ট্রিয়েস্ট-ভেরোনা-ভেনিস
শম্পা গাঙ্গুলী
টিনটোরেটোর যীশু পড়ার পরে ইতালিয় শিল্পকর্ম সম্পর্কে বেশ আগ্রহ জন্মেছিল। রেনেসাঁ যুগের বিখ্যাত শিল্পী জ্যাকোপো তিনতোরেত্তো - তাই রেনেসাঁর শিল্পকলার উপর কয়েকটা বইও পড়ে ফেলেছিলাম। তবে বই পড়া বা ইন্টারনেটে ছবি দেখা এক জিনিস, আর নিজের চোখে দেখা আর এক। দুধের সাধ কি আর ঘোলে মেটে? এবার ত্রিয়েস্তে যাবার আগে গৌতম প্রস্তাব দিলো আমিও ইচ্ছা করলে ইতালি ঘুরে আসতেই পারি। আমি এক কথায় রাজি। স্কুল থেকে না হয় দু সপ্তাহ ছুটি নিতে হবে --- এমন সুযোগ কি আর কেউ ছাড়ে?
ইতালির পথে
গৌতম আগেই চলে গেছে। সৃজনশীল আমাকে কথা দিয়েছিল আমার সঙ্গে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাবে। তাই একটু নিশ্চিন্ত ছিলাম। চেহারাটা ছোটোখাটো হলেও ওর ওপর ভরসাটা রাখা যায়। কিন্তু সমস্যাটা এল অন্য দিক থেকে। শ্বশুরমশায়ের শারীরিক অসুস্থতার কারণে যাওয়াটা প্রায় বানচাল হয়েই যাচ্ছিল। শেষ মুহূর্তে উনি কিছুটা সুস্থ হওয়ায় লাগেজ গোছানো শুরু করলাম। আর তখন থেকেই মনের মধ্যে শুরু হল এক অদ্ভুত শিহরণ। যাওয়ার আগেরদিন তো উত্তেজনায় সারারাত ঘুমই হল না।
রওনা দিলাম ২২ জুলাই রাত এগারোটায়। কলকাতা থেকে দোহা যাবার ফ্লাইট ছিল পরের দিন ভোররাতে। একা একা প্রথমবার বিদেশ যাবার উত্তেজনাটা ভালোই টের পাচ্ছিলাম। কলকাতা থেকে কাতারের রাজধানী দোহা পৌঁছলাম সাড়ে পাঁচ ঘন্টা পরে। সেখানে ইন্টারন্যাশানাল ট্রান্সফারের সময়ে একটু টেনশন হচ্ছিল বৈকি --- সময় মাত্র দু ঘন্টা। তারপর আবার দোহা থেকে ভেনিসের ফ্লাইটের ছ ঘন্টা সময়টা কিছুতেই যেন কাটছিল না। কলকাতা-দোহার ফ্লাইটে বেশিরভাগই ভারতীয় ছিল। কিন্তু ভেনিসের প্লেনে লক্ষ্য করলাম আমিই বোধহয় একমাত্র ভারতীয়। পূর্ব গোলার্ধ থেকে পশ্চিমে ছিটকে পড়ে নানান দেশের লোকের মাঝে থাকার এই প্রথম অভিজ্ঞতাটা বেশ মজার লাগছিল।
ভেনিস এয়ারপোর্টে পা দেওয়ার পর এক অদ্ভুত অনুভূতি হল। যে আমি বরাবরই হারিয়ে যাবার ভয়ে কলকাতাতেই অচেনা রাস্তা ঘাটে একা যেতে ইতস্তত করি; সেই আমিই কিনা আত্মীয়-পরিজন সবাইকে বহু যোজন দূরে ফেলে এসে বিদেশে একদম একা! ভাবা যায় না। প্লেন থেকে নেমে ইমিগ্রেশনের জন্য বেশ খানিকটা দেরি হল। কিন্তু প্রথমবার বিদেশে আসার উত্তেজনায় হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে --- তাই সময়টা কোথা দিয়ে যে কেটে গেল, বুঝতেই পারলাম না।
ট্রিয়েস্টের পথে |
সাগরপাড়ের শহর ত্রিয়েস্তে
ভেনিস এয়ারপোর্টে গৌতম আমাকে নিতে এসেছিল। ওর সাথে প্রায় দেড় মাস পরে দেখা-- কিন্তু কোনো কথার আগেই দাঁড়াতে হল বাসের টিকিটের লাইনে। এয়ারপোর্ট থেকে বাসে মেস্ত্রে স্টেশন আধঘন্টা। সেখান থেকে ট্রেনে ত্রিয়েস্তে দুঘন্টা। নেমেই প্রথমে লাগেজ সমেত ঢুকে পড়লাম স্টেশনের সামনের সুপার মার্কেটে। যা যা দরকার সবই নিলাম --- ফল, সবজি, মশলা, মাছ, মাংস, দুধ, সসেজ, পাস্তা।
এখানকার বাসে টিকিট চেকার থাকে না --- কালেভদ্রে ওঠে। সব তাবাচ্চি মানে তামাকের দোকানে বাসের টিকিট পাওয়া যায়। বাসে উঠে পাঞ্চ করতে হয়। দেখলাম লক্ষ্য করার কেউ না থাকলেও যার যার মতো সবাই বাসে উঠে টিকিট পাঞ্চ করছে। তবে গৌতম বলল, ও অনেক লোককে বাসে টিকিট না কাটার জন্য ফাইন দিতেও দেখেছে।
ত্রিয়েস্তে শহরটা ভূমধ্যসাগরের তীরে উত্তর ইতালিতে --- এপেনাইন পাহাড়টা এখানে সোজা সমুদ্রে নেমেছে। গৌতম যে আপার্টমেন্টটা ভাড়া নিয়েছিল সেটা একদম সমুদ্রের ধারে, পাহাড়ের ঢালে। বাড়িটা খুব হাল্কা কোনো উপাদান দিয়ে তৈরি, দেওয়ালগুলো ফাঁপা -- মনে হয় ভূমিকম্পের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। জানলাগুলো ফাইবারের -- চারভাবে খোলা যায়। প্রযুক্তিটা বেশ অভিনব লাগল।
শোবার ঘরের জানলা খুললেই সাগরের নীল জল। গৌতম গবেষণার কাজে আগেও বেশ কয়েকবার এই শহরে এসেছে। তাই ছবিতে ওই শহর, ওই সমুদ্র আমার চেনা। ডালমেশিয়ান উপকূলের হাতছানি কখনো সত্যি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে সেখানে ফেলবে ভাবিনি। জানলা দিয়ে দেখলাম, গাঢ় নীল জলে ফেনা তুলে হাওয়াকে কাজে লাগিয়ে অক্লান্ত ভাবে সারফিং করে চলেছে কতো মানুষ। ভাসতে ভাসতে হামেশাই উলটে তারা জলে পড়ে যাচ্ছে-- কিন্তু কেউ দমছে না। আবার পাল খাড়া করে সমুদ্রের ফেনা ছুঁয়ে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে। বাইনোকুলার চোখে সিগালদের ডুবসাঁতার দিয়ে জলে ওঠা-নামা-ডানা ঝাপটানো, কেন জানি হঠাৎ মনে করালো ঘরের কবি জীবনানন্দের ‘সিন্ধুসারস’ --- ‘দু-এক মুহূর্তে শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি/ হে সিন্ধু সারস,/ মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি/ নাচিতেছে টারানটেলা-রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পাড়ে চুপে থামি/ চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা দুটি আকাশের গায়/ ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়’।
