেন যাঁরা বিশ্বাস করেন যে বিজ্ঞানীর কোনো সামাজিক দায় নেই। বিজ্ঞান গবেষণা করতে হবে শুধু বিজ্ঞানের জন্য: তার সামাজিক প্রয়োগ আছে কি না দেখার দায়িত্ব বিজ্ঞানের নয়। রবীন্দ্রনাথ এই মতের শরিক নন। ১৯২৫ সালে লেখা “চরকা” প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, “য়ুরোপীয় সভ্যতায় বিজ্ঞানচর্চার সামনে যদি কোনো বড়ো নৈতিক সাধনা থাকে সে হচ্ছে বাহ্যপ্রকৃতির হাতের সব রকম মার থেকে মানুষকে বাঁচানো, আর হচ্ছে মানুষের মনটাকে যন্ত্রে না বেঁধে প্রাকৃতিক শক্তিকেই যন্ত্রে বেধে সমাজের কাজ আদায় করা।“
প্রথম যৌবনের উচ্ছ্বাসের পরে রবীন্দ্রনাথ যে সরল জীবনে ফিরে যাওয়াতে আর বিশ্বাসী ছিলেন না, তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ হল গান্ধীজীর সঙ্গে তাঁর চরকা নিয়ে মনান্তর। দুজনের প্রতি দুজনের শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। কিন্তু গান্ধীজী যখন চরকাকে তাঁর পথের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করলেন; তখন তিনি কুটিরশিল্পকেই আধুনিক ভারত গড়ার চাবিকাঠি হিসেবে ধরে নেন। এই প্রচেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি “চরকা” প্রবন্ধেই লিখছেন, “বিজ্ঞানকে এক পাশে ঠেলে রেখে কেবল হাত চালিয়ে দেশের বিপুল দারিদ্র্য কিছুতে দূর হতে পারবে না। মানুষের জানা এগিয়ে চলবে না, কেবল তার করাই চলতে থাকবে, মানুষের পক্ষে এতো বড়ো কুলিগিরির সাধনা আর কিছুই নেই।” তাঁর স্পষ্ট মত: চরকা যে শুধু স্বরাজ আনার কঠোর সাধনাকে লঘু করে দিচ্ছে তা নয়, আধুনিক ভারত গড়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্যত্রও তিনি একই কথা লিখেছেন।
তবে একথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে মৌল বিজ্ঞান, অর্থাৎ যা সরাসরি প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত নয়, তাকে তিনি অবহেলা করতেন। বিমূর্ত বা মৌল বিজ্ঞানের সঙ্গে তার যোগাযোগ নিয়ে নিবন্ধের শেষ ভাগে আলোচনা করা যাবে। নানাভাবে রবীন্দ্রনাথের কাছে বিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞাননির্ভর গল্পের লেখকদের মধ্যে এইচ জি ওয়েলস যে সর্বকালের শ্রেষ্ঠদের মধ্যে জায়গা করে নেবেন, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর লেখা ওয়ার অফ দি ওয়ার্ল্ডস, ইনভিজিবল ম্যান বা টাইম মেশিন এখন চিরায়ত সাহিত্যের অঙ্গ । বিজ্ঞানের পথ আগামী দিনে কোনদিকে হবে সে বিষয়ে তাঁর  ভবিষ্যৎবাণী আশ্চর্যরকম মিলে যায়। সেই ওয়েলসের সঙ্গে ১৯৩০ সালে জেনেভাতে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, “Physical science of the nineteenth century probably has created the spirit of race superiority in the West. When the East assimilate the physical science, the tide may turn and take a normal course.” এখানেও তিনি স্পষ্টতই দেশের মানুষের কথা চিন্তা করছেন। দেশবাসীরা ভৌত বিজ্ঞান আত্মস্থ করতে পারলেই পশ্চিমের লোক তাদের নিচু নজরে দেখবে না, এই মত একটু অতি সরলীকৃত হতে পারে, কিন্তু দেশের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা এখানে স্পষ্ট। এর সঙ্গে তাঁর ছেলে বা জামাইকে বিদেশে কৃষিবিজ্ঞান শিখতে পাঠানোর কারণের যোগও আমরা খুঁজে পাই। শুধু দেশবাসীর জীবন জীবিকার উন্নতি নয়, তাদের জগৎসভায় মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্যও বিজ্ঞানশিক্ষা জরুরি ।
রবীন্দ্রনাথের জীবনকালের মধ্যেই ভারতীয় বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হয়েছে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা বা সত্যেন্দ্রনাথ বোসের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল। কলকাতাতে কাজ করলেও সি ভি রমনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনো সাক্ষাতের খবর আমার জানা নেই। কিন্তু জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে তার দীর্ঘ এবং গভীর বন্ধুত্বের কথা সকলেই জানেন। তার একটা কারণ যেমন ছিল জগদীশচন্দ্রের দেশপ্রেম, তেমনি রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর গবেষণা জাতীয় প্রগতির প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছিল। অনেক আর্থিক অসুবিধার মধ্যেও অকাতরে তাঁর গবেষণার জন্য অর্থের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এজন্য ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের সাহায্যপ্রার্থী হতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন নি। মহারাজকে লেখা তীর চিঠির একটি অংশ “জগদীশবাবুর জন্য আমি প্রত্যক্ষভাবে মহারাজের নিকট দরবার করিতে ইচ্ছুক - এজন্য আমি আগরতলা যাইতে প্রস্তুত।“ পরের মাসে সত্যিই তাকে আগরতলা যেতে হয়। মহারাজা যথাসাধ্য সাহায্য করেন।
জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার সম্পর্কে ১৯০১ সালে “জড় কি সজীব, নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন রবীন্দ্রনাথ। তা পড়ে স্বয়ং বিজ্ঞানীর প্রতিক্রিয়া, “তুমি যে গত মাসে আমার কার্যের আভাস বঙ্গদর্শনে লিখিয়াছিলে তাহা অতি সুন্দর হইয়াছে। তুমি যে এত সহজে ও বৈজ্ঞানিক সত্য স্থির রাখিয়া এরূপ সুন্দর লিখিতে পার, ইহাতে আমি আশ্চর্য হইয়াছি।” কবি যে সহজেই জটিল বিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন, সে বিষয়ে এর চেয়ে বড়ো সাক্ষ্য আর কী হতে পারে?

