Saturday, 10 March 2018

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বিজ্ঞান গবেষণার অভিমুখ



       সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বিজ্ঞান গবেষণার অভিমুখ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


       ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে রাশিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানশিক্ষা ও গবেষণাতেও সেই নতুন রাষ্ট্র আমূল পরিবর্তন এনেছিল। তা শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক নয়, বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা সংস্থার পরিচালন সমিতির পরিবর্তনের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকেনি বিপ্লবের অব্যবহিত পরে নেয়া পদক্ষেপগুলি একদিকে যেমন বিজ্ঞান গবেষণা চালাবার সাবেকি রীতিকে পালটে দিয়েছিল, অন্যদিকে তেমনি বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক প্রগতির ইতিহাসকে দেখার এক নতুন দিক নির্দেশ করেছিল। ইতিহাস যেমন শুধুমাত্র রাজরাজড়া-সম্রাট-বাদশাহ-রাষ্ট্রনায়কদের বিবরণ নয়, বিজ্ঞানের ইতিহাসও তেমনি বিচ্ছিন্ন কিছু আবিষ্কারের কাহিনি নয় – এ কথা মনে রেখেই নতুন বিজ্ঞান নীতি স্থির করা হয়েছিল। কোন ধরনের নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নে নেওয়া হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীর গবেষণা চালানোর পদ্ধতিতে তার কোন প্রভাব পড়ে, তা এই প্রবন্ধে সংক্ষেপে দেখব স্থান সংকুলানের জন্য আমরা আমাদের আলোচনাকে বিপ্লবের পরের দুই দশকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব  
       এক দেশে, বিশেষ করে রাশিয়ার মতো পশ্চাৎপদ দেশে, সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি নিয়েছিলতাদের সেই লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার হয়েছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইউরোপের আলোকপ্রাপ্তির যুগ, রাশিয়ার উদারপন্থী চিন্তাভাবনার ঐতিহ্য ও মার্ক্সবাদ থেকে শিক্ষা নিয়ে রাশিয়ার  কমিউনিস্ট পার্টি বিজ্ঞানের উন্নতির মাধ্যমে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল যুগযুগব্যাপী ধর্মীয় কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা দিয়ে পরাজিত করতে চেয়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে যে চোখ-ধাঁধানো অগ্রগতি ঘটেছিল, তার পিছনে ছিল বিজ্ঞানপ্রযুক্তির পিছনে সুচিন্তিত বিনিয়োগ। সেই চিন্তার উৎস হল বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে অর্জিত শিক্ষা মার্ক্সবাদীদের কাছে ইতিহাস নিছক অতীতের বিবরণ নয়, তা ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ করে। বিজ্ঞানের ইতিহাস তার ব্যতিক্রম নয়। ১৯৩১ সালে বিজ্ঞানের ইতিহাসে সোভিয়েত প্রতিনিধিদের আলোচনার উপর রিপোর্টে  বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক জে ডি বার্নাল লিখেছিলেন, ‘The history of science was plainly vitally important to them; it was  not only an academic study but a guide to action.’ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রয়াস পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞান পরিকল্পনাকে পথ দেখিয়েছিল বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য রাশিয়ার প্রয়াস বিশেষ করে পরাধীন বা অনুন্নত দেশগুলিতে বিশেষ আগ্রহের জন্ম দিয়েছিল।