সেই অভিনব জানলা |
ত্রিয়েস্তেতে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে সমুদ্রতীর
যাওয়ার আগে দুদিন সারারাত উত্তেজনায় ঘুম হয়নি, প্লেনেও তথৈবচ। কিন্তু আনন্দে সব ক্লান্তি গায়েব। মনটাও তখন হাওয়ার বেগে দ্রিম দ্রিম তালে নাচছে। একি! আমি যে ঘামছি! না, শুধু উত্তেজনায় নয়, মাথার ওপর পাখা নেই, সেজন্যও। ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে গরমকালেও কিছুদিন আগে পর্যন্ত উত্তর ইতালিতে নাকি কারোর বাড়িতে পাখা লাগাত না। এখন পৃথিবী জুড়ে উষ্ণায়ণ। ফলে ওখানেও অনেকের বাড়িতে পাখা, এসি আছে। কিন্তু দাভেদার বাড়িতে, যেখানে আমরা ছিলাম, সেখানে নেই। তাই সমুদ্রের হাওয়া বন্ধ হলেই বেশ গরম। দিনের বেলা বাইরে বের হলেই গা পুড়ে যাবে। আসলে ওখানকার বাতাসে দূষণের মাত্রা কম বলে সূর্যরশ্মি শোষণ করে নেবার জন্য বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা, কার্বন কণাও কম। ফলে অনেক বেশি তাপ ওখানকার মাটি ছোঁয়। কিন্তু আকাশ খুব পরিষ্কার বলে সূর্য ডোবার পর খুব তাড়াতাড়ি তাপ ছেড়ে দিয়ে রাত্রিগুলো বেশ ঠাণ্ডা হয়-- গায়ে কম্বল লাগে। গরমকালে সন্ধে নামে রাত নটার পর। হবেই তো, গ্রীষ্মকালে দিনের অনেকটা সময় সূর্যের দিকে হেলে থাকে উত্তর গোলার্ধে মধ্য অক্ষাংশের ওই জায়গাগুলোতে।
সেইদিন বিকেলে আমাদের ঘরের উল্টোদিকে অন্য ভাড়াটে মার্কোর সাথে আলাপ হল। অল্প বয়সি ইতালিয়ান। অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। মা অসুস্থ, তাই দেশে ফেরা। ক্রাচ নিয়ে হাঁটছে। বলল, রক ক্লাইম্বিং করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পা ভেঙ্গেছে। ভাবলাম মাকে দেখতে ভাঙা পা নিয়ে দেশে এসে একা বাড়ি ভাড়া নিয়ে আলাদা আছে! একা রান্নাবান্না করে খাচ্ছে, একাই ভ্যাক্যুয়াম ক্লিনার দিয়ে ঘর পরিষ্কার করে দু একদিন ছাড়া, একাই মেশিনে কাচাকাচি করে বাইরে বারান্দায় রোদে মেলে। আবার রোজ পাহাড়ী ঢালের ঐ বাড়িটার থেকে বের হয়ে দিনের মধ্যে তিন চারবার কোথায় যেন যায়। বোঝা যায় কতটা স্বাধীনচেতা আর আত্মবিশ্বাসী।
ব্যালকনি থেকে দূরের পাহাড় ও সমুদ্র |
সেইদিন বিকেলে আমাদের ঘরের উল্টোদিকে অন্য ভাড়াটে মার্কোর সাথে আলাপ হল। অল্প বয়সি ইতালিয়ান। অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। মা অসুস্থ, তাই দেশে ফেরা। ক্রাচ নিয়ে হাঁটছে। বলল, রক ক্লাইম্বিং করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পা ভেঙ্গেছে। ভাবলাম মাকে দেখতে ভাঙা পা নিয়ে দেশে এসে একা বাড়ি ভাড়া নিয়ে আলাদা আছে! একা রান্নাবান্না করে খাচ্ছে, একাই ভ্যাক্যুয়াম ক্লিনার দিয়ে ঘর পরিষ্কার করে দু একদিন ছাড়া, একাই মেশিনে কাচাকাচি করে বাইরে বারান্দায় রোদে মেলে। আবার রোজ পাহাড়ী ঢালের ঐ বাড়িটার থেকে বের হয়ে দিনের মধ্যে তিন চারবার কোথায় যেন যায়। বোঝা যায় কতটা স্বাধীনচেতা আর আত্মবিশ্বাসী।
সন্ধেবেলায় দাভেদার সঙ্গিনী সাবিনা ও তাদের বছর দশেকের ছেলে টমাসের সঙ্গেও পরিচয় হল। সারা দিন সমুদ্রের ধারে ছিল ওরা। প্রতিদিন তারা সমুদ্রের ধারে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খেলাধুলো-গানবাজনা-হইচই করে তবে সন্ধেবেলায় বাড়ি ফেরে। গরমের ছুটিতে ওখানে সবাই তা-ই করে। দিনের বেলা সমুদ্রের ধারে ওই চড়া রোদ্দুরে পড়ে থাকে, সূর্যস্নান করে। সূর্যের থেকে অত তাপ নিয়েই কি ওরা দিনের পর দিন এত প্রাণশক্তিতে ভরপুর? শনি-রোববার সমুদ্রের ধার আরো জমজমাট। সকাল থেকে সারাদিন হাঁটাহাঁটি, যোগাসন, সাইকেল চালানো, সমুদ্রে ডাইভিং, সারফিং, নানা খেলাধুলো, নানান কিছু। কেউ কেউ গাছে দোলনা বেঁধে বা ছাউনি করে পিকনিক করছে, কিংবা সার্কাসের মত বিশাল ঝোলানো নেটের ওপর লাফাচ্ছে, ব্যালেন্স করে অ্যাক্রোব্যাটিক গেম খেলছে। কোথাও বা মিউজিক চালিয়ে ব্যায়াম করছে একদল – তাদের সঙ্গে জুটে গেল সম্পূর্ণ অপরিচিত আরো কয়েকজন। একদিন বিকেলে দেখি গাড়ি চালিয়ে এসে ষাটোর্ধ্ব এক দম্পতি হঠাৎ গাড়ির ভিতর থেকে দুটো সাইকেল বার করে চালাতে শুরু করল সমুদ্রের ধারে। একঘন্টা চালিয়ে আবার ফিরে গেল। ভাবি, কী অফুরন্ত জীবনীশক্তি ওদের। শনিবার সন্ধে থেকে সারা রাত সমুদ্রের ধারে জলসা চলে-- ব্যান্ডগুলো গান বাজনা করে -- আর তাদের শ্রোতারাই কেবল তা উপভোগ করে। রাস্তা পেরিয়ে পাহাড়ের ঢালের বাড়িগুলোতে তার আওয়াজটুকুও আসে না। ওরা নিজেদের আনন্দে কেবল নিজেরাই মেতে থাকে --- আমাদের মতো অন্যের কানের গোড়ায় সজোরে মাইক বাজিয়ে আনন্দ পায়না।
ত্রিয়েস্তে গ্রান্ড ক্যানাল
