Friday, 19 November 2021

আইনস্টাইনের নোবেল পুরস্কারঃ শতবর্ষে ফিরে দেখা

 

আইনস্টাইনের নোবেল পুরস্কারঃ শতবর্ষে ফিরে দেখা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

লেখাটার শিরোনাম তৈরিতে একটু সমস্যায় পড়েছিলাম; আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানে ১৯২১ সালের নোবেল পুরস্কার  পেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা দেওয়া হয়েছিল পরের বছর। ১৯২২ সালের ৯ নভেম্বর একই সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানে দু’বছরের নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা করা হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর যে সমস্ত মনোনয়ন জমা পড়ে, নোবেল কমিটি তার মধ্যে থেকেই পুরস্কার প্রাপকের নাম রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের কাছে পাঠায়।  এখানে একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। আইনস্টাইন জীবনে মোট এগারোজন বিজ্ঞানীকে নোবেলের জন্য মনোনীত করেছিলেন, তাঁর প্রত্যেকেই শেষ পর্যন্ত পুরস্কার জিতেছেন।

সে যা হোক, ১৯২১ সালে কমিটি কোনো মনোনয়নকেই যোগ্য মনে করেনি। ১৯২২ সালে পদার্থবিজ্ঞানের জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ডেনমার্কের বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিলস বোরকে; একই সঙ্গে ১৯২১ সালের পুরস্কার দেওয়া হল আলবার্ট আইনস্টাইনকে। তাঁর বিখ্যাত আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নয়, নোবেল কমিটি পুরস্কারের কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছিল, ‘for his services to Theoretical Physics, and especially for his discovery of the law of the photoelectric effect’; অর্থাৎ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অবদান ও বিশেষ করে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া সংক্রান্ত তাঁর গবেষণার জন্য তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

পুরস্কারের খবর দিয়ে অ্যাকাদেমির পাঠানো টেলিগ্রাম আইনস্টাইনের হাতে পৌঁছায়নি, তিনি তখন জাহাজে করে সস্ত্রীক জাপানের পথে। খবরটা আইনস্টাইন কবে পেয়েছিলেন বা তাঁর প্রতিক্রিয়া কী ছিল, সে বিষয়ে কিছু জানা নেই; তাঁর ডায়েরিতে এই ঘটনার কোনো উল্লেখ নেই। জার্মানি ছাড়ার আগে বিজ্ঞানী ফন লউ আইনস্টাইনকে বলেছিলেন নভেম্বর মাসে এমন খবর আসতে পারে যাতে ডিসেম্বরে তাঁ  ইউরোপে থাকার প্রয়োজন হবে; আইনস্টাইন সে কথা শোনেননি। অবশ্য তাঁর সেই সময় দেশ ছাড়ার প্রয়োজনও ছিলআইনস্টাইন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন যুদ্ধোত্তর জার্মানির প্রজাতন্ত্রী সরকারের ভাইমার রিপাবলিকের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আইনস্টাইনের বন্ধু জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াল্টার রাঠেনাউ ১৯২২ সালের জুন মাসে অতি দক্ষিণপন্থীদের হাতে খুন হন,  খবর ছিল আইনস্টাইনেরও প্রাণসংশয় হতে পারে। কয়েক বছর পরে নাৎসিরা ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা দেখা দিলে তাঁকে শেষ পর্যন্ত চিরকালের জন্য দেশত্যাগ করতে হয়।

পুরস্কার দেওয়ার সময় আইনস্টাইন ছিলেন জাপানে, তাঁর হয়ে পুরস্কার নেন সুইডেনে জার্মানির রাষ্ট্রদূত। সে বিষয়েও সমস্যা হয়েছিল, আইনস্টাইন ১৮৯৬ সালেই জার্মানির নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন, কয়েক বছর পরে ১৯০১ সালে তিনি হয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। ১৯১৪ সালে বার্লিনে প্রুশিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের অধীনে আইনস্টাইনকে অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা হয়। অ্যাকাডেমির কর্মচারীরা জার্মান সরকারের কর্মচারী, তাই তাঁদের জার্মানির নাগরিক হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। সম্ভবত আইনস্টাইনের জন্য নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছিল। তিনি সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেননি, জাপানে তিনি সুইস পাসপোর্টই ব্যবহার করেছিলেন। ফলে কোন দেশের রাষ্ট্রদূত আইনস্টাইনের হয়ে পুরস্কার নেবেন, তা নিয়ে দুই দেশের বিদেশমন্ত্রকের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল।

১৯২২ সালে আইনস্টাইন বিশ্বের সব থেকে বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের একজন। ১৯০৫ সালে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যাতে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগ বিষয়ে আইনস্টাইনের গবেষণা প্রকাশ হওয়া মাত্র তাঁর নাম বিজ্ঞানী মহলে পরিচিত হয়েছিল; আমরা সবাই জানি যে তাঁর আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন সুইজারল্যান্ডে এক পেটেন্ট অফিসের কেরানি। ১৯১ সালে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সম্পূর্ণ রূপ তিনি প্রকাশ করেছিলেন। ১৯১৯ সালে সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের পাশ দিয়ে আসা আলো সূর্যের মাধ্যাকর্ষণের জন্য কতটা বাঁকে তা মাপা সম্ভব হয়, দেখা গেল তা আইনস্টাইনের হিসাবের সঙ্গে মেলে; সেই খবর প্রকাশ হওয়া মাত্র বিজ্ঞানী মহলের বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও আইনস্টাইনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এই প্রবন্ধের আলোচ্য নয়, বিজ্ঞানের আলোচনা আমরা এই লেখাতে আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব। 

