ভারতের প্রথম সাইক্লোট্রনের ইতিহাস
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা তথা পূর্ব ভারত। কলকাতাতে ১৮৭৬ সালে মহেন্দ্রলাল সরকার তৈরি করেছিলেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স। ১৯১৭ সালে জগদীশচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠা করেন বসু বিজ্ঞান মন্দির। এই দুই প্রতিষ্ঠানই ছিল মূলত দেশীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত, পরিচালনার ভার ছিল সম্পূর্ণ ভারতীয়দের হাতে। পাশাপাশি আশুতোষের প্রচেষ্টাতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে যে বিজ্ঞান কলেজ তৈরি হয়েছিল, সেখানেও ব্রিটিশ সাহায্যের পরিমাণ ছিল নিতান্তই যৎসামান্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারের সুবাদে বিজ্ঞান কলেজের পরিচালনাতে সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ ছিল না বললেই হয়। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির এক মূল কারণ বিশেষ করে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরে বাংলা দেশের নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদ। অ্যাসোসিয়েশন তার অনেক আগে তৈরি হলেও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসাবে যথাযথ ভাবে কাজ শুরু করে সি ভি রমন কলকাতায় আসার পরে, সেটা ছিল ১৯০৭ সাল। জাতীয়তাবাদই ভারতীয়দের দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সাহায্য দিতে অনুপ্রেরিত করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে সারা ভারতে এই রকম আর একটিই প্রতিষ্ঠানের কথা বলা যায়, তা হল বাঙ্গালোরের টাটা ইন্সটিটিউট, পরবর্তীকালের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স। টাটাদের অর্থানুকূল্যে এবং মহিশূরের মহারাজার দেওয়া জমির উপরে তৈরি হলেও ব্যাবসায়ী পরিবার টাটারা কোনোভাবেই ব্রিটিশ শাসকদের চটাতে চায়নি। তাই প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা নিয়োগে সরকারের নির্ণায়ক ভূমিকা ছিল। ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও ১৯৩৩ সালে রমনের নিয়োগের আগে ইন্সটিটিউটে কোনো ভারতীয় অধিকর্তা নিযুক্ত হননি। ফলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির ব্রিটিশ বিজ্ঞানীতে প্রতিষ্ঠান ভরে উঠেছিল।
ভারতের প্রথম আধুনিক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অবশ্য এরা কেউ পড়বে না, পলাশির যুদ্ধের দশ বছর পরেই তৈরি হওয়া সার্ভে অফ ইন্ডিয়াকেই আমরা সেই স্বীকৃতি দিতে পারি। এর পরে নাম করা যায় শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন (১৭৮৬), মাদ্রাজ মানমন্দির (১৭৯২), গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক সার্ভে (১৮০২), জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (১৮৫১), বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (১৮৯১) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পের। কিন্তু এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সম্পদের উপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব স্থাপন, তাই ভারতীয়দের বিজ্ঞান শিক্ষা বা গবেষণার সুযোগ সৃষ্টিতে এদের ভূমিকা নেই বললেই চলে।
আগে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলি এবং কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ই পরাধীন ভারতে মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণাতে নেতৃত্ব দিত। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল কলকাতাতে। ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী; ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সেই সময় পর্যন্ত তো বটেই, তার পরেও অনেকদিন শিক্ষাসংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সে একটা মূল স্থান অধিকার করে রেখেছিল। সি ভি রমনের কথা আগে এসেছে; তিনি কলকাতায় এসেছিলেন সরকারি চাকরির সুবাদে, তারপর পুরোপুরি ব্যক্তিগত উদ্যোগে গবেষণা শুরু করেছিলেন। রাজধানী শহর না হলে তাঁর কলকাতাতে আদৌ আসার সম্ভাবনা ছিল কিনা, বা একাধিকবার বদলির পরেও ফিরে আসা সম্ভব হত কিনা বলা সম্ভব নয়। ইংরাজি তথা আধুনিক শিক্ষাও কলকাতাতে সব থেকে আগে শুরু হয়েছিল। এই সমস্ত কারণে বিংশ শতাব্দীর প্রথম চার দশকে কলকাতা ছিল ভারতে বিজ্ঞান চর্চার মূল কেন্দ্র। অবস্থার পরিবর্তন ঘটে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চম দশক থেকে, সেই ইতিহাস আলোচনার দীর্ঘ পরিসর একটি প্রবন্ধে পাওয়া সম্ভব নয়। আমরা এই লেখাতে শুধু একটি যন্ত্র স্থাপনের কাহিনির দিকে চোখ রাখব, তা হল একটি সাইক্লোট্রন। আমরা দেখব যে ভারতের বিজ্ঞান প্রশাসনের ইতিহাসের সঙ্গে সেই কাহিনি জড়িয়ে আছে।