ত্রিয়েস্তেতে ছিলাম এক সপ্তাহ। গৌতম রোজ সকালে জলখাবার খেয়ে টিফিন নিয়ে অফিস বার হত। আমি রান্নাবান্না সেরে সময়টা কাটাতাম বই পড়ে বা ল্যাপটপে সিনেমা দেখে। বিকেলে গৌতম ফিরলে দুজনে বাজার সেরে আশপাশটা ঘুরে বেড়াতাম। গ্র্যাণ্ড ক্যানালের ধারটা খুব সুন্দর। শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটা ওখানেই, Piaza del Unita, দেশ হিসাবে ইতালির ঐক্যসাধনের স্মৃতি বহন করে। সমুদ্রের ওপর এড্রিয়াটিক উপকূলে
দিনের পিয়াজা দেল ইউনিতা |
রাতের ত্রিয়েস্তেঃ পিয়াজা দেল ইউনিতা
জনসংখ্যার শতকরা হিসাবে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের দিক থেকে এই শহর ইতালির মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে। বাসিন্দাদের আর্থিক অবস্থাও বেশ ভালো। একদিন বিকেলে একটা নতুন ধরণের ট্রামে চেপে আমরা পাহাড়ের ওপরের ওপিসিনা বলে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম। পাহাড়ের ওপর ট্রাম ওঠে কেউ কখনো শুনেছে! অদ্ভুত এই কৌশলকে বলে ফিউনিকুলার প্রযুক্তি। যে ট্রামটা উপর থেকে নিচে নামছে, সেটা কেবল ট্রাক্টর লাগিয়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে আমাদের ট্রামটাকে টেনে তুলল।
প্রায় সাড়ে তিনশ মিটার ওপর থেকে নীচের এড্রিয়াটিক উপকূলটা দারুণ লাগছিল। পাহাড়ের ঢালের বসতিগুলো ছবির মত। ট্রামে যেতে যেতে ইতালিতে এই প্রথম একজনের সঙ্গে আলাপ হল যিনি ইতালিয়ান হলেও ঝরঝরে ইংরাজি বলতে পারেন। নাম আলেকসান্ড্রা চিন্যাগলিয়া। দেখলে আন্দাজ করা যাবে না, সত্তরের ওপর বয়স। পেশায় সাইকোলজিস্ট। ভেনিসে চেম্বার, ওখানেই থাকেন। ত্রিয়েস্তেতে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন। ওনার ছেলে সাহিত্যের অধ্যাপক --- সেই সূত্রে বিশেষ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাহিত্যিকদের ওনাদের বাড়িতে আনাগোনা আছে। সলমন রুশদি, বিক্রম শেঠ বা অনিতা দেশাই, শুধু লেখার মাধ্যমে যাঁদের সঙ্গে পরিচয়, তাঁরা ওনার বাড়িতে আসেন শুনে কেমন যেন থমকে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, এনারা মানুষ হিসাবে কেমন? সান্ড্রা বললেন, প্রতিভাবান সাহিত্যিক তো, তাই প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর ছিটগ্রস্ত। You know, Vikram Seth is totally mad. Genius, but mad.
ট্রাম |
প্রায় সাড়ে তিনশ মিটার ওপর থেকে নীচের এড্রিয়াটিক উপকূলটা দারুণ লাগছিল। পাহাড়ের ঢালের বসতিগুলো ছবির মত। ট্রামে যেতে যেতে ইতালিতে এই প্রথম একজনের সঙ্গে আলাপ হল যিনি ইতালিয়ান হলেও ঝরঝরে ইংরাজি বলতে পারেন। নাম আলেকসান্ড্রা চিন্যাগলিয়া। দেখলে আন্দাজ করা যাবে না, সত্তরের ওপর বয়স। পেশায় সাইকোলজিস্ট। ভেনিসে চেম্বার, ওখানেই থাকেন। ত্রিয়েস্তেতে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন। ওনার ছেলে সাহিত্যের অধ্যাপক --- সেই সূত্রে বিশেষ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাহিত্যিকদের ওনাদের বাড়িতে আনাগোনা আছে। সলমন রুশদি, বিক্রম শেঠ বা অনিতা দেশাই, শুধু লেখার মাধ্যমে যাঁদের সঙ্গে পরিচয়, তাঁরা ওনার বাড়িতে আসেন শুনে কেমন যেন থমকে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, এনারা মানুষ হিসাবে কেমন? সান্ড্রা বললেন, প্রতিভাবান সাহিত্যিক তো, তাই প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর ছিটগ্রস্ত। You know, Vikram Seth is totally mad. Genius, but mad.
ট্রামে ওপিসিনার পথে এক ইতালিয়ান পরিবার
নেপোলিয়নের পায়ে পায়ে |
ওপিসিনাতে নামলাম। সান্দ্রার জন্য তাঁর বোনঝি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। যাবার সময় বারবার বললেন ভেনিসে গেলে সময় পেলে আমরা যেন ওনার চেম্বারে গিয়ে দেখা করি। ওনাকে বিদায় জানিয়ে আমরা দুধারে গাছ দিয়ে সাজানো ট্রাম রাস্তা ধরে খানিকটা নেমে এলাম। সেখানে সুড়কি বিছানো দারুণ সুন্দর অথচ খুব নির্জন একটা রাস্তা। অনেকখানি হাঁটলাম। জায়গাটার নাম স্ট্রাডা নেপোলিয়নিকা। অনেকটা নীচে এড্রিয়াটিক উপকূলের নীল সমুদ্র হাতছানি দিচ্ছে। রাস্তাটা কিজন্য বিখ্যাত জানলাম। সঙ্গে সঙ্গে জুতোর তলার সুড়কিতে মশমশ শব্দ তুলে উত্তেজনায় হাঁটতে হাঁটতে ঝটাঝট বেশ কয়েকটা ফোন করে ফেললাম বন্ধু পরিজনদের -- তাদেরও উত্তেজনার ছোঁওয়াটা দেবার জন্য। জানালাম ওই রাস্তা দিয়ে এসে নেপোলিয়ন ইতালি আক্রমণ করেছিলেন।