       কী কী পরিবর্তন এনেছিল বিজ্ঞান গবেষণা পরিচালনার ক্ষেত্রে? কমিউনিস্ট পার্টি মনে করেছিল যে বিজ্ঞান গবেষণার লক্ষ্য হওয়া উচিত ব্যবহারিক প্রয়োগ, বিমূর্ত গবেষণার কোনো সার্থকতা নেই। এই মত নিয়ে সাধারণভাবে বিতর্ক থাকবেই, কিন্তু সেই মুহূর্তে রাশিয়ার পরিস্থিতি বিচার করলে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো তর্ক সম্ভবত ওঠে না। বিজ্ঞান গবেষণা, যার মধ্যে সমাজবিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণাকেও ধরতে হবে, তাকে এক গুরুত্বপূর্ণ পেশা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়সমস্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিকে রাষ্ট্রাধীন করা হয়, তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশকে পড়ানোর কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে শুধুমাত্র গবেষণার কাজে নিযুক্ত করা হয়। বিজ্ঞানের লক্ষ্য যেহেতু ব্যবহারিক প্রয়োগ, তাই গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা হয়। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন শিল্পের সামনের সমস্যাগুলি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করা হয়, অন্যদিকে তেমনি শিল্পের কাছে যে অপেক্ষাকৃত বেশি সম্পদ আছে, তার একাংশ বিজ্ঞানের উন্নতিতে ব্যবহৃত হয়। শিল্পের সঙ্গে গবেষণার মেলবন্ধনের এই নীতি যে পৃথিবীতে একেবারে নতুন তা নয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে বিদ্যুৎ শিল্প এবং গবেষণা হাত ধরাধরি করে চলেছে গ্রাহাম বেল, এডিসন, টেসলা, মার্কনি - এঁদের নাম আমরা সকলেই জানি এঁরা সকলেই গবেষণা এবং একই সঙ্গে শিল্প-স্থাপনে উৎসাহী ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রসায়ন শিল্প বিষয়ে সরাসরি গবেষণা শুরু হয়েছিল কিন্তু তা ছিল সাধারণ ভাবে ব্যতিক্রম এগুলো ছিল মূলত ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথম সংগঠিত ভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্প ও বিজ্ঞানের গাঁটছড়া বাঁধার চেষ্টা করে।
       বিমূর্ত ও মৌলিক গবেষণার মধ্যে পার্থক্য করার কোনো সহজ উপায় নেই কেজো লক্ষ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা মানেই কিন্তু মৌলিক গবেষণাকে অস্বীকার করা নয়। বিপ্লবের পরে সোভিয়েত দেশে মৌলিক গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়নি, তার অনেক উদাহরণ দেওয়া যায় -- সে কথায় আমরা পরে আসছি মুক্ত চিন্তার দিক থেকে বিচার করলে গবেষণার উপর কতটা নিয়ন্ত্রণ আদৌ কাম্য তা ঠিক করা সহজ নয়।  