 


আইনস্টাইন যে একসময় নোবেল পাবেন, সে নিয়ে কারোর কোনো সন্দেহ ছিল না, আইনস্টাইনের নিজেরও নয়। ১৯১৯ সালে বিবাহবিচ্ছেদের সময় তিনি প্রথমা স্ত্রী মিলেভাকে কথা দিয়েছিলেন যে নোবেল পুরস্কার যখন পাবেন, সেই টাকা তাঁকে দেবেন; সেই কথা তিনি রেখেছিলেন। ১৯১০ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত তের বছরে তাঁর পক্ষে মনোনয়ন জমা পড়েছিল মোট বাষট্টিটি, ১৯১১ ও ১৯১৫ এই দুই বছর ছাড়া প্রতি বছরই তাঁর নাম বিবেচনাতে এসেছিল। ১৯১৯ সালের পরে তাঁকে অবিলম্বে পুরস্কার দেওয়ার কথা বলেছিলেন অনেক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী।

রয়াল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের সম্পাদক আইনস্টাইনকে জানাতে গিয়ে লিখেছিলেন অ্যাকাডেমি পুরস্কারের কথা বিবেচনার সময় আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে হিসাবে আনেনি। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্য কেন নোবেল পুরস্কার আইনস্টাইনকে দেওয়া হয়নি, সে কাহিনি যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। সেই আলোচনাতে আমরা খুব বিস্তারিত আকারে যাব না; শুধু এই চিঠির পশ্চাৎপটটুকু আমরা দেখে নিই।

১৯২১ ও ১৯২২ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং আলোকতড়িৎ বিক্রিয়ার বিচার করতে জন্য নোবেল কমিটি তার দুই সদস্যকে আলাদা আলাদা রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিল। দু’বছরই আপেক্ষিকতা তত্ত্বের রিপোর্টের দায়িত্বে ছিলেন একই ব্যক্তি, দুবছরই তিনি আইনস্টাইনকে নোবেল দেওয়ার বিপক্ষেই মত দিয়েছিলেন। তাঁর নাম আলিভার গালস্ট্রান্ড, তিনি ছিলেন চক্ষু এবং আলোকবিদ্যা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনিও নোবেলজয়ী, এবং এখনো পর্যন্ত একমাত্র ব্যক্তি যিনি একই সঙ্গে নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান ও গ্রহণ করেছেন। ১৯১১ সালে পদার্থবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যা উভয় বিষয়েই তাঁর নাম এসেছিল। পদার্থবিজ্ঞান কমিটির সদস্য গালস্ট্র্যান্ড পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল নেবেন না বলে কমিটিকে জানিয়েছিলেন এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের নোবেলটিকে স্বীকার করেন। রিপোর্ট দুটি পড়ে বোঝা যায় যে তিনি আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বুঝতেই পারেন নি। ওই রিপোর্টের জন্যই  অ্যাকাডেমির চিঠিতে লেখা ছিল যে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব পুরস্কারের বিবেচনার সময় হিসাবে নেওয়া হয়নি।

১৯২১ সালে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া বিষয়ে রিপোর্টের দায়িত্বে ছিলেন ১৯০৩ সালে রসায়নের নোবেলজয়ী সান্টে আরেনিয়াস। তিনি  লিখেছিলেন সবে ১৯১৮ সালে কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, এখনি একই বিষয়ে আবার পুরস্কার দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এই বিষয়ে যাঁরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন, তাঁদের না দিয়ে আইনস্টাইনের মতো তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীকে পুরস্কার দেওয়ার বিরুদ্ধে তিনি মত প্রকাশ করেছিলেন। পরের বছর রিপোর্টের দায়িত্ব পান কমিটির নতুন সদস্য কার্ল উইলহেল্ম সীন। তিনি সেই বছরই আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার জন্য আইনস্টাইনকে মনোনীত করেছিলেন, স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর রিপোর্ট আইনস্টাইনের পক্ষে যায়। সেই ভিত্তিতেই আইনস্টাইন তার আগের বছরের নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন।

কোথাও কোথাও পড়েছি যে আইনস্টাইনকে আপেক্ষিকতার জন্য পুরস্কার না দেওয়াটা কমিটির ভুল; যে গবেষণার জন্য আইনস্টাইন নোবেল পেয়েছিলেন তা তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজের পড়ে না। আপেক্ষিকতা এই লেখার বিষয় নয়, নিঃসন্দেহে তা নোবেল পুরস্কারের যোগ্য। কিন্তু তা বলে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া বিষয়ে তাঁর কাজকে দ্বিতীয় শ্রেণির মনে করার কোনো কারণ নেই। স্বয়ং আইনস্টাইন নিজের একটিই কাজকে বৈপ্লবিক মনে করতেন, সেটি হল তাঁর আলোকতড়িৎ সংক্রান্ত গবেষণা। আপেক্ষিকতা যেমন স্থান কাল সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে, তেমনি এই কাজটিও বাস্তব বা reality সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে। খুব সংক্ষেপে আমরা আইনস্টাইনের সেই গবেষণা সম্পর্কে জেনে নিই।