ত্রিয়েস্তেতে সকলের বাড়িতে বোধহয় একটা বা দুটো কুকুর আছে। এত যে বিভিন্ন রূপের বা বিভিন্ন প্রজাতির কুকুর হয় তা জানতাম না। বেড়াতে বেরোলে কুকুরও তাদের সঙ্গী। প্রত্যেক ছোট্ট কুকুরের মালিকের সঙ্গে একটা করে ঝুড়ি বা ব্যাগ থাকে। কুকুর ক্লান্ত হলে তাদের ওই ব্যাগে ভরে নেয়। অনেক কুকুরই লক্ষ্য করলাম রাস্তার ধারে ঘাসের উপর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে। কুকুরের মালিক হাতে দস্তানা পরে অনায়াসে সেই নোংরা ন্যাপকিন দিয়ে তুলে নিজের সঙ্গের ঝোলায় পুরছে। ত্রিয়েস্তে শহরে বিশেষত সমুদ্রের ধারে দেখতাম, সবাই খুব আইস্ক্রিম খেতে ভালোবাসে। আইস্ক্রিমের সঙ্গের ন্যাপকিনটাও কেউ কখনো এদিক সেদিক ফেলত না- ডাস্টবিন পেলে তবেই। পরিচ্ছন্নতা আর কুকুরপ্রেমের এমন নিদর্শন আমায় অভিভূত করল। মাঝে মাঝে ভাবি, আমরা যতই স্বচ্ছ ভারতের স্বপ্ন দেখি, আর সারা বছর নির্মল বিদ্যালয়ের শপথ নি, ঘটা করে নির্মল বিদ্যালয় সপ্তাহ পালন করি, “ও আচ্ছে দিন আভি বি বহুত দূর হ্যায়।”
ত্রিয়েস্তেতে বাসে করে বাজার যাওয়ার পথে একটা মজার গল্প বলি। বাসে টিকিট পাঞ্চ করে সবে বসেছি। হঠাৎ হাঁচি। হাঁচড় পাঁচড় করে রুমাল বের করার জন্য ব্যাগ হাতড়াচ্ছি। কিন্তু ইতিমধ্যে আমি নিজেকে অপ্রস্তুতে ফেলে প্রায় আট দশটা হাঁচিতে বাসের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছি। আমার সঙ্গী আমাকে সামলে নিতে বলছে। কিন্তু এলার্জির জন্য পারছি না। সেও অপ্রস্তুত। এন্টি-এলার্জিক ওষুধটাও সঙ্গে নেই। কিন্তু বাসে অন্য কারোর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। যে যার মতো গল্প করে যাচ্ছে। একটা অল্প বয়সি জুটি আগের মতোই একে অপরকে চুম্বন করে যাচ্ছে। এরকম অস্বস্তি একনাগারে চললে আমার সবসময় যা হয় তাই হতে লাগল। ফলে নাকের ওপর তখন প্রবল অত্যাচার। ছোটোবেলায় মনে পরে আমার মামাতো দিদি আমার নাক নিয়ে খুব প্রশংসা করত। ছোটর ওপর আমার নাকটা নাকি বাঁশির মতো সরু। সেই সরু নাক তখন বারবার ঘষছি। নাক লাল, নাক সরসর, নাক ভরভর; আমাকে লজ্জায় ফেলার জন্য যত রকমের বিচ্ছিরি কাণ্ড হতে পারে তাই তাই হতে লাগল। এইসময় মনে হয় প্রবল ঠাণ্ডা লেগে সর্দি লেগে গেছে বুঝি। তাই অভ্যাসবশত ঘনঘন নাক টেনে সর্দিকে বশে রাখতে চেষ্টা করলাম। হঠাত লক্ষ্য করলাম বাস সুদ্ধ লোক আমার দিকে তাকিয়ে। গৌতম আমাকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বলল, ইউরোপে নাক টানাটা অসভ্যতা।
রোমিও জুলিয়েটের শহরে
ত্রিয়েস্তে থেকে আমরা দুদিন দুটো জায়গায় গিয়েছিলাম – ভেরোনা আর ভেনিস। দুটো শহরই ত্রিয়েস্তের পশ্চিমে। রবিবারের ট্রেনের সুবিধা হল, একটা টিকিট কাটলে আর একটা ফ্রি। ভেরোনার জন্য সকাল ৬টা ৩৮মিনিটে ফ্রেসিয়াব্রিয়াঙ্কা ট্রেনে চাপতে হবে -- এই ট্রেনগুলো লোকাল ট্রেনের চেয়ে অনেকটা জোরে যায়। কিন্তু মুশকিল হল আমরা যে জায়গাটায় থাকতাম, স্টেশন থেকে সেটা চার কিলোমিটার দূর। রবিবার অত সকালে বাস পাওয়া যাবে কি? তাই কোনোরকম ঝুঁকি না নিয়ে আমরা ভোরবেলা উঠে হাঁটা লাগালাম।
এরিনা, ভেরোনা
ত্রিয়েস্তে সেন্ট্রালে স্টেশন থেকে ভেরোনা পোর্টানোভা পৌঁছতে প্রায় তিন ঘন্টা সময় লাগল। স্টেশনেই আমরা দুজনের জন্য ৩৬ ইউরো দিয়ে দুটো ভেরোনা কার্ড কিনে নিলাম। তাতে সারাদিনের জন্য সমস্ত বাস রাইড আর সব দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো একবার করে ঢোকা ফ্রি। বাসে চেপে প্রথমে গেলাম এরিনা রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারে। আজ থেকে প্রায় দু হাজার বছর আগে রোমান সম্রাটদের সামনে কখনো গ্ল্যাডিয়েটরদের মধ্যে, আবার কখনো মানুষে-পশুতে যুদ্ধ হত। আমরা একটা গ্যালারিতে বহুক্ষণ বসে ছিলাম। প্রাচীনত্বের ছোঁয়ায় হারিয়ে গিয়েছিলাম কিছুক্ষ্ণণের জন্য। মনে হচ্ছিল গ্যালারির আশপাশের দর্শকাশনগুলো বুঝি ভর্তি। উন্মুক্ত মঞ্চে মানুষে পশুতে যুদ্ধ দেখার জন্য উদগ্রীব জনতার কোলাহল।
হঠাৎ দেখি বাইরে থেকে, গগনচুম্বী ক্রেনে চেপে বিশাল বড়ো মাঝারি, ছোটো বিভিন্ন আয়তনের স্ফিংক্সের বেশ কিছু মূর্তি ঢুকে পড়ছে মঞ্চে। আসলে, এরিনা এম্পিথিয়েটারে চলছিল বিশ্ববিখ্যাত অপেরা উৎসব। সেদিন সন্ধ্যেবেলায় হবে ভার্দির অপেরা ‘আইদা’-- সেই উপলক্ষ্যে স্টেজ সাজানোর প্রস্তুতি। মূর্তিগুলো সাজিয়ে তুলছিল স্টেজটাকে। পঞ্চাশ ষাট ফুট বড়ো মূর্তিগুলোকে খোলা আকাশের তলায় উন্মুক্ত স্টেজে শক্তিশালী ক্রেনে করে ঝুলন্ত অবস্থায় বহন করে আনার কায়দাটা আমাদের অবাক করেছিল। মন চাইছিল নাটকটা দেখেই যাই। কিন্তু সময় নেই, তাছাড়া অপেরার টিকিট শেষ হয়ে গেছে অনেক দিন আগে। ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল যখন উদ্বোধন হয়, তখন ইজিপ্টের সরকার নতুন একটা অপেরা হাউসের জন্য ভার্দিকে একটা অপেরা লিখতে বলেছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত অপেরাগুলির মধ্যে একটা হল ‘আইদা’।
ভেরোনা শহরটা খুবই ছোটো। এরিনা থেকে বেরিয়ে সারাদিন আমরা পায়ে হেঁটেই ঘুরেছি। এরপর গেলাম শহরের কেন্দ্রস্থল পিয়াজা দেল এরবে। সেখানে বহু পুরানো একটা ঘন্টা মিনার আছে, টরে দি ল্যাম্বার্টি।