কিন্তু আজকের দিনে, স্বীকার করুক বা না করুক, সব দেশই গবেষণার ক্ষেত্রে একই নীতি অনুসরণ করছেপরীক্ষামূলক বিজ্ঞানে গবেষণা করতে গেলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, গবেষককে স্বাভাবিকভাবেই সেদিকে খেয়াল রেখে তার গবেষণার দিক ঠিক করতে হবে। তাত্ত্বিক গবেষকদেরও নিজের খুশিমতো বিষয় নির্বাচন কঠিন হয়ে পড়েছে। গবেষণা সম্মেলনগুলিতে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর আলোচনা হয়, গবেষণা পত্রিকাতে প্রচলিত ক্ষেত্রের খুব বাইরের প্রবন্ধ ছাপা শক্ত হয়ে পড়েছে, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিও তাদের সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির লক্ষ্যের কোনো বিষয়ে গবেষণাকে উৎসাহ দেয় না সরকারি প্রতিষ্ঠান হোক বা বেসরকারি, অর্থ বরাদ্দ করার সময় তার নজরে থাকবে কত তাড়াতাড়ি তার থেকে ফল পাওয়া যায়। বর্তমান যুগে সর্বত্রই বিজ্ঞান গবেষণাকে ব্যবহারিক পথেই চালিত করা হচ্ছে, শিল্পের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার কথা বলা হচ্ছে।
এই পর্যন্ত পড়ে যদি কারো মনে হয় যে বর্তমানে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে গবেষণাকে পরিচালনা করার চেষ্টা করছে, তা সোভিয়েত ইউনিয়ন অনুসৃত নীতি থেকে পৃথক নয়, তাঁদের জন্য দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক বিপ্লবের পাঁচ বছরের মধ্যে ১৯২২ সালে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সমীকরণের সমাধান করতে গিয়ে আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান প্রসারণশীল বিশ্বের কথা বলেন। প্রথমে আইনস্টাইন ভেবেছিলেন এই সমাধানটা ভুল, পরে অবশ্য তিনি মেনে নেন যে ফ্রিডম্যানের কাজ পুরোপুরি সঠিক১৯২৯ সালে হাবল আবিষ্কার করেন যে আমাদের বিশ্ব সত্যি প্রসারণশীল। ফ্রিডম্যানের কাজের কোনো ব্যবহারিক উপযোগিতা আমরা কল্পনাতে আনতে পারি না। তারপরে ধরা যাক রমন এফেক্টের কথা। ১৯২৮ সালের আটাশে ফেব্রুয়ারিকে রমন এফেক্ট আবিষ্কারের দিন বলে আমরা জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসাবে পালন করি, যদিও রমন ও তাঁর ছাত্র কে এস কৃষ্ণণ ১৬ ফেব্রুয়ারি নেচারে এক চিঠিতে এই সম্পর্কিত কিছু খবর লিখেছিলেন। সোভিয়েত বিজ্ঞানী লিওনিদ ম্যান্ডেলস্টাম ও গ্রিগরি ল্যান্ডসবার্গ সেই বছরই ২১ ফেব্রুয়ারি এই এফেক্ট দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয় মে মাসে, ততদিনে রমনের দাবী প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। রমনের অগ্রাধিকার নিয়ে নোবেল কমিটিও পুরস্কার দেওয়ার আগে দীর্ঘ আলোচনা করেছিল। এখন রমন এফেক্ট আমাদের নানা কাজে লাগলেও ১৯২৮ সালে তা ছিল একান্তভাবেই মৌলিক বিজ্ঞানের কাজ। সেই মুহূর্তে তার কোনো ব্যবহারিক প্রয়োগ কারো মাথায় আসেনি। অর্থাভাবসহ অন্যান্য সমস্যার মধ্যেও এবং ব্যবহারিক প্রয়োগের উপর জোর দিলেও মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণা রাশিয়ায় বন্ধ হয়ে যায়নি। তার কারণ নীতি প্রণেতারা মৌলিক গবেষণা বন্ধ করে দেশে শুধুমাত্র ব্যবহারিক গবেষণা করা সম্ভব, এ কথা চিন্তা করার মতো বোকা ছিলেন না। এরকম আরো নানা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি আমাদের দেশে অবস্থা কী? কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের কাছে গবেষণার জন্য অর্থে বরাদ্দের আবেদন করতে গেলে বর্তমানে বলে দিতে হয় গবেষণাটি Make in India, Swachch Bharat, Digital India, Swastha Bharat, Start-up India – এই পাঁচটির মধ্যে কার অধীনে আসবে। ফ্রিডম্যানের গবেষণা বা রমন এফেক্টকে এই বিভাগগুলির মধ্যে কোনটিতে আপনি ফেলবেন?
