Monday 1 May 2017

ইবন আল হাইথাম

আলোকবিজ্ঞানী ইবন আল হাইথাম      
     গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়                
                       
     রাষ্ট্রসংঘ গত বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালকে আন্তর্জাতিক আলোক ও আলোক নির্ভর প্রযুক্তি বর্ষ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। আলোর গুরুত্ব কাউকে আলাদা করে নিশ্চয় বুঝিয়ে বলতে হবে না। বাইরের জগত সম্পর্কে যে ইন্দ্রিয় আমাদের সবচেয়ে বেশি খবর দেয় তা হল চোখ। বিজ্ঞানের ভাষায় চোখ হল আলোক-সংবেদী অঙ্গ, বাইরের কোনো বস্তু থেকে আলো এসে আমাদের চোখে পড়লে আমরা তাকে দেখতে পাই। ২০১৫ সালকে আন্তর্জাতিক আলোক বর্ষ হিসাবে পালন করার প্রস্তাব আসে ২০১২ সালে।  ঘানা ও মেক্সিকোর আনা সেই প্রস্তাব নানা ধাপ পেরিয়ে ২০১৩ সালে রাষ্ট্রসংঘে গৃহীত হয়। আমরা জানি ঘানা দেশটা আফ্রিকা মহাদেশে আর মেক্সিকো উত্তর আমেরিকায়। আলোর সমস্ত গুরুত্ব মেনে নিয়েও একটা প্রশ্ন হয়তো মনে আসে, হঠাৎ করে ২০১৫ সালকেই আন্তর্জাতিক আলোক ও আলোক প্রযুক্তি বর্ষ বলে বেছে নেওয়ার কথা পরষ্পরের থেকে এত দূরের এই দুই দেশের প্রতিনিধিদের মনে এসেছিল কেন?
২০১৫ সালে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনার হাজার বছর পূর্ণ হল। ১০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল আলোক বিষয়ে মধ্যযুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।  ১৭০৪ সালে আইজাক নিউটনের ‘অপটিক্স’ অর্থাৎ আলোকবিদ্যা প্রকাশের আগে পর্যন্ত, আলোকবিজ্ঞানে গ্রিক বিজ্ঞানী টলেমির লেখা ‘আলমাগেস্ট’-কে বাদ দিলে, অধিকাংশ বিজ্ঞানীর কাছেই এই বইটির কদর ছিল অন্য সবার থেকে বেশি। কী নাম ছিল ১০১৫ সালে প্রকাশিত বইটির? লেখকই বা কে? ইউরোপে তখন বিজ্ঞানের সমস্ত বই লেখা হত লাতিন ভাষায়। এই বিশেষ বইটির লেখক ইউরোপে পরিচিত ছিলেন আলহাজেন নামে। তবে ইরোপে বইটি পৌঁছোতে সময় লেগেছিল প্রায় দুশো বছর। মূল বইটি তাহলে কী ভাষায় লেখা?
মূল বইটির নাম ছিল ‘কিতাব-আল-মঞ্জির’। আরবি ভাষায় লেখা বইটি লিখেছিলেন সুপরিচিত বিজ্ঞানী আবু আল হাসান ইবন আল হাসান ইবন আল হাইথাম, সংক্ষেপে আল হাইথাম নামে যিনি বিজ্ঞানের ঐতিহাসিকদের কাছে পরিচিত। আল হাইথাম সারা জীবনে দুশোর বেশি বই লিখেছিলেন বলে কথিত আছে  যার মধ্যে পঞ্চাশের বেশি আমাদের কাছে এসে পৌঁছোছে।  আলোকবিদ্যা ছাড়াও গতিবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয় আমরা তাঁর লেখা থেকে পাই। 
Book of Optics Cover Page.jpg
কিতাব-আল-মঞ্জিরের প্রথম পাতা

আল হাইথামের জন্ম হয়েছিল ৯৬৫ সালে বসরায় বর্তমানে যা ইরাকের অন্তর্গত। খলিফা আল হাকিমের আমলে আল হাইথাম তাঁর রাজধানী কায়রোতে যান। কায়রোতেই আজহার মসজিদের কাছেই তাঁর জীবনের সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছিল, তাঁর অধিকাংশ গবেষণা সম্পূর্ণ হয়েছিল। মধ্যযুগের সবচেয়ে বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল-আজহার এই মসজিদের সঙ্গে যুক্ত। ৯৭০ সালে মাদ্রাসা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে তা এক পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে একাদিক্রমে চালু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানদের তালিকায় সবচেয়ে পুরানো নাম আল আজহার। হাইথামের জীবন সম্পর্কে নানা গল্প শোনা যায় যদিও সে নিয়ে আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। কায়রোতেই ১০৪০ সালে আল হাইথামের জীবনাবসান হয়। 
বিজ্ঞানের ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন আল হাইথামের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল পরীক্ষামূলক বিষয় হিসাবে বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা। মধ্যযুগে ইঊরোপীয় বিজ্ঞানে পরীক্ষানিরীক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন রজার বেকন (১২২০-১২৯২)। কিন্তু তাঁর দুশো বছরেরও বেশি আগে আল হাইথাম আরব বিজ্ঞানে পরীক্ষামূলক পদ্ধতি চালু করেন। কিতাব-আল-মঞ্জির সাত খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডেই তিনি বুঝিয়ে দেন আলোক বিষয়ে নিজের করা নানা পরীক্ষার ফল তাঁর বইতে পাওয়া যাবে। পরীক্ষা করে যা পাওয়া যাবে না, তা তিনি লিখবেন না।যে তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই, তা নিয়ে তিনি চিন্তিত নন।
আলোক বিষয়ে পূর্বসূরী অনেক বিজ্ঞানীর মত তিনি আলোচনা করেছিলেন, কখনো কখনো তা ভুল বলে প্রমাণও করেছিলেন। প্লেটো টলেমি বা ইউক্লিডের মত বিজ্ঞানীরা মনে করতেন চোখ থেকে আলো বেরিয়ে কোনো বস্তুতে পড়লে তাকে আমরা দেখতে পাই। আল হাইথামই প্রথম বলেন যে বস্তু থেকে আলো এসে চোখের রেটিনাতে পড়ে ও স্নায়ু মারফত মস্তিষ্কে পৌঁছোয়। আরও নানা বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি বলেছিলেন যে আলো যখন বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে যায়, তখন তার বেগ পালটে যায়। আলোকে তিনি কণিকার স্রোত বলে মনে করতেন।
বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায়, বিশেষ করে গণিতে, আল হাইথামের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর করা অনেক গবেষণা হারিয়ে গিয়েছিল, পরে আবার তা পুনরাবিষ্কৃত হয়। যেমন অষ্টাদশ শতাব্দির বিজ্ঞানী জন উইলসনের নামে একটি পরিচিত উপপাদ্য আছে যা আসলে প্রথম প্রমাণ করেন ইবন আল হাইথাম। এ সব সত্বেও অধিকাংশ বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক তাঁকে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের প্রথম  যুগের প্রবক্তা হিসাবে মনে রাখেন। তাইতো কিতাব-আল-মঞ্জিরের প্রকাশকালের সহস্র বর্ষপূর্তি সমস্ত পৃথিবীতে পালিত হয়েছে।

 (ইদ উৎসব ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত)
 

No comments:

Post a Comment