চুরাশি মিটার উঁচু মিনারের ওপর ওঠার জন্য সিঁড়ির পাশাপাশি লিফটও আছে -- সে জন্য বাড়তি এক ইউরো করে দিয়ে উপরে উঠলাম। সেখানে পেল্লাই সাইজের তিনটে ঘন্টা ঝুলছে। দুপুর বারোটার সময় প্রতিদিন সেই তিনটে ঘন্টাই নাকি নিচের থেকে এক সঙ্গে বাজানো হয়। সেজন্য পৌনে বারোটার সময় আমরা সেখান থেকে নেমে এলাম। ঐ অত বিশাল ঘন্টা কানের কাছে বাজার ঝুঁকি নিতে পারলাম না।
টরে দি ল্যাম্বার্টি |
এরপর আমাদের গন্তব্য কাসা দি জুলিয়েটা অর্থাৎ জুলিয়েটের বাড়ি। ভেরোনা শুনেই মনে পড়েছিল রোমিও জুলিয়েটের কথা --- শেক্সপিয়ারের সবচেয়ে বিখ্যাত এই দুটি চরিত্রের বাড়ি ছিল এই শহরেই। টুরিস্টদের বোকা বানানোর জন্যই নিশ্চয়, সরকারি দপ্তর থেকে তাদের দুজনের নামে দুটো আলাদা আলাদা বাড়ি চিহ্নিত করা আছে। তবে রোমিওর বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেয় না-- সেখানে লোক বসবাস করে। জুলিয়েটের বাড়ি দেখতে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। ওখানকার মানু্যও যে কাল্পনিক কোনো ব্যাপার নিয়ে এত মাতামাতি করতে পারে সেটা একটু পরেই পরিষ্কার হল।
পিয়াযাদেল এরবেতে কবি বার্তো বার্বারিনির মূর্তি |
আমাদের বজবজ থেকে আমতলার দিকে যেতে মুচিশা পেরিয়ে বাখরাহাটের কাছে বড় কাছারি বলে একটা বিখ্যাত জায়গা আছে। সেখানে প্রচুর লোকজন মানত করতে যায়। আমিও সেখানে একবার গেছি। না না, মানতের জন্য নয় --- মুচিশা-বাখরাহাট অঞ্চলে গাছের অনেক নার্সারি আছে, সেখান থেকে ক্যাক্টাস আনতে প্রায়ই যেতাম। লোকের মুখে বড় কাছারির কথা এত শুনেছি যে ঐ জায়গাটা দেখার ইচ্ছে আমার ছিলই। দেখেছিলাম মানুষ কাগজে তার সমস্যা লিখে শিবের কাছে পাঠানোর জন্য টানিয়ে দিচ্ছে।
জুলিয়েটের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম একই ব্যাপার। প্রধান ফটক থেকে বাড়ি পর্যন্ত দেওয়ালে ওই রকম হাজার হাজার চিরকুট ঝোলানো, দেওয়াল জুড়ে অসংখ্য লেখালেখি। প্রথমে সত্যিই ঘাবড়ে গেছিলাম। ইউরোপের লোকজন আবার এত ঠাকুর ভক্ত হয়ে মানত করা শুরু করল কবে থেকে? ওই ভিড়ের মধ্যে চতুর্দিকে শুধু ক্যামেরার ফ্লাশের ঝলকানি। ভাবলাম বুঝি কেষ্ট বিষ্টু কোনো নামজাদার আগমন ঘটেছে। তারপর কোনোক্রমে ভিড় ঠেলে একটু এগিয়ে দেখি সামনের বেদিতে দণ্ডায়মান নায়িকা জুলিয়েট সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। দলে দলে লোকজন মহম্মদ আলি পার্কের দুর্গাপুজোর প্যাণ্ডেলের মতো ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে জুলিয়েটের ব্রোঞ্জের মূর্তির বুকে হাত রেখে প্রেমের শপথ নিচ্ছে, আর সেই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ঝটাঝট ক্যামেরার ঝলকানি দিচ্ছে। দৃশ্যটা ভাবুন একবার! বছরের পর বছর প্রতিদিন হাজার হাজার লোকের হাতের স্পর্শে মূর্তির বুকের অংশ ঘষা লেগে লেগে একেবারে অনাবৃত চকচক করছিল। মজা করে আমাকেও গৌতম বলেছিল ওদের মতো করতে --- আমি রাজি হইনি। পাগলামির একটা মাত্রা থাকা উচিত। আমার আসলে ঐ হুজুগে ব্যাপারটা খুবই বোকা বোকা লেগেছিল। বললাম, ‘আমার পরকীয়ার লাইসেন্সটা এইভাবে বাতিল করতে চাও নাকি?’
জুলিয়েটের মূর্তি, ভেরোনা
আদিগে নদী |
কাস্তেলভেচ্চিও যাওয়ার সেতু
নদীর অন্য পাড়ে শহরের একদম মাঝখানে একটা দুর্গ কাস্তেলভেচ্চিও -- এখন সেটা একটা মিউজিয়াম। এতদিনে অবশেষে তিনতোরেত্তোর আঁকা অনেক ছবি দেখার সৌভাগ্য হল। তার মধ্যে ‘Contest between the Muses and the Pierides’ বেশ বিখ্যাত। রাজা পিয়েরসের নয় কন্যাকে বলা হত পিয়েরাইদস। তারা সঙ্গীতে এত ভালো ছিল যে গানের দেবতা মিউসদের চ্যালেঞ্জ করে। অনিবার্য পরাজয়ের পর দেবতারা নয়জনকেই পাখি বানিয়ে দিয়েছিলেন। ছবিটার গল্প সেটাই।
Contest between the Muses and the Pierides |
এছাড়া আছে তিনতোরেত্তোর আঁকা ‘Adoration of Magi’ । গল্পটা আমরা সবাই জানি। যিশুখ্রিস্টের জন্মের সময় তাঁকে তিনজন পণ্ডিত সম্মান জানিয়েছিলেন। পরে ভেনিসে তিনতোরেত্তোর আরও অনেক ছবি দেখেছি। পাওলো ক্যারিওলি বিখ্যাত ছিলেন ‘ভেরোনিজ পেন্টার’ নামে। তাঁর আঁকা ”Deposition” ছবিটার কথা মনে আছে; ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে ক্রুশ থেকে নামানো হচ্ছে। শিল্পীর তুলিতে বাইবেলের গল্পটা যেন জীবন্ত। তাঁর আরও কিছু ছবি সযত্নে রাখা আছে। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, ওখানকার ছবিগুলো অত সুন্দর হলেও ভাস্কর্য কিন্তু কাঠকাঠ। মধ্যযুগীয় ছাপ রয়েছে।
এখানে একটা অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মিউজিয়ামের গার্ডরা সারাক্ষণ আমাদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য রাখছিল। ভাবলাম কালো চামড়ার লোক বলে বোধহয় এই রকম খাতির। ইতালিতে অন্য কোনো মিউজিয়ামে এমন পাইনি। পরে ইন্টারনেটে দেখলাম ইউরোপ আমেরিকার অনেকেই এই মিউজিয়াম সম্পর্কে একই কমপ্লেন করেছে। সমস্যাটা তাহলে চামড়ার রঙের নয়, অন্য কিছুর!