(২)
তবে এটিই রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক নিবন্ধ নয়। ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গদ্য রচনাই ছিল বিজ্ঞান বিষয়ে। বারো বছর বয়সে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে লেখা এই প্রবন্ধের নাম “গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি”। এখানে কিশোর লেখক অন্যান্য গ্রহে প্রাণীদের থাকার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। এর পরের কুড়ি বছরে বিভিন্ন পত্রিকাতে তিনি অন্তত আরো কুড়িটি বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা ছাপান। এর পূর্ণাঙ্গ তালিকা অধ্যাপক দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান বইটিতে আছে।  রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান বিষয়ে উৎসাহে তাঁর পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। কিন্তু যে সময় প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানশিক্ষা প্রায় অনুপস্থিত, বিজ্ঞান সংস্কৃতিও গড়ে ওঠেনি, সে সময় এই রচনাগুলি যে বিজ্ঞানে তাঁর উৎসাহের স্বাক্ষর দেয়, সে নিয়ে সন্দেহ নেই।
রবীন্দ্রনাথের একটি বইয়ের কথা আলাদা করে বলতেই হয়, তা হল “বিশ্বপরিচয়”। পরিণত বয়সে লেখা তাঁর এই বই আজও সম্ভবত সাধারণের জন্য বাংলা ভাষায় লেখা বিজ্ঞান গ্রন্থদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গা অধিকার করবে। রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথ সেনগুপ্তকে এই বইটি লেখার জন্য বলেছিলেন। তাঁর লেখা মনোমত না হওয়াতে নিজেই নতুন করে বইটি লেখেন। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিজ্ঞানে আগ্রহের ইতিহাস ও কারণ সম্পর্কে অনেক কথা লিখেছেন, আগ্রহী পাঠককে তা পড়ে নিতে অনুরোধ করি। আমরা লক্ষ্য করি যে বিজ্ঞানের সে সময়ের অতি আধুনিক আবিষ্কারও বইটিতে জায়গা করে নিয়েছে।
সেই সময় অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে অর্ধেক ইউরোপ ফ্যাসিবাদের কাছে নতজানু হয়ে শান্তি খুঁজছে। চারিদিকে বেজে উঠেছে আসন্ন যুদ্ধের দামামা। রবীন্দ্রনাথ অপর কয়েকজন মনীষীর সঙ্গে পৃথিবীর বিবেক হিসেবে পরিচিত। সেই সময়ের যন্ত্রণা ও জটিলতা তার সাহিত্যে প্রতিফলিত। সময়টাকে বুঝতে গেলে, বিশ্ব পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করতে গেলে যে বিজ্ঞানকে বুঝতে হবে: সেই বোধ থেকেই আমাদের দেশের মানুষের কথা ভেবে তাঁর “বিশ্বপরিচয়” রচনা। দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় তাঁর পূর্বোল্লিখিত বইতে এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
আমাদের অনেকের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের ভক্ত। তাঁকে আমরা গুরুদেব বলে ডেকে হয়তো নিজেদের অগোচরেই তাঁর লেখায় ধর্মের দিকটাতে বেশী গুরুত্ব আরোপ করি (যদিও তাঁর পরবর্তীকালের লেখায়, বিশেষত “নবজাতক'-এ অস্তিবাদের সঙ্কট সুস্পষ্ট) ৷ কিন্তু “বিশ্বপরিচয়”-এ গীতাঞ্জলির জীবনদেবতাকে তিনি স্থান দেননি । দেখা যাক জীবনের উৎস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কী বলছেন। “বিশ্বরচনার মূলতম উপকরণ পরমাণু: সেই পরমাণুগুলি অচিন্তনীয় বিশেষ নিয়মে অতি সূক্ষ্ম জীবকোষরূপে সংহত হল। ... (কোষের) প্রত্যেকের নিজের ভিতরেই একটা আশ্চর্য শক্তি আছে যাতে করে বাইরে থেকে খাদ্য নিয়ে নিজেকে পুষ্ট, অনাবশ্যককে ত্যাগ ও নিজেকে বহুগুণিত করতে পারে। এই বহুগুণিত করার শক্তি দ্বারা ক্ষয়ের ভিতর দিয়ে মৃত্যু ভিতর দিয়ে প্রাণের ধারা প্রবাহিত হয়ে চলে।” স্রষ্টা এখানে অনুপস্থিত; প্রাণ এখানে বিজ্ঞানের নিয়মে তৈরি। তাঁর সময়ের  থেকে আমরা এখন এ বিষয়ে অনেক বেশী জানি। কিন্তু সেই সময়েও রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত যে জীবনের উৎসের সন্ধান শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানই দেবে।
অপর একটি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ নজর দিয়েছিলেন যা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার জন্য অপরিহার্য -- তা হল বিজ্ঞানের পরিভাষা । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে তিনি এই বিষয়ক কমিটিতে যোগদান করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেই পরিভাষা যে সব সময় জনপ্রিয় হয়েছে তা নয়, কিন্তু উৎসুক পাঠক পরিভাষাগুলি বিবেচনা করলে দেখবেন যে সেগুলি তৈরি করতে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেছেন। আবারও “রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান থেকে একটা উদাহরণ নেয়া যাক। আমরা ইংরাজি solid শব্দের বাংলা করি কঠিন। কিন্তু কঠিন শব্দের সঙ্গে কাঠিন্য গুণটি যুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাতে কঠিন বস্তু বলতে আমরা ময়দার তালকে বুঝব না। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের বিচারে ময়দার তালও solid, তাই “বিশ্বপরিচয়”-এ রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছিলেন নিরেট। দেখতে পেলাম যে পরিভাষা তৈরি করতে তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দই ব্যবহার করতে কবে এমন কোনো ছুঁৎমার্গ তার ছিল না। সাধারণ মানুষের জন্য পরিভাষা তৈরি করতে দুরূহ শব্দ ব্যবহার না করাই ভালো, একথা আমরা কবে শিখব কে জানে ?
রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতেন। “বিশ্বপরিচয়” এর ভূমিকাতে তিনি লিখছেন, “ক্রমাগত পড়তে পড়তে মনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক একটা মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। অন্ধ বিশ্বাসের মূঢ়তার প্রতি অশ্রদ্ধা আমাকে বুদ্ধির উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে আশা করি অনেক  পরিমাণে রক্ষা করেছে।” শুধু বিজ্ঞানের তত্ত্ব বা তথ্য নয়, বিজ্ঞান যে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবনবোধ দেয়, সেদিকেই কবির নির্দেশ । বিহারে ১৯৩৪ সালে ভূমিকম্পের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরে গান্ধীজী তাকে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে ভগবানের শাস্তি হিসেবে বর্ণনা করেন। রবীন্দ্রনাথও অস্পৃশ্যতার তীব্র বিরোধী ছিলেন, কিন্তু বিজ্ঞানপ্রসূত জীবনবোধ থেকেই তিনি গান্ধীজীর এই উক্তির কঠোর সমালোচনা করেন।
তাঁর জীবন ও রচনাতে পাওয়া যাবে। বিশেষ করে “বনবাণী” কাব্যগ্রন্থটিতে পরিবেশ বিষয়ে তার যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় আছে, তার আলাদা উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিশ্বভারতীতে যে পদ্ধতিতে তিনি বিজ্ঞান শিক্ষা চালু করার চেষ্টা করেছিলেন, তা নিশ্চয় যারা শিক্ষা বিষয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের আলোচনার বিষয়। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে একটা কথাই বলতে পারি - রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান বিষয়ক সমস্ত চিন্তাধারার ঘুলে ছিল মানুষ, বিশেষ করে আমাদের দেশের সেই সব মানুষ যারা জীবনে পিছিয়ে পড়েছে।
(৩)
কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে যা নাড়া দেয়, তা হল মৌলিক বিজ্ঞান বিশেষত পদার্থবিজ্ঞান প্রসঙ্গে তাঁর স্বজ্ঞা বা intuition| প্রথাগত বিজ্ঞানশিক্ষা তাঁর ছিল না। আমরা সবাই জানি যে কলেজ দূরে থাক, স্কুলের পড়াও তিনি শেষ করেন নি। আধুনিক পদার্থবিদ্যা মূলত গণিতাশ্রয়ী। ঠাকুরবাড়িতে দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ অঙ্ক নামক বিষয়টিতে পণ্ডিত হলেও ভাইটি ওদিকটা এড়িয়েই চলতেন। তাই পদার্থবিদ্যা বিষয়ে তাঁর জ্ঞান সীমাবদ্ধ হতে বাধ্য। অসামান্য স্বজ্ঞা দিয়ে তিনি সেই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছিলেন।
জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল এবং বহু বই তিনি পড়েছেন। জীববিদ্যাতে আলফ্রেড ওয়ালেসের বিবর্তন সংক্রান্ত লেখা একসময় নিজে অনুবাদ করবেন ভেবেছিলেন। পাঠকদের মনে করিয়ে দিই, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের তত্ত্ব ওয়ালেস সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে আবিষ্কার করেন এবং তাঁর এ বিষয়ে লেখা ডারউইনের প্রবন্ধের সঙ্গে একই সময়ে প্রকাশিত হয়। বিবর্তন তত্ত্বের বৈপ্লবিক তাৎপর্য রবীন্দ্রনাথ কতোটা বুঝতে পেরেছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ আমার জানা নেহ। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে জটিল সমস্যা, আজ পর্যন্ত যার সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি, তার বিষয়ে কবি সচেতন ছিলেন। সেই পরিচয় আমরা পাই রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের মধ্যে সুপরিচিত এক কথোপকথনে।