সাইক্লোট্রন বিষয়ে বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক আলোচনার প্রয়োজন নেই। সংক্ষেপে বলা যায় আধুনিক নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানে যেটা প্রথমেই দরকার তা হল অ্যাক্সিলারেটর বা কণাত্বরক। দুটি নিউক্লিয়াসের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটানো শক্ত কারণ নিউক্লিয়াসের আধান ধনাত্মক, তাই এক নিউক্লিয়াস অন্য নিউক্লিয়াসকে বিকর্ষণ করে। সেই বিকর্ষণকে অগ্রাহ্য করে বিক্রিয়া তখনই হতে পারে যখন সংঘর্ষরত দুটি নিউক্লিয়াসের মধ্যে অন্তত একটার গতিশক্তি খুব বেশি। নিউক্লিয়াসের গতিশক্তি বাড়াতে পারে সাইক্লোট্রন বা অন্য কোনো কণাত্বরক। সাইক্লোট্রন দিয়ে প্রোটন কণা বা কোনো পরমাণুর নিউক্লিয়াসের গতিশক্তি বাড়িয়ে অন্য পরমাণুর নিউক্লিয়াসের উপর আঘাত করা হয়। এর ফলে নিউক্লিয় বিক্রিয়া ঘটে। এভাবে অনেক নতুন পরমাণুর আইসোটোপ তৈরি করা সম্ভব যা বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি চিকিৎসা বা শিল্প ইত্যাদিতে কাজে লাগানো হয়। যেমন ক্যান্সারের চিকিৎসায় বা বিভিন্ন রকমের ডায়াগনসিসে যে রেডিওআইসোটোপ ব্যবহার করা হয়, তা সাইক্লোট্রনে তৈরি। সাইক্লোট্রন উদ্ভাবন করেছিলেন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী আর্নেস্ট লরেন্স। ১৯২৯ সালে তিনি এই নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন, তাঁর তত্ত্বাবধানে বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সাইক্লোট্রন তৈরি হয় ১৯৩২ সালে। আমাদের দেশে সাইক্লোট্রন তৈরির পরিকল্পনা প্রথম করেন মেঘনাদ সাহা, আমরা এই লেখাতে তাঁর সেই প্রয়াস নিয়ে আলোচনা করব।
মেঘনাদ সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েন ১৯২৩ সালে, ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর পরে আবার কলকাতাতে ফিরে আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিভাগে ১৯১৪ সালে তারকনাথ পালিতের অর্থানুকূল্যে তৈরি হয়েছিল দুটি অধ্যাপক পদ। ১৯৩৮ সালে সাহা পালিত অধ্যাপক পদে যোগ দেন। এই পদের সঙ্গেই যুক্ত ছিল পালিত ল্যাবরেটরি। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞান গবেষণাতে সেই সময় নিউক্লিয় বিজ্ঞান একটা বড় স্থান অধিকার করেছে। ১৯৩৮ সালে আবিষ্কার হল নিউক্লিয় ফিশন বিক্রিয়া; এক দশকের মধ্যে সারা পৃথিবীর শক্তির নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাতে সেই আবিষ্কারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সাহা নিজে নিউক্লিয় বিজ্ঞানে কিছু গবেষণা করলেও তা তাঁর কাজের মূল ক্ষেত্র ছিল না, কিন্তু মেঘনাদ সাহা তখনই নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শুরু করলেন নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানের পাঠক্রম। তাঁর লক্ষ্য ছিল পদার্থবিদ্যাবিভাগের আধুনিকীকরণ। কিন্তু সে কাজে প্রধান অন্তরায় হল যন্ত্রপাতির অভাব। পদার্থবিজ্ঞানের মূল কথা হল পরীক্ষানিরীক্ষা, কিন্তু যন্ত্র না থাকলে তা সম্ভব নয়। মেঘনাদ বুঝলেন নিউক্লিয় বিজ্ঞানে গবেষণার চাবিকাঠি হল কণাত্বরক।
সেই সময় সবচেয়ে আধুনিক কণাত্বরক হল সাইক্লোট্রন। কিন্তু আমাদের দেশের সেই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি তাতে সাইক্লোট্রন বানানো ছিল আকাশকুসুম কল্পনা। তার কারণ আমাদের শিল্পপ্রযুক্তি অত্যাধুনিক যন্ত্র বানানোর মতো পরিস্থিতিতে পৌঁছায়নি। মেঘনাদ বুঝলেন যে বিদেশ থেকে সাইক্লোট্রন আনা ছাড়া উপায় নেই। সাইক্লোট্রন কিন্তু এমন কোনো যন্ত্র নয় যা সহজে কিনতে পারা যাবে। সারা পৃথিবীতে সেই যন্ত্রের সংখ্যা তখন হাতে গোনা, সেগুলি সবই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে তৈরি হয়েছে। তাদের কেউ হয়তো তাঁকে বিক্রি করতে রাজি হতে পারে, কারণ তারা আরো বড় সাইক্লোট্রন তৈরি করেছে। কিন্তু যন্ত্রাংশ খুলে তাকে আনার পরে আবার জুড়ে দাঁড় করানোর জন্যও বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন।