       কোলাবরেটিভ বা সহযোগিতামূলক গবেষণা আজ খুব সাধারণ বিষয়, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত একক, ছাত্রের সঙ্গে বা বড়োজোর সামান্য সংখ্যক বিজ্ঞানী মিলে কোনো বিষয়ে গবেষণাই ছিল রীতি। কিন্তু মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী কমিউনিস্ট পার্টি মনে করেছিল যে বিজ্ঞান গবেষণা শুধুমাত্র কয়েকজন ব্যক্তির কৃতিত্ব নয়,  কোনো যুগের বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে সে সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। আবার জে ডি বার্নালের উপরোক্ত লেখা থেকে উদ্ধৃত করি। নিউটন বা ডারউইনের কৃতিত্ব আলোচনা প্রসঙ্গে সোভিয়েত প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, ‘It was the age that formed and found the man rather than the man who found the age.’  তীব্র অভাবের মধ্যেও নতুন সরকার শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রতিভার উপর নির্ভর না  করে অনেকগুলি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন যেখানে বিশেষ বিষয়ে একত্রে অনেক গবেষক কাজ করতেন এবং মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে সমস্যাগুলি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করতেন। এক্স-রে, রেডিও, এরোডায়নামিক্স, এরা সবাই পদার্থবিজ্ঞানের অঙ্গ --– কিন্তু বিপ্লবের পরে পরেই এই বিষয়গুলিতে গবেষণার জন্য আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়। অনেক পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির সময় এই পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছিল। আজ যৌথ ভাবে গবেষণা করাটাই স্বাভাবিক, অনেক বড়ো বড়ো কোলাবরেশনে বহু দেশের শতশত বিজ্ঞানী একত্রে কাজ করেনতাঁরা গবেষণার বিষয়টাকে ক্ষুদ্র ঠিক করে নিয়ে তাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে সেগুলিকে পৃথক পৃথকভাবে সমাধান করেন। হিগস বোসন কণা আবিষ্কার হয়েছিল যে গবেষণাগারে, সেই সার্নের সঙ্গে প্রায় ষাটটি দেশের ছ’হাজার বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদ জড়িত আছেন সোভিয়েত ইউনিয়নই সচেতন ভাবে ও পরিকল্পনামাফিক এই ধরনের সমবেত সহযোগিতার মাধ্যমে গবেষণার সূচনা করেছিল
       আজ আমরা যে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণের সময় বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে অভ্যস্ত। কোন ফসল চাষ  হবে, খনিজ উত্তোলন কোন পদ্ধতিতে সবচেয়ে লাভজনক হবে, বাঁধ নির্মাণ কোথায় হবে, এ সমস্তের জন্য আমরা বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হই। এরও শুরু করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন যেখানে সরকারি পরিকল্পনা গ্রহণের স্তরে বিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। একশো বছর আগে এই ঘটনা ছিল প্রায় সারা বিশ্বেই অভূতপূর্ব এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আকাদেমি অফ সায়েন্সেস যা সারা দেশের বিজ্ঞান গবেষণা সংগঠনের দায়িত্ব নেয়। লেনিন আকাদেমিকে শিল্প স্থাপন ও রাশিয়ার পুনর্গঠনের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণে বিশেষজ্ঞের ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। আকাদেমি সোভিয়েত দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ চিহ্নিত করার ও তাকে ব্যবহার করার পরিকল্পনা তৈরি করে এবং বিজ্ঞান গবেষণার দিক নির্ণয় করে। তারই সহায়তায় প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ১৯২৯ সালে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির উপর কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, তা একটা মাত্র তথ্য থেকে বোঝা যায় --- দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে জাতীয় আয়ের এক শতাংশ বরাদ্দ হয়েছিল বিজ্ঞানের জন্য। এই অংশটা সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বরাদ্দের তিনগুণ এবং ব্রিটেনের বরাদ্দের দশ গুণ। একটা অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া অর্থনীতিতে এই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেখিয়ে দেয় যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিজ্ঞানপ্রযুক্তিকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছিল।