আইনস্টাইনের গবেষণা ছিল মূলত আলোর প্রকৃতি নিয়ে, প্রথমেই আমরা আইনস্টাইনের আগে সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা কী ছিল দেখব। আধুনিক আলোক বিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল আইজ্যাক নিউটনের হাত ধরে। আলো যে শক্তির এক রূপ সে বিষয়ে নিউটনের সময় মোটামুটি মতৈক্য গড়ে উঠেছিল। প্রশ্ন ওঠে তাহলে আলো কেমন ভাবে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যায়? বিজ্ঞানী রেনে দেকার্তে , রবার্ট হুক  এবং ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন্স  বললেন আলো হল তরঙ্গ। তবে তা কোন মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যায় সে বিষয়ে তরঙ্গ তত্ত্বের সমর্থকরাও একমত হতে পারেন। নি। নিউটন অবশ্য আলোকে তরঙ্গ বলে মানতে তৈরি ছিলেন না। তিনি মনে করেছিলেন যে আলো হল কণিকার স্রোত। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতে টমাস ইয়ং পরীক্ষা করে প্রমাণ করেন আলো হল তরঙ্গ।

আলোক তরঙ্গের প্রকৃতি কী? মাইকেল ফ্যারাডে অনুমান করেন আলো হল তড়িৎ ও চুম্বক ক্ষেত্রের কম্পন, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব থেকে তা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে তো শূন্যস্থান, সূর্য থেকে আলো আসার জন্য ইথার বলে এক মাধ্যমের কল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু শত চেষ্টাতেও ইথারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত বিশেষ আপেক্ষিকতাতে আইনস্টাইন দেখান যে ইথারের অস্তিত্ব প্রমাণের যে কোনো চেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। আস্তে আস্তে বোঝা গেল যে শূন্যস্থানেও তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র থাকতে পারে, ইথারের প্রয়োজন নেই।

বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে আলো তরঙ্গ; এমন সময় এলো জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কৃষ্ণ বস্তু সংক্রান্ত প্রকল্প। কৃষ্ণ বস্তু কাকে বলে? যে বস্তু তার উপরে পড়া পড়া সমস্ত তড়িৎচৌম্বক রশ্মি বা বিকিরণ সম্পূর্ণ ভাবে শোষণ করে তাকে বলে কৃষ্ণ বস্তু। এই কৃষ্ণ বস্তু থেকে তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গ বিকিরণ হয়। তাপগতিবিদ্যা থেকে বস্তুর কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কোন দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ কত পরিমাণ বিকিরণ হবে তার সূত্র খুব নিশ্চিত ভাবে নির্দিষ্ট করা গেল। কিন্তু মাপতে গিয়ে দেখা গেল যে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে হিসেবটা একেবারেই মিলছে না।

তাপগতিবিদ্যাতে ধরে নেওয়া হয়েছিল তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ যে কোনো পরিমাণ শক্তি নিয়ে আসতে পারে। ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক বললেন এই ধারণা ভুল। আমরা যদি ধরে নিই যে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের শক্তি একটা নির্দিষ্ট মানের গুণিতকে আসে তাহলে কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণের ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। যদি তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য l হয় তাহলে তার জন্য শক্তির ঐ ন্যূনতম মানের পরিমাণ হল hc/lএখানে c হল শূন্যস্থানে আলোর বেগ এবং h একটি ধ্রুবক। এখন আমরা h-কে বলি প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক। ঐ ন্যূনতম মানের দুগুণ তিনগুণ বা হাজারগুণ শক্তি পাওয়া সম্ভব, কিন্তু দেড়গুণ বা পৌনে তিনগুণ পাওয়া যাবে না। কৃষ্ণ বস্তু থেকে শক্তি একটা নিদিষ্ট প্যাকেটের মাপে আসে। শক্তির পরিমাণ পূর্ণ সংখ্যায় প্যাকেটে পাওয়া যাবে, কিন্তু প্যাকেটকে ভাঙা যাবে না। প্ল্যাঙ্ক এই প্যাকেটের নাম দিয়েছিলেন কোয়ান্টাম।

আলোও তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ, তা তাহলে কতকগুলো কোয়ান্টামের সমষ্টি।  এবার ভাবুন, দোকানে দুধ শুধু এক লিটারের প্যাকেটে পাওয়া যায়। আমি দোকান থেকে কয়েক প্যাকেট দুধ কিনি কিন্তু বাড়িতে এসে প্যাকেট ভেঙে যে কোনো পরিমাণ খেতে পারি। এমনও তো  হতে পারে যে কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ বা শোষণের সময় আলো প্যাকেটে আসে, কিন্তু অন্য সময় নয়।

এইখানেই এলেন আইনস্টাইন, আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি দেখালেন যে তা সম্ভব নয়। আলোর কোয়ান্টামকে কখনোই আর ভাঙা যাবে না। সেই ব্যাখ্যাতে যাওয়ার আগে আলোকতড়িৎ বিক্রিয়া সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া দরকার। আলো যখন কোনো ধাতুর উপর পড়ে তখন কখনো কখনো ধাতুর থেকে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে।  এরই নাম আলোকতড়িৎ ক্রিয়া। ধরা যাক একটা ধাতুর উপর আলো ফেলছি। আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি বাড়াতে থাকি, দেখব যে একটা নির্দিষ্ট মানের চেয়ে বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো কখনোই ঐ ধাতু থেকে ইলেকট্রন বার করতে পারছে না। এমন কি আলোর তীব্ৰতা অনেক বাড়িয়ে দিলেও বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো দিয়ে ইলেকট্রন বেরোবে না। আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি ওই নির্দিষ্ট মানের থেকে কম হত, তাহলে খুব দুর্বল আলোও সঙ্গে সঙ্গেই ইলেকট্রন বার করবে। যদি আলোর তীব্রতা বাড়াই, তাহলে ইলেকট্রনের সংখ্যা বাড়বে, কিন্তু তারা যে গতিশক্তি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তা পালটাবে না। অন্যদিকে যদি তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমাই, তাহলে কিন্তু ইলেকট্রনের গতিশক্তি বাড়বে।