দুজনের মধ্যে কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তার একটি ঘটেছিল ১৯৩০ সালের ১৪ই জুলাই তারিখে আইনস্টাইনের বাড়িতে। আইনস্টাইনের সৎ মেয়ে মার্গটের হবু স্বামী দিমিত্রি মারিয়ানফ তার একটি বিবরণ নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাতে প্রকাশ করেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় অমিয় চক্রবর্তীর নেওয়া নোট থেকে রবীন্দ্রনাথ অনুমোদিত বিবরণটি ছাপা হয়। দুটি বিবরণের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে, তবে আমরা তার মধ্যে যাব না। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস “সত্যের স্বরূপ” নাম দিয়ে তার অনুবাদ করেছিলেন, তার থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে আমরা আলোচনা করব। দৈর্ঘ্যের কারণে সাক্ষাৎকারটি সংক্ষেপিত করতে হয়েছে, তবে আশা করি তাতে আমাদের পরবর্তী আলোচনাতে কোনো বিভ্রান্তি আসবে না।
আ: সত্য ও সুন্দর, এই দুই’ই তবে মানব নিরপেক্ষ নয়?
র: না!
আ: মানুষ যদি না থাকে, তো বেলভিডিয়ারের আপোলোও সুন্দর থাকিবে না?
র: না!
আ: সুন্দরের বিষয়ে আমি আপনার সহিত একমত, কিন্তু সত্যের বিষয়ে নয়।
র: কেন? সত্যকে তো মানুষই উপলব্ধি করিতেছে?
আ: আমার মত যে অভ্রান্ত, তার প্রমাণ দিতে পারি না, কিন্তু এই বিশ্বাসই আমার ধর্ম।
র: সুন্দর, সে তো বিশ্বমানবের নিখুঁত আদর্শের মধ্যে; সত্য, সেও বিশ্বচেতনার অভ্রান্ত উপলব্ধিতে প্রকাশিত। ভুলভ্রান্তির মধ্য দিয়া আমরা প্রত্যেকে সেই উপলব্ধিতে পৌঁছিতে চাই, আমাদের পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতার মধ্যে আমাদের উদ্ভাসিত চেতনার মধ্যে তাহাকেই খুঁজি, তা ছাড়া অন্যভাবে কি করে সত্যকে জানিব?
আ: সত্য যে মানুষের অস্তিত্বের অপেক্ষা না রাখিয়াও সত্য ইহা আমি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রমাণ করিতে পারিব না, তবু তাই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। ...
র: ... অন্ততঃ যাহাকে বিজ্ঞানে সত্য বলিয়া বর্ণনা করি, বিচার মাগেই তো তাহার সাক্ষাৎ ঘটে। অর্থাৎ মানুষের মনরূপ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই তাহার জ্ঞান সম্ভব। ...
আ: আমাদের চেতনার অতীত সত্যের অস্তিত্ব আছে কি না, বস্তুতঃ সেইখানেই সমস্যার আরম্ভ।
আরো কিছুক্ষণ পরে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “মানুষের সহিত সম্পর্করহিত কোন সত্য থাকিলেও, তাহা মানুষের পক্ষে না থাকার সামিল। ... মানুষের অনুভূতি কিংবা যুক্তির সহিত সম্পর্কমাত্র রহিত সত্যের অস্তিত্ব থাকিলেও, যতদিন আমরা মানুষধর্মী ততদিন তাহা আমাদের কাছে নাস্তির পর্যায়েই থাকিবে।”
এই কথোপকথন সম্পর্কে বিজ্ঞানী ইলিয়া প্রিগোজিনের একটা মন্তব্য শুনে নেব। “The question of the meaning of reality was the central subject of a fascinating dialogue between Einstein and tagore. Einstein emphasized that science had to be independent of the existence of any observer ... On the contrary, Tagore maintained that even if absolute truth could exist, it would be inaccessible to the human mind. Curiously enough, the present evolution of science is running in the direction stated by the great Indian poet.” সহজ কথায়, আইনস্টাইন দর্শক নিরপেক্ষ সত্য বা বাস্তবতাতে বিশ্বাস করেন, আর রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে সেরকম কোনো পরম সত্য থাকলেও তা মানবমনের গোচর হয় না। প্রিগোজিন মন্তব্য করছেন যে বিজ্ঞানের বর্তমান ধারা কবিকেই সমর্থন করছে।
প্রিগোজিনের একটু পরিচয় দেয়া হয়তো প্রয়োজন। ১৯৭৭ সালে রসায়নে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি একালের একজন সেরা চিন্তানায়কও বটে। (সচেতন ভাবেই বুদ্ধিজীবি শব্দটি ব্যবহার করলাম না, কারণ আমাদের দেশে বিজ্ঞানীকে বুদ্ধিজীবি মনে করা হয় না।) নৈরাজ্য তত্ত্ব বা chaos theory-র মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানে আমাদের বহু সযত্ন লালিত প্রাচীন ধারণাকে পাল্টে দিয়েছেন। এমন একজন মানুষ যখন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেন, তা আমাদের ভাবায় বৈকি। আর এক নোবেলজয়ী পদার্থবিদ ব্রায়ান জোসেফসনও রবীন্দ্রনাথকেই সমর্থন করেছেন।
এখন দেখা যাক এই আলোচনার বৈজ্ঞানিক পরিপ্রেক্ষিত কী ছিল। আধুনিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্ম হয়েছিল ১৯২০-র দশকের মাঝামাঝি। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ও এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার তার জন্মদাতা, নিলস বোর তার পালক পিতা। এই  তত্ত্বের সবচেয়ে পরিচিত ব্যাখ্যা অনুসারে পর্যবেক্ষক নিরপেক্ষ সত্য বা বাস্তবের কোনো অস্তিত্ব নেই। কথাটা একটু দর্শনের মতো শোনালেও তা পরীক্ষাগারে প্রমাণিত। ধরা যাক একটা পর্দার উপর একটা একটা করে ইলেকট্রন ছোঁড়া হচ্ছে।পর্দার মধ্যে দুটো গর্ত আছে। সাধারণ বুদ্ধি বলে যে একটা ইলেকট্রন একই সময়ে একটা গর্তের মধ্যে দিয়ে যাবে। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে যে যতক্ষণ আমরা ইলেকট্রনটা কোথা দিয়ে যাচ্ছে দেখার চেষ্টা না করব, ততক্ষণ সেটা এক সঙ্গে দুটো গর্তের মধ্যে দিয়েই যাবে। পরীক্ষাও তাকে সমর্থন করে ! অর্থাৎ আমরা যতক্ষণ দেখতে চাইব না, ততক্ষণ ইলেকট্রনের কোনো নিদিষ্ট অবস্থান নেই। শুধু ইলেকট্রন নয়, অণু পরমাণু সমস্ত মৌলিক কণা, সকলের জন্যই এটা সত্য। আমরা দেখতে চাইলে তখন ইলেকট্রন কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় আমাদের কাছে ধরা দেবে, নচেৎ নয়। কোথায় তাকে আমরা পাব, তা আগে জানার কোনো উপায় নেই কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা, সেটা বলা সম্ভব। শুধু অবস্থান নয়; বেগ, ঘূর্ণন ইত্যাদি সমস্ত ধর্মের জন্য এটা সত্য। যেমন না মাপা পর্যন্ত কণার কোনো নিদিষ্ট বেগ থাকে না, মাপার ফলেই তার নির্দিষ্ট মান প্রকাশ পায়।
পর্যবেক্ষণ না করা পর্যন্ত কণার কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান নেই, অর্থাৎ পর্যবেক্ষকের উপর বাস্তবতা নির্ভর করছে। শ্রয়ডিঙ্গার এই প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন এই বিশ্ব আমাদের অনুভূতি ও স্মৃতির সৃষ্টি। এর নিজস্ব অস্তিত্ব আছে বলে ধরলে আমাদের সুবিধা হয়, কিন্তু শুধুমাত্র অস্তিত্বের মাধ্যমেই এর প্রকাশ ঘটে না। কোয়ান্টাম তত্ত্বের অন্যতম জন্মদাতা হয়েও আইনস্টাইন বলবিদ্যার এই অনির্দিষ্টতাকে কখনো মেনে নিতে পারেননি । চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের সমস্ত ধ্যানধারণার বিরোধী এই কোয়ান্টাম বাস্তবতা প্রসঙ্গেই আলোচনা করছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন ।
একথা ভেবে আশ্চর্য লাগে যে অনেক বিজ্ঞানী যখন এই নতুন বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারেন নি, তখন রবীন্দ্রনাথ কেমন করে তার মুল ভাবনা উপলব্ধি করেছেন এবং আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীর সামনে তা দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করছেন। একই চিন্তাভাবনা আছে ছ'বছর পরে লেখা “শ্যামলী” কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত “আমি” কবিতাটিতে।
আমারি চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, 
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, সুন্দর,
সুন্দর হল সে।
দর্শক না থাকলে পান্না চুনির রঙ নেই, নেই আলো। পরের পংক্তিগুলিতে কবি বলেই দিচ্ছেন যে তিনি বিজ্ঞানের সত্যকেই প্রকাশ করছেন।
তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা,
এ কবির বাণী নয়।
আমি বলব, এ সত্য;
তাই এ কাব্য ।