সে সময় চীন বা ভারতের মতো পিছিয়ে পড়া দেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের এই নীতি বিশেষ আগ্রহের জন্ম দেয়। ১৯২০-র দশকেই চিনের কুয়োমিনতাং সরকার সোভিয়েত পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের চেষ্টা করে। সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পরে পরাধীন ভারতেই  ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি তৈরি করেন। তাতে ছিলেন দুজন প্রথম সারির বিজ্ঞানী – মেঘনাদ সাহা ও জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ, এবং একজন স্বনামধন্য ইঞ্জিনিয়ার এম বিশ্বেশ্বরাইয়া। স্বাধীনতার পরে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণে অপর এক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রেরণা নিয়ে বিজ্ঞানীদের দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনার জন্য তৈরি হয়েছিল দুটি সংগঠন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ সায়েন্টিফিক ওয়ার্কার্স এবং সায়েন্টিফিক ওয়ার্কার্স  অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া
উন্নত দেশেও সোভিয়েত প্রয়াস বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স ১৯৩৩ সালে তার রাজনীতি থেকে দূরে থাকার নীতি পরিত্যাগ করে, ঘোষণা করে যে বিজ্ঞানীর পক্ষে আর সাধারণ মানুষের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা সম্ভব নয়। জে ডি বার্নাল, জোসেফ নিডহ্যাম, জে বি এস হ্যালডেন বা হাইম্যান লেভির মতো বিশিষ্ট ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের ইতিহাস ও সমাজ পরিবর্তনে তার ভূমিকা বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। এ সমস্ত ঘটনার পিছনে ১৯৩১ সালে বিজ্ঞানের ইতিহাস কংগ্রেসে সোভিয়েত প্রতিনিধিদের প্রভাব ছিল। রাশিয়ার ঘটনাবলী ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাডারের উপর গবেষণারত বিজ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য প্রতি রবিবার যে সভায় মিলিত হতেন, তার নাম তাঁরা দিয়েছিলেন সানডে সোভিয়েত।
ফ্রান্সে সোভিয়েত ইউনিয়নের নীতির প্রভাব ছিল আরো ব্যাপকপদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার জয়ী জাঁ পেরিন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানীদের মতো সুযোগসুবিধা আদায়ের জন্য চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ১৯৩২ ও ১৯৩৬ সালে নির্বাচনে প্রগতিশীল বামপন্থী শক্তির জয়ের সুযোগে বিজ্ঞানীরা ফরাসি বিজ্ঞানের কাঠামোকে সোভিয়েত মডেল অনুসারে পাল্টানোর কাজ শুরু করেন। সারা দেশে গবেষণার অর্থ সংস্থানের জন্য একটি  সংস্থা সিএনআরএস তৈরি হয় ১৯৩৫ সালে চার বছরের মধ্যেই ফ্রান্সের বিজ্ঞানীদের প্রায় অর্ধেক তাঁদের  গবেষণার কাজে এই নতুন সংস্থার সাহায্য পেয়েছিলেন। পেরিন ও আর এক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আইরিন কুরি সরকারের বিজ্ঞান দপ্তরের মন্ত্রী হয়েছিলেন। বিজ্ঞানীদের সরাসরি রাজনীতিতে যোগদানের এই প্রেরণারও উৎস সোভিয়েত ইউনিয়ন। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বিজ্ঞানীরা নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করেছিলেন। ব্রিটেনের মতোই সে দেশেও তৈরি হয়েছিল বামপন্থী সংগঠন আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ সায়েন্টিফিক ওয়ার্কার্স।
       শিক্ষার বিস্তার ছাড়া বিজ্ঞান গবেষণা সম্ভব নয়। ১৯১৪-১৫ সালে রাশিয়ায় মোট ৯১টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক লক্ষ বারো হাজার ছাত্র পড়াশোনা করত। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া জড়িয়ে পড়ার সময় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে হয় আটশোর বেশি, সেখানে পড়ত ছ’লক্ষ সাতষট্টি হাজার ছাত্রছাত্রীএরা এসেছিল সমাজের সমস্ত অংশ ও দেশের সমস্ত প্রান্ত থেকে কৃষক, শ্রমিক, জাতিগত সংখ্যালঘু ও মহিলাদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্য আলাদা উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাদের জন্য বিনা ব্যয়ে শিক্ষা এবং প্রয়োজনে বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য কোটার ব্যবস্থা হয়। তাদের এমনকি শিক্ষার কোনো কোনো ধাপ এড়িয়ে পরের স্তরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