আলোর তরঙ্গ প্রকৃতি দিয়ে এই ঘটনার ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। সমুদ্রের ঢেউয়ের কথা ধরা যাক।  ঢেউয়ের জোর বাড়া মানে তরঙ্গের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়া; আবার যত ঘনঘন ঢেউ আসবে, দুটো ঢেউয়ের মধ্যে অন্তর অর্থাৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্য তত কমবে। সমুদ্রের ধারে একটা প্লাস্টিকের বল রাখা আছে। জোরে ঢেউ এসে ধাক্কা মারলে বলটা বেশি জোরে ছিটকে যাবে, কিন্তু ঢেউ কত ঘনঘন আসছে, তার উপর নিশ্চয় বলের বেগ নির্ভর করবে না। ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে কিন্তু ঠিক উল্টোটাই ঘটছে।

আইনস্টাইন দেখালেন যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি বেশি হয়, তাহলে তার শক্তি কম। ধাতুর থেকে শক্তি বার করতে হলে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন – আলোর কোয়ান্টামের শক্তি তার থেকে কম হলে ইলেকট্রন বেরোনো সম্ভব নয়। আলোর তীব্রতা বাড়া মানে এখানে কোয়ান্টামের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, তাহলে তারা বেশি সংখ্যায় ইলেকট্রনকে বার করতে পারবে। নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর সব কোয়ান্টামের গতিশক্তি সমান; তাহলে তারা যে ইলেকট্রনদের ধাক্কা মেরে বার করবে, তাদের গতিশক্তির মানও নির্দিষ্ট। তার মানে শুধু কৃষ্ণ বস্তু থেকে বিকিরণ বা শোষণ নয়, অন্য সময়ও আলোক কোয়ান্টাম রূপেই থাকে। পরে আলোর কোয়ান্টামের নাম দেওয়া হল ফোটন।

শুনে মনে হতেই পারে যে এ আর এমন কী। কিন্তু সমকালীন বিজ্ঞানীরা সবাই না বুঝলেও আইনস্টাইন বুঝেছিলেন যে পদার্থবিজ্ঞানে এক বিপ্লবের সূচনা তিনি করেছেন, এবং সেই কোয়ান্টাম বিপ্লব তাঁর পছন্দ ছিল না। তাই বাকি জীবন তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। প্ল্যাঙ্ক ও আইনস্টাইনের পরেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের সব থেকে বড় কাজ হলে হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণালীর ব্যাখ্যা, তা করেছিলেন নিলস বোর। আগেই বলেছি বোর ১৯২২ সালে এর জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কোয়ান্টাম তত্ত্বের চতুর্থ বিখ্যাত কাজ হল সত্যেন্দ্রনাথ বসুর গবেষণা যার পূর্ণতাতে আইনস্টাইনেরও অবদান আছে; অবশ্য তা ১৯২২ সালের পরের ঘটনা।

কেন আইনস্টাইনের এই কাজ বৈপ্লবিক  তার ব্যাখ্যা এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে দেওয়া সম্ভব নয়। একটা উদাহরণই শুধু দেখা যাক। আলোর তরঙ্গপ্রকৃতি প্রতিষ্ঠা করেছিল ইয়ঙের যে পরীক্ষা, তাতে পাশাপাশি দুটি ছিদ্র দিয়ে আলোকে পাঠানো হয়েছিল। আমাদের সাধারণ বুদ্ধি বলে একটা কণিকা একই সঙ্গে নিশ্চয় দুটো ছিদ্র দিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু আলোর ক্ষেত্রে আমাদের ধরে নিতে হবে যে আলোর কণা ঠিক তাই করে, তবেই আমরা সেই পরীক্ষার ফলকে ব্যাখ্যা করতে পারব। আলোর কণা এবং তরঙ্গ দুই রকম ধর্মই আছে, আমরা আলোর যে বিশেষ ধর্ম দেখতে চাই, তার উপর নির্ভর করে আলো তরঙ্গ না কণা, কেমন ব্যবহার করবে। শুধু আলো নয়, অন্য সমস্ত মৌলিক কণারই এই ধরনের দ্বৈত চরিত্র বর্তমান – কিন্তু এই বিষয়ে আমরা এখানে আলোচনা করব না। আরো সঠিক ভাবে বললে নির্দিষ্ট মুহূর্তে যে  কোনো কণার বেগ, অবস্থান ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট নয়, একই সঙ্গে তা দু’জায়গায় অবস্থান করতে পারে। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটাই বাস্তব, এবং আইনস্টাইনের আলোকতড়িৎ সংক্রান্ত গবেষণা সেই বাস্তবকে চিহ্নিত করার পক্ষে একটি বড় ধাপ। তাই নোবেল কমিটি পুরস্কার ঘোষণার সময় আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার উল্লেখ করে কোনো ভুল করেনি। পরবর্তীকালের গবেষণা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার (Quantum mechanics) কাঠামোর মধ্যে দ্বৈত ধর্মকে সঠিকভাবে অন্তৰ্ভুক্ত করেছে, কিন্তু বাস্তব জগতে তার তাৎপৰ্য কী তা নিয়ে এখনো সবাই একমত নন। 

 

প্রকাশঃ সন্ধিৎসা ২০২১ 

 

 

 