আর্নেস্ট লরেন্সের সঙ্গে সাহার বার্লিনে আলাপ হয়েছিল ১৯২৬ সালে, ১৯৩৬ সালে বার্কলেতে আবার তাঁদের দেখা হয় এবং বার্কলের সাইক্লোট্রন সাহাকে মুগ্ধ করে। সাহা তার পরেই এক চিঠিতে লরেন্সকে লেখেন যে যদি তিনি সাইক্লোট্রনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগাড় করতে পারেন, তাহলে লরেন্সকে তিনি সাহায্যের অনুরোধ জানাবেন। এর পরে তিনি প্রিন্সটনের সাইক্লোট্রনটিও দেখেন। এই সময়েই তিনি সাইক্লোট্রন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সম্পর্কের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল, অর্থ জোগাড় করতে এই যুক্তিকেই তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন। লরেন্স ১৯৩৯ সালে তাঁর উদ্ভাবনের জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঘটনাও তাঁর সমর্থনে আসে। সাহা স্থির করেন যে বার্কলে থেকেই তিনি কলকাতার সাইক্লোট্রন জোগাড় করবেন।
সাইক্লোট্রনের জন্য ঠিক কত টাকা প্রয়োজন ছিল? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সাইক্লোটন বিষয়ে এক কমিটি তৈরি করেছিল, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে দেখতে পাই সাইক্লোট্রন যন্ত্রটির জন্য লাগবে আশি হাজার টাকা। এছাড়া তার জন্য বাড়ি তৈরি, যন্ত্র স্থাপন, ইঞ্জিনিয়ার, মেকানিক, গবেষক ফেলো ইত্যাদির মাইনের জন্য দু’বছরে লাগবে আরো সাতান্ন হাজার টাকা। সেই সময় পালিত ল্যাবরেটরির বাৎসরিক বরাদ্দ ছিল পাঁচ হাজার টাকা, এছাড়া বিভাগীয় প্রধান হিসাবে সাহার পক্ষে অন্য যন্ত্রপাতি কেনা ইত্যাদি খাত থেকে সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকা পাওয়া সম্ভব ছিল। তুলনায় সাইক্লোট্রন বসানোর খরচ অনেকগুণ বেশি সন্দেহ নেই; কিন্তু সেই মুহূর্তে টাকাটা মেঘনাদের কাছে একটা সমস্যা হয় নি, কারণ তাঁর রাজনৈতিক যোগাযোগ। ১৯৩৮ সালেই সাহা জাতীয় কংগ্রেসের নবনির্বাচিত সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুকে দেশ গঠনের জন্য জাতীয় প্ল্যানিং কমিটি তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং জহরলাল নেহরুকে সেই কমিটির সভাপতি হতে রাজি করান। সাহা চিরকালই বিজ্ঞানের পাশাপাশি দেশ ও দেশের মানুষের উন্নতিকল্পে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির প্রয়োগ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। রাজনীতি ছাড়া তা সম্ভব নয়, তাই তিনি ছিলেন বিজ্ঞানীর রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণের উৎসাহী সমর্থক।
অর্থ জোগাড়ের কাজে সাহার প্রধান সহায় হয়েছিলেন জহরলাল নেহরু। নেহরু স্যার দোরাবজি টাটা চ্যারিটিজ ট্রাস্টকে লিখেছিলেন যে সাইক্লোট্রন ভবিষ্যতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। টাটা ট্রাস্ট বম্বেতে ক্যান্সার চিকিৎসার এক কেন্দ্র তৈরি করছিলেন, তাঁরা ১৯৪০ সালে সাইক্লোট্রনের জন্য মঞ্জুর করেন ষাট হাজার টাকা। ১৯৪০ সালের ২০ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের মিটিঙে টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান স্যার আর্দেশির দালালের এক টেলিগ্রাম আলোচনার জন্য পেশ হয়েছিল। মেঘনাদ সাহাকে পাঠানো টেলিগ্রামে জানানো হয় যে ট্রাস্ট ষাট হাজার টাকা দিতে রাজি আছে, যদি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সাইক্লোট্রনের জন্য প্রয়োজনীয় বাকি ষাট হাজার টাকা দিতে সম্মত হয়। মেঘনাদ টাকার জন্য আবেদন করেছিলেন ৫ জুন, ১৯৪০। মূল আবেদনটি পাওয়া যায়নি, তবে টাটা ট্রাস্টের বার্তা থেকে অনুমান করতে পারি যে মেঘনাদ সম্ভবত এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা প্রয়োজন দেখিয়েছিলেন। সিন্ডিকেট ধন্যবাদ জানিয়ে বলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স কমিটি প্রস্তাবটি বিবেচনা করার পর তাঁদের উত্তর দেওয়া হবে।
ফিনান্স কমিটির সভা বসেছিল ৫ ডিসেম্বর ১৯৪০। কমিটি বলে যে সাইক্লোট্রনের দামের আশি হাজার টাকার মধ্যে টাটা ট্রাস্টের ষাটহাজার টাকার বাইরের কুড়ি হাজার টাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারে। বাড়ি বানানো ও যন্ত্র স্থাপন করতে যা খরচ হবে, তাতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ ষাট হাজার টাকা পেরিয়ে যাবে। মেঘনাদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রকল্প রচনার জন্য এক কমিটি তৈরি হয়, তার কথা আগেই বলেছি। সিন্ডিকেট পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয় সেনেটের কাছে টাটা ট্রাস্টের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার সুপারিশ করে। সেনেটের ১৪ ডিসেম্বরের সভাতে বিধানচন্দ্র প্রস্তাবকে জোরালো সমর্থন করেন। এত টাকা খরচ নিয়ে মৃদু আপত্তি এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের প্রাক্তন অধ্যাপক জেনকিন্সের পক্ষ থেকে, কিন্তু সেদিনের সভার সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাকে উড়িয়ে দেন। অনুমান যে বিধানচন্দ্রের সমর্থনের পিছনে ছিলেন জহরলাল এবং মেঘনাদ আশুতোষের ছেলে শ্যামাপ্রসাদকে রাজি করিয়েছিলেন।