শিল্পকলা দেখতে দেখতে ইউরোপের ইতিহাস মনে পড়ে যাচ্ছিল। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য পতনের পর পঞ্চম শতাব্দী থেকে মধ্যযুগীয় অন্ধকার সারা ইউরোপকে গ্রাস করেছিল। ইউরোপের পুরো সমাজটা ঈশ্বর কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছিল। ফলে শিল্পে, ভাস্কর্যে তার প্রভাব পড়েছিল অবধারিত ভাবে। তাই ছবি, মূর্তি সবই হয়ে পড়েছিল নিস্প্রাণ, কাঠকাঠ। সেগুলো কিছু কিছু সেন্ট ও যিশুখ্রিস্টের জীবনের কিছু ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু প্রাচীন গ্রিক ভাস্কর্য বা সৌধ যেখানেই দেখেছি তা জীবনী শক্তিতে ভরপুর। মধ্যযুগের শেষে সমাজ যখন শুধুমাত্র ঈশ্বর, স্বর্গ এই চিন্তার বাঁধনে হাঁপিয়ে উঠছিল তখনই এল রেনেসাঁর স্বর্ণযুগ। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণ পর্বে সভ্যতার বহুমুখী বিকাশই তো হল রেনেসাঁ। ইতালিতে এই পর্বের সূচনা হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে এবং বিকাশের শীর্ষে পৌঁছায় পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে। এ যুগে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য, আত্মচেতনা এবং পার্থিব অভিজ্ঞতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। ইতালিতে এই পর্বের সূচনার প্রেক্ষাপট ছিল রাজনৈতিক স্থায়িত্ব, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির মধ্যে মেলবন্ধন স্থাপন। বিকাশমান নাগরিক সভ্যতা ভেনিস, ফ্লোরেন্স, পিসা, জেনোয়া, মিলান প্রভৃতি শহরগুলিকে শক্তিশালী নগররাষ্ট্রে পরিণত করে। এই আন্দোলনের মূলে যে অর্থনৈতিক ঘটনাটি ক্রিয়াশীল ছিল সেটা হল নৌ বাণিজ্যের অতি দ্রুত বিস্তার।
দেশে ফেরার অনেক পরে খবর পেলাম নভেম্বর মাসে কাস্তেলভেচ্চিও থেকে লুঠ হয়ে গেছে বেশ কয়েকটা অতুলনীয় শিল্পকর্ম। তার মধ্যে আছে তিনতোরেত্তো, রুবেন্স, বেনিনির মতো শিল্পীদের ছবি। মনটা কিছুক্ষণের জন্য খারাপ হয়ে পড়েছিল।
ভেনিস স্টেশনে নেমে
ভেরোনা ঘুরে আসার ঠিক দুদিন পর আমরা গিয়েছিলাম ভেনিস। ভেনিস শহরটা আসলে অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে তৈরি। প্রাচীনকাল থেকেই এটা বন্দর শহর হিসাবে প্রতিপত্তি লাভ করেছিল। ভেনিসের মাধ্যমেই এককালে পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে বানিজ্যিক যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল বাইজেনটাইন অর্থাৎ পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য এবং এশিয়ার। সেজন্য ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভেনিস ছিল ইউরোপের সবচেয়ে ধনী নগর রাষ্ট্র। আমরা নেমেই ভেপোরেত্তো অর্থাৎ জলের বাসের টিকিট কেটে ফেললাম। ঐ বাস কানাল গ্রান্দে (Grand Canal) দিয়ে আমাদের নিয়ে গেল মূল দ্বীপ সান মার্কোর দিকে। কথিত আছে ৮২৮ সালে যিশুর অন্যতম শিষ্য সেন্ট মার্কের দেহাবশেষ এখানে আনা হয়েছিল।
লঞ্চ থেকে সান মার্কো
সেই থেকেই সেন্ট মার্ক বা সান মার্কো হলেন ভেনিস এর রক্ষাকর্তা। জলযান থেকে দেখলাম চারপাশের অপূর্ব দৃশ্য। সমুদ্রের ধারের বাড়িগুলো ফুলে ফুলে সাজানো; সেগুলোর বেশিরভাগই হোটেল বা রেস্তরাঁ। বাড়িগুলো যেন সোজা জলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। স্বচ্ছ জলে নীল আকাশে সাদা মেঘের অসংখ্য ভেলা আর জলের ওপর ঝুঁকে থাকা ফুলবাড়িগুলোর প্রতিচ্ছবি মনের মধ্যে স্বপ্নের মায়াজাল তৈরি করছিল। ইতালির মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত দ্বীপের অংশটুকুতে কেবল বাস বা ট্রেন যোগাযোগ আছে। বাদবাকি শহরে কোথাও অন্য কোনও গাড়ি নেই। আছে কেবল জলযান, যাকে বলে গণ্ডোলা। তাই বাতাস পুরোপুরি দূষণ মুক্ত। বাড়িগুলো বহু প্রাচীন। কোনো কোনোটা পাঁচ-সাতশো বছরের বা আরও বেশি পুরানো । লাইন দিয়ে বাড়িগুলো খাল দিয়ে দিয়ে যুক্ত । ফলে জালের মত অসংখ্য খাল আর ব্রিজ। বেশ মজার লাগছিল ব্যাপারটা দেখতে। রিয়াল্টো নামে বিখ্যাত একটা ব্রীজের ওপর আমরা দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি, দেখি বাড়িগুলোর পেছনের দিকে খালের ওপর লাগোয়া পরপর অনেকগুলো গণ্ডোলা দাঁড়িয়ে । অল্প সময়ের মধ্যে লক্ষ্য করলাম বেশ কয়েকজন বাড়ির মালিক খিড়কির দরজা খুলে সামনে রাখা গণ্ডোলায় দাঁড়িয়ে দরজায় তালা দিয়ে নৌকোর দাঁড় টানতে টানতে কাজে বেরিয়ে গেল । ঠিক আমরা যেমন বাড়ির সামনে রাখা নিজের গাড়ি চালিয়ে কোথাও যাই। বাড়ির জানলা দিয়ে দড়ি টাঙিয়ে কাচা জামাকাপড় মেলা আছে, ঐ খালেরই ওপর। খালটা যেন বাড়ির উঠোন। কি মজার না ব্যাপারটা ! আমরা অবশ্য জলযানের বদলে পদযানেই শহরটা ঘুরেছি।ভেনিসের গলিপথ
ভেনিসের শাসনকর্তা ডোজে মানে ডিউক যেখানে থাকতেন সেটাকে বলে ডুকাল প্রাসাদ। টিকিট আগেই কাটা ছিল। ঢোকার আগেই দেখলাম উঁচু মিনারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিশাল ডানাওয়ালা সিংহের বিখ্যাত মূর্তি।