Friday, 12 November 2021

শুক্রের পরিক্রমণ ও সৌরজগতের পরিমাপ নির্ণয়



শুক্রের পরিক্রমণ ও সৌরজগতের পরিমাপ নির্ণয়

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাস আমরা অনেকেই কম বেশি জানি। শুধু ভারত নয়, সুমের, মিশর, চিন বা গ্রিসও প্রাচীন যুগে জ্যোতির্বিদ্যার উপর গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত কেপলারের সূত্র আবিষ্কার ও গ্যালিলিও কর্তৃক দূরবিনের সাহায্যে আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু হওয়ার পরে জ্যোতির্বিদ্যার আমূল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে দূরবিনের সাহায্যে যে ধরনের নিখুঁত পর্যবেক্ষণ সম্ভব, তা আগে চিন্তাই করা যেত না। এর ফলে জ্যোতির্বিদ্যাতে পরিমাপের উপর গুরুত্ব আসে।

অনেক সভ্যতাই আকাশে জ্যোতিষ্কদের অবস্থান, সূর্য চন্দ্র গ্রহদের চলার পথ ইত্যাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা করলেও প্রাচীন গ্রিকরাই সম্ভবত একমাত্র যারা দূরত্ব, আয়তন ইত্যাদি নির্ণয় করার চেষ্টা করত। পরবর্তীকালে এরাটোস্থেনেস প্রথম বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পৃথিবীর পরিধি মেপেছিলেন, তাঁর মাপে ভুল ছিল সম্ভবত পাঁচ শতাংশেরও কম। প্রাচীন যুগের সব থেকে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ হলেন হিপ্পার্কাস। তিনি সূর্যগ্রহণের সময় দুই বিভিন্ন স্থানে সূর্য কতটা ঢাকা পড়েছিল তা বিচার করে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব নির্ণয় করেছিলেন। তিনি হিসাব করে বলেছিলেন যে পৃথিবী ও চাঁদের দূরত্ব পৃথিবীর ব্যাসার্ধের 71 থেকে 83 গুণের মধ্যে থাকে। আসল মাপটা হল 60 থেকে 64-র মধ্যে। প্রাচীন যুগের পর্যবেক্ষণে এর থেকে ভালো মাপ পাওয়া সম্ভব ছিল না। অ্যারিস্টার্কাস মেপে পেয়েছিলেন সূর্য চাঁদের থেকে কুড়ি গুণ বেশি দূরত্বে আছে, আসলে তা হবে প্রায় চারশো গুণ। এরাটোস্থেনেস মেপে বলেছিলেন সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর 27 গুণ, আসলে তা হল 109 গুণ।

দূরবিন আবিষ্কারের পরে বিশেষ করে জ্যোতিষ্কদের কৌণিক অবস্থানের মাপে অনেক উন্নতি ঘটল। একই সঙ্গে সময় মাপার জন্য যান্ত্রিক ঘড়ি ব্যবহার করা শুরু হল। তার ফলে মাপ অনেক বেশি নির্ভুল হত। তা সত্ত্বেও নিউটন যখন কেপলারের সূত্র ব্যবহার করে শেষ পর্যন্ত সার্বজনীন মাধ্যাকর্ষণের সূত্রে পৌঁছান, তিনি কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের ধ্রুবক নির্ণয় করতে পারেন নি, কারণ সূর্য বা সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহের দূরত্ব ও ভর সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ছিল নিতান্তই সীমিত। প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকাতে নিউটন বিভিন্ন গ্রহের ও সূর্যের ভরের অনুপাত নির্ণয় করেছিলেন, কিন্তু প্রকৃত ভর বা দূরত্ব জানা ছিল না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে সমস্ত দূরত্বের অনুপাত পরিবর্তন করে সৌরজগতের আয়তনকে দুগুণ বাড়িয়ে দিলে বা অর্ধেক করে দিলেন তা কেপলার বা নিউটনের সূত্রে ধরা পড়বে না। এটাকে বিজ্ঞানের ভাষাতে বলে স্কেলের সমস্যা।

সৌরজগতের জ্যোতিষ্কদের দূরত্ব বা ব্যাস মাপার জন্য প্রাচীন গ্রিকরা লম্বন পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল, তা ছিল জ্যামিতির বা ত্রিকোণমিতির পদ্ধতি। বিংশ শতাব্দীতে রাডার আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত আমরা ওই একই ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলাম। একটা খুব সহজ উদাহরণ নেওয়া যাক। আজও আমরা আমাদের খুব কাছের কোনো নক্ষত্রের দূরত্ব মাপার জন্য ছয় মাস আগে পরে পৃথিবীর দুই অবস্থান থেকে সেই নক্ষত্রের অবস্থান মাপি। অনেক দূরের নক্ষত্রদের সাপেক্ষে কাছের নক্ষত্রটা জায়গা পাল্টায়, তার কৌণিক অবস্থানের যে পরিবর্তন ঘটে, তাকে বলে প্যারালাক্স বা লম্বন। ছ'মাস আগে পরে পৃথিবীর অবস্থানের পার্থক্য এবং লম্বন কোণের মান থেকে ওই নক্ষত্রের দূরত্ব বার করা হয়। এর জন্য সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্ব দরকার, অষ্টাদশ শতকের প্রথম অর্ধে তা ভালোভাবে জানা ছিল না।