পৃথিবীর প্রথমদিকের প্রায় সব কটি সাইক্লোট্রন তৈরিতেই বার্কলের সহায়তা লেগেছিল। মেঘনাদ প্রথম থেকেই সেই বিষয়ে সচেতন ছিলেন, তিনি তাঁর ছাত্র বাসন্তীদুলাল নাগচৌধুরিকে লরেন্সের কাছে ট্রেনিঙের জন্য পাঠান। লরেন্স তাঁকে ছাত্র হিসাবে নিয়েছিলেন এবং আমেরিকাতে তাঁর থাকা ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে সাহায্য করেছিলেন। মেঘনাদের পরিকল্পনাতে বাসন্তীদুলাল এক কেন্দ্রীয় স্থান অধিকার করে ছিলেন, দোরাব টাটা ট্রাস্টের কাছে আবেদনপত্রে তিনি লিখেছিলেন যে কলকাতাতে সাইক্লোট্রন তৈরিতে মূল দায়িত্ব নেবেন বাসন্তীদুলাল।
এ কথা বলতেই হবে এ মেঘনাদের পরিকল্পনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরির পক্ষে বড় মাপের হলেও আন্তর্জাতিক মাপে তা ছিল নেহাতই ক্ষুদ্র। মেঘনাদের পক্ষে খুব বেশি টাকা জোগাড় করা হয়তো সম্ভব ছিল না, তাই তাঁর উচ্চাশাকে সীমিত রাখতে হয়েছিল। যে নেহরু সাইক্লোট্রনের জন্য অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছিলেন, তিনিই আট বছর পরে মেঘনাদের প্রচেষ্টাকে আখ্যা দেবেন স্থানীয় (local) ও ক্ষুদ্র (petty)। কয়েক বছর আগের ইউরোপ বা আমেরিকা ভ্রমণের সময় যে সমস্ত সাইক্লোট্রন দেখেছিলেন, কলকাতার প্রস্তাবিত সাইক্লোট্রন ছিল তারই মতো বড়। অবশ্য সাহা জানতেন যে আমেরিকাতে তার মধ্যেই আরো বড় যন্ত্র তৈরি হতে চলেছে। কিন্তু সাহা বা অন্য কারো পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব ছিল না যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরমাণু বোমার প্রয়োগের ফলে মিত্র শক্তির দেশগুলি যুদ্ধের পর সেই গবেষণাতে অর্থ বিনিয়োগ বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। তার ফলে ৩৭'’ মাপের সাইক্লোট্রন দিয়ে কোনো ভাবেই গবেষণার প্রথম সারিতে থাকা সম্ভব নয়। (এই মাপটা হল সাইক্লোট্রনে ব্যবহৃত চুম্বকের মেরুর ব্যাস।) ১৯৪০ সালে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে যোগ দেয়নি, তবে অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন যে তা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু ১৯৩৮ সালে বার্কলেতে অনেক বড় সাইক্লোট্রন তৈরির পরিকল্পনা সুরু হয়ে গিয়েছিল। মেঘনাদের অনুরোধে লরেন্স ও তাঁর সহযোগী ডোনাল্ড কুকসে তাঁদের ৩৭” সাইক্লোট্রনটিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে সম্মত হন এবং তা পাঠানোর জন্য খুলতে শুরু করেন।
বাসন্তীদুলালের ডক্টরেট সম্পূর্ণ হয় ১৯৪০ সালে, সাহা তাঁকে আমেরিকাতে আরো কিছুদিন থেকে সাইক্লোট্রন পাঠানোর সমস্ত ব্যাবস্থা করে আসতে বলেন। বাসন্তীদুলালের ফেলোশিপ শেষ হয়ে গেছে, কুকসে তাঁকে বলেন যে অন্য কোনো ব্যাবস্থা না করতে পারলে দু'মাস তাঁর খরচ কুকসেই বহন করবেন। ছোট্ট ঘটনা, কিন্তু তা ভবিষ্যতের অর্থসঙ্কটের পূর্বাভাস দেয়। ১৪ নভেম্বর ১৯৪০ টেলিগ্রাম করে মেঘনাদ তাঁকে কী কী কিনতে হবে সে বিষয়ে পরামর্শ দেন, কিন্তু টাকা না পৌছানো পর্যন্ত অর্ডার দিতে বারণ করেন। বোঝাই যাচ্ছে যে মেঘনাদ তখনো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে নিশ্চিত নন। সাইক্লোট্রনের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় লরেন্সকে দেড়হাজার ডলার পাঠায় যার মধ্যে স্পেশাল রিসার্চ স্কলারের জন্য মাসিক দেড়শো টাকা হিসাবে বাসন্তীদুলালের ছ'মাসের মাইনে ধরা ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাসন্তীদুলালকে ১১,৩০০ ডলার পর্যন্ত খরচের অনুমতি দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক করে যে ১৫ গিরিশ বিদ্যারত্ন লেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জমি আছে, সেখানে সাইক্লোট্রন বসানো হবে। এই জমিটি ৯২ আপার সার্কুলার রোডে সায়েন্স কলেজের ক্যাম্পাসের লাগোয়া,বর্তমানে তা সায়েন্স কলেজের ক্যাম্পাসের মধ্যেই পড়ে।