এটা সান মার্কো বা সেন্ট মার্কের প্রতীক। প্রতিবছর ভেনিসে যে চলচ্চিত্র উৎসব হয়, তাতে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য যে ভেনিসিয়ান সিংহ উপহার দেওয়া হয় তা এই বিখ্যাত winged lion এর অনুকরণে তৈরি। ডুকাল প্রাসাদে ঢোকার মুখে বিখ্যাত golden staircase । স্বর্ণ-খচিত এই সিঁড়ি দিয়ে প্রাসাদে ঢুকে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে সাক্ষী রইলাম নানান ভাস্কর্যের, চিত্রকলার নিদর্শনের। মধ্যযুগের শেষদিকে ইউরোপে প্রযুক্তির নানান উন্নতি ঘটে, বিশেষত কৃষিতে, বস্ত্রনির্মাণে। তারই ফলে জমে ওঠে এই উদ্বৃত্ত। একই সঙ্গে এই উদ্বৃত্তকে অত্যন্ত সহজলভ্য করে তোলে জাহাজ ও নৌচলাচলের উন্নতি। এই বাণিজ্যের মূলস্রোত পূর্ব দিক থেকে এসে ভেনিসের মধ্যে দিয়ে গোটা ইউরোপে প্রবাহিত হত। সোনা দিয়ে কাজ করা প্রাসাদের ছাদ, দেওয়াল মনে করালো বৈদেশিক বাণিজ্যের দৌলতে ফুলে ফেঁপে ওঠা ঐশ্বর্যশালী সেই ভেনিসকে।
‘ইল প্যারাডিসো”, জ্যাকোপো তিনতোরেত্তোর আঁকা পৃথিবী বিখ্যাত সবচেয়ে বড় তৈলচিত্র আছে এখানে। স্বর্গের ছবি, মাঝখানে রয়েছেন যিশু -- তাঁকে ঘিরে অসংখ্য সাধু সন্ত। পাপীদের ক্ষমা করে দিতে মা মেরি তাঁকে অনুরোধ করছেন। প্রাসাদের মূল হলঘরে, যেখানে প্রধান কাউন্সিলরদের সভা হত, সেখানে একদিকের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে ২২ মিটার লম্বা ৭ মিটার উঁচু এই ছবি। ছবিটি আঁকা শুরু করেছিলেন তিনতোরেত্তো -- কিন্তু শেষ করতে পারেননি। তাঁর ছেলে দোমিনিকো ও তাঁর স্টুডিয়োর ছাত্ররা ছবিটি শেষ করেন। আছে পাওলো ভেরোনিসের আঁকা `Rape of Europa’, জিওভান্নি তিয়েপোলোর আঁকা `Gift of Naptune to Venice’। (একটা কথা বলে রাখা ভালো, সব মিউজিয়ামেই এত বেশি শিল্পকলার নিদর্শন দেখেছি, তাদের মাত্র কয়েকটার কথাই লেখা সম্ভব।)
ডানাওয়ালা সিংহ ও সান মার্কো
এটা সান মার্কো বা সেন্ট মার্কের প্রতীক। প্রতিবছর ভেনিসে যে চলচ্চিত্র উৎসব হয়, তাতে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য যে ভেনিসিয়ান সিংহ উপহার দেওয়া হয় তা এই বিখ্যাত winged lion এর অনুকরণে তৈরি। ডুকাল প্রাসাদে ঢোকার মুখে বিখ্যাত golden staircase । স্বর্ণ-খচিত এই সিঁড়ি দিয়ে প্রাসাদে ঢুকে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে সাক্ষী রইলাম নানান ভাস্কর্যের, চিত্রকলার নিদর্শনের। মধ্যযুগের শেষদিকে ইউরোপে প্রযুক্তির নানান উন্নতি ঘটে, বিশেষত কৃষিতে, বস্ত্রনির্মাণে। তারই ফলে জমে ওঠে এই উদ্বৃত্ত। একই সঙ্গে এই উদ্বৃত্তকে অত্যন্ত সহজলভ্য করে তোলে জাহাজ ও নৌচলাচলের উন্নতি। এই বাণিজ্যের মূলস্রোত পূর্ব দিক থেকে এসে ভেনিসের মধ্যে দিয়ে গোটা ইউরোপে প্রবাহিত হত। সোনা দিয়ে কাজ করা প্রাসাদের ছাদ, দেওয়াল মনে করালো বৈদেশিক বাণিজ্যের দৌলতে ফুলে ফেঁপে ওঠা ঐশ্বর্যশালী সেই ভেনিসকে।
ইল প্যারাডিসো |
Giant Staircase |
প্রাসাদের একপাশে রয়েছে Giant Staircase - মঙ্গল ও নেপচুনের বিশাল মূর্তিগুলো একটা বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার ওপর। আসলে ভেনিস একসময় সমুদ্র পথে বাণিজ্য করেই বিশাল ধনসম্পত্তি করে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সেজন্য সমুদ্রের ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য এবং তা সারা পৃথিবীকে বোঝানোর জন্য যুদ্ধের দেবতা মঙ্গল এবং সমুদ্রের দেবতা নেপচুনের আশীর্বাদ তখন তাদের বিশেষ ভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তখন ভেনিস শাসন করত ধনী পরিবারগুলো থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে তৈরি দশজন সদস্যের একটা দল, `Great Council’। ভেনিসের ডিউক, যাঁকে ডোজে বলা হত, এবং যাঁর নামে এই প্রাসাদ; তিনিও নির্বাচিত হতেন। কিন্তু একবার নির্বাচিত হবার পর আমৃত্যু তিনি ঐ পদে বহাল থাকতেন। ডুকাল প্রাসাদের অসংখ্য কক্ষ। একজায়গায়, সংকীর্ণ অলিন্দ টপকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলাম প্রাসাদের নীচে অন্ধকূপে। বন্দীদের রাখা হত লোহার গরাদ দেওয়া ছোটো ছোটো খুপরিগুলোতে। সংকীর্ণ অলিন্দ দিয়ে কারাগারে যাবার আগে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে তারা জীবনের শেষবারের জন্য বাইরের পৃথিবীটার দিকে একপলকের জন্য যখন তাকাত, একটা ব্রিজ তাদের চোখে পড়ত। তাই আজও সেটা ‘Bridge of Sighs’ নামে পরিচিত ।
ব্রিজ অফ সাইস, ভেনিস
ব্যক্তি মানুষ ও ব্যক্তিত্বের বহুমুখী বিকাশের ওপর মৌলিক প্রাধান্য থেকে উদ্ভব হয় রেনেসাঁ যুগের আদর্শ-মানুষ সম্পর্কিত মানবতাবাদী ধারনা। ইতালীয় ভাস্কর্য , স্থাপত্য ও চিত্রকলায় লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চি, মিকেলাঞ্জেলো, রাফায়েল, ব্রামান্ত প্রমুখের এবং সাহিত্যে পেত্রারক, দান্তে, বোকাচ্চিও, এরিওস্তো্র মতো সাহিত্যিকদের আবির্ভাব ইতালির মনন জগত বিকাশের এক স্বর্ণযুগ আনে। তার এত নিদর্শন, যে দেখে শেষ করা যায় না।