লম্বন পদ্ধতিতে মঙ্গলের দূরত্ব প্রথম মেপেছিলেন প্যারি মানমন্দিরের বিজ্ঞানী জাঁ পিকার্ড ও জিওভান্নি ক্যাসিনি। প্রথমেই অবশ্য সূর্যের দূরত্ব মাপার কথা আসে, অন্য তারাদের তুলনায় সূর্য পৃথিবীর খুবই কাছে, তাই তার দূরত্ব মাপার জন্য ছ’মাস অপেক্ষা করার দরকার পড়ে না। পৃথিবীতেই দুই আলাদা জায়গা থেকে লম্বন নির্ণয় করা যায়। কিন্তু সূর্য আমাদের চোখে অনেক বড়, দুই জায়গা থেকে তার উপর ঠিক কোন বিন্দুর কৌণিক অবস্থান মাপা হবে তা ঠিক করা যাচ্ছিল না। যেমন কেপলার মেপে যা পেয়েছিলেন, লম্বনের প্রকৃত মান হল তার বারো ভাগের এক ভাগ।

গ্রহরা অনেক ছোট, তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। প্যারি এবং ফ্রান্সের উপনিবেশ দক্ষিণ আমেরিকার ফ্রেঞ্চ গায়নার দুরত্ব জানাই ছিল; সেই দুই জায়গা থেকে মঙ্গল যখন পৃথিবীর সব থেকে কাছে এসেছিল সেই সময়ে মঙ্গলের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা মঙ্গলের দূরত্ব নির্ণয় করেছিলেন। সেটা ছিল 1671 সাল। মনে রাখতে হবে যে লম্বনের মান একই সময় বার করতে হবে, কারণ পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্য দুই অবস্থানই জায়গা পরিবর্তন করে। কিন্তু ফরাসি গায়না ও প্যারিতে পেন্ডুলাম ঘড়ি একই সময় দেয় না, কারণ দুই জায়গার অক্ষাংশ আলাদা। সেটা অবশ্য তখন বোঝা যায়নি, তার কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন নিউটন 1687 সালে প্রিন্সিপিয়াতে। কেপলারের সূত্র ব্যবহার করে একবার কোনো একটা গ্রহের দূরত্ব মাপতে পারলেই আমরা সৌরজগতের বাকি সমস্ত দূরত্ব নির্ণয় করা গিয়েছিল। ক্যাসিনিদের মাপ থেকে সূর্যের দূরত্ব পাওয়া যাচ্ছিল 14 কোটি কিলোমিটার, কিন্তু সময় নির্ণয় সহ বিভিন্ন কারণে তাতে বেশ কিছু সমস্যা ছিল। আধুনিক কালে আমরা জানি তাঁদের মাপে সাত শতাংশ ভুল ছিল। তাই সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্ব নির্ণয় করার জন্য শুক্রের পরিক্রমণকে ব্যবহার করার কথা ভেবেছিলেন বিজ্ঞানীরা।

শুক্র গ্রহ খন সুর্য আর পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে আসে, সেই ঘটনাকে বলে শুক্রের পরিক্রমণ বা ট্রানসিট। তখন সূর্যের উজ্জ্বল পটভূমিতে আমরা তাদের একটা কালো ছোট চাকতির মতো দেখতে পাই। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখলে সূর্যের পটভূমিতে তাকে আমরা আলাদা জায়গায় দেখব। সেই সমস্ত জায়গার দূরত্ব জানা থাকলে গ্রহের অবস্থানের কৌণিক পার্থক্য বা লম্বন কোণ থেকে ঐ গ্রহটার দূরত্ব নির্ণয় সম্ভব। নক্ষত্রদের ক্ষেত্রের তুলনায় অবশ্য এই পদ্ধতিতে সামান্য একটা সমস্যা আছে। আমাদের পদ্ধতিতে দূরের নক্ষত্ররা অসীম দূরত্বে আছে বলে ধরে নিলে কোনো ভুল হয় না, তাই তাদের সাপেক্ষে লম্বন কোণ মাপা সহজ।

পৃথিবী থেকে সূর্য ও শুক্রের দূরত্ব তুলনীয়, তাই পৃথিবীতে বিভিন্ন অবস্থান থেকে শুক্রকে যেমন আলাদা কোণে দেখব, সূর্যকেও আলাদা কোণে দেখব। কিন্তু তার সমাধান করা খুব সোজা, কারণ দূরত্বগুলো না জানলেও নিউটন ও কেপলারের গবেষণা থেকে আমরা তাদের অনুপাতটা জানি। নিচের ছবিটাতে শুক্রের পরিক্রমণের সময় কেমনভাবে দূরত্ব মাপা সম্ভব তা দেখানো হয়েছে। A B অবস্থান থেকে শুক্রকে সুর্যের উপরে A' B' বিন্দুতে দেখা যাবে। আমরা AB দূরত্ব জানি, VA/VA' অনুপাত কেপলারের সূত্র থেকে জানা আছে, সুতরাং V বিন্দুতে উৎপন্ন কোণ মাপতে পারলেই আমরা শুক্র পৃথিবীর দূরত্ব VT, শুক্র সূর্যের দূরত্ব VS, সূর্য পৃথিবীর দূরত্ব ST জেনে নিতে পারব।


 

 