কোনো সন্দেহ নেই যে প্রথম থেকেই মেঘনাদ সাইক্লোট্রনের দাম অনেক কম দেখিয়েছিলেন। তাছাড়া যুদ্ধের জন্য খরচ বেড়ে চলেছিল। যেমন ১৯৪২-৪৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুর করেছিল ১০,৩০০ টাকা, ৩১ জুলাই এক চিঠি দিয়ে মেঘনাদ অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়েছিলেন ২৯,০০০ টাকা। ২০ আগস্ট আর এক চিঠিতে মেঘনাদ বলেন যে বিশ্ববিদ্যালয় তখনো পর্যন্ত মোট ১,২৮,৭৯৫ টাকা বরাদ্দ করেছে, এর মধ্যে টাটা ট্রাস্টের অনুদানও আছে। আরো ৩৪,৪৭৩ টাকা পেলে প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করা সম্ভব। এর মধ্যে বাসন্তীদুলালের মাইনেও ধরা ছিল, সিন্ডিকেট সেই অংশটি বাদ দিয়ে বাকি খরচ অনুমোদন করে।
![]() |
সাইক্লোট্রনের সামনে অন্যদের সঙ্গে বাসন্তীদুলাল নাগচৌধুরি (সামনের সারিতে বাঁদিক থেকে দ্বিতীয়) ও মেঘনাদ সাহা (ডানদিকে) |
মেঘনাদ বুঝেছিলেন যে বারবার বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে আসবে না, তাই অন্য দাতাদের দিকেও তিনি দৃষ্টি দেন। ঘনশ্যাম দাস বিড়লার থেকে পাঁচ বছরের জন্য মোট ষাট হাজার টাকা অনুদান পাওয়া যায়। শ্যামাপ্রসাদের অনুরোধে দোরাবজি টাটা ট্রাস্ট পাঁচ বছরের জন্য আরো তিরিশ হাজার টাকা দিতে সম্মত হয়। রায় বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহা দেন পঁতাল্লিশ হাজার টাকা, ডাক্তার বি সি লাহা সতের হাজার পাঁচশ টাকা। শেষ পর্যন্ত মেঘনাদ সাইক্লোট্রন বা তার অনুসঙ্গের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি বা দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে মোট দু'লক্ষ বারো হাজার টাকা পেয়েছিলেন।
বাসন্তীদুলাল সাইক্লোট্রন পাঠানোর সমস্ত ব্যাবস্থা করে দেশে ফেরেন ১৯৪১ সালে। তখন জাপান পার্ল হারবার আক্রমণের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষে যোগ দিয়েছে। কাজেই যথেষ্ট সেই সময় সমুদ্রযাত্রা করতে তিনি যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়েছিলেন সন্দেহ নেই। তিনি বিজ্ঞান কলেজে যোগ দেন সে বছর ১৫ আগস্ট। পঞ্চাশ টন ওজনের তড়িৎচুম্বকটি এবং অন্য যন্ত্রাংশ পরের বছর এসে পৌছায়, কিন্তু হাই ভ্যাকুয়াম পাম্প ও ভাল্ভ যে জাহাজে আসছিল তা জাপানি টর্পেডোর আঘাতে প্রশান্ত মহাসাগরে ডুবে যায়। এই ধাক্কা সামলে ওঠা কঠিন হয়েছিল, কারণ ভারতে সেই রকম সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশ তৈরির মতো কোনো ওয়ার্কশপ ভারতে ছিল না।
কলকাতায় ফিরে বাসন্তীদুলাল স্পেশাল সাইক্লোট্রন অফিসার হিসাবে পাচ্ছিলেন মাসিক ২০০ টাকা, তা বেড়ে সাড়ে তিনশো টাকায় পৌঁছেছিল। যুদ্ধের সময় সেই টাকা দিয়ে কাজ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো চাকরির সুযোগ ছিল না। তাছাড়া তাঁর চাকরি ছিল অস্থায়ী। অথচ তাঁকে ছাড়া সাইক্লোট্রন বসানো অসম্ভব। মেঘনাদ এবার গেলেন শূর এনামেল এন্ড স্ট্যাম্পিং ওয়ার্ক্স কোম্পানির কাছে। ১৯৪৫ সালে তাঁদের থেকে দু'লক্ষ টাকা দানের সুদে বাসন্তীদুলালের জন্য ৫০০ টাকা মাইনের তারিণীচরণ শূর রিডার পদ তৈরি হল।ধীরেন্দ্রনাথ কুন্ডু সাইক্লোট্রনে গবেষক ছাত্র হিসাবে কাজ করছিলেন। মেঘনাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাইক্লোট্রনের ব্যবহার শেখার উদ্দেশ্যে তাঁর জন্য ওহাইয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ব্যবস্থা করেন ও দেড় হাজার ডলার স্কলারশিপ জোগাড় করেন।
বিদেশে প্রায় সর্বত্রই মৌলিক বিজ্ঞানে গবেষণাগার কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। মেঘনাদ চাইছেন সাইক্লোট্রনকে কেন্দ্রে রেখে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের মধ্যেই এক আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করতে। সেজন্য তিনি ইলেকট্রন মাইক্রস্কোপ কেনার অর্থ জোগাড় করেছিলেন এবং তাকে কেন্দ্র করে এক বায়োফিজিক্স ল্যাবরেটরি তৈরি করেছিলেন। এবার মেঘনাদ, সত্যেন্দ্রনাথ ও শিশিরকুমার মিত্র একযোগে গিরিশ বিদ্যারত্ন লেনে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের নতুন ল্যাবরেটরি তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে চার লক্ষ টাকা চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মেঘনাদ সায়েন্স কলেজের মধ্যে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ল্যাবরেটরির বাড়ি তৈরির জন্য ছ'লক্ষ সত্তর হাজার টাকা জোগাড়ে সক্ষম হয়েছিলেন। এর দু'লক্ষ টাকা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়, বাকিটা ভারত সরকার।