       সোভিয়েত ইউনিয়ন যে নীতি গ্রহণ করেছিল, তা ছিল সুসংবদ্ধ। আংশিকভাবে তা রূপায়ণ করার মধ্যে সমস্যা আছে।  যেমন ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান গবেষণাকে সরিয়ে নিয়ে কয়েকটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের সোভিয়েত নীতির অন্ধ অনুসরণ দেশের গবেষণার ভিত্তিকে সংকুচিত করেছে। কারণ সোভিয়েত নীতির এক অপরিহার্য অঙ্গ ছিল বিজ্ঞানসহ উচ্চশিক্ষাকে পিছিয়ে পড়া মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার সচেতন প্রয়াস, আমাদের দেশে ওই মাপের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
       সোভিয়েত নীতির মধ্যে সমস্যা কি ছিলনা? তখনও ছিল, এবং সেই সব সমস্যার অনেকগুলির সমাধান আজও আমাদের অধরা। সরকারি নীতি রূপায়ণ করতে গিয়ে এবং সরকারি নির্দেশ মতো চলার ফলে প্রশাসন অতিরিক্ত আমলা নির্ভর হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। বর্তমানেও আমলাতান্ত্রিকতা বিজ্ঞানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে পড়েছে। যে দেশেই বিজ্ঞান গবেষণার মূল দায়িত্ব নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সেখানেই এই সমস্যা আছে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও আজকাল এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। জে ডি বার্নাল ১৯৩৯ সালে তাঁর The Social Function of Science বইতে সাধারণ ভাবে বিজ্ঞানপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে সোভিয়েত নীতিকে সোচ্চারে সমর্থন করেও অন্য এক সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সাবধান করে দিয়েছিলেন যে বিজ্ঞানের ট্রাডিশনের অভাব, যৌবনের উৎসাহের আধিক্য এবং বিদেশের বিজ্ঞান জগতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের যোগাযোগের অভাব স্বাভাবিকভাবেই সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে সমালোচনামূলক মনোভাবকে দুর্বল করে দিয়েছে। এর ফলে যান্ত্রিকভাবে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ প্রয়োগের প্রবণতা বাড়ে এবং অনেক সময় সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই তত্ত্ব নির্মাণের ঝোঁক দেখা দেয়। বিশেষ করে বলতেই হবে কৃষিক্ষেত্রের কথা যেখানে এই ত্রুটি বিপদ ডেকে এনেছিল।
       এ ধরনের নানা দুর্বলতা সত্ত্বেও বলতেই হবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সোভিয়েত পদ্ধতিগুলির ভূমিকা সুদূরপ্রসারী, সারা পৃথিবীর বিজ্ঞান গবেষণাকে তা প্রভাবিত করেছিল। সবসময়ই যে সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথম এই পদ্ধতিগুলিকে ব্যবহার করেছিল তা নয়। আমরা দেখেছি বিদ্যুৎ শিল্প ও সেই সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগের ইতিহাস প্রাচীনতর। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের নীতি প্রণেতারা সচেতন ভাবে এই নীতিগুলিকে প্রয়োগ করেছিলেন। তার ফলস্বরূপ আমরা দেখতে পাই যে একশো বছর আগে রাশিয়াতে বিজ্ঞান গবেষণার যে নতুন ধারার সূচনা হয়েছিল, তখন তা উপহাসের বা অবহেলার পাত্র হলেও আজ সারা বিশ্ব সেটাকেই অনুসরণ করছে। নভেম্বর বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে চমকপ্রদ অগ্রগতি দেখিয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সে দেশ দ্রুত উন্নতির পথে ফিরে আসে এবং পশ্চিমী উন্নত দেশগুলির সঙ্গে সমান তালে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে বিপ্লবোত্তর নীতিগুলিই এর পিছনে রয়েছে, কারণ ১৯১৭ সালের আগে রাশিয়া বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। বিপ্লব বঞ্চিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসে। তারাও এই সুযোগ গ্রহণ করে বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে নিশ্চিত করে। পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজমের কেন পতন ঘটে সে বিষয়ে অনেকে আলোচনা করেছেন, তা আমাদের এই লেখার পরিধির বাইরে। কিন্তু পরে যাই ঘটুক না কেন, সে দেশে বিপ্লবী সরকার বিজ্ঞান গবেষণার যে নীতি অবলম্বন করেছিল, তার প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বে – সে কথাকে কখনোই ভোলা যাবে না।

(প্রকাশঃ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার শারদীয় ২০১৭)


No comments:

Post a Comment