শুক্রের পরিক্রমণের সময় তার অবস্থান থেকে দূরত্ব মাপার কথা প্রথম বলেছিলেন জেমস গ্রেগরি। বিখ্যাত ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ এডমন্ড হ্যালি বিষয়টি বিজ্ঞানীদের নজরে এনেছিলেন। হ্যালি 1742 সালে পঁচাশি বছর বয়সে মারা যান। তিনি জানতেন যে শুক্রের পরিক্রমণ দেখার সুযোগ তাঁর হবে না, তা ঘটবে 1761 সালের 6 জুন। সূর্যের উপর কোন বিন্দুকে আলদা করে চেনা শক্ত, তাই কৌণিক অবস্থান নির্ণয়ে ভুল থেকে যেতে পারে। হ্যালি দেখান যে যদি বিভিন্ন জায়গা থেকে শুক্রের পরিক্রমণ ঠিক কতক্ষণ ধরে হচ্ছে তা মাপা যায়, তাহলে সেই ত্রুটি এড়ানো সম্ভব। নিচের ছবিতে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। এখানে দুই পর্যবেক্ষক কোন পথে শুক্রকে যেতে দেখবেন তা দেখানো হয়েছে। দুই পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে শুক্রের বেগ সমান, তাই পরিক্রমণের সময় থেকে শুক্রের কৌণিক অবস্থানের পার্থক্য অর্থাৎ আগের ছবিতে V বিন্দুতে উৎপন্ন কোণ নির্ণয় করা সম্ভব।



সেই সময় বিশেষ করে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সারা পৃথিবীতে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, সেই সুযোগ নিয়ে পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে পরিক্রমণ দেখার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই অর্থে এটিকে প্রথম আন্তর্জাতিক স্তরে বৃহৎ বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের নিদর্শন বলা যায়। মোট 122টি জায়গা থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। তার মধ্যে আমাদের দেশও ছিল।

সেই সময় আবার ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, ফলে অনেক বিজ্ঞানী সমস্যার মধ্যে পড়েছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে সুমাত্রাতে পাঠানো এক জাহাজের উপর ফ্রান্সের আক্রমণে বেশ কয়েকজন নাবিক প্রাণ হারান, এবং জাহাজ লন্ডনে ফিরে আসে। পরে অভিযানটি আবার রওনা হয়েছিল। এর নেতৃত্বে ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী চার্লস ম্যাসন ও জরিপদার জেরেমিয়া ডিক্সন। পরবর্তীকালে এই দুজন মার্কিন যুক্তরাষ্টের মেরিল্যান্ড ও পেনসিলভেনিয়ার মধ্যের সীমানা নির্দেশ করবেন যা ম্যাসন-ডিক্সন লাইন নামে পরিচিত। যাত্রা শুরুর কয়েকদিন পরেই তাঁরা বুঝতে পারেন যে সময়মতো সুমাত্রা পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাঁরা তখন দক্ষিণ আফ্রিকার ডাচ অধিকৃত কেপটাউনে যাত্রা শেষ করেন। নিরপেক্ষ ডাচদের সহায়তাতে সেখান থেকেই তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। লে জেন্টিল নামের এক ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী পন্ডিচেরি থেকে পরিক্রমণ দেখবেন বলে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু ফরাসি অধিকৃত মরিশাসে পৌঁছে তিনি শোনেন যে ব্রিটিশরা পন্ডিচেরি অবরোধ করেছে। অবরোধ ভাঙার জন্য যে জাহাজ পাঠানো হয়, তিনি সেই জাহাজের যাত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার জন্য জাহাজের দেরি হয়, মাহে বন্দরে পৌছে তাঁরা জানতে পারেন যে পন্ডিচেরি ব্রিটিশরা দখল করে নিয়েছে। তাঁদের জাহাজ আবার ফিরে যায়। লে জেন্টিল মাঝসমুদ্র থেকে পরিক্রমণ দেখেন কিন্তু জাহাজের দোলার ফলে পরিক্রমণের সময়কাল ও জাহাজের অবস্থান নির্ণয়ে প্রচুর ভুল থেকে গিয়েছিল। তাই তাঁর মাপ কোনো কাজে আসেনি। লে জেন্টিলের কথা আমাদের লেখাতে আবার আসবে।

ভারতে কয়েক জায়গায় পরিক্রমণ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। কলকাতা থেকে নোটারি পাবলিক উইলিয়াম ম্যাগি এবং মাদ্রাজের গভর্নরের প্রাসাদের উপর থেকে জ্যোতির্বিদ পাদ্রি উইলিয়াম হির্স্ট পরিক্রমণ পর্যবেক্ষণ করেছলেন। উইলিয়াম হির্স্ট এবং রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গের বিখ্যাত বিজ্ঞানী মিখাইল লোমোনোসভ তাঁদের পর্যবেক্ষণ থেকে প্রথম শুক্রের বায়ুমণ্ডলের অস্তিত্বের কথা বলেন, যদিও আধুনিক কালের বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন যে তাঁদের দূরবিন তা দেখার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। সে সময় চট্টগ্রামের উপকূল জরিপ করছিলেন বার্থেলমিউ প্লেইস্টেড, তিনিও পর্যবেক্ষণের রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন। তামিলনাড়ুর তরঙ্গমওয়াদি থেকে কয়েকজন জেসুইট পাদ্রি পরিক্রমণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।

কিন্তু এত চেষ্টার পরেও যে পরিমাপ পাওয়া গিয়েছিল, তাতে এতই ভুল ছিল যে তা কাজে আসেনি। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের মধ্যে প্রায় কুড়ি থেকে পঁচিশ শতাংশ পার্থক্য ছিল। ফলে পিকার্ড আর ক্যাসিনির নির্ণয় করা দূরত্বের থেকেও এতে ত্রুটি ছিল অনেক বেশি। সব থেকে বড় সমস্যা হয়েছিল যে দুরবিন দিয়ে পর্যবেক্ষণের আগে বোঝা সম্ভব হয়নি যে পরিক্রমণ ঠিক কোন মুহূর্তে শুরু বা শেষ হবে তা নির্ধারণ করতে কত অসুবিধা হবে। সূর্যের সামনে আসার আগে শুক্রের প্রতিবিম্ব হঠাৎ লম্বাটে হয়ে গিয়েছিল, আবার যখন তা গোলাকার ধারণ করল, তখন তা অনেকটা ভিতরে। একে বলা হয়েছিল ব্ল্যাক ড্রপ এফেক্ট।