মেঘনাদ যে পদ্ধতিতে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন, সেটা লক্ষণীয়। তিনি জানেন যে সাইক্লোট্রন বানানো সহ আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার তৈরি করতে যে বিশাল পরিমাণ টাকা লাগবে, তা একবারে চাইলে দাতারা হাত গুটিয়ে নেবেন। তাই তিনি সাইক্লোট্রন দিয়ে শুরু করেছেন এবং তাঁর পরিকল্পনাকে ভেঙে ভেঙে দেখাচ্ছেন। এতে করে টাকা পাওয়া যাচ্ছে সন্দেহ নেই, কিন্তু দাতারা তাঁর বৃহৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে অন্ধকারে আছেন এবং অবিলম্বে ফল দেখতে ইচ্ছুক। জহরলাল যেহেতু এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁর কাছেও অভিযোগ গিয়েছিল। জহরলালের অনুযোগের উত্তরে মেঘনাদ লিখেছিলেন যে বিদেশেও সাইক্লোট্রন বসাতে তিন বছর সময় লাগে, তাঁরা দু'বছর সময় নেবেন। বাস্তবে অবশ্য এর অনেক গুণ বেশি সময় লেগেছিল। পরবর্তীকালে মেঘনাদ এর জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন। নেহরু বিজ্ঞান গবেষণা দপ্তরের মন্ত্রী কে ডি মালব্য, যিনি আবার মেঘনাদের ছাত্রও ছিলেন, তাঁকে লিখেছিলেন যে অনেকেই মেঘনাদের ইন্সটিটিউটের সাফল্যের সম্ভাবনা সম্পর্কে সন্দিহান।
যুদ্ধের প্রয়োজনে ব্রিটিশ সরকার ভারতে গবেষণাতে টাকা বিনিয়োগ করতে শুরু করেছিল; তৈরি হয়েছিল বোর্ড অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ বা বিএসআইআর, যা আজকের কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের পূর্বসূরী। তার অধিকর্তা হয়েছেন মেঘনাদের পুরানো বন্ধু শান্তিস্বরূপ ভাটনগর। ১৯৪৩ সালে জাহাজডুবির পরে পাম্প তৈরির অন্য ভাটনগর পনের হাজার টাকা মঞ্জুর করেছিলেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্কশপে সে কাজ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৬ সালে বিএসআইআর থেকে পাওয়া গেল এক লক্ষ দশ হাজার টাকা, যার অধিকাংশটাই সাইক্লোট্রনের পিছনে খরচ হবে। সরকারি টাকা নেওয়ার সমস্যা মেঘনাদ অবশ্য খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারবেন।
আরো একটা কথা এখানে মনে রাখা দরকার। মেঘনাদ জানেন যে কলকাতা থেকে বিজ্ঞানের ভারকেন্দ্র সরে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নতুন বাড়ির জন্য অর্থ চেয়ে ১৯ মে ১৯৪৬ এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন যে বম্বে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে আসছে এবং এখনি ব্যবস্থা না নিলে শীগগিরই কলকাতাকে পিছনে ফেলে দেবে। তার ঠিক চারদিন আগে অ্যাটমিক এনার্জি রিসার্চ কমিটির সভা হয়েছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে ভারতের মতো দেশের পক্ষে একাধিক জায়গায় নিউক্লিয় গবেষণা চালানো সম্ভব নয়, সুতরাং এখন থেকে এ বিষয়ে সমস্ত বড় প্রকল্প দেশের একটি কেন্দ্রেই হবে। সেই কেন্দ্র হল বম্বের নব প্রতিষ্ঠিত টাটা ইন্সটিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, সংক্ষেপে টিআইএফআর। কলকাতাতে সাহার ল্যাবরেটরিতে নতুন প্রকল্পের জন্য নয়, তবে চালু প্রকল্পের জন্য বাৎসরিক অনুদান দেওয়া হবে।
হোমি জাহাঙ্গির ভাবা কাজ করছিলেন কেমব্রিজে, মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে তাঁর কাজ বিজ্ঞানী মহলে সাড়া জাগিয়েছে। তিনি ১৯৩৯ সালে ছুটিতে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসেছিলেন, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের জন্য আর ফিরতে না পেরে বাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সে কাজ শুরু করলেন। তাঁর মনে হয়েছে দেশে থেকেই বিদেশের তুলনীয় গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলাটাও বিজ্ঞানীর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। দেশে যদি এক ভালো বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে তিনি আর বিদেশে যাবেন কেন? ১৯৪৫ সালে টাটাদের কাছে তিনি বম্বেতে এক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য প্রস্তাব পাঠালেন, তাঁরাও উৎসাহী। প্রয়োজন বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় ও বম্বে সরকারের সহায়তা। ভাবার পক্ষে তা জোগাড় করা খুব সহজ। নেহরুর সঙ্গে তাঁর পরিবারসূত্রে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কয়েক মাসের মধ্যেই প্রতিষ্ঠা হল টিআইএফআর। সেই ভাবাই কমিটির প্রধান।
মেঘনাদের প্রতিবাদে কোন কাজ হল না। হয়তো জাতীয় রাজনীতিতে বাংলার গুরুত্ব হ্রাস পাওয়াও ছিল সাহার মতকে উপেক্ষার আরও এক কারণ। অন্যদিকে সাইক্লোট্রন কাজ করছে না। সরকারি সাহায্য পাচ্ছেন, কাজেই সাহার উপর চাপ বাড়তে লাগল। ভাবার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়া সত্ত্বেও সাহাকে তাঁর কাছেই আবেদন করতে হচ্ছে, বা সাইক্লোট্রন কেন চলছে না তার ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে। সমস্যা সমাধানের জন্য বাসন্তীদুলাল আবার বার্কলে গেলেন ছ'মাসের জন্য। কিন্তু সুবিধা হল না। ভাবা সাইক্লোট্রনের সমস্যা সমাধানের জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ করার পরামর্শ দেন। সাহা পুরোপুরি একমত হলেন না, তাঁর কাছে মূল সমস্যাটা হল দেশে যন্ত্রাংশ বানানোর মতো কোম্পানির ও লোকের অভাব, এবং একই সঙ্গে বিদেশ থেকে আমদানির সমস্যা।