প্রসঙ্গত বলে রাখা যাক যে এই অনির্দিষ্টতা কিন্তু ভাববাদকে প্রতিষ্ঠা করে না। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বস্তুবাদী ব্যাখ্যা সম্ভব। ডেভিড বোহ্‌ম তা করে দেখিয়েছেন -- কিন্তু তা অনেক পরের ঘটনা ।
শুধু আইনস্টাইন নন; কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম স্রষ্টা হাইজেনবার্গ ও অপর এক বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড সমারফেল্ড ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভারতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল জানা যায় নি। ফ্রিজফ কাপরা একজন পদার্থবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের দার্শনিক। তাঁর “Uncommon Wisdom” বইতে তিনি লিখেছেন যে হাইজেনবার্গ তাঁকে এই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে জানান, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বিজ্ঞান ও ভারতীয় দর্শন নিয়ে আলোচনা হয়। হাইজেনবার্গ মন্তব্য করেন, “After these conversations with Tagore some of the iodeas that seemed so crazy suddenly made much more sense. That was a great help to me.” দুঃখের বিষয় যে এই আলোচনা চিরকাল আমাদের অজানাই থেকে যাবে। আমরা কখনোই আর জানতে পারব না কোন ধারণাই বা বিজ্ঞানীর কাছে পাগলামি মনে হচ্ছিল, আর কবিই বা তাঁকে কেমন করে তার সারবত্তা বোঝান। মৌল বিজ্ঞান বা তার দর্শন প্রসঙ্গে কবির এই দখল এককথায় তাঁর স্বজ্ঞার প্রকাশ।
তথ্যসূত্র:
রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতিগুলি পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত রচনাবলী থেকে সংকলিত । আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকারের সত্যেন্দ্রনাথ কৃত অনুবাদটি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রকাশিত “সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন” থেকে গৃহীত। অন্যান্য বহু তথ্য ও আলোচনার জন্য আমি আনন্দ প্রকাশিত দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের “রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান” বইটির কাছে ঋণী।

(প্রকাশ: নিশিত সাহিত্যপত্রিকা, ডিসেম্বর, ২০১০, পরিমার্জিত)
























Friday, 5 May 2017

গুহাচিত্র

         জীবনে অনেক অদ্ভুত কাজ করেছি, তার মধ্যে একটা হল একটা ভূতের গল্প লেখা। সেটা বেরিয়েছিল ম্যাজিক ল্যাম্প ওয়েব ম্যাগাজিন জুলাই ২০১৬  সংখ্যায়। তার লিঙ্কটা নিচে দিলাম। অলঙ্করণ করেছিলেন পুষ্পেন মণ্ডল।  
অবিশ্বাসী লোকে ভূতের গল্প লিখছে -- এর পিছনে কি তেনাদের হাত আছে? কে জানে।
গুহাচিত্র
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

উপরের লিঙ্কে ক্লিক করলে ওয়েব ম্যাগাজিনে পড়া যাবে। 

Wednesday, 3 May 2017

বিনায়ক দত্তরায়ঃ শ্রদ্ধাঞ্জলি






















Monday, 1 May 2017

ইবন আল হাইথাম

আলোকবিজ্ঞানী ইবন আল হাইথাম      
     গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়                
                       
     রাষ্ট্রসংঘ গত বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালকে আন্তর্জাতিক আলোক ও আলোক নির্ভর প্রযুক্তি বর্ষ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। আলোর গুরুত্ব কাউকে আলাদা করে নিশ্চয় বুঝিয়ে বলতে হবে না। বাইরের জগত সম্পর্কে যে ইন্দ্রিয় আমাদের সবচেয়ে বেশি খবর দেয় তা হল চোখ। বিজ্ঞানের ভাষায় চোখ হল আলোক-সংবেদী অঙ্গ, বাইরের কোনো বস্তু থেকে আলো এসে আমাদের চোখে পড়লে আমরা তাকে দেখতে পাই। ২০১৫ সালকে আন্তর্জাতিক আলোক বর্ষ হিসাবে পালন করার প্রস্তাব আসে ২০১২ সালে।  ঘানা ও মেক্সিকোর আনা সেই প্রস্তাব নানা ধাপ পেরিয়ে ২০১৩ সালে রাষ্ট্রসংঘে গৃহীত হয়। আমরা জানি ঘানা দেশটা আফ্রিকা মহাদেশে আর মেক্সিকো উত্তর আমেরিকায়। আলোর সমস্ত গুরুত্ব মেনে নিয়েও একটা প্রশ্ন হয়তো মনে আসে, হঠাৎ করে ২০১৫ সালকেই আন্তর্জাতিক আলোক ও আলোক প্রযুক্তি বর্ষ বলে বেছে নেওয়ার কথা পরষ্পরের থেকে এত দূরের এই দুই দেশের প্রতিনিধিদের মনে এসেছিল কেন?
২০১৫ সালে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনার হাজার বছর পূর্ণ হল। ১০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল আলোক বিষয়ে মধ্যযুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।  ১৭০৪ সালে আইজাক নিউটনের ‘অপটিক্স’ অর্থাৎ আলোকবিদ্যা প্রকাশের আগে পর্যন্ত, আলোকবিজ্ঞানে গ্রিক বিজ্ঞানী টলেমির লেখা ‘আলমাগেস্ট’-কে বাদ দিলে, অধিকাংশ বিজ্ঞানীর কাছেই এই বইটির কদর ছিল অন্য সবার থেকে বেশি। কী নাম ছিল ১০১৫ সালে প্রকাশিত বইটির? লেখকই বা কে? ইউরোপে তখন বিজ্ঞানের সমস্ত বই লেখা হত লাতিন ভাষায়। এই বিশেষ বইটির লেখক ইউরোপে পরিচিত ছিলেন আলহাজেন নামে। তবে ইরোপে বইটি পৌঁছোতে সময় লেগেছিল প্রায় দুশো বছর। মূল বইটি তাহলে কী ভাষায় লেখা?
মূল বইটির নাম ছিল ‘কিতাব-আল-মঞ্জির’। আরবি ভাষায় লেখা বইটি লিখেছিলেন সুপরিচিত বিজ্ঞানী আবু আল হাসান ইবন আল হাসান ইবন আল হাইথাম, সংক্ষেপে আল হাইথাম নামে যিনি বিজ্ঞানের ঐতিহাসিকদের কাছে পরিচিত। আল হাইথাম সারা জীবনে দুশোর বেশি বই লিখেছিলেন বলে কথিত আছে  যার মধ্যে পঞ্চাশের বেশি আমাদের কাছে এসে পৌঁছোছে।  আলোকবিদ্যা ছাড়াও গতিবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয় আমরা তাঁর লেখা থেকে পাই। 
Book of Optics Cover Page.jpg
কিতাব-আল-মঞ্জিরের প্রথম পাতা