বিজ্ঞানীরা অবশ্য হাল ছাড়েননি, শুক্রের পরে পরিক্রমণ হবে 1769সালের জুন মাসের 3 4 তারিখ। ইতিমধ্যে অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির অনেক উন্নতিসাধন হয়, বিশেষ করে ব্রিটিশ দূরবিন নির্মাতা জেমস শর্ট ব্ল্যাকড্রপ এফেক্টের জন্য ত্রুটি কমানোর দুটি নতুন পদ্ধতি খুঁজে বার করেন। লে জেন্টিল আর ফ্রান্সে ফিরে যাননি, মরিশাসেই রয়ে গিয়েছিলেন এবং আকাশ পর্যবেক্ষণের কাজ করছিলেন। তিনি আবার পন্ডিচেরি আসেন ১৭৬৮ সালে, ইতিমধ্যে যুদ্ধ শেষে তা ফরাসিদের হাতে ফিরে গেছে। পন্ডিচেরির গভর্নর তাঁকে সব রকমের সহায়তা করেন, স্থানীয় ব্রিটিশরা তাঁকে একটি টেলিস্কোপ দিয়ে সাহায্য করে। এক বছর ধরে তিনি নিখুঁতভাবে পন্ডিচেরির দ্রাঘিমা নির্ণয় করেছিলেন। কিন্তু আসল দিনে মেঘের জন্য তিনি কিছুই দেখতে পাননি। এত বছরের চেষ্টা বৃথা হওয়াতে তিনি খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। বিখ্যাত ব্রিটিশ অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন জেমস কুক জ্যোতির্বিজ্ঞানী চার্লস গ্রিন ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী জোসেফ ব্যাঙ্কসকে তাহিতি দ্বীপে নিয়ে যান, সেখানে পরিক্রমণ দেখার পরে তাঁরা দক্ষিণ গোলার্ধে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে যে অভিযান করেছিলেন তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। ব্যাঙ্কস অবশ্য ফেরার পথে অসুখে মারা যান। ফরাসি বিজ্ঞানী জাঁ-ব্যাপ্টিস্ট শ্যাপ 1761 সালে সাইবেরিয়াতে পরিক্রমণ অভিযানে গিয়েছিলেন, এবার তিনি গিয়েছিলেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে। অভিযান সফল হয়েছিল, কিন্তু তার পরেই এক মড়কে শ্যাপ সহ অভিযাত্রীদলের আটাশজন সদস্যের মধ্যে ছাব্বিশজন প্রাণ হারান। ভারতে পাটনার কাছে দানাপুর থেকে ক্যাপ্টেন লুই ডিগ্লস ও ক্যাপ্টেন আলকজান্ডার রোজ ফেজাবাদ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। আমাদের পূর্ব পরিচিত উইলিয়াম হির্স্ট তখন ইংল্যান্ডে। তিনি গ্রিনউইচ থেকে পরিক্রমণ দেখেছিলেন, যদিও এবারে বায়ুমণ্ডলের কোনো চিহ্ন তাঁর চোখে পরেনি।

এত বিপদ কষ্ট হতাশা প্রাণহানির পরে শেষ পর্যন্ত সাফল্য এসেছিল, বিভিন্ন জায়গার পরিক্রমণ পর্যবেক্ষণ থেকে শেষ পর্যন্ত সূর্যের যে দূরত্ব পাওয়া গিয়েছিল, আধুনিক যুগে রাডারের মাপের সঙ্গে তার পার্থক্য এক শতাংশেরও কম। সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্বকে বলে অ্যাস্ট্রনমিক্যাল একক, সেটার মান জানার পরে শুরু হয় নক্ষত্রদের দূরত্ব মাপার চেষ্টা। প্রথম ছবির মতো করে আঁকলে A B বিন্দুর মধ্যে দূরত্ব হবে দুই অ্যাস্ট্রনমিক্যাল একক বা তিরিশ কোটি কিলোমিটার, কারণ ছ'মাস আগে পরে মাপা হয়েছে। কিন্তু নক্ষত্রদের দূরত্ব এতই বেশি যে এত দূরের দুই বিন্দু থেকে মাপলেও তাদের লম্বন খুব কম, তাই তা মাপা অনেক বেশি শক্ত। সূর্যের লম্বনের মান হল 8.8", সেখানে আমাদের নিকটতম তারার লম্বনও এক সেকেন্ডের কম। তাই 1838 সালের আগে সূর্য ছাড়া অন্য কোনো নক্ষত্রের লম্বন মাপা সম্ভব হয়নি।শুক্রের আবার পরিক্রমণ হয় 1874 সালের 9 ডিসেম্বর, ও 1882  সালের 6 ডিসেম্বর, এবং 2004 সালের 8 জুন ও 2012 সালের 5 জুন। এর পরের পরিক্রমণ হবে 2117 সালের 10 ডিসেম্বর। 


তথ্যসূত্রঃ

Transits of Venus and the Astronomical Unit, Donald A. Teets, Mathematics Magazine, December 2003

Venus in India: The Transit Tales, R.C. Kapoor

Indian Astronomy and the Transits of Venus. 1: The Early Observations, R.C. Kapoor, Journal of Astronomical History and Heritage, November 2013

ইউরোপিয়ান স্পেস অবজার্ভেটরির ওয়েবসাইট



(প্রকাশঃ জ্ঞান ও বিজ্ঞান, শারদীয় ২০২১)