১৯৪৮ সালে তৈরি হল পরমাণু শক্তি আয়োগ, ভাবা সভাপতি। নেহরুর অনুরোধ ফিরিয়ে দিলেন মেঘনাদ, তিনি এর সদস্য হতে অস্বীকার করলেন। টিআইএফআরের থেকে পৃথক করে জাতীয় পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র তৈরি হবে, ভাবাই হবেন কর্ণধার। সেটা বম্বেতে স্থাপনের কারণ হিসাবে বলা হল ভারতের কোথাও নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যা পড়ানো হয় না, সুতরাং বম্বেতে করলে আলাদা কোনো অসুবিধা নেই। ক্ষোভে ফেটে পড়ে নেহরুকে চিঠি লিখলেন মেঘনাদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাটা সুবিধামতো ভুলে যাওয়া হয়েছে।
সন্দেহ নেই যে সেই সময় একমাত্র কলকাতাতেই নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ভালোভাবে পড়ানো হত, এবং তার পিছনে ছিল সাহার প্রচেষ্টা। কিন্তু স্বাধীনতার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। আগেই বলেছি যে সাহা চিরকালই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে মৌলিক গবেষণার সমর্থক, পরাধীন ভারতে সমস্ত মৌলিক গবেষণাই হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সারা পৃথিবীতেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে বিজ্ঞান গবেষণাতে বিশেষ সরকারি সাহায্য পাওয়া যেত না, সর্বত্রই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও ব্যক্তিগত দানের উপরে অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। সাহা সেই পরিমণ্ডলেরই ফসল। কিন্তু দুটি বিশ্বযুদ্ধ যখন বিজ্ঞানের গুরুত্ব দেখিয়ে দেয়, গবেষণাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পরিমাণ অনেকগুণ বাড়ে। সেখানেই উন্নত দেশগুলির তুলনায় পরাধীন বা নবস্বাধীন ভারতে বিজ্ঞান গবেষণা পিছিয়ে পড়ে। এই সমস্যার সমাধানে স্বাধীন ভারতে নেহরু-ভাবা যে মডেল অনুসরণ করছেন তা হল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিচ্ছিন্ন কতগুলি কেন্দ্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেখানে গবেষণাকে আর্থিক সাহায্য অনেক বেশি দেওয়া সম্ভব। অনেকেই মনে করেন যে বিজ্ঞানে আমাদের দেশের অপেক্ষাকৃত ধীরগতির পিছনে আছে এই মডেল। কিন্তু তার সমর্থনে এ কথা বলা যায় যে সেই সময় সদ্য স্বাধীন এবং দ্বিধাবিভক্ত দেশের পক্ষে গবেষণার জন্য বেশি অর্থ বরাদ্দ করা সম্ভব ছিল না। শিক্ষা বিস্তারের জন্য নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলতেই হবে, তাদের সবাইকে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ মঞ্জুর করতে হলে কেউই বিশেষ কিছু পাবে না। তার থেকে শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও গবেষণা কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ রাখাই হয়তো সেই মুহূর্তে যুক্তিযুক্ত ছিল। দুঃখের বিষয় হল স্বাধীনতার সাত দশক পরে পরিস্থিতির পরিবর্তন হলেও নীতি একই রয়ে গেছে, তবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
সাহা এই মডেলের সমর্থক না হলেও বাস্তবের মাটিতেই পা দিয়ে চলেন। তিনি বুঝলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে আধুনিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ার তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই শেষ পর্যন্ত তাঁর পালিত রিসার্চ ল্যাবরেটরিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স হিসাবে তৈরি করলেন। ইন্সটিটিউটের কেন্দ্রে ছিল সেই সাইক্লোট্রন। সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে একেবারে ছাড়তে চাইছিলেন না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন ইন্সটিটিউটের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান। ১৯৪৮ সালে নতুন ইন্সটিটিউটের বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন শ্যামাপ্রসাদ। ১৯৫০ সালে ১১ জানুয়ারি নতুন ইন্সটিটিউটের দ্বারোদ্ঘাটন করলেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আইরিন জোলিও-কুরি, নেহরু লক্ষণীয়ভাবেই অনুপস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে কোনো স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সেনেটের আপত্তি ছিল, আবারও শ্যামাপ্রসাদের হস্তক্ষেপে জট কাটল।