আল হাইথামের জন্ম হয়েছিল ৯৬৫ সালে বসরায় বর্তমানে যা ইরাকের অন্তর্গত। খলিফা আল হাকিমের আমলে আল হাইথাম তাঁর রাজধানী কায়রোতে যান। কায়রোতেই আজহার মসজিদের কাছেই তাঁর জীবনের সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছিল, তাঁর অধিকাংশ গবেষণা সম্পূর্ণ হয়েছিল। মধ্যযুগের সবচেয়ে বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল-আজহার এই মসজিদের সঙ্গে যুক্ত। ৯৭০ সালে মাদ্রাসা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে তা এক পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে একাদিক্রমে চালু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানদের তালিকায় সবচেয়ে পুরানো নাম আল আজহার। হাইথামের জীবন সম্পর্কে নানা গল্প শোনা যায় যদিও সে নিয়ে আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। কায়রোতেই ১০৪০ সালে আল হাইথামের জীবনাবসান হয়। 
বিজ্ঞানের ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন আল হাইথামের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল পরীক্ষামূলক বিষয় হিসাবে বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা। মধ্যযুগে ইঊরোপীয় বিজ্ঞানে পরীক্ষানিরীক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন রজার বেকন (১২২০-১২৯২)। কিন্তু তাঁর দুশো বছরেরও বেশি আগে আল হাইথাম আরব বিজ্ঞানে পরীক্ষামূলক পদ্ধতি চালু করেন। কিতাব-আল-মঞ্জির সাত খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডেই তিনি বুঝিয়ে দেন আলোক বিষয়ে নিজের করা নানা পরীক্ষার ফল তাঁর বইতে পাওয়া যাবে। পরীক্ষা করে যা পাওয়া যাবে না, তা তিনি লিখবেন না।যে তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই, তা নিয়ে তিনি চিন্তিত নন।
আলোক বিষয়ে পূর্বসূরী অনেক বিজ্ঞানীর মত তিনি আলোচনা করেছিলেন, কখনো কখনো তা ভুল বলে প্রমাণও করেছিলেন। প্লেটো টলেমি বা ইউক্লিডের মত বিজ্ঞানীরা মনে করতেন চোখ থেকে আলো বেরিয়ে কোনো বস্তুতে পড়লে তাকে আমরা দেখতে পাই। আল হাইথামই প্রথম বলেন যে বস্তু থেকে আলো এসে চোখের রেটিনাতে পড়ে ও স্নায়ু মারফত মস্তিষ্কে পৌঁছোয়। আরও নানা বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি বলেছিলেন যে আলো যখন বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে যায়, তখন তার বেগ পালটে যায়। আলোকে তিনি কণিকার স্রোত বলে মনে করতেন।
বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায়, বিশেষ করে গণিতে, আল হাইথামের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর করা অনেক গবেষণা হারিয়ে গিয়েছিল, পরে আবার তা পুনরাবিষ্কৃত হয়। যেমন অষ্টাদশ শতাব্দির বিজ্ঞানী জন উইলসনের নামে একটি পরিচিত উপপাদ্য আছে যা আসলে প্রথম প্রমাণ করেন ইবন আল হাইথাম। এ সব সত্বেও অধিকাংশ বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক তাঁকে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের প্রথম  যুগের প্রবক্তা হিসাবে মনে রাখেন। তাইতো কিতাব-আল-মঞ্জিরের প্রকাশকালের সহস্র বর্ষপূর্তি সমস্ত পৃথিবীতে পালিত হয়েছে।

 (ইদ উৎসব ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত)
 

সাধারণ আপেক্ষিকতা

সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের শতবর্ষ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় 

            এই বছর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের (General Theory of Relativity)  একশো বছর পূর্ণ হল। ঠিক এক শতাব্দী আগে ১৯১৬ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর এই তত্ত্বের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। ঘটনাক্রমে বছরই তাঁর সেই তত্ত্বের একটা ভবিষ্যৎ বাণী পরীক্ষাগারে প্রথমবার প্রমাণিত হয়েছে। বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে আইনস্টাইনের তত্ত্বটি বেশ দুরূহ। তবে অঙ্কের জটিলতাকে দূরে সরিয়ে রেখে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি বোঝা হয়তো সম্ভবএই লেখায় আমরা সেই চেষ্টাই করব।
            এক কথায় বলতে গেলে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ হল মহাকর্ষ বা মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব। স্কুলে আমরা সবাই আইজ্যাক নিউটনের মাধ্যাকর্ষণের সূত্র পড়েছি। নিউটন বলেছিলেনব্রহ্মাণ্ডের যে কোনো দুটি বস্তু পরষ্পরকে আকর্ষণ করে। যদি দুটি বস্তুর ভর যথাক্রমে m M, এবং তাদের মধ্যে দূরত্ব r হয়, তবে তাদের মধ্যে এই আকর্ষণ বলের মান হল
F = GmM/r2
এখানে G হল নিউটনের মহাকর্ষীয় ধ্রুবক।
            নিউটনের এই সূত্র বিজ্ঞানে তথা সমাজে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলার গ্রহ উপগ্রহ ধূমকেতুদের গতিবিধি সংক্রান্ত নিয়মগুলি আবিষ্কার করেছিলেন। নিউটনের সূত্রের সাহায্যেই প্রথম সেগুলিকে ব্যাখ্যা করা গেল। একই সঙ্গে এই সূত্র যে কোনো বস্তু উপর থেকে মাটির দিকে কেমনভাবে পড়ে তা দেখিয়ে দিল। প্রায় দুহাজার বছর ধরে আরিস্টটল বিজ্ঞান সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। তাঁর তত্ত্বে গ্রহ নক্ষত্ররা ছিল অপরিবর্তনশীল, মাটির পৃথিবীর নিয়মের ঊর্ধ্বে। সে সময়ের কায়েমি স্বার্থ আরিস্টটলের মতকে খুব পছন্দ করত, কারণ যে কোনো রকম পরিবর্তন, তা সমাজ ধর্ম বা রাজনীতিযে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, তার বিরোধিতাতে তাকে ব্যবহার করা যেত। সচেতনভাবে প্রকাশ্যে আরিস্টটলের তত্ত্বের বিরোধিতা যাঁরা প্রথম করেছিলেন, গ্যালিলিও তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। রোমান ক্যাথলিক চার্চের কোপে পড়ে তাঁর কী দশা হয়েছিল, তা আমাদের সকলের জানা।   
            গ্যালিলিওর মৃত্যুর এক বছর পর নিউটনের জন্ম। তিনি দেখালেন যে পৃথিবী আর আকাশের জ্যোতিষ্করা একই নিয়ম মেনে চলে। প্রোটেস্টান্ট ইংল্যাণ্ডে নিউটনকে অবশ্যই গ্যালিলিওর  মতো বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়নি। তবু নিউটনের নিজের কথা থেকেই জানা যায় যে আবিষ্কারের পর দীর্ঘকাল তিনি তাঁর সূত্র প্রচারের চেষ্টা করেন নি, কিন্তু সেটা একান্তই নিউটনের নিজস্ব খেয়ালিপনা। অনুজপ্রতিম বন্ধু এডমণ্ড হ্যালির উৎসাহে নিউটন তাঁর তত্ত্বকে সাধারণের গোচরে আনেন। হ্যালি নিজে নিউটনের সূত্র ব্যবহার করে দেখান যে অনেক ধূমকেতু প্রকৃত পক্ষে আমাদের কাছে কাছে বারবার ফিরে আসে। তিনি বলেছিলেন ১৬৮২ সালে যে ধুমকেতুটি দেখা গিয়েছিল, তা কমবেশি সাতাত্তর বছর পর পর ফিরে আসে। তাকে আবার পৃথিবী থেকে দেখা যাবে ১৭৫৯ সালে। ধূমকেতু যথা সময়ে দেখা দিয়েছিল, যদিও তা দেখার জন্য নিউটন বা হ্যালি কেউই তখন জীবিত ছিলেন না।  হ্যালির  সম্মানে আমরা সেই ধূমকেতুকে তাঁর নামে ডাকি  