প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আমরা চলে গেলাম উল্টোদিকের Correr Museum, জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব মিউজিয়ামে। ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের পতনের পর অষ্ট্রিয়ার অধীনে থাকাকালীন যুগের ভেনিসের নানান রকমের অস্ত্র সম্ভার, যুদ্ধজাহাজের মডেলগুলো সেখানে সংরক্ষিত আছে।
পিয়াজা সান মার্কো |
প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আমরা চলে গেলাম উল্টোদিকের Correr Museum, জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব মিউজিয়ামে। ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের পতনের পর অষ্ট্রিয়ার অধীনে থাকাকালীন যুগের ভেনিসের নানান রকমের অস্ত্র সম্ভার, যুদ্ধজাহাজের মডেলগুলো সেখানে সংরক্ষিত আছে।
করার মিউজিয়ামের নানা সংগ্রহ |
সামনের ব্যাসিলিকায় ঢোকার জন্য বিশাল লাইন দেখে ঢোকার ইচ্ছে সংবরণ না করে উপায় ছিল না; কারণ ভেনিসে রাত্রে থাকব না। আমাদের হাতে সময় কমই ছিল। কেবল ব্যাসিলিকার মাথায় চারটে বিখ্যাত ব্রোঞ্জের ঘোড়ার মূর্তি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। এগুলো অবশ্য নকল, মূল প্রাচীন গ্রিক মূর্তিগুলো ভিতরে আছে। নেপোলিয়ন ইতালি আক্রমণের সময় এই ঘোড়াগুলো আর ডানাওয়ালা সিংহকে ফ্রান্সে নিয়ে যান। পরে সেগুলো আবার ফেরত আসে।
সান মার্কোর ব্যাসিলিকা |
সারা পৃথিবী থেকে আসা পর্যটকের ভিড় বেশ উপভোগ করা যায় ভেনিসের পুরানো ইতিহাসের স্মৃতি বয়ে বেড়ানো অতি প্রাচীন অলিগলিতে। খাবারের অসম্ভব দাম। তার মধ্যেই আমরা একটা বাংলাদেশী দোকান থেকে দোনা কাবাব কিনে খেলাম, সঙ্গে পানীয়। প্রচুর বাংলাদেশী ওখানে ব্যবসা করে। মুখোশ খুব বিক্রি হচ্ছে দেখলাম, কয়েকটা কিনেও ফেললাম । একটু আগে ‘Great Council’ এর কথা বলেছি। ভেনিস শাসন করার সময়ে দশ জন সদস্যদের মধ্যে অনেকে নগর পরিচালনার সময়ে প্রকাশ্যে পরিচয় জানাত না। সভাতে তারা মুখোশ পরে থাকত। সেই থেকেই সম্ভবত ভেনিসের মুখোশ বিখ্যাত।
ফুলের বাহার, ভেনিস |
ভেনিস থেকে ত্রিয়েস্তে ফিরে রাত্রে প্রবল উদ্যমে দুজনে মিলে গল্প করতে করতে রান্না করলাম। স্যালমন মাছের ঝাল আর ভাত। বাইরে বেড়াতে গেলে আমরা সবাই খুব উদার হয়ে যাই। বাড়িতে কখনো রান্না করলে গৌতম ভুলেও আমাকে যেচে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না। কিন্তু ওখানে উৎসাহটাই আলাদা রকম। ত্রিয়েস্তেতে রোজ রাতের রান্নাতে ও হাত লাগাতো। রাতে রান্নার ফাঁকে ফাঁকে আমরা একসঙ্গে গান করতাম বা কবিতা আওড়াতাম। ভেনিস ঘুরে আসার পর আর মাত্র দুদিন ওখানে থাকব । তারপর ফ্লোরেন্সের দিকে রওনা দেব। সেখানে রান্না করে খাবার কোনো সুযোগ নেই। এদিকে ফ্রিজে একগাদা মাংস, সব্জি ঠাসা। কিন্ত চাল শেষ। গৌতম বলল, দুটো দিন ভাত বাদ দিয়ে পাস্তা দিয়ে চালিয়ে দাও। দু ইউরো দিয়ে এক কিলো চাল কিনলে শেষ হবে না, ফেলে দিতে হবে। কিন্তু আমার মনটা মুষড়ে গেল। ফ্লোরেন্স বা রোমে গিয়ে ভাত পাব কিনা জানি না। ত্রিয়েস্তেতে যেখানে রোজই প্রায় রেঁধে খেতাম। ভাত ছাড়া কতদিন থাকতে হবে ভেবেই কষ্ট হতে লাগল। পরদিন ফ্রিজে যা যা ছিল, একটা গোটা বাঁধাকপি, অন্য সব্জি, মাংস সব রান্না করে ফেললাম। আমার ভাতের জন্য শোকাকুল অবস্থা বুঝে ও অফিস যাবার আগে বাজার থেকে অল্প চালের (৫০০ গ্রাম) সিল করা প্যাকেট কিনে এনে আমার মুখে হাসি ফোটালো। ঐ চাল দিয়ে আমার চার বেলা ভালোভাবে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু রান্না করতে গিয়ে একেবারে বোকা বনলাম। প্যাকেটে চাল নয়, ছিল রান্না করা ভাত -- খালি গরম করে খেতে হবে। প্যাকেটের গায়ে ইতালিয়ান ভাষায় সবই লেখা থাকে। কিন্তু ভাষাটা না জানার ফলে ঐ দুদিন দুপুরে ও রাত্রে স্তুপাকার বাঁধাকপি, সব্জি ও মাংসের ওপর নামমাত্র ভাত ছড়িয়ে পেট ভরালাম। বিদেশে গেলেও ভাতের প্রতি আকর্ষণ আমার এতটুকুও কমেনি দেখে নিজেই অবাক হলাম। (ক্রমশ)
প্রকাশিতঃ সৃষ্টির একুশ শতক, জুন ও জুলাই সংখ্যা, ২০১৬
এককথায় অনবদ্য। একটানে পুরোটা পড়ে ফেললাম। কোনো অতিশয়োক্তি নেই,সর্দি লাগাজনিত অস্বস্তি থেকে শুরু করে মনের অজান্তেই সত্তর দিয়ে গুন করে ফেলার অভ্যেস,জলের বোতলের দাম, ভাতবিহীন রাত কাটানোর অনুভূতি - সরল স্বীকারোক্তিতে সমৃদ্ধ এরকম প্রান্জল একটা লেখা উপহার দেওয়ার জন্য ম্যাডামকে আন্তরিক অভিনন্দন । তৃতীয় বিশ্বের একজন সাধারন মানুষের জবানবন্দিতে ইওরোপকে পড়তে গিয়ে নিজেকে খুব বেশি করে খুঁজে পেলাম, বারে বারেই । আর শেষটা প্রত্যাশিতভাবেই ছুঁয়ে গেল... গায়ে শিহরণ জাগানো স্বপ্নের সেই ইতিহাসের দেশ থেকে বিবিধ প্যাকেজের ফাঁসে বিপর্যস্ত 'মা-মাটি-মানুষ'-এর বাংলায়, কঠোর বাস্তবে পদার্পণ, মনে দাগ কেটে গেল । আরও পড়তে চাই আর মুখোমুখি চা তেলেভাজা সহযোগে আড্ডার ইচ্ছে রয়ে গেল কিন্তু !
ReplyDelete