সাহা আকস্মিকভাবে মারা যান ১৯৫৬ সালে, তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ইন্সটিটিউটের নাম হল সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। মেঘনাদ জীবিত থাকতেই সাহা ইন্সটিটিউটের কার্যকরী অধিকর্তা দায়িত্ব নিয়েছিলেন বাসন্তীদুলাল, ১৯৫৬ থেকে তিনিই ছিলেন পূর্ণ সময়ের অধিকর্তা। তাঁর পরে অধিকর্তা হন ধীরেন্দ্রনাথ কুন্ডু। দুজনেই ছিলেন সাইক্লোট্রন গ্রুপের সদস্য, অর্থাৎ সাইক্লোট্রন দীর্ঘদিনই ইন্সটিটিউটে এক কেন্দ্রীয় স্থান অধিকার করে ছিল। ১৯৫৪ সালে সাইক্লোট্রন থেকে প্রোটন কণার স্রোত পাওয়া যায়। অবশ্য যন্ত্র পুরোপুরি কাজ করতে লেগে গিয়েছিল আরো বারো বছর। কিন্তু ততদিনে তার থেকে মৌলিক গবেষণার সুযোগ প্রায় অন্তর্হিত।
এখানে একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন। নিউক্লিয় বিজ্ঞানের গোড়ার দিকে প্রায় সমস্ত ভারতীয় বিজ্ঞানীই তার প্রাযুক্তিক দিকটাকে অতটা গুরুত্ব দেননি। পরমাণু শক্তি বিল নিয়ে সংবিধান সভাতে যে বক্তৃতাতে নেহরু মেঘনাদের সাইক্লোট্রন তৈরির পরিকল্পনাকে ক্ষুদ্র ও স্থানীয় বলেছিলেন, সেই বিলে ১৯৬৫ সালের মধ্যে এক হাজার মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুতের লক্ষ্য রাখা হয়েছিল। বাস্তবে ১৯৬৬ সালে বিমান দুর্ঘটনাতে ভাবার মৃত্যু পর্যন্ত এক মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎও উৎপাদিত হয়নি। পরমাণু অস্ত্রে ব্যবহার হতে পারে এই আশঙ্কায় উন্নত দেশগুলি থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রযুক্তি হস্তান্তরে অনেক নিয়ম নিষেধ চাপে। তার আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য সাইক্লোট্রন প্রকল্প অনেক পিছিয়ে গিয়েছিল। জাপানি আক্রমণে পাম্প বা ভাল্ভবাহী জাহাজের সলিলসমাধির কথা আগে বলেছি। যুদ্ধের জন্য এমনকি ভালো মানের তামা বা স্টিলেরও দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের পরে মেঘনাদ একাধিকবার বিদেশে গিয়ে সাইক্লোট্রনের জন্য কেনাকাটার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু উন্নত মানের যন্ত্রাংশ বাজার থেকে সরাসরি কেনা আর সম্ভব ছিল না। স্বাধীনতার আগের দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা ও স্বাধীনতার পরের উদ্বাস্তু সমস্যাও রাজ্য সরকার ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষমতাকে সংকুচিত করেছিল।
মেঘনাদ বিশ্বাস করতেন যে সঠিক সমালোচনা করা তাঁর দায়িত্বর মধ্যে পরে, এবং তা তাঁর যুক্তিসঙ্গত দাবির পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। তাই ভাবাকে যে চিঠিতে তিনি তীব্র সমালোচনা করেছেন, সেই চিঠিতেই তাঁর নিজের দাবি পেশ করেছেন, এমন উদাহরণ বিরল নয়। সাহা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে প্রথম লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং লোকসভাতে প্রায়শই প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সমালোচনা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে এর ফলে তাঁদের দুজনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ হবে না, কিন্তু ঠিক তাই হয়েছিল।
সাহা ইন্সটিটিউট এখন সল্ট লেকে নতুন ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়েছে। ইন্সটিটিউটের যে দুটি বাড়ি বানানো হয়েছিল তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তরিত করা হয়েছে। সাইক্লোট্রনটিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি, এক কোণে অন্ধকারে পরে আছে ভারতবর্ষ তথা এশিয়ার প্রথম সাইক্লোট্রন। কলকাতায় অবস্থিত বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানরা আন্তর্জাতিক মানে গবেষণা করে চলেছে, কিন্তু মেঘনাদের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে বিজ্ঞানের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কলকাতা থেকে চলে গেছে বললে বোধহয় ভুল হবে না।
1. Nucleus and the Nation, Robert Anderson, University of Chicago Press
2. Atomic State, Jahnavi Phalkey, Permanent Black
3. Minutes of the Syndicate and Senate of the University of Calcutta
4. মেঘনাদ সাহা, গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়, খোয়াবনামা
প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, উৎসব সংখ্যা, ১৪২৮ (পরিমার্জিত)
No comments:
Post a Comment