Portrait of man in black with shoulder-length, wavy brown hair, a large sharp nose, and a distracted gaze Edmond Halley 072.jpg
 নিউটন            এডমণ্ড হ্যালি
     এত সমস্ত সাফল্যের মধ্যেও নিউটনের তত্ত্ব নিয়ে দুটো সমস্যা ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জ্যোর্তিবিদরা সৌরজগতের গ্রহদের দিকে দূরবিন তাক করে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছিলেন এবং নিউটনের সূত্র ব্যবহার করে অঙ্ক কষে মেলাচ্ছিলেন। সৌরজগতে বাকি সব গ্রহের হিসাব মিলে গেলেও জ্যোর্তিবিজ্ঞানী লে ভেরিয়ের ১৮৪০ সাল নাগাদ লক্ষ্য করেন যে বুধের কক্ষপথের ক্ষেত্রে নিউটনের তত্ত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণের একটা তফাত রয়ে যাচ্ছে তফাতটা খুব সামান্য, কিন্তু নিউটনের উপর বিজ্ঞানীদের তখন এতটাই অগাধ বিশ্বাস যে তাঁরা এটুকু গণ্ডগোলও মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। ইউরেনাস গ্রহ আবিষ্কারের পর যখন দেখা গেল তার চলাফেরা অঙ্ক কষে মেলানো যাচ্ছে না, তখন লে ভেরিয়ের মনে করেছিলেন যে অজানা কোনো এক গ্রহের আকর্ষণ এঁর জন্য দায়ী। তিনি হিসাব করে বলেছিলেন আকশের কোন দিকে গ্রহটাকে পাওয়া যাবে। জোহান গটফ্রিড গ্যালে নামে অপর এক জ্যোর্তিবিদ সেই মতো নতুন গ্রহ নেপচুনকে খুঁজে বার করেন। একই রকম ভাবে বুধ নিয়ে সমস্যা মেটাতে কোনো কোনো বিজ্ঞানী তখন ভেবেছিলেন যে সূর্যের আরও কাছে একটা গ্রহ আছে, কিন্তু সূর্যের ঔজ্জ্বল্যের জন্য তাকে দেখা যায় না। তার আকর্ষণের জন্যই বুধের চলাফেরার হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। এই অদেখা গ্রহের নাম দেয়া হয় ভালকান। তবে শত চেষ্টাতেও ভালকানের দেখা মিলল না। সমস্যা সমাধানের আরও নানা রকম চেষ্টা  হয়েছিল, কিন্তু কোনোটাই কাজে আসেনি।
            অপর সমস্যাটা তখনই বোঝা যায়নি। আমরা জানি সূর্য পৃথিবী থেকে প্রায় পনের কোটি কিলোমিটার দূরে। আমরা এও জানি যে শূন্যে আলোর বেগ প্রতি সেকেণ্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার। আলো সূর্য থেকে পৃথিবী পর্যন্ত আসতে সাড়ে আট মিনিট মত সময় নেয়। তাই যদি এই মুহূর্তে সূর্য নিভে যায়, আমাদের তা বুঝতে সময় লাগবে সাড়ে আট মিনিট। কিন্তু যদি সূর্য কোনো কারণে হঠাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়? পৃথিবী সহ সমস্ত গ্রহেরা সূর্যের মাধ্যাকর্ষণের টানে বাঁধা পড়ে আছে, সূর্য না থাকলে তারা সবাই ছিটকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু কখন? নিউটনের তত্ত্ব অনুযায়ী সূর্য নিশ্চিহ্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী তার টান থেকে ছাড় পেয়ে যাবে --একেবারেই সময় লাগবে না। টেকনিকাল কথায় বললে নিউটনের তত্ত্ব হল action at a distance তত্ত্ব-- যা ঘটে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত জায়গায় তার প্রভাব পড়ে। এটা মেনে চললে সূর্য নিশ্চিহ্ন হলে সেই খবর মহাবিশ্বের সর্বত্র একই সময়েই পৌঁছে যাবে। এটা কল্পনা করা একটু শক্তআমার ঘরের কাছের খবর আমি যখন পাব, একই সঙ্গে সবচেয়ে দূরের ছায়াপথেও তা যাবে আবার হয় নাকি?       
            তবে action at a distance তত্ত্বের ক্ষেত্রে সমস্যাটা প্রকৃতপক্ষে আরও জটিল ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (Theory of Special Relativity) প্রকাশ করেন। এখানে তিনি দেখান যে স্থান কাল আলাদা বা পরষ্পর বিচ্ছিন্ন নয়। আমরা কোনো বস্তুর অবস্থান বোঝাতে তিনটে মাত্রা ব্যবহার করি। সময়কে আমরা আলাদা ভাবে মাপি। আইনস্টাইন দেখালেন যে এরা সবাই মিলে এক চতুর্মাত্রিক জগৎ সৃষ্টি করে যাকে আমরা বলি দেশকাল। এই তত্ত্বেই তাঁর সেই বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2 প্রথম খুঁজে পাওয়া যাবেঅর্থাৎ ভর শক্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আইনস্টাইন ধরে নিয়েছিলেন শূন্যস্থানে আলোর বেগ পর্যবেক্ষক নিরপেক্ষ খুব জটিলতার মধ্যে না গিয়ে একটা সিদ্ধান্ত আমরা এখান থেকে খুঁজে পেতে পারিশূন্যস্থানে আলোর থেকে দ্রুত কোনো কিছু যেতে পারে না। তাহলে সূর্য ধ্বংসের খবরটা সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে আসতে পারে না, তার জন্যও অন্তত সাড়ে আট মিনিট সময় লাগবে। সূর্য জ্বলছে কিনা সে খবরটা আমাদের কাছে এনে দেয় আলো। সূর্য নিশ্চিহ্ন হওয়ার খবরটা খবরটা তাহলে কে বয়ে নিয়ে আসবে? নিউটনের তত্ত্ব বিষয়ে নিরুত্তর।     
            নাম থেকেই বোঝা যায় যে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ বিশেষ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সব সময় নয়। সোজা ভাষায় বললে যদি বস্তুর বেগ না পাল্টায় তাহলে তার গতিবিধি বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু যদি বেগ একই না থাকে? যদি একটা পাথরের টুকরোকে উপরে তুলে ছেড়ে দিই, তাহলে তা পৃথিবীর দিকে পড়বে তো বটেই, যতক্ষণ ধরে পড়বে তার বেগও ততক্ষণ বাড়তে থাকবে। এই রকম বেগ পরিবর্তনকে আমরা বলি ত্বরণ। আইনস্টাইন এই ধরণের বেগ নিয়ে চিন্তা করছিলেন। তাঁর সেই ভাবনার ফলই হল সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ।
            বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের সবটাই আইনস্টাইন প্রায় এক সঙ্গে প্রকাশ করেছিলেন। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ কিন্তু তাঁর দীর্ঘ পাঁচ বছরের পরিশ্রমের ফসল। এর জন্য তাঁকে অঙ্কশাস্ত্রের একটা বিষয় শিখতে হয়েছিল। তাঁকে সেই tensor calculus শিখিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু গণিতবিদ মার্সেল গ্রসম্যানসেই ইতিহাসে না গিয়ে সংক্ষেপে দেখা যাক শেষ পর্যন্ত আইনস্টাইন কোথায় পৌঁছোলেন।


Einstein 1921 by F Schmutzer - restoration.jpg   ETH-BIB-Grossmann, Marcel (1878-1936)-Portrait-Portr 01239.tif (cropped).jpg
আইনস্টাইন             মার্সেল গ্রসম্যান
            আইনস্টাইন দেখলেন যে মাধ্যাকর্ষণ এবং ত্বরণসম্পন্ন গতিকে একই নিয়মে বাঁধা যায় সেই নিয়মই হল সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নিউটনের তত্ত্বে মাধ্যাকর্ষণ হল একটা বল নতুন তত্ত্বে মহাকর্ষ বল নয় -- দেশকালের বিকৃতি। এই বিষয়টা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। নিউটনের প্রথম গতিসূত্র অনুসারে বস্তুর উপর বল প্রয়োগ না করলে সে সমবেগে সরলরেখায় চলতে থাকবে। আমরা জানি পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। সূর্যের আকর্ষণ বল তাকে সরল রেখায় যেতে দেয় না, এই ছিল নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের কথা। আইনস্টাইন দেখালেন যে পৃথিবী আসলে সোজা রাস্তায়ই যাচ্ছে, কিন্তু সূর্যের টানে সোজা রাস্তাটাই গেছে বেঁকে। যে বস্তুর ভর যত বেশি, তার দেশকালকে বিকৃত করার ক্ষমতাও বেশি। ধরুন একটা রবারের পর্দা টানটান করে অনুভূমিক ভাবে বেঁধে রেখেছি। আমরা যদি একটা হালকা মার্বেলের গুলি নিয়ে গড়িয়ে দিই, সেটা ঠিক সরলরেখা বরাবর যাবে। এবার পর্দার ঠিক মাঝখানে একটা ভারি বাটখারা রেখে দিলাম। আমরা দেখব যে এবার মার্বেলের গুলিটা বাটখারাটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার দিকে বেঁকে গেল। তার মানে কি  বাটখারা আর গুলির মধ্যে আকর্ষণ বল কাজ করছে? তা নয়, বাটখারা পর্দাকে বাঁকিয়েছে, গুলিটা সেই বাঁকা পথ অনুসরণ করছে। ঠিক তেমনি ভর (বা শক্তি) তার আশেপাশে দেশকালকে বাঁকিয়ে দেয়, সেই দেশকালের বক্রতার জন্য অন্য বস্তুর পথ বেঁকে যায়। আমাদের মনে হয় আকর্ষণ বল কাজ করছে। শেষ বিচারে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে আমরা জ্যামিতি বলতেই পারি, তবে এই জ্যামিতি আমরা স্কুলে যে ইউক্লিডিয় জ্যামিতি পড়েছি তার থেকে আলাদা। এখানে সমান্তরাল রেখারা মিলে যেতে পারে, ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি একশ আশি ডিগ্রির চাইতে কম বা বেশি হতে পারে। যে বস্তুর ভর বা শক্তি যত বেশি, তার আশপাশের দেশকালকে বক্র করার ক্ষমতাও তত বেশি।   


 Spacetime Curvature
সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ অনুসারে পৃথিবীর কাছে দেশকাল (চিত্রঃ NASA)

            তাহলে কি নিউটন ভুল? একজন পুরোপুরি ঠিক, অন্যজন পুরোপুরি ভুল -- বিজ্ঞান এভাবে এগোয় না। আইনস্টাইন দেখালেন যে মহাকর্ষ ক্ষেত্রের মান যদি খুব বেশি না হয়, তাহলে তাঁর এবং নিউটনের হিসাবের কোনো পার্থক্য হয় না বললেই চলে। এক মাত্র যেখানে মাধ্যাকর্ষণ খুব জোরালো,  সেখানেই আমরা দুই তত্ত্বের মধ্যে তফাত খুঁজে পাব। তেমনই এক জায়গা হল সূর্যের আশপাশ, সেখানে মহাকর্ষ ক্ষেত্রের মান বেশি। বুধ সূর্যের খুব কাছে আছে, তাই বুধের কক্ষপথের হিসাব নিউটনের সূত্র থেকে মেলে না। আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে বুধের কক্ষপথের হিসাব ঠিকঠাক মিলে গেল।    
            সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ আরও অনেকগুলি ভবিষ্যৎ বাণী করে। কিন্তু ১৯১৬ সালের প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের মধ্যে একটাই মাত্র মিলিয়ে দেখা সম্ভব ছিল। তত্ত্ব অনুসারে আলোর উপরেও মাধ্যাকর্ষণ কাজ করবে। তাই তীব্র ক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় আলো বেঁকে যাবে। নিউটন আইনস্টাইন, দুজনের তত্ত্বই এই কথা বলে। কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুসারে এই বেঁকে যাওয়ার পরিমাণ নিউটনের তত্ত্বের দুগুণ। সহজেই এই ভবিষ্যৎ বাণী মিলিয়ে দেখতে পাওয়া উচিত, অবশ্য যদি সেরকম জোরালো মহাকর্ষ ক্ষেত্র পাওয়া যায়। কোথায় তাকে পাওয়া যাবে
            সূর্যের কাছাকাছি সেই রকম জোরালো মহাকর্ষ ক্ষেত্র আছে, তাই নক্ষত্রের আলো যখন সূর্যের পাশ দিয়ে যায়, তখন তা বেঁকে যাওয়ার কথা। তবে সূর্যের পিছনের তারা দেখা শক্ত, সূর্যের অতি উজ্জ্বল আলো সবাইকে ঢেকে দেয় একমাত্র পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় সেই সব জ্যোতিষ্কদের দেখতে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু পূর্ণ সূর্যগ্রহণ অনেক দিন পরে পরে হয় সূর্যের পাশ দিয়ে গেলে আলো কতটা বাঁকবে ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন তা অঙ্ক কষে বার করেন। তার আগের বছর থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছেজার্মানি তার মধ্যে জড়িত। তাই জার্মান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ঠিক না ভুল, তা দেখার জন্য সে সময় সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণের কোনো সুযোগ আসেনি। সে সুযোগ প্রথম এলো যুদ্ধবিরতির মাস পরে, ১৯১৯ সালের ২৯ মে দক্ষিণ আমেরিকাতে আফ্রিকাতে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় পরাজিত যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানির বিজ্ঞানীদের পক্ষে তখন সেরকম কোনো অভিযান পাঠানো কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। সেই দায়িত্ব তুলে নিলেন জার্মানির শত্রু দেশ ব্রিটেনের বিজ্ঞানীরা। সে সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের উৎসাহে দুটি অভিযান পাঠানো হয় দক্ষিণ আমেরিকা আফ্রিকাতে। এডিংটন নিজে গিয়েছিলেন আফ্রিকা সূর্যগ্রহণের সময় তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় আইনস্টাইনের হিসাব একদম ঠিক। এর পরই আইনস্টাইনের খ্যাতি সারা বিশ্বে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে এই একটি ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে বিজ্ঞান সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে, তার একটা আন্তর্জাতিক চরিত্র আছে।   
            গত একশ বছরে আইনস্টাইনের তত্ত্বকে আরও অনেকবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে। প্রতিবারই সে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। তাদের মধ্যে দুটো সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ অনুযায়ী  মহাকর্ষ ক্ষেত্রে সময় ধীর গতিতে চলে। পৃথিবীতেই পরীক্ষা করে এই বিষয়টা প্রমাণিত হয়েছে। পৃথিবীর কাছে মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র অপেক্ষাকৃত বেশি তীব্রপৃথিবী থেকে যত দূরে যাব, তার মান কমে যাবে।  তার মানে সমুদ্রতলের কাছে একটা ঘড়ি যে রকম সময় দেখাবে, পাহাড়ের উপরে গেলে সে আরো একটু তাড়াতাড়ি চলবে (এর সঙ্গে ঘড়ির কলকব্জার কোনো সম্পর্ক নেই, পাহাড়ের উপরের থেকে সমুদ্রতলে সময় ধীরে চলে।) তফাতটা খুব কম, এক সেকেণ্ডের ক্ষেত্রে এক লক্ষ কোটি ভাগের এক ভাগেরও কম। কিন্তু আধুনিক ঘড়িতে এই পরিমাণ পার্থক্য মাপা যায়। মেপে দেখা গেছে আইনস্টাইনের তত্ত্ব পুরোপুরি নির্ভুল। জি পি এস পদ্ধতির নাম আমরা সবাই শুনেছি, অনেকেরই মোবাইল ফোনে জি পি এস পাওয়া যাবে। এই পদ্ধতিতে বিশেষ সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ দুইকেই হিসাবের মধ্যে ধরতে হয়।
            আলো যে শুধু বেঁকে যায় তা নয়, মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে সময় ধীরে চলার ফলস্বরূপ তার কম্পাঙ্কও যায় কমে। দৃশ্য আলোকে যদি রামধনুর সাতটা রঙে ভেঙে নিই, তাহলে বেগুনি আলোর কম্পাঙ্ক বেশি, তারপর কমতে কমতে লাল আলোর ক্ষেত্রে কম্পাঙ্ক সবচেয়ে কম হয়। কম্পাঙ্ক কমে যাওয়ার অর্থ আলোর রঙ লালের দিকে যাওয়া, তাই একে বলে লোহিতাপসরণ (red shift) দূরের জ্যোতিষ্ক থেকে আসা আলোর জন্য মহাকর্ষজ লোহিতাপসরণ প্রথমেই লক্ষ্য করা গিয়েছিল, এখন পৃথিবীর পরীক্ষাগারেও তা মাপা গেছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তা আইনস্টাইন সমীকরণ মেনে চলে।
            ২০১৬ সালে আইনস্টাইনের তত্ত্বের সমর্থনে আরও একটি জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে। অবশ্য এখন আর কেউ সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে না। তাহলেও বিজ্ঞানের যে কোনো তত্ত্বকেই বারবার পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়, সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তার ব্যতিক্রম হতে পারে না। এই বিষয়টা একটু বিশদে আলোচনা করা যাক 
            ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন দেখিয়েছিলে যে দুর্বল মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে দেশকালের যে সামান্য বিকৃতি হয়, তা এক তরঙ্গ সমীকরণ মেনে চলে। ধরুন পুকুরের জলে একটা ঢিল ফেলা হল, দেখব যে জলে ঢেউ উঠল। ঠিক তেমনি যদি দেশকালকে কোনোভাবে নাড়াচাড়া করি, তাহলে তার যে তোলপাড় হবে সেটা ঠিক জলের ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়বে। (মহাকর্ষীয় ঢেউ বা তরঙ্গের বেগ আলোর বেগের সমান হওয়ার কথা।) বাস্তব সমস্যাটা হল সাধারণত এই ঢেউয়ের তীব্রতা এতই ক্ষীণ তাকে যন্ত্রে ধরাটা শক্ত দীঘার সমুদ্রে একটা পাথর ফেললে পুরীতে সে ঢেউ পৌঁছোবে না। কিন্তু ইন্দোনেশিয়াতে ভূমিকম্পের ফলে যে সুনামি তৈরি হয়েছিল, তার বিপজ্জনক প্রভাব এসে পড়েছিল ভারতবর্ষে। তেমনি মহাকর্ষের ঢেউকে দেখতে গেলে খুব জোরে দেশকালকে নাড়া দিতে হবে আমাদের পরীক্ষাগারে সেরকম জোরদার ঢেউ তৈরি আমাদের ক্ষমতার বাইরে, কিন্তু মহাবিশ্বে এমন অনেক ঘটনাতে অতি তীব্র মহাকর্ষীয় ঢেউ তৈরি হয় অবশ্য ধরণের ঘটনা আমাদের কাছাকাছি হবে, সে সম্ভাবনা খুব কম সেটা এক দিক দিয়ে ভালো, কারণ এরকম কোনো ঘটনা আমাদের আশেপাশে ঘটলে তা পৃথিবী থেকে প্রাণের চিহ্ন মুছে দিতে পারে। কিন্তু দূ্রের কোনো জায়গায় মহাকর্ষের ঢেউ তৈরি হলে সেখান থেকে তা আমাদের কাছে আসতে আসতে স্বাভাবিক ভাবেই দুর্বল হতে পড়ে -- তাই আমাদের যন্ত্রে তাকে ধরা সহজ নয়।  দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করেও বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষীয় ঢেউয়ের সন্ধান পাচ্ছিলেন না  
            মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে ধরা না গেলেও তার অস্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞানীদের সন্দেহ ছিল না কারণ সেই তরঙ্গের পরোক্ষ প্রমাণ আগেই পাওয়া গিয়েছিল। আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী যদি দুটি বিশাল ভর খুব কাছাকাছি থেকে পরষ্পরকে প্রদক্ষিণ করে, তাহলে তাদের থেকে তীব্র মাত্রায় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বেরোনোর কথা। অন্য তরঙ্গদের মতো মহাকর্ষীয় তরঙ্গও শক্তি বহন করে। তার ফলে ভর দুটির শক্তি কমতে থাকে, তারা পরষ্পরের কাছে আসে এবং তাদের আবর্তনকাল কমতে থাকে। মহাকাশে দুটি নিউট্রন তারা পাওয়া গেছে যারা খুব কাছ থেকে পরষ্পরকে প্রদক্ষিণ করে নিউট্রন তারাদের ভর সূর্যের মোটামুটি দেড় থেকে দু গুণের মধ্যে হয়। রকম ক্ষেত্রে সত্যিই আবর্তনকাল কমতে দেখা গেছে এবং সেই হিসাবটাও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সঙ্গে মিলে যায়। এই আবিষ্কারের জন্য রাসেল হালস জোসেফ টেলর ১৯৯৩ সালে পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার পান। নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের এই ভিডিওগুলোতে মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ বিকিরণের জন্য আবর্তনরত নিউট্রন তারাদের আবর্তনকাল কেমন করে পাল্টায় করে তার অ্যানিমেশন দেখানো হয়েছে।
            মহাকর্ষীয় তরঙ্গ অবশেষে সরাসরি ধরা পড়ল যে যন্ত্রে, তার নাম লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি, সংক্ষেপে লাইগো (LIGO) কোন ধরণের ঘটনা দেশকালকে এতটা আলোড়িত করতে পারে যে তার রেশ আমাদের যন্ত্রে এসে ধরা দেবে? বিজ্ঞানীরা বললেন সবচেয়ে জোরালো আলোড়ন ওঠে যখন দুটো কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাক হোল একসঙ্গে মিলে যায়। এই কৃষ্ণ গহ্বরকেও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সমীকরণ থেকে পাওয়া যায়, কিন্তু সে প্রসঙ্গে এখন  যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
            লাইগো মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ধাক্কাতে কোনো বস্তুর আকারের যে সামান্য পার্থক্য হয়, তাকে মাপার চেষ্টা করে। পার্থক্যের পরিমাণ খুবই কম, একটা দণ্ডের দৈর্ঘ্য পালটাবে এক কোটি কোটি কোটি ভাগের এক ভাগেরও কম। যন্ত্রটা দেখতে ইংরেজি L-অক্ষরের মত, যার এক একটা বাহু চার কিলোমিটার লম্বা। আমেরিকার হ্যানফোর্ড আর লিভিংস্টনে দুটো এইরকম L বসানো আছে। দুই বাহু বরাবর দুটো লেজার রশ্মি পাঠিয়ে আবার তাদের প্রতিফলিত করে ফিরিয়ে এনে মিলিয়ে দিলে তাদের ব্যতিচার থেকে বাহু দুটোর দৈর্ঘ্য সমান কিনা নিখুঁতভাবে মাপা যায়। বাহু দুটোর ওপর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এসে পড়লে তাদের দৈর্ঘ্য খুব সামান্য পালটাবে কিন্তু লম্বভাবে থাকার ফলে দুটো বাহুর পাল্টানোর পরিমাণটা আলাদা আলাদা হবে দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন হয় খুব কম, তাই সেটা মাপার জন্য দুটি লেজার রশ্মিকে প্রতিটি বাহু বরাবর কয়েকশোবার একই রাস্তা অতিক্রম করানো হয়, ওই সামান্য পার্থক্যটা তখন কয়েকশো গুণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তা মাপা সম্ভব হয়। লাইগো বিষয়ে আরো বিশদ তথ্য এখানে পাওয়া যাবে। 
            অবশেষে গত বছর ১৪ই সেপ্টেম্বর হ্যানফোর্ড এবং লিভিংস্টনের দুটো যন্ত্রেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরা পড়ল। তাদের মধ্যে সময়ের পার্থক্য এক সেকেণ্ডের হাজার ভাগের ভাগদুটো আলাদা জায়গায় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আলাদা আলাদা সময়ে পৌঁছেছিল বিজ্ঞানীরা হিসাব করে বললেন পৃথিবী থেকে ১৪০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে সূর্যের থেকে ৩০ গুণ এবং ৩৫ গুণ ভারি দুটো কৃষ্ণ গহ্বর পরষ্পরের সঙ্গে মিলে একটা কৃষ্ণ গহ্বরের জন্ম দিয়েছে। নতুন গহ্বরটা সুর্যের থেকে ৬২ গুণ ভারি। বাকি ভরটা, যা সূর্যের ভরের তিনগুণ, তার শক্তি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ রূপে বেরিয়ে এসেছে। ভালোভাবে নিশ্চিত হয়ে বিজ্ঞানীরা ২০১৬ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করেন যে অবশেষে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়েছে। তার পরে আরও একবার দুটি কৃষ্ণ গহ্বরের মিলিত হওয়ার সঙ্কেত লাইগোতে পাওয়া গেছে। এই লিঙ্কে দুটো কৃষ্ণ গহ্বর মিলিত হলে মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ কেমনভাবে বেরোবে দেখতে পাবেন।
            আইনস্টাইনের তত্ত্বের যে কটা ভবিষ্যৎ বাণী পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব হয়েছে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ হওয়ার পর তার সবকটাই মিলে গেছে। লাইগো সারা পৃথিবীতেই সাড়া ফেলেছে।  ইতিমধ্যে তৃতীয় লাইগো ভারতবর্ষে বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। যে সময় ভারতের অসামরিক বিজ্ঞানপ্রযুক্তি খাতে সরকারি খরচ ক্রমশই কমানো হচ্ছে, সে সময় এটা একটা সুসংবাদ সন্দেহ নেই।
             আইনস্টাইনের ভবিষ্যৎ বাণী পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হতে এক শতাব্দী লেগে গেল, খুব সামান্য কথা নয়। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ এক অনন্য কীর্তিচিরায়ত বা ক্লাসিকাল পদার্থবিদ্যার সর্বশেষ বিজয়স্তম্ভ। এই গবেষণাতে আইনস্টাইন ছিলেন প্রায় একা, তাঁর সমকালীন কোনো বিজ্ঞানী বিষয়ে গবেষণা করছিলেন না। একক চেষ্টাতে তিনি এই বিশাল সৌধ রচনা করেছিলেন। এই তত্ত্বের সমীকরণগুলি এতই জটিল যে মাত্র কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে তাদের সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। তবে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ এত ভাবে নানা পরীক্ষাতে সফল হলেও তার একটা সমস্যার সমাধান এখনো সুদূরপরাহত - আধুনিক কোয়ান্টম বলবিদ্যার সঙ্গে তার মেলবন্ধন এখনো ঘটানো যায়নি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বা রজার পেনরোজ এই বিষয়ে গবেষণা করছেন। আধুনিক স্ট্রিং থিওরিও সেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো তাতে সাফল্য আসেনি।

প্রকাশঃ ছাত্রসংগ্রাম শারদ ১৪২৩/২০১৬
আপেক্ষিকতা কেন নোবেল পুরস্কারের যোগ্য বিবেচিত হয়নি, সেই নিয়ে অনেকে আলোচনা করেছেন। এই লেখাতে সেই নিয়ে কিছু কথা আছে।